সোনালী কাবিন কাব্যে ছিল যে তীব্র প্রেম আর আদিমতা, আল মাহমুদ আসলে সেই কবিই। রক্তমাংসের এমন নোনা গন্ধ বাংলা সাহিত্যে বিরল নিশ্চয়। আল মাহমুদের গল্প সেই গল্পই। নর নারীর জৈবিক প্রেম, আদিমতার সাহসী উচ্চারণ যেমন তাঁর কাব্যে দিয়েছিল অচেনা এক সুষমা, গল্পেও তাই। পানকৌড়ির রক্ত, কালো নৌকো, রোকনের স্বপ্নদোলা, নীল নাকফুল, বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা… আল মাহমুদ যে গল্প লিখেছেন, সেই গল্পে সোনালী কাবিনের কবিকে চেনা যায়। চেনা যায় তীব্র প্রেম, যৌনতা, আদিমতার এক অচেনা রূপ। আমি যতবার পড়েছি পানকৌড়ির রক্ত কিংবা জলবেশ্যা, পেয়েছি নতুন মাত্রা। জলবেশ্যার কথা নতুন করে বলি। নতুন করে বলি পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কার গন্ধ জড়ান মেঘনা তীরের লালপুর হাটের কথা। সেই হাট আমার অচেনা। আমি দেখিনি। মেঘনা ফেলে এসেছি ওপারে, লালপুর হাটও। কী করে চিনব? চিনেছি আল মাহমুদ এ। আসলে হাটের যে তন্নিষ্ঠ বিবরণ দেন তিনি, তা কবিই দিতে পারেন। তিনি গন্ধের বিবরণ দিয়ে যান। পেঁয়াজ রসুনের সিজিনে ক্রেতা বিক্রেতা, হাটুরে মানুষের গা থেকে পাওয়া যায় সেই গন্ধ, ঘামে পাওয়া যায় সেই গন্ধ…, হাটের ব্যাপারীরা অধিক রাতে হিশেব নিকেশ করে যখন মেঘনার বোয়াল কিংবা গজার মাছের লালচে সুরুয়া, মরিচ, গরম ভাতের বিবরণ দেন আল মাহমুদ তখন মনে হয়, এমন যেন দেখেছিলাম কিছুটা ক্যানিঙের মাছ বাজারে গভীর রাতে। কিন্তু মৃতপ্রায় মাতলা আর ভরা নদী মেঘনায় যে তফাৎ অনেক। মেঘনায় নাও নিয়ে ব্যাপারীরা আসে কত দূর থেকে, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে। নৌকোগুলির মহাজনরা পয়সাওয়ালা। তাদের কথা আলাদা করে বলতে হয়। কিন্তু সে কথা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, লালপুর হাটের আমিষ গন্ধও হারিয়ে যায় আবিদ ব্যাপারীর কাহিনি চলে এলে। আবিদ ব্যাপারী হাটের কেনা বেচার দালাল। নৌকোর মহাজনদের কেনা বেচার ভিতরে ঢুকে পড়ে তাদের লাভের অংশ পায়। এক হাটে আয় করে, পরের হাটের জন্য এক সপ্তাহ তার অপেক্ষা। যে টাকাটা পায় সে, তা দিয়ে এক সপ্তাহ ফুর্তি করে ভালোই কেটে যায়। আবিদ ব্যাপারী আর এক বেদেনীর কাহিনিতে পৌঁছতে লালপুর হাটকে চিনতে হয়। আসলে মানুষের বেঁচে থাকার এক আশ্চর্য কাহিনি লিখতে বসে কবি ক্রমশ উন্মোচন করেন এমন বাস্তবতা যা আমাদের প্রচলিত যাপনকে তুচ্ছ করে দেয়। দালালি করে আবিদ ব্যাপারীর এই সপ্তাহে আয় ২৫০ টাকা। সে মহাজনের নৌকোয় গিয়ে মুর্গির মাংস, বঙ্গেশ্বরী মদ, ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলতে তুলতে বেরিয়ে এসে মেঘনার পাড় ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে মেঘনার প্রায় ওপারে ভাসা বেদের নৌকোর বহরের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। নৌকোগুলিতে বিন্দু বিন্দু আলো দেখা যায়। তারা জেগে আছে। তারা ঘুমলে, নাও বহরের আলো নিভে গেলে, একটি নৌকোয় আলো জ্বলবে। একাকী হয়ে থাকা সেই নৌকাটি এখন অন্ধকারে চোখের মতো তাকিয়ে আছে আবিদ ব্যাপারীর চোখের দিকে। গল্পটি এত নিবিড়, এত অনুভূতিময়, এত প্রাকৃতিক যে যত ভিতরে প্রবেশ করবেন পাঠক, তাঁর শরীরে এসে বাসা বাঁধবে লালপুর হাটের আমিষ গন্ধ। অন্ধকার, শান্ত হয়ে থাকা মেঘনা, বেদেদের নৌকোর বহর, আকাশের চোখ, কালো চোখের মতো অন্ধকারে ভেসে থাকা নৌকো...এসবে প্রবেশ করতে লালপুর হাটে তার আরম্ভ হতেই হবে। আবিদ ব্যাপারী মেঘনার এক ঘাটে এসে অপেক্ষা করে কখন বেদের বহরের আলো নিভবে, আর অন্য কালো চোখের মতো নৌকোটিতে আলো জ্বলবে। আলো সাড়া দেবে। সে বটের শিকড়ের উপরে বসে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। কিছুটা দূরে তার মায়ের কবর। ওলাউঠোয় মারা গিয়েছিল মা। বাপে আবার বিয়ে করে তাকে খেদিয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে। জমি-জমার অংশ দেয়নি। দালালি করেই খায়। সে কবরে শুয়ে থাকা মাকে ডাক দেয় অন্ধকারে, “ “মায়ো, বাজান আবার এক বেডিরে বিয়া কইরা আমারে খেদাইয়া দিছে। জমি জিরাত কিছু দেয় নাই। আমি বাজারে ব্যবসা করি, দালালি করি। ভালাই আছি। তুই হুনছ মায়ো, আমার কতা? হুনছ?” ।
এই মানুষ আমাদের অচেনা। এই মানুষকে ক্রমাগত চিনিয়ে দেন লেখক। মায়ের কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে আবিদ ব্যাপারী কবরস্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। কবরের নিস্তব্ধতার ভিতরে তার মনে হয় কবরে যারা থাকে তাদের জীবন নেই। কবরের বাস্তবতা আর তার বাস্তবতা এক নয়। সে ভয় পেয়ে ফিরে আসে বটমূলে। আবার তাকিয়ে থাকে মেঘনার ভিতরে বেদে বহর থেকে একটি কালো চোখের মতো যে নৌকা আলাদা হয়ে আছে, তার দিকে।
গল্পটি যেন পাক দিয়ে দিয়ে এগোতে থাকে। প্রতিটি মুহূর্ত নির্মাণ করতে থাকেন লেখক বেদেনীর নৌকোর আলো জ্বলে ওঠার জন্য। বহরের আলো নিভলে একাকী নৌকো থেকে আলোর ঈঙ্গিত আসে। আসার আগেই আবিদ ব্যাপারী রওনা হয়েছিল ঘাটের নৌকো নিয়ে লগি ঠেলে ঠেলে। আসলে ২৫০ টাকা আয়, মদ, মাংসের পর তার চাই নারী। সেই নারী, একাকী নৌকোর নারী তাকে ডাকছে জলের ভিতর থেকে। হাটের দিনে তারাও আসে লালপুরের মেঘনায়। নিস্তব্ধ প্রকৃতির ভিতরে চুল উড়িয়ে আলো দুলিয়ে বেদেনী ডাকে পুরুষদের। আবিদ ব্যাপারী যাচ্ছে তার কাছে। নৌকো নিয়ে পৌঁছে যায় সে বেদেনীর নৌকোর কাছে। নৌকোটি লগি পুতে বেঁধে সে উঠে যায় বেদেনীর নৌকোয়। তার দেহখানির বিবরণ দেন কবি আল মাহমুদ, লেখক আল মাহমুদ এমন মোহময় করে, মনে পড়ে যায় সোনালী কাবিনের কবির প্রণয় নিবেদন। নাম কী বেদেনীর ? কেন বেউল্যা। বেহুলা সুন্দরী। তাদের পরিচয় এইভাবে হয় নৌকোয়,
“নাম জিগাইয়া কি অইব? নাম আমার বেউলা সুন্দরী!’
আমার নাম আবিদ ব্যাপারী। আমি অই হাডে দালালি করি।’ চিবুকটা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আবিদ ব্যাপারী।
‘অ আল্লাহ, আপনে তইলে লখিন্দর না! আর আমি ভাবতাছি, আমার নাওয়ে লখাই আইছে।”
লখাইই হয় আবিদ ব্যাপারী। কিন্তু এখানে বেহুলা লখিন্দরের সম্পর্ক সেই মঙ্গল কাব্যের নৈতিকতা বর্জিত। চাঁদ সদাগর বেনে ছিল। ব্যাপারীই তো। আবিদ ব্যাপারীর তাই লখাই হতে বাধা নেই। লখাই বা আবিদ ব্যাপারী খুতি থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে। তা নিয়ে বেহুলা নিজেকে সমর্পণ করে ব্যাপারীর কাছে। লখাইয়ের কাছে। তাদের জৈবিকতা, কামনাকে চিত্রিত করেছেন লেখক এক আশ্চর্য সুন্দর শিল্প ভাষায়। যৌনতা এত সুষমা মণ্ডিত এই কাহিনিতে যে পড়তে পড়তে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে হয়। আসলে আল মাহমুদের এই গল্পের প্রতিটি বিন্দু যেন একটু একটু করে নির্মাণ। উপমায়, ব্যঞ্জনায় গল্প প্রতি বিন্দুতে এক এক মাত্রা অর্জন করে যেন। তাই জলবেশ্যা, বেদেনীর কাছে এসে পৌঁছতে অনেক মুহূর্ত নির্মাণ করতে করতে এগোতে হয়। কবির দেখার সঙ্গে আমাদের দৃষ্টি মিলে যেতে থাকে। নর নারীর যৌনতার যে ছলাকলা এই গল্পে নির্মাণ করেছেন লেখক তা যেন নাগ নাগিনীর মিলনের চেহারা নিতে থাকে ক্রমশ। কবির লেখা গল্প, শিল্পীর লেখা গল্প তাই যৌনতা হয়ে ওঠে অপূর্ব সুষমা মণ্ডিত। বেহুলা লখিন্দরের মৃতদেহকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রের সভায়, এই গল্পে নিজে বেহুলা হয়ে কালনাগিনীর ঝাঁপির ভিতরে পঞ্চাশ টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে উদোম হয় বেদেনী। আহ্বান করে লখাইকে। নারী পুরুষের আদিমতা কত সৌন্দর্যময় হতে পারে তার নিদর্শন এই গল্প। কিন্তু সেই আদিমতা যেখানে পৌঁছয় তা আমাদের স্তম্ভিত করে। গল্পের অন্তিমটুকু না হয় বাদই থাক। পাঠক খুঁজে বের করুন কীভাবে মিথ ভেঙেছেন লেখক। একাকী নৌকায় লখিন্দর ভেসে চলে অকুল মেঘনার জলে। বেদেনীর নৌকো যায় অন্য পথে। কবির লেখা গল্প কবির কবিতার গা ঘেষে ভেসে যায় আকাশের নিচে। সব চোখ এখন ভোরের আকাশে যা কিনা মুক্তা ফলবৎ হিম নীলাভ। কমলকুমার স্মরণ করি শেষ বাক্যটিতে।
আহা... দারুণ..
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।