ধরা যাক , আমি একটি কবিতা পড়েছি . কবিতা টি শেষ করে আমার মনে হলো কবি এবং আমি পরস্পর কে বুঝতে পারছি . এই উপলব্ধি কেই আমার মনে হলো সকলের সামনে মেলে ধরবো . আমার উদ্দেশ্য : যাঁরা আমাকে শুনছেন সকলের যেনো মনে হয় এই মানুষ টি তো আমার কথা বলছে ; আমার মনে হবে আমি এবং শ্রোতা পরস্পর পরস্পর কে বুঝতে এবং বোঝাতে পারছি . এই ভাবেই কান্ডারী হয়ে কবির সত্বা কে আমি পৌঁছিয়ে দিতে পারবো মানুষের কাছে ।.আমি মনে করি এই কান্ডারী হওয়ার মূল মন্ত্র একটাই , শম্ভু মিত্র যেমন টা বলেছেন - " আপনার করে বলো " যতো নিজের করে বলা যেতে পারবে ততোই বেশি করে শ্রোতার বোধগম্য হবে ।....ততোই সহজ হয়ে উঠবে কবির আত্মা কে অপরের কাছে পৌছিয়ে দেওয়া .
আমার প্রিয় একজন আবৃত্তিকার বিজয়লক্ষী বর্মন বলছেন অহেতুক আবেগ না দিয়ে যদি স্বাভাবিক কথোপকথনের মতোই বলা যায় , , এবং আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উনি বলছেন - " যে কথাই বলি , তার মধ্যে যেন শুধু আবেগ নয় , যুক্তিও থাকে . কবিতায় যে কথা উচ্চারণ করা হচ্ছে তারও আবেগ নিশ্চয়ই আছে , শিল্পের ক্ষেত্রে আবেগ থাকবে না সে তো হয়না কিন্তু যুক্তিও তো আছে , যে কথা টা যেভাবে বলছি সে বলার যুক্তি টা কি ? তা যদি নিজের কাছে পরিষ্কার থাকে অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাও সহজ হয় ......"
আসলে কবিতা আবৃত্তি হলো এক ধরনের প্রকাশ ।...এই প্রকাশ যতো স্বাভাবিক , সাবলীল হবে যাঁরা শুনছেন তাঁদের কাছে একটু সহজ মনে হবে ।...এই আর কি ....
কবিতা আবৃত্তির ক্ষেত্রে : দুটি হাতিয়ার ।.....যা শান দিয়ে যেতে হবে প্রতিনিয়ত : ১ ) উচ্চারণ ২ ) স্বরযন্ত্রের ব্যবহার ।....অনুশীলন করে যেতে হবে সমানে ।....এক আধটা নমুনা দেওয়া যাক :
ক চ ট ত প
খ ছ ঠ থ ফ
গ জ ড দ ব
ঘ ঝ ঢ ধ ভ
ঙ ঞ ণ ন ম
বাংলা বর্ণ গুলি কে এইভাবে পাশাপাশি খুব দ্রুত উচ্চারণ করতে হবে ।....এর মধ্যে নাসিকা বর্ণ গুলি কে আলাদা করে দ্রুত স্পষ্ট উচ্চারণ করা
আরেকটি বেশ মজার :
জলে চুন তাজা তেলে চুল তাজা /
আমাদের অতি পরিচিত : পাখি পাকা পেঁপে খায় / ইংরাজী তে : she saw seventy ship on the sea shore :
এই গুলি কে অতি দ্রুত বলতে পারার চেষ্টা করা
প্রত্যেকটি ধ্বনি কে একদম নিচু স্বর থেকে একেবারে উচ্চস্বরে বলা ।.......এই সব .......
এইবার আসি আমার ভীষণ প্রিয় কিছু আবৃত্তিকার ।...তাঁদের কথায় ।........
১ ) কাজী সব্যসাচী - শুধুমাত্র স্পষ্ট উচ্চারণ , দৃপ্ত কণ্ঠস্বর এবং অসাধারণ স্বরযন্ত্রের কাজ ।.....কোনো মিউজিক ছাড়াই কি দুর্ধর্ষ আবৃত্তি করে গিয়েছেন !!
" ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ
চায় শুধু ভাত একটু নুন
বেলা বয়ে যায় খায় নিকো বাছা
কচি পেটে তার জ্বলে আগুন ! "
এই লাইন গুলি বলতে কি কোনো মিউজিক লাগে ??
২ ) শম্ভু মিত্র - এমন ব্যক্তিত্ব ভূভারত এ আর জন্মাবে না . কি অসাধারণ সাবলীল ভাবে বলে গিয়েছেন উনি !!
কবি জীবনানন্দ দাশ এর " বোধ "
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের " নিরর্থক "
নিরর্থক এর বিষয়ে বলি -
প্রথম পংক্তি :
"আকাশ তোমায় খুঁজবে
উঁকি দেবে , দেবে , দেবেই "
দ্বিতীয় পংক্তি :
" ছাদে ঢাকা দেবে , দেবেই ,
যতই ভাবো না কিছু নেই
তৃতীয় পংক্তি :
" বেড়া দেবে , দেবে , দেবেই ,
যতই ভাবো না কিছু নেই "
চতুৰ্থ পংক্তি :
" নাড়া দেবে , দেবে , দেবেই ,
যতই ভাবো না কিছু নেই
উঁকি দেবে , দেবে , দেবেই
যতই ভাবো না কিছু নেই "
যতবার কথাগুলির পুনরাবৃত্তি হয়েছে
ঠিক ততরকম ভাবে বলেছেন উনি !
বিজয়লক্ষী বর্মন : "নাথবতী অনাথবৎ" থেকে শুরু করে " যারা বৃষ্টি তে ভিজেছিলো " ।....অপূর্ব ।....উনি তো একপ্রকার শ্রোতার সঙ্গে কথোপকথন ই করেন
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ওনার কণ্ঠে আমার ভীষণ প্রিয়
আজকাল বিভিন্ন পরম্পরায় অতিরিক্ত মিউজিক এর ব্যবহারে কবিতার শব্দগুলি যেনো কোথাও খুব কষ্টে আছে ।.....ধরুন আপনি একটা স্প্যানিশ গান শুনছেন ।....সুর টা খুব ভালো লাগছে কিন্তু মানে বুঝতে পারছেন না .. কিন্তু কবি তো এটা চান নি ।...কবি চেয়েছেন আমরা তাঁকে জানি , বুঝি ।....একজন আবৃত্তিকার হিসেবে আমাদের তাঁর কাছে এক দায়বদ্ধতা আছে বই কি ......
একজন আবৃত্তিকার কে সেই সঠিক কান্ডারী হতে হবে যে ।.......তবেই তো তার স্বাৰ্থকতা ..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।