ঘোষক। পেশেন্ট অন্তরা মিত্র, পেশেন্ট অন্তরা মিত্র, পেশেন্ট অন্তরা মিত্রর বাড়ি থেকে যদি কেউ উপস্থিত থাকেন, অবিলম্বে 'অনুসন্ধান' বিভাগে যোগাযোগ করুন।
অনলাভ। (উদ্বিগ্ন মুখে দ্রুত 'অনুসন্ধান'-এ পৌঁছোয়) আমি অন্তরা মিত্রর হাজব্যাণ্ড।
অনুসন্ধান-সহায়িকা। অন্তরা মিত্র? তিনশো এগারোয় চলে যান, মেট্রনের সঙ্গে কথা বলবেন।
অনলাভ। পেশেন্ট ভাল আছে তো?
সহায়িকা। মেট্রনের সঙ্গে কথা বলুন। (অনলাভকে পেরিয়ে পিছনে অপেক্ষমান ব্যক্তিকে) হ্যাঁ, আপনার?
অনলাভ। দেখুন, আমি অন্তরা মিত্রর বাড়ি থেকে আসছি।
নার্স। (ফাইল ওলটাতে ওলটাতে) আপনি কে হন?
অনলাভ। হাজব্যাণ্ড। ভালো আছে তো?
নার্স। আই-সি-ইউ থেকে তিনশো এগারোতে শিফ্ট্ করা হয়েছে। আপনি দেখা করতে পারেন। আপনাদের গাইনিক ডক্টর দীপিকা সেন আর আই-সি-ইউ ইনচার্জ জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে দেখা না করে যাবেন না।
অনলাভ। ঠিক আছে, তাহলে এখন ঢুকবো তিনশো এগারোতে?
নার্স। হ্যাঁ হ্যাঁ, যান। পেশেন্ট জেগেই আছে। (অনলাভ তিনশো এগারোতে সন্তর্পণে ঢোকে, অন্তরা শুয়ে আছে, কপালে এবং নাকে স্টিকিং প্লাস্টার। অনলাভ আস্তে কাশে)
অন্তরা। এলে? আমি এক ঘন্টা ধরে শুয়ে আছি একা একা। আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাও।
অনলাভ। বাড়িতে নিয়ে যাব বলেই তো এলাম অন্তু। এখন গাইনিকোলজিস্ট আর আই-সি-ইউ ইনচার্জের সঙ্গে কথা বলতে হবে। দেখা যাক ওঁরা কী বলেন। অনুমতি পেলেই নিয়ে যাব।
অন্তরা। আমাকে তো দুজনেই বললেন আমি ভালো আছি।
অনলাভ। তুমি তো ভালো আছ আমিও দেখতে পাচ্ছি। আর অন্যটা? সেটা কেমন আছে?
অন্তরা। সেটাও। দীপিকা সেন বললেন কোন ক্ষতি হয়নি।
অনলাভ। বললেন? বাঁচা গেল। হাসপাতালের লোকগুলো অযথা ভয় দেখায়। রিসেপশনে বসে আছি, মাইকে তিনবার করে তোমার নাম বলে দেখা করতে বললো। এমন ভাবে বললো, আমি তো ঘাবড়ে গেছি। জিজ্ঞেস করলাম, পেশেন্ট ভালো আছে তো। কোন জবাব দিল না, বললো মেট্রনের সঙ্গে দেখা করুন। কেমন লাগে বল তো?
অন্তরা। (মৃদু হেসে ― কণ্ঠস্বরে তৃপ্তির আভাস) কেমন লাগে?
অনলাভ। যেদিন আমি এসে এরকমভাবে শুয়ে থাকব, আর তুমি দেখা করতে আসবে, সেদিন বুঝবে কেমন লাগে।
অন্তরা। তুমি শুয়ে থাকবে? পেটে বাচ্চা নিয়ে?
অনলাভ। হ্যাঁ, সে টুকুই বাকি আছে। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
জ্যোতির্ময়। হ্যালো ইয়ং ম্যান, বউকে কেমন দেখছেন?
অনলাভ। সেটা তো আপনি বলবেন ডাক্তারবাবু।
জ্যোতির্ময়। ও, আমি বলব? শী ইজ ফিট অ্যাজ আ ফিড্ল্ অ্যাকর্ডিং টু মী, কিন্তু আজই নিয়ে যেতে পারবেন না। আর একটা দিন রাখতে হবে।
অনলাভ। আরও একটা দিন?
জ্যোতির্ময়। (অনলাভর পিঠ চাপড়িয়ে চোখটা টিপে) আরে, ভালোই তো হলো। যেখানে আপনার স্ত্রী শুয়ে আছেন সেটা কী জানেন? সেটা আমাদের এই হসপিটালের মহারাজা, থুড়ি, মহারানি সুইট। মেট্রনকে বলে দেব: আপনার আনরেস্ট্রিক্টেড, মানে অবাধ, যাতায়াত। এই সুযোগে আর একটা মধুচন্দ্রিমার সুযোগ ছাড়বেন কেন? ওয়েল, অন আ সীরিয়াস নোট, নাকে যে প্লাস্টারটা দেখছেন, ওটা এমন কিছু নয়, লেফ্ট্ টু ইটসেল্ফ্ নিজে নিজেই সেরে যাবে। মাথাটা অবিশ্যি আপনাদের অবস্টেট্রিশিয়ান আর একবার দেখতে চান। কিন্তু ঘাবড়াবেন না। জাস্ট কনসিভ করেছেন তো, ব্রেন কণ্ডিশনটা একটু দেখে নিতে চান উনি, এক দিনেই হয়ে যাবে।
দীপিকা। (অন্তরার দিকে তাকিয়ে, হেসে) কী, ভালো তো? (অনলাভকে) কেমন দেখছেন স্ত্রীকে?
অনলাভ। আমি আর কী বুঝি, আমি তো শুধু নাকে আর কপালে প্লাস্টার দুটোই দেখতে পাচ্ছি।
দীপিকা। হ্যাঁ, ওই প্লাস্টারের কথাটাই বলছিলাম। নাকটা বিশেষ কিছু নয়, ই-এন-টি স্পেশালিস্ট দেখেছেন, রক্ত খানিকটা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু মেজর কোন ইনজুরি হয়নি। ফীটাল ইনজুরিও নেই, থাকবার কথাও নয়, পড়েছেন তো ফেস ডাউন। কিন্তু মাত্র ফাইভ উইক্সের কনসেপশন, আমি একটা ব্রেন স্ক্যান করিয়ে নিউরোলজিস্টের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন কোন মেজর ইশ্যু নেই, তবুও হাসপাতালে ভর্তি যখন হয়েইছেন, চান্স নেব কেন? ডক্টর রয় বলেছেন, কালই ছেড়ে দেবেন, আজও বিশেষ কিছু রেস্ট্রিকশন থাকবে না। আপনি যতক্ষণ ইচ্ছে থাকতে পারেন আজ। আমি তো বলব থেকেই যান কিছুক্ষণ, কম্পানী দিন স্ত্রীকে, মনটা ভালো থাকবে। কাল সকালেই স্ক্যান হবে, নিউরোলজিস্টও এসে যাবেন, দুপুরের মধ্যেই ছেড়ে দিতে পারব আশা করছি। ও কে, আসি। ভালো থেকো অন্তরা, বাই। (বেরিয়ে যায়)
জ্যোতির্ময়। রাইট ইয়ং ম্যান, এনজয় ইয়োরসেল্ফ্। (বেরিয়ে যায় – ডক্টর জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে সঙ্গে বেরোয় অনলাভও, একটু পর ফিরে আসে, একটা চেয়ার অন্তরার 'বেড'-এর কাছে টেনে, অন্তরার একটা হাত ধরে বসে) ।
অনলাভ। ডক্টর রায় বললেন তুমি খুব ভালো আছো, চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু একটা কথা তোমায় বলি, এবার থেকে তুমি গাড়িটা নিয়েই অফিসে যেও। তোমাদের ওই পূল-কার বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে ছেড়ে দিয়ে যাবে, আর হেঁটে হেঁটে আসতে গিয়ে আবার কবে কলার খোসায় স্লিপ করবে...
অন্তরা। কলার খোসায় স্লিপ জীবনে এই প্রথমবার করলাম আমি, ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট, একটা একসেপশন, ওটা রোজ রোজ হয় না।
অনলাভ। না হোক, কিন্তু গাড়িটা তো কোন কাজেই লাগেনা, আমিও পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করি, তুমিও পূল কারে।
অন্তরা। কোন কাজে লাগে না তোমাকে কে বলল। মা তো ব্যবহার করেন।
অনলাভ। হ্যাঃ, মা'র আবার ব্যবহার! মা'র তো কালেভদ্রে বাজার যাওয়া আর কখনো সখনো রামকৃষ্ণ মিশন।
অন্তরা। তা ঠিক, কিন্তু স্বাধীনতাটা? ইচ্ছে করলেই বেরোতে পারার স্বাধীনতাটা? সেটার দাম নেই?
অনলাভ। ঠিক আছে, আমি মাকে দিয়েই তোমায় বলাবো।
অন্তরা। একেবারেই নয় অনলাভ, একেবারেই নয়। মাকে তুমি এই তর্কে একেবারেই জড়াবে না।
অনলাভ। আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে তর্কে লাভ নেই। আচ্ছা, গাইনিকোলজিস্ট তোমাকে কী বললেন?
অন্তরা। উনি তো বললেন সব ঠিকই আছে।
অনলাভ। এই যে এদের 'সব ঠিক আছে' ― এর মানে আমি বুঝিনা। স্পেসিফিকালি বলে না কেন? উনি তোমাকে বললেন ঠিক আছে, আর ডক্টর রয় আমাকে বলছেন, এখনই কী বোঝা যাবে! এখন তো সবেমাত্র পাঁচ সপ্তাহ! কোন্টা ঠিক?
অন্তরা। আমার তো মনে হয় দুটোই ঠিক। তুমি জানো, পাঁচ সপ্তাহে কতটুকু ডেভেলপমেন্ট হয়? হতে পারে? একটা সেল। কনসেপশন মানে একটা মাত্র সেল-এর প্রাণস্পন্দন। সেই একটা সেল-এর ডেভেলপমেন্টের গতি তুমি জান? কল্পনা করতে পার? একটা, মাত্র একটা সেল থেকে বাড়তে বাড়তে শিশুর জন্মের দিন সেল-এর সংখ্যা দাঁড়ায় কুড়ি হাজার কোটি। প্রতিদিনের পরিবর্তনের হারটা ভাবতে পারছ? ডাক্তারদের হিসেবে আমার পাঁচ সপ্তাহের গর্ভ। পাঁচ সপ্তাহে সেল-এর সংখ্যা কত হয় আমি ঠিক ঠিক জানিনা, কিন্তু একটা লেখায় পড়েছি প্রথম সাত সপ্তাহে সেল-এর সংখ্যা বেড়ে তের কোটি। একটা থেকে শুরু, সেখান থেকে তের কোটি। যদিও অনেক, কিন্তু কুড়ি হাজার কোটির তুলনায় কতটা আর বল! তার মানে, মানুষটার প্রায় কিছুই এখনও তৈরিই হয়নি। এরই মধ্যে ভালো-খারাপ কী বলবে ডাক্তার? বাইরে থেকে বড়জোর ডাক্তার বুঝবে সেলগুলোয় প্রাণ আছে কিনা। থাকলেই, ভালো আছে। আর, আমিও তাই খুশি।
অনলাভ। সত্যি অন্তু, তোমাকে আমি যত দেখি, ততই অবাক হয়ে যাই। এত কিছু তুমি জানলে কী করে? সেল-এর সংখ্যা-টংখ্যা?
অন্তরা। বাঃ, জানতে হবে না! মা হতে চলেছি, এসব জানব না?
অনলাভ। তুমি মা হতে চলেছ, তাহলে আমিও তো বাবা। আমারও তো সন্তান।
অন্তরা। (হেসে) বাবা হবার সুবিধে! ঝাড়া হাত-পা!
অনলাভ। আচ্ছা অন্তু, একটা সত্যি কথা বলবে? তুমি ছেলে চাও না মেয়ে?
অন্তরা। তুমি?
অনলাভ। আমি মেয়ে চাই। তোমার মতো দেখতে।
অন্তরা। উঁহুঁ, মেয়ে হলে বাবার মতো। শোননি, পিতৃমুখী মেয়ে সুখী...
অনলাভ। সে যেমনই দেখতে হোক, তোমার মতো যেন বুদ্ধি হয়।
অন্তরা। বল কী, ওর বাবা যে ইকোনমিক্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট!
অনলাভ। আর মা যে ম্যাথ্ম্যাটিক্সে ফার্স্ট ক্লাস। ফার্স্ট যে নয়, সে তো রাইটারের দোষে। রাইটার তো ম্যাথ্ম্যাটিক্সের আদ্দেক সিম্বলই চেনে না, আর ফিগারও আঁকতে পারে না। চোখ থাকলে অন্তু, তুমি তো পৃথিবী কাঁপিয়ে দিতে পারতে।
অন্তরা। তাই তুমি ভাব, আমি পৃথিবী কাঁপাবার লোক?
অনলাভ। তুমি কাঁপাবার লোক কিনা আমি জানিনা, কিন্তু পৃথিবীটা কেঁপে যেত। যাক্গে সে কথা, কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলি। তোমার সব কথা মানি, সব কথাই। শুধু একটাই ইচ্ছে আমার, প্রবল। আজ এই সব কথা ওঠার অনেক আগে থেকেই আছে।
অন্তরা। কী ইচ্ছে, কী?
অনলাভ। ছেলে বা মেয়ে, যা-ই হোক আমাদের, সে দেখতে হোক তোমার মতো, তোমারই মতো। তবু... তবু... বলব? বলব অন্তু?
অন্তরা। বল না কী বলবে।
অনলাভ। শুধু যেন তার চোখ থাকে। আমার মতো পুরু লেন্সের চশমা পরা চোখও যদি হয়, তবুও, চোখ যেন থাকে তার।
অন্তরা। যা আমার মধ্যে পাওনি, সন্তানের মধ্যে তা-ই পেতে চাও, অনলাভ?
অনলাভ। না না, ঠিক সেভাবে নয়। কিন্তু অন্তরা, তুমি তো কখনো দেখনি নিজেকে, তুমি জানই না, কী অপূর্ব সৌন্দর্য তোমার। শুধু তোমার কণ্ঠস্বর নয়, তোমার দেহের রূপ, ঈষৎ অবনতশির তোমার দাঁড়াবার ভঙ্গী, গভীর চিন্তায় তোমার কপালের ভাঁজ, লজ্জা পেয়ে অল্প-লালের আভাস তোমার গালদুটিতে, প্রবল খুশিতে তোমার হাসি, তুমি তো দেখনি অন্তু।
অন্তরা। দেখিনি তো নিশ্চয়ই, আমি দেখিনি নিজের চোখে, কিন্তু এতদিন ধরে তুমি স্পষ্ট করে না বললেও তোমার কণ্ঠস্বরে আমার মনের গভীরে ― ওই যে, জীবনানন্দ যাকে বলেছেন গভীর গভীরতর ― ঐ গভীর গভীরতর মনের গহ্বরে আমি দেখেছি বৈ কি। কিন্তু সেটা কথা নয় অনলাভ, এতদিন তোমার স্বরে যা বুঝিনি, তা হলো আমার মৃত চোখদুটির অহরহ তোমাকে কষ্ট দেওয়া, যে কষ্টের কান্না আজ শুনতে পেলাম তোমার গলায়।
অনলাভ। তা নয় অন্তু, তা নয়। আমি বোধ হয় তোমাকে বোঝাতে পারিনি। তোমার চোখকে কখনো আমার মনে হয়নি মৃত, কিন্তু, কিন্তু যখনই কোন ব্যাপারে তোমার উচ্ছ্বাস দেখি, তোমার চোখ কোন কথা বলে না। কোন কথা বলে না অন্তু, নীরব থাকে। আমি তখন ভাবি, যদি অন্য সব অবয়বের মতো চোখদুটোরও অভিব্যক্তি থাকত অমন, কী হত তাহলে?
অন্তরা। সেই অভিব্যক্তি পরম আনন্দের হত, মনে কর তুমি? আর যদি না হত? যদি চোখের অভিব্যক্তির এতটুকু ছোট একটা কণা শরীরের অন্য অবয়বগুলোকে একটু একটু করে ছোট করে দিত? তোমার-আমার মস্তিষ্ক আছে, আছে সব মানুষের, সব প্রাণীর। কোন শারীরতত্ত্ববিদকে জিজ্ঞেস করে দেখো তো, কোন প্রাণী তার মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ ব্যবহার করে কিনা? কেউ না অনলাভ, কেউ করে না। অবয়ব থাকলেই তার ব্যবহার হবে, এ কথা কে তোমাকে বলল? কে জানে, হয়তো আমার চোখ নেই বলেই আমার কান অনেক বেশি শোনে, আমার হাত দুটো আর শরীরের অন্য অঙ্গগুলো অনেক বেশি অনুভব করে, হয়তো অনেকের চেয়েই ঘ্রাণশক্তি আমার অনেক বেশি, হয়তো অনেক বেশি গুছিয়ে কথাও বলতে পারি আমি, কে জানে! ঐ যে যে সৌন্দর্যের কথা তুমি বললে, হয়তো চোখ নেই বলেই অত তুমি সুন্দর দেখো এগুলোকে! চোখ থাকলে হয়তো এগুলো কমে যেত! কী হত, কেউ কি বলতে পারে অনলাভ?
অনলাভ। তা জানি না, কিন্তু ঐ যে বললে অনেক বেশি গুছিয়ে কথা বলার কথা, সেটা হয়তো সত্যি। তাই তোমরা যখন কথা বল ― তুমি অথবা সন্তু ― কখনোই তোমাদের যুক্তি আমি খণ্ডন করতে পারিনা। কিন্তু তবুও, তবুও অন্তু, আমাদের সন্তানের যদি দৃষ্টিশক্তি থাকে, আমি যে খুশি হব, এটাই সত্যি।
অন্তরা। তুমি সত্যি কথা বল তা আমি জানি অনলাভ। আমার সন্তান যদি দৃষ্টিশক্তি নিয়ে জন্মায় তাহলে আমি অখুশি হব এ কথা মনে কোরো না। কিন্তু বিশেষ করে দৃষ্টিশক্তি চাইব কেন, তা আমি বুঝি না। এই যে তুমি একটা একটা করে এতগুলো গুণের কথা বললে আমার ― আজ বুঝলাম ― সত্যি সত্যি এতদিন বুঝিনি ― সেগুলোকে তুমি ― ঐ যে ইংরিজিতে বলে না, টেক্ন্ ফর গ্র্যাণ্টেড ― ওগুলো তো ঐরকমেরই হওয়ার কথা ― সেরকমটাই ধরে নিয়েছ! আর যা পাওনি, তোমারই ভাষায় আমার জীবনের-চেয়েও-জীবন্ত মুখাবয়বে এক জোড়া বাক্যহারা চোখ ― তা-ই তোমাকে অহরহ কষ্ট দিয়েছে। আমি যা, তা তুমি মেনে নিতে পারনি, আমি যা নই, তাই নিয়ে কষ্ট পেয়েছ এতদিন।
অনলাভ। এ তুমি কী বলছ অন্তু, তুমি যা, আমি মেনে নিতে পারিনি! এ সত্যি নয় অন্তু, এ সত্যি নয়। তুমি যা ― তা-ই আমার সুন্দর, কিন্তু সুন্দরের চেয়েও সুন্দরতর কি মানুষ খোঁজে না তার সন্তানের মধ্যে?
অন্তরা। আসলে যেটা তুমি বোঝোনি অনলাভ তা হল আমরা ― মানে সন্তু আমি আর অন্যান্য অন্ধ মানুষদের কথা বলছি ― আমরা সাধারণ নই, সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশ নই, আমরা ব্যতিক্রম। জ্ঞান হবার পর থেকেই এই একটা কথা বারবার শুনে আসছি বাবামায়ের কাছ থেকে: আমরা ব্যতিক্রম, কারো চেয়ে ছোট নই বা বড়ও নই। আমরা যা, আমরা তা-ই। আমরা তো আমরাতর হতে পারিনা অনলাভ, এ-ও মানতে পারিনা যে অন্ধত্ব এক ধরণের পঙ্গুতা। আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ যখন বলছি তখন কাদের কথা বলছি তুমি নিশ্চয়ই বোঝ, যাদের সব কটা অঙ্গ ― ইন্দ্রিয় ― অন্তত বাইরে থেকে অটুট। আর এই অটুট ইন্দ্রিয়ের দম্ভই তাদের যুগ যুগ ধরে নিজেদের শ্রেয়তর ভাবতে শিখিয়েছে।
অনলাভ। না না না, এ কী বলছ অন্তু! আমি একবারের জন্যেও তা ভাবিনা। অন্তত তুমি আর তোমার বোন তো দেখিয়েই দিয়েছ, বেশির ভাগ দৃষ্টিপ্রাপ্ত মানুষের তুলনায় তোমরা কত সফল।
অন্তরা। তুমি স্কুল-কলেজের পড়ার কথা বলছো তো? সেই সাফল্য? হয়তো দেখিয়েছি সেই সাফল্য, কিন্তু কী আসে যায় তাতে? যদি না পারতাম, ধর, আমরাও আর পাঁচ জনের মতোই সাধারণ ফল করতাম পরীক্ষায়, তাহলেই তো আমরাও করুণার পাত্র হয়ে যেতাম। আর শুধুমাত্র চোখ না থাকার অপরাধেই অন্যদের তুলনায় কতটা ছোট হয়ে যেতাম ভাব তো। দৃষ্টিপ্রাপ্ত যারা আমাদের চেয়েও খারাপ ফল করেছে তাদেরও তুলনায় কতটা ছোট! আমি তোমাকে দোষ দিই না অনলাভ, আমার কোন ক্ষোভ নেই। আমাদের এই 'ভারতমাতা' সেই আদিযুগ থেকে আমাদের এইরকম ভাবেই ভাবতে শিখিয়েছে। মহাভারত কে লিখেছিলেন মনে আছে তোমার?
অনলাভ। থাকবে না কেন, মহাকবি ব্যাস।
অন্তরা। উঁহু, ব্যাস নয় ব্যাস নয়, লিখেছিলেন গণেশ। দ্রুত লেখার ক্ষমতা ছিল না ব্যাসদেবের, তাঁর অপটুতা ছিল লেখায়। আঙুল হয়তো ছিল, কিন্তু তাঁর নিজের মনের সঙ্গে তাল রাখতে পারতো না তাঁর আঙুল। আমরা অন্ধ, পরীক্ষার সময় আমরা 'রাইটার' নিয়ে পরীক্ষা দিই। চোখ থাকতেও ব্যাসদেব রাইটার নিলেন, কিন্তু অন্ধদের তিনি ছেড়ে কথা বললেন না। আমি তোমাকে মহাভারতের গল্প শোনাতে চাই না, তা তুমি ভালোই জানো। কিন্তু ভেবে দেখ, বৃদ্ধ, কুৎসিতদর্শন, কটুগন্ধদেহ ব্যাস যখন তাঁর ভ্রাতৃবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদনের কন্ট্র্যাক্টটা নিলেন, তখন ভীত ভ্রাতৃবধূর ভয়ে-চোখ-বুজে-ফেলাটাকে মানতে পারলেন না তিনি। অভিশাপ দিলেন, তোর গর্ভে যে আসবে, সে দৃষ্টিহীন হবে।
অনলাভ। এ সব কথা বলছ কেন অন্তু?
অন্তরা। বলতে দাও, বলতে দাও আমাকে। একটু ধৈর্য ধর, কেন বলছি বুঝবে। ধৃতরাষ্ট্র। জন্মান্ধ। অতএব মানুষটাও সে ভালো নয়, ব্যাসদেব তার মধ্যে কোন গুণ দেখালেন না। একটি ছাড়া। সে প্রবল শক্তিশালী। অমিতশক্তিধারী, হাতির বল তার। সেই শক্তিকে সে কীভাবে কাজে লাগায়? আলিঙ্গনবদ্ধ লৌহভীমকে সে প্রবল ক্রোধে হিংসায় প্রবলশক্তিতে চুরমার করে দেয়, এমন সে দয়াহীন, এমন তার প্রতিশোধস্পৃহা। অথচ তারই স্ত্রী গান্ধারী, যে জন্মান্ধ নয় কিন্তু স্বামীর দুর্ভাগ্যের শরিক হিসেবে স্বেচ্ছাদৃষ্টিহীনা, সে কিন্তু সর্বগুণের আধার। যুগ যুগ ধরে আমাদের সভ্যতার জনকরা এই তো শিখিয়েছেন আমাদের। মাঝে-মধ্যে এক-আধজন অন্ধমুনিটুনি এসেছেন যাঁরা ততটা খারাপ ন'ন, কিন্তু অভিশাপ দেওয়ার সময় তাঁদের প্রতিশোধস্পৃহাও চমকিত করে আমাদের। কাজেই অনলাভ, সন্তান যেন দৃষ্টিহীন না হয় ― এ প্রার্থনা তো সব ভারতীয়েরই!
অনলাভ। হ্যালো, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি হাসপাতালে...ভালো আছে... হ্যাঁ হ্যাঁ ভালো আছে...কাল ছাড়বে...না না একটু নিউরোলজিস্টের ওপিনয়ন নেবে তাই...হ্যাঁ গাইনিকের সঙ্গে কথা বলেছি...আপনি অন্তুর সঙ্গে কথা বলবেন?
অন্তরা। বাবার ফোন? লাউডস্পীকারে দিয়ে দাও না, তিনজনেই একসঙ্গে কথা বলতে পারব।
অনলাভ। আচ্ছা। (ফোনটা লাউডস্পীকার করে অন্তরাকে দিয়ে দেয়)
অন্তরা। কেমন আছ বাবা?
ফোনে বাবা। আমরা ভালো আছি, তুই কেমন আছিস মা? কোন... ফ্র্যাকচার ট্যাকচার...
অন্তরা। না বাবা, ফ্র্যাকচার ট্যাকচার কিচ্ছু হয়নি, একটু কেটে-কুটে গেছে, একদিন পুরো ওরা আই-সি-ইউ-তে রেখেছিল, অনেক পরীক্ষা করেছে, একেবারে ঠিক আছি বাবা, তোমরা কিন্তু আজ হাসপাতালে আসার চেষ্টা কোরো না, কাল ছুটি দিয়ে দেবে, তারপর আমরাই বাড়ি যাব।
বাবা। হ্যাঁরে, গাইনিকোলজিস্ট কী বললেন?
অন্তরা। খারাপ কিছু বলেননি, তবে এত তাড়াতাড়ি তো বিশেষ কিছু বোঝা যাবে না।
বাবা। সে তো ঠিকই। তুই ঠিক আছিস তো মা, একেবারে ঠিক? মানে, মানে, তোর কোন ভয়-টয় করছে না তো?
অন্তরা। (একটু হাসির শব্দ তুলে) আমার ভয় করছে না বাবা, ভয় করছে অনলাভর...
অনলাভ। এই, কী বাজে কথা বলছ? না মেসোমশাই, আপনি কিচ্ছু ভাববেন না।
বাবা। না না ভয় তো করতেই পারে, প্রথমবার, তার উপর এরকম একটা অ্যাকসিডেন্ট বাধিয়ে ফেলল।
অনলাভ। না না, কোন ভয় নেই, সব ঠিক আছে। কাল ও বাড়ি ফিরে আসুক, পরশুদিন আমরা দুজনে রাজবল্লভপাড়ায় যাব।
অন্তরা। বাবা, সন্তু কেমন আছে? ত্রিপুরার কনফারেন্স থেকে ফেরেনি এখনো?
বাবা। আজই ফিরবে, সন্ধ্যেবেলা।
অন্তরা। বাবা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। অনলাভর ভয় বোধ হয় তুমিই কাটাতে পারবে।
বাবা। অনলাভর ভয়? আমি? কেন, কী হল?
অনলাভ। (একটু চাপা স্বরে) এঃই, না না, কী সব বাজে কথা বলছ...
অন্তরা। (অনলাভর প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে) ওর ভয় অনিশ্চিতের ভয় বাবা, ওর সন্তান কি দৃষ্টিহীন হবে? ― এই ভয়।
বাবা। (কণ্ঠস্বরে দ্বিধা) না না... তা কেন হবে? এমন আর কটা হয়?
অন্তরা। আর যদি হয় বাবা?
বাবা। কেন এসব কথা তুলছিস অন্তু? এখন তোর শরীরটাই জরুরি। এই অ্যাকসিডেন্ট...হাসপাতাল...এগুলোই এখন চিন্তা।
অনলাভ। ঠিক মেসোমশাই, ঠিক। এখন ও তো বাড়ি ফিরুক সুস্থ হয়ে, সেটাই কথা।
অন্তরা। আমি তুলিনি বাবা, আমি তুলিনি এ সব কথা। আমার মাথাতেও এ কথা আসেনি। এ অনলাভর ভয়।
বাবা। না অনলাভ, এমন করে তুমি ভেব না। তোমরা শিক্ষিত ছেলে... এ-এ-এগুলো তো এক্স-এক্স...একসেপশন, ব্যতিক্রম, এমন হতে যাবেই বা কেন? বেবিটা হেল্দি হবে, এ-কথাই তো ভাবতে হবে এখন। মন ভালো রাখতে হবে, তোমাদের দুজনেরই...
অন্তরা। কিন্তু হয় যদি বাবা, তখন?
বাবা। তুই বলছিস এ-কথা, অন্তু?
অন্তরা। হ্যাঁ আমি। আমিই তো বলছি। আমিই তো বলব। বাবা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? তুমি তো বরাবর সত্যি কথা বলো বাবা, জিজ্ঞেস করব?
বাবা। হ্যাঁ বল্ না, এত সঙ্কোচ করছিস কেন?
অন্তরা। বাবা, আমি অন্ধ হয়ে জন্মাবার পর, সন্তু যখন আসবে, তুমি বা মা তখন অনলাভর মতো করে ভাবতে?
বাবা। এ সব কী কথা হচ্ছে অন্তু? এ সব কী বলছিস তুই?
অন্তরা। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় তোমাকে জিজ্ঞেস করছি বাবা। বাবা তুমি এড়িয়ে যেও না। জবাব দাও প্লীজ।
বাবা। তোর, তোর কি মাথা খারাপ হল অন্তু?
অন্তরা। না বাবা, মাথা ঠিক আছে। কিন্তু বল বাবা, বল। আজ এ প্রশ্নের জবাবটা জানা জরুরি। আমি তো জন্মান্ধ বাবা, আমার যে কী নেই কোনদিন জানতেও দাওনি তোমরা। আমার সঙ্গে খেলেছ, গল্প বলেছ, পড়িয়েছ, বড় করেছ। সবায়ের কাছে শুনে শুনে যখন একটু একটু বুঝতে শিখলাম যে কিছু একটা আমার নেই, ততদিনে আমি স্কুলে। অনবরত সবায়ের কাছ থেকে নিজের প্রশংসাই শুনি। সেই সময় মা বললো একদিন, এবার তোর একটা ভাই হবে অথবা বোন। এটুকুই, এটুকুই বলেছ তোমরা আর আমি একটা ভাই অথবা বোন পাবার আশায় মশগুল থেকেছি।
বাবা। হ্যাঁ, তাই তো। কত ভালো ছিলি তুই পড়াশোনায়। এমনকি শান্তশিষ্ট হলেও খেলাধুলোতেও ভালো ছিলি। স্কুলের স্পোর্টসে একশো মিটার দৌড়ে প্রাইজ পেয়েছিলি।
অন্তরা। বাবা, সেই সময় যখন বোন আসবে, ডাক্তার আসতো বাড়িতে। একদিন ডাক্তার চলে যাবার পর মা আমাকে বলল, তোমার যে পুতুলের মতো ভাইটা বা বোনটা আসছে, তার স্বাস্থ্য খুব ভালো হবে। আজ ডাক্তারমাসি বলে গেল, বেবি খুব হেল্দি হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই না বোন, মা? বোন হলে ভালো, ভাই হলে আমি ওর কাছে হেরে যাব। মা বলেছিল, কী আসবে, ভাই না বোন, ও সব ভাবতে নেই। যা আসবে তা-ই ভালো। সত্যি কথা বল বাবা, তখন কি তোমরাও অনলাভর মতো ভাবতে? ভাই বা বোন কিছু আসে-যায় না, কিন্তু...
বাবা। এতদিন পর এ প্রশ্ন কেন করছিস মা? তুই তো কখনো এসব ভাবতিস না।
অন্তরা। আমি আজও ভাবিনা বাবা, কিন্তু তুমি বল। বলতে তোমাকে হবেই।
বাবা। তোর মা চলে গেছে, আজ সবটাই আমার ওপর চাপাতে চাস?
অন্তরা। আমি কারো ওপর কোন কিছুই চাপাতে চাইনা বাবা, কিন্তু আজ এটা জানা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। তোমার স্কুলে-ফার্স্ট-হওয়া, সবাই যাকে বলতো ফুটফুটে, পাঁচ বছরের সেই মেয়েটাকে তোমরা একটা ভাই বা বোন দেবে কথা দিয়েছিলে। নিজেদের কী দিতে চেয়েছিলে বাবা? চক্ষুষ্মান দৃষ্টিপ্রাপ্ত এক সন্তান? যে তার দৃষ্টিশক্তির বলে বুড়ো বয়েসে হয়তো তোমাদের ভার বহন করবে, হয়ত তার দৃষ্টিহীন দিদিকে দেবে সাহস? বল বাবা বল, বলতে তোমায় হবেই।
বাবা। তোদের কি কখনো মনে হয়েছে অন্তু যে তোরা আমাদের আকাঙ্খিত সন্তান নোস? সত্যি বল্ সত্যি বল্, আজ এ প্রশ্ন কেন।
অন্তরা। মনে হয়নি বাবা, কক্খনো মনে হয়নি। তোমরা যখন বলতে আমরা প্রতিবন্ধী নই, কোন প্রতিবন্ধকতা নেই আমাদের, চাইলে সবায়ের চেয়ে ভালো হতে পারি আমরা, সেরা হতে পারি, তখন বুঝিনি তোমরা তোমাদেরই, আসলে নিজেদেরই, সান্ত্বনা দিচ্ছ। আমাদের নিয়ে গর্বও হয়তো হতো তোমাদের যখন স্কুল-কলেজে আমরা ভালো করতাম। কিন্তু, কিন্তু বাবা, যদি ভালো না করতাম? প্রতিবন্ধী সন্তানের বাবা-মা হিসেবে কপাল চাপড়াতে তো তোমরা? অথচ আমাদের রাজবল্লভপাড়ার ওই ছেলেগুলো? যারা সিণ্ডিকেট করে, গুণ্ডামি করে ― যাদের দৌরাত্ম্যে ভয়ে তটস্থ থাকে গৃহস্থ ― তাদের মা-বাবারা? সেই সন্তানরা প্রতিবন্ধী নয়, চোখ নেই যাদের তারা প্রতিবন্ধী? ওই ছেলেগুলোকে তুমি ভয় কর বাবা, ইনিয়েবিনিয়ে কথা বল ওদের সঙ্গে, কিন্তু দেখেছ কি, সন্তুকে কেমন ভয় করে ওরা? সন্তুর সঙ্গে গলা তুলে কথা বলতে সাহস পায় না, লক্ষ্য করেছ তুমি?
বাবা। হ্যাঁ। সন্তু আমার বড় সাহসী মেয়ে। ঐ চোখ-ওয়ালা গুণ্ডাগুলোও ভয় করে ওকে।
অন্তরা। বাবা তবুও, সন্তু আসার আগে যে কামনা ছিল তোমাদের ― চক্ষুষ্মান সন্তান হোক ― তাকে, সেই কামনাকে, কেন জীইয়ে রেখেছ তুমি?
বাবা। তুই কী বলছিস অন্তু, কী বলছিস তার মানে জানিস?
অন্তরা। জানি বাবা, জানি বলেই বলছি। আমি বড় হয়ে গেছি, সন্তু বড় হয়ে গেছে, আজ আমাদের সন্তান আসার সময় হয়েছে, তোমার দৌহিত্র বা দৌহিত্রী। আজও অনলাভ যখন চক্ষুষ্মান সন্তান চায়, তুমি তাকে স্ট্যাটিস্টিক্স দেখাও। বল, আমাদের মতো অন্ধ যারা, তারা তো একসেপশন, ব্যতিক্রম, ব্যতিক্রম বারবার হয় না। ওকে বলো আশায় বুক বাঁধতে, কেন বলতে পার না বাবা, সন্তান যদি দৃষ্টিহীন হয় তো হোক, তাতে কিছু যায়-আসে না, কেন বলতে পার না―
বাবা। অন্তু, শোন্―
অন্তরা। না বাবা, আমাকে বলতে দাও। তুমি বলতে পারনা, কারণ অনলাভর সঙ্গে সঙ্গে তুমিও বুক বেঁধে আছ। তোমরা যাকে বল সফল, সেরকম সফল দুই অন্ধ কন্যার গর্ভেও তোমরা চাও চক্ষুষ্মান সন্তান ― মুখে বল হেলদি বেবি, কিন্তু হেলদি তো তখনই যখন সে চক্ষুষ্মান বাবা, চক্ষুষ্মান......