এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • অন্য দেশের পাখি - ১৩

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | ১৭৫ বার পঠিত
  • ছবি: রমিত
    ১৩


    গাড়িতে বসে প্রথম কথা বললো ফল্গু, আপনাকে একটা কথা আগে জানাইনি কিন্তু এখনই জানিয়ে রাখতে চাই।

    কী কথা? – জিজ্ঞেস করেন শ্যাভেজ।

    আপনি আন্দাজ করেছেন কিনা জানিনা, আমরা কিন্তু ঠিক আর পাঁচজন সাধারণ ট্যুরিস্টের মতো এখানে বেড়াতে আসিনি, আমাদের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।

    কী উদ্দেশ্য?

    সেটা আপনাকে না বলার আর কোন মানে হয় না, এখন হয়তো আপনার কাছ থেকে আমাদের অনেক সাহায্য নিতে হবে। আর সত্যি কথা হল, আমাদের যা উদ্দেশ্য তার সঙ্গে আপনার কাজের কোন সংঘাত তো নেইই, বরঞ্চ একটা আর একটার পরিপূরক বলতে পারেন। যাঁর নির্দেশে কাজটা আমরা করতে এসেছি, তাঁর পরামর্শ ছিল আমরা যেন আমাদের উদ্দেশ্য যতটা পারি গোপন রাখি, এটা নিয়ে কোন হৈ চৈ যেন না হয়, তাই প্রথম আলাপেই আপনাদের জানাইনি ব্যাপারটা।

    হুঁ হুঁ – নিজের কৌতূহল যথাসম্ভব সংযত রাখেন শ্যাভেজ।

    আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, বলতে থাকে ফল্গু, কিছুদিন ধরে আপনাদের জঙ্গলে পুরুষ কক অব দ্য রকের সংখ্যা কমছে; খুব গোপনে কিন্তু সম্ভবত খুব নিয়মিত, চুরি করা হচ্ছে তাদের।

    জানি তো বটেই, বলেন শ্যাভেজ, এবং এ-ও জানি যে এটা জানাটাও আমার কাজের একটা অঙ্গাঙ্গী অংশ, কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে?

    ফল্গু বলে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজ যাঁরা করেন তাঁদের একটা সংস্থা এ ব্যাপারে আমাদের কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। তাঁদেরই ইচ্ছে অনুযায়ী কাজটা যতদূর সম্ভব চুপচাপ করার চেষ্টা করছি, কাউকে জানাইনি। তাছাড়া, সরকারী লোকজনদের আমি এমনিতেই এড়িয়ে চলি। সরকারী কাজে এতরকমের নিয়ম এবং পদ্ধতি, যে প্রায়ই সেগুলো মেনে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আসল কাজটাই নিয়ম আর পদ্ধতির বেড়াজালে ঘুরপাক খেতে থাকে, এগোয় না। এ ছাড়াও আরও একটা কথা আছে, আপনি যদি অনুমতি দেন এবং কিছু মনে না করেন তো বলি।

    মনে আর করবটা কী, বলেন শ্যাভেজ, আপনি ক্রিমিনাল-ইনসাইডার নেক্সাসের কথা বলবেন তো? হোলি অ্যালায়েন্স? আমাদের লোকরাই যেখানে অপরাধীর সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং সহায়ক?

    আপনি তো বলেই দিলেন, বলে ফল্গু, এই সব কারণেই আমরা মুখ খুলতে চাই না, কাউকে বলতেও চাই না আমাদের আসল উদ্দেশ্যটা কী। কিন্তু এখন এমন একটা অবস্থায় এসে পড়লুম, বুঝতে পারছি না কী করব।

    গাড়িটা ততক্ষণে এসে পৌঁছেছে ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন অফিসের সামনে, যেটা কামিলার বাসস্থানও। কামিলা বোধ হয় নজর রাখছিল, বাইরে বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনা করে অফিসের ভেতরে নিয়ে গেল ওদের, সেখানে আগে থেকেই বসেছিল উল্কিও। উল্কিকে এখন মোটামুটি সুস্থই দেখাচ্ছে, মুড়কি ছাড়া ওদের দুজনকে ঢুকতে দেখে ওর বিশেষ ভাবপরিবর্তন না হওয়ায় বোঝা গেল মুড়কির অপহরণের ব্যাপারটা ও কামিলার কাছ থেকে আগেই শুনেছে।

    এতক্ষণ ওদের মধ্যে কী আলোচনা হচ্ছিল সে বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে শ্যাভেজ ফল্গুর সঙ্গে চলতে থাকা আগের আলোচনারই জের টেনে বললেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে আপনারা আমাদের বিদেশী অতিথি, যে মুহূর্তে আপনাদের আমরা ছাড়পত্র দিই আমাদের দেশে আসবার, সেই মুহূর্তেই আপনাদের সুরক্ষার ব্যাপারে আমাদের একটা দায়িত্ব বর্তায়। আপনাদের কনিষ্ঠতম সভ্যটির হঠাৎ-অন্তর্ধানের ঘটনাটা যদি স্থানীয় প্রশাসকদের না জানানো হয় তাহলে আমাদের – মানে কামিলার আর আমার – পক্ষে তা কর্তব্যহানি, বড়ো কিছু ঘটলে আমরা আমাদের দায় অস্বীকার করতে পারব না।

    এক ঝলক উল্কির দিকে তাকিয়ে ফল্গু বলে, নিজেদের সান্ত্বনা দেবার জন্যে বলছি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, বড়ো-কিছু যে ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আপনারা করছেন তা অমূলক। যে বা যারা মুড়কিকে চুরি করেছে, মুড়কির ক্ষতি করা তাদের উদ্দেশ্য নয়, তারা আমাদের ভয় পাওয়াতে চাইছে। ভয় পেয়ে এই অনুসন্ধানের কাজ ছাড়াতে চাইছে। ছেড়ে, এ-দেশ থেকে পালিয়ে নিজের দেশে ফেরাতে চাইছে। যে মুহূর্তে স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে একটুও নড়াচড়া করবে সেই মুহূর্তেই ওরা বুঝতে পারবে ভয় আমরা ঠিকই পেয়েছি, ভয় পেয়েই পুলিশকে জানিয়েছি ঘটনাটা, কিন্তু সেটা মেনে নেবার মতো সাহস আমরা দেখাতে পারছি না। তাই, এ-দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছি না। তখন ওদের উপায় থাকবে না 'বড়ো-কিছু'টা ঘটানো ছাড়া।

    এবার কথা বলে কামিলা, দেখুন আপনাদের দেখে ভালো লেগেছিল, তাই ট্যুরিজ্‌ম্‌ প্রোমোশনের উদ্দেশ্যটা মাথায় রেখে একটু সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, আপনাদের উদ্দেশ্যটা তখন আমাদের, মানে অ্যালেক্সের বা আমার, জানা ছিল না। কিন্তু সেটা অন্য কথা। নিজেদের উদ্দেশ্য আমাদের জানতে না দিয়েও আমাদেরই সাহায্যে আপনাদের যেটা প্রধান উদ্দেশ্য তার প্রাথমিক ধাপটা – অর্থাৎ লেকিং সাইটে গিয়ে কক অব দ্য রককে দেখে তাদের সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি করার কাজটা – যেভাবে আপনারা করলেন তাতে আপনাদের পেশাগত উৎকর্ষ সম্বন্ধে আমার অন্তত খুবই শ্রদ্ধা হচ্ছে। মুড়কির যে ঘটনাটা ঘটল, সে ব্যাপারেও আমি আপনাকে দায়ী করতে চাইনা, আপনাদের পেশায় এটুকুর জন্যে মনে মনে তৈরি থাকতেই হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আপনার এতটা আত্মবিশ্বাস আর সাহস দেখেও, স্থানীয় প্রশাসনকে মুড়কির ব্যাপারটা না-জানাতে আমি রাজি হতে পারছি না। আমাদের পক্ষে এটা শুধুমাত্র বেআইনীই নয়, অনৈতিকও বটে। আমাদের কথা ছেড়ে দিন, উল্কির কথাও তো আপনার ভাবা দরকার। আপনি না হয় পোড়-খাওয়া গোয়েন্দা, কিন্তু উল্কির কথাটাও ভাবুন একবার। ওর চেয়ে সামান্যই ছোট একটা মেয়ে এই ভাবে চুরি হয়ে গেল, আর আপনি নিজের জেদ বজায় রেখে প্রশাসনেরও সাহায্য নিতে চাইছেন না! ওর কী মনে হচ্ছে ভেবেছেন একবার?

    উল্কি এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। এবার সে বলে কামিলাকে, আপনার কথাটা মানতে পারলুম না ম্যাম, আমার সম্বন্ধে আপনি যা ভাবছেন সেটা ঠিক নয়। ফল্গুদি যা বলছে সেটা আমারও মনের কথা। যে কাজ করতে এসেছি সে কাজ আমাদের করতেই হবে, আর দেখবেন, মুড়কিও আমাদের সঙ্গেই ফিরবে। আর শুধু আমিই যে এ কথা বলছি তা ভাববেন না, আজ যদি মুড়কির বদলে আমাকে অপহরণ করা হতো, আর আমার জায়গায় থাকতো মুড়কি, ও-ও তাহলে একই কথা বলত।

    সারা রাত্তির জাগা হয়েছে, প্রজেক্টে ফিরে একটা ইজি-চেয়ারে একটু হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করছিলেন শ্যাভেজ, এমন সময় ওয়াকি-টকিতে মুড়কির খবরটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই রওনা দিয়েছেন নৌকোয় চড়ে – সেই কাল বিকেল থেকে চলছেই একটানা – হাতদুটো জোড়া করে মাথার পিছনে নিয়ে গিয়ে একটু আড়মোড়া ভাঙেন শ্যাভেজ, তারপর বলেন কামিলাকে, একটু কফি-টফির ব্যবস্থা রাখোনি নাকি কামিলা?

    একটু লজ্জিত হেসে ভিতরে চলে যায় কামিলা, শ্যাভেজ হেসে তাকান উল্কির দিকে, শরীর কেমন?

    এখন এক্কেবারে ফিট, দু-একটা জায়গায় একটু ছড়ে-টড়ে গিয়েছিল, ডাক্তারবাবু দুটো ইঞ্জেকশন দিলেন, তারপর একজন ফিজিওথেরাপিস্টকে ডেকে পাঠালেন। সে ঘন্টা দুয়েক নানারকমের ম্যাসাজ-টাসাজ করল, এখন কোন অসুবিধেই নেই আর। দু দিনের জন্যে ওষুধ দিয়েছেন, তা-ও এস-ও-এস। আমার তো মনে হয় না দরকার হবে।

    একটু পরেই কামিলা ঢুকলো একটা ট্রের ওপর কয়েকটা প্লেট-এ রাশিকৃত কুকি আর পেস্ট্রী নিয়ে। বললো, এগুলো চলুক আপাতত, কফি আসছে।

    কফি এলো। বিরাট একটা থার্মোস ভর্তি, সঙ্গে অনেকগুলো মগ। একা শ্যাভেজই খেলেন তিন মগ কফি। খেতে খেতে ফল্গুকে বলেন শ্যাভেজ, ধরুন কামিলা আর আমি খানিকটা রিস্ক নিলাম। এখনই জানালাম না কাউকে। কতদিনে আপনি সমস্যাটার সমাধান করতে পারবেন?

    কোন্‌ সমস্যা? পাখি চুরি যাবার? সেটা ঠিক এভাবে বলা যাবে না। পাখি চুরি তো আপনাদের জঙ্গলে চলছেই, বলে ফল্গু, সে ব্যাপারে আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন আমি জানি না। আপনারা যদি আপনাদের প্রশাসনকে আগেই জানিয়ে থাকেন তাহলে তো তারা জানেই। আর যদি না জানিয়ে থাকেন তাহলে আদৌ জানাবেন কিনা সেটা আপনারাই ঠিক করুন। আমার অনুরোধ শুধু একটাই। আমরাও যে এ ব্যাপারটায় কাজ করছি এটা কাউকে না জানানো। আমরা শান্তিতে কাজটা করতে চাই। এ ব্যাপারে আপনাদের কোন অনুরোধ করিনি আমি। আমি অনুরোধ করছি শুধুমাত্র মুড়কির ব্যাপারে। মুড়কির ব্যাপারটা যদি আপনারা আপাতত না জানান আমরা বাধিত হব। এখন মুড়কিকে খুঁজে বের করাটাই আমাদের প্রথম কাজ। সেই কাজটা, অন্য কেউ নাক গলানোর আগেই আমরা করতে চাই।

    কতদিনে করবেন? – জিজ্ঞেস করেন শ্যাভেজ, কতদিন আমরা জানাব না? বুঝতেই পারছেন, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ভয়ঙ্কর ব্যাপার নিজেরা জেনেও প্রশাসনকে না-জানানো একেবারেই বেআইনী। আপনার উপর ভরসা রেখে, ধরুন, আমি আর কামিলা রাজি হলুম এই বেআইনী কাজটা আপাতত করতে। কিন্তু সেটা কতদিনের জন্যে? কতদিনের মধ্যে আপনি আশা করছেন মুড়কিকে খুঁজে বের করবেন?

    এই প্রশ্নটা যে আসবে ফল্গু তা ভাবেনি। সত্যিই তো, অনন্তকাল কেউ প্রশাসনকে না-জানিয়ে বসে থাকতে পারবে না ফল্গুর ভরসায়। বিশেষত, শ্যাভেজ আর কামিলা – দুজনেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাঁদেরও দায়িত্ব আছে। তবুও, কিসের ভরসায় একটা নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে মুড়কিকে উদ্ধার করার প্রতিশ্রুতি দেবে ফল্গু? ফল্গু জানে, এটা প্রায় জুয়া খেলার মতো অবস্থা, কোন কিছুর ভিত্তিতে নয়, শুধুমাত্র নিজের উপর ভরসায় একটা প্রতিশ্রুতি দেওয়া!

    ফল্গু বললো, তিন-চার দিন।

    তিন না চার? – প্রশ্ন করেন শ্যাভেজ।

    চার।

    মাথাটা একটু নীচু করে রগের শিরা দুটো চেপে ধরেন শ্যাভেজ, মিনিটখানেক থাকেন ওই অবস্থায়। তারপর পকেট থেকে বের করেন তাঁর মোবাইল ফোনটা। কয়েকটা চাবি টিপতে টিপতে কানে ফোনটা চেপে ধরে বাইরে বেরিয়ে যান শ্যাভেজ।

    পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রজেক্টের অফিস এই একই কম্পাউণ্ডে, শ্যাভেজই সেই অফিসের কর্তা। মনে হলো ওই অফিসের দিকেই গেলেন তিনি। কামিলার অফিসের ঘর তখন নিস্তব্ধ, কেউ একটাও কথা বলছে না।

    মিনিট দশেক পর ফিরলেন শ্যাভেজ, ফল্গুর মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসলেন তিনি।

    ঘটনাটা ঘটেছে আজই, কয়েক ঘন্টা আগে, শ্যাভেজ বলতে থাকেন, যেটুকু আমি জেনেছি তার বেশি একটুও এখনও অবধি জানেননি আপনিও, কিসের ভরসায় চার দিনের মধ্যে মুড়কিকে উদ্ধার করবেন ভাবছেন?

    দেখুন, ফল্গু বলে, আমাদের পেশায় ইনট্যুইশন একটা বড় কাজ করে। আমার মনে হচ্ছে উল্কির যে অ্যাকসিডেন্টটা হলো সেটা কোন অ্যাকসিডেন্টই নয়, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে এক মুহূর্তের মধ্যে মুড়কিকে নিয়ে পালিয়ে যাবার একটা ফন্দী। যারা এটা করেছে তারা তাদের প্ল্যান এগ্‌জিক্যুট করেছে অক্ষরে অক্ষরে, পলে পলে। অথচ, পুরো ব্যাপারটা যদি ভাবেন, দেখবেন, খুবই কম সময় পেয়েছে তারা। আমরা যে গতকাল রাত্তিরে জঙ্গলে পাখি দেখতে যাব, তা আমরা কেউই সন্ধ্যের আগে ভাবিইনি, জানতুম না তো বটেই। তার মানে, জঙ্গলে যাবার খবরটা যাদের কাছে ছিল, তাদের মধ্যে একজন অপহৃত, বাকি চারজন এখানে, এই ঘরেই, বসে আছে। তাহলে কি অপহরণকারীরা অন্তর্যামী? তা তো সম্ভব নয়।

    তাহলে সম্ভবটা কী? – ফল্গু যেন নিজেকেই প্রশ্ন করে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সে, তারপর বলতে থাকে, যে নৌকোটায় কাল রাতে আমরা ওপারে গেলুম, তার মাঝি এবং সাঙ্গপাঙ্গরাও তো সবাই মিলে আমাদের ওপারে যাবার কোন পরিকল্পনার কথা আগে থেকে জানতো না, যদি না আপনি তাদের বলে থাকেন।

    আমি বলিনি, বলেন শ্যাভেজ।

    অর্থাৎ, আমরা নৌকোয় ওঠার পরেই এমনকি তারাও ব্যাপারটা প্রথম জানতে পারে। ঠিক জানতে পারে বলাটাও ঠিক হবে না, আন্দাজ করতে পারে। তার মানে, আমরা নৌকোয় ওঠার আগে অপরাধীদের পক্ষে – সে তারা যে-ই হোক না কেন – কোন প্ল্যানই তৈরি করা সম্ভব ছিল না। সব প্ল্যানটাই হয়েছে আমরা নৌকোয় ওঠার পর। নৌকোর মাঝি এবং তার সহকারীর গল্পটা খুব ইন্টারেস্টিং, গায়ের জোরে নৌকো থেকে ওদের তিনজন লোককে সরিয়ে দিয়ে আর তিনজন বাইরের লোকের নৌকোটাকে দখল করে নেবার গল্পটা নেহাৎই মামুলি, অতি পরিচিত অ্যালিবাই-এর গল্প: যারা ছিলই না অকুস্থলে, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে নৌকোয়, তারা অপরাধ করবে কীভাবে! আমরা লক্ষ্য করেছি নৌকো এপারে আসার পর প্রথম যখন মুড়কির অনুপস্থিতি আমাদের নজরে পড়ে, তখন ক্যামিলা ম্যামের ধমক খেয়ে নৌকোর থেকে চার জন লোক বেরিয়ে এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। পাঁচ জনের নৌকো, কিন্তু চার জন লোক! আপনাকে যখন রিপোর্ট দিচ্ছিল মাঝি আর তার সহকারী, তখন খুব সতর্কতার সাথে এই চারজনের হিসেবও ওরা দিয়েছে! এপারে এসে, মুড়কিকে খোঁজবার সময় ওরা লক্ষ্য করেছে, একজন আগেই পালিয়েছে! কে সে? কোথায় পালালো? কখন? মুড়কিকেও কি সঙ্গে নিয়ে গেল সে? যদি নিয়েই যায়, তাহলে তো নৌকো থেকেই নিয়ে গেছে, সে ক্ষেত্রে কেউ জানতে পারল না কেন?

    স্তব্ধ হয়ে ফল্গুর কথা শুনছিল বাকি তিনজন। একটু দম নিয়ে বলতে থাকে ফল্গু, যা যা বললুম এতক্ষণ, তাতে আপনারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে মাঝি এবং অন্যান্যদের আরও একটু জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। হয়তো সেখান থেকেই কোন ক্লু উঠে আসতে পারে। এইটাই এখন পর্যন্ত আমার ভাবনা। সেই ভাবনাটাই বললুম আপনাদের। শেষ পর্যন্ত এই থিয়োরীটা দাঁড়াবে কিনা তা সময়ই বলতে পারবে, তবে আমি যে কিছুই না ভেবে চার দিনের কথা বলিনি তা হয়তো আপনারা বুঝতে পারছেন। এখন শ্যাভেজ স্যরের কাছে আমার একটাই অনুরোধ। উনি যথাশীঘ্র ওই একই নৌকোয় প্রজেক্টে ফিরে যান, যাবার সময় নৌকোয় যে দুজন আছে তারা সম্ভবত নিজেদের আগ্রহেই অনেক কথা বলতে চাইবে, সেগুলো শুনুন, সম্ভব হলে কোন মন্তব্য ছাড়াই, এবং লোক দুটোকে প্রজেক্ট থেকে বেরোতে না দেবার ব্যবস্থা করুন। আগামী কাল প্রজেক্টে আমি নিজেও একবার যেতে চাই, স্যর অনুমতি দিলেই যাব। আমার মনে হচ্ছে উল্কিও এখন মোটামুটি সুস্থ, ওর বয়েস উনিশ, কাজেই ওরও আমার সঙ্গে যাবার কোন বাধা থাকবে না।

    বেশ, বলেন শ্যাভেজ, আপনার নির্দেশই মানবো আমরা। আমি মিনিট পনেরোর মধ্যেই তৈরি হয়ে চলে যাচ্ছি নদীর পারে। কাল সকালে অন্য একটা নৌকো পাঠিয়ে দেব, আপনাদের নিয়ে যাবে প্রজেক্টে। কামিলাকে আমি নৌকোর সময়-টময় জানিয়ে দেব, ওর কাছ থেকেই আপনারা খবর পেয়ে যাবেন, আজ রাতে আশা করি এখানেই থাকবেন আপনারা।

    কামিলা ম্যামের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সময়টা আমরা জেনে নেব, কিন্তু এখানে থাকতে আমাদের অনুরোধ করবেন না, সেটা ভালো হবে না, আমাদের পক্ষেও নয়, আপনাদের পক্ষেও।

    ঠিক আছে, বলে কামিলা, তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্‌লার্স ইন-এর ম্যানেজারকে আমি ভালোই চিনি, খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনাদের ঘর রেখে দেবে।

    না ম্যাম, ফল্গু বলে, একেবারেই নয়, আমরা এসেছিলুম তিন জন, এখন এক জন কম। অহেতুক কারো কৌতূহলের উদ্রেক না করানোই ভালো। কম খরচে দুজনের একটা অ্যাকোমোডেশনের ব্যবস্থা যদি করে দিতে পারেন, অনেক উপকার হবে আমাদের। আপনার ফোন নম্বর তো আছেই, আমরা ঠিক যোগাযোগ করে নেব।

    ওঠবার আগে শ্যাভেজ বলেন, আপনার সঙ্গে আর একটা কাজ ছিল। সত্যি কথাটা আপনাকে বলে দিই, আমরা প্রশাসনকে যে একেবারেই জানাইনি তা নয়, আমাদের পুলিশ-ফোর্সের সর্বোচ্চ অফিসারকে ব্যক্তিগতভাবে আমি জানিয়েছি। ব্যাপারটা ব্যক্তিগতই, আগামী চার দিন উনি নিজে ছাড়া প্রশাসনের কেউ আপনাদের সম্বন্ধে জানবে না। চার দিন পেরুর যে কোন জায়গায় যখন ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে, আপনারা কাজ করবেন। চার দিনের মধ্যে যদি তেমন কিছু করতে না পারেন, তাহলে আপনার সঙ্গে আলোচনা করেই পরে কী হবে তা স্থির হবে। তবে, এই কাজের মধ্যে আপনার যদি কোন ব্যাপারে কোন অসুবিধে হয় বা কোন ক্ষমতাবান মানুষ কোন অসুবিধে সৃষ্টি করে – জামার বুক-পকেট থেকে একটা ছোট চিরকুট বের করে ফল্গুর হাতে দিয়ে বলেন শ্যাভেজ – এই নম্বরটা ব্যবহার করবেন, কোন সমস্যা বা বাধা থাকবে না কোথাও।

    থ্যাঙ্ক য়্যু, কাগজটা নিয়ে বলে ফল্গু।

    আরেকটা কথা, কিছু মনে করবেন না, বলেন শ্যাভেজ, আপনাদের যাবতীয় ট্র্যাভেল-ডক্যুমেন্ট কামিলাকে দিয়ে দেবেন। ও অরিজিনাল রেখে আপনাকে ফোটোকপি দিয়ে দেবে।

    বেশ, দেব।

    ঠিক আছে, অল দ্য বেস্ট।



    চলবে ---
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | ১৭৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ২০ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:০৫538712
  • আবার এক সপ্তাহের অপেক্ষা!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন