গুরু কি উপায় বলো না,
তুমি সব খোল, মন খোল না...
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, মন অতি বিষম বস্তু। ছোট বাচ্চা যখন মা বাবাকে শুধায়, মন কোথায় থাকে? বাবা মা কি বলে? আমার ঈশ্বরবিশ্বাসী মা আমার বুকের দিকে আঙুল বাগিয়ে, যেখানে হার্টটা ধুকপুক করছে, সেটা দেখিয়ে বলত, এইখানে! এইখানেই নাকি মন থাকে। আবার যদি কখনো জিজ্ঞেস করতাম, ভগবান কোথায় থাকে; একই উত্তর পেতাম। আমার ছোট্ট কল্পনাশক্তিতে ভাবতাম ঐখানেই মন থাকে, আর মনের মধ্যে থাকে ঈশ্বর।
আমার মধ্যবিত্ত মা-বাবা প্রত্যহ সকালে ঠাকুরপুজো করত। ছাতে ওঠার সিঁড়ির মাঝপথে একটা কুলুঙ্গি মত ছিল, সেখানেই ছিল আমাদের ঠাকুরের অবস্থান। ঠাকুর বলতে ছিল, একটা লক্ষীর পট আর একটা কালো রঙের শিবলিঙ্গ। আমার বাবা রোজ সকালে একবালতি জল হুশ হুশ করে মাথায় ঢেলে গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে, দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে, ত্রিভূবনতারিনী তরলতরঙ্গে... গুণগুণ করতে করতে দুটো ফুল বেলপাতা পটের গায়ে দিয়ে, একটা ছোট তেলের শিশি থেকে সর্ষের তেলে ঢেলে শিবের গায়ে মাখিয়ে দিত। তারপরে শীতকালে যেমন আমাকে আচ্ছা করে তেল মাখিয়ে দলাইমলাই করে আটা মাখা করত, তেমনি করে চটকে মটকে একটা পাথরের বাটিতে বসিয়ে গুপুশ করে একঘটি জল ঢেলে দিত মাথায়।
তেল জল খেয়ে খেয়ে শিবঠাকুরের গায়ের কালো রঙ গুটি বসন্তের মত চাকা চাকা হয়ে ফুলে উঠেছিল। আমি যখন আরেকটু বড় হই, তখন একবার থাকতে না পেরে আমি মেজোকাকার পুরোনো ব্যাঙ কাটা ছুরি দিয়ে শিবঠাকুরকে আচ্ছা করে চেঁছে দিয়েছিলাম। দেখেছিলাম উপরে তেল কালি মাখা শ্যাওলা ছ্যাতলা পড়া শিবঠাকুরের চামড়ার তলায় একটা মেটে মেটে ছাই ছাই রঙের পাথুরে বডি আছে। আচ্ছা করে ছালচামড়া তুলে আমি শিবঠাকুরকে চাইনিস ওয়াটারপ্রুফ রঙ দিয়ে রঙ করে দি। এর জন্যে আমার অলরেডি অনন্ত নরকে বিনা এনাস্থিশিয়ায় স্কিন গ্রাফটিং বরাদ্দ হয়ে আছে নিগঘাত। কিন্তু আমি শিবঠাকুরের সুস্বাস্থ্যের কথা ভেবেই একাজ করেছিলাম, আশা করি চিত্রগুপ্তের খাতায় একথা ফুটনোটে লেখা আছে।
তা যা বলছিলাম মনের কথা - একটু বড় হয় জানতে পারলাম যে মন ধুকপুক করে বলে জানতাম, সেটা আসলে হার্ট। হার্ট আবার দুই রকম, একরকম হার্ট রক্ত পাম্প করে বডিতে, অন্যটা রুহিতন। সেটা আবার প্রেমপত্রের নিশানা। যেহেতু আমার ভগবৎ কল্পনা শিবলিঙ্গের বাইরে যেত না, তাই হার্টের আকার প্রকার দেখে আমার মনে হত শিবলিঙ্গ গৌরীপট্ট সমেত ওর মধ্যে আস্তানা গেঁড়েছে। নইলে ঈশ্বর তো হোমলেস হয়ে পড়ত, তাই ওরই মধ্যে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকে,ঐ জন্যে হার্টের শেপটা ওরকম বেঢপ। এদিকে ক্লাসে বায়োলজির টিচারেরা শিবঠাকুরকে হার্ট থেকে তাড়াবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তাই আমি লেফেট এট্রিয়াম, রাইট এট্রিয়াম, লেফট ভেন্ট্রিকল, রাইট ভেন্ট্রিকল, পালমোনারি ভালভ, এওর্টা ইত্যাদি মুখস্ত করে চললাম। শিবঠাকুর ও মন দুইই হার্টের থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ল।
ক্রমে ক্রমে বয়স বাড়তে লাগল, ক্লাস সিক্সে উঠে ডে স্কুলে পড়া ইস্তক পিউবার্টি এক্কেবারে চড়াৎ করে ছিটকে বেরুলো গালের উপরে বিদঘুটে ব্রণ, আর হার্টে চমক জাগিয়ে। যে সব ফ্রকপরা খুকীরা জঞ্জাল বলে পষ্ট বুঝতে পারতুম কদিন আগেও, তারা সব শকুন্তলা, প্রিয়ম্বদা বলে প্রতীত হতে লাগল। ইশকুলে চাচা ও জনা নামক দুই অবতার আমাদের নারীবিষয়ক জ্ঞানের ভান্ডার ছিলেন। তাদের কাছ থেকে বিশেষ জ্ঞানলাভ করে আমরা টিফিনটাইমে পাশের গার্লস স্কুলে, কলেজে উঁকি দিতুম। একদিক থেকে আমাদের স্কুলটা অত্যন্ত vantage point-এই ছিল। স্কুলে পুব দিকে পৌনে এক কিলোমিটারের মধ্যে ছিল কালীকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয়, পশ্চিমে একশ মিটারের মধ্যে ছিল সরকারী বালিকা বিদ্যালয়, যার নেটিব নাম গার্লস ইস্কুল। আর আমাদের স্কুলের খেলার মাঠের লাগোয়া ছিল বারাসাত সরকারী কলেজ। এই কলেজের সামনেই ছিল বারাসাত থানা। ফলে বারাসাতের ইশকুল কলেজযাত্রী মেয়েদের সিংহভাগ আমাদের স্কুলের সামনে দিয়ে যাতায়াত করত, এবং আমরাও ক্যাবলাকান্তর মত সকাল ও বিকেলের দিকে আলুকাবলি, ঝালমুড়ির স্টলে দাঁড়িয়ে বিঞ্জ ওয়াচিং করতুম।
আমাদের মধ্যে যারা বেশ বীর গোছের বা কৃষ্টোফোর কলম্বস কিম্বা ভাস্কো ডি গামা গোছের সাহসী নাবিক টাইপের তারা কখন কখন মেয়েদের সাথে আলাপ করতে যেত ফুচকা বা আলুকাবলির স্টলে। আমরা দূর থেকে দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করতাম যে কি হচ্ছে, সামনে দাঁড়িয়ে ম্যানস্লটার দেখার অভ্যাস তখনো হয় নি। তারপরে তারা ফিরে এসে যা সব গল্প বলত, সে শুনে আমাদের সর্বাঙ্গের লোম খাড়া হয়ে যেত। চাচাই আমাদের শিখিয়েছিল, ট্রাই এন্ড ট্রাই এগেইন, আনটিল ইউ সাকসিড। এইসময়য়েই আমি আরামসে বুঝে গেলুম মনে পেরজাপতি কেমনি করে ওড়ে। পষ্ট বুঝতে পারলুম বায়োলজি স্যার বিস্তর ফাঁকি দিয়েছেন, হার্টের যায়গায় যদি মনই না থাকে তবে বুকে ব্যাথা লাগে কেন!
এরকম একটা দোদুল্যমান অবস্থায় মার্কেটে বঙ্কিম হাসি হেসে প্রবেশ করলেন দুই ব্রাহ্মণসন্তান, বঙ্কিমচন্দ্র ও শরদিন্দু। আমার অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ হৃদয় ভেসে গেল। আমি ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখতে লাগলুম। ট্রেনে, বাসে, রাস্তায় পাশে যাকেই দেখি মনে হয় আয়েশা কিম্বা দূর্গেশনন্দিনী। এই বুঝি বলে উঠল, এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর। এরকম করে বললে আমি জীবানন্দ যেরকম নবীনানন্দের সাথে মিষ্টালাপ করেছিলেন সেরকম কথা বলব, নাকি ' -এসেছিল বকনা গরু পরগোয়ালে জাবনা খেতে' বলে হিক্কা তুলব দুটোর কোনটাই ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। এমন দোলাচলে জ্ঞান দিয়ে সিধে করে তুলবে এরকম ফাদার ফিগারও কেউ ছিল না। ফলে আমরা কাঁচামিঠে আমের মত অর্ধপক্কই হয়ে রইলাম বহুকাল।
ডে-স্কুলে উঠে ইস্তক প্রাণটা হু হু করতে লাগল এমন যে সে আর বলার মত না। আগেই বলেছি ইস্কুল আমাদের এক্কবারে ভোগের উপরে কদমা মধ্যমণির মত বিরাজ করত। কিন্তু সে কদমায় দন্তস্ফুট না করতে পেরে সব বালিকারাই আমাদের মত নিরীহ বালকদের নিয়ে হাসাহাসি করত। হয়তো কদমার চুড়োতে তাদের টাগরায় সুড়সুড়ি লাগত! এ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান আমি আজও অনুধাবন করতে পারি নি।
তা এমনই এক শীতের সকালে আমি কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। আমাদের ওদিকে তখন অত অটো টোটো চলত না, ট্রেকার বলে এক ধরনের আধা জিপগাড়ি ধরনের গাড়ি শাটল ট্যাক্সির মত চলত। আমি কচি ছেলে, দুইপাশের গাবদা মুষকো দুই লোকের চাপে দলামোচা হয়ে আছি এমন সময় চোখে পড়ল রিয়ার ভিউ মিররে একটা মিষ্টি মত মেয়ের মুখ। বেশ শ্যামলা চেহারা, গরুর মত আয়ত দুখানি চোখ। সাদা শার্ট আর নীল জিনসের প্যান্ট পরেছে, মাথায় হাতে বোনা একটা বৌ টুপি। আমি লাজুক মুখে টুপুস করে মিটমিটিয়ে তাকালুম তার দিকে, দেখি সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এট্্টু হাসলাম, সেও হাসল। আমি তো এক্কেবারে রামহড়কান হড়কালাম, বুকের মধ্যে হার্টটা যেন ধোপার পাটে কেউ আছড়াচ্ছে, কিন্তু একটা কথা পষ্ট বুঝে গেলুম যে মনটা হার্টের মধ্যেই পোরা আছে, যে বিষয়ে সব রোমান্টিক সাহিত্যিকরাই পষ্টাপষ্টি বলে গেছেন।
তা বেশ খানিক হাস-প্রত্যাহাস বিনিময়ের পরে বেশ গরম লাগছিল বলে মাফলারটা খুলতেই কেলো হয়ে গেল। হঠাৎ করে মিষ্টি মেয়েটা কেমন গাম্বাট মত হয়ে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমি আমাকেই এতক্ষণ ধরে...
বিধ্বস্ত মনে ফিরে এসে আমি বুঝলাম জগতে সকলি অসার, মন ফন বলে কিছু হয় না, সবই হরমোনাল ইমব্যালেন্স এবং অপ্টিক্যাল ইল্যুশান! সেই থেকে আমি খালি জিভে প্রেম করি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।