তিমি আর মাছ দুটোই তো জলে থাকে, তাহলে তিমি কেন মাছের চেয়ে বড় হয়?
উল্কিদি আগেই বলে দিয়েছিল নানারকমের প্রশ্ন করবে ফল্গুদি, জেনারাল নলেজের প্রশ্ন। তাছাড়া কমন সেন্স যথেষ্ট আছে কিনা, সেটারও পরীক্ষা নেবে। কিন্তু শুধু নিজের নাম আর স্কুলের নামটা একবার জিজ্ঞেস করেই সোজা পরীক্ষা করতে শুরু করবে, এরকমটা ভাবেনি মুড়কি। তবু প্রশ্ন যখন করেছে, উত্তর তো দিতেই হয়।
প্রথম কারণটা হচ্ছে, বলতে থাকে মুড়কি, মাছকে অক্সিজেন নিতে হয় জল থেকে, মানে যেটুকু অক্সিজেন জলের মধ্যে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে, তারই থেকে, ফুলকোর সাহায্যে। তিমি কিন্তু অক্সিজেন নেয় ফুসফুসের সাহায্যে, জলের ঠিক উপরের যে বায়ুস্তর, সেখান থেকে। সেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ জলের মধ্যে যেটুকু পাওয়া যায় তার তুলনায় অনেক বেশি, কোন কোন সময় এমনকি পঞ্চাশ গুণ পর্যন্ত বেশি। যেহেতু অক্সিজেন বেশি পায়, অতএব যে সব খাবারদাবার তিমি খায়, তার থেকে তার পুষ্টি বেশি হয়, সে বড় হয়।
মানে, তুই বলছিস, একটা মাছকে যদি এমন সুযোগ দেওয়া যেত যে সে জলের গভীর থেকে না নিয়ে জলের ঠিক ওপরের বায়ুস্তর থেকে অক্সিজেন নেবে, তাহলে সে তিমির মতই বড় হতে পারত?
একটু থমকে যায় মুড়কি, তারপর হেসে বলে, এটা তুমি ঠিকই বলেছ ফল্গুদি, একটা মাছকে যদি তিমি হবার সুযোগ দেওয়া যেত, সে তিমির মতই বড় হতে পারত। কিন্তু একটু যে দেরি হয়ে গেছে! মাছকে তুমি যেখানেই রাখ না কেন, তাকে এখন ফুলকো দিয়েই অক্সিজেন নিতে হবে, তার তো আর ফুসফুস গজাবে না। আমি ঠিক ঠিক জানি না, কিন্তু আমার মনে হয়, তিমির মতো ফুসফুসওয়ালা প্রাণীর হৃৎপিণ্ড থেকে অক্সিজেন-মুক্ত রক্ত যায় ফুসফুসে, সেখানে সেই রক্তে অক্সিজেনের যোগ হয়, তারপর অক্সিজেন-যুক্ত সেই রক্ত ফিরে যায় হৃৎপিণ্ডে, আর হৃৎপিণ্ড তারপর হাই প্রেশারে সেই রক্ত পাঠায় শরীরের সব জায়গায়। হাই প্রেশার তো, কাজেই রক্তটা পৌঁছতে পারে অনেক দূর পর্যন্ত, আর সেই সুযোগে এই প্রাণীর শরীরটাও হতে পারে বেশ বড়সড়, লম্বা-চওড়া। কিন্তু মাছের ক্ষেত্রে যেহেতু ফুলকোই সব, ফুলকোই রক্তে অক্সিজেন মিশিয়ে পাঠায় গোটা শরীরে অপেক্ষাকৃত কম প্রেশারে, অতএব সে রক্ত বেশি দূর পৌঁছোতে পারে না, মাছ তাই তার ছোট শরীর নিয়েই খুশি থাকতে বাধ্য হয়।
এই যে তুই বলছিস তুই ঠিক ঠিক জানিস না, এ রকমটা তোর আন্দাজ, তো আন্দাজটা করলি কী করে? আন্দাজের তো একটা বেসিস থাকবে। তোর আন্দাজের বেসিসটা কী?
ডাক্তার কাকাকে তো তুমি চেনো না, আমার বাবার বন্ধু। যখনই কাজ থাকে না, ডাক্তার কাকার চেম্বারে চলে যাই। দৈ-সন্দেশ আর হট চকলেট খেতে খেতে নানারকমের গল্প শুনি। বড়রা তো সবাই ছোটদের সব ব্যাপারে কথা বলা অপছন্দ করে, কিন্তু ডাক্তার কাকা আমাকে সব ব্যাপারে কথা বলার একটা টেকনিক শিখিয়ে দিয়েছে। বলেছে, পৃথিবীতে তুই যে সব কিছুই জানবি, এর কোন মানে নেই। এত কিছু জানার আছে যে দিন দিন বুঝতে পারবি প্রায় কিছুই জানা হল না। কিন্তু জানা হল না বলে বসে থাকা তো চলবে না, তোকে জানতে হবে। আর পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্যে তোকে সব রকমের আড্ডায় পার্টিসিপেট করতে হবে। জেনে রাখিস, পৃথিবীটা আসলে চলে যুক্তির ভিত্তিতে, লজিক। যে কোন ব্যাপারে তোর যেটা মনে হবে লজিকাল, দেখবি সেটা প্রায়ই সত্যি। সব সময় যে সত্যি হবে তার কোন মানে নেই, কিন্তু সত্যি যখন হবে না, তখন দেখবি, আসলে কয়েকটা ঘটনা – মানে আমরা যাকে ফ্যাক্ট বলি – তোর জানা ছিল না। ঠিকঠাক ঘটনার সঙ্গে ঠিকঠাক লজিক, সব সত্যের এটাই ঠিকানা! তাই আমি চেষ্টা করি, সব ব্যাপারেই যতটুকু জানি সেটাকে লজিকালি ভাবতে। কিছুদিন আগে ডাক্তার কাকার সঙ্গে মানুষের রক্ত সংবহন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তাতে যেটুকু শিখেছিলাম, মনে হলো মোটামুটি সব স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রেই সেটা হয়তো প্রযোজ্য হবে। সেটাই তোমাকে বললুম।
বাঃ, তোকে তো এখন থেকে শ্রীমতি লজিক বলে ডাকা চলতে পারে। আচ্ছা বেশ, একটা কাগজে তোকে কিছু লিখে দিচ্ছি, দেখ্ তো পড়তে পারিস কিনা।
টেবিলের ওপর খোলা প্যাডটায় খসখস করে কিছু একটা লিখে, কাগজটা ছিঁড়ে মুড়কিকে দেয় ফল্গু।
কাগজটার দিকে তাকায় মুড়কি, চার লাইনে কতকগুলো সংখ্যা লেখা:
৪১১১৪৫৪১৫১৬২
৫৩৫৩৫৫০২৬২৫১৩২৬৪৬৩১১৬২২৩১১৬২৪১৬৫৫৩
৬৪৩১৪১৬২১১২৩
৫৫৩১৫৫৩১৪১৪৫৫৫৬৪৬৩১৩৫৩
সংখ্যাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুড়কি বলে, ক্লাশ নাইনে পড়ি, তুমি নিশ্চয়ই 'কথায় লেখ, অঙ্কে লেখ'র পরীক্ষা নিচ্ছ না, কতক্ষণ সময় দেবে?
আধ ঘন্টা।
ঠিক আছে, তোমার প্যাডের থেকে একটা কাগজ আমাকে দেবে, আর একটা পেনসিল?
উল্কি এতক্ষণ ধরে কোণের দিকের টেবিল-চেয়ারটায় বসে এক মনে মোর্স কোড প্র্যাকটিশ করছিল, এবার মনে হল কৌতূহল আর ধরে রাখতে পারছে না। উঠে এসে একবার মুড়কির পেছনে দাঁড়িয়ে ওর কাগজটায় উঁকি দিয়ে দেখল। পেনসিলটা দিয়ে কোন কোন সংখ্যার নীচে ছোট ছোট দাগ দিচ্ছে মুড়কি, পেছনে উল্কি দাঁড়িয়ে আছে টের পেয়ে একটু পেছন ফিরে হেসে আবার নিজের কাজে মন দিল। উল্কি কোন কথা না বলে ফিরে গেল নিজের টেবিলে, তারপর একটা ফাইল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার একটা ম্যাপ বের করে খুব যেন মন দিয়ে দেখছে এ ভাবে তাকিয়ে রইল সেটার দিকে।
থ্যাঙ্ক য়্যু ফল্গুদি, বাবা-মার দায়িত্বটা আমিই নিচ্ছি, হঠাৎ মুড়কির গলা শোনা যায়, কিন্তু স্কুলের ব্যাপারটায় তোমাকেই হেল্প করতে হবে।
হেল্প করতে হবে মানে? লেখাটা পড় তো আগে, শুনি।
এবার উল্কিও এগিয়ে এসে দাঁড়ায় মুড়কির সামনে, লেখাটা পড় না।
ধীরে ধীরে টেনে টেনে পড়তে শুরু করে মুড়কি:
প্রথম লাইন – তোকে নিতে পারি
দ্বিতীয় লাইন – বাবা মা আর পাঠশালাকে রাজি করাতে হবে
পরের লাইন – সেটা তোর কাজ
আর তার পর – মোটামুটি তিন মাস লাগবে।
কিভাবে বুঝলি? – এবার উত্তেজিত গলা উল্কির।
চারটে লাইনের এতগুলো সংখ্যা দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলাম। তারপর শেষ লাইনে ৫৫৩১৫৫৩১ সংখ্যাগুলো দেখে কেমন একটা ক্লু পেলাম মনে হলো। সংখ্যাগুলো কী জোড়ায় জোড়ায়? তারপর গুনে গুনে প্রতিটা লাইনের মোট সংখ্যাগুলো লিখলাম, এই দেখো না প্রথম লাইনে বারটা, তারপর চৌত্রিশটা, তারপর আবার বারটা, আর শেষের লাইনে বাইশটা – বার চৌত্রিশ বার বাইশ – সবগুলোই জোর সংখ্যা! কাগজটায় লাইনগুলোর শেষে ওর হাতে লেখা নোটটা দেখায় মুড়কি।
জোড় সংখ্যাগুলো দেখে মনে হল বোধ হয় ঠিকই ভেবেছি, তা না হলে অন্তত একটা লাইনের মোট সংখ্যা বিজোড় হওয়া উচিত ছিল। আচ্ছা, সংখ্যাগুলো যদি সত্যিই জোড়ায় জোড়ায় থাকে, তাহলে তার মানে কী? তার মানে প্রতি দুটো সংখ্যা মিলে কিছু একটা বলতে চাইছে, জোড়াগুলোর বাঁ দিক বা ডান দিকের সংখ্যাগুলোর আলাদা করে কোন মানে নেই। এবার নিজের কাগজটা আবার দেখায় মুড়কি, এই দেখ না, তখন আমি প্রতিটা জোড়ার বাঁ দিকের সংখ্যাগুলোর তলায় একটা করে, আর ডান দিকের সংখ্যাগুলোর তলায় দুটো করে ছোট ছোট দাগ দিতে শুরু করলাম। এই সময় উল্কিদি এসে পেছনে দাঁড়ালো আমার, সরি উল্কিদি, তোমার সঙ্গে কথা বলিনি তখন, আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা।
তো, ঐ যে দাগ দিলাম সংখ্যাগুলোর তলায়, তখন একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করলাম। ডান দিকের সংখ্যাগুলোয়, মানে যেগুলোর তলায় আমি দুটো করে দাগ দিয়েছিলাম, সেগুলোর মধ্যে পাঁচের চেয়ে বড় কোন সংখ্যা নেই। পাঁচ, পাঁচ, পাঁচ। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার ব্যঞ্জনবর্ণের কথা মনে পড়লো। ক খ গ ঘ ঙ। চ ছ জ ঝ ঞ। সব পাঁচটা করে। তাহলে কি বাঁ দিকের সংখ্যাগুলো, যেগুলোর তলায় আমি একটা করে দাগ দিয়েছিলাম, সেগুলোর ১ মানে প্রথম লাইন, মানে ক-এর লাইন, ক বর্গ; ২ মানে দ্বিতীয় লাইন, মানে চ বর্গ, এই রকম? তার মানে ৪১ মানে চতুর্থ লাইনের প্রথম অক্ষর? ত? ৫৫ মানে পঞ্চম লাইনের পঞ্চম অক্ষর? ম? এবার পড়ি তো। তাহলে প্রথম লাইনটা হচ্ছে তক নত পর। তক নত পর, তক নত পর, তক নত পর। মানে? তোকে নিতে পারি? অর্থাৎ স্বরের উচ্চারণের চিহ্ণগুলো আর যুক্তাক্ষর বাদ দিয়ে, যথাসম্ভব সরল বাংলা বাক্য শুধু সংখ্যা দিয়ে লেখ, আর প্রসঙ্গ অনুযায়ী সেটার মানে বুঝে নাও! তাই স্কুলের বদলে পঠশল! মানে পাঠশালা? বাঃ ভালো তো।
আর একটা জিনিষ আমি লক্ষ্য করলুম, জানো ফল্গুদি? তুমি যে মোট বার আর চৌত্রিশ – ছেচল্লিশ; তার সাথে বার – আটান্ন; আর বাইশ – আশিটা সংখ্যা দিয়েছিলে, তার মধ্যে আমি একটাই শূন্য পেলাম, আর সেই শূন্যটা জোড়ার বাঁ দিকের সংখ্যা। শূন্যর মানে কী হবে? ক থেকে তো প্রথম লাইনের শুরু, ১১ মানে তাই ক, ১২ মানে খ, ১৩ মানে গ, এইরকম;
তাহলে কি শূন্য দিয়ে স্বরবর্ণের শুরু, শূন্য আর এক মানে অ, শূন্য আর দুই মানে আ, এইরকম? মিলিয়ে দেখলাম, ঠিক!
তোমার দ্বিতীয় লাইনটা হলো বব ম আর পঠশলক রজ করত হব, অর্থাৎ বাবা মা আর পাঠশালাকে, মানে স্কুলকে, রাজি করাতে হবে!
এই পর্যন্ত শুনে ফল্গু দৌড়ে চলে আসে মুড়কির কাছে, তার চুলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মুঠো ভর্তি চুল নিয়ে ধীরে ধীরে নাড়তে নাড়তে বলে, শ্রীমতি লজিক নামটা তোর সার্থক রে মুড়কি, তোকে তো নিতেই হবে! লর্ডসে সৌরভ সেঞ্চুরী করার পর সম্বরণ ব্যানার্জীর মতো মুখ করে উল্কি বলে, তোমাকে বলেছিলাম না ফল্গুদি!
বিপন্ন মুখ করে মুড়কি বলে, কিন্তু স্কুলকে ম্যানেজ করা যাবে কীভাবে ফল্গুদি, তিন মাসের ব্যাপার!
সেটার ব্যবস্থা হচ্ছে, মুড়কির কথা প্রায় শেষ না করতে দিয়েই বলে ওঠে উল্কি, কিন্তু তোর ব্যাখ্যা তো এখনো অসম্পূর্ণই থেকে গেল। স্বরবর্ণের বারটা বর্ণকে দু অঙ্কের সংখ্যায় রাখবি কী করে? ঐ, ও আর ঔ তো ০১০, ০১১ আর ০১২ হয়ে যাবে।
সে আমার ভাবা হয়ে গেছে উল্কিদি, আমাদের উদ্দেশ্য তো সরলতম কায়দায় বাংলা ভাষায় খবর পাঠানো, বানান-টানান তো খুব একটা ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার নয়! কাজেই স্বচ্ছন্দেই আমরা দীর্ঘ ঈ, দীর্ঘ ঊ, ঋ আর ৯ বাদ দিতে পারি, তাহলে মোট স্বরবর্ণের সংখ্যা দাঁড়াবে আট। একই কায়দায় ব্যঞ্জনবর্ণে শুধু তালব্য শ রাখব, দন্ত্য স-মূর্ধন্য ষ বাদ, যেমন বাদ ড় আর ঢ় – কনফিডেন্স যেন ঝরে ঝরে পড়ে মুড়কির গলায়!
ব্যস ব্যস, এনাফ – ফল্গুদির গলা শোনা যায় – ফ্যাক্ট আর লজিক মিলিয়ে ডাক্তার কাকার ভাইঝি এখন অতি সহজে সত্য আবিষ্কার করতে করতে সত্যবতী হয়ে গেছে, তফাৎ শুধু একটাই, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যবতী ব্যোমকেশের বৌ ছিলো, আর আমাদের পরের অভিযানে সত্যবতী মুড়কিই ব্যোমকেশ।