উৎসবের অলংকরণ: রমিত
লেখার অলংকরণ: লেখকের
অরুণিমা যা দেখতে চেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন সেবার। সেবার, যেবার সুপ্রিয়রা তপোবন আশ্রমে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। আর সুপ্রিয় যা চায়নি তাও পেয়ে গিয়েছিল। হয়তোবা শম্ভুদাই ওর জন্যই তুলে রেখেছিলো সেসব। মরফির সূত্র ছত্রে ছত্রে মিলে গিয়েছিল।
রোমহর্ষক শ্রাবণ বয়ে যাচ্ছে আকাশ পথে। ঝিরঝিরে ময়লা আকাশ। আকাশের মেঘের খানিকটা দায়িত্ব ট্রেনের। সে ট্রেন এখন স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেছে। আর ওরা চললো বাহনের খোঁজে। স্টেশন ছাড়িয়ে রিকশা এসে যখন সওয়ারিদের নামিয়ে দিয়ে গেল, তখন ওদের দুধারে তালপাতার ছাউনি আর বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরী বস্তি। যানবাহনের সীমানা এই পর্যন্তই। দুধারে বেড়ে ওঠা পাথুরে বাড়ি আর মাঝ দিয়ে ঢালু পথ। ভরন্ত পাথরকুচি পাতার শিরা দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেন। তফাৎ শুধু মসৃণতার। এঁটেল মাটির কাদার ভেতর থেকে উঁচিয়ে আছে পাথরদের বিক্ষিপ্ত ইতিহাস। খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে এগোনো যায়। রাজর্ষি পড়ে যেতে যেতেও পড়ে গেলেন না। শুধু কালো টেরিলিনের কালো প্যান্টে খয়েরি ছোপ লেগেছিলো, পরের দিন পুকুরে কেচে ফেলার আগে পর্যন্ত।
তপোবনের চৌহোদ্দিতে ঢোকার গেট খুলতে হয়না। খোলাই থাকে। ডালপালা সরিয়ে বলতে গেলে বাঁ দিকেরটা বন্ধ আর ডান দিকেরটা অক্সিডাইজেশনের শিকার। রিটায়ার্ড ধাতব প্রহরীকে সম্মান জানিয়ে এগোতেই দূরে বিশাল বারান্দায় ওরা দেখতে পেল দিদা দাদু, মামাদের। প্রায় সব্বাই পুজোর জোগাড়ে ব্যস্ত। সুবিশাল বারান্দাকে মাটির কাছাকাছি এনেছে আবিল্ডিংলম্বিত সিঁড়ির প্রপাত। কাছাকাছি পৌঁছতেই ছুটে এলেন দিদা, "ওরে, তবে আসা হলো তোদের! গুরুদেব ডেকে এনেছেন তো, না এসে যাবি কোথায়!" প্রায় বিঘা চারেক উঁচু পাঁচিলে ঘেরা, অগুনতি গাছে ঢাকা, অযত্নে পড়ে থাকা চৌহদ্দির উত্তর ঘেঁষা এক প্রাচীন জমিদার সুলভ বাড়ি। এখানে-সেখানে পাতার ট্রাফিক ঠেলে আহত রোদ মাটিতে পড়ে আছে। হাওয়া দিলে ঠোকাঠুকি লাগে আলোয়-আলোয়। ব্যথা চকমক করে ওঠে। বেজি দৌড়ে যায়, কুবো পাখি নাচে-গায়। এবাড়ির আরো উত্তরে, উল্টো দিকের বারান্দার কোল থেকে উঠে গেছেন আকারে নাতি অথচ দৃঢ় এক গ্রানাইট বৃদ্ধ। তিনিই এদিককার প্রহরী। এঁর পিঠে চড়েই আশ্রমের তৃতীয় প্রজন্মের অতিথিদের বিকেলগুলো কাটবে আগামী কয়েকটা দিন। এই দৈর্ঘ্য থেকে গড়িয়ে পশ্চিমে নেমে গেলে পঞ্চমুন্ডি মায়ের মন্দির। আস্থার জগৎপটে অলৌকিক ও সিদ্ধিবহ। বাকি জায়গা জুড়ে সাপ, বিছে, শেয়াল, বেজি, খরগোশের সাথে মানুষের পূর্বপুরুষদেরও বাস। হুপ্ হুপ্।
বাড়ি থেকে পঞ্চমুন্ডি মায়ের মন্দির যাবার মাঝরাস্তার একপাশে এক প্রকান্ড কুঁয়ো। সেখানে এসে রূপক প্রায়-উদোম হয়ে গামছা পরে কপিকলের দড়ি জাপটে জল টানতে লাগলো। সুপ্রিয় ঝুঁকে দেখলো, জলের ওপর ও, কপিকল আর একটা ফ্যাকাশে নীল আকাশ একে অন্যের দিকে ভ্যাল ভ্যাল করে তাকিয়ে। বালতি নেমে আকাশ ছুঁয়ে দিলো। সুপ্রিয় মুখ ওপরে তোলার সাথে সাথেই রূপক দাদা ততক্ষনে ভেজা কাক। এবার সুপ্রিয়র পালা। "তোরা চলে এলি, আমাকে না ডেকে!" যে বললো সে জাতিতে লম্বা, সম্মানে শ্যামলা আর হাসিতে দোহারা। রূপক উত্তর দিলো, "আরে তোকেই খুঁজছিলাম তো, না পেয়ে চলে এলাম কুট্টুসকে নিয়ে, ওরা একটু আগেই এলো"। সুপ্রিয় সেই প্রথম দেখল শম্ভুকে। সে তখন জল টানতে লেগেছে। ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “দাঁড়া, তোর জন্য জল তুলে দি”। যেন জানত সুপ্রিয় আসবে আর ওদের দেখা হবে এই কুয়োর সামনে। বড্ড স্বাভাবিক। তিনজনে মিলে স্নানটান সারা হলে সুপ্রিয় আরেকবার ঝুঁকে দেখল সেই পাথুরে মাটিতে গাঁথা জমিদারি কুঁয়োর গুমোর এতটুকুনও কমেনি। যাকগে, তাতে ওদের কি!
পদ্ম পুকুরের ডান পাশে একটা ছোট্ট ক্ষত। সে আঘাত ওদের জলে নেমে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে। রূপকদারা জানতো। ওরা গত পরশু এসেছে। পুজোর আগে এই জলাশয় থেকেই ফুল নিয়ে যাবার রীতি। জলের ক্ষতে দেবতার আহ্বান। শম্ভুদার পায়ে ঠোক্কর খেয়ে গেল একটা জলঢোঁড়া, সুপ্রিয় স্পষ্ট দেখতে পেলো। দেখেও ডাকতে পারলোনা। সামনে, আকাশের ঠিক নিচে এবড়ো খেবড়ো ধূসর পাথরের শরীর। মাটির কাছাকাছি শেষ হয়ে এসে মাঠে সবুজ হয়ে জমে আছে। সেখানকার সবুজ কিছুটা চুঁয়ে এসে পড়েছে পুকুরের জলে। প্রেমে পড়ার অচুক মৌকা। জলঢোঁড়া সেটা বুঝবে না। শম্ভুদাও না। সুপ্রিয় খোদাকে ডাকার ভঙ্গিমায় হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা দুজন পদ্ম কেটে, ভেঙে সুপ্রিয়র খোলা দুহাত ভারী করে ফেললে তিনজনে ফিরে চললো। পেছনে পুকুরের ক্ষত আর পদ্মের ক্ষত একে অপরের সাথে ফিসফাস সেরে নিচ্ছিলো।
পাথরে পা রেখে রেখে সেই প্রথম ট্রেকিংয়ে পা। রূপকদা বলেছিলো দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে পেছনের টিলায় চড়বো। সুপ্রিয় সেই অপেক্ষায় ছিল। এখন ভয় লাগছে ওর। নিচে তাকানো বারণ। সুপ্রিয় বাধ্য ছেলে, তাকায়নি। ওর রিয়াদিদি ফার্স্ট, সুপ্রিয় আর রিয়াদির মধ্যে। এখানে এই উচ্চতায় বর্ষা ঋতুর স্বেদ ছড়িয়ে আছে বাতাসে। বৃষ্টি ঢেলে, মেঘ বয়ে ক্লান্ত সে এক ক্লান্ত অদ্ভুত মায়াকাল। সাথী আসেনি, পুজোর কিসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পা ঝুলিয়ে ঝাপসা সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা অনেকক্ষণ। এরকম স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলে সূর্য ধরা দেয় চোখে। তারপরে খেলা যায় তাকে নিয়ে। ভুলে যাওয়া যায় বয়ঃসন্ধি। নাঃ ভুল নয়, রিয়াদি সত্যিই চিৎকার করে ডাকছে। ফিরে দেখলাম, উঁচু ছাই পাথরটার ওদিক থেকে। শম্ভুদা, রূপকদা ছুটে এলো। ওদিকে দুটো ছেলে ছিলো, অন্য দিক দিয়ে উঠেছিল। মতলব বুঝতে পারার আগেই পালিয়েছে। দু-তিনটে কাঁচের বোতলের একটা কুড়িয়ে রূপকদা ব্যোমকেশের মত বললো, "হুম, পুরোনো!" যেখানে ফেললো তার পাশে একটা ঠেস দিয়ে বসার মত পাথরের খাঁজে লেখা "A+S"। বোঝা গেল এই বৃদ্ধের সওয়ারী একা আমরা না। এখান থেকে আশ্রমটা দেখা যায় না। তবু রিয়াদির আওয়াজ নীচ পর্যন্ত ভেসে গেলে বড় মামা হাঁক দিয়ে ডেকে নিলো রিয়াদিকে। রিয়ার সাথে সাথে সূর্য্যও নেমে গেলে পাথরের খাঁজে। রিয়াদি কার্মেলে পড়ে। পড়ে যাওয়া বিকেলের থেকে হাফ কিলোমিটার মত দূরে আরেকটা উঁচু টিলা। বেশ খাড়াই। ভোঁদা আঙ্গুল তুলে সুপ্রিয়কে দেখিয়ে বললো, "পারবি চড়তে?" উত্তরও নিজেই ঝুলিয়ে সাথে সাথে, "উঁহু পারবি না, আমার দাদা পারবে।" ঘটনাক্রমে দুই দাদার মাঝে বেট হয়ে গেলো, যে আগে চড়বে সে হেরোর কাছে পাবে পছন্দের অডিও ক্যাসেট। রূপকদার 'ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ', শম্ভুদার 'বেস্ট অফ লাকি আলী'। লাকি আলী! ‘ও সনম’? ‘দেখা হ্যা অ্যায়সে ভি’? ‘তেরে মেরে সাথ’? ..সে তো সুপ্রিয়রও! প্রতিযোগিতা-পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে তক্ষুনি সুপ্রিয় নিজেকেই দেখতে পেল। তরতর করে উঠে যাচ্ছে ও, ওপরে সাথীদি, হাতে লাকি আলীর ক্যাসেট নিয়ে দাঁড়িয়ে, 'অনজানি রাহো মে তু ক্যা ঢুঁন্ডতা ফিরে..'!
মশারীর ভেতরে আলো এসে ঢুকছে। বন্ধ চোখের পাতাও আলো আটকাতে পারছে না। অগত্যা ওদুটোকে খুলে সামনে তাকাতেই মানুষ-সমান জানালায় তিনটে হনুমান। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে হাজির। “ও মা, মাআআআ..” বলে দৌড় দিয়ে গিয়ে সুপ্রিয় দেখল, পেছনের হল ঘরে তার মাকে ঘিরে দিদা, মাসি, মামা-দের জটলা। কারো মুখে হাসি চোখে জল, কেউ তার মায়ের গায়ে হাত বোলাচ্ছে। ওদের চোখে-মুখে এক অলৌকিকের আভাস। "ও অরু, দ্যাখ তুই বলছিস আর আমার সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ওঃ ঠাকুর! কি পেলি রে তুই! অনেক পুণ্যের ফল" প্রায় সমস্বরে স্বগক্তি ভাসছিল। আখ্যানের অলৌকিক সূত্রপাত গতকাল রাতে। যে জানালার নাগাল থেকে সুপ্রিয়র পালিয়ে আসা, তার থেকে বিশ-পঁচিশ ফুট দূরত্বে এক গোলাকার পাথর। আকারে বয়ঃসন্ধি ছাড়িয়েছে, প্রকারে কোয়ার্টজাইট। সে বেড়ে চলে খানিক করে ভূগোলের খেয়ালে। আশ্রমের পরিবেশে অবশ্যই অতিলৌকিক। তার ওপরেই ভোরের আলো ফোটার আগে মায়ের মহিমান্বিত এক আলোর দর্শন। সেই আর্য-আলো বিরল। অতএব ভাগ্যবঞ্চিত অরুণিমার সৌভাগ্যবতীতে রূপান্তর। আলো সুদূর থেকে আসে। আমাদের ছোটবেলা, যৌবনবেলা পার করে। আমাদের আচরণ-সংস্কৃতি ধার করে। আমাদের মজ্জা, আমাদের এমিগডালার মধ্যে দিয়ে। এতটা পথ এসে হাঁপিয়ে পড়ে, বিশ্রাম নেয় আমাদেরই চোখের সামনে। দেখা দেয় যখন, অচেনা লাগে, হয়ে ওঠে লীলাময়। কারো কিচ্ছু যায় আসে না, কেউ-কেউ আস্থায় ভেসে যায়। সাথীদি এসে সুপ্রিয়কে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মুখ ধুয়েছিস? চা খাবি?” ও বললো, “না”।
কুমারী পূজা, কুমার পূজা, অতিথি আপ্যায়ন, খিচুড়ী ভোগ সহ দৈনিক তিনবেলা পূজার সারাদিনের পার্বণ শেষ। ধূপ-ধুনোর গন্ধ তবু লেগে আছে চুন-সুরকি -কড়িকাঠে। পুজোর ঘরে প্রদীপের আলোর পাশে শ্যামাপোকারাও ঘুমিয়ে পড়েছে। এবাড়ীর না-পতঙ্গরা এখন সবাই মশারী গোঁজায় ব্যস্ত। সবার আগে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিতে হয় ভেতরে অবাঞ্ছিত কারুর প্রবেশ ঘটেছে কিনা, তারপর নিশ্চিন্দি। এই সময়ে হঠাৎ হুলুস্থুল, মহাভারত। বাইরের হলঘরে, বারান্দায় দাপাদাপি, হুংকার। রিয়াদি কোত্থেকে যেন ছুটে এল, সুপ্রিয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “চুপ করে থাক”। তবু দিদার আর্তনাদ শুনে ঠিক থাকতে পারল না। বাথরুমের পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখল পরেশদা দিদাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। হ্যাজাক নিভে গেছে অনেকক্ষন, বাইরের যতটুকু আলো পুজোর ঘরের বড় প্রদীপ থেকে আসছে। সুপ্রিয়র পাশে এসে রিয়াদিও উঁকি দিলো। এর মাঝে কখন বারান্দার ডান পাশের ঘর থেকে সাথীদি ছুটে এল দিদাকে তুলতে। সাথীদির ভাল নাম কি যেন, চেতনা না অসীমা! পরেশদা খপ্ করে ধরল সাথীর হাত। সাথী ভয়ে সাদা। পরেশ এখন প্রায় জ্যান্ত শয়তান। লাল চোখ, গায়ে যেন মোষের শক্তি। এই সময়ে আগের দিনের অব্যবহৃত হুড়কোটা পড়ল পরেশের হাতে। শম্ভু। প্রত্যাশিত হিরোর মত এন্ট্রি। সুপ্রিয় শঙ্খনাদ শুনতে পেল ওর সিনেমাঘরে। রূপক, ভোম্বল মামা, সুপ্রিয়র বাবা রাজর্ষি, গেলু মামা ছুটে গেল পরেশকে কাবু করতে। জানি দুশমন সিনেমার দানবকে হার মানাচ্ছিল পরেশ। অবশেষে একটা দড়ির খাটিয়ায় হাত-পা বাঁধা হল। দিদাকে তুলে নিয়ে গেছে সাথী, শুশ্রূষা চলছে। “একি সাথীদি, তোমার হাত !” ওঘরে গিয়েই সুপ্রিয়র চোখে পড়ল, হাতের রক্ত আর চিরে যাওয়ার দাগ। ও ছুটল মগে করে জল আনতে। সেও হিরো হবে, নিরীহ। বাসী মুখের ভারী হাওয়ায় আর কলগেটের ঠান্ডায় ভোরের পালাবদলের ফাঁকে সুপ্রিয় দেখলো খাটিয়ায় বাঁধা হাত পা মানুষ সব যেন বিশ্বাসঘাতকের মত পলাতক। ছুটে গেট পেরোলে দেখা যাবে কি, পরেশদা এখন একটা জ্যালেজেলে সকাল হয়ে মোড়ের স্থূলকোণ ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে!
কাদা সামলাচ্ছিল সুপ্রিয়, এই রাস্তায় মাড-স্কিয়িং উচিত স্পোর্টস। উইলি ওয়াঙ্কার ফ্যাক্টরী এখানেই ছিল এককালে। এখন সব চকোলেট গলে রাস্তা তৈরি করেছে। একটু আগেই তুমুল বৃষ্টি হল, জলে জলে সাদা হয়ে গেছিল চারপাশ। ওদের এক্সপিডিশনের দেরি হয়ে গেল তাই। রাস্তার বাঁ পাশে বড় বড় পুটুস ফুলের ঝোপ, তাদের মাঝে ভাঁট ফুল ডালপালা ছড়াচ্ছে। ঝোপগুলো আস্কারা পাচ্ছে ওদের পেছনে নীলচে আভা গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলোর ভরসায়। ডান দিকে স্কেচ পেনে ক্ষেত আঁকা রয়েছে। আঁকার হাত বেশ ভালো, প্রাণবন্ত লাগছে। "কালকের কেসটা জানিস?" শম্ভুকে জিজ্ঞেস করলো রূপক। "ভর এসেছিলো?" সন্ধ্যা পুটুস ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে বেশ যাচ্ছিলো, গতকালের প্রসঙ্গ শুনতেই কৌতূহল আটকাতে পারলো না। সাথী এসেছে এই সন্ধ্যাদের সাথেই। দুজনার বাড়ী পাশাপাশি। ওরা বন্ধু কাম পাশের বাড়ীতুতো বোন। আশ্রম-পুজো পার্বন শুনে সাথীর বাড়ি থেকে আর না করেনি। "হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই" শম্ভুদা চোখ টিপে দিল। রিয়া ওর কাদায় চিটে যাওয়া চটি ছাড়িয়ে নিচ্ছিলো, কিন্তু রূপককে ছাড়লো না, "এই দাদাভাই বল, কি হয়েছিল রে? আমরা সবাই কিন্তু বড় হয়ে গেছি। কুট্টুস আর ভোঁদা কাউকে কিছু বলবে না, কি রে বলবি না তো?" "আমি বলবো না, ওর কথা জানি না" ভোঁদা বলতে বলতে কাদায় পাথর ছুঁড়লো, কাদা ছিটিয়ে লাগলো সুপ্রিয়র পায়ে। "তোরা এরকম করলে বাড়িতে রেখে দিয়ে আসবো" রিয়াদি ধমক দিয়েই আবার হাঁক দিলো "দাদাভাই..!"। দুই দাদা আর সাথী পাশাপাশি হাঁটছিলো। উত্তর এলো, "চল গিয়ে বলছি।" ক্ষেতের মাঝে আবার এক কুঁয়ো, বয়সে নবীন। এর জল নাকি বিখ্যাত। পাথরও হজম হয়ে যায়। ওরা সবাই সেই জল খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেল্ল। আর খিদে পাচ্ছে না। এইখান থেকে আর কাদা নেই। এই যে আদুড় সবুজ ঘাস, ছেলে মেয়েগুলোর অস্তিত্ত্বে সামিল হতে লাগলো ক্রমশ। সেলুলোজ মাড়িয়ে শালপাহাড়ের দেখা পেল ওরা শেষে। "পরেশ ড্রাগ এডিক্ট, রবীনদা চেষ্টা করছিল ওকে সারানোর"। শম্ভুদার কাছে এই চমকে দেওয়া তথ্য শোনার আগেই ওরা চড়ে বসেছে শালপাহাড়ের অর্ধেক। এলাকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। আরেকটু ওপরে উঠলেই রঙিন ম্যাপ হয়ে যাবে চারপাশ। উত্তরে রেলস্টেশন, উত্তর-পূর্বে আশ্রম, দক্ষিণে রাজ্যের সীমানা, পশ্চিমে কিছু এলোমেলো ছেলে-মেয়ে যেন লোকালয়ে আর ফিরবে না ভেবেই জড়ো হয়েছে। "দাদাআ.., আমার হিসি পেয়েছে।" ভোঁদার হাত ধরে শম্ভুদা আড়াল দেখিয়ে দিয়ে এলো। "তারপর.." সাথী জলের বোতলটা এগিয়ে দিলো। "সেরেই উঠছিলো জানিস", রূপক যোগ দিলো, "শুনলাম প্রায় মাস দুয়েক সারভাইভ করেছিলো নেশাভাঙ ছাড়াই, তারপর গতকাল হঠাৎ।" সন্ধ্যার কাছে এতক্ষনে যত পুটুস ফুল জমেছিলো সব খাদের দিকে উড়িয়ে দিল। নিচের থেকে, বহু নিচের থেকে হাওয়া এলো। পাহাড়ের হাওয়ায় সেকয়েকটা হলুদ-বেগুনী ফুল সন্ধ্যাদির সালোয়ার ছুঁয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে পড়লো। "ভোঁদা কোথায় গেলো?" বলে সন্ধ্যা যাকে খুঁজতে চলে গেলো, সে ভোঁদা নয় অবশ্যই। রিয়া দেখলো হাওয়ার টানে সন্ধ্যার ওড়না শাল গাছের ডালে ডালে কিসব বলে যাচ্ছে দিয়ে যাচ্ছে। ওড়নায় ঢাকছে পাতা, সরে যাচ্ছে, আর কাঁধ নেড়ে সায় দিচ্ছে পাতারা। রিয়াও সঙ্গ নিলো। "কি হলো?" রূপক অবাক। "কিছু না", সাথী শান্তভাবে জবাব দিলো। এখন এখানে সুপ্রিয়, সাথী আর শম্ভু। রূপক আরো একটু নিচে যেখানে জল জমে আয়না হয়েছে সেখানে গুহা খুঁজতে গেল। সুপ্রিয় দেখলো রূপকদাকে আগলে রেখেছে আসেপাশে উড়ে বেড়ানো সাদা-হলুদ প্রজাপতিরা। বৃষ্টি আসার আগে আলো বাতাসের স্তরে সাদা কার্পেট সাজিয়ে আপ্যায়নের তরিবত শুরু হয়েছে। প্রায় অদৃশ্য অগুনতি জলকনায় সূর্য শান্ত হয়ে এসেছে অনেক। খানিক আগের ঝকমকে ল্যান্ডস্কেপ এখন প্যাস্টেল রঙের। কেউ নেই ক্ষেতে-জমিতে। শস্যদের খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে অভিভাবকরা চলে গেছে আকাশের হাতে ছেড়ে। মাঝে মাঝে ক্ষেতের ওপর দিয়ে কালো কালো ছায়ারা ভেসে যাচ্ছে, দৃশ্যমান হচ্ছে আর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। "এই সময়ে কোন গান মনে পড়ছে বলতো?" শম্ভুদার অশরীরী প্রশ্নের সুপ্রিয় উত্তর দিলো, "অশোকা সিনেমার বাঁশি, ওই যে থিম ইন্সট্রুমেন্টালটা, শুনেছো তুমি?" "আরে, তোর সাথে তো খুব জমবে আমার! আমিও তো ওটার কথাই ভাবছিলাম, সন্দীপ চৌটা কি অসাধারণ বাজিয়েছেন বল, ওটাতে অনু মালিকের কোনো হাত নেই।" আর কিছুই বলার ছিল না। সুরটা দুজনেরই মাথায় ভাসতে লাগলো। ওদের মাথা থেকে বেরিয়ে সাথীকেও ছুঁয়ে যাচ্ছিলো হয়তোবা। তিনজনে এখন বৃষ্টির অপেক্ষায়। সাথী খোঁপাটা খুলে দিল।
সুপ্রিয় ওর মাকে বলেছিল, শম্ভুদার সাথে একবার কথা বলবে। "ওদের ফোন নাম্বারই তো আমার কাছে নেই রে, কি করে বলবি?" অরুণিমা নিরুপায়। এখন সুপ্রিয়র কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। মাসির গিফট। লাকি আলীর ক্যাসেট কেনার আগে শম্ভুদার সাজেশনটা খুব জরুরি। "দাঁড়া দেখবো, ভোম্বলকে বলে, ওর কাছে পাওয়া যাবে।" আশ্বাস পেল মায়ের কাছে। পাহাড়ে ভেজার পর মাস চারেক পেরিয়ে গেছে। ওরা কথা রাখতে পারেনি। ফিরে গিয়েছিল আশ্রমে, ফিরে এসেছিল নিজের নিজের বাড়ি। বেরোনোর আগে সাথীদির দেওয়া একটা কাগজ শম্ভুদার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েওছিল। পরে, আপাত সময় ব্যায়ের শেষে বুঝেছিল এসব ক্লিশে, 'বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবে কী, সে?'। শেষ দিনের পরীক্ষা দিয়ে ফিরেই কৈলাশ খেরের 'আল্লা কে বন্দে' চালাচ্ছিল সজোরে। অরুণিমা এসে একটা ইনল্যান্ড চিঠি দিলো সুপ্রিয়র হাতে। গেলু মামার পাঠানো। শম্ভুদা নেই, বাস্তবে আর নেই। হেপাটাইটিস বি নিয়ে নার্সিং হোমে গেছিলো আর ফেরেনি। পারলৌকিক কাজে যেতে লিখেছে ওদের। "বাদলোঁ কি গেহরাই মে, শুনেছিস? শুনবি, ওর পপুলার গানগুলোর চেয়ে অন্যগুলো অনেক অন্যরকম", সুযোগ পেলেই সুপ্রিয়কে হিন্দি পপ কৃষ্টির সৃষ্টি রহস্য বোঝাতে ছাড়তোনা শম্ভুদা। বাঁ হাতে ঘন করে লাল তাগা বাঁধা। সেই হাত এখনও চোখ বুজলেই নিস্পৃহে সুপ্রিয়র হাত থেকে সাথীর দেওয়া কাগজটা চেয়ে নেয়, যখন-তখন। "হ্যাঁরে, কিছু করতে পারলি না!" চিঠিতে নাম্বার দেওয়া ছিল। মা কাঁদছিলো আর ঘুলিয়ে যাচ্ছিলো ডায়ালটোন। ফের রিং, "আয় ভোঁদার সাথে কথা বলবি।" চোখ মুছতে মুছতে ডাকলো অরুণিমা। রিসিভারের দিকে এক পলক তাকিয়ে, সুপ্রিয় ছুটল ছাদের দিকে। কার্নিশের ধারে গিয়ে বসে হাঁপালো খানিক। ম্যাজমেজে সূর্য হেলে আছে। কংক্রিটের এই বিন্যাসে সুখী দুঃখী পাহাড় নেই, অভিমানী ক্ষেত-শস্য নেই, অনবদ্য সেলুলোজ নেই, অকারী-ইয়েলো গ্রানাইট নেই। মাথায় বাঁশির সুর আছে নেপথ্যে। শম্ভুদাই এনে দিয়েছে হয়তো। আচ্ছা, সাথীদিকে কেউ জানিয়েছে?