এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  ইস্পেশাল

  • বালিকা ও ইস্ত্রিওয়ালা

    অদিতি দাশগুপ্ত
    ইস্পেশাল | উৎসব | ১০ অক্টোবর ২০২৫ | ২৪ বার পঠিত
  • অলংকরণ: রমিত 



    বালিকা তাহার মাতার সহিত বাস করিতো মহানগরের শহরতলির এক পল্লীতে। একটি দুই তলা বাড়ির এক তলাটির এক প্রান্তে তাহাদের বাস। ছোট একখানি শুইবার ঘর, একখানি ছোটো বারান্দা, কলঘর লইয়া সে ক্ষুদ্র গৃহখানি। বারান্দার এক প্রান্তেই তাহাদের ক্ষুদ্র রান্নাঘর। বালিকার বয়স একাদশ বৎসর। তবে বঙ্কিমবাবুর যুগ হইতে আমরা অনেকটাই আগাইয়া আসিয়াছি বলিয়া সে আটহাতি শাড়ি পরিয়া মালা বেচিতে যায়না, সে বিদ্যালয়ে যায় এবং তাহার মাতাও বাড়িতে বসিয়া না ধুকিয়া একটি সওদাগরী আপিসে চাকুরী করিতে যান। চাকুরীর খাটুনি ও স্বল্প পারিশ্রমিকের বিষয়টি রহিয়াছে, তথাপি, পাঠকগণ নিশ্চয় বুঝিয়া ফেলিয়াছেন যে, মা ও মেয়ের জীবনে অনিশ্চয়তার ছায়াটি এতটা ভীতিপ্রদ নহে, যে রুক্মিণীকুমাররূপ কোনো লণ্ঠন-সলিতা নামাইয়া হইলেও, তাহাদের উঠানের কোনে রাখিয়া দিতে হইবে। ইহা শিল্প বিপ্লবের সুফল। ব্যাখ্যাটিও ভারতীয় প্রেক্ষিতে শিল্পবিপ্লব উত্তর। কেহ নাও মানিতে পারেন।

    অবশ্য, ক্ষমতার সমস্যা ও উপদ্রব সর্ব দেশে সর্ব যুগেই থাকে। তাহারা বেশ পরিবর্তন করে মাত্র! এক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম আশা করা যায়না।

    উক্ত পল্লীরই একটি প্রান্তে এক পশ্চিমা ইস্ত্রিওয়ালার চালাঘর। পল্লীর ভদ্র গৃহস্থগণের বসনাদিকে কুঞ্চন মুক্ত করিয়া রম্য রূপ দানেই তাহার দিন গুজরান। পরিবারটি তাহার দেশে। ইস্ত্রিওয়ালার চেহারা কেহ তেমন নজর করিয়া দেখেওনা যদি না কিছু অস্বাভাবিকতা বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। এই ইস্ত্রিওয়ালার সেইরূপ কিছু ছিলোনা। তথাপি, নিজেকে পরিবেশের সহিত খাপ খাওয়াইয়া লইবার প্রচেষ্টা, জীবন ও জীবিকার ধরণ, সেই ধরণটির সামাজিক মূল্যমাপকে অবস্থান এবং সেই অবস্থানটি লইয়া নিজ মনোভাব- এই সবকিছুই বুঝি মানুষের বাহ্যিক চেহারায় একটি বিশেষ রূপ ও ভঙ্গি আনিয়া দেয়। অপরের কাছে সে এই রূপটিতেই ধরা দেয়! অন্যত্র, অন্য রূপে তাহাকে দেখিলেও মানুষ সহসা চিনিয়া উঠিতে পারেনা।

    আমাদের এই ইস্ত্রিওয়ালা গৃহস্থ বাড়িগুলি হইতে কাপড় সংগ্রহ করিয়া লইয়া যায় ও ফিরতও দিয়া যায়, যাহাতে কর্মব্যস্ত দিনে তাহার কাছে তাহাদিগকে ছুটিতে না হয়। মাজা রং এর পাতলা দেহটি লইয়া কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে সে চলাফেরা করে। মস্তকটি বাম পার্শে তাহার হেলিয়াই থাকে প্রায়, একটু কুঁজো হইয়া সে আসিয়া দাঁড়ায় গৃহস্থ দ্বারে, একবারই মাত্র দরোজার ঘন্টিটি বাজায়। গৃহস্থ শুনিতে না পাইলে নিজেকেই অপরাধী বোধ করিয়া হয়তো ভীত ভাবে আরেকবার চেষ্টা করে ঘন্টি বাজাইবার। ঢিলে ফুলপ্যান্ট, কুঁচকানো শার্টটির গলার ফাটা কলার আর অন্য ফুটিফাটাগুলি বেশ নজরে পড়ে। সে দেশে যাইলে তাহার এক দেশোয়ালী ভাই ব্যবসাটি ধরিয়া রাখে তাহার চেহারা ও চলন বলন অন্য রূপ হওয়ায় লোকে একটু অশান্তিতে ভোগে। উচ্চমন্যতার আরামটি যেন ঠিক আসেনা। সে ফিরিয়া আসিলে লোকে হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচে।

    ইস্ত্রিওয়ালা বালিকার গৃহের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়ায় দোতলার মানুষদেরই অপেক্ষায় মূলত। বালিকার মা নিজেই বসন ইস্ত্রি করিয়া লন। কচ্চিৎ কদাচিৎ নিজের বা বালিকার সৌখীন কোনো বস্তু হয়তো তাহার হাতে ছাড়িয়া দেন। ইস্ত্রিওয়ালার কার্য ও দীর্ঘসূত্রিতা লইয়া অভিযোগ করিয়া দরদস্তুরীতে তিনি যাননা সে ক্ষেত্রে। ইস্ত্রিওয়ালা বালিকাকে দেখিলে হাসে, তাহাদের সহিত স্থায়ী কারবার তাহাদের না থাকিলেও।

    বালিকার মধ্যে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য নাই যাহা দেখিয়া অপরিচিত লোকে তাহাকে অগ্রাধিকার দিবে। সে নিতান্ত শিশু নহে, আবার কৈশোরের লাবণ্য আসিতেও দেরী রহিয়াছে। তাহার মেলানিন সমৃদ্ধ কৃষ্ণা ত্বক এ দেশে এখনো একটি নারী সমস্যা বলিয়াই গণ্য হয় যদিও কৃষ্ণ মহাকাশে নারীর টহলদারির ষাট বর্ষ অতিক্রান্ত। বালিকার শৈশবের কঠিন রোগ স্বাক্ষর রেখে গিয়াছে তাহার দৃষ্টিশক্তিতে। ভারী কাঁচের আড়ালে চক্ষু দুইটি অনেকটাই পিছু হটিয়াছে। বালিকা কথা বলেনা। তাহার বাকশক্তি নাই তাহা নহে। নিজেকে উপস্থাপিত করাতেই বুঝি তার অনীহা। শ্রেণীকক্ষে আর বালক বালিকারা যখন হটোপাটি করে, সে তাহাতে অংশ গ্রহণ করেনা। যে কেতাদুরস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে তাহার মাতা তাহাকে অনেক আশা লইয়া বহু কষ্টে ভর্তি করাইয়াছেন ও খরচ টানিতেছেন, সেইখানের পরীক্ষাদিতেও সে বিশেষ কোনো কৃতিত্ব দেখাইয়া উঠিতে পারে নাই এ যাবৎ। সে কীসে অপারগ তাহার তালিকাটিই বাড়িয়া চলে, কীসে সে পারঙ্গম তাহা জানিবার কোনো সময় বা সুযোগ হয় নাই কাহারো। তাই বিদ্যালয়ের পাঠক্রম অতিরিক্ত কার্যক্রমেও তাহাকে সকলেই তুলিয়া থাকে একরূপ। তাহার মাতাও চাকুরীর চাপে নিয়মিত তাহার বিদ্যালয়ে হাজিরা দিতে, বা অভিভাবকদের সামাজিক সংগঠনে যোগ দিয়া বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা ও পঠনপাঠন সংক্রান্ত মূল্যবান তথ্যাদি সংগ্রহ করিতে পারেননা। তাই বহু সময়েই তাহারা অর্বাচীন প্রতিপন্ন হয়। শিক্ষক- অভিভাবক বৈঠকে তাহাদের কোনো বক্তব্য কেহ শোনেনা, শিক্ষকরাই বলিয়া যান এবং বালিকা সম্পর্কে কোনো সদর্থক ইঙ্গিত সেখানে বিশেষ মেলেনা। নিজ কন্যা সম্পর্কে এতগুলি নেতিবাচক ভাবনা মাতা তাঁহার নিজ যুক্তিবুদ্ধি এবং সহজাত ও সাধারণ বোধ এর সমর্থন না পেলেও শিষ্টাচার রক্ষার্থে ও নিজ কন্যার আশু অবস্থার স্বার্থে সায় দিয়া যাইতে বাধ্য হন।

    কিন্তু, যে নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি নিজ বক্তব্য পেশ করেননাই এতকাল, তাহার জন্যই এইবার মরিয়া হইয়া বিদ্যালয়ে ছুটিতে হইলো!

    একটি বালক প্রায় প্রতিদিনই শ্রেণীকক্ষে নানারূপ উৎপাত করিত। সহপাঠীদের জিনিস ছুঁড়িয়া, তাহাদের ঠেলা মারিয়া, চিমটি কাটিয়া তাহার কী সন্তোষ হইতো সেই জানে! সে ইদানিং বালিকাকে ধরিল। তাহার কলম ইত্যাদি কাড়িয়া লইতে লাগিল, চিমটি কাটিতে লাগিল, অবশেষে জলপানের বিরতিতে তাহাকে সহসা এমনই ধাক্কা মারিল যে, সে মুখ থুবড়াইয়া পড়িল, তাহার চশমা ভাঙিল, রক্তপাতও ঘটিল। কী মত অবস্থায় সে গৃহে ফিরিল সেই জানে! কাহাকে নালিশ করা তাহার স্বভাবে ছিলোনা, বন্ধু তাহার হয় নাই তেমন। কাজেই ঘটনার গুরুত্ব পরবর্তী পাঠদানরত শিক্ষকের কাছে ততটা পৌঁছাইলোনা কেবল দু একটি শিশুর অগোছাল বক্তব্যের মধ্য দিয়া। তাহাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হইলো মাত্র। মাতৃহৃদয় উদ্বেল হইলো। পরবর্তী বিপদের আশংকায় মাতা দৌড়াইলেন।

    দিন স্থির হইলো। বালিকার মাতা ও বালকের পিতামাতাকে ডাকিয়া মিটিং হইবে। বালকের পিতামাতা বালকসহ আসিয়া একটি "আহা" বলিয়াই পুত্র সন্তানটির 'পুরুষ সুলভ' নানান বীরত্বের নিদর্শন প্রছন্ন আত্মপ্রসাদ সহকারে বর্ণনা করিতে থাকিলো পুত্র সাক্ষাতেই। বালিকাকে আনিতে বলা হয় নাই বলিয়া মাতা আনেন নাই। বালক কেমনভাবে বিড়ালটির লাঙ্গুল ধরিয়া মোচড় দেয়, কেমন ভাবে ঠাকুরমার চশমাটি লুকাইয়া রাখে, কেমন ভাবে মাতার নতুন শাড়িটি কাঁচি দিয়া কাটিয়া ফালা ফালা করিয়াছে, কেমন ভাবেই বা পরিচারিকা টেবিলে খাইতে বসিতে যাইলে তাহার পশ্চাৎ হইতে চেয়ার খানি সরাইয়া লইয়া তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া দিয়াছে- আমোদের সহিত তাহারা বর্ণনা করিলো। গুটিকয় শিক্ষিকাও হরষের সহিত নিজ পুত্র সন্তানের প্রসঙ্গ তুলিয়া উক্ত আলোচনায় অংশ গ্রহণ করিল। কন্যা সন্তানরা উক্ত কার্যে অপারগ, তাই তাহাদের মাতারা বাঁচিয়া গিয়াছেন এমনও কেউ বলিলো। উক্ত কার্যগুলি করা ও না করার মধ্য দিয়া এক পক্ষের জয়, অন্যের প্রচ্ছন্ন পরাজয় এক রকম ভাবে ঘোষিতই হইয়া গেল বুঝি! কেহ বলিলনা, উক্ত আচরণ পুরুষ নারীর বিষয় নহে, উহাতে গৌরবও কিছু নাই। বালিকার মাতা পাথরের মত মুখ করিয়া তাহাই বলিয়া ফেলিলেন এবং উক্ত কার্যাবলিকে 'শাখামৃগ সদৃশ' বলিয়া মত প্রকাশ করিলেন। তাহাতে ভারী গোল বাধিল। বালকের পিতামাতা আরক্ত মুখে স্থান ত্যাগ করিলো। মাতা বসিয়া রহিল।

    কিয়ৎকাল পরে বালিকার মাতার ডাক পড়িল অধ্যক্ষার কক্ষে। তাঁহার পোশাক ও উপস্থিতি মুগ্ধকর ও ভক্তিশ্রদ্ধা উদ্রেককারী। মাতাকে সাদরে অভিবাদন পূর্বক আসন গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিয়া তিনি আর্দালিকে উভয়ের জন্য চা আনিতে আদেশ করিলেন। ইত্যবসরে তিনি বালিকার শরীর স্বাস্থ্য ইত্যাদির খবর লইতে লইতে তাহার পাঠে অমনোযোগিতা, শিক্ষক শিক্ষিকাদের সহিত বা নিজ শ্রেণীর অন্য শিশুদের সহিত কোনোরূপ আদান প্রদান না করার ঘটনার উল্লেখ করিলেন। সে যে আর এই বিদ্যানিকেতনের সাধারণ পাঠক্রম বেশিদিন অনুসরণ করিতে পারিবেনা-সেই বিষয়টিতে মায়ের বারংবার দৃষ্টি আকর্ষণ পূর্বক সবিশেষ উদ্বেগ ও সহানুভূতি প্রকাশ করিলেন। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বিদ্যালয়ের সন্ধান দিবার প্রতিশ্রুতিও দিলেন। মাতা কোনো কথা কহিলেননা। মাখাটি নাড়িয়া অভিবাদন পূর্বক বিদায় লইলেন। সে মাথা নাড়ার অর্থ সম্মতি ও অসম্মতি উভয়েই হইতে পারে। অধ্যক্ষার তাহাতে কোনো উৎসাহ নাই।

    মাতাটি হইতে কেহই বা আর অধিক জানিবে গৃহীত, সুচর্চিত ও প্রচারিত নিরাপত্তার বলয়টি ক্ষেত্রভেদে কেমন করিয়া কণ্ঠদেশে চাপিয়া বসো উক্ত ক্ষেত্রে অচেনা পথে পা না বাড়াইলে মুক্তি নাইা আজ তাহার কন্যাটির সেই মুক্তি দিবস সমাগত! সে মুক্তি উদ্বেগের নয়-উদযাপনের। ইহার পরে কী হইবে- তাহার উত্তর দিতে পারে একমাত্র মহাকাল!

    বিদ্যানিকেতনের প্রাচীর সংলগ্ন পায়ে হাঁটা পথখানি দিয়া মা চলিতেছিলেন নিকটবর্তী বাজারটির দিকে। অন্যান্যদিন আপিস ফেরৎ তাঁহার শহরতলির রেল স্টেশন সংলগ্ন সান্ধ্য বাজারটি হইতেই তিনি বাজার করেন। আজ ছুটি লইতে হইয়াছে, ঐদিকে যাইবার প্রয়োজন নাই, তাই কাজটি সারিয়া রাখিতেছেন দিবা ভাগেই। তাহা ছাড়া তিনি শুনিয়াছেন এই বাজারটিতে সফরী জাতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৎসের পাশাপাশি শম্বুক জাতীয় সেই ক্ষুদ্র জলজ প্রাণীও পাওয়া যায় যাহা চক্ষুজ্যোতি বর্ধনের পক্ষে সবিশেষ উপকারী। তিনি দ্বিতীয়টি অন্য কোথাও পান নাই। তাই আজ তৈয়ারি হইয়াই আসিয়াছেন।

    আনমনে হাঁটিতে হাঁটিতে অকস্মাৎ তিনি পথের অপর প্রান্তে সেই দুর্বিনীত বালকটিকে দেখিতে পাইলেন! একটি অপেক্ষারত মহার্ঘ্য মোটরগাড়ি হইতে মুখ বাড়াইয়া একটি গোলাপি রং এর আঠালো বস্তু মুখ হইতে টানিয়া বাহির করিতেছে আবার ঢুকাইয়া লইতেছে, ফুলাইতেছে বেলুনের ন্যায়। উক্ত অটঠ-বুদবুদ কন্যাও চায় মাঝে মধ্যে। বালকের পিতামাতাকে দেখিতে পাইলেননা। সারখিটি গাড়ির বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে; তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা একটি তেন্ডুবিটিকা ধরিয়া পথিপার্শ্ব পর্যবেক্ষন করিতে করিতে ধূম্রপান করিতেছে। তিনি বিস্মিতই হইলেন, উহারা এখনো যায় নাই!

    পরদিন রবিবার ছিল। তাহার পরদিন মহালয়া। ইস্তিওয়ালা আসিয়া দাঁড়াইলে বালিকা বাহির হইলো। কিয়ৎক্ষণ পর হাতের কাজ সারিয়া মাতা বাহির হইলেন অন্য কারণে। তিনি ইস্ত্রিওয়ালা হইতে ছাই সংগ্রহ করেন। বালিকার চক্ষুদুটি লইয়া চিন্তিত মাতার দৈনন্দিন কর্ম তালিকায় অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৎস কাটিয়া পরিস্কার করিয়া রন্ধন একটি নিত্য ও আবশ্যিক বিষয়। সারাদিনের কর্মক্লান্তি ও গৃহে অনেক্ষণ একাকী কন্যার চিন্তায় প্রথম কাজটি বাজার হইতেই পরিশ্রমিকের বিনিময়ে করাইয়া আনিবার সুযোগ তিনি পাননা। তাহা সময় সাপেক্ষ, যেহেতু উক্ত কার্যে অপেক্ষমান মানুষের সংখ্যা অত্যধিক। কার্যটি করিবার লোক গুটি কতক। অতিরিক্ত ব্যয়ের হিসাবটিও মাথায় রাখিতে হয়া নিজ সুবিধামত বাড়িতেই তিনি তাই কার্যটি করেন। উক্ত কার্যে হস্তে ছাই মাখিয়া লইলে সুবিধা হয়। তিনি ইস্ত্রিওয়ালাকে প্রতিবার পাঁচ টাকার একটি মুদ্রা বাড়াইয়া দেন উক্ত ছাই এর বিনিময় মূল্য ধরিয়া। প্রতিবারই সে বিনীত হাসিয়া সেটি প্রত্যাখ্যান করে। আজও তিনি বাহির হইয়াছেন ইস্ত্রিওয়ালাকে উহা আনিয়া দিবার কথা বলিবার জন্য।

    তিনি দেখিলেন বালিকা দাঁড়াইয়া রহিয়াছে আর ইস্ত্রিওয়ালা উবু হইয়া বসিয়া তাহার একটি হাত ধরিয়া অধর পার্শ্বের গভীর ক্ষতটি ভ্রু কুঁচকাইয়া দেখিতেছে। বালিকা তাহাকে কী যেন বলিয়া যাইতেছে। তিনি যাইতে ইস্ত্রিওয়ালা তাঁহার দিকে তাকাইয়া রহিল। নীরবতা ভাঙিতে গিয়া তিনি দেখিলেন নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়াই তিনি ইস্ত্রিওয়ালাকে সমুদয় বৃত্তান্ত বর্ণনা করিয়া যাইতেছেন আর সে মন দিয়া শুনিয়া যাইতেছো তাহার মনের ভাষা বুঝি তাহার পরিবর্তনশীল মুখভঙ্গিতেই ফুটিয়া উঠিতেছে! সব ভঙ্গির সহিত তিনি এ যাবৎ কাল পরিচিত হননি। কিছু তাহারা নতুনতর!

    উক্ত দিবসেই অপরাহ্নকালে বালিকাকে আবার পথে দেখা যাইলো। মাতাটি বুঝি নিদ্রিত, এক দিবসের বিশ্রাম পাইয়া। বালিকা ইস্ত্রিওয়ালার সকাশে যাইয়া আরো ছাই চাহিল। ইস্ত্রিওয়ালা বিস্মিত হইলো বুঝি! তথাপি দেখা যাইলো সে বালিকাকে হাসিয়া প্রশ্ন করিতেছে "কিতনি জ্যাদা মছলি খাতি হো তুম গুড়িয়া?" বালিকা হাসিতে হাসিতে দুই হস্ত দুই পার্শ্বে যত দূর সম্ভব প্রসারিত করিয়া বলিতেছে, "ইতনি.... জ্যাদা!" ইস্ত্রিওয়ালা চক্ষু বিস্ফোরিত করিয়া মস্তক নাড়িতে নাড়িতে জল নিরোধক মলিন দুইটি ছোট্ট থলি লইলো, ফেলিয়া দিবার জন্য রাখা ছাই এর গাদা হইতে কিয়ৎ খানিক তুলিয়া দিলো তাহাতে।

    বালিকা প্রশ্ন করিলো, তাহার আরো আরো লাগিলে সে দিতে পারিবে কিনা। ইস্ত্রিওয়ালা তাহার নমনীয় ও হেলানো ঘাড়খানি সহসা ঋজু ও কঠোর ভঙ্গিমায় তুলিয়া ধরিল! ফলত, ঘাড়ের উপর তাহার মস্তকটি, তাহার মুখমন্ডল পূর্ণ রূপে প্রতিভাত হইতে লাগিল। তাহার মরা মাছের মত দৃষ্টিটির জায়গায় এখন এক অন্য জ্যোতি যেন দেখা দিল! দৃঢ় কণ্ঠে সে কহিল, "আরওওও দুবো!" তাহার মুখের রেখাগুলিও দৃঢ় হইয়া উঠিল। তাহা দেখিয়া বালিকা যেন ভারী খুশী হইলো। সে ইস্ত্রিওয়ালার ভবিষ্যৎ লইয়া একটু নিশ্চিন্তও বুঝি হইলো!

    পথের লোক দেখিলো চুল উড়াইয়া, দুই হস্তে দুই ভস্ম থলি দুলাইতে দুলাইতে এক ক্ষুদ্রকায়া কৃষ্ণা নাচিতে হাসিতে, হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া চলিতেছে! তাহার হস্তের থলির ফাঁক দিয়া দুই পার্শে রেণু রেণু ভস্ম উড়িতেছে, তাহার খেয়াল নাহি।

    উৎসবের ঋতু মানুষকে উদার করে। তাই বুঝি জনা দুয়েক পরিচিত জন তাহার সহিত আলাপ করিতে আগাইয়া আসিলো। সে গুনগুন করিয়া কী এক সুর ভাঁজিতে ভাঁজিতে চলিয়া গেল। তাহাদের কথা শুনিতে পাইলো কি পাইলোনা বুঝা গেলোনা। বালিকা বধির নহে! সে পথিকরা খানিক অপ্রস্তুত বোধ করিল বুঝি, যাহা বালিকার প্রতি বিরূপতা আনিয়া দিল। অনুকম্পার শব্দ প্রয়োগে তাহারা তাহা প্রকাশ করিল।

    ইতিমধ্যে, কিছু পুরাতন বস্তুকে উৎসবের মরসুমে পরিধানের যোগ্য করিয়া তুলিবার বাসনায় যাহারা ইস্ত্রিওয়ালার সম্মুখে ভীড় জমাইলো, তাহাদেরও আজ যেন তাহাকে কিছুটা নতুন মানুষ ঠেকিল! কিন্তু কোন নব উপাদানে তাহার এ রূপ পরিবর্তন, তাহারা বুঝিয়া উঠিতে পারেনা! তাহাদের কেহ কেহ শারদ অপরাহ্নের মায়াবি আলোটিকেই এর উৎস বলিয়া মনে করিতে থাকিলা যাহারা দুই এক পয়সার দরদাম লইয়া বচসা করিত, চলিত দরের অপেক্ষা নিম্ন অর্থ ছুঁড়িয়া দিয়া চলিয়া আসিত- তাহারা আজ যেন তেমন মনের জোর সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেনা আরা ইস্ত্রিওয়ালার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ আজ বুঝি কিয়ৎ অধিক লাগে তাহাদের কাছে। তাহারাই যখন বুঝিয়া উঠিতে পারেনা, ইস্ত্রিওয়ালারও তাহা বুঝিবার কথা নহে।

    তথাপি, বালিকা ও ইস্ত্রিওয়ালা উভয়েই আজ এক অ-পূর্ব, অনাস্বাদিত আনন্দ উপভোগ করিতে লাগিলা তাহারা নিজেদের অজান্তেই এক ভস্ম আরতিতে মাতিয়া উঠিয়াছে! এই আরতিতে কে দেবতা আর কে বা ভক্ত- কাহার দেহভস্ম মাখিয়া কেই বা নাচিতেছে – তাহা স্থির করা মুশকিল!

    শিষ্টকে নিজেকেই বুঝি গা ঝাড়া দিয়া উঠিতে হয় নিজেকে রক্ষা করিতে। দুষ্টের দমনতো তাহার পরবর্তী স্তর! মহেশ্বর ও কালিকার হস্ত ধরিয়া মাঝেমধ্যে না নাচিয়া উঠিলে বিষ্ণুও নানান ব্যস্ততায় অনেক সময় তাঁহার কর্তব্য ভুলিয়া থাকেন!


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ১০ অক্টোবর ২০২৫ | ২৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন