অলংকরণ: রমিত
এতক্ষণ ধরে যে পাপান ডাকাডাকি করছে নিচে দাঁড়িয়ে কারুর কোনো হুঁশই নেই! বাড়িটাও যেন ঠিক কেমন একটা, একদিকের দেওয়ালে মিশমিশে কালো ঝুল, একটা টিকটিকি চুপটি করে দেওয়ালে কান পেতে কিসব শুনছে। ওদিকের দেওয়ালে লম্বা ফাটলের ধার ঘেঁষে একটা শত পুরোনো নোটিশ বোর্ড কোনক্রমে একটা পেরেক থেকে টেনেটুনে ঝুলে আছে, এইসব দেওয়ালে বোধহয় লর্ড কার্জনের আমলে শেষবারের মতো রঙের পোঁচ পড়েছিল। পাপান ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিক দেখতে দেখতে আর কতবার ডাকলে সাড়া পাওয়া যাবে সেটাই ভাবছে আর অমনি একটা ইয়াব্বড় ইঁদুর সুরুৎ করে পায়ের সামনে দিয়ে চলে গেল। পাপানের বুজুম ফ্রেণ্ড গাবলু পেছনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ফোনে কিসব খুটখাট করছিল, ইঁদুর দেখে তড়াক করে তিন লাফে পাশের সিঁড়িতে উঠে দৌড় মেরেছে। পাপান তো কমরেডের আচমকা পলায়নে হতভম্ব। সে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে তাড়াতাড়ি গাবলুর পিছু নিল। আগের বছর পুজোয় সেই যে রাজস্থান ঘুরতে গেছিল, ঠিক যেন সেখানকার দুর্গগুলোর মতো উঁচু উঁচু সিঁড়ি।
পাপান মনে মনে দাদাকে শাপ-শাপান্ত করে চলেছে, আজ কলেজ থেকে বেরোতেই একটা ফাঁকা বাস তার নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেল, ওটা ধরে ফেনলে দিব্যি জানলার ধারে বসে গান শুনতে শুনতে কোথায় এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যেত, তা না, এখন এই ঝুললাগা ভূতের বাড়িতে ঘর বুক করতে আসতে হয়েছে। সঅব দাদার জন্য। আসলে পাপানের দাদা কোন একটা লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত আছে। অফিস সামলে সে সব দিকে ছোটাছুটি করতে পারে না। সামনের ৯ই আগষ্ট ওদের পত্রিকা-প্রকাশ অনুষ্ঠান, সেটা নাকি এই ভূতের বাড়িতেই হবে, কারণ এক, এটার ভাড়া কম, দুই, কলেজ স্কোয়ারের এক্কেবারে কাছে, সবারই আসতে সুবিধে হবে। দাদার ধারণা ওইদিন নাকি অনেক ডিমান্ড রয়েছে, তাই আজ পাপানকে দাদার দূত হয়ে আগেভাগে আসতে হয়েছে এই বাড়িতে হল বুক করতে।
পাপানের কলেজ ঠনঠনিয়ায় হলে কি হবে, ও কলকাতার প্রায় কিচ্ছুটি চেনে না। তবে ও নিজেকে সান্তনা দেয় এই বলে, সবে ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকেছে, ফাইনাল ইয়ারে উঠতে উঠতে নিশ্চই চিনে যাবে। এই কলেজ স্কোয়ারে ও এতবার এসেছে, এখানে যে এরকম একটা ভূতুড়ে বাড়ি দিব্যি ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে, ও থোড়াই খেয়াল করেছে এদ্দিন। দাদা যখন ত্রিপুরা হলের ঠিকানাটা লিখে দিল চিরকুটে, তখন কি আর পাপান জানত, সামনে এসে শুধু ঢোকার দরজা খুঁজে পেতে এত নাকাল হতে হবে! গাবলু আসলে কথাবার্তায় বেশ চৌকস, নানান ব্যাপার-স্যাপার জানে টানে, কলকাতাও ওর থেকে ঢের বেশি চেনে, তাই পুঁটিরামের সিঙারা খাওয়ানোর টোপ দিয়ে ওকে ধরে এনেছে। অচেনা লোকের সঙ্গে বেশি কথা বলতে গেলেই পাপানের জিভ জড়িয়ে যায়।
ওরা যতক্ষণে ত্রিপুরা হলের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে, সব অপশন বিয়োগ করতে করতে যে গলিটা শেষমেশ পড়ে রইল, সেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঢোকার আগে বুকটা বেশ ধুকপুক করছিল। পাশের পানের দোকানের লোকটা বলে দিয়েছিল দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে নাকি কেয়ার টেকারের ঘর, সাদা চুলওলা লম্বা বুড়ো লোক, তাকেই 'ঢুঁনতে' হবে।
বাড়িতে কোনোক্রমে ঢুকে তো তাকে কোথাও ঢুঁড়ে পাওয়া গেল না। কেয়ারটেকারের ঘরের দরজা, আলো দুইই বন্ধ। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে দুই মহারথী ভাবছিলেন যে কী করা যায়, তখনই ইঁদুর দর্শনে একজন ঊর্ধ্বপানে ছুট মেরেছেন।
পাপান সিঁড়িতে উঠে দেখে গাবলু একটা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে এখনো সিঁড়িতে ইঁদুর খুঁজে চলেছে। চুক চুক শব্দ করে পাপান বলল, 'ছি ছি, এস.এমের ক্লাসে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে করে খুব তো বীরপুরুষ সাজিস, এখন সামান্য ইঁদুর দেখেই এই অবস্থা!'
- আহা তুই জানিস না, আমার মুরোফোবিয়া আছে।
- সেটা কী? মাছের মুড়ো খেতে ভয় লাগে? পাতি একটা ইঁদুর দেখে পালালি, আবার ডায়লগ দিচ্ছিস।
- তুই কি জানিস, আমার মতো ক্ষণজন্মা লোকেদের এরকম দু'একটা জিনিসে দুর্বলতা থাকে, এটা নেচারের নিয়ম। এখন শিগগিরি এই ইঁদুরওলা বাড়ি থেকে বেরোই চ।
- বেরোনোর প্রশ্নই ওঠে না, আজ হল বুক না করে গেলে দাদা আমার মাথা ভাঙবে। আর তুই পালালে আমি কালই তোর এই মুড়ো না মাথা তার গল্প ক্লাসে ফাঁস করছি।
অগত্যা নিমরাজি মুখে গাবলু আবার কেয়ারটেকারকে খোঁজা শুরু করল । ওরা যে সিঁড়িতে উঠে পড়েছিল, মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে পুরোটা ঘুরে আসা হল, কেউ কোত্থাও নেই। ওপরটা সত্যিই একটা ছোটখাটো দুর্গের মতো। গাবলুর মতে ফটোগ্রাফির আদর্শ জায়গা। আবার নেমে এসে নিচ থেকে খোঁজাখুঁজি শুরু হল। ওদিকে আরেকটা সিঁড়ি অন্য একটা দিকের দোতলায় উঠে গেছে। সেখানে সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপে কোত্থেকে একটা সরু আলোর ফালি এসে পড়েছে। দু'জনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ঠিক করল তবে এই পথেই খুঁজে দেখা যাক। সিঁড়ি দিয়ে যত ওঠা হচ্ছে একটা বিচ্ছিরি গন্ধ তাদের নাকে এসে ঠেকছে। কোনোক্রমে সেই গন্ধমাদন ঠেলে সিঁড়ির উপরের ধাপে পৌঁছে সেই গন্ধের উৎসস্থল আবিষ্কার করা গেল, দেওয়ালের মাঝে অন্ধকারে একটা ছোট্ট গুমটির মতো বাথরুম, তার দরজা হাট করে খোলা, সেই খোশবাইতেই জগৎ মাতোয়ারা। গাবলু তাড়াতাড়ি সেই দরজা বন্ধ করে দিতে ওরা দেখল সিঁড়িটা ডানদিকে ঘুরে আরো উপরে উঠে গেছে, সেখানের এক বন্ধ দরজার ভেতর থেকেই আলো এসে সিঁড়িতে পড়ছে। গাবলু বলল এখানেই দেখা যাক, কেউ না কেউ তো আছে বলে মনে হচ্ছে। পাপানও এক্সাইটেড, যাক কিছু না কিছু ব্যবস্থা হবেই এবার। সিঁড়ি বেয়ে যতই ওরা ওপরে উঠছে ততই ভেতরের আওয়াজ কানে আসছে। বন্ধ দরজার ওপার থেকে ওরা শুনতে পেল, কে একটা জোরে জোরে বলছে, 'ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?' তারপর সব চুপচাপ। সে আবার বলছে, 'ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? সাকসেস ইঁউহি আসে না। অনেকদিনের প্ল্যানিং আর এফোর্ট লাগে, লেগে পড়ে থাকতে হয়, তবেই আসবে সাকসেস। রুলস ফলো করতে হবে, ট্রেনিং মেটেরিয়াল ফলো করতে হবে। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?... '
পাপান আর গাবলু দরজায় কান লাগিয়ে এসব শুনছিল, হঠাৎ দুম করে দরজাটা খুলে গেল, একটা লম্বা মতো লোক হকচকিয়ে গিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পাপান অবাক হয়ে দেখল এই গরমের মধ্যেও লোকটা একটা কালো স্যুট পরে রয়েছে, আর মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল, সকালেই কাঁচা হাতে কলপ করা।
গাবলু মিনমিন করে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, লোকটাই উল্টে বলল, 'আরে এত দেরি করলে কেন তোমরা, মিটিং তো শুরু হয়ে গেছে, যাও যাও তাড়াতাড়ি বসো গিয়ে। আমি বাথরুম করে আসছি।'
দু'জনে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে একটা বেশ বড়ো হলঘর, একটু পুরোনো পুরোনো, খানিক রংচটা। ভেতরে অনেক আলো টালো জ্বলছে। সারি সারি চেয়ারে অন্তত জনা পঞ্চাশ মানুষ বসে রয়েছে সামনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। সামনে একজন মাঝারি হাইটের লোক চকচকে স্যুট পরে প্রজেক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিল। ওদের ঢুকতে দেখে ঈষৎ রাগত স্বরে বলল, ইতনি দের সে কোই আতা হ্যায়! যাও ব্যায়ঠো জলদি।
গাবলু আর পাপান কলেজেও ব্যাকবেঞ্চার, চুপচাপ পেছনের সিটগুলোর দিকে এগোচ্ছিল, যেতে যেতে দর্শকদের দিকে চোখ পড়তে পাপান দেখল খুবই সাসপিসাশ ব্যাপার, এত গোপন মিটিঙে সন্দেহ এড়ানোর জন্য সবাই খুবই সাদামাটা জামাকাপড় পরে এসেছে। এদের মধ্যে মাঝবয়সী লোকজনই সংখ্যায় বেশি, কলেজ-ইউনিভার্সিটি তে পড়া ছেলেমেয়েও আছে কিছু কিছু। কিসের এত গোপন মিটিং চলছে এই ভূতের বাড়ির হলে, ভেবেই পাচ্ছেনা পাপান।
ওরা চেয়ার টেনে বসে পড়তে চকচকে স্যুট পড়া লোকটা আবার বলা শুরু করল, 'সাকসেস। সাকসেস ইস ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট। আর সাকসেস পেতে হলে খাটতে হবে, টাইম দিতে হবে। যা যা বলা হচ্ছে আমাদের মিটিংয়ে ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড ফলো করুন, আমরা সবাই আছি, মিশ্রাজি আছেন, অসুবিধা হলে জিজ্ঞেস করুন, আমরা এডভাইস দেব। এনি ডাউট?'
উত্তরে গোটা হল চুপচাপ।
লোকটা হাতের রিমোট দিয়ে প্রজেক্টরের স্লাইড বদলে দিয়ে বলল, 'দেখুন আমাদের প্রজেক্টের সাকসেস এর জন্য সবচেয়ে জরুরি হল স্ট্র্যাটেজি আর টিম বিল্ডিং। অব স্ট্র্যাটেজি হল খুব ভাইটাল। গোটা দেশে...'
এই সময় মাঝের সারিতে বসা এক মহিলা কেঁপে কেঁপে হাত তুলেছেন। পাপান উৎপল দত্তের মুখের সাথে মিল দেখে মনেমনে চকচকে স্যুটওলা লোকটার নাম দিয়েছে মগনলাল। মগনলাল এবার কথা থামিয়ে বলল, ইয়েস ম্যাডাম।
- দেখুন স্যার, আমি একজন সাধারণ বাড়ির বউ। আমি কি এসব পারব?
মগনলাল একটু হেসে বলল 'নমস্তে, আপনার নাম?'
- স্যার, শিখা মণ্ডল।
- শিখাজি, প্লিজ স্যার বলবেন না, এখানে আমরা সবাই ইকুয়াল, আমি আপনার ব্রাদার। আপনি যে আজ আমাদের মিটিংয়ে এসেছেন, এটাই আপনাকে সাকসেসের দিকে চার পা এগিয়ে দিয়েছে। ইউ চোজ দা রাইট থিং। এবার আপনি যদি ডাউট রাখেন মনে, তাহলে কিন্তু হবে না, আপনাকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট এফর্ট দিতে হবে, আমাদের কথা হান্ড্রেড পার্সেন্ট শুনতে হবে, তবেই প্ল্যান হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাকসেস হবে।
আরও একজন হাত তুলেছেন একটু পেছনে, বয়স্ক মানুষ।
- বোলিয়ে স্যার।
- স্যার ম্যায় রঘুবীর সাউ, ড্রাইভার হুঁ, কেব চালাতা হুঁ। মেরা তো কোই জান পহচান হ্যায় নেহি, ম্যায় ক্যাসে কার পাউঙ্গা।
- স্যার, স্ট্র্যাটেজি তো হাম বাতা দেঙ্গে, আপ সিরফ কাম করতে রহিয়ে, ফিক্র কা কোই বাত নেহি। অব ম্যায় টিম বিল্ডিং ওউর স্ট্র্যাটেজি কে বারে মে বাতাউঙ্গা, ধ্যান সে শুনিয়ে।
'দেখুন, সবাই আজ এসেছেন যে কাজে সেটার কথা মাথায় রাখুন। আপনারা যে কাজে আসছেন, সেটা আপনাদের ফিউচারের কথা ভেবে নেওয়া বেস্ট ডিসিশন এইটুকু বলতে পারি। এই কাজে যেটা সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট, সেটা হল টিম বিল্ডিং। আমরা সবাই একটা পরিবার, একটা টিম। একটা টিম কী করে, যে কোনো ঝামেলায় সবাই সবার পাশে থাকে। দেখুন টিম বিল্ডিং এ ছ'টা স্টেপ থাকে...'
এতক্ষণ ধরে শুনেও পাপান কিছুই উদ্ধার করতে পারল না, হচ্ছেটা কী। লোকটা খালি গোল গোল কথা বলে বোর করছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাথা ধরে যাচ্ছে বসে, মনে মনে ভাবছে, কী ফ্যাসাদে যে আজ এসে পড়লাম!
মিনিট পাঁচেক পর মগনলালের স্লাইড বোঝানো শেষ হল। মুখে একটু হাসি এনে বলল, আপনারা সবাই আজ আমাদের বিজনেস মিটিংয়ে এসেছেন, কাল থেকে আপনারা আমাদের বিজনেস পার্টনার হবেন। আমাদের ডিস্ট্রিবিউশনকে নেক্সট লেভেলে নিয়ে যাবেন, কলকাত্তার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দেবেন, আজ তাই আপনাদের জন্য অল্প স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা করেছে আমাদের কোম্পানি। একটু নাস্তা করে নিন, তারপর আবার মিটিং কন্টিনিউ হবে।
সবাই ছোট কাপের চা আর সিঙারা নিয়ে খাওয়া শুরু করতেই ফাঁক পেয়েই এবার গাবলু উঠে দাঁড়িয়েছে। সোজা মগনলালের কাছে গিয়ে কি একটা বলতে যাচ্ছে। দেখে পাপান তাড়াতাড়ি পিছু ধরল।
- স্যার, আজ অ্যাক্সিডেন্টালি দারুণ সুযোগ পেয়ে গেলাম স্যার।
- তাই? অ্যাক্সিডেন্টালি কেন?
- আমি আর আমার বন্ধু আজ এই হল বুক করতে এসেছিলাম, এসে দেখি আপনাদের মিটিং চলছে। আমার বন্ধু আপনাদের কোম্পানি জয়েন করতে চায় স্যার।
পাপান তো শুনেই চমকে গেছে। কিছুই জানে না কী কেস, এত লোক কেন এসেছে, কী সব বিজনেস মিটিং-টিটিং বলছে, তার মধ্যে গাবলু দুম করে এসব বলে বসছে।
মগনলাল বলল, বাহ্, ভালো তো, দেখেছো তোমাদের লাক, একদম ঠিক দিকেই নিয়ে এসেছে আজ তোমাদের। তোমার বন্ধু অবশ্যই জয়েন করুন, তোমরা ইয়ংম্যান, এখন থেকেই ফিউচার নিয়ে ভাবছ, খুব ভালো লাগল। তা তুমিও জয়েন করছ না কেন?
- আমি তো জয়েন হয়েই আছি!
- তাই? কোন সার্কেল?
- শিলিগুড়ি সার্কেল, আমার কাজিন অরিজিৎ মিত্র, গোল্ড মেম্বার স্যার। ও জয়েন করিয়েছে।
- আচ্ছা, আমি কলকাতার ব্যাপারটা জানি, শিলিগুড়ির সবাইকে অতটা চিনি না। তুমি কি নতুন ঢুকেছ?
- হ্যাঁ, স্যার, নেক্সট মান্থে সার্কেল ইনডাকশন আছে। তবে দাদাও আমাকে বুঝিয়েছে বিজনেস স্ট্র্যাটেজি নিয়ে, কিভাবে অপারেশন বাড়াতে হবে সব বুঝিয়েছে।
- তাহলে তো ভালোই। তোমার ব্রাদার কে জয়েন করিয়ে নাও আজ। আর যাওয়ার সময় (একদম শুরুর লম্বা মতো পুরোনো স্যুটের চুল কলপ করা লোকটাকে দেখিয়ে বলল) মিশ্রাজির সাথে কথা বলে নিও। উনিও তো আমাদের বিজনেস পার্টনার, এখানকার কেয়ারটেকারও, তাই ফ্রিতে হলটা পেয়ে যাই আমাদের বিজনেস মিটিংয়ের জন্য। তুমি ওঁকে বোলো, হল বুক করে দেবেন।
- স্যার, একটা রিকোয়েস্ট আছে। রাখবেন প্লিজ!
- আরে তুমি আমাদের ব্রাদার, অবশ্যই রাখব। কী রিকোয়েস্ট বলো।
- স্যার, দাদা আমায় বিজনেস স্ট্র্যাটেজির পার্ট হিসেবে পাবলিক স্পিকিং-এরও ট্রেনিং দিয়েছে। আপনি টক দিচ্ছিলেন, খুব ভাল লাগছিল শুনতে, আমারও অনেক দিনের ইচ্ছে একটা টক দেওয়ার। আজ এতজন উড-বি বিজনেস পার্টনার এসেছেন, একটা টক রাখতে দেবেন স্যার? আমাদের অর্গানাইজেশন নিয়ে আমিও দুটো কথা বলতে চাই, খুব প্রাউড ফিল করব স্যার।
- আরে এটা কোনো ব্যাপার! স্ন্যাকস ব্রেকের পরই তুমি টক দেবে। আর কোথাও কিছু আটকালে, ভুলটুল হলে আমরা তো আছিই, সামলে দেব।
পাপান তো খেপে বোম, গাবলু পাগলামির সব লিমিট ছড়িয়ে যাচ্ছে। ও তো কিসের মিটিং তাই বুঝতে পারছে না, গাবলু সার্কেল-বিজনেস-শিলিগুড়ি কী সব বলছে, সবই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল, এবার বলছে নাকি টক দেবে! মগনলাল না থাকলে বোধহয় রাগের চোটে গাবলুর মাথায় একটা গাঁট্টাই বসিয়ে দিত।
সবাই আবার চা সিঙারা শেষ করে নিজেদের সিটে এসে বসেছে, নিজেদের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস করছে, এমনি সময় গাবলু মাইক হাতে প্রজেক্টরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পাপান মাঝামাঝি একটা সিটে বসেছে। ওদিকে মগনলাল স্যুটের বোতাম আলগা করে পেছনে গিয়ে বসেছে, মিশ্রাজির সাথে টুকটাক কথা বলছে।
গাবলু বেশ গলা টলা ঝেড়ে শুরু করল, আপনাদের সবার সামনে বলার সুযোগ পেয়ে খুব ভালো লাগছে। আমিও আপনাদের একজন ব্রাদার, সে জন্যই আজ আমাদের কোম্পানি নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাই। এই কোম্পানির সাথে কাজ করতে পারাটাই বিশাল ব্যাপার, কারণ আপনারা তো শুনেইছেন আমাদের নেটওয়ার্ক দেশ-বিদেশ সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। আপনারা সাথে থাকলে আরো উন্নতি করবে। কী, করবে তো?
গাবলুর কথার সাথে সবাই বেশ কানেক্ট করছে, সবাই বেশ জোর গলায় বলে উঠল, হ্যাঁ!
- দেখুন, আপনারা তো আমাদের কোম্পানির বিজনেস পার্টনার হতে যাচ্ছেন, আমাদের কোম্পানি স্ট্রাকচার সম্বন্ধেও কিছু কথা আপনাদের তাই জানা উচিত। আপনারা হয়তো শুনেছেন যে আমাদের বিজনেস মূলত ডিস্ট্রিবিউশনের।
পাপান একটু আগে অব্দি এই মিটিং-এর কিছুই বুঝতে পারছিল না, এতক্ষণে গাবলুর কথা শুনে কিছু কিছু ধরতে পারছে। কিন্তু গাবলু এতকিছু জানল কী করে? তাহলে কি ওর ঐ কাজিনের ব্যাপারটা সত্যি?
গাবলু ওদিকে বলেই চলেছে, 'তাই আমাদের কোম্পানি স্ট্রাকচার নিয়েও যেটুকু জানি, চারটে কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করি। কোনো অসুবিধা নেই তো মিশ্রাজি?'
- না, না, বাচ্চে, কোই বাত নেহি। বাতাও না।
- তো দেখুন, কোম্পানির কাছে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছেন আপনারা, মানে এই ডিরেক্ট ডিস্ট্রিবিউশন এজেন্ট হিসেবে যারা জয়েন করছেন। ধরুন আজ আপনারা আছেন পঞ্চাশ জন। তার ওপরের লেভেলে আছেন আপনাদের টিম লিডার। ধরে নিন এই লেভেলে টিম লিডার আছেন পঞ্চাশ জন,তাহলে মোট এজেন্ট হল আড়াই হাজার। আবার তার ওপরের লেভেলে আছে ওঁর টিম লিডার। ওরকম টিম লিডার ধরুন আছেন পনেরো জন, তার ওপরে রয়েছে পাঁচ জন, সবার ওপরে রয়েছে কেউ একজন। কিরকম ধাপে ধাপে জিনিসটা নামছে দেখছেন? প্রত্যেক ধাপে অল্প অল্প করে ডিজাইনটা বাড়ছে, কেমন যেন পিরামিডের মতো না?
মগনলাল এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, পিরামিড শব্দটা শুনে হঠাৎ নড়েচড়ে বসল।
গাবলুর তো থামার নাম নেই, সে বলে চলেছে - 'পিরামিডটা বড় হবে কী করে বলুন দেখি আপনারা? প্রোডাক্ট বেচে তো? কোম্পানির প্রোডাক্ট নিশ্চই দেখেছেন আপনারা?'
প্রশ্নের উত্তরে সবাই বলল, না তো!
মগনলাল পিছন থেকে বলল, 'একদম চিন্তা করবেন না, সব প্রোডাক্ট দেখবেন, দারুন দারুন প্রোডাক্টের ডিস্ট্রিবিউশন আছে আমাদের।'
গাবলু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, 'প্রোডাক্ট দেখবেন তো বটেই কিন্তু খেয়াল রাখবেন সেসব মাল বাজারে চলে তো আদৌ? জালি মাল তিনগুণ দাম দিয়ে কে কিনবে?'
মগনলাল এবার চেঁচিয়ে উঠেছে, 'এ লড়কা! কী অনাব সনাব বকছিস?'
- ঠিকই বলছি। কারণ এ কোম্পানি মাল বেচে চলে না, চলে লোক ধরে। সবাইকে জয়েন করার সময় পঞ্চাশ হাজার, এক লাখ, দু লাখ, তিন লাখ যাকে যেমন পারে ভুল বুঝিয়ে পার্টনারশিপ ইনভেস্টমেন্ট বলে হাতিয়ে নেয়। সেই টাকা উশুল করার জন্য তাকে আবার পাঠিয়ে দেয় নতুন লোক ধরে আনতে। তারা ছড়িয়ে যায় স্টেশনে, বাজারে, কলেজে, অফিসে। ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা কামানোর টোপ দিয়ে তাদেরকে দলে ঢোকায়। তার টাকা থেকে আগের লোককে ভাগ দেওয়া হয়, পুরোটাই লোক ঠকানো পিরামিড স্কিম। শেষে ভাঁড়ার ফাঁকা হয়ে যাবে, কান্নাকাটি পড়ে যাবে। কী আপনাদেরও তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার টোপ দিয়ে ধরে এনেছে না? বলেছে না, নিজের বড় বিজনেস হবে, গাড়ি-বাড়ি হবে?
লোকজনের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু হয়ে গেছে, কেউ কেউ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ছে।
মিশ্রাজি এবার তেড়ে যাচ্ছে সোজা গাবলুর দিকে, চোখ দিয়ে ভস্ম করা গেলে, গাবলু এতক্ষণে ছাই হয়ে যেত নিশ্চই। ধরতে পারলে একটা মারও বাইরে পড়বে না। কিন্তু তা হলে কি আর চলবে? ঠিক সময়ে বাড়ানো পাপানের একটা ল্যাং খেয়ে মিশ্রাজি পা জড়িয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে। ভাড়ার স্যুটে ধুলো মাখামাখি হয়ে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড।
পুরো হলে চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে।
গাবলু সিঁড়ির দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে চেঁচাল, 'কেউ এদের পাল্লায় পড়বেন না, এরা খুব খারাপ লোক, এদের জন্যই আমার দাদা, অরিজিৎ মিত্র সুইসাইড করেছে।'
পেছনে পেছনে পাপানও দৌড় মেরেছে, আর তাদের তাড়া করেছে মগনলাল। ওরা প্রায় দরজার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কিন্তু গর্জনশীল মগনলালও হাতের নাগালে। সে চেঁচাচ্ছে, 'ভাগকে কাঁহা জায়গা বুরবাক, আজ মাজা চাখাতা হুঁ তুম দোনো কো।' হাতে করে একটা ভাঙা স্কেলও নিয়ে এসেছে পেটাবে বলে।
ঠিক এই সময় নিচু হয়ে কি একটা ছোঁ মেরে তুলে মগনলালের মুখে ছুঁড়ে দিল পাপান।
গাবলু-পাপান ততক্ষণে একদৌড়ে গলির মুখে। পেছন থেকে মগনলালের প্রচণ্ড চিৎকার কানে এলো কারও কারও, 'আরে কোই বাঁচাও! চুহা নাক মে কাট লিয়া!'
পুনশ্চ: বলাই বাহুল্য, এইসব ঘটনার পর পাপানের পক্ষে সেদিন আর ৯ই আগষ্টের জন্য হল বুক করা সম্ভব হয়নি। তবে দুঃখ করবেন না পাঠকরা, তবেই তো পরের দিন গুরুর প্রতিনিধি গিয়ে গুরুচণ্ডা৯-র ৯ই আগষ্টের অনুষ্ঠানের জন্য সেই হল বুকিং করতে পারল, ওদিন পাপান বুক করে নিলে কি আর পেত?
বিঃ দ্রঃ ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র বিষয়ে যদি কোথাও কোনো মিল থেকে থাকে তবে তা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত।