এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  ইস্পেশাল

  • যে জীবন গেঁড়ির, গুগলির

    দেবাশিস সরকার
    ইস্পেশাল | উৎসব | ১১ অক্টোবর ২০২৫ | ২৬ বার পঠিত
  • অলংকরণ: রমিত 



    — ঝকমারি কুথায় সার ?
    পথমে এক কুন্টেল মাছ ছাড়ার মতন একটা বড় বাঁধ লাগব্যাক । তারপর সেই বাঁধের পাশে চার পাঁচ বিঘে জায়গাতে শচারেক ছোট ছোট ‘ডবা’ তোয়ের কইরতে হব্যাক ।
    — অ! ‘ডবা’ বুইতে পারল্যান নাই ? পুখোর– পুখোর ! ছোটগুলনকে ডবা বলে । লাল জলের পুখোর হলে ভালো হয় —
    —- কি? হি হি হি ! দিল্লাগি করচ্যান ? বতলের লাল জল লয়। উটা কি এক পুখোর হয় ! কাঁকুরে মাটির জল । ইয়াতে মাছের ডিমটা ভালো ফুটে ! আর আমাদের বাঁকুড়ার বহু জায়গার বাঁধেই লালে লাল জল ! কাঁকুরে মাটির পুখোর ত গাদাই ! কত লিবেন !
    — না–না ! আপনাকে লিতে বলছি নাই । ‘ কত লিবেন’টা আমাদের গাঁয়ে-ঘরে কথার একটা ইয়া – মানে লবজ্ আর কি ! ধরেন ক্যানে , আপনি আমাকে জিগাস করলেন , ‘তুমাদের গাঁয়ে এখন ছাগল বিককিরি আছে কি ?’ আমি বইলব , ‘ হঁ আইজ্ঞা ! কত লিবেন’! সেরকম । বুইল্যান ?
    — অ ! আপনাদের উখেনে কাঁকুরে মাটি নাই ? তাথে কনো ওষুবিদা নাই। অভাবে লাতজামাই ভাতার ! সাদা জলের পুখোরেই ডিম ফুটানো যাবেক । হঁ ! সাদা বা লাল যে জলই হোক না ক্যানে জল থাকব্যাক তিন চার ফুট । হল ? পথম দিন অইন্য পুখোর থেকে এক কুন্টেল মাছ এনে ছাড়া হব্যাক । তাতে হাফ মানে অদ্ধেক মেইল মাছ আর হাফ ফিমেল
    মাছ –
    — ই বাবা ! মাছের নারী-পুরুষ নাই আবার ? আচে বই কি ! সোব জীবেরই নারী–পুরুষ আছে , মাছের থাকবেক নাই ক্যানে ? নারী-পুরুষ না থাইকলে সিষ্টি হব্যাক কি করে !
    —- দূর ! মাছেদের উসব নাই । পুরুষ মাইনষের যেমন ধন আছে আর মেয়াদের যেমন ইয়া – যিটা বাইরে থেকে দেখলেই বুইতে পারা যায় ই মেয়া বঠে, সেরকম আর কি , মাছেদের তা নাই বঠে , তবুও চিনবার উপায় আছে ।
    — বলচি – মাছের মাথার পেচনে যে পাখনাগুলন থাকে তার তলায় আঙুল দিয়ে ঘষা দিলেই বুজতে পারা যায় । যে মাছের ওই জায়গাটা একটু খসখসে লাগবেক সেটা হচ্ছে মরদ মাছ আর যেটা পেলেন লাগবেক সেটা হচ্ছে ইস্ত্রী মাছ । ত , পুখোরে সেরকম ফুট চারেক মাপের জল ভরে ডাগর ডাগর মাছগুলন এনে ছাড়া হবেক পথম দিন ।
    —- কিনে আনব্যাক ক্যানে ? মাছ ব্যবসা যারা করতে নেমেছে তাদেরই কনো পুখোর লয়ত তাদেরই কনো বন্দুর পুখোর থেকে মাছগুলো ধার লিয়ে আসে ।
    —- ধার শোধ কিভাবে হয় বলচি পরে । ত , একটা দিন মাছগুলো গ’টা পুখোরটায় ঘুরে বুলবেক । পরের দিনকে মাছের ডাকতর আসবেক—
    — হঃ হঃ ! সোবাইকার যেমন ডাকতর আছে তেমনি মাছেদেরও ডাকতর আছে সার !
    – না । পাস করা লয় বোদয় । ক্যানে কি না , মাইনষের ডাকতরের মতন জাঁকজমক ইয়াদের নাই । এক একজন ত লুঙ্গি পরেও আসে ।
    — না । মুচুলমান ক্যানে হব্যাক ? ইসব হিসাব কুথা থেকে চালু হঁয়েচে বলেন দেখি ! নরেন মুদী , অমিত সাহা যেমন লুঙ্গি পরা লোক দেখলেই ধরে লিচ্ছে ই মুসলমান বঠে – ক্যাঁক করে ধরে বাংলাদেশে চালান করে দিচ্ছে সেই হিসাব যেদি সবাই করে তাহালে ত মশকিল! আমাদের গাঁয়ে ঘরে ত হিন্দু– মুচুলমান সোবাই লুঙ্গি পরে । হিন্দুরা লুঙ্গি না পরে কি ল্যাংটো থাইকব্যাক ? আমি লুঙ্গি পরে আছি বলে আমাকে কি মুচুলমান ভেবে লিয়েচেন নাকি !
    — বলচি – বলচি । আপনিই ত কথার মাঝখেনে ই কথা সি কথা এনে লাইনের গাড়িকে বেলাইন করে দিচ্ছেন ! কতদূর তক্ বলেছিলম বলেন দেখি !
    — হঁ ! মাছের ডাকতর । ইয়ারা পুখরের জলে ওষুদ দেয় , মাছের খাবারে ওষুদ দেয় । তার আগে মাছের চারাপোনাগুলো যে পুখোরের জলে এনে ঢালা হব্যাক সেই পুখোরের জলে সার ওষুদ মিশিয়ে জলটাকে রেডি রাখতে হয় । সেটাই আগে বইলব কি ?
    — অ ! আগে ডিম ফুটানোর কথা শুনব্যান ? বেশ! ওইন্য ওইন্য বন্দুদের পুখোর থেকে বাঁধের জলে ত কুন্টেল খানেক মাছ এনে ফেলা হলো । পরদিন সইন্ধ্যা সাতটার দিকে মাছের ডাকতর আসব্যাক । পুখোরে জাল ফেলে পথমে বেছে বেছে ফিমেল মাছগুলোকে তুলে ইনজিশন দিয়া হব্যাক । যে যেরকম সাইজ সে অনুযায়ী ডাক্তারবাবুরা ঠিক করব্যাক কি কতটা ডোজ ঢুকানো উচিত ।
    —- না ! ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ করে সব মাছকেই এক ধারসে ইনজিশন দিয়া যাবেক নাই ! মেল মাছগুলনকে ঘন্টাখানেক বাদে ইনজিশন দিতে হবেক ।
    — না । ইয়ার কারণ আছে ফিমেল মাছের সেক্স আসতে একটু দেরি হয় —
    —- কি ? সেক্স– মানে ওই – ইয়া – আপনাদের ভাষাতেই ত বললম ! মানে ওই ইয়া – মিলনের ইচ্ছা । হাসব্যান নাই ! একসঙ্গে মেল ফিমেল সোবাইকেই ইনজিশন দিয়ে দিলে হবেক কি , মেল মাছগুলো সঙ্গে সং গরম হঁয়ে জল তোলপাড় করে ক্যানে , তাই ঘন্টাখানেক বাদে উয়াদের ইনজিশন দিতে হয় । ফিমেল মাছগুলোর গরম হতে অ্যানক ডেরী হয় যে ! সবাইকেই একসঙ্গে ইনজিশন দিয়ে দিলে মেল মাছগুলো ত্যাতক্ষণ ধইজ্জ ধরতে পারব্যাক ক্যানে ?
    —- হঃ হঃ হঃ ! ইসব মাছের ডাকতররাই বলেচে । নাইলে আমি কি জলের ভিতরে চোখ ফেড়ে ইসব দেখতে গেছি ! যেমন যেমন শুনেছি তেমন তেমন বললম । পত্যেক বছরই আষাঢ় মাসে এই কাজ ত আমাকেও করতে হয় ।
    — তা বই কি ! মাছগুলোকে জাল ফেলে ধরা , ডাকতরের হাতে তুলে দিয়া , ইসব আমরা চার-পাঁচজন মুনিশই ত করি ।
    — হঁ ! মালিকরাও থাকে বই কি ! চার-পাঁচজন মালিক মেলে শেয়ারে মাছের ডিমের ব্যবসাটা করে। তারা পালা করে আমাদের সঙে রাত জাগে , আমাদের সঙে এক একটা মুনিশের মতন খাটে—
    — কুন্টেল খানেক মাছ কিনে ছোট পুখোরে পাউস করানো যাবেক ক্যানে ! বড় বাঁধ চাই । একটা বড় বাঁধের মালিক কি একজন হয় নাকি ! পাঁচ ছ’জন মালিক ত—
    — ‘পাউস’ কি জিনিস বুঝল্যান নাই ? ‘পাউস’ হল মাছের ডিম ফুটিয়ে চারাপোনা বার করা ।
    — বলতেই তো চাচ্ছি ! আপনিই ত নানারকম সন্দ পকাশ করে আর কোশ্চেন করে করে আমার কথার খি গুলিয়ে দিচ্ছেন ! বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন নাই আবার পশনো করতেও ছাড়চেন নাই ।
    — অতশত নাই জানি বাবু ! আমরা পেত্যেক বছর বর্ষার আগে ইভাবেই বাঁধে ডিম ফুটাই ।
    — ল্যান তালে বলচি । তালে পেত্যেক কথার মাঝে টুকবেন নাই । হঁ – ! আমার কথার খি হারাঁই যায় । ত , ইভাবেই পুরুষ নারী সমস্ত মাছগুলনকেই ত গরম করে পুখোরের জলে ছেড়ে দেওয়া হল । তারপর ওয়েট করতে হব্যাক—
    — কতক্ষণ তা বলি কি করে ! তা ধরেন ক্যানে দুবার পেসাব ফিরা কি দুবার বিড়ি ফুঁকা হঁয়ে যাবেক ত্যাতক্ষণে । ওপিক্ষা করতে হবেক মেল ফিমেল মাছের মধ্যে মেলবন্ধনটা কখন আরম্ভ হয় !
    — উঁহু ! জলে কনো শব্দ করা বা উঁকি দিয়া যাবেক নাই । ওই জন্যিই ত বাঁধের পাড়ে বসে বসে ওপিক্ষা করা– ! মাইনষের যেমন তেমন ত উয়াদেরও ! উ সময় ডিসটাপ করা চলে কি !
    — আমরা ত বাঁধের পাড়ে বসে বিড়ি ফুঁকচি আর ফিসফিস করে কথা বলচি । তখন ওই মেল মাছ ফিমেল মাছ উয়ারা ঠিক খুঁজে লিবেক যার যা সাইজ সেরকম মাছ । তাথে হয়তো রুই মাছের সাথে কাতলার জোড় লাগতেও পারে -–
    —- না । মাছেদের জগতে আমাদের মতন জাত মানামানি নাই । মানুষই নানারকম ধান্দার কারণে হিন্দু–মুচুলমান , কায়েত– বামুন ইসব ভাগাভাগি করেচে । মাছেরা এখনো উসব শিখে নাই ! উয়াদের সাইজ মিলে গেলেই হল !
    — তা হয় বই কি ! কাতলার সঙ্গে রুইয়ের বা মিগেলেরও জোড় লাগে অনেকসময় । সেই জন্যিই অনেক সময় দেখা যায় এক একটা কিম্ভুত কিমাকার দো– –আঁশলা মাছ । অনেকেই ভয়ে বা গা ঘিনঘিনানিতে কিনতে চায় নাই , তবে আমি খেয়ে দেখেছি , টেস ত খুবেই চমৎকার !
    —- অ ! আপনি দেখেন নাই ? ইরকম দেখা যায় মাজে মাজেই । মাছটার মাথাটা হয়তো কাতলা মাছের কিন্তু বোডিটা রুই মাছের ।
    —- হঁ ! কতদূর তককো বলেচি যেমন ?
    — হ্যাঁ ! মেল ফিমেল দুই রকম মাছই গরম হল তারপর উয়াদের মিলন হল , তারপর চার পাঁচ দিন বাঁধের পাড়ে বসে ফিমেল মাছের ডিম ছাড়ার অপিক্ষা ।
    —- না ,জলে নামা যাবেক নাই । এমনকি জলের ধারে বসে মুখ ধুয়া বা কুথাও হেগে এসে জলের ধারে বসে ছোঁচানোও যাবেক নাই । জলটাকে পুরাপুরি রেস–এ রাখতে হবেক । জলে নামা বারণ ।
    — বলচি – সাঁঝবেলায় বা রাতের বেলা কনো একসময় ফিমেল মাছগুলো ডিম ছাড়বেক । হাজার হাজার ডিম চাকবাঁধা থকথকে অবস্থায় পুখোরে বা বাঁধের ইখেনে সিখেনে ভাসতে থাকবেক । সকালবেলা আমরা দেখব যে ডিমগুলো আস্তে আস্তে সাবুদানার মতন হয়ে ফুলে উঠচে আর ভিতরে একটা করে বিন্দু দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে দেখা যাবেক আস্তে আস্তে সাবুদানাগুলো একটু করে লড়ছে। কিচু পরেই দেখা যাবেক কি ওই ডিমের চাকগুলন সব আলাদা আলাদা হঁয়ে গেছে । বেশিরভাগই লড়চড়া করচে ! ত্যাখন আমরা ওই ডিমগুলোকে মশারির জাল দিয়ে ছেঁকে—
    — ওঃ ! ইটাও বুজাতে হবেক ! মাছ ধরার জাল দেখেচ্যান ত ? জলের ভিতরে ওই জালটাকে ডুবিয়ে যখন টানা হয় , যে চারকোণা ফুটোগুলো থাকে সেই ফাঁক দিয়ে জল পেরাঁই যায়, কিন্তুক মাছ পেরাতে পারবেক নাই , বঠে ত ? মশারির জালও সেইরকমই তবে ওই ফুটোগুলো এত খুদি খুদি যে মশাও পেরাতে পারবেক নাই । ক্যালা কামড়াবি কি ! মশারির বাইরেই সারারাত গুনগুন করে গান করবেক আর ঘুরে বুলবেক । এখন মাছের ডিমও তো সেরকমই খুদি খুদি । জল থেকে ওই ডিমগুলোকে আলাদা করার জন্য তাই মশারি ছেঁড়া দিয়ে জাল তৈরি করতে হয় । বুইল্যান ?
    —- আদ্ধেক জল ভরা বড় বড় অ্যালুমিনির হাঁড়িতে ওই ডিমগুলো ভরে একরাত রাখা হবেক । তারপর ওই হাঁড়িগুলো থেকে বড় বাটির এক বাটি করে এক একটা ছোট ছোট চৌবাচ্চায় রাখা হল —
    —- হঁ ! ওই বড় বাঁধটার পাশে বিঘে দুই জায়গা জুড়ে লাল জলের ছোট ছোট চৌবাচ্চা বা ‘ডবা’ ত তোয়ের করা হঁয়েচে আগেই । এই ‘ডবা’গুলোতেই ডিম ফুটে ব্যাঙাচির সাইজের হলে ত্যাখন বিক্রি হয়ে যাবেক । — নাঃ ! বাঁধে আর মাছ রেখে কি হবেক ! বাঁধের মাছগুলো আবার যাদের কাছে ধার লিয়েছিল তাদেরকে পুখোরে ছেড়ে দিয়া হব্যাক ।
    —- হ্যা ! এমনি এমনি কেউ কি আর মাছ ধার দেয় ! মাছের চারাপোনা বিক্কিরি হবার পর পোয়সাটা দুভাগ হব্যাক । যাদের পুখোরের মাছ লিয়া হঁইছিল তারা পাবেক দশভাগের চার ভাগ আর যারা ডিম তৈরি করে চারাপোনা বার করছে তারা পাবেক ছ’ভাগ । যে পুখোরের মাছ সে পুখোরেই ফিরত গেল।
    —-- হঁ ! দু চারটা মাছ মরে যায় বই কি ! ত্যাখন মাছের মালিককে মাছের দাম দিয়ে দিয়া হয় ।
    — উঁহু ! একজন মালিকের এমন দম আছে ? বোদয় কুড়ি পঁচিশ লাখ টাকার কারবার !
    —- আমি সব জানবো কুথা থেকে ? আমি মুনিশ বঠি ! রাতে দিনে দুবেলাই বাঁধ পাহারা দিয়া , আর জাল ফেলে মাছ ধরা বা আবার জলে ছেড়ে দিয়া আমার কাজ ।
    — নাঃ ! ডেলি চারশো টাকা আমার ব্যাতন ।
    —- তার বেশি কে দিবেক ! হঃ ! মূলে মাগ নাই তার আবার ফুলসইজ্জা !
    —- ওষুদ ক্যানে দেয় ? হ্যা:! সাতকান্ড শুনে এখন বলচেন কি সীতা রামের মা বঠে ! ই বাবা ! ওষুদ ত লাইগবেকোই বাবু ! মাছের যাতে রোগ না হয় , মাছের ফলনটা যাতে গেদে হয় সেই লেগে ওষুদ দেয় । মাছের বাজারে পাকা মাছ কিনেছেন ত বঠেই ! কখনো দেখেছেন কি একটা লোক মাছের বাজারে ঢুকে পাকা মাছের দোকানির কাছ থেকে এক একটা পাকা মাছ লিয়ে মাছটার মাথার খুলির ভিতরে একটা ইঞ্জিসানের সিরিঞ্জ ঢুকাঁই দিয়ে খানিকটা থকথকে জিনিস টেনে লিচ্ছে ! লিয়ে মাছটা আবার দোকানিকে ফিরত দিয়ে দিচ্ছে ! দেখেছেন ?
    — হঁ ! সন্ধের দিকেই বেশি আসে উয়ারা । যেদি চোখ ফেড়ে দেখতেন তাইলে দেখতেন কি ওই যে মাথার ঘিলুর রসটা টেনে লিচ্ছে তার ভিতরে ছোট ছোট সাবুদানার মত কতগুলো কি যেমন ভেসে বেড়াচ্ছে !
    — বলচি বলচি ! এত তাগাদা মারচেন ক্যানে ? কুথাও যাবেন না কি ? ত , থকথকে ওই সাবুদানাগুলন লিয়ে উ ইবার একটা শিশিতে ভরে রাখব্যাক । ইবার আসল কাজ !
    — বলি ! মাথার খুলির ভিতরে সিরিঞ্জ ঢুকাঁয়ে যেটা বার করলেক সিটা হচ্ছে মাছের বীজ্জ ।
    —- না । প্যাঁদা কথা লয় । বিজ্জ। আমি মাছের ডাকতরের কাছে লিজে শুনেচি । বিশ্বাস না হলে ডাক্তারি বইতে লেখা আছে , পড়ে লিবেন ।
    — বেশ ! ইয়ার থেকেই ইবার অইন্য মাছের জন্ম হবেক । মানুষের মধ্যেও দেখবেন অনেক ইনজিশনের বাচ্চা হচ্ছে আজকাল । মাছেদের যাতে গেদে বাচ্চা হয় , আর বাচ্চা হওয়ার পর সেগুলো যাতে চড়চড় করে বেড়ে উঠে , সেই লেগে ওই বিজ্জর ইনজিশনের সঙ্গে ওষুদ মিশানো হচ্ছে এখন। নাহলে সেই বহুকাল আগে থেকেই মাছেদের ইনজিশন দিবার এই ব্যবস্থা চালু আছে । হায়েলডিং ফলনের বেবস্থা আমাদের এই গাঁয়ে ঘরের দিকে এই বছর কুড়ি চালু হঁয়েচে দেখছি ।
    — বিনা ইনজিশনে মিলন হবেক নাই ক্যানে ! ইস্ত্রি মাছ আর পুরুষ মাছে মিলন ত জলের ভিতরে আকছার হচ্ছেই ।
    ইখেনে বাঁধে মাছ চাষের কথা হচ্ছে । ত শুনেন ! বাইরে থেকে ধরে আনা মাছগুলোকে পুখোরে মানে বাঁধে ছেড়ে দিয়া হলো । একদিন উয়ারা নিজের মনে ইদিক-উদিক খেলব্যাক, লাফালাফি করব্যাক , লিজেদের মদ্যে ভালোবাসাবাসি করব্যাক । এই ফাঁকে ওই ডাক্তারবাবু করব্যাক কি , যত্ত মাথার ঘিলু বা বিজ্জ জোগাড় করেছিল , সেগুলো একটা খল–নুড়িতে ঘষে ঘষে পেস্ট করে আবার শিশিতে ভরব্যাক । তার সঙ্গে আরও যা যা সব মিশায় সে ত আগেই বলেছি !
    — নাঃ ! ইউরিয়া মিশায় নাই ! মাছের বীজ্জর সঙ্গে ইউরিয়া মিশানো যায় ? ইউরিয়া পুখোরে । ডিম ফুটে ছোট ছোট পোকার মতন বাচ্চা বার হবার পরে সেই বাচ্চাগুলোকে যে পুখোরে ছাড়া হয় সিখেনে বস্তা ভর্তি করে পুখোরের জলে চুণ, ইউরিয়া আগেই ঢালতে হবেক ।
    —- চুণ ? পুখোরের সাইজ মতন দু তিন বস্তা ঢালতে হয় । শুদু চুণ বা ইউরিয়া লয়, আরও কতরকম কি !
    —- তা বলতে লারব ক্যানে ? মিশাই তো আমরাই ! তবে উসব ইংরাজি নাম বলতে পারবনি ।
    —- ধরেন ক্যানে ,পুখোরে ঢালবার আগে একটা বড় গামলাতে জল রেখে একটা বড় জেরিক্যান থেকে পটাশিয়াল নামের কি একটা ওষুদ ওই গামলার জলে ঢেলে দিয়া হলো । সঙ্গে সঙ্গে গোটা গামলার জলটা বেগনি বা নীল রঙের হয়ে যাবেক । তারপর সেই নীল রঙের জলের গামলাটা পুখোরে ঢেলে দিতে হব্যাক । ইটা আমরা দুফরবেলা নাগাদ করি , তখন লোকজন পুখোর পাড়ে কম আসে । তারপর মেথি না মেথিলিন নামের কি একটা ওষুদ —
    —- হঁ ! ঝঞ্ঝাট এড়ানোর জন্যেই লোকের চোখের আড়ালে ইসব করতে হয় ।
    —- বলচি ক্যানে , ধরেন – ফরমা – ইয়া – ফরমালিন , উটা পুখোরে ঢালবার আগে নাকেমুখে কাপড় বেঁধে রাখতে হয় । ঝাঁঝালো গন্ধ ! গন্ধে দম বনদো হয়ে আসে , চোখ জ্বালা করে । উটা যেদি পকাশ্যে , দিনের বেলায় ঢালা হয় , লোক এসে তো আপিত্য করব্যাকোই ! পুখোরের জলে তুমি বিষ মিশাচ্ছ ক্যানে ! পুখোরের মালিকানা তুমার হতে পারে তবে জল ত পাঁচজনের। লোকে পুখোরের জলে মুখ ধোয় , চান করে , হেগে এসে ছোঁচায় –
    — আপনি কি কিছুই জানেন নাই নাকি ? গাঁওলি লোকের কি বাতরুম আছে কি , যে লোকের চোখের আড়ালে ইসব করব্যাক ? আমার বলার মাঝে এত কোশ্চেন করলে আমি সব ভুলে যাচ্ছি। আগেরটা পরে মনে পড়ছে পরেরটা আগে মনে পড়ছে ! ওই জন্যই বলি , কথার মাঝে টুকব্যান নাই ।
    — চাষের আগে জমি তৈরি করার মতন পুখোরে মাছ চাষের আগে পুখোরের জলটাকেও রেডি করতে হয়। মাছের চারাপোনাগুলো এনে পুখোরে ফেলবার আগে সেই পুখোরের জলটাকে রেডি করার কথা বলচি ।
    — ইবার মাছের মড়ক লেগে চারাপোনাগুলন যাতে মরে ভেসে না উঠে সেই জন্যে জলে কি যেমন টাইসিন ফাইসিন নামের কি সব অ্যান্টিবায়ুটিক মিশাতে হয়।
    —- পাঁচ লিটার দশ লিটারের জেরিকেনে পাওয়া যায় । ই সবই আমরা মাঝরাতে ঢালি ।
    —- বা ! লোকে যদি দ্যাখে চিল্লিয়ে পাড়া মাত করে দিবেক নাই ? জলে বিষ মিশাচ্ছে ! মহামারী ছড়াবেক। বলা যায় নাই , সরকার থেকে এসে মাছ চাষ বন্ধ করে দিলেক ! তাই গোপনে—
    —- হ্যা:! হ্যা! : হ্যা :! বিষ মনে করলে বিষ , অমরেতো মনে করলে অমরেতো । পুকুরের জলে চান করলে গায়ে এত চুলকুনি ছুলি দাদ হচ্ছে ক্যানে ? হাঁচিসর্দিজ্বরে আর আগেকার কনো ওষুদ কাজ করচে নাই কি জন্যে ? মেজবাবু সেদিনকে বলছিলেক , মাছকে ত কনো রোগই আর ছুঁতে পারব্যাক নাই । পোলট্রির মুরগিকে যেমন ডিম ফুটে বার হওয়া মাত্তকই অ্যান্টিবায়ুটিক আর তরতর করে বেড়ে যাওয়ার ইস্টেরড ইনজিশন ফুঁড়ে ফুঁড়ে বড় করা হচ্ছে , সেরকম ! সেই মাছ মুরগি যারা খাবেক তাদের আর পুরনো ওষুদে কাজ হবেক ক্যানে !
    — বুজচে নাই কি ! যে বাঁশটি ঢুকে গেছে সেটা মানুষ বুজতে পারচে বইকি । মানুষ নাই পোতিবাদ করতে পারে বা বেবস্তা লিতে পারে । ইদিকে পুখোরের জলে ইসব ওষুদ মিশানোর ফলে জলে যে সমস্ত গেঁড়ি, গুগলি,কাঁকড়া এমনকি কত রকমের পোকা থাকত তাদের কি হলো বলুন দেখি ! নাকি তারা পোতিবাদ করতে পারে নাই বলে তাদের জীবনটা জীবন লয় ? মা বসুমতী ত চেয়েছিল , তার বুকে মানুষ যেমন চলাফেরা করব্যাক তেমনি বাঘ , শিয়াল এমনকি সামাইন্য একটা কেঁচোও ত চলাফেরা করব্যাক । মা বসুন্ধরার কুন জায়গায় ব্যথা সেটা বুজতে পারচ্যান কি ?
    —- অ ! বিজ্ঞানকে আটকানো যাবেক নাই । মানুষ বেশি ফসলের লোভে জমিতে ,পুখোরে সার ওষুদ দিবেকোই । তাই বলচেন ত? —- হ্যা হ্যা হ্যা ! আপনার মনের কথাটা মুখ্যু হলেও ধরেচি ! বেশ ! আসল সমইস্যাটাই ত আপনি বুজতে চাইচ্যান নাই ! আগেও বলেচি । বাঁধের জলে চান করলেই গায়ে চুলকানি হচ্ছে ক্যানে ? মাছের সেই টেস আর নাই ক্যানে ? মাছের জন্মের সময় থেকেই ত তাদের চলাফেরার যে জায়গা সেই জলে যত রকমের ওষুদ মিশানো হচ্ছে! উয়াদের খাবার দাবারটাতেও ত ইউরিয়া আর নাম জানি নাই কিসব ! ইয়ার ফলে মাছ আর সেই মাছ আছে কি ! নাকি সেই পুষ্টি আর আছে ! সেই মাছ আপনি ডেলি খাচ্ছেন , আমিও ন’মাসে ছ’মাসে খাচ্ছি , একটু একটু করে শরীরে বিষ ঢুকছে নাই কি ! আজকাল কত রকমের নতুন নতুন রোগ বেড়েছে দেখেছেন ?
    —- আমরা হলম ক্যালা পুখোরের গেঁড়ি গুগলির মতন মানুষ । উয়াদের মতনই ধীরে ধীরে ফিনিশ হঁয়ে যাব। পুখোরের জলে চান করে গায়ে ঘা , পুকুরের জল খেয়ে পেটে ক্যানসার , এখন আপনারা কি করে বাঁচবেন বলেন দেখি ! ভাইব্যে দ্যাখেন মা বসুন্ধরার কুন জায়গায় ব্যথা !


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ১১ অক্টোবর ২০২৫ | ২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন