মধ্যপ্রদেশের ঘটনাটা দেখার পর থেকে মাথার মধ্যে কিছু জিনিস ঠিক করে কাজ করছে না। মানে সব কিছুই করছি, দেখছি, কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রচণ্ড অস্বস্তি কাজ করছে, যার র্যাশনালিটি ঠিক করে খুঁজে পাচ্ছি না। ভয়, না রাগ, না ঘৃণা—কিছুই ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমার র্যাশনাল বন্ধুরা হয়তো বলবে, এ আবার নতুন কী? এ কি জানা ছিল না? এমন তো নয়, যে এমন ঘটনা হঠাৎ ঘটেছে—এরকম হয়েই থাকে। আমি ভারতের যে প্রান্তে বাস করি, সেখানে এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমার নিজের ছাত্রটিকে দেখেই বুঝতে পারি। সে সম্ভবত দলিত সমাজের থেকে উঠে এসেছে। তাকে তার নাম লুকাতে হয়, নইলে সোশাল মিডিয়ায় সবাই বুঝতে পারবে — এই হল ডিস্ক্রিমিনেশনের, এলিয়েনেশনের ভয়। এ ভয় যে কী তা আমি আর আমার আর পাঁচটা সাধারণ মানুষ বুঝবো না। যাদের হয় তারা বোঝে।
এমন নয়, যে এই ঘটনা আজকেই শুরু। এর বীজ তো বহু আগের। সেই ক্লাস সেভেন না এইটে ভূবন সোম পড়েছি। সিনেমা তো তখন অত জানতাম না। বনফুলের লেখার ফ্যান ছিলাম। কিন্তু সেখানে ভূবন সোমের জবানিতে নিচু জাতের উপরে যে তাচ্ছিল্য বা ঘেন্নার কথা পড়েছি, সেটা পড়ে নিজেই অবাক হয়ে গেছিলাম। ভাবলাম—এ কি বনফুলের নিজের কথা, নাকি কাহিনীর জন্য এভাবে লিখেছেন? বুঝতে পারিনি, কিন্তু সেই নিয়ে উচ্চ্যবাচ্য করিনি। আজ এতদিন পরে মনে হয়—হয়তো সেখানেও ছিল কিছু।
একইরকম ভাবে, মুজতবা আলী পড়তে ভালোবাসতাম খুব। ওঁর নিজের জবানীতে শুনেছি — পাঠশালায় গুরুমশাইকে দুইহাত দূরে দাঁড়িয়ে দূর থেকে শ্লেট দেখাতেন (পাদটীকা দ্রষ্টব্য)। অথচ অন্য লোকের স্মৃতিচারণে শুনেছি—উনি যখন কারো কোয়ালিফিকেশান হিসেব করছেন, তখন জাতের হিসেব নিচ্ছেন, যে সে এসসি-এসটি কিনা। তারা নাকি চাকরি বাগিয়ে নিচ্ছে, পুরোপুরি আনকোয়ালিফায়েড। শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। তাহলে নিচু জাতের হিসেব সবাই করে!
নিজের ছেলেবেলার কথা বলি। গভর্মেন্ট স্কুলে পড়তাম। স্কুলে বাঁদরামি করতাম না—এমন বললে মিছে কথা বলা হবে। কিন্তু সেই বাঁদরামির মাত্রা বেড়ে যেত, মৌলভি সায়েব আসলে। তাঁর ম্যানারিজম নকল করে, ডেস্কে ব্যাঙ রেখে, নানাবিধ কার্যকলাপ করা হত—যা অন্য মাষ্টারমশাইদের উপরে করতে দেখিনি। ভুল বললাম, করা হত—তাঁরা এফিমিনেট হলে বৌদি ডাকা হত। কথা বলার ধরন আলাদা হলে নানান নামে ডাকা হত। বড়রা শুনলে বলতেন, ছেলেমানুষ। আমাদের সংবেদনশীলতা পরিশীলত হল না।
ডে স্কুলে একবার আমাদের স্কুলে একজন অঙ্কের টিচার এলেন। তাঁর নাম আজ আর মনে নেই, সারনেম মান্ডি। অর্থাৎ শিডিউলড ট্রাইব। তিনি যে কিছুই জানেন না—সেটা প্রমাণ করার জন্যে আমাদের চেষ্টার খামতি ছিল না। ডেস্কে একবার সাপ রাখা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত বা সৌভাগ্যবশত—সাপটা ছিল বাচ্চা, এবং ধ্বস্তাধস্তিতে সে মারাই গেছিল। ফলে মাণ্ডিবাবু এসে চক নিতে গিয়ে—এ যে সাপ রে—বলে যখন নিজেই তুলে বাইরে ফেলে দিলেন, তখন স্বস্তিই পেয়েছিলাম। সেই বয়সে মব মেন্টালিটিতে তাঁর প্রতি কী মনোভাব ছিল আমার—সেটা ভাবলে এখনো লজ্জাই পাই।
এমন নয় যে আমাদের স্কুলে বাকি অঙ্কের মাস্টাররা সকলে রামানুজনের মত ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন, কিন্তু ঐ যে জাত—ঐতেই আমরা বুঝে গেছিলাম, যে উনি কিচ্ছু জানেন না। জাতের দোহাই দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। এ নিয়ে কথাও হত আমাদের মধ্যে। একটু উঁচু ক্লাসে উঠলে অনেক বলত এসব কথা।
আজ আমিও একটা কলেজে পড়াই। মাস্টার্স বা পিএইচডি ছাত্রছাত্রীদের হায়ার করি। বছর বছর সিট খালি যায়। জেনারেল সিটে নেবার মত যোগ্যতা-ওলা লোক পাই না। অথচ সকলের মড়াকান্না শুনি—ওগো এসসি-এসটি সিট নিয়ে গেল। গভর্মেন্টের নতুন নিয়মে যে সব কোটার স্টুডেন্ট জেনারেল কাট-অফের বেশি পায়, তাদের জেনারেল ক্যাটাগরিতেই পড়তে হয়। সেই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে আরো দুঃখ। এরা জেনারেল সিটও কাড়ছে — কোটার সিট তো বাঁধাই। অথচ এমনটাই হবার কথা ছিল কিন্তু। ভালো ছেলেমেয়েরা কঠিন লড়াইটা করবে, যারা পিছিয়ে আছে—তাদের একটু এগিয়ে যাবার সুযোগ দিতে হবে।
সবাইকে নয়, বেছে নেওয়া হয় তারপরেও। যারা সুযোগ পেয়ে কলেজে চান্স পেল, তারা কিন্তু জীবনযুদ্ধে জিতে গেল না — তাদের তারপরেও ভালো রেজাল্ট করতে হয়। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরি পেতে হয়। আর যাই হোক—কর্পোরেট দুনিয়া কোটা দেখে বসিয়ে মাইনে দেবে এমনটা বিশ্বাস হয় না।
কিন্তু মানুষ তাই বিশ্বাস করে। মানুষ জানে তার লতায়-পাতায় সম্পর্কযুক্ত যে ছেলে বা মেয়েটি ৫৫% পেয়ে কলেজে সিট পেল না, তার চেয়ে ৪৫% পাওয়া এসসি/এসটি ছেলে বা মেয়েটি অনেক কম শিক্ষিত। অথচ আমরা যারা স্কুল কলেজে পড়াই এবং সত্যিকারের ভালো ছেলে-মেয়ে দেখি – বুঝতে পারি ৫০% আর ৩৫%-এ খুব বেশি ফারাক নেই। কিন্তু ৮৫% আর ৯০%-এ ফারাক আছে। অনেকটাই ফারাক। সেটাকে লিনিয়ার কোরিলেশান দিয়ে পার্সেন্ট মেপে বোঝানো যায় না।
যদিও সেই পদ্ধতিই চলে এসেছে এতদিন ধরে। সবাই তাই ধ্রুব সত্য বলে মেনে এসেছে। সকলেই মনে করে তার প্রতি করা ইনজাস্টিসটাই সবথেকে ঘৃণ্য। তাই আমরাও মনে মনে ভাবি – কোটার ছেলেমেয়েগুলো আসলে বাজে। আর যারা ভালো, তারা নিশ্চয়ই এডভান্টেজ নিচ্ছে। নিশ্চয়ই তার বাবা মায়েরা অনেক বেশি ইনফ্লুয়েনশিয়াল, টাকা দিয়ে ব্যবস্থা করে দিচ্ছে আরো নানান রকম।
ইউএস-এ থাকতে কোনো এক এনজিও ওয়ার্কারদের সাথে একবার কথা হচ্ছিল — তারা ব্রংক্স অঞ্চলে একটা প্রজেক্ট করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘সিঙ্গল মাদার’দের ‘স্পেশাল হেল্প’ করা। যারা শুধু ছেলেমেয়ের পেট ভরাবার জন্যে ২-৩ শিফটে কাজ করে, তাদের সঠিক কাজ খুঁজে দেওয়া ও তাদের শুধু ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার বন্দোবস্ত করা। এরকম তারা তদ্দিন করত—যদ্দিন না মা মোটামুটিভাবে ছেলেমেয়ের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে পারে৷
ছেলেটি আমাকে বলেছিল, আমরা গত দশ বছর এই কাজ করছি। এখন দেখছি—যে সেই ফ্যামেলির মায়েরা বা তাদের মেয়েরা এই প্রোগ্রামে আবার ফিরে আসছে। তাই আমরা নতুন প্রজেক্ট খুলেছি৷ আমরা আর শুধু সিঙ্গল মাদারদের সাহায্য করছি না। আমরা কম্যুনিটিকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। আমাদের বিশ্বাস—কম্যুনিটির উন্নতি না হলে এদের অবস্থার উন্নতি হবে না। কিন্তু তার জন্যে টাকা চাই—প্রচুর টাকা। আর চাই সরকারি পরিকাঠামো। পরোপকারের টাকায় তারা সামলে উঠতে পারছে না।
কিন্তু আমরা হয়তো সে সবে বিশ্বাস করি না। আমরা এসব খবরকে স্ক্যাম ভাবি – ভাবি সেকু-মাকুর চাল। আমরা বিশ্বাস করি নিচু জাতেরা ইনকম্পিটেন্ট। তারা অনর্থক বেশি সুবিধে পায়। তাদের মাথা নত করেই থাকা উচিৎ। আর তারই প্রকাশ দেখি ফেসবুকে, খবরের কাগজে, নিউজ চ্যানেলে। একজন নেতা কোনো ইন্সটিগেশান ছাড়াই একজন আদিবাসীর মুখে প্রস্রাব করে দিয়ে গেল। একটি ন-বছরের ছেলে এক উঁচু জাতের শিক্ষকের জলের জগ ছুঁয়ে ফেলেছিল বলে তাকে সেই শিক্ষক পিটিয়ে মেরে ফেলে দিল।
আমরাই আবার গর্ব করি সভ্যতার!
ছোঃ!!