ঠিক সন্ধ্যের মুখে একটা টেলিফোন এল। এসপিণ্ডোলোর ফোন। বললেন, আমার কাছে ফিনিগান বসে আছে। ফিনিগানকে মনে আছে তো?
ফিনিগান? – ফল্গুর গলার স্বরে বোঝা গেল ফিনিগান নামের কোন ব্যক্তিকে ও মনে করতে পারছে না।
এসপিণ্ডোলো বললেন, তুমি কি একা? না, তোমার সঙ্গে উল্কিও আছে?
উল্কি আছে তো। কথা বলবেন?
তুমি ফোনটা লাউডস্পীকারে করে দাও, আমারটাও আমি করছি, তাহলে আমরা চারজনেই সবাই সবায়ের গলা শুনতে পাব।
ফোন দুটো লাউডস্পীকারে হবার পর এসপিণ্ডোলো বলেন, উল্কি কি মনে করতে পারছ ফিনিগানকে?
না, মানে ঠিক... উল্কি ইতস্তত করে।
এসপিণ্ডোলো বলেন, ফিনিগান আক্রিয়ানো জনজাতির লোক। তোমাদের খেয়াল আছে রিও ব্র্যাঙ্কো থেকে আমরা যখন আশানিঙ্কা জনজাতির মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলাম তখন সেরা ডা কন্টামানা নামের একটা সহরে একজন আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল? সে কাজ চালাবার মতো ইংরিজি বলতে পারতো?
হ্যাঁ হ্যাঁ, উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায় উল্কি, ঠিকই তো, তাঁরই নাম তো ফিনিগান। এবার ফল্গুও যোগ দেয় উল্কির সঙ্গে, আরে তাই তো, কীভাবে ভুলেছিলাম! ফিনিগানই তো আমাদের পাহাড়ের ওপারে জুরুয়া নদীর ধারে শিম্পাটিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। কেমন আছেন আপনি, ফিনিগান?
ফিনিগান বললো, আপনারা চিনতে পারলেন তাই ভালো লাগলো।
উল্কি বললো, আপনাকে তো আমরা আবার দেখলাম আকরে নদী পার হবার সময়। নদীর ধারে বসে আপনাকে লঞ্চে দেখতে পেলাম। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলাম কোথাও যেন আপনাকে দেখেছি! মনে হলো, আপনিও আমাদের দেখতে পেয়ে লঞ্চের উল্টো দিকের বারান্দাটায় চলে গেলেন। তারপর এপারে এসেও আপনাকে দেখলাম। আপনার সঙ্গে টাকমাথা একজন...... জানেন ফিনিগান, তিনি আজ সকালে আমাদের চোখের সামনে......
আপনাদের চোখের সামনে?
এসপিণ্ডোলো বললেন, থাক, টেলিফোনে এসব কথাবার্তা থাক। আমি তোমাদের কেন ফোন করেছিলাম সে কথা বলি। আগামী কাল বিকেলের মধ্যে ফিনিগান তোমাদের হোটেলে – কোন হোটেলে যেন আছো তোমরা? – তোমাদের সঙ্গে দেখা করবে। ও তোমাদের সাহায্য করতে চায়, এবং ওর সাহায্য তোমাদের দরকারও হবে।
আমরা আছি একটা ছোট হোটেলে, নাম বায়োডাইভার্সিটি হোস্টেল।
ফিনিগান বললো, আমি চিনি, বায়োডাইভার্সিটি হোস্টেল আমি চিনি। কিন্তু আপনারা আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন, যতক্ষণ না আমি যাই, হোটেলেই থাকবেন।
লাইন তাহলে এখন কেটে দিই, এসপিণ্ডোলো বলেন।
ঠিক আছে স্যর, আমরা হোটেলেই অপেক্ষা করব।
পরের দিন দুপুরেই হাজির ফিনিগান, এসে প্রথমেই বলে, কাল ফোনে বলছিলেন আপনাদের চোখের সামনেই...
হ্যাঁ, আমাদের চোখের সামনেই, বলে ফল্গু, তারপর আগের দিন সকালে যতটুকু দেখেছে সবটাই বলে। শুনে, ফিনিগান বললো, আমরা পুলিশের মর্গ থেকেই আসছি এখানে সোজা। আপনারা যা দেখেছেন সেটা পুলিশকে বলবেন নাকি? হয়তো ওদের তদন্তে সুবিধে হবে।
তদন্তে যদি সুবিধে হয় তাহলে পরে বলবো, এখনই নয়, কিন্তু আপনি এইমাত্র বললেন পুলিশের মর্গ থেকে আপনারা এখানেই সোজা আসছেন। আপনারা মানে? আপনি ছাড়া আর কে?
প্রোফেসর সেবাস্তিয়ান। পন্টিফিসিয়া য়্যুনিভার্সিটির – ওই যে অ্যানথ্রোপোলজি না কী যেন – তার প্রোফেসর। পুন্টু ওঁর সাপ্লায়ার ছিল।
পুলিশ কী বললো? – জিজ্ঞেস করে ফল্গু।
পুন্টুর মৃতদেহটা একটা চাদরে চাপা দিয়ে মর্গে একটা ট্রেতে রাখা ছিল। চাদরটা সরিয়ে ওরা আমাদের দেখালো। দেখেই আমরা চিনলাম। পুন্টু।
পুন্টু? পুন্টু কি ওই টাকমাথা ভদ্রলোকের নাম? – জিজ্ঞেস করে উল্কি।
হ্যাঁ, ওর নাম পুন্টু, বলে ফিনিগান, সেবাস্তিয়ান নিজের পরিচয় দেবার পর পুলিশের লোকরা জিজ্ঞেস করল কী সূত্রে উনি জানতেন পুন্টুকে। উনি বললেন পুন্টু ওঁকে জনজাতিদের নিজেদের ব্যবহারের নানা জিনিস সাপ্লাই করতো, সেগুলো উনি য়্যুনিভার্সিটির অ্যানথ্রোপোলজিকাল মিউজিয়ামের জন্যে কিনতেন। উনি পুন্টুর কোনো নিকট আত্মীয়কে চিনতেন কিনা জানতে চাইল পুলিশ, উনি বললেন, সম্ভবত ওর নিকট আত্মীয় কেউ ছিল না। ওরা আমার পরিচয়ও জানতে চাইল, আমি বললাম আমি ওর বন্ধু। ওর জামাকাপড় প্যাক করে রাখা ছিল এক জায়গায়, পুলিশের লোকরা বললো, সেগুলো পরীক্ষার জন্যে ল্যাব-এ পাঠানো হবে। প্রোফেসরের কাছ থেকে ওরা একটা স্টেটমেন্ট লিখিয়ে নিল, আমাকে দিয়েও সেখানে সই করিয়ে নিল একটা। তারপর একটা ওয়ালেট – ওরা বললো এই ওয়ালেটটা ওর পকেটে ছিল – এই বলে নিজের পকেট থেকে একটা ওয়ালেট বের করে ফিনিগান – এটা ওরা প্রোফেসরের হাতে দিয়ে দিল। খুলে দেখিয়ে দিল ভেতরে পাঁচ খানা পঞ্চাশ সোলের আর আট খানা একশো আমেরিকান ডলারের নোট আছে। সেইমতো সইও করিয়ে নিল ওরা।
তারপর?
তারপর আর কিছুই নয়, ওরা বলল, ওর গলায় একটা মালা ছিল, বাঁদরের দাঁতের মালা, সেই মালা দেখেই পুলিশ ওকে কোন জনজাতির মানুষ বলে বুঝেছে, মালাটা কি আমরা ফেরৎ চাই?
আমি বললাম, চাই। ওই মালাটা দেখেই ওর জনজাতির লোকরা বিশ্বাস করবে যে ও মারা গেছে। তারপর ওদের কিছু নিয়ম-প্রথা ইত্যাদি আছে, সেগুলোতে ওই মালাটার প্রয়োজন হবে। মালাটা তখন ওদের সীনিয়র কোন অফিসারের অনুমতি নিয়ে ওরা আমাকে দিয়ে দিল।
আপনারা তখন চলে এলেন? – জিজ্ঞেস করে ফল্গু।
চলেই এলাম, কিন্তু আসবার আগে জিজ্ঞেস করলাম ওই টাকাগুলো নিয়ে আমরা কী করব। মনে হলো পুলিশ হাত ধুয়ে ফেলেছে, বললো আপনারা নিজেদের বিবেচনায় যা ভালো বোঝেন তা-ই করবেন।
একবার শুধু টাকমাথা লোকটারই নাম পুন্টু কিনা জিজ্ঞেস করেছে উল্কি, তারপর এতক্ষণ প্রায় পুরোটাই চুপ করে ছিল সে, এখন হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, এই যে খুন হলো পুন্টু, কেন? এর মধ্যে কি আমাদের কোন ভূমিকা বা দায়িত্ব আছে?
ফিনিগান কয়েক মুহূর্তের জন্যে চুপ করে থাকে, তারপর বলে, দায়িত্ব না হলেও ভূমিকা হয়তো আছে। আপনারা সেই যে এসপিণ্ডোলোর সঙ্গে গিয়েছিলেন শিম্পাটিয়া, মনে আছে? আপনাদেরও মালা পরিয়ে দিয়েছিলো ওখানকার লোকরা, মনে আছে আপনাদের?
নিজের জামার ভেতরে ঢুকে-যাওয়া মালাটা বের করে দেখায় উল্কি, এই তো, এই তো সেই মালা, পরেই আছি সেই থেকে, খুলিনি তো।
আপনারা সেদিন চলে আসার পর ওই জনজাতির লোকরা ওইখানে বসেই ঠিক করে আপনাদের কোন ক্ষতি হতে দেবে না ওরা। আপনারা ওখানে বলেছিলেন আপনারাও ওদের লড়াইয়েরই সহযোদ্ধা। জনজাতিদের নিয়ে গবেষণা করেন যাঁরা তাঁদের অনেকেই পুন্টুকে যে চেনেন তা জানতো ওখানে অনেকে। ওরা ঠিক করে আপনারা যখন পেরু আসবেন, পুন্টু আপনাদের উপর নজর রাখবে। ও যে নজর রাখছে তা আপনাদের জানার দরকার নেই, ও প্রতিদিন ফোন-এ আমাকে খবর দেবে আপনারা কোথায় আছেন, কোন অসুবিধেয় পড়লেন কিনা। সেই জেনে আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব। এ ব্যাপারে পুন্টুর যা খরচ হবে, সবাই মিলে চাঁদা তুলে সেটার ব্যবস্থা করবে।
রোজ খবর পেতেন আপনি?
হ্যাঁ, রোজ। কোন কোনদিন এমনকি দুবারও।
শেষ খবর পেয়েছিলেন কবে?
পাঁচ-ছ দিন আগে। সকালে আপনারা এসেছিলেন ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারে, সেখান থেকে গিয়েছিলেন বাটারফ্লাই ফার্মে, ফিরে এসে বিকেলে ট্যুরিস্ট সেন্টারের ম্যাডাম আর ভলান্টিয়ারিং প্রোজেক্টের ডিরেক্টরের সঙ্গে মীটিং করছিলেন। আপনারা মীটিঙে বসার পর শেষ খবর দেয় পুন্টু, তারপর আর খবর নেই।
খবর পেলাম কয়েকদিন পর, ফিনিগান বলতে থাকে, যখন প্রোফেসর সেবাস্তিয়ান ফোন করে জানালেন পুন্টু খুন হয়েছে, পুলিশ ওর পরিচিত মানুষদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরিচিত হিসেবে উনি নিজেই পুলিশের সঙ্গে দেখা করবেন ঠিক করেছেন। আর তার একটু পরেই এসপিণ্ডোলোর ফোন এল, আমি তোমার শহরেই এসেছি, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই! তখনই শুনলাম, শুধু যে পুন্টুই খুন হয়েছে তা-ই নয়, আপনাদের গ্রুপের সবচেয়ে ছোট্ট যে মেয়েটা, মুড়কি যার নাম, তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
চুপ করে যায় ফিনিগান, তারপর জিজ্ঞেস করে, আপনাদের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল পুন্টুর?
আলাপ হয়নি, ফল্গু বলে, হয়তো পরশুদিন আলাপ হতে পারতো, কিন্তু তার আগেই তো ও খুন হয়ে গেল। এর আগে ওকে আমরা অনেক বার দেখেছি, প্রত্যেকবারই পিছন থেকে, প্রত্যেকবারই ও হন হন করে চলে যাচ্ছে এমন অবস্থায়, তখন তো জানতুম না ও বন্ধু হিসেবেই আমাদের উপর নজর রাখছে। পরশুদিন ওকে আমরা প্রথম দেখলাম সামনাসামনি। যখন প্রথম দেখলাম, তখন ও দৌড়িয়ে আমাদের দিকে আসছে, দু হাত দিয়ে প্রবল ভাবে আমাদের থামাবার চেষ্টা করছে। আমরাও ওকে থামাতে থামাতেই সব শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফল্গু।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে সবাই, তারপর হঠাৎই যেন মনে পড়েছে এভাবে বলে ফিনিগান, প্রোফেসর সেবাস্তিয়ান যাবার আগে এই ওয়ালেটটা দিতে বলে গেছেন আপনাদের, বলে ওয়ালেটটা এগিয়ে দেয়।
ওটা নিয়ে আমরাই বা কী করবো বলুন, ফল্গু বলে।
তা জানিনা, কিন্তু ওয়ালেটের খাপে একটা কাগজের টুকরো পেয়েছেন প্রোফেসর, সেটা দেখে উনি কিছু বুঝতে পারেননি, আপনাদের দেখাতে বলেছেন। বলেছেন, এটা আপনাদের দেখানো খুব জরুরি।
একটা ছেঁড়া ব্রাউন পেপারের টুকরো ওয়ালেটটা থেকে বের করে আনে ফিনিগান, দেখে মনে হয় যেরকম কাগজে মুড়ে জিনিসপত্র বিক্রি করা হয় পৃথিবীর সর্বত্র, সেরকম কোন কাগজের ছোট একটা অংশবিশেষ। রোমান হরফে – ইংরিজি স্প্যানিশ ফ্রেঞ্চ জর্মন – প্রায় সব য়্যোরোপিয়ান ভাষাই যে হরফে লেখা হয় আজকাল, সেই হরফের কোন একটা বর্ণের অংশও ছাপা দেখতে পাওয়া যায় কাগজটাতে। ফল্গু হাতে নেয় কাগজটা, ছাপা দিকের উল্টো দিকে তাকায় একবার, তারপর প্রায় আর্তনাদের স্বরে বলে, হে ভগবান! – এবং উল্কির হাতে তুলে দেয় কাগজের টুকরোটা।
উল্কি কাগজটার দিকে তাকায়, তাকিয়েই থাকে কয়েক মুহূর্ত, দর দর ধারা বেরিয়ে আসে তার চোখ দিয়ে, আর অস্ফুট একটা শব্দ যেন গলার সামনে এসে আটকিয়ে যায়।
অস্বস্তি বোধ করে ফিনিগান, অবাক হয়ে তাকায় একবার ফল্গুর দিকে, একবার উল্কির। কী আছে কাগজটাতে? – উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করে সে।
মুড়কির খবর, ফল্গু বলে, মুড়কির খবর নিয়ে আসছিল পুন্টু, বরাবর সে তার চলে যাওয়াটাই দেখিয়েছে আমাদের, এবারটা সে সামনাসামনি দৌড়িয়ে আসছিল, খুব তাড়া ছিল তার......
জনজাতির স্বাভাবিক সারল্যে অন্য সব কিছু ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ফিনিগান, মুড়কির কী খবর? কী খবর মুড়কির?
কী খবর তা আমরা সবাই মিলে পড়ব, আপনি একটু স্থির হয়ে বসুন ফিনিগান। তারপরেই প্রসঙ্গান্তরে যায় সে, আপনি খেয়েছেন, কিছু খেয়েছেন সকাল থেকে? সেই কখন বেরিয়েছেন।
সেবাস্তিয়ান আমাকে খাইয়ে দিয়েছেন। চলে যাবার আগে আমাকে খাইয়ে তারপর গেছেন তিনি।
ঠিক আছে, বলে ফল্গু, তারপর বলে উল্কিকে, সাদা কাগজ নিয়ে আয়।
সাদা কাগজ আর পেনসিল নিয়ে তৈরি হয়ে বসে উল্কি, উল্কির কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে সেটা মেলে ধরে ফল্গু ফিনিগানের সামনে। বলে, দেখুন, এটা একটা সাঙ্কেতিক ভাষা। ভাষাটা না জানলেও এটা দেখেই প্রোফেসর সেবাস্তিয়ান বুঝেছিলেন ভাষাটা সাঙ্কেতিক, সম্ভবত আমাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা, তাই আপনাকে বলেছিলেন কাগজটা আমাকে দিতে।
কাগজটা দেখে ফিনিগান, ফেলে-দেওয়া কাগজে কয়েকটা রঙে লেখা। জনজাতিরা যে ধরণের রঙ ব্যবহার করে চোখে মুখে প্রসাধনের জন্যে, বোধ হয় সেই রঙে কাঠি ডুবিয়ে লেখা হয়েছে:
৫৩৭১৬৩ ২৩৬৩৫৪৫৫। ৭১১৩৬২ ০১৪২৫৩ ৭১৬২৫৩৬২। ২১৬২৪৩১১ ৭১৪৪০৩ ২৩৬৩। ০২৬২ ১১২২ ৪৩১২৪১ ৫১০৩ ৪৫। ০৫১১৩১ ১৩৩১ ৫৩৬৩৪১ ০২৫৫ ০৫১১।
৫১৩১ ৫৪৬২ ১২৫৩৬২। ০২৬২৫৫৬২ ৫৩২২৪৫। ৬১২২৪৫ ০২২২ ২৩৬৩৬২ ৫৪৪১৬২ ৪৩৫৩৫১। ১৩৬৩৬২ ৫৫৬৩৩১ ৫৩২১০৫ ৪৩৬৩।
০৫০৩ ৪৩৫৩৫১ ৭১৪৪০৩ ২৩৪৫২৩৪১। ২৩৪৫২৩৪১ ২২৬১ ১১৪৫ ৫৫৪৫৭১ ৪৫০৩ ৭১৪৪ ০২৫৫ ২২৬২। ০২৫৫১১ ৫৫৬২৫৩ ৪৫। ৩১১১৫৫৪২০৭ ২৩৪৫২৩৪১।
৫৫৬৩ ৫১৬২। ১৪৫৩৬২০৭ ৪৫। ১১২৩ ২১৬৩০৫ ৬১০৭।
উল্কিকে ফল্গু বলে, লেখ্, আমি বলে যাচ্ছি।
প্রথম লাইন: বশল জলভম। সগর অথব সরবর। চরদক শধই জল। আর কছ দখত পই ন। একট গট বরত আম এক।
দ্বিতীয় লাইন: পট ভর খবর। আরমর বছন। যখন আছ জলর ভতর দবপ। গলর মলট বচএ দল।
তৃতীয় লাইন: এই দবপ শধই জনজত। জনজত ছড় কন মনষ নই শধ আম ছড়। আমক মরব ন। টকমথও জনজত।
চতুর্থ লাইন: মল পর। ঘবরও ন। কজ চলএ যও।
ফাইনালটা পড়তে পারবি? – জিজ্ঞেস করে ফল্গু উল্কিকে।
উল্কি সমস্ত লেখাটার ওপর চোখ বোলায় কয়েকবার। মনে হয় সমস্তটার মোটামুটি অর্থটা বুঝে নিতে চাইছে প্রথমে। তারপর বলে, প্রথম লাইন: বিশাল জলভূমি। সাগর অথবা সরোবর। চারিদিকে শুধুই জল। আর কছ... আর কছ..., তার মানে বোধ হয়, আর কিছু দেখতে পাই না। একট গট বরত আম এক, আম এক মানে হয়তো আমি একা। তাহলে বরত আমি একা। বরত কি বাড়িতে? বাড়িতে আমি একা? গট বরত তাহলে হলো গোটা বাড়িতে। তার মানে গোটা বাড়িতে আমি একা। তাহলে একট হলো একটা। একটা গোটা বাড়িতে আমি একা।
ফল্গু বলে, মনে হচ্ছে বিশাল জলরাশির মধ্যে – যেটা সমুদ্র বা বিশাল লেক হতে পারে এমন জলরাশি – তার মধ্যে একটা গোটা বাড়িতে ও একা আছে। ঠিক আছে, দ্বিতীয় লাইনটা?
উল্কি বলে, পট ভর খবর। কীসের খবর? ভর যদি ভরা হয় তাহলে ভরা খবর। ভরা খবর মানে?
ফল্গু বলে, খবরটা যদি খাবার হয় তাহলে ভরা খাবার। পেট ভরা খাবার কি?
হতে পারে, বলে উল্কি, তাহলে পরের বাক্যটা?
আরমর বছন, বলে ফল্গু, পেট ভরা খাবার যখন হলো, তাহলে বছনটা বিছানা। তার মানে আরামের বিছানা, গূড।
উল্কি বলে, যখন আছ জলর ভতর দবপ। পেট ভরা খাবার, আরামের বিছানা, গোটা বাড়িতে একা, বিরাট জলরাশির মধ্যে। তার মানে, জলর ভতর হচ্ছে জলের ভিতর।
আর, যখন আছ হবে যেখানে আছি, বলে ফল্গু। যেখানে আছি জলের ভিতর দবপ। দবপ, দবপ। দবপ-টা কী হতে পারে?
উল্কি বলে, প্রথমেই বলেছে চারিদিকে জল। চারিদিকে জল, মাঝখানে বাড়ি। দবপ।
ফল্গু বলে, চারিদিকে জল, মদ্যিখানে কী? স্থল?
হ্যাঁ, স্থলই, বলে উল্কি, কিন্তু সেই স্থলটার নাম কী? দবপ, শেষে প শেষে প – দ্বীপ না? দ-য় ব-য় দীর্ঘ ঈ আর প! দ ব প! তার মানে, যেখানে আছি জলের ভিতর দ্বীপ। তাহলে ভেবে দেখ ফল্গুদি, জলের ভিতর দ্বীপ, সেখানে একটা গোটা বাড়িতে একা, পেট ভরা খাবার এবং আরামদায়ক বিছানা! এ তো রাজার হাল! ব্যাপারটা কী?
ঠিক আছে, পরের বাক্যটায় আয়, বলে ফল্গু। গলর মলট বচএ দল। গলর মলট মানে নির্ঘাৎ গলার মালাটা। ঐ গলার মালার জোরেই এত হচ্ছে। তার মানে বন্ধু জনজাতিরা আছে আশপাশে।
উল্কি বলে, ঠিকই বলেছ ফল্গুদি। এই লজিকে বচএ দল-র একটাই অর্থ হতে পারে। বাঁচিয়ে দিল! গলার মালাটা বাঁচিয়ে দিল! গলার মালার জোরেই এত কিছু! ঠিক আছে, এবার তৃতীয় লাইনে এস। এই দবপ শধই জনজত। জনজত তো জনজাতি হবেই, আর এই দবপ মানে এই দ্বীপ। এই দ্বীপ শধই জনজাতি। তাহলে শধই মানে কি শুধুই?
ঠিক বলেছিস, বলে ফল্গু, শুধুই জনজাতি। তার মানে এই লাইনটায় প্রথম দুটো শব্দ হবে এই দ্বীপে। এই দ্বীপ নয়, এই দ্বীপে। এই দ্বীপে শুধুই জনজাতি।
উল্কি বলে, তার পরের লাইনে আসি। জনজত ছড় কন মনষ নই শধ আম ছড়। প্রথম পাঁচটা শব্দ তো অবভিয়াস। জনজাতি ছাড়া কোন মানুষ নেই।
রাইট, বলে ফল্গু, পরের তিনটে শব্দও অবভিয়াস, শধ আম ছড় মানে শুধু আমি ছাড়া। অর্থাৎ মুড়কি নিজে ছাড়া আর সবাই জনজাতি। ওর গলায় একটা জনজাতির মালা, তাই অন্য জনজাতিরাও ওর ক্ষতি করছে না। আচ্ছা, পরের লাইনটা বল।
উল্কি বলে, আমক মরব ন। আমাকে মারবে না, তাই না?
তাই। এ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আচ্ছা, তার পরের লাইনটা?
টকমথও জনজত। জনজতটা তো হলো জনজাতি, উল্কি বলে, কিন্তু টকমথ?
টক মানে কী হতে পারে? – প্রশ্ন করে ফল্গু, বোধ হয় নিজেকেই। এক, টাকা। অথবা, টক, মানে ক-এ হসন্ত দিয়ে টক্। টক্মথ? নাঃ, কোন মানে দাঁড়াচ্ছে না। তাহলে, টাকামথ? নাঃ, মানে নেই।
উল্কি বলে, কিন্তু মথটা যদি মাথা হয়? টাকামাথা?
টাকামাথার কী মানে? – বলে ফল্গু, আচ্ছা, পরের শব্দটা কী?
পরের শব্দ জনজত। মানে জনজাতি, তার মানে হলো টাকামাথা জনজাতি। টাকামাথা জনজাতি। টাকামাথা জনজাতি। না ফল্গুদি, উল্কি উত্তেজিত চিৎকার করে ওঠে হঠাৎ, টাকামাথা নয়, টাকমাথা। টাকমাথা জনজাতি।
তা-ই না হয় হলো, বলে ফল্গু, কিন্তু টাকমাথা জনজাতিরই বা কী মানে হলো? পুরো জনজাতিই টাকমাথা? এমন কোন জনজাতি আছে যাদের সবায়েরই টাকমাথা? একটা কোথাও ভুল হচ্ছে রে, এমনটা হতে পারে না।
ফিনিগান এতক্ষণ ধরে বসে আছে ওদের দুজনের সঙ্গে, বুঝতে পারছে ওরা পুন্টুর কাগজটার অর্থোদ্ধার করার চেষ্টা করছে, যদিও নীরব তবুও ওদের উত্তেজনাতে নিজেও উত্তেজিত হচ্ছে খানিকটা, কিন্তু নিজে অংশ নিতে পারছে না। হঠাৎ তার দিকে চোখ পড়ে উল্কির, উল্কি জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, এমন কোন জনজাতি দক্ষিণ আমেরিকায় আছে যাদের সবায়ের মাথায় টাক, টাকমাথা জনজাতি বলা যায় যাদের?
টাক, ফিনিগান বলে, এমনিতে জনজাতিদের মধ্যে কম। আমাদের বন্ধু পুন্টুর টাক ছিল, কিন্তু ও একটা ব্যতিক্রম, ওকে তাই অনেকেই ঠিক ঠিক জনজাতি বলে বুঝতে পারত না।
এক মিনিট, ফিনিগানকে থামায় ফল্গু। কিন্তু ওর নাম যে জানে না, সে তো ওকে টাকমাথা জনজাতি বলে পরিচয় দিতেই পারে। উল্কি, পরের লাইনটা কী আছে রে?
পরের লাইনটা মল পর।
হঠাৎ উত্তেজিত উল্কি, মল পর? মানে, মালা পরে?
পুন্টুও তো মালা পরতো বললো ফিনিগান, হয়তো সেটাই জানাতে চেয়েছে আমাদের।
ফল্গু যতক্ষণ কথা বলছে ততক্ষণ যে কাগজে মুড়কির চিঠির সঙ্কেত ভেঙে লাইনগুলো লেখা হয়েছিল সেই কাগজের দিকে তাকিয়েছিল উল্কি। ও বললো, তুমি যা বলছো সেটা পুরোপুরিই ঠিক। আসলে একটা ছোট্ট বর্ণ, যা মুড়কি লিখেছে, সেটা এতক্ষণ খেয়াল করিনি আমরা। ও লিখেছে টকমথও জনজত। এই 'ও'-টা আমরা খেয়াল করিনি আগে। 'ও'-টা নিয়ে পড়লে বাক্যটা হবে, টাকমাথাও জনজাতি। পুন্টুকে তো আমরা টাকমাথা বলেই নিজেদের মধ্যে বিবরণ দিতাম। তার মানে পুন্টুও জনজাতি। পুন্টুকে অনেক আগের থেকে দেখেও কিন্তু আমরা ওকে জনজাতি বলে বুঝতেই পারিনি, খানিকটা আমাদের-ওপর-নজর-রাখা প্রতিপক্ষ বলেই মনে করেছিলুম। এখন মুড়কি যেখানে আছে, সেখানে ওর মালা এবং ব্যবহার দেখে নিশ্চয়ই মুড়কি ওকে বন্ধু মনে করেছে, তাই ওরই হাতে আমাদের জন্যে চিঠিও পাঠিয়েছে।
ঠিকই বলেছিস, ফল্গু বলে, মনে হলো চিঠির শেষ লাইনে সেরকমই লিখেছে ও। শেষ লাইনটা পড় তো।
'মালা পরে'-র পর আর দুটো বাক্য: ঘবরও ন। কজ চলএ যও।
ঘবরও মানে কী? – বলে ফল্গু, ঘাবড়িও? ঘাবড়িও না?
ঘাবড়িও না, ঠিক, কারণ তার পরের বাক্যে আছে কজ, মানে কাজ, চলএ যও মানে চালিয়ে যাও। অর্থাৎ ঘাবড়িও না, কাজ চালিয়ে যাও।