ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারে ফিরে আসতেই অ্যালেহান্ড্রো শ্যাভেজের মুখোমুখি ওদের বসিয়ে দিয়ে পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে গেলেন মহিলা নিজেও। নিজেদের নাম ওরা মহিলাকে বলেছে আগেই, কিন্তু মহিলার নাম জানা হয়নি। এবার কথোপকথনে নাম বোঝা গেলো মহিলার, কামিলা। কামিলা সম্ভবত আগেই ওদের ব্যাপারে কথা বলেছে, এবার বলল, দেখুন অ্যালেক্স, মহাবীর আলেকজাণ্ডারের নামে আপনার নাম, আপনি মানুষের রক্ষক তো বটেই, পেরুর জঙ্গল যাতে ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকে সে দায়িত্বও আপনার। আমার এই বন্ধুরা সেই কতদূর ইণ্ডিয়া থেকে এসেছে আপনার জঙ্গলে কাজ করবে বলে, ওদের একটা ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতেই হবে।
অ্যালেক্স হেসে বললেন, সে তো বুঝলাম, কিন্তু যে নিয়ম আমি নিজেই তৈরি করেছি তা ভাঙব কিভাবে? ভলান্টিয়ার হয়ে আমাদের জঙ্গলে কাজ করে যারা, তাদের প্ল্যানিং রিসার্চ এবং থাকার সেন্টার যেখানে, সেখানে আঠেরো বছর বয়েস না হলে ঢোকারই অনুমতি পাওয়া যায় না, আমাদের কনিষ্ঠতম বন্ধুকে এখানে তোমার কাছে রেখে ওর দিদিরা কি যেতে রাজি হবে?
দিদিদের বলার জন্যে অপেক্ষা না করেই মুড়কি বললো, রাজি হওয়াই উচিত, এতদূর এসে একজনের জন্যে অন্যদের কাজও হবে না – এর কোন মানে হয়না।
ঈষৎ হেসে মুড়কির দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন অ্যালেহান্ড্রো শ্যাভেজ, আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কথার কথা। ধর, একদিনের জন্যে অনুমতি শেষ পর্যন্ত পাওয়াই গেল জঙ্গলে যাবার, সে ক্ষেত্রে কী তুমি করতে চাও? মানে সেই দিনটা কাজে লাগাবে কীভাবে? বলেই উল্কির দিকে তাকিয়ে বললেন, এ প্রশ্নটা আমি শুধু মুড়কিকেই করছি, আর কেউ উত্তর দেবে না।
একটুও না ভেবে বললো মুড়কি, অ্যাণ্ডিয়ান-কক-অব-দ্য-রক এর খোঁজ-খবর নেবার চেষ্টা করব।
অ্যাণ্ডিয়ান-কক-অব-দ্য-রক? কী জানো তুমি ওদের সম্বন্ধে?
সাইজে প্রায় এক ফুটের মতো। বড়োসড়ো হলেও খুব লাজুক পাখি, আপন মনে একা-একা ঘুরে বেড়ায়, সাধারণত দেখা দেয় না। পুরুষদের পালকের রঙ প্রধানত নীচের দিকে কালো আর ওপরের দিকে সোনালী-গেরুয়া, চোখে পড়ার মতো একটা বিরাট ঝুঁটি থাকে মাথায়, গায়ে সূর্যের আলো পড়লে বহু দূর থেকেও ঝকঝকে লালচে সোনালী পাখিটাকে দেখতে পাওয়া যায়। এরা রুপিক্যুলা বর্গের পাখি, এই বর্গের অন্য পাখিটার নাম গায়ানান কক-অব-দ্য-রক, প্রায় একই রকমের দেখতে। অতি সুন্দর অ্যাণ্ডিয়ান-কক-অব-দ্য-রক মূলত পেরুর পাখি, পেরুর জাতীয় পাখির মর্যাদা এদের। গায়ানান যারা, গায়ানা ছাড়াও তাদের পাওয়া যায় সুরিনাম, ভেনিজুয়েলা, কলাম্বিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার আরও দুয়েকটা জায়গায়।
তবে একটা কথা কিন্তু মানতে হবে, একটু দম নিয়ে বলে মুড়কি। পুরুষগুলো এত সুন্দর হলেও এদের মেয়েরা কিন্তু সেই তুলনায় কিছুই নয়। পাটকিলে-বাদামী রঙে ছিটেফোঁটা কমলা, সাইজে পুরুষের চেয়ে ছোট, ঝুঁটিটাও অনেক ছোট, পুরুষের তুলনায় প্রায় নেই-বললেই-হয়! ডিম পাড়ে দুটো করে, আর পাথুরে পাহাড়ের মসৃণ ঢালের খাঁজে তৈরি করে বাসা, সেই জন্যেই কক-অব-দ্য-রক। বাচ্চাগুলো একটু ওড়ার মতো হলেই বাসা ছেড়ে মা যায় পালিয়ে।
এই পর্যন্ত বলার পর একটু থামে মুড়কি। শ্যাভেজকে জিজ্ঞেস করে, আমাদের দেশের রামায়ণ-মহাভারতের গল্প জানেন আপনি?
কী করে আর জানব, বলেন শ্যাভেজ, আমরা বড় হয়েছি স্প্যানিশদের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে। একটু-আধটু বাইবেলের গল্প জানি, আর গ্রীক পুরাণের।
রামায়ণ-মহাভারতে রাজার মেয়েদের বিয়ে হতো স্বয়ন্বর সভা ডেকে, বলে মুড়কি। অনেক রাজপুত্র আসতো সেজেগুজে, তাদের বিদ্যে বুদ্ধি বীরত্ব আর নানান প্রতিভার কথা বলে রাজকন্যেদের মন জয় করার চেষ্টা করতো। সবার চাইতে যাকে মনে ধরতো, তারই গলায় মালা দিত রাজকন্যে। এই পাখিদেরও ঠিক এরকম স্বয়ম্বর হয়। ডিম পাড়ার সময় এলে অনেক পুরুষ পাখি এসে জোটে এক জায়গায়। মেয়ে-পাখিরা একটু দূর থেকে লক্ষ্য করে তাদের। তাদের গলার নানারকমের শব্দ আর শরীরের নানা কসরৎ দেখে মেয়েরা খুশি হলে তখন তারা নিজের নিজের সঙ্গী বেছে নেয়।
আর একটা কথা বলি, বলে মুড়কি, ডারউইনের চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট কিন্তু তাঁরই সমসাময়িক বিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড ওয়ালেস তাঁর দক্ষিণ আমেরিকা অভিযানের সময় গায়ানান কক-অব-দ্য-রক দেখে মুগ্ধ হয়ে কয়েকটা পাখিকে স্টাফ করে বিলেতে তাঁর এজেন্টের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেগুলো শুধু যে প্রচুর দামে বিক্রী হয়েছিল তা-ই নয়, নানা প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়ে সৌন্দর্যের জন্যে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিল তারা। তাতে অবিশ্যি অ্যাণ্ডিয়ান কক-অব-দ্য-রক এর সম্মান কিছু কমলো না। প্রজাতি হিসেবে সামান্য হেরফের থাকা সত্ত্বেও গায়ানান আর অ্যাণ্ডিয়ান কক-অব-দ্য-রক দেখতে প্রায় একই, স্বভাবও!
হৈ হৈ করে ওঠেন শ্যাভেজ, তুমি এত জান? এত পড়াশোনা করে এসেছ? এমনকি ওয়ালেসের ব্যাপারটাও জানো দেখছি। নাঃ, তোমাদের বিফলমনোরথ করে ফেরত পাঠালে আমার পাপ হবে।
এতক্ষণ অবাক হয়ে মুড়কির কথা শুনছিল কামিলা। এবার শ্যাভেজকে বলে সে, তাহলে আর পাপটা করবেন কেন, ব্যবস্থা একটা করে দিন ওদের।
ক' রাত্তির না ঘুমিয়ে কাটাতে পারবে? – শ্যাভেজ জিজ্ঞাসা করেন, এবার শুধু মুড়কিকেই নয়, ওদের সবাইকেই এক সঙ্গে।
সবায়ের হয়ে জবাবটা দেয় ফল্গু, দুয়েক রাত্তিরে অসুবিধে হবে না।
দুই না এক?
দুই-ই ধরুন।
তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট যে – মুড়কি – সে বলেছে মাত্র এক দিনের জন্যে যদি জঙ্গলে যাওয়ার অনুমতি পায় তাহলে অ্যাণ্ডিয়ান কক-অব-দ্য-রক দেখার চেষ্টা করবে, তোমরা কি ওর সঙ্গে একমত?
উল্কি আর ফল্গু বলে একই সঙ্গে, হ্যাঁ, একমত।
শোন তবে আমার কী প্ল্যান। আমাদের যেতে হবে আজ রাতেই, নৌকোয়। রাজি?
নিশ্চয়ই রাজি।
তাহলে শোন। চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগবে নৌকোয় পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রজেক্টে পৌঁছোতে। আজ সারাদিন তোমাদের আউটডোর অ্যাক্টিভিটিতে কেটেছে। একটুখানি অন্তত ঘুম তোমাদের দরকার। কামিলাকে আমি অনুরোধ করব এখ্খুনি ওর অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গিয়ে তোমাদের ঘুমের ব্যবস্থা করতে। খাওয়া-দাওয়ার দরকার নেই। আমরা রাত এগারোটায় নৌকোয় চাপবো, নৌকোতেই তোমাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। ওখানে পৌঁছিয়ে প্রজেক্টের ভেতরে আমরা ঢুকব না। যে নৌকোয় চড়ে আমরা যাব জঙ্গলে, সেটা যে নদী দিয়ে যাবে, তাতে মাইল তিরিশেক অন্তর একটা করে ওয়াচ-টাওয়ার বসানো আছে জঙ্গলে নজরদারি করার জন্যে। আমি ওয়াকি-টকিতে সবচেয়ে কাছাকাছি টাওয়ারে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, সেখান থেকে কয়েকটা টাওয়ার হয়ে খবরটা প্রজেক্টে পৌঁছিয়ে যাবে। তিনটে-সাড়ে তিনটের মধ্যে আমরা ওপারে পৌঁছোবো। আমার লোকজনরা তৈরি হয়ে প্রজেক্টের বাইরেই আমাদের সঙ্গে দেখা করবে। তোমাদের কপাল ভালো, কক-অব-দ্য-রক এর লেকিং অ্যাক্টিভিটি এ বছর শুরু হয়ে গেছে, সূর্য ওঠার আগেই যদি একটা স্যুটেব্ল্ লেকিং-সাইটে আমরা পৌঁছোতে পারি, তাহলে তোমাদের আশা সম্ভবত পূরণ হবে।
কামিলা বললো, লেকিং-সাইট বুঝলে তো?
এবার হেসে ফেলে মুড়কি, আমি এতক্ষণ ধরে শ্যাভেজ স্যরের কাছে যে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলুম তাতে কি সন্দেহ আছে আমরা লেকিং সাইট কাকে বলে জানি কিনা? প্রথমেই তো বলেছি কক-অব-দ্য-রক খুব লাজুক পাখি, একা-একা নিজের মনে ঘুরে বেড়ায়, কাজেই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একসঙ্গে ওদের পাওয়া যায় স্বয়ম্বর সভায়, যেটাকে বলা হচ্ছে
লেকিং-সাইট। কিন্তু আসলে যেটা বুঝলুম না সেটা হচ্ছে সূর্য ওঠার আগেই কেন পৌঁছোতে হবে।
খানিকটা কৈফিয়ত দেবার গলায় কামিলা বলে, আমি ভাবলাম তোমরা হয়তো ইণ্ডিয়ান ভাষায় পড়াশোনা করে এসেছ, কে জানে লেকিং-সাইট বুঝবে কিনা!
কথা আর বাড়তে না দিয়ে শ্যাভেজ বললেন, ঠিক সূর্যোদয়ের সময়েই কক-অব-দ্য-রক সবচেয়ে সুন্দর দেখতে লাগে, ওদের ওই লালচে সোনালী রঙে সূর্যোদয়ের আলো যখন এসে পড়ে তখন তার যে কী রূপ হয় তা বলে বোঝান যাবে না। কিন্তু কামিলা, তুমি ওদের শোবার ব্যবস্থাটা যত তাড়াতাড়ি পার করে দাও, আমি এদিকে আমার কাজগুলো সারি।
এই পর্যন্ত বলার পর – যেন বলতে ভুলে গিয়েছিলেন এখন নিজেকে শুধরে নিচ্ছেন এই ভঙ্গিতে – শ্যাভেজ বলেন, মনে রেখ, তোমাদের জামাকাপড় যেন একটুও চকচকে-ঝকঝকে না হয়, নিজেরা যতই উজ্জ্বল রঙের হোক, নিজের শরীরের বাইরে উজ্জ্বল রঙ পছন্দ করে না কক-অব-দ্য-রক, সম্ভবত ভয়ই করে, বেশি উজ্জ্বল রঙ দেখলে ওদের পালিয়ে যাবার সম্ভাবনা। আর একটা কথা, ক্যামেরা-বাইনোকুলার নিশ্চয়ই নেবে, কিন্তু ফ্ল্যাশ চলবে না। ওটাও আমাদের পাখির বড়ই অপছন্দ!
বিছানায় শুয়েও কিন্তু ঘুম এল না ওদের, বিশেষ করে কামিলাও ওদের সঙ্গে গল্পে জমে গেলেন। কথায় কথায় বাটারফ্লাই ফার্মে আজ বেড়ানোর কথাটাও উঠলো, তার সঙ্গে চিত্রগুপ্ত্ বর্মার কথা। কামিলা চিত্রগুপ্ত্ বর্মার নাম শুনেছেন। শুনেছেন উনি খুব বড় বিজ্ঞানী, ভারতীয় বংশোদ্ভব। একটা প্রজাপতি যে উনি আবিষ্কার করেছেন, আর সেই প্রজাপতির নামের সঙ্গে ওঁর নামও যে জুড়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা, সে খবরও কামিলা রাখেন। মুড়কি আর উল্কি লক্ষ্য করলো বর্মার সঙ্গে বাংলায় কথোপকথন আর স্ন্যাক-বারের ছেলেটার বাংলায় কথা বেলার ব্যাপারটা ফল্গু চেপে গেল। চেপে গেল ওরাও।