বুদ্ধ পূর্ণিমায় কী হয়েছিল, খবরিয়া পেনসিলিয়া খবর দিল।
অন্ধ্রপ্রদেশে বিশাখাপত্তনমে এল জি ব্যাটারির কারখানায় গ্যাস লিক করে ১১জনের মৃত্যু হয়েছে। আরো কিছু মানুষ মৃত্যু মুখে। কারখানা দক্ষিণ কোরিয়ার মালিকানার। এই গ্যাস লিক ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভোপালে ইউনিয়ন কারবাইড কারখানার গ্যাস লিকের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। লকডাউনের পর কারখানা খুলছিল। এতদিন যে বন্ধ ছিল, কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল না প্রাণঘাতী গ্যাসের ট্যাঙ্কারে। এই ঘটনা নিয়ে অনেক রাতে কলকাতার মেয়ে রোশনীকুহু চক্রবর্তী যিনি থাকেন হায়দরাবাদে, তিনি উদয়ন বসাকের একটি লেখা উদ্ধৃত করেছেন, খুবই প্রাসঙ্গিক, অংশত তা বলছি,
“একটি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি থেকে গ্যাস কিভাবে লিক হতে পারে তা আমার বোধের বাইরে। তারা যথেষ্ট সচেতন রাসায়নিক দ্রব্যের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে। তারপরও যদি তারা যথেষ্ট সুরক্ষার না নিয়ে থাকে, তাহলে এটিকে মর্মান্তিক মৃত্যু নয় বরং খুন বলা উচিৎ। এটিকে অবহেলা বলে, আর তা না বললে বলতে হয় ইচ্ছাকৃত করা ঘটনা। বলা হচ্ছে, এল. জি. পলিমার ইন্ডাস্ট্রি থেকে স্টাইরিন (styrene) গ্যাসের লিকের জন্য এই অবস্থা, কিন্তু সেখানে টলুইন (toluene) বা বেঞ্জিন (benzene) গ্যাসের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে না যা আরো বিষাক্ত এমনকি কার্সেনোজেনিক (carcinogenic)। যারা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তারা সবাই আদৌ সেরে উঠবে কিনা তার কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। আর সেরে উঠলেই বা, তাদের প্রত্যেককে সারা জীবন এই ক্ষতি (acute asthma) ফুসফুসে নিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে। এবার বলুন এ দায় কে নেবে? পুঁজিপতি? রাষ্ট্র না রাষ্ট্রের দালালরা? শাস্তি হবে এই খুনের? হ্যাঁ এটা খুনই, কারণ একটি ইন্ডাস্ট্রি যখন জানে যে তাদের ব্যবহার করা গ্যাস লিকের দরুন মানুষের মৃত্যু হতেও পারে, তখন উৎপাদনের থেকেও সেটিকে সুরক্ষিত করা তাদের প্রধান দায়িত্ব। এই কর্পোরেট ইন্ডাস্ট্রির পুঁজিপতিরা মানুষকে গিনিপিগের মতো দেখে। এই ঘটনায় মাত্র ১০ জন (যদিও আমার মনে হয় না) মরেছে বলে হাত-পা গুটিয়ে ভাববেন না, মাত্র তো ১০ জন। নিশ্চিন্তে ঘুমানোর আগে ভোপাল ট্রাজিডির কথা মনে করে নেবেন, আর না মনে থাকলে ইন্টারনেটে খুঁজে নেবেন। ভয়ে হাড় হিম হয়ে আসবে।”
মার্কো পোলো বিমর্ষ জয়িত্রীকে বলে,
ভোপাল ট্রাজেডি তো জানা। ১৯৮৩, ডিসেম্বরের ২ তারিখ। বাতাস বইছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে, তাই সম্পন্ন মানুষ বেঁচে গিয়েছিলেন। ফ্যাক্টরির দক্ষিণে ধেয়ে গিয়েছিল মারণ গ্যাস। সেদিকে গরিব মানুষের বসবাস। কত মানুষ মরে গিয়েছিল হিশেব নেই। গরিব মানুষ পোকামাকড়, মনে হয় হিশেব করেই গ্যাস ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তার মারণ ক্ষমতা পরীক্ষা করতে। মুখ্যমন্ত্রী বিমানে করে ভোপাল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইউনিয়ন কার্বাইডের কর্মকর্তারা মার্কিন দেশে পালিয়েছিলেন। সরকার ছেড়ে দিয়েছিল। ভোপাল গ্যাস ট্রাজেডিকে এখনো মনে করা হয় মারণ গ্যাসের পরীক্ষা। গরিব মানুষকে গিনিপিগ বানানো হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো উদ্ধার হয়নি। মার্কো বলছিল, সে তখন ভোপালের কাছে বিদিশা নগরে, সাঁচি স্তূপ ওই অঞ্চলে, ঘরের কাঁথা-কম্বলে মুড়ে শুয়ে থাকা মানুষও বাঁচেনি, হ্যাঁ, কিছু বেঁচেছিল, তারা পালিয়ে এসেছিল সাঁচির দিকে, বিদিশার দিকে...।
বিদিশা? জয়িত্রী অবাক হয়ে বলে, মার্কো সে তো তোমার জন্মের কত শত বছর আগের কথা, তারও আগের কথা সাঁচি স্তুপ, তুমি কবের কথা বলছ মার্কো ?
মার্কো বলল, সেই বছর, তখন আমি সাঁচি স্তূপের অদূরে বিদিশা নগরে বেত্রবতী নদীর জলে নিজের মুখ দেখছিলাম, মরেই যেতাম জয়িত্রী, আমি তো ওই মহল্লায় রবি লায়েকের ফ্যামিলিতে ছিলাম তাদের আশ্রয়ে, রবির পুরো ফ্যামিলি মরে গিয়েছিল জয়িত্রী, আমি কি বেঁচে থাকতাম।
জয়িত্রী বলল, এই সেযান শহরে আসবে বলে তুমি বিদিশায় চলে গিয়েছিলে মার্কো, কিন্তু শীতে তো বেত্রবতী নদীতে জল থাকে না, বর্ষায় ঐ নদীর নীল জলের কথা আমি কল্পনা করেছি মহাকবির কাব্য পাঠে, মার্কো তুমি কি দেখেছিলে নিচৈ পাহাড়ের গুহায় প্রেমিক প্রেমিকার গুঞ্জন…
এসব নিতান্তই কল্পনা, মার্কো এবং জয়িত্রীর ভিতরে কী কথা হয়েছিল, তা খবরিয়ার আন্দাজ মাত্র। খবরিয়া পেনসিলিয়া জানে জয়িত্রীর আজ মন ভালো নেই। গত রাতে তার ঘুম হয়নি বিশেষ। কতবার ভেবেছে তার মোবাইল ফোন বেজে উঠবে। বাজেনি। মোবাইলে নেট অন করা। হোয়াটস আপ কল আসেনি।নভশ্চর অ্যালেক্সের ফেসবুক পেজ ডি অ্যাক্টিভেট করা আছে মনে হয়। খুঁজেই পায়নি। নাকি সে তাকে ব্লক করে রেখেছে। আজ ৮-ই মে। গত কাল ভেসে এসেছে আর এক বিষাদ অশ্রু,
সমীর চট্টোপাধ্যায় লিখল,
কেউ জানে না
যে লোকটি কাজ হারিয়ে ফেরত এল ভিন রাজ্য থেকে বা ভিন দেশ থেকে সে কবে আবার ফেরত যাবে ফেরত পাবে কাজ , কেউ জানে না।
স্কুলে স্কুলে কখন বাজবে ঘন্টা, শিশুদের কলরবে মুখরিত হবে সকাল , কেউ জানে না।
বিকেল হতে না হতেই ওই যে মাঠে কয়েক দল ছেলেপুলে চামড়ার বলটা নিয়ে কী দস্যিপনাই না করে , তারা কবে আবার ঘাম ঝরাবে মাঠে , কেউ জানে না।
সব কটা ফুটপাত হকারের শোরগোলে ক্যাসেটের চিৎকারে ক্রেতাদের গুঁতোগুতিতে মহিলাদের দরদামে ভালোমানুষ পথচারীদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবে কবে আবার , কেউ জানে না।
ভিড়ঠাসা বাসে ভিড়ঠাসা মেট্রোয় কবে যে পুরুষ মহিলার পেছনে নির্বিকল্প স্ট্যাচু পোজে দাঁড়াবে , কেউ জানে না।
সিনেমা হলে মাল্টিপ্লেক্সে হাউস ফুল লাল আলো দেখে প্রেমিকা দুষবে প্রেমিককে প্রেমিক প্রেমিকাকে কবে আবার , কেউ জানে না।
আবার ফিরে আসবে কবে সেই নিভৃতি যখন চুম্বন নিরাপদ মনে হবে , কেউ জানে না।
ওগো সোনাগাছির মেয়ে , পাউডার লিপস্টিকে সেজে কবে আবার তুমি রাস্তায় দাঁড়াবে অহংকারী ভঙ্গিতে , এখন যে পেটে তোমার দাউদাউ খিদে আর বাড়িউলির তাগাদা , কেউ জানে না।
ওরে আমার যাত্রাপাড়ার রঙ্গিলা নায়িকা , ওরে আমার গ্রুপ থিয়েটারের চোখে স্বপ্নের কাজল মাখা যুবক যুবতী , কবে আবার বেজে উঠবে ক্ল্যারিওনেট কবে আবার ডায়ালগের ক্লান্তিহীন রিহার্সালে ঢেকে যাবে ট্রামের ঘর্ঘর , কবে আবার ফিরে আসবে প্রথম শোয়ের চোখের পাতা এক করতে না পারা উত্তেজনা , কেউ জানে না।
হে আমার প্রিয় কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকান , হে আমার না - কিনতে পারা প্রিয় গ্রন্থরাজি , কবে আবার তোমাকে নাড়ব চাড়ব ঘাঁটব , কবে ভিড়ে ভিড়াক্কার বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঠিক খুঁজে নেবো দেজ-এর দরোজা , কফি হাউসের ধূমায়িত পরিবেশে দম বন্ধ হয়ে যায় যায় আমার তবু একটু বন্ধুতা আর একটু আড্ডার লোভে আর একবার কয়েক কাপ কালো কফি আসবে টেবিলে , অমর নলিনী অলোক প্রবুদ্ধ সমীরণ দেবাঞ্জন জয়ন্ত তিমির বলবে আরও একটু আরও একটু বসতে ----- কবে আবার , হবে কি আবার , কেউ জানে না।
সদ্য চাকরি পাওয়া ছেলেটির চাকরি চলে গেল , বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েটির বিয়ে পিছিয়ে গেল অনির্দিষ্ট সময় , রেস্তরাঁর ছেলেটির টিপস নেই , মলের ঝাঁ চকচকে দোকানের অল্প মাইনের ছেলে মেয়েটির মাইনে নেই , তড়তড় প্রমোশন পাচ্ছিল মাইনে বাড়ছিল যে ছেলেটির সে জেনে গেছে এ মূহুর্তে সব বন্ধ , সদ্য চাকরির দুনিয়ায় পা দিচ্ছিল যে সে জেনে গেছে দুয়ারে খিল , কবে খুলবে কেউ জানে না।
আমি তুমি আমরা আজ আছি কালও কি আছি , কেউ জানে না।
কেউ জানে না। কেউ জানে না। কেউ জানে না।
শুনতে শুনতে জয়িত্রী বলল, অ্যালেক্স কবে ফিরবে কেউ জানে না, মনে হয় টেলিভিশনে সংবাদ পাঠের সময় অ্যালেক্সের কথা বলে দিই। কিন্তু মেয়র কি তা অনুমোদন করবেন, কত মানুষ তো কত জায়গায় আটকে গেছে, মেয়র সব জেনে কাল দেখাই করলেন না।
মার্কো পোলো
৮-ই মে, আজ ২৫শে বৈশাখ। জয়িত্রী রবীন্দ্রনাথের সূত্রেই ভারত চেনে, সে ডাকঘর, দ্য পোস্ট অফিস পড়েছে। অমলকে চেনে। সুধাকে চেনে। পিসে মশায়, ঠাকুরদা আর কবিরাজ। জয়িত্রী বলল, অমল আর এই পৃথিবী, সব কি চেনা যায় না মার্কো ?
মার্কো বলল, শোনো জয়িত্রী, সেই সব হারিয়ে যাওয়া ভোরের কথা,
“ ২৫শের ভোরে আমরা বন্ধুরা ২ নম্বর বাসে চেপে ভোর ৪-৩০-- ৪-৪৫-এ রওনা হতাম রবীন্দ্র সদনের পথে। সামনের দিকে বসার জায়গা নিতে হবে। তারপর গান আর গান। শান্তিদেব ঘোষ, দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত, কণিকা, সুচিত্রা, সুমিত্রা সেন, দ্বিজেন, সাগর সেন থেকে অতি নবীন গায়ক গায়িকারা। মান্না দে এসে শুনিয়ে গেলেন, না চাহিলে যারে পাওয়া যায়। মেঘ ও রৌদ্র ছবিটির কথা মনে পড়ে গেল এই পঁচিশের ভোরে। হাঁসু বন্দ্যোপাধ্যায় আর কোন ছবি করেছিলেন মনে নেই। তো সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখতাম কবিতা পত্রিকা নিয়ে বসে আছেন কবিরা। কবিতা পাঠ চলছে এখানে ওখানে। কাউকেই তো চিনতাম না, কিন্তু কিনে আনতাম পত্রিকা। কেউ হয়ত চিনিয়ে দিল ওই যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়...। এরপর বন্ধু বদল হলো। আমিও লিখি। আমাদেরও পত্রিকা আছে। আমরা যাই পত্রিকা নিয়ে। কবিতার কত রকম পত্রিকা। ২৫শে বৈশাখ নামেই একটি লম্বা চওড়া পত্রিকা বেরত শুধু কবিতা আর কবিতা নিয়ে। কতজনের সঙ্গে ওখানেই আলাপ। মনে পড়ে গেল কৃত্তিবাস রায়ের কথা। তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত এক যুবক এসে আমার সঙ্গে আলাপ করল, আমি আপনার এই এই পড়েছি। প্রথম গল্পের বইটি পর্যন্ত। এসব ৮০-র দশকের শুরুর কথা, কিংবা সত্তরের শেষের কথা। আর দেখিনি তাকে। খুব মনে পড়ে। কবি যোগব্রত, শিল্পী অসিত পাল, প্রশান্ত রায়, অজয় নাগ, পার্থপ্রতিম, নিশীথ ভড়, কতজনের নাম মনে আসছে, সকলে রবীন্দ্রসদনে। এঁরা সব বিখ্যাত কবি। এরপর যোগব্রত মারা যান। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে এক আশ্চর্য এলিজি লিখেছিলেন। কলকাতার জীবন থেকে সেই রবীন্দ্র সদনের ভোর হারিয়ে গেছে। জোড়াসাঁকো গিয়েছি অনেক ভোরে। সপরিবারে গিয়েছি। গান শুনেছি। ঠাকুর বাড়ি দেখেছি ঘুরে ঘুরে। কিন্তু ওই বেনিয়াপাড়া আমার পছন্দ হয়নি কোনোদিন। ঠাকুরবাড়ির ভিতরে গেলে অবশ্য সব বদল হয়ে যায়। আমার মনে পড়ে ওই বাড়ির ভিতরে এক রাজার বাড়ি আছে। একটি বালিকা এসে বলে যেত বালক রবিকে। আমি সেই রাজার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে পাইনি কিন্তু রাস্তাটা দেখেছিলাম মনে হয়। আচমকা সেই রাস্তাটা হারিয়ে যায়। শোনো জয়িত্রী পৃথিবী থেকে সুন্দরের বিদায় ঘন্টা যত বেজেছে, মানুষ বিপন্ন হয়েছে তত বেশি। সেই ভোরে কবির জন্মদিনে খবর এসেছিল,
মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে মালগাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে ১৪জন শ্রমিকের। ৫১জনের দল ফিরছিলেন নিজ রাজ্য মধ্যপ্রদেশে। ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন পাঁচজন। মৃতদের মধ্যে কয়েক জন শিশুও রয়েছে। শুক্রবার সকাল পাঁচটা নাগাদ এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, ওই পরিযায়ী শ্রমিকরা হেঁটে মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশ ফিরছিলেন। রাস্তায় ক্লান্ত হয়ে, ঔরঙ্গাবাদের কারমাড থানা এলাকায় রেল লাইনের উপর ঘুমিয়ে পড়েন তাঁরা। সেখানেই ঔরঙ্গাবাদ ও জালনার মধ্যে একটি মালগাড়ি পিষে দিয়ে চলে যায় তাঁদের। এই হলো খবর। মানুষ কত নিরূপায় হয়ে কৃষ্ণগহ্বরের ভিতর প্রবেশ করছে, নিঃশেষ হচ্ছে তা কেউ জানে না। ভারতবর্ষ জুড়ে শ্রমিক হাঁটছে। কবির জন্মদিন অন্ধকারে ছেয়ে গেল। শ্রমিকের জন্য দেশ কোনো দায়িত্ব নেয় না। নিষ্ঠুর রাজনৈতিক নেতা বললেন, রেললাইন তো ঘুমোনর জায়গা নয়, এর দায় সরকারের নয়।
১০.০৫
টেলিভিশন দেখতে ভয় করছে। শুধু মৃত্যু নিয়ে তর্জা। রাজনৈতিক নেতাদের কথা শুনে যাবে মানুষ?
মানুষের কথা তাঁরা শুনবেন না?
১১.০৫
বিশ্বজোড়া করোনা ত্রাসে স্বল্প সময়ের নোটিশে লকডাউন জারি হয়েছে একের পর এক দেশে। প্রস্তুতি ছাড়াই প্রবাসে আটকে পড়েছিলেন ভারতীয়রা। বন্দে ভারত মিশনের মাধ্যমে তাঁদের দেশে ফেরানোর কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করেছে সরকার। এবার মার্কিন মুলুক, লন্ডনে আটকে পড়া ভারতীয়দের নিয়ে আসা হচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়ার বিশেষ বিমানে করে।
আজ ভোরে মধ্যপ্রদেশে আবার ৫ শ্রমিক রেলে কাটা পড়েছে। তারাও হেঁটে ঘরে ফিরছিল। হাইওয়ে ধরে ট্রলি ব্যাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছেন শ্রমিক মা। তাকে জাপটে ধরে ঘুমোচ্ছে শিশু। এই ভারত আমার। তাদের ফেরার কোনো ব্যবস্থা করেনি ভারত সরকার।
দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েই চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩,২৭৭ জন সংক্রমিত ও মৃত ১২৮ জন। স্বাস্থ্যমন্ত্রক প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে কোভিড আক্রান্ত ৬২,৯৩৯। এর মধ্যে অ্যাকটিভ কেস ৪১,৪২৭ ও সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১৯,৩৫৮ জন। মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২,১০৯।
বাংলায় করোনায় মৃতের সংখ্যা ১০০ ছুঁইছুঁই। এ রাজ্য়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৯। বর্তমানে পজিটিভ কেসের সংখ্যা ১,২৪৩। মোট করোনা আক্রান্ত ১,৭৮৬। রাজ্য়ে করোনামুক্ত হয়েছেন ৩৭২ জন। গোটা বিশ্বে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ করোনার কবলে, মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি।
কাল কোভিড হলে হবে। কিন্তু আজ তো পেট ছেড়ে কথা বলছে না। কাল শ্বাসকষ্ট বাড়লে দেখা যাবে, কিন্তু আজ তো ফিরতে হবে ছেড়ে আসা গ্রামে। কাল গোপনে লাশ গুম করে দেওয়া হলে হবে কিন্তু আজও যখন পা জিন্দা আছে, হাঁটতেই হবে। হ্যাঁ দরকার হলে জলজঙ্গলের মধ্যে দিয়েই। চাঁদরাতে হারামি চোখদুটো জড়িয়ে এলে শুয়ে পড়তে হবে কালান্তক রেললাইনকে বালিশ করেই.... লিখলেন অগ্নি রায়।
ইতিহাসের নামী অধ্যাপক হরি বাসুদেবন করোনা আক্রান্ত হয়ে চারদিনের ভিতর চলে গেলেন। তাঁর পরিবারের কেউ দেখতে পেলেন না তাঁকে। হাসপাতাল মৃত্যু, নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। করোনা ভাইরাস কাছাকাছি বৃত্তের ভিতরে যেন প্রবেশ করছে। ভয় সংক্রামিত হচ্ছে।
১২.০৫
করোনা প্রতিরোধক আপডেট
*****************************
১। রেমডিসেভির ইনজেকশন ( জাপানে মঞ্জুর ) - ৩১ % রিকভারি রেট।
২। অক্সফোর্ড জেনার ইনস্টিটিউট সুপার ভ্যাকসিন - প্রথম পর্যায় সফল। দ্বিতীয় পর্যায় চলছে। ভারতের 'সিরাম' কোম্পানি শুরু করেছে এই ভ্যাকসিন বানানো।
৩। ইজরায়েল - প্রকৃত অ্যান্টিবডি খুঁজে ভ্যাকসিন বের করায় সাফল্য পেয়েছে জানিয়েছে ( শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে - মোসাদ এর ল্যাবে )
৪। ইতালি - ভ্যাকসিনের কাজ শেষ পর্যায়ে
৫। চিন জানিয়েছে তাদের দুটি ভ্যাকসিন সফল।
৬। ভারত - প্লাজমা থেরাপি সহ মোট ৩০ টি ভ্যাকসিনের কাজ চলছে। ৫ টি শেষ পর্যায়ে।
আজকেই করোনা ভ্যাকসিন ডেভলপিং এর জন্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ, ভারত বায়োটেক এর সঙ্গে পার্টনারশিপ করেছে।
মিলন চ্যাটারজি।
সুত্র - আন্তর্জালের বিভিন্ন ওয়েবসাইট। আশা নিয়ে বাঁচা।
প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশে ভাষণ, ২০ লক্ষ কোটির প্যাকেজ ঘোষণা। এই নিয়ে বিস্তর আলাপ চলছে। এই টাকার ভিতরে অর্থমন্ত্রী এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া প্যাকেজও রয়েছে শুনছি।
খবরিয়া খবর নিলঃ
গত দুদিন আগে (০৯-১০ মে ) হুগলীজেলার চন্দননগরের তেলেনিপাড়া অঞ্চলে কোভিড -১৯ পজিটিভ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেছে। তার অনুপুঙ্খ বিবরণ শুনলাম চন্দননগরের তরুণ বন্ধু অধ্যাপক বিশ্বজিত পণ্ডার কাছে। বিবরণের প্রয়োজন নেই, কিন্তু এই অতিমারীর দিনে মানুষের হিংস্রতা কমছে না। রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি কমছে না। কী ভয়ানক এক সমাজ গড়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে নেওয়ার জন্য এদেশের রাজনৈতিক দলগুলি কত নিচে নামতে পারে, তার চিহ্ন হলো এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত করা। ঈশ্বরগুপ্ত সেতু পার হয়ে অ্যাম্বুলেন্সে সাইরেন বাজাতে বাজাতে দাঙ্গাবাজের দল এসেছিল চন্দননগর। প্রশাসন দু’পক্ষকে শান্ত করেছে। দমন করেছে অপরাধ। দুই পক্ষই ছিল হিংস্র।
বারুইপুরে এক করোনা আক্রান্ত রোগীকে আইশোলেশনে নিয়ে যেতে চেয়ে পুলিশ মার খেয়েছে। রাজনৈতিক আশ্রয় ব্যতীত কি মানুষ পুলিশের গায়ে হাত দিতে পারে ? মহামারীর সময় দাঙ্গা হয়, মহামারীর দায় এক পক্ষের উপর চাপিয়ে দিতে। এক পক্ষ মানে সংখ্যালঘু, দলিত, দুর্বল শ্রেণী, বস্তিবাসী, শ্রমিক, ফুটপাথবাসী--- তাদের ঘাড়ে চাপাতে পারলে কর্তৃপক্ষ হাত ঝেড়ে ফেলতে পারেন।
উল্লেখ করি গুরুচণ্ডালীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি লেখা।
ফরাসী সমালোচক রেনে গার্দঁ প্লেগ সম্বন্ধে লিখেছিলেন, "প্লেগের বিশেষত্ব হল এই যে এ সমস্ত বিশেষত্বকে অবান্তর করে দেয়"। অতিমারী তাই হতেই পারত সমতা ফেরানোর এক মহাবাহক - কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এক্ষেত্রে ব্যপারটা সেরকম নয়। না, অতিমারী কখনোই সমতা আনতে পারে না - উলটে তার হাত ধরে আরো বেশী বেশী করে এসে পড়ে ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা এবং কোন মনগড়া সম্ভাব্য শত্রুর বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষ। ইউরোপে প্লেগের বিস্তারকালে ইহুদিরা অস্পৃশ্য হয়ে পড়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার পশ্চিম উপকূলে কলেরা এবং মেনিনজাইটিস ছড়িয়ে পড়ায় একঘরে করা হয়েছিল হিন্দু এবং শিখদের। হিটলারের জার্মানি " জিপসি প্লেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ঘোষণা করে জিপসিদের প্রায় বিলুপ্তই করে দিয়েছিল সে দেশ থেকে। সুজন শুক্লা তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন বিভিন্ন সমাজ কিভাবে করোনা ভাইরাসের মুখে পড়ে নিজের নিজের মত করে তাদের দোষারোপের বলির পাঁঠা খুঁজে নিয়েছে। আমেরিকানরা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দোষ দিচ্ছে প্রবাসী চিনাদের, চিনারা উইঘারদের, পাকিস্তান দোষ দিচ্ছে হাজারাদের, ভারত মুসলিমদের, আর মুসলিমরা জাহিল মুসলিমদের। স্প্যানিশ ফ্লু এর দোষ চাপানো হয়েছিল স্প্যানিশদের ঘাড়ে, আবার স্প্যানিশরা একে বলতেন "ফ্রেঞ্চ ফ্লু" - অর্থাৎ দোষটা ফরাসীদের। রাষ্ট্রের চোখে পরিযায়ী শ্রমিকেরা সবাই সন্দেহভাজন। বড় বড় "বহুজাতিক" শহরগুলি এই শ্রমিকদের তাড়িয়ে দিয়েছে, আর গ্রামের অভিজাতেরা যারা এদের আগেই দূর করে দিয়েছিলেন, দরজা জানলা বন্ধ করার নতুন বাহানা পেয়ে গেছেন। অতিমারীর সময়ই এরকম পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য সেরা সুযোগ নয় কি? উপরন্তু মুসলিমদের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দিতে পারলে, উচ্চবিত্ত শ্রেণী, যারা বিমানে দেশে বিদেশে যাতায়াত করে এবং যাদের এই ভাইরাসের প্রাথমিক এবং প্রধান বাহক বলে ভাবা হচ্ছে, তাদের দিক থেকে আলোচনাটা সরিয়ে নেওয়ারও সুবিধা হয়, তারা দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে। কর্পোরেট মিডিয়া এবং রাষ্ট্র উভয়ের পক্ষেই তাদের মতাদর্শের বিপরীতগামী এই ন্যারেটিভ থেকে মনোযোগটা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া খুবই জরুরী ছিল।
(২৩শে এপ্রিল, ২০২০)
ব্রহ্ম প্রকাশ- জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ এর সহকারী অধ্যাপক। ( অনুবাদ রৌহিন ব্যানারজি )
এত খারাপ খবরের ভিতর অদ্ভুত এক ভালো খবর এল। তারা বিয়ে করবে বলেছিল ২৫শে বৈশাখ। সাহিত্যপ্রাণ দুই যুবক যুবতী। বনগ্রামের শ্রাবন্তী মজুমদার এবং মধ্যমগ্রামের বিশ্বজিৎ রায়। করোনা সব পরিকল্পনা ধ্বংস করে দিয়েছিল। বিশ্বজিৎ আছেন এখন আর এক গ্রামে, গুরুগ্রামে চাকরিতে। তাঁরা জুম অ্যাপ ব্যবহার করে ভিডিওর মাধ্যমে বিবাহ সেরেছেন। পুরোহিত মন্ত্র পড়েছে বনগ্রামে তাঁর বাড়িতে বসে। কনে তার বাড়ি, বর গুরুগ্রামে নিজের ঘরে একা। বিবাহের মন্ত্র পড়া হলো। মানুষের অদম্যতার শেষ নেই। শেষ নেই। সব মিটলে তাঁরা উৎসব করবেন।
শুনতে শুনতে জয়িত্রীর মনে হলো, অ্যালেক্স এবং সে, তার প্রেমিক নভশ্চর ও সে, তারা কি এই পথে যাবে ? পৃথিবী কি অবাস্তবতার দিকেই ক্রমশ হেঁটে যাবে ? ভিনদেশে একলা ঘরে আটকে আছে অ্যালেক্স। খাঁচায় বন্দী বাঘের মতো ঘরের ভিতরে পায়চারি করতে করতে অবসাদে ঘুমিয়েই পড়ছে সে। কতদূর মহাকাশে কতদিন ছুটে যাবে সে, লাইকা।
মার্কো পোলো চুপ করে তাকিয়ে আছে জয়িত্রীর দিকে, ওর প্রশ্নের ভিতর উত্তর নিহিত আছে।
জয়িত্রী বলল, অবাস্তব, ভার্চুয়াল রিয়ালিটির ভিতরেই কি মানুষের নির্বাসন হবে মার্কো, আমাদের প্রেম আমাদের ভালোবাসা আমাদের আদর, আমাদের চুম্বন, আমাদের সঙ্গম সবই কি কল্পনায় নিহিত থাকবে, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি আমাদের ভবিতব্য ?
মার্কো মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, লক ডাউন উঠবেই, আর এই নগরে লকডাউন নেই, এইটা আমার কাছে অবাস্তব মনে হয় জয়িত্রী।
জয়িত্রীর মুখ নত হলো কেন, জয়িত্রী জানে না।