এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  ইস্পেশাল

  • গোয়েরনিকা

    অমর মিত্র
    ইস্পেশাল | উৎসব | ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | ১০৭ বার পঠিত
  • অবিস্মরণীয় নজরুল | বাঙালি বিদ্বেষ ও পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতি | সোনম ওয়াংচুক: গণতন্ত্র কি শুধুই কাগজে-কলমে? | নবান্ন, গাজা থেকে বাংলার দুর্ভিক্ষ | দুই ঘর | সমসাময়িক | ফ্লোটিলা | ঢাকের দিনে ঢুকুঢুকু | দু-প্যান্ডেলের মাঝখানটায় | সুন্দরী কমলা নাচে রে | কাশী বোস লেনের পুজো : লড়াইয়ের হাতিয়ার | অস্তিত্ত্ব | শালপাহাড়ের গান | পুজোর দিনগুলি | অপেক্ষা-দিন | ভোলুরামের হাঁচি ও মত্তের উৎসব | এ অবধি আঠারো | মিনিবাসে গদার | জালিকাটু | তিনটি কবিতা | সাত সেতুর সাতকাহন | ফ্রান্স - একটি অবতরণিকা | শারদীয়া | বালিকা ও ইস্ত্রিওয়ালা | তিনটি কবিতা | গগন | যে জীবন গেঁড়ির, গুগলির | লা পাতা | দু’টি কবিতা | ধাতব পাখিটি একা | নিষিদ্ধ গন্ধ ছড়িয়েছে হাসনুহানা বলে | তিন ঋতুর কবিতা | গোয়েরনিকা | "এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।" | উৎসব সংখ্যা ১৪৩২

    অলংকরণ: রমিত 


    আতঙ্কিত এক প্রাণী বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। অতিকায় আর এক প্রাণী গিলে খেতে আসছে। এই দুটি বাক্য লিখে তুহিন চুপচাপ। তুহিনের লেখা আটকে গেছে। একে বলে রাইটারস ব্লক। কলম সরছে না। কলম নয় ল্যাপটপে আঙুল। যা লিখছে, তা মুছে দিচ্ছে। শুধু দুটি বাক্য রয়ে গেছে। এর ভিতরে একটি রাখবে, অন্যটি মুছে দেবে? মুছে দিতে গিয়ে আবার ফুটিয়ে তুলছে তার আঙুল এবং ল্যাপটপের কী-প্যাডের ছোঁয়া।
    ফোন করল ভব মণ্ডল, দাদা হল?
    তুহিন বলল, দেরি হবে।
    ভব নাছোড়বান্দা, বলল, প্রেসে সব চলে গেছে।
    - কী গেল?
    - গল্প কবিতা প্রবন্ধ বুক রিভিউ।
    তুহিন বলল, আমাকে বাদ দিয়ে দাও, গতকাল একটা খারাপ ঘটনা হয়েছে।
    সম্পাদক বলল, এসব হাঁচি কাশির মতো লেগেই আছে, তা বলে লেখা হবে না?
    - দুটি লাইন লিখেছি, তারপর যা লিখি, মুছে দিচ্ছি, হচ্ছে না, দু লাইনের ভিতর আবার একটি রাখব কিনা ভাবছি, কোনটি তা বুঝতে পারছি না।
    ভব মণ্ডল বলল, আপনি একটি লাইন থেকে মস্ত একটা উপন্যাস লিখেছিলেন, মনে নেই?
    তুহিন ভাবছিল, কথাটি সত্য। অমন হয়। গল্পও অমন হয়েছে। কিন্তু এবার হচ্ছে না অথচ কোনও লাইনই ফেলতে পারছে না। কী লিখতে চাইছে তা আবছা মাথায় এসে হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় নরেশ চক্রবর্তীর মৃত্যু সংবাদ লিখছে। কিন্তু যেভাবে আর অগ্রসর হতে পারছে না। রেখা যদি লেখায় আসে, এমন হয় নাকি?
    ভব বলল, দাদা একটা সভা হচ্ছে অমুক হলে, আপনাকে আসতে হবে।
    - বুক লঞ্চ?
    - না তা নয়, সেমিনার।
    - কিসের সেমিনার?
    - আপনি সভাপতি থাকবেন, যদি ইয়েস করেন, তাহলে ওরা আপনাকে ফোন করবে।
    - তুমি জান না কী বিষয়ে?
    - আমি, না, আমি জানি না। বলল ভব। কিন্তু মনে হয় জানে। জেনেও তাকে বলতে সাহস পাচ্ছে না।
    - না জেনে আমি কী করে ইয়েস করব?
    - আপনি সভাপতি, আপনি শেষে বলবেন, মতে না মিললে তাও বলবেন, আপনি সকলের বক্তব্যের উপর বলবেন তো।
    - তুমি নিশ্চয় জান, বলতে পারছ না।
    ভব বলল,আমি অতটা জানি না, দেখুন তুহিনদা চাদ্দিকে যা হচ্ছে তার বিপক্ষে একটা সভা হবে।
    - কী হচ্ছে চারদিকে? তুহিন জিজ্ঞেস করল।
    - এই ধরুন রেপ, মার্ডার, বোম ব্লাস্ট, চুরি, অসহায় চাকরি হারানো শিক্ষক, সাধারণ কর্মী- সব।
    - আচ্ছা, আর?
    - আপনি টিভি দেখুন, দেখতে পাবেন, আপনাকে ডেকেছিল একটা চ্যানেল?
    তুহিন বলল, আমি না করে দিয়েছি।
    - বলবেন না?
    - বলব, কিন্তু কী বলব?
    ভব বলল, এই যে কলেজে সহপাঠিনী ধর্ষিতা হল।
    - আমার অসহায় লাগছে ভব।
    ভব বলল, অসহায় লাগলে হবে না, আপনি লেখক, আপনাকে বলতে হবে।
    - তুমি বলেছ?
    - আমি বলতে পারি না, আর আমার মতের কী মূল্য আছে, এইটা লেখক কবিদের সভা, সম্পাদকের নয়।
    তুহিনের চা এল। এইটা দ্বিতীয় কাপ। ল্যাপটপ ভাঁজ করল তুহিন। অতিকায় ভয়ানক এক প্রাণী আর আতঙ্কিত প্রাণী ল্যাপটপে রয়ে গেল। থাক। আতঙ্কে আর কোনো পংক্তিই আসছে না। এলেও গিলে খাচ্ছে ভয়ানক প্রাণীটি। ভবর সঙ্গে কথা বলছে সে। কলম ব্লক হয়ে গেলে, রাইটারস ব্লক হলে এমনি এলোমেলো কথা বলতে ভালোবাসে। গত সপ্তাহে এক দুপুরে ফোন এসেছিল যদুরহাটি থেকে। খবর দিয়েছিল সুনীল। নরেশ চক্রবর্তী বেঁচে নেই। বহুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, শীতের সময় তুহিন তাঁকে দেখতে গিয়েছিল। সেই প্রায়ান্ধকার দালানকোঠা, ভাঙা চণ্ডীমণ্ডপ, নিঝুম গ্রাম মনে পড়ে। তখন বেলা পড়ে এসেছে। শীতের বেলা খুব ছোট। তুহিন ভিতরে গিয়েছিল সুনীলের সঙ্গে। অদ্ভুত সেই বাড়ি। সামনের অংশে কেউ থাকে না, ভিতরে যেতে একধার দিয়ে ঢুকতে হয়েছিল। সেই অংশটা ভেঙে পড়ছে প্রায়। সুনীল ডাকতে লাগল, জীবনদা, জীবনদা।

    জীবন চক্রবর্তী হলেন নরেশদার ছেলে। তিন ছেলের দুইজন থাকে বসিরহাট, বারাসত। জীবনদা বাড়িতেই থাকেন। কলেজ টিচার ছিলেন। রিটায়ার করেছেন, কিন্তু পেনশন আটকে গেছে। মাঝে মাঝেই কলকাতা যান, কিন্তু কাজ খুব বেশি এগোচ্ছে না। তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছে বারাসত। মেয়ে বাপের বাড়ি থাকে বেশিরভাগ সময়। জামাই মালদায় বদলি হয়ে গেছে । শ্বশুরবাড়িতে বনে না, আবার মালদা যেতেও চায় না। গিয়েছিল কিছুদিনের জন্য, ভালো লাগেনি। বাপের বাড়ি এসে ঘুমোয়।

    তখন সেই বাড়িতে সকলেই ঘুমিয়ে। জীবনদার নাতি এসে দরজা খুলল, অবাক হয়ে তাদের দেখতে লাগল বালক। নরেশ চক্রবর্তী ঘুমিয়ে ছিলেন। জীবনদা, তাঁর স্ত্রী, কন্যাও। শুধু বালকটি জেগে। জীবনদার বাবা নরেশ চক্রবর্তী সারাদিন ঘুমোন। বাড়িটাও তাই প্রায়। সেই বাড়ির একটা ঘুমন্ত মানুষ চলে গেল, সুনীল বলল, নরেশদা একবার অপমানিত হয়ে আর বাড়ি থেকে না বেরিয়ে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘুম থেকে আর উঠলেন না।
    - কবে কিসের অপমান?
    - আপনি জানতেন, ভুলে গেছেন।
    তুহিন বলল, হতে পারে, মানুষ সব ভুলে যেতে পারে বলে পরেও সেই ঘটনা বারবার ঘটতে পারে, ঘটাতে পারে তারা, কী হয়েছিল?
    - এখানকার একটা বই মেলা হচ্ছিল, অনেক পুরোন বই মেলা, চমৎকার সব সেমিনার হত, বই বিক্রি কম হত না।
    - জানি, আমিও গেছি একবার উদ্বোধন করতে।
    - এখন মেলার মঞ্চে শুধু গান বাজনা, মাঠেও তাই, সেমিনার বন্ধ।
    - তারপর?
    - নরেশদা প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন তাঁকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল কমিটির দুটো ছেলে, বলেছিল, গানবাজনার জন্য পাবলিক মেলায় আসে, বই দেখতে না, মেলাটাকে জলসা করে দিয়েছে তারা, বলছে বার্ষিক উৎসব, সেখানে বই বিক্রির ব্যবস্থা করেছে তারা, রাত হলে বোতল খোলা হয়।
    - তোমরা কিছু বলনি?
    - বলেছিলাম তুহিনদা, কিন্তু তারা বলল, কে নরেশ, সে আবার কবে লেখক হল, তারা এক ভূতপেত্নির গল্প লেখা লেখককে নিয়ে এল, সব টোকা, কপি পেস্ট করা, তাঁকে সংবর্ধনা দিল, তারপর ব্যান্ডের সঙ্গে নাচ হতে লাগল, নরেশদা সেই ঘটনার পর আর বাড়ি থেকে বেরোননি।
    তুহিন বলল, প্রতিবাদ ভালো করে হয়নি।
    - হয়েছিল তুহিনদা, কিন্তু সে সব পাত্তাই দিল না কেউ, বলল, বিশ্বায়নের যুগ, সব কিছু এক সাথেই হবে।
    - সেই মেলা এখন হয়?
    - হয়, কিন্তু হাফ গান, হাফ খাদ্য, সিকি গারমেন্টস, বই সামান্য, যদুরহাটি ফেস্টিভ্যাল, বুক ফেয়ার অ্যান্ড মিউজিক কনফারেন্স।
    - আমি যখন গিয়েছিলাম, প্রচুর লোক বই কিনছিল, আমাকে কত সই করতে হয়েছিল।
    - হ্যাঁ, তখন আমরা দায়িত্বে ছিলাম, নরেশদা তখন মেলা কমিটির প্রেসিডেন্ট, তিনিই আপনার নাম প্রস্তাব করেছিলেন।
    এই কথা আটদিন আগের। তারপর থেকে লেখাটা আটকে আছে। তুহিন কোনো ছক বেঁধে লেখে না। একটা মনোমত পংক্তি পেলে, সে তা থেকেই গল্প বুনতে থাকে। ভব বলল, তুহিনদা, যা রটছে, সব সত্যি নয় হয়ত।
    - তা যেমন সত্য, যা ঘটছে সব আমরা জানতেও পারি না, চাপা দিয়ে রাখা হয়, দুর্গন্ধ তাতে ছড়াবেই।
    - হুঁ। ভব অস্ফূট উচ্চারণ করে থেমে গেল, বলল, এমন আগেও ঘটত।
    - ঘটত নিশ্চয়, জানা যেত না, না জানা গেলে আমাদের মাথা ব্যথা হত না।
    ভব বলল, আমি রাখছি তুহিনদা, ওরা ফোন করবে, আপনি শুনবেন কী বলতে চায়।
    তুহিন চন্দ ল্যাপটপের ভাঁজ খুললেন। নরেশদা চলে গেলেন। কাগজে সংবাদ নেই। সংবাদ হতেই পারতেন। আসলে তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন। কেউ তাকে মনে রাখেনি। ল্যাপটপে সেই লাইনটির পরে তিনি লিখলেন, “ অতিকায় জন্তুটির মুখের অর্ধেক শৃগালের, বাকি অর্ধেক মানুষের। চোখদুটি থেকে সবুজ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। তার চাদ্দিকে অমনি সব অদ্ভূত প্রাণী, তা দেখে অন্যরা আতঙ্কিত।”
    সুনীলের ফোন এল, আমরা নরেশ চক্রবর্তীর একটি স্মরণ সভা করব, আপনাকে আসতে হবে।
    - কবে হবে?
    সুনীল বলল, সকলের ডেট পাই, হল বুকিং হোক, হল না পেলে ছাদে ম্যারাপ বেঁধে করব।
    তুহিন বলল, ঠিক আছে যাব যদি আটকে না যাই।
    সুনীল ফোন রেখে দিল। তুহিন ল্যাপটপে চোখ স্থির করে বসে আছে। বাইরে ঝিরঝিরে বর্ষা। বাতাস ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেই সময়ে অচেনা একটা ফোন এল। তুহিন ফোন ধরল না। সাইলেন্ট করল ফোনটিকে। সকালে বারবার ফোন এলে লেখা থেকে মন সরে যায়। এখন তুহিন পরপর কয়েক লাইন লিখল। আবার মুছেও দিল। ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বসে থাকল।

    খবরের কাগজ এল। এক তরুণী নেত্রী বলছেন, এইটা এ আই-য়ের যুগ, কোনটা আসল, কোনটা তা নয়, ধরা যাবে না। প্রসঙ্গ কলেজের তরুণীর রেপ। তুহিন ভাবছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি তাঁর না লেখা অংশটি লিখে দেবে? তরুণী নেত্রী বলেছেন, তাঁর ছবি এ আই দিয়ে নগ্ন করে নেটে ছড়িয়ে দিয়েছিল তাঁরই বিরোধীরা। তার ভিতরে নারীও আছে। সুতরাং যা হয়েছে, তার সত্যতা এ আই দিয়ে নির্মিত হতে পারে। কী হয়েছে, না গণ ধর্ষণ এবং তার ভিডিও করণ। অন্য একটি রেপের ভিডিওয় এই মেয়েটির মুখ বসিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। তার পাশেই গাজায় অনাথ শিশু, দলিত পিটিয়ে মারা, এবং অমাবস্যা উপলক্ষে তারাপীঠে রেকর্ড ভক্ত সমাগম। প্রচুর পুলিশ। কেউ যেন পদদলিত না হয়। তখন একটি ফোন এল, ফোন ভাইব্রেট করতে লাগল। ভাইব্রেট করলে মনে হয় কেউ প্রাণপনে ঢুকতে চেষ্টা করছে তার ফোনে। কথা বলতে চাইছে তার সঙ্গে। ধরবে না ধরবে না করেও ধরল তুহিন। তখন একটি বাক্য মাথায় এল, অর্ধেক মানুষ অর্ধেক শৃগালের পাশে একটা ঘোড়ার মুখ। ঘোড়াটি জিজ্ঞেস করল, বাকিটা গেল কোথায় ?
    ফোন ধরেও কথা বলছে না তুহিন, বলে দিল, ধরে থাকুন।
    ওপার থেকে জবাব এল কি না শুনতে পায় না সে। যা মনে এসেছে লিখে যাচ্ছে শাদা পর্দায়।
    একটা মুখ জিজ্ঞেস করল, কোন বাকিটা?
    - তোমার যে দুই মুখ।
    - ও এই কথা, এ আই করেছে।
    - কিন্তু মানুষগুলোর হাফ দেখে আন্দাজ করতে পারছি, তারা এমন হয়ে গেল প্রকাশ্যে?
    শৃগালের মুখ বলল, মিলে মিশে করি কাজ, নাহি ভয়, নাহি লাজ।
    টেবিলে রাখা ফোনটি তুহিন তুলল, জিজ্ঞেস করল, কে বলছেন?
    - ভবদা বললেন ফোন করতে, আমার নাম অরিন্দম দত্ত, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
    - কেন?
    এরপর তুহিন জবাব না শুনে লেখায় হাত দিল, বলল, আলাদা আলাদা হতে পারতে।
    - ভাগাভাগি করে খেতে হয়, যত শিয়াল তত মানুষ, ভাগ করতে অসুবিধে হয়নি, কিন্তু একটা মানুষ পালিয়েছে, পিছনে একটা শিয়াল ছুটেছে।
    - হ্যালো, বলুন।
    - চাই আমাদের সভায় আপনি সভাপতি হন।
    তুহিন চন্দ বললেন, সভা কেন?
    - চারপাশে যা ঘটছে, আমাদের একটা সভা না করলেই নয়, এই সভার সঙ্গে কোনো রাজনীতির সম্পর্ক নেই।
    - চারপাশে কী ঘটছে?
    - এই যে স্যার, কতজন সুইসাইড করছে, আত্মহত্যা বেড়ে গেছে।
    - কেন সুইসাইড করছে?
    - চাকরি চলে গেছে, গাড়ির লোন বাড়ির লোন, জামাকাপড় কেনার লোন, লোনলি ম্যান সবাই, এখন কী করে শোধ করবে?
    - এত লোন করার অভ্যেস ঠিক না, আমি লোন করতে ভয় করতাম, যদি শুধতে না পারি।
    লোকটি মানে সেই অচেনা অরিন্দম বলল, এখন লোন নিতে হয় স্ট্যাটাস রাখতে, দেখুন স্যার সমস্যা খুব গভীরে।
    - কেন গভীরে, বাড়ি গাড়ির লোন আছে বলে?
    - সে তো বটেই, কিন্তু একদল পাবলিক বলছে কারোর চাকরির দরকার নেই, আর একদল বলছে সকলেরই দরকার, আমাদের সভা এই নিয়ে।

    তুহিন ফোন রাখল ‘আচ্ছা’ বলে। লিখতে আরম্ভ করল। শিয়াল আর মানুষ মুণ্ড ভাগাভাগি করে নিয়েছে এ আই দিয়ে। একজনের সঙ্গে অন্যজন জুড়ে গেছে। এতে কোনো অসুবিধে নেই। সকলের সমান অধিকার। মানুষ হয়ে উঠছে শৃগালের মতো চতুর। শৃগাল হয়ে উঠছে মানুষের মতো মধুর। হ্যাঁ, এই ভাগাভাগিতে নারী নেই। কেন নেই, না নারী চায় না চতুর হতে। তারা মধুর। এই শব্দটি পুরুষরা নিয়ে এই চিত্রকর্মে জুড়ে গেছে।
    তুহিন দেখল ফোন আবার থরথর করছে। সে ফোন তুলে জিজ্ঞেস করল, হ্যালো।
    - স্যার, তাহলে কার্ডে আপনার নাম দিই?
    - আমি নরেশ চক্রবর্তী নিয়ে বলব।
    - না স্যার, এইটার ইসু অন্য।
    - নরেশ চক্রবর্তীর উপর চড়াও হয়েছিল একদল, তিনি তখন এইট্টি এইট।
    - তা অন্য ইস্যু।
    - একই ইস্যু, একই।
    - এইটা স্যার ফলস রেপ আর ফলস চাকরি যাওয়া নিয়ে সভা, সবই এ আই নির্মিত।
    - তা হতে পারে? তুহিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
    -পারে স্যার, এখন যা দেখবেন টেলিভিশনে, সব এ আই, খবরের কাগজও ওই সব ফলো করছে, আসলে কিছু ঘটছে না, ইরান ইজরায়েল, গাজা, ল-কলেজ, কমার্স কলেজ, ইংলিশ কলেজ, সব এ আই।
    তুহিন চন্দ ফোন রেখে লিখল, তাদের মধ্যে অলিখিত চুক্তি আছে, একবার শিয়াল কথা বলবে আর একবার মানুষ। কিন্তু একটা সমস্যা আছে, সন্ধ্যায় সব শিয়াল একসঙ্গে ডেকে ওঠে। তাতে মানুষ বিরক্ত হয়। মানুষ বলে তারাও একটা সময় ঠিক করবে, যখন সকলে একসঙ্গে ডেকে উঠবে। কিন্তু মানুষের ডাক নানা রকম। মিলছে না কিছুতেই। কেউ বলছে “দূর হটো”, কেউ বলছে, “বুকে এস।” কেউ বাংলা, কেউ ইংরেজি, কেউ হিন্দি বা উর্দু। এইটা না মেলাতে পারলে হবে না। শৃগালের মতো, কুকুরের মতো, ফেউয়ের মতো একটা ডাক দরকার মানুষের। সব ভাষায় তা এক হবে। এই ডাক হুতোম পেঁচার মতো হতে পারে। সে কেমন, অবিরাম হিস হিস, হিস হিস। এতে সকলেরই সম্মানে লাগছে। তারা কেউ চায় না মানুষের ডাক এমন হোক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা এই সমস্যার সমাধান হবে আশা করছে শৃগাল এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা অর্ধেক মানুষ।
    ফোন তুলল তুহিন চন্দ, হ্যাঁ কী বলছিলেন?
    ভব বলল, তুহিনদা, এই ব্যাপারে নরেশ চক্রবর্তীকে না জড়ানো ভালো।
    - তুমি এই ফোনে এলে কীকরে?
    - অরিন্দম যোগ করে নিয়েছে, যা বলছি যদুরহাটির লেখক নরেশ চক্রবর্তী এখেনে আসে না।
    - কেন, একটা অষ্টাশি বছরের মানুষ, প্রবীণ লেখক, সম্পাদক, চিন্তক, তাঁর ধুতি টেনে, পিটিয়ে, পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিয়ে জুতো পেটা করতে করতে মেলা থেকে বের করে দিল, তা নিয়ে কিছু বলা হবে না?
    - সে তো আট বছর আগে একদিন, জীবনানন্দের কবিতার এ আই ভার্সন, অমন কিছু হয়নি।

    - তারপর তিনি ঘরে ঢুকে আর বের হননি, দালান খসে পড়তে লাগল, জানালা বন্ধ থাকায় ঘরে আলো আসে না। আবার প্রায়ই তাঁর বাড়ির আলো কে নিভিয়ে দেয়। গরমে পাখা বন্ধ। তিনি শুয়ে শুয়ে ঘামেন। তাঁর ছেলে পেনশনের জন্য প্রতি পক্ষে একবার কলকাতা যায়, কাগজপত্র সব হারিয়ে ফেলেছে কলেজ আর অফিস অথরিটি, শুনেছি নরেশ চক্রবর্তী একটা লেখা লিখছিলেন, তা অসমাপ্ত রয়ে গেল। সেই লেখার পাতাগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এইটা ইস্যু হতে পারে না?

    ভব বলল, আমাদের ইস্যু এ আই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব সভ্যতার…, কীভাবে ঘটনা নির্মাণ করা হচ্ছে এক একজনকে লক্ষ্য করে, আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের শান্তি কীভাবে লুন্ঠিত হচ্ছে, আমাদের ঘুম চলে যাচ্ছে।

    তখন শান্ত মনে ফোন রেখে তুহিন চন্দ লিখল, সন্ধ্যা সমাসন্ন, অর্ধেক শৃগাল এবং অর্ধেক মানুষ, ষাঁড়, শুয়োর, ঘোড়া, গাধা একই স্বরে ডাকতে আরম্ভ করল, অন্ধকারে তাদের কন্ঠস্বর ভেসে যেতে লাগল দূর, বহুদূর। তাতে কেউ কেউ বুক চেপে বসে ঘামতে ঘামতে নিদারুণ ভয়ে আর্তনাদ করতে লাগল। জীবন চক্রবর্তী এর ভিতরে মার খেয়েছে পুরোন কলেজে গিয়ে কাগজপত্র পাঠাবার অনুরোধ জানাতে গিয়ে, তার মাথায় জলের জগ এস ফেটে গেল। তার শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। লেখক তুহিন চন্দ বুঝল, তার কলম অসাড়তা মুক্ত হয়েছে। লিখতে লাগল তুহিন। আঁকতে লাগল তুহিন। চোখের জল আর আগুন একসঙ্গে ঝরাতে লাগল তুহিন।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    অবিস্মরণীয় নজরুল | বাঙালি বিদ্বেষ ও পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতি | সোনম ওয়াংচুক: গণতন্ত্র কি শুধুই কাগজে-কলমে? | নবান্ন, গাজা থেকে বাংলার দুর্ভিক্ষ | দুই ঘর | সমসাময়িক | ফ্লোটিলা | ঢাকের দিনে ঢুকুঢুকু | দু-প্যান্ডেলের মাঝখানটায় | সুন্দরী কমলা নাচে রে | কাশী বোস লেনের পুজো : লড়াইয়ের হাতিয়ার | অস্তিত্ত্ব | শালপাহাড়ের গান | পুজোর দিনগুলি | অপেক্ষা-দিন | ভোলুরামের হাঁচি ও মত্তের উৎসব | এ অবধি আঠারো | মিনিবাসে গদার | জালিকাটু | তিনটি কবিতা | সাত সেতুর সাতকাহন | ফ্রান্স - একটি অবতরণিকা | শারদীয়া | বালিকা ও ইস্ত্রিওয়ালা | তিনটি কবিতা | গগন | যে জীবন গেঁড়ির, গুগলির | লা পাতা | দু’টি কবিতা | ধাতব পাখিটি একা | নিষিদ্ধ গন্ধ ছড়িয়েছে হাসনুহানা বলে | তিন ঋতুর কবিতা | গোয়েরনিকা | "এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন।" | উৎসব সংখ্যা ১৪৩২
  • ইস্পেশাল | ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | ১০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শ্রীমল্লার বলছি | ১৪ অক্টোবর ২০২৫ ১৮:১৬734898
  • সন্ধে বেলায় একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং দারুণ লেখা পড়লাম! অমর মিত্র আপনাকে আমার শুভেচ্ছা জানাই! 
  • ? | 2a0e:4005:1002:ffff:185:40:4:***:*** | ১৪ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:২৩734902
  • এ মালটা কে বাওয়া? বর্ষীয়ান শ্রদ্ধেয় লেখক অমর মিত্রকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে?? একেবারে অশিক্ষিত টাইপ এ মাল কোত্থিকে এল?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন