আর্ট কাকে বলে এই প্রশ্নটা করলে, যুগে যুগে নানান রকম উত্তর পাওয়া যায়। রেনেসাঁ-পূর্ববর্তী যুগে একরকম, পরবর্তী যুগে আরেক রকম, উনিশ শতকে আগে এক, পরে এক। কিন্তু প্রতি যুগেই নতুন কোন আর্ট মুভমেন্টের পেছনে একটা প্রতিবাদী সত্ত্বা বা যুগ পালটে দেওয়ার মত জেদ কাজ করেছে। শুরুর দিকে তা হয়তো টেকনোলজি বা রঙের রসায়নভিত্তিক ছিল। রঙের মিডিয়াম, ছবির পার্স্পেক্টিভ, বিষয়ের বৈচিত্র্য ইত্যাদি নিয়ে রেনেসাঁ ও তার পরবর্তী যুগে বহু শিল্পী তাদের শৈলী তৈরী করেছেন। কিন্তু সেই শিল্পের উদ্দেশ্য মূলত প্রকাশভঙ্গিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং সমাজকে, যুগকে পালটে দেবার এক আগ্রাসনও তার মধ্যে ছিল। শুধু আগ্রাসনই ছিল না, সমাজকে সে পাল্টেও দিয়েছে রীতিমতো। ইউজিন ডেলাক্যোয়ার "Liberty Leading the People" ছবিটাই ভাবুন (ছবি ১)
ফ্রেঞ্চ রেভোলুশান শেষ হয়ে নেপোলিয়ন হয়ে ফ্রান্সে তখন জুলাই রেভোলুশান চলছে। ফ্রান্সে তখনো হিরো ওয়ারশিপিং চলছে। লিবার্টি শব্দটা মানুষের কানে নিত্যই বাজছে। একই সময় আর্ট চলেছে তার রোমান্টিসিজম নিয়ে। ডেলাক্যোয়ার তুলিতে উঠে এল এই লিবার্টি, যে কোন দেবী নয়, বরং সাধারণ মানুষ। যুদ্ধে তার কাপড় এলোমেলো হয়ে যায়, কিন্তু সে পতাকা উঁচিয়ে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে। ছবিটার মধ্যে স্বাধীনতা, ধনীদের দমন পীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এতটা মূর্ত - যে একে অনেকে ভুল করে ফ্রেঞ্চ রেভোলুশান (১৭৮৯) এর প্রতীকি ছবি বলেও মনে করেন। লিবার্টি তখনকার আর্ট রেভোলুশানের সাথে এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছিল যে বহু ছবিতেই তার আবির্ভাব ঘটে। এমনকি লিবার্টি আইল্যান্ডের স্ট্যাচু অব লিবার্টিও তারই পথ ধরে এসেছে।
ফ্রেঞ্চ রেভোলুশানেও কিন্তু ছিলেন জাক লুই ডেভিস, যার তুলিতে উঠে এসেছিল "মারোর মৃত্যু" (ছবি ২) বা "গিলেটিনের পথে মারি আঁতানোয়েত" (ছবি ৩)। বিদ্রোহের আঁচ এসে পড়েছিল ছবিতে শিল্পীর মননে।
পরবর্তীতে উনিশ শতকে আরো নতুন নতুন প্রতিবাদ এসেছে চিত্রজগতে। পিকাসো প্রতিবাদ করেছেন গ্যেরনিকা, বুলস হেডের মধ্যে দিয়ে। নর্মান রকওয়েল এঁকেছেন পলিটিক্যাল আর্ট, হেলমুট হার্জফেল্ড, যিনি জন হার্টফেল্ড বলে বেশি পরিচিত, আঁকলেন এন্টি-ফ্যাশিস্ট আর্ট (ছবি ৪)। প্রতিবাদ ছবির ভাষা হয়ে উঠল বিশ শতকে। নানারকম ফর্ম ও চিত্রভাষ্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হতে লাগল সর্বত্র। শাসক যত আঘাত হানল, চিত্রকর ততই নিজেকে পালটে পালটে প্রতিবাদ করে চলল।
আমরাও কি ছিলাম তার বাইরে? "অদ্ভুত লোক"-এ গগনেন্দ্রনাথের কার্টুন (ছবি ৫) সাক্ষ্য দেয় সমাজের বীভৎস রসের, যা তখনকার লেখার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এলেও, ছবি হয়ে আমাদের চোখে ধরা দেয় নি আগে। ছবির নাম প্রচণ্ড মমতা - যা তৎকালীন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার নামক সোনার পাথরবাটিকে ব্যঙ্গ করে আঁকা।
একটু খেয়াল করলে দেখবো, বিশ-শতকে বা আরো স্পেসিফিক করে বললে বিশ্বযুদ্ধের পরে বেশিরভাগ ছবি হয় বিমূর্ত অথবা এইরকম প্রতিবাদী চিত্রকলায় ভরে ওঠে। প্রতিবাদ আর শিল্প যেন সমর্থক হয়ে ওঠে। সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তন ও হচ্ছিল সাথে সাথে। উপনিবেশের সময় ফুরলো বেশিরভাগ যায়গাতেই। কিন্তু উপনিবেশের পতনের সাথে সাথে একটা জিনিস ক্রমেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তা হল কনজিউমারিজম। এমন নয় যে পণ্যায়ন এর আগে ছিল না, বা উপনিবেশ তাকে চেপে রেখেছিল। বরং সবকিছুই যে পণ্য ও এবং বিশ্বব্যাপী পণ্যায়নের শুরু সেই উপনিবেশের পত্তনের শুরু থেকেই। কিন্তু আর্টকে তার মধ্যে সেভাবে ফেলা হয় নি। যদিও রাজারাজড়াদের দেয়ালে দামী পেইন্টিং শোভা পেত, কিন্তু তারা সাধারণের নাগালের বাইরে গিয়ে পড়ে নি।
কিন্তু বিশ শতকের গোড়ার দিকেই আর্টিস্টরা ক্রমশ এবস্ট্রাক্টের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দাদাইজম, কিউবিজম, সাররিয়ালিজম, এবস্ট্রাকট এক্সপ্রেশানিজম ইত্যাদি পোস্টমডার্ন শৈলী ক্রমশ যায়গা করে নেয় ছবির দুনিয়ায়। একটু খেয়াল করলে দেখব বিশশতকের পর ইন্ডিভিজুয়ালিজম ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা সবেতেই এর প্রভাব দেখা যায়। যত দিন গেছে আর্টের শৈলী বা ফর্ম বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, অন্তর্নিহিত অর্থ হয়েছে বেশি রহস্যময়, ক্রিপ্টিক। আর্টের ইতিহাসের গোড়ার দিকে থেকেই আর্ট ছিল অস্তিত্ব জানান দেবার তাগিদ। পরবর্তীতে সে ধর্মীয় আচারের সাথে যুক্ত হয়ে তার নিজের পথ পাল্টেছিল। রেনেসাঁর পর বিজ্ঞান আর টেকনোলজির ব্যবহার তাকে দিয়েছিল নতুন দিশা। কিন্তু ফোটোগ্রাফি আবিষ্কারের পর বাস্তবসম্মত চিত্রায়নের চাহিদা ক্রমশ কমে আসে। আর্টিস্টরা তাই ক্রমশ তাদের অস্তিত্বের নতুন মানে খুঁজতে শুরু করেন।
এইখানে এসেই আর্টিস্টদের সাথে সাধারণের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। ছবির জগত যত দুর্বোধ্য হতে শুরু করে, সাধারণ ততই তাকে পাশ কাটিয়ে চলে। ২০১৬ তে এক ব্রিটিশ সমীক্ষায় দেখা গেছিল বেশির ভাগ লোকই মডার্ন আর্ট পছন্দ করেন না। এর দুটো কারণ মোটামুটিভাবে ধরা যায়। প্রথমত যে সব ক্ল্যাসিকাল ছবি বা মূর্তি বা রিলিফ আমরা দেখে অভ্যস্ত ছিলাম এর আগে অব্দি, তা মূলতঃ সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়। বীভৎসতা সেভাবে ছবির মূল বিষয় হয়ে ওঠে নি। ট্রাজেডি অবশ্যই বলা হয়েছে, নাটকীয়তা অবশ্যই দেখানো হয়েছে, কিন্তু তা সেভাবে ভয়াল হয়ে ওঠে নি। সেই এক্সপ্রেশানিজম শুরু হয়েছে আঠেরোশ শতকের শেষ থেকে। এক্সপ্রেশানিজমও সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে, কিছুটা তার রোমান্টিসিজম-এর সাথে যোগাযোগের জন্য, কিছুটা রঙের ব্যবহারের নতুনত্বে জন্য যা পুরোনো ক্লাসিক রেনেসাঁকে পুরোপুরি ত্যাগ করে নি। কিন্তু বিশ শতক যখন অ্যাবস্ট্রাক্ট দাদাইজিমের জন্ম দিল, সাধারণ মানুষ স্বভাবতই তাকে তার আজন্মলালিত সৌন্দর্যবোধ ও স্বাভাবিক রোমান্টিসিজমএর সাথে মেলাতে পারল না। এবং এর উপরে শুরু হল, কিছু ছবির অসম্ভব দামে বিক্রি হওয়া।
অস্বাভাবিক দামি জিনিসের উপরে সাধারণ মানুষের একটা স্বভাবসিদ্ধ বৈরিতা কাজ করে। এ অস্বাভাবিক কিছু নয়, আমরা আমাদের দৈনিক জীবনেই বুঝতে পারি। যা আমাদের সাধ্যাতীত তাকে দূরে রেখে জীবনের কঠোর পথে তৈলনিষিক্ত করার নাম স্বাভাবিক জীবন৷ যা সাধ্যাতীত তাকে দূরে রাখবার জন্যেই এই মানসিক দমন প্রক্রিয়া, ডিফেন্স মেকানিজম, আমাদের শিখতেই হয়েছে। মিউজিয়ামে রাখা আকবরের সোনার গ্লাস দেখে আমাদের চিত্ত চাঞ্চল্য হয় না, কারন সেটা সরকারের প্রপার্টি, কিন্তু পাশের বাড়ির হরিপদ যদি অডি গাড়ি কেনে তবে আমরা মনে মনে চটে উঠি। তাই একটা ক্যানভাসে এলোমেলো কটা দাগ, যা হয়তো আমার পাঁচ বছরের বাচ্চাও করে দিত, তাকে কেউ কোটি কোটি টাকা দিয়ে কিনছে, এমনটা ভাবলে একধরণের বিতৃষ্ণা জন্মানো কিছু অস্বাভাবিক নয়।
ছবি যতক্ষণ তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে বজায় রেখেছিল, ততদিন সাধারণ মানুষ তাকে একেবারে দুচ্ছাই করে নি। আজও যদি লেওনার্দো বা রেমব্রান্টের কোন হারিয়ে যাওয়া ছবি ফিরে এসে অকশানে হৈচৈ ফেলে দেয়, তবে সবাই ভুরু কোঁচকাবে না। কিন্তু একটা লোক তার ক্যানভাসে কালো রঙ করে দিল, আর তার দাম ধার্য হল ৬ কোটি ডলার এমনটা হলে আমরা খুব চমকে উঠব (ছবি ৫)।
এইখানে আর্ট ক্রিটিক হয়তো বলবেন, এই ছবি কেবল সাধারণভাবে দেখলে চলবে না, এই ছবির পেছনের ইতিহাসও জানা দরকার। মালিয়েভিচ কিসের যন্ত্রণা থেকেই এই ব্ল্যাক স্কোয়ার আঁকলেন, কেন তার ছবিতে এত নেগেটিভ স্পেস, কিভাবে ১৯৩০ সালে স্ট্যালিনের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মালিয়েভিচের সব ছবি, ম্যানুস্ক্রিপ্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়, দু-মাস জেলে থাকা অবস্থায় তার চিন্তার কি গতিপ্রকৃতি ছিল, কিভাবে তার চিন্তা ঐভাবেই ক্যানভাসে বেরিয়ে আসে, এমনটা বোঝাও দরকার। এইখানেই আর্ট সমঝদার ও সাধারণ মানুষের চিন্তা দুটি আলাদা পথ ধরল। শিল্পী আর তার শিল্প সাধারণের নাগাল থেকে বেরিয়ে একটু আলাদা স্পেসে বসল। তাতে ছবি ভালো হল কিনা সেটা ক্ষেত্রবিশেষে পালটে যাবে। কিন্তু সাধারণের চিন্তায় এমন জিনিস ততটা সাড়া দেয় না, যা সরাসরি তার ইমোশানকে ধাক্কা দেয় না। দ্বিতীয়ত, ছবির অর্থ যাই হোক, যতই গভীর হোক না কেন, তা কি কোটি টাকার অঙ্কে হিসেব করা যায়?
ইকোনমিস্ট হয়তো বলবেন, কোনোকিছুর মূল্য বাজারে ততখানিই যতটা বাজার তাকে দিতে পারে, উচ্চমূল্য বলে কিছু নেই। কিন্তু সত্যিই কি তাই? এই সব পেইন্টিং বা আর্টওয়ার্ক কি সত্যিই এমন অর্থ দাবী করে? যদি তাই করে, তবে এর কতটাই বা চিত্রকর নিজে পাচ্ছেন, বা কতটা দাম তিনি নিজে আশা করেন? এসব প্রশ্ন করলে দেখব, এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিত্রকর বা ভাস্কর এইসব মূল্যের কিছুমাত্র পান না। যে কোন শিল্পকে পণ্যে রূপান্তরিত করে তার থেকে লাভ করার যে পন্থা, তা বেশিরভাগ শিল্পীরই হাতের বাইরে। একটু খেয়াল করলে আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় যে, আর্টের পণ্যায়ন ও তার এই অদ্ভুত মূল্যবৃদ্ধি অন্তত শিল্পের তাগিদে নয়, তার অন্য কারণ আছে।
মূলত এই শিল্পের বাজারকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক ভাগে চিত্রকর/ভাস্কর স্বয়ং ছবি বিক্রি করেন, এবং এর থেকে যা অর্থাগম হয় তা চিত্রকরের লাভ। প্রথম শ্রেণীর ক্রেতা মূলত ছোট আর্ট গ্যালারি, সাধারণ মানুষ। কিছু ক্ষেত্রে অর্থবান ক্রেতার সাথেও চিত্রকরের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এই ভাগে ছবির দাম কমই থাকে। অতি সামান্য থেকে শুরু করে এই দাম বাড়তে বাড়তে লক্ষ ডলারেও যেতে পারে অবশ্য, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর বাজারের তুলনায় তা কিছুই নয়। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর বাজার মূলতঃ কালেকটারদের জন্য। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর বাজারে দর চড়ার জন্যে শিল্পীর কিছু মার্কেট ভ্যালু থাকা চাই। যখন তার ছবির জগতে কিছু নাম বাড়ল, তখন তার প্রাথমিকভাবে বিক্রি করা যে ছবি তার দর বাড়তে থাকে। এবং সেই ছবির প্রথম কালেক্টর ছবি বিক্রি করেন লাভের প্রত্যাশায়। ফলে ছবির দাম ক্রমশ বাড়তে থাকে। আর্ট অকশান হাউসগুলি এই আর্ট মার্কেটের খবর রাখে ও বিক্রি হতে সাহায্য করে। কোটি টাকার বিনিময়ে এই সব আর্ট ওয়ার্ক কোনো কালেক্টরের ঘরে এ্যাসেট হয়ে শোভাবর্ধন করে। সে যখন আবার এই আর্ট বিক্রি করে তখন তার দাম আরো বাড়ে। অর্থাৎ এই দাম বাড়া কমার মধ্যে আর্ট এপ্রিসিয়েশান থাকলেও তা এই দামের মূল সূচক নয়। বরং তার সোশাল ও ডেকোরেটিভ ভ্যালুই তার দাম নিয়ন্ত্রণ করে।
এদ্দুর পড়ে পাঠক হয়তো ভুরু কোঁচকাবেন, যে বেশ করে দাম বাড়ে, কিছু লোক মুনাফা করছে তাতে আমার এত গাত্রদাহ কেন? বিশ্বাস করুন আমার এতটা গাত্রদাহ হত না যদি আর্ট এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারত। যত দিন যাচ্ছে, আমার ধারণা দৃঢ় হচ্ছে যে এই অদ্ভুত অচ্ছেদ্য চক্র থেকে শিল্প আর কখনোই বেরিয়ে আসতে পারবে না। আসুন এইবারে সেই কথাটাই বলি।
যারা এই বোরিং লেখা এদ্দূর পড়েছেন, আমি ধরে নিচ্ছি তাঁরা আধুনিক ছবিটবি দেখেন ও ব্যাঙ্কসির নাম শুনেছেন। যদিও শুনে না থাকলেও বিশেষ কিছু যায় আসে না, কারণ এই ব্যাঙ্কসি কে তা কেউই সঠিকভাবে জানে না, একেবারে তার ইনার সার্কেলের লোকেরা ছাড়া। কিন্তু নাম শুনুন বা না শুনুন, তার আঁকা ছবি আশা করি ঠিকই দেখেছেন। ১৯৯৭ সালে ব্যাঙ্কসির আঁকা প্রথম ম্যুরালটার নাম ছিল The mild mild west (ছবি ৬ক)। ছবিটা ব্রিস্টলের এক সলিসিটরের দেয়ালের সামনের এডভার্টাইজসমেন্ট কে ঢেকে দিয়ে বানানো। ব্যাঙ্কসির ছবি মূলত স্টেনসিলে আঁকা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা ক্যাচি স্লোগান থাকে তার সাথে। ছবিগুলো দেখলে (ছবি ৬খ: The girl with Balloon, ছবি ৬গ: Flower Bomber, ছবি ৬ঘ: Can't Beat That Feeling or, Napalm) বোঝা যায় ছবির সাবজেক্ট ব্যঙ্গাত্মক ও পোলিটিক্যাল। বেশিরভাগ ছবিতেই যুদ্ধবিরোধী, এন্টিক্যাপিটালিস্ট, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী বার্তা থাকে। ছবিগুলি দ্রুত প্রশংসিত হতে থাকে এবং আর্টক্রিটিকদের আগ্রহ বাড়ায়।
ছবিগুলো খেয়াল করলে দেখবেন তার তীব্র অভিঘাত। নাপাম ছবিটাই ধরুন। ছবির সেন্ট্রাল ক্যারেক্টর হল একটি নয় বছরের শিশু কিম ফুক্, যে দক্ষিন ভিয়েতনামের এক গ্রামে থাকত, যে গ্রাম তখন উত্তর ভিয়েতনামের দখলে। ১৯৭২ সালের ৮ই জুন, সেই গ্রামে দক্ষিন ভিয়েতনাম এয়ার রেইড করে নাপাম বোমা ফেলে। কিম ফুক্ তখন তার গ্রামবাসীদের সাথে পালাচ্ছিল। রিপাবলিক অব ভিয়েতনামের বোমারু পাইলট তাদের বিপক্ষের সৈন্য মনে করে তাদের উপরে বোমা ফেলে। কিমের চার সাথী সেখানেই মারা পড়ে, ও কিমের সমস্ত জামাকাপড় পুড়ে গিয়ে থার্ড ডিগ্রি বার্ন হয় ঐ আগুনে-বোমায়। সকলের সাথে কিম যখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছিল আর চিৎকার করে খুব গরম, খুব গরম ("Nóng quá, nóng quá")বলে কাঁদছিল, Nick Ut বলে এক প্রেস ফোটোগ্রাফার কিমের ঐ ছবিটা তোলে; নাম দেয় "the girl in the picture"। নিচের ভিডিওটা দেখে নিতে পারেন এই লিঙ্কে
পরবর্তীতে এই ছবিকে পুলিৎজার পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধের বীভৎসতার সাথে এই ছবিটা প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠে। ব্যাঙ্কসি সেই ছবিটাকেই তার নাপাম ছবির সেন্ট্রাল ক্যারেক্টর করে তুলেছে৷ কিন্তু তার দুই পাশে আছে মিকি মাউস আর রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড (ম্যাকডোনাল্ডের ম্যাসকট)। তারা যেন হাত ধরে কিমকে খোলা মার্কেটে নিয়ে আসছে। যুদ্ধপীড়িত শিশুর অসহায়তা, নগ্নতা, সভ্যতার ব্যর্থতা সবই যেন পণ্য। তাই তাকে খোলা বাজারেও বেচা যায়। ক্যাপিটালিজম ও যুদ্ধ এর বিরুদ্ধে ছবিটা যেন একটা খোলা জেহাদ। অনেকে মনে করেন এই ছবিটা ব্যাঙ্কসির সবচেয়ে মর্মভেদী ছবিগুলির মধ্যে একটি। ব্যাঙ্কসি এই ছবির প্রায় শতাধিক প্রিন্ট বানায়। এই ছবিগুলির এক একটি বিক্রি হয় প্রায় ২৫-৩০ হাজার পাউন্ডে। এইখানেই আবার বাজার জিতে যায়। যে বাজারের বিরোধ করে এমন প্রচার, এমন তীব্র ব্যঙ্গ তা শিল্পী নিজেই বাজারজাত করলেন। বিরোধীতাকেও বাজার তার পণ্যে রূপান্তরিত করে নিল। বাজার, বাজারের সমালোচনা থেকেও অর্থপার্জন করে যদি তবে সেই সমালোচনার অর্থ খানিক ঘোলাটে হয়ে পড়ে।
আর একটা এনেকডোটাল ঘটনা বলে শেষ করি। ২০১৮ সালে ব্যাঙ্কসি তার পুরোনো একটা ছবি ফ্রেম করে নিলামে তোলে। ছবিটা আমাদের পূর্বপরিচিত Girl with balloon এর পেপার প্রিন্ট, যা একটা দামী সোনালী ফ্রেমে বেঁধে পাঠানো হয়েছিল সাদাবির নিলাম ঘরে। যথারীতি ব্যাঙ্কসির নাম মাহাত্ম্য এখানেও কাজ করল - এবং ছবিটা দাম উঠল ১৪ লক্ষ ডলার। নিলামের হাতুড়ি পড়া মাত্রই ক্রেতা আর বিক্রেতাদের অবাক করে দিয়ে চড় চড় শব্দ করে ছবিটা ছিঁড়ে নিচের দিকে পড়তে শুরু করে। ব্যাঙ্কসি ঐ ফ্রেমের মধ্যে একটা শ্রেডার ফিট করে রেখেছিল, যা সঠিক সময়ে ছবিটা ছিঁড়ে ফেলার জন্যে তৈরী ছিল। মুহূর্তের মধ্যে ইতিহাস তৈরী হয়, বর্তমান বাজারে একটা বিক্রি হওয়া জিনিসকে নষ্ট করার মত ক্ষমতা কজনের আছে, হোক না সে যতই নামী শিল্পী। দূর্ভাগ্যবশত ছবিটা পুরোপুরি ছেঁড়া যায় নি। যান্ত্রিক গোলযোগেই হোক বা পূর্বপরিকল্পিত হোক, প্রায় অর্ধেক ছবি ছেঁড়ার পরে শ্রেডিং মেশিন বন্ধ হয়ে যায় (ভিডিও দেখুন লিঙ্কে)
অনেকে ভেবেছিল হয়তো এটা মিথ্যে গিমিক তৈরী করার একটা প্রচেষ্টা, সত্যিকারে ছবিটা নষ্ট হয়নি। কিন্তু তা নয়। ব্যাঙ্কসি তার সোশাল মিডিয়া হ্যাণ্ডেলে স্বীকার করে নেয়, যে এটা তারই করা, সে তার ছবির মধ্যে নিজেই এই শ্রেডার ফিট করে রেখেছিল, যদি ছবি নিলামে ওঠে সেক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। সমগ্র আর্ট ক্রিটিক, এমনকি নিলাম কর্তাদেরও নিশ্চই দুরবস্থা হয়েছিল তাদের অত দামের ছবির ঐ হাল দেখে।
এদ্দুর পড়ে যারা ভাবছেন, তবে তো আর্টের জয় হল, বিরোধীতার নতুন মাত্রা এল, তারা ভুল ভাবছেন। এত বড় এক সিম্বলিক বিপ্লবও কোন কাজে এল না, কারন সাদাবি তার ক্রেতাকে আস্বস্ত করাতে সক্ষম হল যে এই ছেঁড়া অবস্থাতেও তার দাম কিছু কম হল না। বরং ঐ ইউনিকনেস তাকে ইতিহাসে একটা বিশেষ যায়গা করে দিল। ঐ ছবিকেই অন্য নাম দিয়ে তাকে ঐ দামেই বিক্রি করে দেওয়া হল আগের ক্রেতার কাছেই (ছবি ৭)।
অর্থাৎ শিল্পী ও শিল্প যতই প্রতিবাদ করুক না কেন, যতই তার বাজারধর্মীতার বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠাক না কেন, সে বাজারের কাছে নত হতে বাধ্য। বাজার তার বিরোধিতা থেকেও মুনাফা কামাতে পারে। সফলতা আর মুনাফা হয়তো প্রায় সমর্থক হয়ে উঠেছে আজকে। আজ আর কবিকে বলতে হয় না - "ভারতীরে ছাড়ি ধর এই বেলা লক্ষ্মীর উপাসনা!" কারণ ভারতীর উপাসনা সফল হলেই লক্ষ্মীর আগমন হয়। প্রতিবাদ যাই হোক না কেন বাজার নিঃশর্তে জেতে। সমগ্র শিল্পের ইতিহাসে এইটেই সম্ভবত শিল্পের সবথেকে বড় হার।