এটি সর্বজনবিদিত যে, থিয়েটার বিশ্বের সমস্ত দেশে বিনোদন এবং সামাজিক যোগাযোগের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন যে, থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়। জাপানেও নাট্যশিল্পের যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তাতে জাপানী থিয়েটারের আসল রূপগুলি তার সূচনার দিন থেকে এখন পর্যন্ত একই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু আবার একই সঙ্গে আধুনিক চিন্তাধারা ও ধ্যান-ধারণার এক সতর্ক সংমিশ্রণও হয়েছে।
জাপানের থিয়েটারের সুপরিচিত ঐতিহ্যগত রূপ প্রধানত চারটি। সেগুলো হল নো, ক্যিওগেন,বুনরাকু এবং কাবুকি।
নো
“নো” (মূলতঃ গীতি-নৃত্যনাট্য, ছবি-১) চতুর্দশ শতাব্দী থেকে বিশেষ জনপ্রিয় এক শিল্পকলা এবং বর্তমান সময়েও সম্যকভাবে সমাদৃত। “নো”, গান এবং নৃত্যকে ঘিরে সঞ্চালিত। নড়াচড়া ধীর, ভাষা কাব্যিক, সুর একঘেয়ে, পোশাক-পরিচ্ছদ সমৃদ্ধ, জমকালো ও ভারী এবং মুখ মুখোশে ঢাকা । প্লট সাধারণত কিংবদন্তি, ইতিহাস, সাহিত্য এবং সমসাময়িক ঘটনা। “নো” গান একটি স্বাধীন শিল্প হিসাবে এবং এক অনন্য মুন্সীয়ানার সঙ্গে অনুশীলন করা হয় । নাচেও এক বিশেষ ভঙ্গিমা পরিলক্ষিত । কুশীলবরা মুখোশ পরে ধীর তালে সঞ্চালিত নাচের মাধ্যমে সমগ্র বিষয়টি উপস্থাপন করে থাকেন। মঞ্চ সজ্জাতেও বিশেষ আঙ্গিকের ছোঁয়া । আদতে “নো” খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হত । সেই ধারণাকে বজায় রেখে এক মুক্তমঞ্চের আদলে “নো” থিয়েটার তৈরী হয় । ‘হোন-বুতাই’ বা মূল মঞ্চটির ছাদ চারটি পিলারের উপর নির্মিত। বাম পাশে হাশিগাকারি (ব্রিজওয়ে, প্রধাণতঃ কুশীলবদের যাতায়াতের জন্য)। এছাড়া থাকে আতো-জা (মঞ্চের পেছনদিকে সঙ্গীতশিল্পী এবং মঞ্চ পরিচারকদের জন্য বসার বিভাগ), জিউতাই-জা (কোরাসের শিল্পীদের জন্য বসার বিভাগ) এবং “আগে মাকু” বা সাজঘরের পর্দা। এছাড়াও “নো” মঞ্চের পেছনের দেওয়ালে আঁকা থাকে পাইন গাছ । ‘হাশিগাকারি’-র পাশেও কখনো কখনো পাইন গাছের চিত্র থাকে। যাতে দর্শকদের কল্পনায় অভিনয়টি পাইন গাছের নীচে অনুষ্ঠিত বলে মনে হতে পারে। অন্যদিকে, দর্শকাসন যে কেবল সামনের দিকেই থাকে তা নয়, পাশের দিক থেকেও অভিনয় দেখার ব্যবস্থা থাকে। “নো” মঞ্চ এবং দর্শকের আসনের মধ্যে কোনো পর্দা নেই । অতএব, অভিনেতারা “আগে মাকু” বা সাজঘর ছেড়ে মঞ্চে অভিনয় করতে “হাশিগাকারি” বা সেতুতে উপস্থিত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই দর্শকদের কাছে দৃশ্যমান। এই সেতু যে শুধুমাত্র অভিনেতাদের প্রবেশ এবং প্রস্থান করার জন্যই ব্যবহৃত হয় তাই নয়, গল্পের দৃশ্য হিসাবেও অনেক সময়ে কাজ করে। আখ্যানের প্রধান চরিত্রটি (জাপানী-শিতে) একটি ভূত, দেবতা, বুদ্ধ, গাছ, ফুল বা পশুর আত্মার মুখোশ পরে উপস্থিত হয়। সমকালীন বিশ্বে বর্তমান এমন কোনো মানুষের চরিত্রায়নের সময়ে মুখোশও থাকে না বা তাঁরা মেক-আপও করেন না।
“নো” জাপানের মধ্যযুগে, মুরোমাচি সময়কালে (১৩৯২ – ১৫৭৩ খৃষ্টাব্দ) শুরু হয়েছিল। এর আগে, হেইয়ান যুগে (৭৯৪ – ১১৯২ খৃষ্টাব্দ), কিছু কৌতুক অভিনেতা ছিলেন যারা অ্যাক্রোব্যাটিক্স বা দড়া-দড়িতে উঠে খেলা দেখাতেন, জাদু কৌশল, গান এবং নাচে নিজস্ব শিল্প আঙ্গিক কাজে লাগিয়ে আনন্দদান করতেন। এই শিল্পকে সারুগাকু বলা হত। ঘটনাক্রমে, কামাকুরা যুগের শেষের দিকে (১১৯২ – ১৩৩৩ খৃষ্টাব্দ) গান এবং নৃত্যের মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়বস্তু সহ সঙ্গীত এবং নৃত্য নাট্যগুলি উত্সব এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানেও দেখানো শুরু হয়েছিল।
এই কমেডি-ভিত্তিক স্কিট বা ছোটো ছোটো প্রহসনগুলি পরে ক্যিওগেন নামে পরিচিতি পায়। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে,গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু সহ নাটককে গান এবং নৃত্য সহযোগে কমেডি-কেন্দ্রিক করে বেশি জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছিল। এই ধরণের শিল্পকলা হল “সারুগাকু নো”। “সারুগাকু নো” শৈল্পিক পরিশীলতাকে নিয়ে পরিবেশিত গীতি-নৃত্য নাট্য। সেই সময়ে অনুষ্ঠিত,“ইয়ামাতো সারুগাকু” তৎকালীন সারা দেশের সারুগাকু থিয়েটারগুলির মধ্যে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। কানামি নামের একজন নো অভিনেতা, কোমাই ঘরাণার সঙ্গীতের আকর্ষণীয় বীটগুলিকে নো সংগীতে অন্তর্ভুক্ত করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, যা মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। তার পুত্র, জেয়ামি, সঙ্গীত, নৃত্য এবং নাটকের আরও মার্জিত শৈলী তৈরি করেছিলেন।
নো-এর আদর্শ যে রূপটির প্রতি জেয়ামির লক্ষ্য ছিল তা হল এই নাট্যরূপের এক সুক্ষ্ম কমনীয়তা প্রদান। জেয়ামি বিশ্বাস করতেন যে কমনীয় নো নাটকে অভিনয় করার সময় অভিনেতাদের আরও সৌন্দর্য প্রদর্শন করা উচিত ফুলের মাধ্যমে। এখানে ফুল একটি রূপক অভিব্যক্তি যা অভিনবত্বের প্রতিনিধিত্ব করে,এবং যা সদা আকর্ষণীয় ও সদা সতেজ। জেয়ামি জোর দিয়েছিলেন যে প্রতিটি নো নাটক পরিবেশনায় এবং অভিনেতাদের সাথে অবশ্যই ফুল থাকতে হবে এবং “সারুগাকু দাঙ্গি” এবং “ফুশিকাদেন” সহ ২১ রকম নো-পরিবেশনের উপর তাত্ত্বিক বই লিখেছিলেন। তিনি ৫০টির-ও বেশী নো গানের প্রবক্তা। এগুলি আধুনিক নো-তেও ব্যবহৃত হতে শোনা যায়।
পরবর্তীকালে এদো যুগের (১৬০৩ – ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দ) শুরুতে, কানজে-রিউ (কানজে ঘরানা: যা কিনা পিতা-পুত্র কানামি এবং জেয়ামি শুরু করেছিলেন) ছাড়াও আরও চারটি ঘরাণার প্রবর্তন হয়। এই শিল্প-রীতি য়োজা ইচিরিউ বা চার প্রধাণ ঘরাণা নামে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল।
বর্তমানে “তাকিগি নো” (টর্চ লাইট নো)-র মুক্তমঞ্চ পরিবেশনা সমগ্র জাপান জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মন্দির, উপাসনালয় বা পাবলিক পার্কের মাঠে এই ধরণের নো অনুষ্ঠিত হয়। এই রকম মঞ্চে পরিবেশন, নমনীয়তা এবং সৌন্দর্যের সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য এবং অনুভূতিকে একত্রিত করে। সন্ধ্যার প্রথম দিকে, একটি মশাল প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি মায়াময়ী সন্ধ্যার মঞ্চ তৈরি হয়। এছাড়াও বহু নো নাটক প্রতিদিন বহু জাপানীদের বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
ক্যিওগেন
ক্যিওগেন, (ছবি-২) নো-এর মতোই,একটি ধ্রুপদী নাটক যা মধ্যযুগে উদ্ভুত কমেডি অভিনয়। নো এবং ক্যিওগেন দুইটিই হেইয়ান যুগের(৭৯৪ – ১১৯২) সারুগাকু থেকে আধারিত । বর্তমান যুগে ক্যিয়োগেন, নো নাট্য-মঞ্চেই দুটি নো নাটকের মধ্যবর্তী সময়ে অথবা নো নাটক শুরু হবার আগে অনুষ্ঠিত হয়। দুটি নো নাটকের মাঝে যে ক্যিওগেন অনুষ্ঠিত হয় সেটি আসলে নো-নাটকের যে পর্যায়ে ট্র্যাজেডির অবতারণা হয় সেই সময়ের ট্র্যাজিক উত্তেজনাকে দমন করার উদ্দেশ্যেই এই কমেডির অবতারণা করা হয় ।
ক্যিওগেন, অষ্টম শতাব্দীতে (জাপানের নারা যুগে) চীন থেকে জাপানে প্রবর্তিত সাঙ্গাকুর অন্ধ অনুকরণ হিসাবে গণ্য হত। হেইয়ান যুগে (৭৯৪-১১৮৫ খৃষ্টাব্দ), ডেঙ্গাকুর মতো জাপানি ঐতিহ্যবাহী পারফরমিং আর্টের সাথে সংযুক্ত হয়ে সাঙ্গাকু সারুগাকুতে বিকশিত হয়েছিল এবং কামাকুরা যুগে (১১৮৫ -১৩৩৩ খৃস্টাব্দ) এটি নো-র একটি অংগ হিসাবে যুক্ত হয়েছিল । চতুর্দশ শতকের প্রথম দিকের মুরোমাচি যুগে (১৩৩৩-১৫৭৩ খৃষ্টাব্দ) কানামি এবং জেয়ামি সম্পাদিত নোর কাছে ক্যিওগেন একটি অতি সাধারণ এবং হাস্যকর ছোট নাটক ছিল যা আজকের পরিচিত শৈলী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল এবং ক্যিওগেনের অভিনয়শিল্পীরা ছিলেন কোনো না কোনো নো দল-নিয়ন্ত্রিত । মুরোমাচি যুগের শেষের দিকে, ক্যিওগেন জাপানী থিয়েটারের একটি বিশেষ রূপ হিসাবে বিকশিত হয়েছিল এবং কাইজেন অভিনয়শিল্পীদের দ্বারা ওকুরা স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদো যুগে (১৬০৬-১৮৬৮) সাগি স্কুল এবং ইজুমি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে তোকুগাওয়া শোগুনেত ক্যিওগেন এবং নো-কে এদো যুগের আনুষ্ঠানিক শিল্পকলা হিসেবে মনোনীত করেছিল, তাই এই তিনটি বিদ্যালয়ের ক্যিওগেন শিল্পীদের তোকুগাওয়া শোগুনেত, দাইম্যিও (সামন্ত প্রভু) এবং রাজসভা দ্বারা নিযুক্ত করা হয়েছিল । ফলস্বরূপ ক্যিওগেনও ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছিল।
পরবর্তীকালে কাবুকি থিয়েটারের বিকাশে ক্যিওগেনের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। আধুনিক জাপানে, ক্যিওগেন আলাদাভাবে এবং নো এর অংশ হিসাবে সঞ্চালিত হয়। বর্তমানে ক্যিওগেনের তিনটি পর্যায়ে লক্ষ্য করা হয় । এক- পৃথক কমিক ক্যিওগেন নাটক, দুই- নোহ নাটকের (আন্তঃ-নোহ) মধ্যে পরিবেশিত হয়, যা হোন্-ক্যিওগেন বা প্রকৃত ক্যিওগেন নামে পরিচিত,অন্যটি হল নন-কমিক, যেটি আইক্যিওগেন বা বেৎসুক্যিওগেন নামে পরিচিত। বেৎসুক্যিওগেনের সময়ে প্রায়শই প্রধান নো অভিনেতা (শিতে) মঞ্চ ছেড়ে চলে যান এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন একজন ক্যিওগেন অভিনেতা, যিনি দর্শকদের সুবিধার্থে নাটকটি ব্যাখ্যা করেন।
বুনরাকু
বুনরাকু একটি ঐতিহ্যবাহী জাপানি পাপেট-শো (ছবি-৩) যা সপ্তদশ শতকে শুরু হয়ে মূলত ওসাকা অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল। বুনরাকু পুতুলরা জোরুরি (এক ধরণের জাপানী গীত শৈলী) ও শামিসেনের (একটি জাপানী বাদ্যযন্ত্র) সাথে তাল রেখে নাট্য পরিবেশন করে। ১৮৭২ সালে, ওসাকায় “বুনরাকু-জা” নামে পুতুল থিয়েটারের জন্য একটি বিশেষ থিয়েটার নির্মিত হয়েছিল । বর্তমানে “বুনরাকু” এবং “নিঙ্গিয়ো জোরুরি” শব্দদুটি পুতুল থিয়েটারকে নির্দেশ করে।
মঞ্চে, প্রতিটি পুতুল তিনজন কুশীলব দ্বারা চালিত হয়। এই সকল কুশীলবরা আসলে পুতুলনাচিয়ে বা পাপিটিয়ার। তাঁরা মুখ ঢেকে থাকেন একটি ফ্ল্যাপের সাহায্যে আর কালো পোশাক পরে থাকেন। একজন কুশীলব পুতুলের মাথা এবং ডান হাত,অপর একজন বাম হাত এবং অন্য আরেকজন পা নিয়ন্ত্রণ করেন। মহিলা পুতুলেদের পা থাকে না । সেক্ষেত্রে তৃতীয় কুশীলব দক্ষতার সাথে পুতুলের স্কার্টগুলিকে হেরফের করে হাঁটা এবং পায়ের অন্যান্য নড়াচড়াকে প্রতীয়মান করেন। সম্পূর্ণ নাটকটি পরিবেশিত হয় বিশেষ কিছু গান ও শামিসেনের মূর্চ্ছনার আবেশে। এই কারণে বুনরাকুকে নিঙ্গিয়ো জোরুরি অর্থাৎ পুতুল-গাথাও বলা হয় ।
পুতুল নাট্যশিল্প হেইয়ান যুগ(৭৯৪ – ১১৯২ খৃষ্টাব্দ) থেকে চলে আসছে। অন্যদিকে, মুরোমাচি যুগের শেষের দিকে (১৩৯২ – ১৫৭৩ খৃষ্টাব্দ) বিভিন্ন ধরণের গল্প বলা এবং সঙ্গীতের মধ্যে, জনপ্রিয় ছিল জোরুরি-হিমে বা জোরুরি রাজকুমারীর গল্প। এই কাহিনীতে একজন মহিলাকে প্রধাণ চরিত্র রূপে কল্পনা করে একটি প্রেমের গল্প বলা হত। বিওয়া (জাপানি বাদ্যযন্ত্র) সহযোগে তা পরিবেশিত হত। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য অনুষ্ঠানও যোগ করা হয়, কিন্তু রাজকুমারী জোরুরির গল্পটি অত্যন্ত বিখ্যাত হওয়ায় ওই বিভাগে বলা সব গল্পকেই জোরুরি বলা হত। যে ধারা এখনও চলে আসছে । প্রায় একই সময়ে, শামিসেন নামের বিখ্যাত জাপানী বাদ্যযন্ত্রটিও উদ্ভব হয়েছিল। এটি ওকিনাওয়াতে ব্যবহৃত এক ধরণের যন্ত্রের একটি উন্নত সংস্করণ। যেহেতু সাধারণ মানুষ শামিসেনের সুমিষ্ট ধ্বনি পছন্দ করেছিল তাই শামিসেনকে বিওয়ার বদলে জোরুরির একটি অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
কাবুকি
ঐতিহ্য অনুসারে কাবুকির উদ্ভব হয়েছিল ১৫৮৬ সালে কিয়োতোতে । সেই বছরে ওকুনি নামের ইজুমো মন্দিরের এক নর্তকী একটি নতুন থিয়েটার ফর্ম শুরু করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে কাবুকি নামে পরিচিত হয়েছিল। কাবুকি শব্দটি তিনটি চীনা অক্ষর বা চিত্রলিপির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে- কা,বু (অর্থ সংগীত ও নৃত্য) এবং কি (মানে দক্ষতা)। সুতরাং এককথায় কাবুকি শব্দের অর্থ গান এবং নাচের দক্ষতা। অন্য ভাবে বললে, এটির অর্থ শব্দ এবং সঙ্গীতের সমন্বয়, নৃত্যের সমস্ত আংগিক দক্ষতার সাথে সম্পাদন করা । কালক্রমে কাবুকি, জাপানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় নাট্য শিল্পে পরিণত হয়েছিল। ষোড়শ/ সপ্তদশ শতাব্দীতে জাপানের বেশিরভাগ মন্দিরই শিন্তো (জাপানের আদি ধর্ম বিশ্বাস) ও বৌদ্ধ মাতাদর্শের এক মেলবন্ধনে বাঁধা ছিল। সেই সময় মন্দিরের কর্তৃপক্ষ মন্দিরের জন্য অনুদান ও তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর মন্দিরের নর্তকীদের প্রেরণ করতেন সাধারণের মনোরঞ্জনের অভিপ্রায়। এই ভ্রাম্যমান নৃত্যশিল্পীরা মূলত মহিলাদের দ্বারা গঠিত ছিল এবং জাপানে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তাদের মধ্যে ইজুমো মন্দিরের ওকুনি (ছবি-৪) কাবুকি নামে এক বিশেষ ধরনের নৃত্য পরিবেশন করতেন। ওকুনির নৃত্যদলও প্রধাণতঃ মহিলাদের দ্বারা গঠিত ছিল । কিন্তু ১৬১০ সালে ওকুনির মৃত্যুর পরে সেই দলে কিছু পুরুষ নর্তক যোগদান করেছিলেন। যদিও পুরুষ অভিনেতা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিলেন, তবুও ১৬২৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত নারী অভিনেতারাই মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করতেন। কিন্তু ১৬২৯ খৃষ্টাব্দে শোগুনেত (সামুরাই) সরকার মহিলাদের মঞ্চ অভিনয়ে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করার পরে সুদর্শন কমবয়সী পুরুষ অভিনেতারা মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন । আর এক আশ্চর্যের ব্যাপার হল যদিও এই কাবুকি নৃত্যধারার প্রবর্তক এক মহিলা কিন্তু সেই ১৬২৯ খৃষ্টাব্দ থেকে এখনও পর্যন্ত পুরুষরাই সমস্ত চরিত্র অভিনয় করে চলেছেন (ছবি-৫)।
কাবুকি থিয়েটার তোকুগাওয়া শাসক সুয়ানোশির রাজত্বকালে বা গেনরোকু যুগে (১৬৮৮ থেকে ১৭০৩ খৃষ্টাব্দ) সর্বাপেক্ষা উন্নতি লাভ করে। এই সময়ে কাবুকির জন্য এক বিশেষ মঞ্চের অবতারণ হয়। ওকুনি তাঁর অভিনয় শুরু করেছিলেন ক্যিয়োতো শহরের নদীর তীরে এবং পরবর্তীকালে ক্রমে ক্রমে কোনো অভিজাত মানুষের বাড়ীর বাগানে ও পরে নো মঞ্চে তাঁর অভিনয় করার সুযোগ ঘটেছিল। কিন্তু গেনরোকু যুগে কাবুকিএর জন্য এক বিশেষ ধরনের মঞ্চ “মাওয়ারী বুতাই” নির্মিত হয় । সেইসময়কার এক বিখ্যাত নাট্যকার নামিকি সোজোর ধারণাতেই ঘূর্ণায়মান মঞ্চের (রিভোলভিং স্টেজ) ব্যবহার শুরু হয়। এই বিশেষ মঞ্চ শুরু হবার ফলে একই সংগে চারটি দৃশ্যকে সাজিয়ে রাখা যেত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাৎক্ষণিক পট পরিবর্তনের অসুবিধা হত না। এখন পর্যন্ত সেই ধারাই চলে আসছে । তফাৎ হল আগে কায়িক শক্তিতে মঞ্চ ঘোরানো হত আর এখন বৈদ্যুতিক শক্তিকে কাজে লাগান হয়।
তবে সম্ভবত জাপানি থিয়েটার নৈপুণ্যের সবচেয়ে কাবুকির চিত্তাকর্ষক অবদান হল হানামিচি (আক্ষরিক অর্থ ফুলের-পথ)। এটি মঞ্চের একটি দীর্ঘ সংকীর্ণ সম্প্রসারণ যা দর্শকদের মধ্য দিয়ে থিয়েটার হলের পিছনে চলে যায়। অভিনেতারা প্রায়শই এই হানামিচির মাধ্যমে প্রবেশ করেন বা বাইরে যান। তবে এটি মঞ্চের মূল প্রবেশদ্বার নয়। এই পথ দর্শক এবং অভিনেতাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সাধারণতঃ এই পথটি মূল মঞ্চের বাম দিকে থাকে। কিন্তু এই পথটিকে হানামিচি বা ফুলের পথ বলে হয় কেন সেই নিয়ে অনেক মতদ্বৈধতা আছে। কেউ কেউ বলেন ফুলের মত সুন্দর অভিনেতারা এই পথ দিয়ে যাতায়াত করেন বলে এর নাম হানামিচি। আবার অনেকে র মতে অভিনেতারা বেশিরভাগ সময়ে ফুলের সাজে সেজে যাতায়াত করেন বলে এর নাম হানামিচি। (ছবি-৬, কাবুকি মঞ্চ ও দর্শকাসন)
কাবুকি নাটককে তিনটি বিভাগে ভাগ করা যায়। ঐতিহাসিক নাটক, দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা বা ঘরোয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাটক,যা “সেওয়ামোনো” নামে পরিচিত এবং এছাড়া আছে নৃত্যনাট্য। সামগ্রিকভাবে কাবুকি সাহিত্যের সেরা গ্রন্থগুলির সর্বাধিক ঐতিহাসিক নাটকগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। সেগুলি যোদ্ধা, প্রভু এবং আমলাদের জীবন-ভিত্তিক নাটক। ঐতিহাসিক নাটকগুলি মূলত মিনামোতো এবং তিয়ারা গোষ্ঠীর যুদ্ধের ইতিহাস থেকে উপাদান গ্রহণ করে রচিত । বিখ্যাত যোদ্ধা ওদা নোবুনাগা (১৫৩৪ থেকে ১৫৮২ খৃষ্টাব্দ), তোয়োতোমি হিদেয়োশি (১৫৩৭ থেকে ১৫৯৮ খৃষ্টাব্দ)-র জীবন ভিত্তিক নাটকও কাবুকির এক বিশেষ আঙ্গিক। জীবন-কেন্দ্রিক নাটকে মূলত প্রেম,অর্থ ও সাধারণ জীবনের গল্পগুলো গুরুত্ব পেয়েছে। এই নাটকগুলি পুতুল-নাটকের ক্ষেত্রেও বিশেষ করে ব্যবহৃত হত। কাবুকিতে নাটকীয়তা আরোপ করার জন্য সবসময়েই বিভিন্ন শব্দকে প্রাধাণ্য দেওয়া হয়। তদুপরি, কাবুকি দর্শকদের কাছে মূল আকর্ষণ হল অভিনয়শিল্পী । নাটকের প্লট বা মূল পাঠের প্রতি বিশ্বস্ততা নয়। তারা তাদের প্রিয় তারকাদের সুপরিচিত ভূমিকায় উপভোগ করতে আসেন যা প্রায়শই একটি অভিনয় পরিবারের মধ্যে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রেষিত হয়। প্রতিটি অভিনেতা একটি অভিনয় ঘরাণা বা পরিবারের অন্তর্গত, যে নামে তাকে চিহ্নিত করা হয়। এইভাবে কাবুকি প্রথম থেকেই অভিনেতা কেন্দ্রিক থিয়েটার এবং নাট্যকার একটি গৌণ অবস্থায় থাকেন । পেশাগতভাবে একজন অভিনেতা এক নেতৃস্থানীয় অভিনেতার নেতৃত্বে গঠিত কোনো সংস্থার একটি অংশ। এই পেশাদার পরিবারে সদস্যরা কঠোর শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণের অধীনে শিক্ষানবিশের বছর অতিবাহিত করেন। প্রতিটি অভিনেতা দলের মধ্যে তার নির্ধারিত অবস্থানের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন যতক্ষণ না তিনি অন্য কোনো পদমর্যাদায় অগ্রসর হতে সক্ষম হন। প্রতি বছর শুউমেই নামের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে, এক একজন কাবুকি অভিনেতাকে একটি নতুন পেশাদার নাম দেওয়া হয় যা উচ্চ পদমর্যাদার ইঙ্গিত দেয়। শুউমেইতে পাওয়া স্বীকৃতি তাদের বর্ধিত শক্তি এবং প্রভাবকে প্রতিনিধিত্ব করে যা তিনি অভিনয় জগতের মধ্যে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
নিয়মিত অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি, মঞ্চ-সহকারী (বা কোকেন) একটি মূল্যবান দায়িত্ব পালন করেন। কোকেনরা নৃত্যনাট্যের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়, যেখানে তাঁরা প্রধান অভিনেতাকে মঞ্চেই পোশাক পরিবর্তন করতে সাহায্য করেন বা মঞ্চ থেকে অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম (প্রপস্) সরিয়ে দেন। দর্শকদের চোখের সামনেই সবকিছু ঘটে। কোকেনরা সাধারণত কালো পোষাক পরিধান করেন,যা তাদের প্রায় অদৃশ্য করে তোলে।
শিনপা জাপানী থিয়েটারের একটি আধুনিক রূপ। শিনপা (আক্ষরিক অর্থে নতুন ঘরাণা) নামটি ব্যবহৃত হয় এই আধুনিক রূপকে কিউহা (পুরানো ঘরাণা) থেকে আলাদা করার জন্য। এই পৃথকীকরণের কারণ হল এই থিয়েটারগুলিতে সমসাময়িক এবং বাস্তবসম্মত গল্পের অবতারণা। ১৯৮০-র দশকে জাপান শোগেকিজো, আক্ষরিক অর্থে ছোট থিয়েটার তৈরিতে উৎসাহিত হয়েছিল। এর অর্থ সাধারণত অপেশাদার নাট্যদল যে কেউ এবং প্রত্যেকের দেখার জন্য নাটক তৈরি করত । এইসব নাটক প্রকৃতিতে ততটা অর্থবহ নয় যতটা তারা কেবল বিনোদনমূলক ছিল । সম্প্রতি, শোগেকিজো শিল্পীদের নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব হয়েছে যাদেরকে হারানো দশকের প্রজন্ম বা ২০০০ এর প্রজন্ম হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রজন্মের মধ্যে প্রধান শিল্পীরা হলেন: তোশিকি ওকাদা, শিরো মায়েদা, কুরো তানিনো, দাইসুকে মিউরা, তোমোহিরো মায়েকাওয়া এবং অন্যান্যরা।
শিল্প,সংস্কৃতি ও নান্দনিকতার পূজারী জাপানীদের সভ্যতায় প্রতিনিয়তই নাট্যশিল্পও ক্রমবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে উন্নীত হচ্ছে। ঐতিহ্য বজায় রেখে আধুনিকতার সাথে মিশে গিয়ে জাপানি নাট্যশিল্প ধীরে ধীরে নতুন মাত্রা পেয়ে চলেছে।