এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • রূপান্তর

    Nirmalya Bachhar লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০২ জুন ২০২৩ | ৫৮৮ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • এক ছিল তালপাতা। যে তালগাছ মাটির থেকে সিধে উঠে গেছে আকাশপানে, তেপান্তরের মাঠের পাড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকত, মস্ত উঁচু আকাশ ছোঁয়া, সেই তালগাছের পাতা সে। ভাদ্র আশ্বিন মাসে তাল পাকলে, পাখি আসত, ঠুকরে ঠুকরে তাল খেত। আশেপাশে গন্ধে ম ম করত। যখন ধুপ ধুপ করে তাল পড়ত, আসে পাশের ছেলে ছোকরা, বৌ ঝিয়েরা কুড়িয়ে নিয়ে যেত সেসব।

    তালপাতা দিব্যি ছিল। হাওয়ায় দোল খেত সে। যখন কচি ছিল, বড় বড় পাতার চাপে গাছের গায়ে জড়িমড়ি করে লেগে থাকত সে দিব্যি। শুধু সবুজ পাতাগুলো মেলে দিয়ে রোদ্দুর শুষে নিত সে। ক্রমশ যত বড় হয়ে উঠছিল, আশে পাশের বড় পাতাগুলো খসে খসে পড়ছিল, ততই তার ভয় হচ্ছিল। গাছের থেকে পড়ে গেলে কি হবে তার? তার পরিচয় তো ঐ তাল গাছ। সেই যদি না থাকে তবে? এইসব চিন্তা করত সে। দখিন হাওয়া তার গায়ে হাত বুলিয়ে চলে যেত মাঠের কিনার দিয়ে। আস্তে আস্তে তার শরীর বেড়ে চলল, মস্ত হয়ে উঠল সে, আর ক্রমশই কিনারে চলে এল। পুরোনো পাতাগুলো সব পড়ে গেছে। সেই এখন কচি পাতাগুলোকে আগলে রাখে। শরীর দিয়ে জাপটে গাছের গায় আগলে থাকত সে।

    তালপাতা ক্রমশ বুঝতে পারছিল, যে বয়স বাড়ছে তার। গাছের সাথে বন্ধন আলগা হয়ে এসেছে। একদিন হাওয়ার দাপটে ছিঁড়ে নিচেই পড়ে গেল সে। আরো অনেক পাতার সাথে গাছের তলায় রাত কাটালো সেদিন। উপর থেকে নিচটা যেমন সবুজ লাগে কাছ থেকে দেখে অত ভালো লাগল না তার। মাটি মাটি পচা পচা গন্ধ, আসপাশে, সে ভয়ই পেল খানিক। কয়েকদিন পরে কটা অল্প বয়সী ছেলে এসে তাকে আর আরো পাতাগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে গেল তাদের ঘরে। এতদিন যে তালগাছের অংশ ছিল, সে এখন তালপাতা হয়ে গেল।

    ছোট মাটির ঘর, তার উঠোনে ছেলেটার দুই বোন বসে বসে মাটির পুতুল নিয়ে খেলা করছিল। তাদের মা গাছ কোমর করে শাড়ি জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ছেলেটা পাতাগুলোকে ঘরের ছাউনির উপরে বিছিয়ে দিয়ে নেমে এল। পরের বেশ কটাদিন তালপাতার কাটল সেখানেই। ছেলেটার বাড়ির কাজ কম্মো খুব সরল না, সকালে উঠে সে এটা ওটা ফাইফরমাশ খাটতে যায়। কারো খেতে নিড়েন দিতে হবে, কারো পুকুরে জাল ফেলতে হবে, কোন খেজুরগাছ কাটতে হবে, ছেলেটা মহা ব্যস্ত সে সব নিয়ে। ওর বোনেদের অবশ্য এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা সকাল থেকে পুতুলের সাজসজ্জা, বিয়ে, ঘরকন্নায় ব্যস্ত। ছেলেটির মাও সকাল থেকে রান্নার উনোনে আঁচ দেয়, জল আনে, রান্না করে, বড়ি বড়ি গুল দেয়, সংসার সামলায়। ছেলেটার বাবাকে দেখল না পাতা।

    এ কদিনে তালপাতার মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে অনেক। রোদে পুড়ে তার সবুজ ভাবটা চলে গেছে একেবারেই। একটা গমরঙা ভাব এসেছে তার উপরে। জলের ভাব একেবারেই কমে গেছে তার থেকে। ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল পাতা। ছেলেটা মাঝে মাঝে উঁকি মেরে যেত ছাউনিতে। তালপাতাদের দেখে যেত সে।

    একদিন তার মুখে হাসি ফুটল পাতাদের অবস্থা দেখে। টেনে নামালো তাদের উঠোনে। একটা ধারালো হেঁসো নিয়ে এসে টুকরো করে কাটল সে, তালপাতাকে। তারপরে সেই টুকরোগুলো নিয়ে তাদের ঘাড় মুচড়ে লোহার তার দিয়ে বেঁধে রেখে দিল উনোনের পাশে। তালপাতার ভেতরের অবশিষ্ট জলটুকুও শুকিয়ে আসছিল দ্রুত উনোনের আঁচে। লোহার বাঁধুনি যখন খুলল ততদিনে ঘাড়ের ভাঁজে সে একপাশে কাত হয়ে গেছে। ছেলেটা লোহার সুঁচ আগুনে তাতিয়ে পাখায় ফুটো করল অনেক। তারপরে কতগুলো বাখারি নিয়ে সরু সরু করে কেটে তার উপরে বাঁধুনি দিল সে। পাতার কিনারে বাঁধল লাল শালু। লাল সুতো দিয়ে সেলাই দিলো তার মধ্যে। পাতার উপরে লাল নীল রঙের ছোপ দিল সে। বার্নিশ গর্জন তেলে গুলে সারা গায়ে লাগিয়ে দিল তার। উনোনের আলোতে চকচক করতে লাগল তার গা। তালপাতা থেকে পাখা হয়ে গেল সে।

    পরের দিন তাকে নিয়ে চলল হাটে বাকি পাখাগুলোর সাথে। পাখার মনে শান্তি নেই। এত লোক এত হইহল্লা সে আগে দেখে নি। সবাই ছুটে চলেছে ঝম ঝম করে। পাখা চমকে চমকে উঠছিল সেই শব্দ শুনে শুনে। ছেলেটি তাকে নিয়ে একটা রঙচঙে কাপড়ের উপরে বিছিয়ে দিল। নানান লোকে এসে তাকে নেড়ে চেড়ে দেখছিল। কেউ দর করছিল কেউ বা নেড়েচেড়ে ফেরত দিচ্ছিল। হঠাৎ একটা মোটাসোটা গিন্নীবান্নী মত মহিলা, তাকে আর আরো কয়েকটা পাখাকে ছেলেটার কাছ থেকে দাম দিয়ে কিনে নিল। আবার ঠাঁইনাড়া হল পাখা।

    গৃহিনীর ঘরে মেলা লোকে লোকারণ্য। সব বয়সের লোকেরা সেখানে আছে - ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়ঃবৃদ্ধ অবধি। পাখা তাদের হাতে হাতে ঘুরতে লাগল।  দিন রাত তাকে নিয়ে সবাই নাড়ায় আর হাওয়া খায়। এমনকি মানুষের গায় ছোঁয়া লাগলে মাটিতে অবদি ঠোকে। হাতপাখার সুখ নেই। পাখা নড়ে নড়ে নড়ে। গরমের দিনে লোকে হাওয়া খেতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখা এসে ঠক করে তাদের কপালে পড়ে। একদিন তো বুড়ো দাদু তাকে ঘুমচোখে মাড়িয়েই দিল। হাতলটা নড়বড়ে হয়ে গেল তার।

     মাটিতে ঠোকা খেয়ে খেয়ে বাঁখারিগুলোও ভাঙতে লাগল তার। লাল শালু দিয়ে যে বুনুনি বুনেছিলে পাখারি, সেই বুনুনিতে ঢিল পড়ল। শালুর বাঁধানো সুতোটা আটকে রইল পাখার গায়ে, আর শালু একপাশে বুনুনি ফসকে চিৎপটাং। দিন যায় রাত যায়, বাড়ির বাচ্চারা শালুটাকে টান মারে। আর সুতোটা আরেক প্যাঁচ খুলে যায়। পাখাটার বুক চিরে চিরে। তারপরে একদিন এমন হল শালুটা খুলে ঝুলুরমুলুর, গিন্নি হুকুম করলেন আবার পাখা আনো, এই পাখায় আর চলে না। পাখাটা এক কোনে পড়ে রইল। লাল শালু আর সুতোর অন্ত্রে অন্ত্রে পাক খেয়ে, বাড়ির এক কোণে। কেউ যদি তাকে খুঁজে পায় তবে তার শেষকৃত্য করবে সেই আশায়।

    তারপরে সত্যি একদিন তার আশ মিটল। হোলির আগে বুড়ির ঘর পোড়ানো হচ্ছিল। সবাই এটা সেটা ছুড়ে দিচ্ছিল সে আগুনে। বাড়ির এক ছোট ছেলে পাখাটাকে এনে ফেলে দিল তার মধ্যে। আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল পাখাটা। কিন্তু আগুনও তাকে পুরো পোড়াতে পারল না। আধপোড়া হয়ে তার স্থান হল ছাই গাদায়। এইবারে সে যথাস্থান পেল। যে মাটির কাছে যাবার কথা ছিল তেপান্তরের পারে, সেই মাটির কাছেই ফিরে এল সে, কলতলার ধারে শহরের এক কোণে। কিন্তু মাটি তো মা, সে সব যায়গায় তার আঁচল বিছিয়ে রেখেছে। তাই কলতলার ছাইগাদাও তাকে সেই আদরে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নিল। তেপান্তরের কথা ততদিনে ভুলেই গেছে পাখাটা।

    নিরমাল্লো
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০২ জুন ২০২৩ | ৫৮৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2601:14a:502:e060:cb90:76c5:f774:***:*** | ০২ জুন ২০২৩ ০৪:৩১520171
  • ভালো লাগলো। হ্যান্স অ্যান্ডারসনের 'শনগাছের কথা' মনে পড়লো।
  • Nirmalya Bachhar | ০২ জুন ২০২৩ ১০:২৮520175
  • থ্যাঙ্কিউ kk, এন্ডারসনের গল্পটা আগে পড়িনি, আপনি বলার পরে পড়ে নিলাম। আসলে হয়তো আমাদের সব গল্পই পুরোনো, কারন সব ফিলিংগুলোই হয়তো একইরকম। এই গল্পটা মুখে মুখে বানিয়েছিলাম ভাগ্নেকে বলার জন্যে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন