শুভম একটি গানের ঘর করেছে তার বাড়ির তিনতলায়। গানের জন্যই সেই ঘর সাজিয়েছে শুভম। দেওয়ালে প্লাস্টার অফ প্যারিস লেপেনি, মসৃণ দেওয়ালে গানের স্বর পিছলে যাবে। শব্দ ব্রহ্ম। সেই শব্দের সত্যিকারের রূপ সুরের ভিতর দেখতে চায় শুভম। শুভম তার ঘর জুড়ে কার্পেট লাগিয়েছে। মারবেল পাথরের মসৃণ মেঝে যেন সুরের চলাচলে ব্যাঘাত না ঘটায়। সুর হল হাওয়ার মতো। সে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে নিয়ে এসেছে একটি সিডি প্লেয়ার। উত্তর কলকাতার এক প্রবীন নাগরিক, ডাক্তার, শুভমের গানের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে একটি বিলিতি কলের গান দিয়ে গেছেন, সঙ্গে অনেক রেকর্ড। শুভমের বয়স তিরিশ। খুব মেধাবী ছাত্র। এখন বড় এক কর্পোরেট হাউজের উচু তলায়, কর্তা। চাকরিতে অনেক টাকা দেয়। গানের পিছনে তাই অনেক খরচ করতে পারে শুভম। শুভমের ঘরে যে স্পিকার আছে দুটি তা ওর এক বন্ধু নির্মাণ করেছে। তারও প্যাশন গানে। গানের চেয়েও শব্দ প্রক্ষেপনে। সে স্পিকার নিয়ে ভাবে। নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করে। শুভম মাঝে মধ্যে এক একজনকে ডেকে আনে গান শোনাতে। তার গানের ঘরে আমন্ত্রণ জানায়। তাঁরা এসে ওর ঘরে বসে গান শুনে যান। প্রখ্যাত কবি মাল্যবান চৌধুরী গানের সমঝদার। শুভম তার কথা শুনেছিল ছোটোবেলায় তারা যে বাড়িতে ভাড়া থাকত, সেই বাড়ির মেয়ে সুচরিতার কাছে। সুচরিতা কবির অনুরাগী। শুভম নিজেও কবির অনুরাগী। নিজে লিখতে পারে না, কিন্তু কবিতা গল্প ভালবাসে। জীবনানন্দ দাশ থেকে মাল্যবান, তার গানের ঘর আবার কবিতা আর গল্পেরও ঘর। তার মনে হয় কবিতাও গান, গল্পও গান। বইগুলি সুন্দর করে সাজানো। শুভম যখন পড়ে তখন নিস্তব্ধতার ভিতরে থাকে তার গানের ঘর। শুভম যখন গান শোনে তখন ঘরে মৃদু আলো। লাতিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ার জিপসি সঙ বাজছে। শুভম এই সব গান ইন্টারনেট ঘেঁটে খুঁজে পেয়েছে । তারপর নেটেই অর্ডার দিয়ে আনিয়েছে বিদেশ থেকে। আফ্রিকার মালি দেশের কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক আলি ইব্রাহিম ফরকার ফোক সে আগে শোনেনি। ঐ গান শুনে মাল্যবান চৌধুরী শুভমকে তাঁর কবিতার বই উপহার দিয়েছেন। বইয়ে নিজ হাতে লিখে দিয়েছেন, শুভম পালোধী, পরম স্নেহাস্পদেষু।
শুভমের বাড়ি বেলগাছিয়া। টালাপারকের ধারে। ওখানে টালাপারকের ধারে বহু প্রাচীন সব গাছ। তার ছায়া ঢাকা পথ। ওই পথের এক প্রান্তে একটি জলাশয়। তার ভিতরে একটি দ্বীপ। দ্বীপটি আগে ছিল ঘন বনে ভরা। এখন তাকে এম,এল,এ, ফান্ডের টাকায় রুজ লিপস্টিক লাগিয়ে লাগিয়ে অসুন্দর করে দেওয়া হয়েছে। তার পাড় বাঁধিয়ে গাছ কেটে ফুল গাছ বসিয়ে তাকে যেন বাবু বাড়ির বাগান করে দেওয়া হয়েছে। তার বন্য সৌন্দয শেষ হয়ে গেছে। বছর দশ আগেও শুভম দেখেছে, ওই দ্বীপের বড় বড় গাছ ছিল বকের বাসা। ভোর বেলায় দেখা যেত আকাশ শাদা করে বক উড়ছে দ্বীপ থেকে। সন্ধে বেলায় শাদা হয়ে থাকত গাছের মাথা। বক ছাড়াও ছিল নানা পাখ-পাখালি। সে সব আর নেই। নেই জলাশয়ও আগের মতো। তার পাড়ও এম,এল,এ, ফান্ডের টাকায় বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। জলাশয়টি হয়ে গেছে অতি বৃহৎ এক চৌবাচ্চা। আগে পান কৌড়ি দেখত শুভম সেই ভোর বেলায়, এখন আর দ্যাখে না। পুকুর পাড়ে ব্যাঙের লাফ নেই। সেই যে হাইকু, পুরোন পুকুর ব্যাঙের লাফ জলের শব্দ......মুছে গেছে। ওই জলাশয়ের ধারে শুভম আর যায় না। মনে হয়, সেই ছেলেবেলায় যখন সে বিস্মিত হতো দ্বীপের ভিতর রাতে নেমে আসা নিবিড় এক তমিস্রায়, সেই দ্বীপ এখন বৃক্ষহীন বলা যায়, রাতে সেখানে জ্বলে হাই পাওয়ারের সোডিয়াম ভেপার আলো, আলোয় পাখিরা ঘুমোতে পারে না দেখত জলাশয় ঘিরে যে পার্ক, তার প্রান্তের প্রাচীন গাছে ঝুলে আছে পুরোন বাদুড়, তার সঙ্গে ভেসে আসত অচেনা এক সুর। সঙ্গীতে তার মুগ্ধতা জাগে ওইখানে। এখন পার্কে আর জলাশয়ের সমুখে গেলে শুনতে পায় যেন কর্কশ কণ্ঠস্বর।
শুভম রাত জাগত আগে। সেই কত রাত। ভূ বলয়ে তখন কোথাও দিন ফুরিয়ে রাত আসছে। কোথাও সবে রাত বাড়ছে। কোথাও আবার ভোরের আলো ফুটে গেছে। শুভম পড়ত রাত জেগে। আবার এক একদিন গানই শুনে যেত। তখন তার ভিতরে গান প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছে একটু একটু করে। সে একদিন হয়ত সদ্য সংগৃহীত হস্তির গান শুনল প্রায় শেষ রাত পযর্ন্ত। গৌরীপুরের প্রতিমা বড়ুয়ার গান। তুমরা গেইলে কি আসিবে মোর মাহুত বন্ধুরে...। হস্তির কন্যা হস্তির কন্যা বাহমনের নারী...। এক বর্ষার দিনে শুভম শুনল গিরিজা দেবী আর রবি কিচলু, কিংবা শুধু গিরিজা দেবীর গলায় কাজরী। বর্ষার গান কাজরী কতজনের কন্ঠে। গানের রেকর্ড আর সিডি জোগাড় করে শুভম নানা জায়গা থেকে। তার চেনা এক রেকর্ড কালেক্টর আছে মতিন মিঞা। তার বাড়ি বারাসতে। সে কলকাতা কেন জেলায় জেলায় ঘুরে নানা গান জোগাড় করে আনে। সিডি, টেপ। তারপর শুভমকে ফোন করে, স্যার লাগবে, প্রাণবন্ধু ঘোষাল, সেভেন্টি এইট, সাতষট্টি সালের রেকর্ড, নিজের কথা নিজের সুর, বর্ষার গান, খুব ভালো, শুনে দেখুন, মনে হবে...।
কী মনে হবে মতিনভাই ?
স্যার কাল রাতে আমার গ্রামোফোনে চালিয়ে ছিলাম, মেঘ করেছে ঘন করে, ঠান্ডা বাতাস বইছে, তখন বেলা পড়ে যায় যায়, ষোল সতের তারা, রঙিন শাড়ি, মাথায় লাল ফিতে, হাত ধরে নাচছে আর গাইছে।
তারপর ?
সব যেন এক পেখম তোলা ময়ুরকে ঘিরে গাইছে গো।
তারপর।
কখনো মনে হতে লাগল কৃষ্ণকে ঘিরেছে গোপিনীরা, গোবর্ধন গিরির মাথায় মেঘ জমেছে , মেঘের ছায়া নেমেছে ধরাতলে।
ধরাতলে ?
হ্যাঁ, এই ধরায়।
আপনি কত অবধি পড়েছেন মতিন ভাই ?
ক্লাস টেন, অঙ্ক আর ইংলিশে তিনবার কম্পারটমেন্টাল, আমি আর দিই নি, মাধ্যমিক পেরোতে পারি নি।
ধরাতলের কথা কে শোনাল আপনাকে ?
কেন ওই গান।
তারপর ?
কী বলব স্যার, গান সর্বনাশী।
কেন কী হল ?
আমি গিয়ে বলব আপনাকে।
এখন বলা যাবে না ?
আমি আপনার সময় নষ্ট করে দিচ্ছি স্যার।
না, আমি তো শুনতে চাইছি।
ফোন গোলমাল করছে স্যার, আর একজন অনেকক্ষণ ধরে আমাকে ধরতে চাইছে।
ঠিক আছে মতিনভাই, তুমি এস একদিন, ওই রেকরডটা নিয়ে এস।
ওককে স্যার, ভাল থাকবেন, আমি আজ বিকেলে যাব, তুমি থাকবে স্যার ?
কী অদ্ভুত ভাবে সম্বোধন বদলে গেল। মতিন মিঞাকে সে বলল, আজ হবে না, রবিবারে এস, সকালে এস, সারাদিন থেকে যাবে, সন্ধেয় না হয় চলে যেও।
না স্যার, সকালে না, আমি বেলা পড়লে যাব, রোদ তখন নরম হয়ে আসবে, আমি ওই পুষ্করিনীর পশ্চিম পাড়ে থাকব স্যার, একটা নাগকেশর গাছ আছে না যেখানে, সেইখানে।
তুমি এইদিকে এসেছ আগে ?
হ্যাঁ স্যার, নীলমণিবাবুর বাড়ি থেকে রেকর্ড নিয়ে এসেছিলাম, নীলমণি চট্টরাজ, পাইকপাড়ার রানি হর্ষমুখী রোডে বাড়ি ছিল, সে বাড়ি এখন নেই, বিক্রি হয়ে ভেঙেচুরে ফ্ল্যাট, তিনি----আচ্ছা স্যার রোববারে অপরাহ্নে বলব।
অপরাহ্নে ?
ইয়েস স্যার, তুমি ওই নাগকেশর গাছের কোলে দাঁড়িও।
আমার ওখানে যেতে ভাল লাগে না।
কেন স্যার, সুর নেই ?
এভাবে ভাবি নি।
নাগকেশর গাছটিকে চেন তুমি ?
আবার কথা হয়ে যেতে লাগল। শুভম চেনে না। কেউ চিনিয়ে দেয় নি। কিন্তু তার মনে হল হয়তো দেখলে চিনতে পারবে। এই পাড়ার কত রাম শ্যাম যদু মধুর নাম সে জানে না, অথচ কথা হয়, দেখা হয় নিত্য, বাজারে দোকানে বাসে ট্রামে ভোরের পথে। তাদের কারোর নাম যদি বলে মতিন, সে কি চিনবে ? দেখলে চিনবে। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি যে লোকটি তার সঙ্গে দেখা হলেই কথা বলে, একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সুপ্রীতি ঘোষের নাম সে জানে কিনা, তার গান সে শুনেছে কিনা, শুভম সুপ্রীতি ঘোষের গানের কলি, গুনগুন করে উঠেছিল। তখন সে বলেছিল, সুপ্রীতি ঘোষ তার বড় মাসির ননদের শাশুড়ি ছিলেন সম্পর্কে। না তার কাছে সুপ্রীতি ঘোষের কোনো গান নেই। কিন্তু শুভমের সংগ্রহে আছে। সে আমলের সেভেন্টি এইট রেকর্ড, এইচ,এম,ভির। সেই ফ্রেঞ্চ কাট তার কাছে এসে শুনে যাবে বলেছিল। আর রেকর্ড করে নেবে তেমন কথা ছিল। কিন্তু আসে নি। বাজারে দেখা হয়, হেসে সরে যায়, কিন্তু ওই প্রসঙ্গ আর তোলে না। শুভম হতাশ হয়েছে, গান তার যা সংগ্রহে আছে, তা তার নিজের জন্য তো নয়, শোনাতে চায় বহুজনকে। কিন্তু তেমন মানুষ কই ? এখন কেউ যদি বলে আপনাদের পাড়ার অমলকে চেনেন, অমল বসু। শুভম কী করে জানবে কে অমল বসু। ওই ফ্রেঞ্চ কাটই যে অমল বসু হলেও হতে পারে তা তার ধারণায় নেই। আবার ফ্রেঞ্চ কাট এ পাড়ায় জনা পাঁচের আছে। শুধু ফ্রেঞ্চ কাট বললে হবে ? সে চেনে অথচ পরিচয় জানে না, এমন কতজনা আছে। নাগকেশর গাছটি হয়তো তেমন।
২
আহা বৃষ্টিতে ভিজছে কিশোর কিশোরী, লাল শাড়ি নীল শাড়ি হলুদ শাড়ি সবুজ শাড়ি, খোপা ভেঙে পড়ছে এমন ভাবে যেন তা মেঘ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, বর্ষণ লাগি এ বাদরিয়া রুম ঝুমকে----তারা হাত ধরাধরি নেচে বর্ষার আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে, সে যে কী সুন্দর স্যার। মতিন মিঞা বলল। মতিন সাড়ে পাঁচ ফুট। পাঞ্জাবি আর প্যান্ট। মতিনের গালে কাঁচা পাকা দাড়ি। চোখে গোল চশমা। এই চশমা শুভম দেখেছে ছবিতে সুকুমার রায়ের চোখে। সে আমলে এই ছিল চশমা। আবার কি তা ফিরে এল? মতিন যেন একশো দেড়শো বছর ধরে হেঁটে এসেছে এই নাগ কেশর গাছের নিচে। এই মস্ত গাছটির কান্ডের গায়েই যেন ফুল। ঈষৎ লাল থোকা।
তুমি দেখতে পেলে ?
হ্যাঁ স্যার, না দেখতে পেলে তা কি আর গান হয় ! আমি সিডি বা রেকর্ড চালিয়ে চোখ বুঁজে সব দেখে নিই যদি গান গানের মতো হয়।
নাগকেশরের তলায় এলে কেন ?
স্যার এই দীঘির কোথাও আর গান নেই, যা আছে এইখানটায়, তাই।
আমি তো আর আসি না, বকের দল নিরাশ্রয় হয়ে চলে গেল যেদিন, তার পর আর না।
মতিন মিঞা বলল, গান নিয়ে উড়ে গেছে স্যার।
হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে তাই।
মতিন বলল, গান ছাড়া জগতে আর কিছু নাই।
হাসল শুভম বলল, তাই কি, তাহলে ওই দ্বীপ নষ্ট করল যারা তারা কি করে আনন্দে থাকে, বকেরা গান নিয়ে উড়ে গেল, গান ছাড়া জগতে এমন কিছু আছে যা গান নয়, আর তা নিয়ে লোকে সুখেই থাকে।
মতিন তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে, বলে, নাগকেশর গাছটি শুকিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, ওই গাছও তার গান নিয়ে চলে যাবে।
তারা হাঁটতে হাঁটতে শুভমের বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। শুভম বলল, আমাকে একটা সিডি পাঠিয়েছে আমার মোজাম্বিকের বন্ধু সৈদ জাফরি, আল ফাকিরার গান, তোমাকে আমি শোনাব মতিন।
মতিন বলল, জানি তুমি শোনাবে বলে ডেকেছ স্যার।
শুভম বলল, আমার কাছে আরো গান আছে, তুমি শুনলে আমি বাধিত হব মতিন।
মতিন বলল, আমি মাধমিক পেরতে পারি নি, তুমি কত বড় পন্ডিত লোক, কত সব গানের খোঁজ রাখ, আমাকে ওসব বলে কী হবে স্যার।
তারা পরস্পরের কাছে বিনয় প্রকাশ করতে করতে পৌঁছে যায় গানের ঘরে। তখন গানের ঘর ছিল তখন গভীর এক নিস্তব্ধতায় ভরা। খোলা জানালার ওপারে দিনের আলো নিভে আসছিল। শুভম বলে, সুপ্রীতি ঘোষ শুনবে না আলি ইব্রাহিম ?
সুপ্রীতি ঘোষ শুনলে চোখে জল এসে যায়। মতিন বলে।
কেন ?
সুপ্রীতি ঘোষ, গায়ত্রী বোস যে গান গেয়েছিল যে তা মানুষ ভুলেই গেছে স্যার, এদের গানও কি চলে গেছে বকের ডানায় ডানায়।
হয়তো তাই।
আমাদের বলা দরকার ছিল এম,এল,এ,কে, আপনার মনে নেই, শোনেন নি, সুপ্রীতি ঘোষ গেয়েছিল, সেথায় গেলে হারায় সবাই ফেরার ঠিকানা গো...বিদায় নেব একটিবার শুধু তোমায় দেখে, আপনি শুনেছেন, এই ফুলের দেশে কোন ভ্রমর এসে কী কথা নিয়ে যে করে কানাকানি, জানি তা জানি।
শুভম বলল, আমার বাবা মায়ের ছেলেবেলার গান।
হ্যাঁ, তুমি কি জান স্যার, কৃষ্ণকলির মুকুল কাঁপে উতল হাওয়াতে......কোন অলকার স্বপ্নে ভরা ফাল্গুনি রাতে, গায়ত্রী বসুর গান।
শুভম হাসে, বলে, শুনেছি যেন মনে হয়।
সব গান ঊড়ে গেছে স্যার সেই বকের ডানায়। মতিন চাপা গলায় বলে।
হ্যাঁ জানি, কিন্তু এই কাজে কতজন উপকৃত হয়েছে বলো, কনট্রাকটর, সাপ্লায়ার, থেকে সরকারি অফিসের বাবুরা।
স্যার উত্তরাখন্ডের পাহাড় যে ভেঙে পড়ল, সব ভেসে গেল, ঈশ্বরও ভেসে গেল, কেন তা টের পান?
পাই। বিনবিনিয়ে বলল শুভম।
পাহাড় প্রকৃতির গান চলে গিয়েছিল বকের ডানায় ?
হতে পারে তা, তুমি আলি ইব্রাহিম ফরকা শোনো মতিন, এমন তুমি শোনো নি আগে।
মতিন চুপ করে থাকে। শুভম বিদেশ থেকে আনা সিডি প্লেয়ারে আলি ফরকা চালিয়ে দিল। এবার অপেক্ষা। মতিন তাকিয়ে ছিল বাইরে। তারপর গিটার আর আফ্রিকান ড্রাম আর বাঁশির সঙ্গে ভেসে এল জলদ গম্ভীর স্বর। সেই স্বর যেন নাভি মূল থেকে ঊঠে আসতে লাগল। শুভম দেখল মতিনের দু চোখে বিস্ময়। মতিনের চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠতে লাগল বিস্ময়ে। সে আচমকা বলল, এ কী গান , কোন দেশের ?
মালি, আফ্রিকার একটি ছোট দেশ।
মতিনের চোখে জল, চাপা গলায় বলল, একটা বাচ্চা মরছে স্যার।
কী বলছ তুমি ?
ইয়েস স্যার, আমি দেখতে পাচ্ছি, বকেরা সব শকুন, গাছে গাছে শকুন, মানুষ মরছে, তারা অপেক্ষা করছে, দুর্ভিক্ষের দেশ।
কী বলছ ?
ঠিক বলছি স্যার, আমি দেখতে পাচ্ছি, বাচ্চাটার কহাত দূরে বুড়ি শকুন বসে আছে, মরলেই, স্যার কাঁদছে আকাশ, আকাশ, আর মরা নাগকেশর ছেয়ে গেছে শকুনে।
হোয়াট আর ইউ টেলিং ?
ইয়েস স্যার তাই, মরছে মরছে, এই গান আকাশের কান্না। বলতে বলতে মতিন দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে স্যার, সব দেখতে পাচ্ছি যে।
বন্ধ করে দি ?
দিন, আপনার কবি বুঝতে পারেন নি ?
না।
মতিন মিঞা চুপ করে থাকে এরপর। গানের ঘর আবার স্তব্ধ হল। কিন্তু আলি ফারকার কণ্ঠস্বর যেন বেঁচে থাকল। শূন্যে ভাসতে লাগল। সেই শূন্য থেকে শকুনেরা পাখা ঝাপটে নেমে আসছিল সেই পৃথিবীতে যে পৃথিবীতে একদিন ভেসে বেড়াত বকের পাখা।
অমর মিত্রের গল্পসংগ্রহ 'আশালতা' থেকে ( https://www.guruchandali.com/book.php?&page=2 )
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের " রেকর্ড " মনে পড়ে গেল।
স্বীকার করি, অবচেতনের সুপ্ত আবেগ উস্কে দেয় গান, সুর, লয়। গানেরই ক্ষমতা আছে, এমন বিভ্রম সৃষ্টির, আর মাদকেরও হয়তো।
এক ভোরে শ্রীমঙ্গলের খাসি পাহাড়ে ক্যাথলিক চার্চে আদিবাসী শিশুদের সমবেত কণ্ঠে "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে" এই প্রার্থনা সংগীতে চোখ ভিজে উঠেছিল।
আর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধদিনের কালে সুমনের "বাবা পড়ে আছেন মর্গে, লাল মোহনের মেয়ের মাধ্যমিক, এনকাউন্টার হলো কী বাস্তবিক?" গান শুনে ফুঁপিয়ে উঠেছিলাম।
এখনো ওই গান শুনলে বুকের ভিতরে শেল গেঁথে যায়। ....
লেখাটিকে খুব হৃদয়স্পর্শী। আরো লিখুন ..
চোখ ভেসে গেল।