এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  ইস্পেশাল

  • লা পাতা

    বেবী সাউ
    ইস্পেশাল | উৎসব | ১১ অক্টোবর ২০২৫ | ৪৩ বার পঠিত
  • অলংকরণ: রমিত 




    — এটা তুই-ই করেছিস?

    সুভাষ চমকে উঠল। সে ভাবতেই পারে নি এভাবে কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে পারে। বিশেষত এই অবস্থার পরে। সে যদিও এতটা সম্মান কখনো আশা করে না, আশা করার মতো এখনও তেমন কোনও কাজ করতে পারে নি সে। কিন্তু সে তেমন কোনও নিয়মবিরুদ্ধ কাজ থেকেও নিজেকে সরিয়ে রাখতে পেরেছে। এই শব্দগুলো পাঁচবছর আগে আগে হলে বিষয়টা অনেকটা অন্যরকম হত। সে চারপাশটিকে একবার দেখে নিল। কোনও লাভ নেই। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে লুকানোর মতো আর কিছু নেই! বে-আব্রু সুভাষ মাথা নেড়ে হ্যাঁ কিংবা না কিছু বলল না। স্থির! হতভম্ব হয়ে কিছুটা সময় নিল নিজেকে সামলে নেওয়ার! ঘটনা এত অপ্রত্যাশিত, ভাবনার অবকাশটুকুও ছিল না তার কাছে।
    — তুই কি জানিস না?
    — কিন্তু ...
    — সরকার তোদের জন্য এত কিছু করছে! আর তোরা!
    হা হা করে হেসে উঠল কাজল ডন। সে এই অঞ্চলে এমএলএ -এর জন্য লড়ছে বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে। জিততে না পারলেও একটা প্রতিপত্তি জমাতে পেরেছে এতদিনে। তবুও নির্বাচনে যতক্ষণ না জিততে পারছে, এমএলএ-এমপি না হলে শালা কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। তাছাড়া তার বহুদিনের শখ এমপি হয়ে দেশের সেবা করার। দিল্লিতে বাড়ি গাড়ির স্বপ্নও আছে। লোকাল বালি-খাদান, মোরাম-খাদানগুলো এমএলএ হলেও পাওয়া যাবে! কিন্তু জনগণের চোখে উঠে আসার জন্য তেমন কোনও সৌভাগ্য ভগবান তাকে এখনও দিচ্ছেন না। পাবলিক হিরো চায়। হিরো! সেই জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।
    ভোটের জন্য চারপাশটাকে নজরে রাখতে হয়। যেমন করে হোক, যেভাবে হোক! সকাল সকাল স্কুলে এসেছিল বাচ্চা ছাড়তে। সেখানেই যে এমন কন্টেন্ট মিলে যাবে, কে জানত! এই সুযোগ!
    কাজল লকলকে চোখে সুভাষের দিকে তাকায়। বলে,
    — মাস্টার হয়েছ! আর এটুকু জানো না? নাকি অযোগ্য তালিকার?
    সুভাষ প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না! সে কাজলের সঙ্গে বেশি কথা বাড়াতে চায় না সকাল সকাল। পুরো স্কুলের দায়িত্ব তার ঘাড়ে। মিড-ডে মিলের রান্না ঠিক করে বাচ্চাদের অ্যাটেন্ডেন্স রেডি করে তা আবার আপলোড করা। সে এসবে নজর না দিয়ে ভাবে মিড-ডে মিলের হিসেবটা করে ফেলা উচিত। সে ক্লাসরুমগুলোর দিকে চলে যায়। প্রতিটি ক্লাস থেকে টোটাল অ্যাটেন্ডেন্স জোগাড় করে। ছোট নোটবুকটায় লিখে রাখে। এবার তাকে কম্পিউটারে চাপাতে হবে টোটাল নাম্বার এবং মিড-ডে মিলের রান্নাকারীদের বলে দিতে হবে। আজ ডিমের দিন। টোটাল ৪৪৭ জন ছাত্র-ছাত্রী। মানে ৪৫৫টি মতো ডিমের অর্ডার যাবে। কোনও ডিম ভাঙা-ফাটা তো থাকতেই পারে। বাচ্চাদের জিনিস বাচ্চারা খাবে, কিন্তু সেখানে দু-চারজন টিচারও ভাগ বসাবেন। যাইহোক, সুভাষ এই সময়টা খুবই ব্যস্ত থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না রান্না চেপে যায় ততক্ষণ সে আর কিছুতে মন দিতে পারে না। বাচ্চাদের খাওয়া বলে কথা। তাছাড়া শহরের মাঝখানে স্কুল। একটু এদিক ওদিক হলেই অভিভাবক থেকে পার্টির নেতা, রিপোর্টার থেকে টিকটকওয়ালা সবাই হাজির হবে।
    — স্যার! আপনারে ডাকতেছে!
    অন্যমনস্ক সুভাষ একবার তাকিয়ে আবার কম্পিউটারে নাম্বার চাপাতে লাগল। সাড়ে দশটার মধ্যে বিআরসি অফিসে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের ডেটা জমা করা চাই! অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত নেই!
    — কে? কারা? অপেক্ষা করতে বল! অপেক্ষা...
    — স্যার! পুলিশ এসেছে! প্রধান স্যার আপনাকে ডাকছেন!

    সুভাষ চমকে ওঠে! পুলিশ? কী হল রে বাবা!

    হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে কম্পিউটারের ছোট রুমটা থেকে। দেখে মিড-ডে মিলের সামনের এরিয়াটা পুরো ভিড়ে ভিড়। যদিও সুভাষ এদের সবাইকে চেনে না, কিন্তু পুলিশের উর্দি দেখে কেমন বুকের ভেতরটা ধড়াম করে উঠল। কেমন একটা অজানা আতঙ্ক। ছোটবেলায় পুলিশের ভয় দেখাত মা। কিছু একটা ভুল করলেই 'পুলিশ ডেকে পাঠাচ্ছি' বলে সেই যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল সুভাষের মনে, সেখান থেকে এখনো বেরোতে পারে নি সে। মনে মনে আশ্চর্য হল। ছোটবেলার অবচেতন মন এত জোরাল হয়! তবে যে এখন যেসব শিশুদের মনে সমাজ, রাষ্ট্র এবং ইতিহাস সম্পর্কে ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা নিশ্চয়ই সত্যে পরিণত হবে!
    সে মনে মনে নিজের ভুলগুলো দেখার চেষ্টা করল। না তো! তেমন তো কিছু মনে পড়ছে না। কোনও ছাত্র-ছাত্রীর গায়ে কখনো হাত তোলে নি সে। মিড-ডে মিলের সমস্ত নথিপত্র ঠিক রেখেছে। এমনকি বিদ্যালয়ের বিল্ডিংয়ের যে অনুদান পাওয়া গেছিল, পাঁচটাকা এদিক ওদিক করে নি সে! কম্পিউটারে সমস্ত কিছু আপলোড করা আছে। সুভাষের নামে কেউ কখনো অভিযোগও করে নি। আর রইল ব্যক্তিগত জীবনের ভুল-ভ্রান্তি! কিন্তু না তেমন তো মনে পড়ছে না। বাড়িতে মা বাবা সে এবং শুভ্রা। বাচ্চা একটা। আবার গর্ভবতী শুভ্রার সঙ্গে উচ্চবাচ্যে কখনও কথা পর্যন্ত বলেনি সে। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স-এর প্রসঙ্গই আসে না। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ সে। যদিও সবাই তাকে সুভাষ স্যার বলে, কিন্তু আসলেই তো স্কুলের অস্থায়ী ক্লার্ক! ক'টাকাই বা মাইনে। বেতনের টাকায় একটা সপ্তাহও ঠিকঠাক টানা যায় না। বিকেলে স্টেশনের ওদিকটায় একটা ঠেলা গাড়ি লাগায়। দোসা ইডলি বানায়। তাতে কোনও মতে চলে যায়। শুভ্রা নেহাতই ভালো মেয়ে, তাই সামলে নেয়!
    — এটা তুই করেছিস?
    — হ্যাঁ... ভিজে গেছিল... খুব বৃষ্টি তো! শুকাতে দিয়েছি... বাড়ি নিয়ে যাব স্যার! কাচ্চা বাচ্চার বাড়ি স্যার! চাইছিল!
    — উফ! তুই কি পাগল?
    — কেন স্যার! কী হল?
    — শালা! তোরা আবার না কি জাতি তৈরি করছিস? ভবিষ্যতের? বাচ্চাদের শিক্ষা দিচ্ছিস! তেরঙ্গার মর্যাদাটুকু দিতে জানিস না?
    সুভাষ আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে থাকে। চারপাশে তখন অন্যান্য টিচাররাও এসে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীরাও। সুভাষের ইচ্ছে হচ্ছিল মাটির ভেতর লুকিয়ে পড়তে। কেঁচোরা যেভাবে লুকিয়ে পড়ে। খুঁজেই পাওয়া যায় না। সে কারোর চোখের দিকে তাকাতেই পারছিল না। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। একটা তেরঙ্গা। কাল ছেলেটা খুব কাঁদছিল 'পতাকা পতাকা' করে। সকালে স্কুলে আসার রাস্তায় এটা কুড়িয়ে পেয়ে ভেবেছিল ছেলেকে দেবে।
    — স্যার, ওটা পড়েছিল রাস্তার ওপর! ওই ডাস্টবিনের ওদিকটায়। আমি তুলে এনেছি সকালে স্কুলে আসার পথে... ভেজা ছিল তাই শুকাতে দিয়েছি...
    ততক্ষণে ইউটিউবাররা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা লাইভ করে বারবার দেখাচ্ছে মিড-ডে মিলের রান্নাঘরের দরজায় টাঙানো তেরঙ্গার ছবি। উল্টো তেরঙ্গা। গেরুয়া নীচে। ওপরে সবুজ। সাদা তো মধ্যবর্তী। ঠিক যেমন গামছা শুকায় মানুষ!
    — বন্ধুরা, আমরা গণতান্ত্রিক দেশে থাকি। এটা আমাদের সৌভাগ্য! কিন্তু কিছু মানুষ আছেন ভারতের খাবেন, পরবেন কিন্তু দেশকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকুও দিতে নারাজ! একজন শিক্ষক, তিনি কীভাবে জাতীয় পতাকার এরকম অবমাননা করতে পারেন!
    — বন্ধুরা, আজ আমাদের সঙ্গে কাজলবাবু না থাকলে, কাজলবাবুদের মতো মানুষজন না থাকলে এই 'ঘর ঘর তেরঙ্গা' অভিযান সফল হত কী? কখনোই না! কাজলবাবুর মতো মানুষজন আছেন বলেই আমাদের দেশ এখনও বাংলাদেশ, পাকিস্তান হয়ে যায় নি! জয় ভারত! জয় হিন্দুস্থান!

    সুভাষের দিকে একজন ইউটিউবার এসে ফোকাস করলেন ক্যামেরা!

    — সারে জাঁহা সে আচ্ছা... বন্ধুরা লাইনগুলো আমার এখন ঠিকমতো মনে নেই। আর মনে রেখেই বা কী হবে? এই তো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা! এই তো আমাদের শিক্ষকবৃন্দ! যে দেশে জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা হয়, সে দেশ জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন কীভাবে নেবে? আমাদের দেশের নাগরিকরাই, দেশ হন্তারক!
    সুভাষকে এতদিন কেউ শিক্ষকের মধ্যে ধরেই নি। অবশ্য সুভাষ শিক্ষক না হলেও কম্পিউটার ক্লাস নেয় ছাত্র-ছাত্রীদের। তারা সুভাষের ক্লাস করতে চায়। আজ হঠাৎ তাকে সবাই শিক্ষক ভাবছে দেখে খানিকটা ভালোলাগাও কাজ করছে মনের ভেতর। কিন্তু এত এত মানুষের মধ্যে তার কথাগুলো কেউ শুনতেই চাইছে না। কেউ বুঝছে না।
    তখনই একজন রোগা পাতলা পুলিশ কনস্টেবল এসে বলল,
    — চলিয়ে, চলিয়ে জিপ মে বৈঠিয়ে...
    — কেন স্যার?
    — আপনাকে জাতীয় পতাকা অবমাননার দায়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে!
    — স্যার এটা রাস্তায় পড়েছিল। আমি সম্মান জানিয়ে পতাকাটিকে তুলে এনেছি...অবমাননা আমি করি নি...
    — কিন্তু আপনি তো ঝাণ্ডাটিকে উল্টো শুকিয়েছিলেন। আমাদের কাছে ভিডিও আছে। উঠুন, উঠুন...আপনার যা বলার থানায় বলবেন! উঠুন উঠুন...

    প্রতি বছর পনেরো আগস্ট আসে। যায়। যায়। আবার আসে। হর ঘর তেরঙ্গা। তেরঙ্গা নিয়ে কত রকমের পোস্ট। সরকারের প্রতিটি সংস্থা হর ঘর তেরঙ্গা পৌঁছে দেয়। ভারতের বস্তি থেকে রাজার প্রাসাদ; পাবলিক টয়লেট থেকে ঝাঁ চকচকে সিনেমা হল পতপত করে উড়তে থাকে ইয়া বড় বড় জাতীয় পতাকা। এখন আবার সবাই তেরঙ্গা বলে কিংবা ঝাণ্ডা। পতাকা পুরনো শব্দ। বাংলা শব্দ!
    সুভাষ লজ্জায় মাথা নীচু করে থাকে। জিপে ওঠার আগের মুহূর্ত। সুভাষ কী করবে! কীভাবে বাঁচবে!
    স্কুলের প্রধানশিক্ষকের কাছে মাইক হাতে এগিয়ে যায় একজন সাদা, গেরুয়া, সবুজ কাপড় পরা চকচকে ইউটিউবার!
    — স্যার, আপনারা নাকি মানুষ গড়ার কারিগর! আর আপনারই স্কুলের শিক্ষকের এই অধঃপতন!
    — বিষয়টা সম্পর্কে আপনারা জলঘোলা করছেন... একটা ভেজা...
    প্রধানশিক্ষকের মুখ থেকে ক্যামেরা, মাইক্রোফোন সরিয়ে নেন ইউটিউবার মহিলা! যেন তিনি আগেই থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন প্রধানশিক্ষক তাদের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলবেন না। তারপর তিনি নিজেই চিৎকার করতে থাকেন। তিনি তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী এবং এখন পর্যন্ত যা যা শুনেছিলেন জাতীয় পতাকার মর্যাদা সম্পর্কে সবকিছুই বলে যেতে থাকেন।

    জিপ স্টার্ট দেয়। স্কুলের গেট দিয়ে, সবার দৃষ্টির বাইরে সুভাষকে দৃশ্য করে দিয়ে বেরিয়ে যায়!

    এখন নতুন নতুন শখের যুগ। চেয়ার থেকে বাস, রাস্তা থেকে সরকারি ভবন সবকিছুর রঙ বদলে যাচ্ছে। বারবার বদলায়। কোনো এক অদৃশ্য দাঁড়িপাল্লায় সবকিছু ওজন করে বুঝে নেওয়ার রীতির এখন রমরমা। সব পালটে ফেল! সব পালটে দাও! আর ঘটনার পরে ঢেলে দাও ঘটনা। ঘটনার ঘণঘটায় মুছে দাও মানুষের স্মৃতি। যে জাতির ইতিহাস নেই, সে জাতির তো এমনিতেই নিঃস্ব।
    সবাই রাতারাতি নিজের পরিবর্তন চায়। বিউটি পার্লারের মেয়েরা থেকে রাজনীতি খেলা সবক্ষেত্রেই — যা আছে তা চাই না। চমকে দেওয়ার, চমকে যাওয়ার ভড়ং শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে যে ভারতমাতাই নির্বাচন করেন প্রধানমন্ত্রী কে হবে; কে না! স্বপ্নাদেশের কথাও ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে ঘরে। খাওয়া থেকে শুরু করে পান করা, পোশাক পরা, দেখা, পূজা করা, জিনিসপত্র কেনা-বেচা, বাড়ি, চাকরি পাওয়া পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই এই ওপরওয়ালার হাত এখন এবং এটি একটি সাধারণ বিষয়।
    কিন্তু ভারতে কোটি কোটি সুভাষ আছেন আছেন যারা এই সমস্ত বিষয় সম্পর্কে অবগত নন এবং তারা শুধু নিজেদের ক্ষুধা মেটাতেই নাজেহাল হয়ে যাচ্ছেন। চাকরি নেই। স্থির কোনও কাজ নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং খালি পেট। ঘরে রুগ্ন বাচ্চা, বৃদ্ধ মা বাবার নিরাশ ভরা চাউনি!
    এবছর 'হর ঘর তেরঙ্গা' নতুন ফ্যাশনের মধ্যে একটি। প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর অন্তর নতুন নতুন কীর্তি তৈরি হয়। সারা শহরে ঝুলতে থাকে ফ্লেক্স। শাসক দলের ফ্লেক্স সবচেয়ে বেশি, তারপর বিরোধী দল। রিক্সাওয়ালা থেকে সাধারণ মানুষ এসব ফ্লেক্সের ওপর নজর রাখেন, তাদের ঘরের চালের ছাউনি করার জন্য। সেরকমই পনেরো আগস্টের পরে শহরের বস্তিগুলোর ঘরের দরজা হয়ে ওঠে তেরঙ্গা। ভারতের জাতীয় পতাকা। বে-আব্রু বস্তিগুলোর পর্দা হয়ে ওঠে তেরঙ্গা। বস্তির দুর্গন্ধে কোনও সরকারি নেতা পা দেন না ওদিকে। ফলে বস্তিবাসীদের তেরঙ্গা অবমাননার দায় থেকে রেহাই পেয়ে যায়! অবশ্য তেরঙ্গাগুলো দিনের বেলা খুলে রাখে তারা। রাতে টাঙায়। স্বামী-স্ত্রীর আদিম সম্পর্কের জন্যই তো আড়াল দরকার। দিনের বেলা যে যার কাজের জায়গায়! প্রেম করার, সম্পর্ক করার সময় কোথায়!

    থানায় ঢুকেই চমকে উঠল সুভাষ!

    বড়বাবুর চেয়ারে বসে আছে কাজল ডন। ধোপদুরস্ত চোস্তপায়জামা পাঞ্জাবি। দু'দিকে দু'জন কালো পোশাক, কালো চশমা পরা কমান্ডো। বড়বাবু দাঁড়িয়ে আছেন হাত জোড় করে। মেজবাবু চায়ের জন্য তাড়াহুড়ো করছেন!
    — কী রে সুভাষ! তুই নিজের কর্ম নিয়ে লজ্জিত নোস! শুনলাম! কী জাতি তৈরি করছিস রে তোরা! ছাত্ররা কী শিখবে! অধঃপতন শুরু করছিস তোরা!
    — স্যার! আমি তো ভুল কিছু করিনি... শুধু পতাকাটিকে তুলে এনে শুকাতে দিয়েছি...
    — কিন্তু উলটো ভাবে কেন?
    — স্যার! ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দিন! আমি জেনে-বুঝে কিছু করি নি।
    — তোরা শিক্ষক! তোরা শিখাবি বাচ্চাদের! না কি তোদেরই এখনো শেখা ফুরাল না?
    সুভাষ বুঝল তার কথায় চিঁড়ে ভেজার মতো মন কাজল ডনের নয়। সে আরেকবার হাত জোড় করে বলল,
    — স্যার, মাফ করে দিন! আমার ভুল হয়ে গেছে! আর হবে না!
    — ভুল কি আর বারবার হয় রে? একবারই হয়!
    — বাড়িতে পোয়াতি বৌ, বাচ্চা, বৃদ্ধ মা বাবা... সবাই মরে যাবে স্যার! মাফ করে দিন!

    সুভাষের চোখে তখন বাড়ির করুণ অবস্থা ভাসছে। বৃদ্ধ মা-বাবা যখন শুনবেন সুভাষকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে নির্ঘাৎ হার্টফেল করবেন। বাড়িতে গর্ভবতী শুভ্রা। ছোট বাচ্চা ছেলে। কীভাবে? কী করবে তারা? সমাজের কাছে যা কেলেঙ্কারি, অপমান, সম্মানহানি হল সে তো কানায় কানায় হল! মুখ দেখানোর জায়গা পর্যন্ত নেই! এবার স্কুলের চাকরিটা যদি না বাঁচাতে পারে সব শেষ। পেটের দানাটুকুও জুটবে না! সে চাইল কোনো মতে এটাকে মিটিয়ে ফেলতে!

    — কিন্তু এতক্ষণ তো বেশ বড় বড় বুলি কপচিয়ে যাচ্ছিস!
    — ভুল হয়ে গেছে স্যার! আমি সরকারি তেরঙ্গা চুরি করি নি! নাকি অবমাননা করেছি! রাস্তার ধারে, ডাস্টবিনের কাছটাতে পড়েছিল। বর্ষায় ভিজে গেছে পুরো... তাই শুকাতে দিয়েছিলাম! ক্ষমা করে দিন স্যার!
    সুভাষ কান্নায় ভেঙে পড়ল।

    বড়বাবু কাজল ডনের দিকে তাকালেন। ইশারায় কিছু কথা সেরে নিলেন। সুভাষ দেখল তারা হাসছেন। শয়তানের মতো ক্রূর, নিষ্ঠুর এবং নিষিদ্ধ!

    সুভাষকে মেজোবাবু বললেন,
    —বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। ইচ্ছে হলে বেঞ্চে বসতে পারেন। যদিও আমরা দাগীদের বেঞ্চে বসতে দিই না...

    সুভাষ চুপচাপ বসে আছে। অনন্তকাল! অপমানিত! বিধ্বস্ত!

    একজন সিপাহি বলল, — ঝাণ্ডা অবমাননাকারী!
    — ভাবা যায়! যে দেশে খাচ্ছে পরছে হাগছে তাকেই অবমাননা!
    আরেকজন বলল।
    — এরা নাকি শিক্ষক! শালা হারামির জাত!
    — তেরঙ্গাকে অবমাননা!
    — জাতীয় পতাকাকে অবমাননা!

    সুভাষকে ডেকে পাঠানো হল।

    এফআইআরটি ফ্লাগ কোডের ২নং ধারায় পড়ে ঝাণ্ডা অবমাননাকারীর শাস্তি... কিন্তু তোমার কথা শুনে, মানে যেমনটা বলেছ, তোমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও আনা যেতে পারে, মিঃ সুভাষ... বুঝতে পারছেন!
    ইন্সপেক্টর বলল সুভাষকে। এতক্ষণ তুই তোকারি দিয়ে কথা বলা বড়বাবু হঠাৎ করে তুমি আপনি তে কেন উঠে গেলেন — সুভাষ বুঝতে পারল না।
    তারপর কাজল ডনের দিকে তাকিয়ে বলল,
    — আপনি বলুন স্যার! আপনার এলাকা আপনার কথাটাও শোনা উচিত আমাদের!
    — আইন কী বলছে?
    — যাবজ্জীবন স্যার...
    — একটু এদিক ওদিক করে দিন! এ লজ্জা তো আমারও! আমার এলাকার মানুষ! তাও একজন শিক্ষক! মানে শিক্ষকের মতো আর কি! যোগ্যতার প্রশ্ন তোলা ঠিক নয় এই মুহূর্তে!
    — স্যার, তিনবছরের...

    সুভাষ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সবকিছুই মনে হচ্ছিল একটা দুঃস্বপ্ন!
    তার চোখে তখন ভাসছে পোয়াতি স্ত্রী, বাচ্চা এবং বৃদ্ধ মাতা পিতা! খালি ভাতের হাঁড়ি! অভুক্ত শিশু। খালি রান্নাঘর। চাল চুঁইয়ে জল পড়ছে! পোয়াতি বৌটা কাজল ডনের ফ্লেক্স এনে ঘরের ছাউনিতে তুলছে।

    সুভাষের ঘরের কাছেই ল্যাম্পপোস্ট। 'হর ঘর তেরঙ্গা'-র সরকারি গাড়ি এসে একটা বিরাট পতাকা বেঁধে দিয়ে গেল সেখানে। শ্রাবণের ঝড়ো হাওয়ায় পতপত করে পতাকা উড়ছে। মহান ভারতের মহান পতাকা!
    গর্ভবতী শুভ্রা দেখছে বৃষ্টির জলে ভিজে যাচ্ছে পনেরো আগস্ট!


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ১১ অক্টোবর ২০২৫ | ৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন