প্রতিমানাটক নামে মহাকবি ভাসের একটি নাটক আছে। আমাদের এই নাটকটি ভাসের নাটকের বঙ্গানুবাদ নয়। এর পরিণতি ভিন্ন। প্রথম অঙ্কের প্রেক্ষাপটটি ভাসের অনুসারী এবং প্রেক্ষাপটের যুক্তিতেই কয়েকটি সংলাপ প্রায়-অনুবাদ। তাঁর নিজের সময়ে ভাস ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী নাট্যকার; আমি ভাবতে ভালোবাসি, আজকের দিনে লিখলে ভাসের নিজের নাটকটিও হয়তো এই ধরণের কোন পরিণতি পেতে পারতো। মহাকবির মূল নাটকটি ছাড়াও এ নাটক রচনায় আমি শ্রদ্ধেয় রাজশেখর বসুর বাল্মিকী রামায়ণের সারানুবাদটি ব্যবহার করেছি। যাঁরা এই রামায়ণটি পড়েছেন তাঁরা জানেন বাংলায় চলিত ভাষার ভঙ্গীতে সাধু ভাষার ব্যবহারে রাজশেখর বসু শুধুমাত্র সিদ্ধহস্তই ন'ন, কোন কোন জায়গায় তাঁর ভাষার কোন বিকল্পই হয় না, ফলত সে রকম দু-একটি জায়গায় আমার নাটকের সংলাপ প্রায় রাজশেখরের রচনা থেকে হুবহু নেওয়া হয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাবার প্রশ্ন নেই, তাঁর ভাষাটি এখন আমাদের উত্তরাধিকার। নাটকের শেষ অঙ্কে দূতের দুর্মুখ নামটি ভবভূতির উত্তররামচরিত থেকে নেওয়া।
সুধাকর। কত্তাদের হুকুম মতো কাজ হয়েছে, এবার তাহলে একটু আরাম করা যাক।
প্রহরী। (হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচা দেয়) হতচ্ছাড়া, কাজ না করে ঘুমুচ্ছিস?
সুধাকর। (ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে) মারছেন কেন, কী করলাম?
প্রহরী। ন্যাকা! কী করলি জানিস না?
সুধাকর। না বললে জানব কিভাবে?
প্রহরী। এত কিছু কাণ্ড ঘটে গেল, আর তুই কিছুই জানিস না? শ্রীরামচন্দ্রের অভিষেকটা যে ভেস্তে গেল সেটা তো জানিস?
সুধাকর। জানি আবার না! শোকে দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে মহারাজ দশরথ সগ্গে গেলেন―
প্রহরী। তাঁর প্রতিমা তৈরি করে এই প্রতিমাগৃহে দিলীপ-রঘু-অজের পাশে দাঁড় করানো হল―
সুধাকর। এ সব তো জানি কত্তামশাই, কিন্তু আমি দোষটা কী করলাম?
প্রহরী। আবার আমি দোষটা কী করলাম! প্রতিমাগৃহে মহারাজ দশরথের প্রতিমা দেখবার জন্যে আজ যে মহারানিরা আসছেন, আর তার জন্যে তোকে যে সব পরিষ্কার-টরিষ্কার করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে বলা হল, সে সব করেছিস?
সুধাকর। ক―খ―ন! এই দেখুন না পায়রার উৎপাত থেকে বাঁচার জন্যে যে জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল প্রতিমাগুলোকে, সেই জাল সরিয়ে দিয়েছি, চূণকাম করেছি, ঢোকবার মুখে মালা ঝুলিয়ে দিয়েছি, সবই তো করেছি!
প্রহরী। ও, করেছিস। ব্যস ব্যস ঠিক আছে, তবে যা, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যা, আমি ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীমশাইকে খবরটা দিয়ে আসি।
ভরত। সেই ছোটবেলা থেকে মামাবাড়িতেই আছি, কোশলরাজ্যে কোথায় কী হচ্ছে, কে কেমন আছে, খবরই রাখি না। (সারথিকে) সারথি মশাই, আপনাকে এত তাড়াহুড়ো করে আমাকে নিয়ে আসতে পাঠানো হল কেন! অতটা দূর, যেদিন পৌঁছোলেন সেদিনই আবার রওনা দিলেন। শুধু বলছেন মহারাজের শরীরটা খারাপ। কতটা খারাপ, কী হয়েছে?
সারথি। মনস্তাপটাই বেশি।
ভরত। চিকিৎসা চলছে? কী বলছেন রাজবৈদ্য?
সারথি। আসলে এ রকমটা ঠিক তিনিও আগে দেখেননি, এ তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে।
ভরত। পথ্য কী চলছে? শয্যা কি শয়নঘরেই, না অন্য কোথাও?
সারথি। অনশন এবং ভূমিশয্যা।
ভরত। কোন আশা আছে কি?
সারথি। সবই দৈবের অধীন।
ভরত। সারথি মশাই, আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। চলুন, আর বিশ্রামের প্রয়োজন নেই, আমরা যথাসম্ভব দ্রুত প্রাসাদে পৌঁছোই।
সারথি। (স্বগত)নিষ্ফল আশায় বুক বেঁধে কুমার ভরত প্রাসাদে প্রবেশ করবেন, সব জেনে-শুনেও আমরা বলতে পারছি না তাঁকে। পিতার প্রাণত্যাগ, মাতার লোলুপতা এবং শ্রীরামের বনগমন―তিন তিনটে মর্মান্তিক ঘটনা কে তাঁকে জানাবে!
প্রহরী। কুমারের জয় হোক। রাজজ্যোতিষী বলছেন কৃত্তিকা নক্ষত্রের এক দণ্ডমাত্র অবশিষ্ট আছে। কৃত্তিকার অন্তে রোহিণী নক্ষত্রের শুরুতে কুমারের অযোধ্যা প্রবেশ উচিত হবে বলছেন তিনি। সে সময়টুকু কোথাও কাটিয়ে তারপর যাওয়াই বোধ হয় ঠিক।
ভরত। তাই হোক। গুরুবাক্য লঙ্ঘন করব কেন? আচ্ছা, সামনের এই মন্দিরেই তাহলে বিশ্রাম নিই না কেন। দেবপূজাও হবে, বিশ্রামও হবে। তা ছাড়া নগরের উপকণ্ঠে বিশ্রাম নিয়েই নগরে প্রবেশ করা প্রশস্ত, তা-ই করি। সারথি মশাই, তাহলে রথটা এখানেই রাখা যাক। আপনি একটু ঘোড়াদেরও বিশ্রাম করিয়ে নিন না।
সারথি। হ্যাঁ, তা-ই করি।
ভরত। (মন্দিরের সামনে গিয়ে) বাঃ, খৈ আর ফুল দিয়ে কী চমৎকার সাজানো নৈবেদ্য! দেয়ালের গায়ে চন্দনমাখা পাঁচ আঙুলের ছাপ, আর কী সুউচ্চ মন্দির! প্রতিটি দুয়ারে ফুলমালা সজ্জিত, কার মন্দির এ, কোন্ দেবতার! আজ কি কোন বিশেষ পার্বণ, না কি এই-ই মন্দিরের নিত্যসজ্জা? যাই, ভেতরে প্রবেশ করে দেখি। (প্রবেশ করে) আরে, কাদের বিগ্রহ এ সব? প্রতিমাচতুষ্টয় কাদের? কী জীবন্ত প্রতিমা! প্রণাম করব কি? কিন্তু কী মন্ত্রে প্রণাম করবো এঁদের?
দেবকুলিক। কী আশ্চর্য, মন্দিরে কে যেন একজন প্রবেশ করল না, মন্দিরের প্রতিমার সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্য আছে মনে হল! (মন্দিরে প্রবেশ করেন)
ভরত। প্রণত হই।
দেবকুলিক। না না, প্রণাম করবেন না।
ভরত। কেন? প্রণাম করায় বাধা কিসের? কেউ করতে পারবে, কেউ পারবে না, এ রকম কিছু আছে?
দেবকুলিক। না না, তা নয়। আসলে এগুলো দেবমূর্তি নয়, ক্ষত্রিয়ের বিগ্রহ। পাছে কোন ব্রাহ্মণ ভুল করে প্রণাম করে ফেলেন তাই বারণ করছিলাম।
ভরত। ক্ষত্রিয়ের বিগ্রহ? কারা এঁরা?
দেবকুলিক। ইক্ষ্বাকুবংশীয় অযোধ্যার পূর্ববর্তী রাজন্যবর্গের প্রতিমা এগুলি।
ভরত। ইক্ষ্বাকুবংশীয় নৃপতি এঁরা? এঁরাই সেই প্রাতস্মরণীয় নৃপতি অযোধ্যার, যাঁরা দেবাসুরের যুদ্ধে দেবপক্ষে যুদ্ধ করে অসুরদের নগর ধ্বংস করেন, যাঁরা নিজেদের সুকৃতির পুরস্কারে সপুরজন ইন্দ্রলোক প্রাপ্ত হন, পৃথিবীকে করায়ত্ত করেন, এবং মৃত্যুকেও অপেক্ষা করতে বলার স্পর্ধা রাখেন? ওঃ, কোন্ সুকৃতির বলে আমি এত ভাগ্যবান যে আজ এঁদের দর্শন পেলাম! (দেবকুলিককে) আমাকে একটু অনুগ্রহ করবেন, এঁদের চিনিয়ে দেবেন? (একটি বিগ্রহকে দেখিয়ে) ইনি কে?
দেবকুলিক। ইনি দিলীপ। ইনিই প্রজ্জ্বলিতধর্মদীপ প্রবর্তক দিলীপ। শ্রেষ্ঠ রত্নাদি একত্র করে ইনি বিশ্বজিৎ যজ্ঞ করেছিলেন।
ভরত। ধর্মপরায়ণ দিলীপকে নমস্কার। (আর একটি বিগ্রহকে দেখিয়ে) ইনি?
দেবকুলিক। রঘু ইনি।
ভরত। সেই রঘু যিনি ব্রাহ্মণদের রাজ্যফল দান করেছিলেন?
দেবকুলিক। সেই রঘু।
ভরত। এঁকে প্রণাম করি। (আর একটি প্রতিমাকে দেখিয়ে) এই প্রতিমাটি কার?
দেবকুলিক। পত্নীর বিরহদুঃখে যিনি রাজ্যত্যাগ করেছিলেন, সেই মহামতি অজের প্রতিমা এইটি।
ভরত। দেব অজ, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।
ভরত। আমার চিত্ত একটু বিক্ষিপ্ত হয়েছিল নানা কারণে, কোন্ প্রতিমাটি কার, ঠিক ঠিক মনে রাখতে পারিনি, অনুগ্রহ করে আর একবার চিনিয়ে দেবেন আমাকে? (দিলীপকে দেখিয়ে) এই প্রতিমাটি কার?
দেবকুলিক। দিলীপের।
ভরত। দিলীপ। মহারাজ দশরথের প্রপিতামহ দিলীপ। (আর একটিকে দেখিয়ে) এটি কার?
দেবকুলিক। রঘু।
ভরত। রঘু? মহারাজের পিতামহ রঘু? (আর একটিকে দেখিয়ে) আর এটি?
দেবকুলিক। অজ।
ভরত। অজ। মহারাজের পিতা অজ। (আড়চোখে এক মুহূর্তের জন্য দশরথের প্রতিমাটিতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে) (স্বগত) চতুর্থ প্রতিমাটি একেবারে পিতা দশরথের অনুকৃতি! না না, তা হবে না, একই রকমের দেখতে অন্য মানুষ হতে পারে না? (প্রকাশ্যে) হ্যাঁ, যা বলছিলাম, একবার পর পর বলুন তো।
দেবকুলিক। (আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) দিলীপ, রঘু, অজ।
ভরত। (ঢোক গিলে) আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, উত্তর দিতে না চাইলে না-ও দিতে পারেন আপনি। আচ্ছা বলুন তো, যাঁরা জীবিত, তাঁদের প্রতিমাও কি এখানে রাখা হয়?
দেবকুলিক। না না, যাঁরা দেহরক্ষা করেছেন শুধুমাত্র তাঁদের প্রতিমাই এই মন্দিরে থাকে।
ভরত। (মুখ শুকিয়ে যায়) ও, (ঢোক গিলে) আচ্ছা আমি তাহলে এখন, মানে এখন যাই, মানে বিদায় নিই, মানে ধন্যবাদ, অ্যাঁ!
দেবকুলিক। একটু দাঁড়ান ভদ্র। অঙ্গীকার অনুযায়ী পত্নীর কাছে প্রতিশ্রুত বর―হ্যাঁ, ভয়ঙ্কর সেই বর―দিতে গিয়ে প্রাণত্যাগ করলেন এবং রাজ্য বিসর্জন দিলেন যে মহারাজ দশরথ, তাঁর প্রতিমা দেখেও আপনি কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না কেন?
ভরত। ওঃ সত্য, সত্যের মুখোমুখি আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন আপনি আর্য, চেষ্টা করেও অস্বীকার করতে পারলাম না! হায় পিতা! (পতন, দেবকুলিক দৌড়িয়ে আসেন, ভরতের ঘাড়ে এবং পিঠে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে বসিয়ে দেন।) হে হৃদয়, পালিয়ো না, আশঙ্কা সত্য হয়েছে, এখন পিতার মৃত্যুবার্তা শোন, ধৈর্য ধর।
দেবকুলিক। আপনি আমাকে আর্য সম্বোধন করলেন, এ সম্বোধন তো সাধারণত ইক্ষ্বাকুবংশীয়রাই করে থাকেন, আপনি কি কৈকেয়ীর পুত্র ভরত?
ভরত। কৈকেয়ীপুত্র? আপনি আমাকে দশরথপুত্র বলে জানবেন। কৈকেয়ীর কাছে প্রতিশ্রুত বর এবং পিতার মৃত্যুর বিষয়ে আপনি যা বললেন, তাতে যদি সত্যের লেশমাত্রও থাকে, কৈকেয়ীর ঘৃণিত পুরষ্কার যদি আমাকে স্পর্শমাত্রও করে, তাহলে আমাকে প্রায়শ্চিত্য করতে হবে, ঘৃণিত এই দেহ শুদ্ধ করতে হবে! হে আর্য, যতটা আপনি জানেন, সবটাই বলুন।
দেবকুলিক। শুনুন তবে। মহারাজ দশরথ লোকান্তরিত হয়েছেন। বনে গিয়েছেন শ্রীরামচন্দ্র, গিয়েছেন লক্ষ্মণ এবং ধর্মপত্নী সীতাসহ। তবে কেন তাঁদের বনে যেতে হল সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
ভরত। কী? কী বলছেন? আর্য শ্রীরামকে বনেও যেতে হলো?
দেবকুলিক। শান্ত হোন কুমার, শান্ত হোন।
ভরত। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হুঁ, শান্ত তো হতেই হবে। ক্ষীণ জল, জল অতি ক্ষীণ, জেনেও তৃষ্ণার্ত যেমন ধাবিত হয় নদীর দিকে, আমিও ঠিক সেরকম পিতৃভ্রাতৃবর্জিত অরণ্যোপম অযোধ্যায় ছুটে চলেছি। কেন? কিসের জন্য? আর্য, সমস্তটা আপনি বলুন। আমার মানসিক অবস্থা চিন্তা করে করুণাবশত কোন কিছু বাদ দেবেন না। কে জানে, হয়তো বিস্তারিত শুনলেই আমার মনে স্থিরতা আসবে।
দেবকুলিক। তবে বলি। মহারাজ দশরথ যখন শ্রীরামচন্দ্রকে অভিষিক্ত করতে যাচ্ছিলেন, তখন, ঠিক সেই মুহূর্তেই, আপনার জননী বললেন―
ভরত। (কান্নায় ভেঙে পড়েন) আমার জননী বললেন, ওঃ, আমার জননী বললেন, থামুন! আমি জানি তিনি কী বললেন! কী আর বলবেন! বললেন, আমার পুত্র রাজা হোক্! আর ধৈর্যের মূর্তি জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীরামচন্দ্রের হাসিমুখ দেখে মহারাজ, স্বয়ং মহারাজ দশরথ (কান্না) , আমাদের পিতা কৈকেয়ীপতি দশরথ, এই বাক্য উচ্চারণ করলেন: পুত্র, বনে যাও! তারপর, তারপর, বল্কলপরিহিত পুত্রকে দেখে তিনি, যে তিনি মৃত্যুকেও তিষ্ঠ বলার স্পর্ধা রাখেন, সেই তিনি, মৃত্যুর শান্তি বরণ করলেন! আর সমস্ত দেশ, সমস্ত প্রজাবৃন্দের নিন্দাবাদ এবং অভিশাপ আমার উপর বর্ষিত হল! আমি তো জানি, আমি তো সবই জানি! (মূর্ছা)
কণ্ঠস্বর। সরে যান, সবাই সরে যান।
দেবকুলিক। (উইংসের ভেতরে তাকান) ভালোই হলো। পুত্র মূর্ছিত, ঠিক সেই সময়েই মায়েরা এলেন।
সুমন্ত্র। আসুন মহিষীরা, আসুন। এই সেই সুউচ্চ প্রতিমাগৃহ, যেখানে প্রজাদের প্রবেশ অবাধ। আসুন (ঢুকতে গিয়ে ভরতের সংজ্ঞাহীন দেহ দেখে পিছিয়ে গিয়ে) , না না দাঁড়ান। এখনই আসবেন না। মনে হয় কোন তরুণ নৃপতি এখানে সংজ্ঞাহীন পড়ে আছেন।
দেবকুলিক। না না আসবেন না কেন, আসুন! অপরিচিত কেউ নয়, ইনি ভরত।
মহিষীরা (একযোগে) । ভরত!
ভরত। আর্য!
সুমন্ত্র। জয় হোক মহারা― (ভুল বুঝতে পেরে) না না, কণ্ঠস্বরের সাম্য শুনে মনে করেছিলাম স্বয়ং প্রতিমাই কথা বলছেন!
ভরত। মায়েরা কেমন আছেন, কী অবস্থা তাঁদের?।
মহিষীরা (একযোগে) । (অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে বৈধব্য দর্শন করিয়ে) বাছা! দেখ আমাদের অবস্থা!
ভরত। (সুমন্ত্রকে) আচ্ছা, আপনিই কি পূজনীয় সুমন্ত্র?
সুমন্ত্র। অভিশপ্ত সুমন্ত্র। দেখছ না, এই দীর্ঘ জীবনের অভিশাপ নিয়ে মহারাজের শূন্যরথের সারথি, এখনো খেয়ে, ঘুমিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি!
ভরত। (উঠে) হায় তাত, এতদিন নন্দীগ্রামে থেকে আমি তো অপরিচিত হয়ে গেছি, আপনি আমাকে বলে দিন কোন্ ক্রমে মায়েদের অভিবাদন করব।
সুমন্ত্র। বলছি। (কৌশল্যাকে নির্দেশ করে) ইনি মাননীয় রামের জননী দেবী কৌশল্যা।
ভরত। মা! আমার প্রণাম নাও। মা! বিশ্বাস করো আমি নিরপরাধ!
কৌশল্যা। আমি জানি বৎস, তোমার সন্তাপের কোন কারণ নেই।
সুমন্ত্র। (সুমিত্রাকে নির্দেশ করে) ইনি লক্ষ্মণজননী সুমিত্রা।
ভরত। মা, অভিবাদন করছি।
সুমিত্রা। যশস্বী হও, বৎস।
সুমন্ত্র। (কৈকেয়ীকে নির্দেশ করে) বৎস, ইনি তোমার জননী।
ভরত। (উঠে দাঁড়ায়) জননী! পাপীয়সী! গঙ্গা-যমুনার মতো পবিত্র আমার এই দুই মাতার পুণ্য নদীধারার মধ্যে অনুপ্রবেশকারী কলুষ তুমি!
কৈকেয়ী। বাছা, কী করেছি আমি?
ভরত। অহো, কী নিদারুণ সন্তাপহীন রমণী! তুমি কী করেছ! নিন্দাভাজন করেছ আমাকে, বল্কল দিয়েছ এমনকি তোমারও জ্যেষ্ঠপুত্র বলে পরিচিত রামকে, পুত্রবধূকে পথশ্রমে ক্লান্ত করেছ, তোমার স্বামী মহারাজ দশরথকে হত্যা―হ্যাঁ, যতই কঠিন শোনাক হত্যাই―করেছ তুমি! আর নিজেকেও যে নিন্দাবাদের, ধিক্ ধিক্ ধ্বনির, বিষয়ে পরিণত করেছ সে ব্যাপারে ধারণা আছে তোমার?
কৌশল্যা। এ কী ভরত, এ কী আচরণ তোমার! তুমি তো সদাচারে দীক্ষিত, মাকে বন্দনা কর।
ভরত। মা কে, কে মা? তুমিই মা, তোমাকেই বন্দনা করি আমি।
কৌশল্যা। এ কী কথা ভরত, না না, এটা ঠিক হচ্ছে না, আমি তো নিশ্চয়ই তোমার মা, কিন্তু ইনিই তোমার জননী।
ভরত। আগে ছিলেন, এখন আর নেই। মাতার কুস্বভাব তাঁর শরীর থেকে স্নেহ অপসারিত করে, তখন পুত্রও অপুত্র হয়; নিজ স্বামীর প্রতি বিদ্বিষ্ট মাতা অমাতা হন, লোকমধ্যে এই নূতন ধর্ম আমি স্থাপন করব।
কৈকেয়ী। স্বামীর প্রতি বিদ্বিষ্ট? আমি যা করেছি মহারাজের সত্যরক্ষার জন্যই করেছি।
ভরত। কী বললে! মহারাজের সত্যরক্ষা?
কৈকেয়ী। তোমার পুত্র রাজা হবে―এই কথা মহারাজ আমাকে দিয়েছিলেন।
ভরত। হাঃ! সত্যরক্ষা! রামচন্দ্র তোমার পুত্র নন? তিনি তোমার স্বামীর ঔরসপুত্র নন?
কৈকেয়ী। ঔরসপুত্র নিশ্চয়ই, কিন্তু তার অভিষেকে সত্যরক্ষা হতো কিনা তোমার এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মহারাজই দিতে পারতেন। তবে অমাত্যবর্গকে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবে, তিনি সত্যের পথে থাকেননি, আসলে তিনি রামরাজ্য চেয়েছিলেন, প্রজাদের দ্বারা নির্বাচিত রামের রাজত্ব, সেখানে সত্যই বা ছিল কোথায়, আর তুমিই বা কোথায়! তাই আমাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল, মহারাজের সত্যরক্ষার স্বার্থে!
ভরত। চমৎকার, অসাধারণ সত্যরক্ষা! আর হৃতরাজ্য রামকে সস্ত্রীক পায়ে হেঁটে বনবাসে পাঠানোও কি মহারাজের সত্যরক্ষার স্বার্থে?
কৈকেয়ী। তোমার এ প্রশ্নের উত্তর আমি যথাস্থানে এবং যথাসময়ে দেব।
ভরত। ধিক্ তোমাকে! নিজের মনস্কামনা পূরণের জন্য আমার নাম তুমি জড়ালে কেন? তুমি যদি রাজ্যভোগই চেয়েছিলে, সত্য বল, রাম কি তোমার ইচ্ছা পূরণ করতেন না? 'রাজমাতা' পদবীর জন্য এতই যদি তুমি লোলুপ, তাহলে নিজের বুকে হাত রেখে বল, রাম তোমার পুত্র নন? রাজ্যলুব্ধা দুষ্কর্মকারিণী - বল্কলপরিহিতা জনকতনয়াকে দেখেও তোমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়নি?
সুমন্ত্র। কুমার ভরত, কুলগুরু এবং কুলপুরোহিত মহাঋষি বশিষ্ঠ এবং মাননীয় বামদেব অভিষেকের সামগ্রী নিয়ে এসেছেন। নৃপতিহীন প্রজাবর্গ গোপহীন গাভীর মতো বিনষ্ট হচ্ছে। এসো বৎস, অভিষেক গ্রহণ করো।
ভরত। অভিষেক! প্রজাদের বলুন আমার অনুসরণ করতে।
সুমন্ত্র। অভিষেক বর্জন করে কোথায় যাবে তুমি কুমার?
ভরত। (কৈকেয়ীকে দেখিয়ে) অভিষেক যদি এতই জরুরী হয় তাহলে তা এঁকে দান করুন।
সুমন্ত্র। তুমি কোথায় যাবে?
ভরত। আমি তো অযোধ্যায় এসেছি; যেখানে রাঘব সেখানেই আমার অযোধ্যা। আমি রামের সন্ধানে চললাম।