এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  ইস্পেশাল

  • শালপাহাড়ের গান

    সুমন মুখার্জী
    ইস্পেশাল | উৎসব | ০৩ অক্টোবর ২০২৫ | ৭৬ বার পঠিত
  • উৎসবের অলংকরণ: রমিত 

    লেখার অলংকরণ: লেখকের



    অরুণিমা যা দেখতে চেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন সেবার। সেবার, যেবার সুপ্রিয়রা তপোবন আশ্রমে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। আর সুপ্রিয় যা চায়নি তাও পেয়ে গিয়েছিল। হয়তোবা শম্ভুদাই ওর জন্যই তুলে রেখেছিলো সেসব। মরফির সূত্র ছত্রে ছত্রে মিলে গিয়েছিল।

    রোমহর্ষক শ্রাবণ বয়ে যাচ্ছে আকাশ পথে। ঝিরঝিরে ময়লা আকাশ। আকাশের মেঘের খানিকটা দায়িত্ব ট্রেনের। সে ট্রেন এখন স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেছে। আর ওরা চললো বাহনের খোঁজে। স্টেশন ছাড়িয়ে রিকশা এসে যখন সওয়ারিদের নামিয়ে দিয়ে গেল, তখন ওদের দুধারে তালপাতার ছাউনি আর বড় বড় পাথর দিয়ে তৈরী বস্তি। যানবাহনের সীমানা এই পর্যন্তই। দুধারে বেড়ে ওঠা পাথুরে বাড়ি আর মাঝ দিয়ে ঢালু পথ। ভরন্ত পাথরকুচি পাতার শিরা দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেন। তফাৎ শুধু মসৃণতার। এঁটেল মাটির কাদার ভেতর থেকে উঁচিয়ে আছে পাথরদের বিক্ষিপ্ত ইতিহাস। খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে এগোনো যায়। রাজর্ষি পড়ে যেতে যেতেও পড়ে গেলেন না। শুধু কালো টেরিলিনের কালো প্যান্টে খয়েরি ছোপ লেগেছিলো, পরের দিন পুকুরে কেচে ফেলার আগে পর্যন্ত।



    তপোবনের চৌহোদ্দিতে ঢোকার গেট খুলতে হয়না। খোলাই থাকে। ডালপালা সরিয়ে বলতে গেলে বাঁ দিকেরটা বন্ধ আর ডান দিকেরটা অক্সিডাইজেশনের শিকার। রিটায়ার্ড ধাতব প্রহরীকে সম্মান জানিয়ে এগোতেই দূরে বিশাল বারান্দায় ওরা দেখতে পেল দিদা দাদু, মামাদের। প্রায় সব্বাই পুজোর জোগাড়ে ব্যস্ত। সুবিশাল বারান্দাকে মাটির কাছাকাছি এনেছে আবিল্ডিংলম্বিত সিঁড়ির প্রপাত। কাছাকাছি পৌঁছতেই ছুটে এলেন দিদা, "ওরে, তবে আসা হলো তোদের! গুরুদেব ডেকে এনেছেন তো, না এসে যাবি কোথায়!" প্রায় বিঘা চারেক উঁচু পাঁচিলে ঘেরা, অগুনতি গাছে ঢাকা, অযত্নে পড়ে থাকা চৌহদ্দির উত্তর ঘেঁষা এক প্রাচীন জমিদার সুলভ বাড়ি। এখানে-সেখানে পাতার ট্রাফিক ঠেলে আহত রোদ মাটিতে পড়ে আছে। হাওয়া দিলে ঠোকাঠুকি লাগে আলোয়-আলোয়। ব্যথা চকমক করে ওঠে। বেজি দৌড়ে যায়, কুবো পাখি নাচে-গায়। এবাড়ির আরো উত্তরে, উল্টো দিকের বারান্দার কোল থেকে উঠে গেছেন আকারে নাতি অথচ দৃঢ় এক গ্রানাইট বৃদ্ধ। তিনিই এদিককার প্রহরী। এঁর পিঠে চড়েই আশ্রমের তৃতীয় প্রজন্মের অতিথিদের বিকেলগুলো কাটবে আগামী কয়েকটা দিন। এই দৈর্ঘ্য থেকে গড়িয়ে পশ্চিমে নেমে গেলে পঞ্চমুন্ডি মায়ের মন্দির। আস্থার জগৎপটে অলৌকিক ও সিদ্ধিবহ। বাকি জায়গা জুড়ে সাপ, বিছে, শেয়াল, বেজি, খরগোশের সাথে মানুষের পূর্বপুরুষদেরও বাস। হুপ্ হুপ্।



    উঠোন-আপ্যায়ন শেষ হবার পর বড়মামার সাথে থাকার আয়োজন শিখতে যাওয়া হল সপরিবার। শিখতে সময় লাগেনা। পুজোর ঘর আর একমাত্র বাথরুম বাদ দিলে পড়ে থাকে আরো চারটে আস্তানা। একটা গুরুমায়ের। আর বাকি তিনটেতে মিলিয়ে-মিশিয়ে ঠাঁই সবার। বাথরুম একটাই, তাই মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। রান্নার ঠাকুররা গ্রাম থেকেই আসে আর চলে যায় কাজ শেষে। ব্যাগপত্তর রাখা হলে রূপক দাদার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল সুপ্রিয়। হলঘর পেরিয়ে বাঁ দিকের ঘরে মাসি দিদাদের প্রণাম করতে ঢুকেই ওর চোখে পড়ল রাজরানীসুলভ গাঢ় মেহগনি খাট থেকে এক মাথা চুল ঝর্ণার মত বেয়ে লাল সিমেন্টের মেঝে ছুঁয়ে আছে। তারপরে গড়িয়ে গড়িয়ে তৈরী করছে খাটের তলার গুচ্ছ অন্ধকার। হঠাৎ পেছন থেকে রুনু মাসি ধমকে উঠলো, "সাথী ওঠ, চুল বাঁধ, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, আর কতকক্ষন চুল খুলে রাখবি!" সেই ঝর্ণার মালকিন তখন, "আমার চুল এখনো ভিজে যে" বলতে বলতে খাট থেকে উঠে দিব্যি বাইরে উঠোনের দিকে চলে গেলো। আর সুপ্রিয়’র চোখদুটোও সঙ্গী হলো। কিন্তু বক্ররেখায় ততক্ষনে রিয়া দিদির আবির্ভাব, "আরে এসে গেছিস! আয় আয়.." এরপর সবার প্রণাম নেবার আর গাল টানিয়েটুনিয়ে একশা হবার পালা চললো খানিকক্ষণ। ভাগ্যিস রূপক দাদা এসে উদ্ধার করলো, "ওরে কখন এলি? চল ব্বেটা চান করতে যাচ্ছি, তুইও চল।" বলেই হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো।

    বাড়ি থেকে পঞ্চমুন্ডি মায়ের মন্দির যাবার মাঝরাস্তার একপাশে এক প্রকান্ড কুঁয়ো। সেখানে এসে রূপক প্রায়-উদোম হয়ে গামছা পরে কপিকলের দড়ি জাপটে জল টানতে লাগলো। সুপ্রিয় ঝুঁকে দেখলো, জলের ওপর ও, কপিকল আর একটা ফ্যাকাশে নীল আকাশ একে অন্যের দিকে ভ্যাল ভ্যাল করে তাকিয়ে। বালতি নেমে আকাশ ছুঁয়ে দিলো। সুপ্রিয় মুখ ওপরে তোলার সাথে সাথেই রূপক দাদা ততক্ষনে ভেজা কাক। এবার সুপ্রিয়র পালা। "তোরা চলে এলি, আমাকে না ডেকে!" যে বললো সে জাতিতে লম্বা, সম্মানে শ্যামলা আর হাসিতে দোহারা। রূপক উত্তর দিলো, "আরে তোকেই খুঁজছিলাম তো, না পেয়ে চলে এলাম কুট্টুসকে নিয়ে, ওরা একটু আগেই এলো"। সুপ্রিয় সেই প্রথম দেখল শম্ভুকে। সে তখন জল টানতে লেগেছে। ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “দাঁড়া, তোর জন্য জল তুলে দি”। যেন জানত সুপ্রিয় আসবে আর ওদের দেখা হবে এই কুয়োর সামনে। বড্ড স্বাভাবিক। তিনজনে মিলে স্নানটান সারা হলে সুপ্রিয় আরেকবার ঝুঁকে দেখল সেই পাথুরে মাটিতে গাঁথা জমিদারি কুঁয়োর গুমোর এতটুকুনও কমেনি। যাকগে, তাতে ওদের কি!



    হ্যাজাক একটা আলো নয়, অনুভূতি। উত্তাপ পেলে তীব্র হয়। কেউ কি বলেছিলো আগে? নাঃ কেউ বলেনি। এখানে, এই বারান্দায় হ্যাজকের অনুভূতির উত্তাপ যতদূর, ঠিক ততদূর চোখ যায়। তার ওপারে কিছু নেই। নাঃ সত্যি কিছু নেই। আছে বারান্দার বাসিন্দারা, হ্যাজকের কাছেপাছে। কীর্তন, রামপ্রসাদী, সব চলছে একের পর এক। গেলুমামা মানে শম্ভুদার বাবা গলা খেলিয়ে সন্ধ্যেটাকে বড় করছে। সুপ্রিয় ওর মায়ের পেছনে অল্প ছায়ায় লুকিয়ে সাথীদিকে দেখছে। সাথীদির এখন বিনুনি, খুলে রাখেনি। অন্ধকারকে শাসনে রাখার অভিপ্রায়। এই বন্দোবস্তে সুপ্রিয় একটু রাগ হচ্ছে, পেটের নিচে, আরেকটু বেশি নিচে অচেনা চিন্ চিন্। কয়েকদিন আগে সেজকাকুর বিছানা ঝাড়ার সাথে সাথে ঝরে পড়েছিল একটা দুর্বল বই। ভেতরে ছোট-বড় গল্প, গল্পে কবির প্রেমিকা ফরেস্ট বাংলোয়, অফিসারের বিছানায়। সেখানে জানলা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ হামলে পড়ছিল নগ্ন তার শরীরে। সেখানে পূর্ণিমা, এখানে অন্ধকার, দুইই খারাপ। "কইগো, অরুদি, এবার ধরো" শুনেই অপরাধীর দশা সুপ্রিয়র। নাঃ ওকে নয়, মামারা মাকে গান ধরতে বলছে অরুণিমাকে, সুপ্রিয়র মাকে। "আমি দুচোখ ভরে ভুবন দেখি, মায়ের দেখা পাইনা.." গেয়ে উঠতেই, গুরুমা বলে উঠলেন "আঃ, অরু, তোর গলাটা এখনও বড় সুন্দর।" হ্যাঁ, সুপ্রিয়ও জানে মাকে দেখতে অনেকটা হেমা মালিনীর মত, আর গলাটা লতা মঙ্গেশকরের। বিয়ের আগে স্টেজে গাইতে উঠলে অরুণিমা এই মুগ্ধতা বারবার পেতেন। এখন সবার চোখ অরুণিমার দিকে তাই সুপ্রিয় ওর অবাধ্য নজরকে শাসন করে নিয়ে গেল বাইরের লোহার গেট পেরিয়ে, পদ্ম পুকুর পেরিয়ে। দিগন্তের সরলরেখায় পাহাড়ের অবয়ব তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো প্যারিয়েটাল লোব। গান যখন থামলো, রুটি-আলুপোস্ত আর বোঁদের রাত শেষ হয়নি তখনও। রূপকদা, শম্ভুদা, কৌস্তভ, শম্ভুদার ভাই ভোঁদা, সরোজ কাকা আর ড্রাইভারদাদা সন্তোষ চৌহদ্দি পেরিয়ে জলবিয়োগ সারতে গেল, সঙ্গে সুপ্রিয়। সেরে আসার পথে রূপকদার চোখ পড়ল যেটায় সেটা নাকি জাত-গোখরোর খোলস। বনজ-রেশম দিয়ে অনবদ্য এমব্রয়ডারির কাজ, ব্যবহারে মলিন হয়ে গিয়েছে শুধু। সাপের জাত বিচার অবশ্য আবিষ্কারকের দাবির কৌলিন্য। “ফেলে যাওয়া জামার দাবীদার আসে-পাশে আছেন কি?” ভোঁদার অকস্মাৎ জিজ্ঞাসায় সবাই পেছন ফিরে দেখল সে ঝোপের মধ্যে মালিক খোঁজায় তৎপর। আর থাকে কেউ! দৌড় থামলো বারান্দার ওপরে গিয়ে। শেষমেশ দাবীদারের জাত-কুল বিতর্ক জমে শিশির হবার আগেই সেদিনের মত রাতের ছুটি।

    পদ্ম পুকুরের ডান পাশে একটা ছোট্ট ক্ষত। সে আঘাত ওদের জলে নেমে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে। রূপকদারা জানতো। ওরা গত পরশু এসেছে। পুজোর আগে এই জলাশয় থেকেই ফুল নিয়ে যাবার রীতি। জলের ক্ষতে দেবতার আহ্বান। শম্ভুদার পায়ে ঠোক্কর খেয়ে গেল একটা জলঢোঁড়া, সুপ্রিয় স্পষ্ট দেখতে পেলো। দেখেও ডাকতে পারলোনা। সামনে, আকাশের ঠিক নিচে এবড়ো খেবড়ো ধূসর পাথরের শরীর। মাটির কাছাকাছি শেষ হয়ে এসে মাঠে সবুজ হয়ে জমে আছে। সেখানকার সবুজ কিছুটা চুঁয়ে এসে পড়েছে পুকুরের জলে। প্রেমে পড়ার অচুক মৌকা। জলঢোঁড়া সেটা বুঝবে না। শম্ভুদাও না। সুপ্রিয় খোদাকে ডাকার ভঙ্গিমায় হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা দুজন পদ্ম কেটে, ভেঙে সুপ্রিয়র খোলা দুহাত ভারী করে ফেললে তিনজনে ফিরে চললো। পেছনে পুকুরের ক্ষত আর পদ্মের ক্ষত একে অপরের সাথে ফিসফাস সেরে নিচ্ছিলো।



    পাথরে পা রেখে রেখে সেই প্রথম ট্রেকিংয়ে পা। রূপকদা বলেছিলো দুপুরের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে পেছনের টিলায় চড়বো। সুপ্রিয় সেই অপেক্ষায় ছিল। এখন ভয় লাগছে ওর। নিচে তাকানো বারণ। সুপ্রিয় বাধ্য ছেলে, তাকায়নি। ওর রিয়াদিদি ফার্স্ট, সুপ্রিয় আর রিয়াদির মধ্যে। এখানে এই উচ্চতায় বর্ষা ঋতুর স্বেদ ছড়িয়ে আছে বাতাসে। বৃষ্টি ঢেলে, মেঘ বয়ে ক্লান্ত সে এক ক্লান্ত অদ্ভুত মায়াকাল। সাথী আসেনি, পুজোর কিসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পা ঝুলিয়ে ঝাপসা সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা অনেকক্ষণ। এরকম স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলে সূর্য ধরা দেয় চোখে। তারপরে খেলা যায় তাকে নিয়ে। ভুলে যাওয়া যায় বয়ঃসন্ধি। নাঃ ভুল নয়, রিয়াদি সত্যিই চিৎকার করে ডাকছে। ফিরে দেখলাম, উঁচু ছাই পাথরটার ওদিক থেকে। শম্ভুদা, রূপকদা ছুটে এলো। ওদিকে দুটো ছেলে ছিলো, অন্য দিক দিয়ে উঠেছিল। মতলব বুঝতে পারার আগেই পালিয়েছে। দু-তিনটে কাঁচের বোতলের একটা কুড়িয়ে রূপকদা ব্যোমকেশের মত বললো, "হুম, পুরোনো!" যেখানে ফেললো তার পাশে একটা ঠেস দিয়ে বসার মত পাথরের খাঁজে লেখা "A+S"। বোঝা গেল এই বৃদ্ধের সওয়ারী একা আমরা না। এখান থেকে আশ্রমটা দেখা যায় না। তবু রিয়াদির আওয়াজ নীচ পর্যন্ত ভেসে গেলে বড় মামা হাঁক দিয়ে ডেকে নিলো রিয়াদিকে। রিয়ার সাথে সাথে সূর্য্যও নেমে গেলে পাথরের খাঁজে। রিয়াদি কার্মেলে পড়ে। পড়ে যাওয়া বিকেলের থেকে হাফ কিলোমিটার মত দূরে আরেকটা উঁচু টিলা। বেশ খাড়াই। ভোঁদা আঙ্গুল তুলে সুপ্রিয়কে দেখিয়ে বললো, "পারবি চড়তে?" উত্তরও নিজেই ঝুলিয়ে সাথে সাথে, "উঁহু পারবি না, আমার দাদা পারবে।" ঘটনাক্রমে দুই দাদার মাঝে বেট হয়ে গেলো, যে আগে চড়বে সে হেরোর কাছে পাবে পছন্দের অডিও ক্যাসেট। রূপকদার 'ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ', শম্ভুদার 'বেস্ট অফ লাকি আলী'। লাকি আলী! ‘ও সনম’? ‘দেখা হ্যা অ্যায়সে ভি’? ‘তেরে মেরে সাথ’? ..সে তো সুপ্রিয়রও! প্রতিযোগিতা-পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে তক্ষুনি সুপ্রিয় নিজেকেই দেখতে পেল। তরতর করে উঠে যাচ্ছে ও, ওপরে সাথীদি, হাতে লাকি আলীর ক্যাসেট নিয়ে দাঁড়িয়ে, 'অনজানি রাহো মে তু ক্যা ঢুঁন্ডতা ফিরে..'!



    মালবেরি গাছ ঘিরে মণীন্দ্র গুপ্তের প্রদক্ষিণের মত সুপ্রিয় ঘুরছিল আশ্রম ঘিরে। প্রত্যক্ষ করছিল সেই সদ্য প্রাচীন আশ্রমকে। বাঁদিক পথে পেছনের দিকে যেতে হলে কাঁঠালি চাঁপা আর দেবদারুর কাছে মাথা নত করে যেতে হয়। গায়ে অজস্র সবুজ চোখ দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, আশ্বাস দেয় হরিতকি, "এবার তুই ভালো হবি"। ফাঁকা আশ্বাসে কান না দিয়ে একবার পেছনে চলে গেলে সামনে টিলা আর ডানদিকে দালানে তখন গামলা, নৌকা, ইয়া বড় সব হাতা-খুন্তির নিরমা-স্নান চলছে। হর শ্রাবণে গুরুদেবের জন্মবার্ষিকী পালন এইসমস্ত আয়োজনের হেতু। "কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস! আয় এক্ষুনি ভোগ দেওয়া হবে।" শাসন আসে। সুপ্রিয় দেখল এই একটু আগে পর্যন্ত যা সব বেতের ঝুঁড়িতে দোল খাচ্ছিল তারা সব এখন নিবেদিত। ভাগ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ধূপ-ধোঁয়া, ফল-মিষ্টি-নৈবেদ্য, ঘট-শালু-প্রদীপ, আলতা-সিঁদুর, পঞ্চশস্য-পঞ্চগব্য, আস্থা-সংস্কার। ঋত্বিক ওদের, যজমান আমাদের। অগোচর ওদের, গোচর আমাদের। নিয়ন্ত্রণ ওদের, বিশ্বাস আমাদের। ভূত ওদের, জীবন আমাদের। প্রসাদটুকু লোভনীয়। ভোগের শেষে সবাই শতরঞ্জি পেড়ে বসে গেলো। ভোম্বল মামার সাথে সুপ্রিয় থালাপাতা বিলোতে লাগল।

    শম্ভুদা এক্কেবারে ইমপ্রেসড। সাথীদি আজ সব্বার আগে সেই ভুঁইফোঁড় পাহাড়ের টেবিল পর্যন্ত চড়ে অবাক করে দিয়েছে সবাইকে! শুধু সুপ্রিয়ই বাদ। গোল করে বসে অন্তাক্ষরির শুরুয়াতের অপেক্ষা। ও আর শম্ভুদা একদল। উল্টোদিকে সাথীদি-সন্ধ্যাদি। সাথীদির চোখেমুখে এখনও পাহাড়ের অকারী-ইয়েলো লেগে আছে। ওদের অ্যাডভেঞ্চাচারের সময় সুপ্রিয় আজ ঘুমোচ্ছিল। আর কিনা আজকেই সাথীদি সময় পেয়েছিলো। দুপুরের দফারফা। ..লেকে প্রভুকা নাম, ম- দিয়ে 'মদহোশ দিল কি ধড়কন..' রিয়াদি শুরু করলো। গলা খাদে। আশ্রমের হাওয়া বাতাসকে হিন্দি গান বিবর্জিত রাখার চেষ্টা। "ইয়ে হাসিন ওয়াদিয়া, ইয়ে খুলা আসমান.." শম্ভুদা গাইছিলো ঠিকই কিন্তু প্রায় পুরোটাই সাথীদির দিকে তাকিয়ে। সাজনা'র আ-টা মিশে গেলো একটা চিৎকারের সাথে। রুনু মাসির গলা। সবাই ধড়ফড় করে ওরা সবাই ছুটে গিয়ে দেখল একটা কাঁকড়া বিছে লেজ তুলে, দুহাত ছড়িয়ে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু কেউ কিছু বুজতে পারছে না। একটা হুড়কো নিয়ে ছুটে এলো পরেশদা। গ্রাম পেরিয়ে ওদিককার মফস্বলে বাড়ি। পুজোবাড়ির সমস্ত আয়োজন সারম্বড়ে সেরে ফেলার সব দায়িত্ব যেন ওর একার। যেকোনো ডাকের পরতে পরতে হাজির। আশ্রমের কেয়ারটেকার রবীনকাকা ওকে আগলে রাখেন। কে জানে কেন! সেই পরেশদার হাতের হুড়কোটা ক্লাইম্যাক্সের দিকে নেমে আসতেই গুরুমার গলা শোনা গেলো, "অবলা জীবকে মেরোনা, ওকে ঝাঁটা দিয়ে বাইরে বাগানের দিকে ফেলে এসো"। নির্দেশ মান্য হয়ে গেলে গুনগুন শুরু হয়ে গেলো কামড়ের কনসিকোয়েন্স নিয়ে। আজ সন্ধ্যের টপিক সেট। এদিকে "আজ মে উপর আসমা নিচে.." সাথীদিও গ্রানাইট লঙ্ঘন করে চোখ স্থির করে ফেলেছে শম্ভুদার ওপর। ঘুরে পদ্মপুকুরের শেষে পাহাড় খুঁজতে চাইল সুপ্রিয়, পেল না এবারে। দুর্ভেদ্য বর্ষাকাল সেখানে।

    মশারীর ভেতরে আলো এসে ঢুকছে। বন্ধ চোখের পাতাও আলো আটকাতে পারছে না। অগত্যা ওদুটোকে খুলে সামনে তাকাতেই মানুষ-সমান জানালায় তিনটে হনুমান। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে হাজির। “ও মা, মাআআআ..” বলে দৌড় দিয়ে গিয়ে সুপ্রিয় দেখল, পেছনের হল ঘরে তার মাকে ঘিরে দিদা, মাসি, মামা-দের জটলা। কারো মুখে হাসি চোখে জল, কেউ তার মায়ের গায়ে হাত বোলাচ্ছে। ওদের চোখে-মুখে এক অলৌকিকের আভাস। "ও অরু, দ্যাখ তুই বলছিস আর আমার সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ওঃ ঠাকুর! কি পেলি রে তুই! অনেক পুণ্যের ফল" প্রায় সমস্বরে স্বগক্তি ভাসছিল। আখ্যানের অলৌকিক সূত্রপাত গতকাল রাতে। যে জানালার নাগাল থেকে সুপ্রিয়র পালিয়ে আসা, তার থেকে বিশ-পঁচিশ ফুট দূরত্বে এক গোলাকার পাথর। আকারে বয়ঃসন্ধি ছাড়িয়েছে, প্রকারে কোয়ার্টজাইট। সে বেড়ে চলে খানিক করে ভূগোলের খেয়ালে। আশ্রমের পরিবেশে অবশ্যই অতিলৌকিক। তার ওপরেই ভোরের আলো ফোটার আগে মায়ের মহিমান্বিত এক আলোর দর্শন। সেই আর্য-আলো বিরল। অতএব ভাগ্যবঞ্চিত অরুণিমার সৌভাগ্যবতীতে রূপান্তর। আলো সুদূর থেকে আসে। আমাদের ছোটবেলা, যৌবনবেলা পার করে। আমাদের আচরণ-সংস্কৃতি ধার করে। আমাদের মজ্জা, আমাদের এমিগডালার মধ্যে দিয়ে। এতটা পথ এসে হাঁপিয়ে পড়ে, বিশ্রাম নেয় আমাদেরই চোখের সামনে। দেখা দেয় যখন, অচেনা লাগে, হয়ে ওঠে লীলাময়। কারো কিচ্ছু যায় আসে না, কেউ-কেউ আস্থায় ভেসে যায়। সাথীদি এসে সুপ্রিয়কে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মুখ ধুয়েছিস? চা খাবি?” ও বললো, “না”।

    কুমারী পূজা, কুমার পূজা, অতিথি আপ্যায়ন, খিচুড়ী ভোগ সহ দৈনিক তিনবেলা পূজার সারাদিনের পার্বণ শেষ। ধূপ-ধুনোর গন্ধ তবু লেগে আছে চুন-সুরকি -কড়িকাঠে। পুজোর ঘরে প্রদীপের আলোর পাশে শ্যামাপোকারাও ঘুমিয়ে পড়েছে। এবাড়ীর না-পতঙ্গরা এখন সবাই মশারী গোঁজায় ব্যস্ত। সবার আগে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে নিতে হয় ভেতরে অবাঞ্ছিত কারুর প্রবেশ ঘটেছে কিনা, তারপর নিশ্চিন্দি। এই সময়ে হঠাৎ হুলুস্থুল, মহাভারত। বাইরের হলঘরে, বারান্দায় দাপাদাপি, হুংকার। রিয়াদি কোত্থেকে যেন ছুটে এল, সুপ্রিয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “চুপ করে থাক”। তবু দিদার আর্তনাদ শুনে ঠিক থাকতে পারল না। বাথরুমের পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখল পরেশদা দিদাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। হ্যাজাক নিভে গেছে অনেকক্ষন, বাইরের যতটুকু আলো পুজোর ঘরের বড় প্রদীপ থেকে আসছে। সুপ্রিয়র পাশে এসে রিয়াদিও উঁকি দিলো। এর মাঝে কখন বারান্দার ডান পাশের ঘর থেকে সাথীদি ছুটে এল দিদাকে তুলতে। সাথীদির ভাল নাম কি যেন, চেতনা না অসীমা! পরেশদা খপ্ করে ধরল সাথীর হাত। সাথী ভয়ে সাদা। পরেশ এখন প্রায় জ্যান্ত শয়তান। লাল চোখ, গায়ে যেন মোষের শক্তি। এই সময়ে আগের দিনের অব্যবহৃত হুড়কোটা পড়ল পরেশের হাতে। শম্ভু। প্রত্যাশিত হিরোর মত এন্ট্রি। সুপ্রিয় শঙ্খনাদ শুনতে পেল ওর সিনেমাঘরে। রূপক, ভোম্বল মামা, সুপ্রিয়র বাবা রাজর্ষি, গেলু মামা ছুটে গেল পরেশকে কাবু করতে। জানি দুশমন সিনেমার দানবকে হার মানাচ্ছিল পরেশ। অবশেষে একটা দড়ির খাটিয়ায় হাত-পা বাঁধা হল। দিদাকে তুলে নিয়ে গেছে সাথী, শুশ্রূষা চলছে। “একি সাথীদি, তোমার হাত !” ওঘরে গিয়েই সুপ্রিয়র চোখে পড়ল, হাতের রক্ত আর চিরে যাওয়ার দাগ। ও ছুটল মগে করে জল আনতে। সেও হিরো হবে, নিরীহ। বাসী মুখের ভারী হাওয়ায় আর কলগেটের ঠান্ডায় ভোরের পালাবদলের ফাঁকে সুপ্রিয় দেখলো খাটিয়ায় বাঁধা হাত পা মানুষ সব যেন বিশ্বাসঘাতকের মত পলাতক। ছুটে গেট পেরোলে দেখা যাবে কি, পরেশদা এখন একটা জ্যালেজেলে সকাল হয়ে মোড়ের স্থূলকোণ ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে!

    কাদা সামলাচ্ছিল সুপ্রিয়, এই রাস্তায় মাড-স্কিয়িং উচিত স্পোর্টস। উইলি ওয়াঙ্কার ফ্যাক্টরী এখানেই ছিল এককালে। এখন সব চকোলেট গলে রাস্তা তৈরি করেছে। একটু আগেই তুমুল বৃষ্টি হল, জলে জলে সাদা হয়ে গেছিল চারপাশ। ওদের এক্সপিডিশনের দেরি হয়ে গেল তাই। রাস্তার বাঁ পাশে বড় বড় পুটুস ফুলের ঝোপ, তাদের মাঝে ভাঁট ফুল ডালপালা ছড়াচ্ছে। ঝোপগুলো আস্কারা পাচ্ছে ওদের পেছনে নীলচে আভা গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলোর ভরসায়। ডান দিকে স্কেচ পেনে ক্ষেত আঁকা রয়েছে। আঁকার হাত বেশ ভালো, প্রাণবন্ত লাগছে। "কালকের কেসটা জানিস?" শম্ভুকে জিজ্ঞেস করলো রূপক। "ভর এসেছিলো?" সন্ধ্যা পুটুস ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে বেশ যাচ্ছিলো, গতকালের প্রসঙ্গ শুনতেই কৌতূহল আটকাতে পারলো না। সাথী এসেছে এই সন্ধ্যাদের সাথেই। দুজনার বাড়ী পাশাপাশি। ওরা বন্ধু কাম পাশের বাড়ীতুতো বোন। আশ্রম-পুজো পার্বন শুনে সাথীর বাড়ি থেকে আর না করেনি। "হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই" শম্ভুদা চোখ টিপে দিল। রিয়া ওর কাদায় চিটে যাওয়া চটি ছাড়িয়ে নিচ্ছিলো, কিন্তু রূপককে ছাড়লো না, "এই দাদাভাই বল, কি হয়েছিল রে? আমরা সবাই কিন্তু বড় হয়ে গেছি। কুট্টুস আর ভোঁদা কাউকে কিছু বলবে না, কি রে বলবি না তো?" "আমি বলবো না, ওর কথা জানি না" ভোঁদা বলতে বলতে কাদায় পাথর ছুঁড়লো, কাদা ছিটিয়ে লাগলো সুপ্রিয়র পায়ে। "তোরা এরকম করলে বাড়িতে রেখে দিয়ে আসবো" রিয়াদি ধমক দিয়েই আবার হাঁক দিলো "দাদাভাই..!"। দুই দাদা আর সাথী পাশাপাশি হাঁটছিলো। উত্তর এলো, "চল গিয়ে বলছি।" ক্ষেতের মাঝে আবার এক কুঁয়ো, বয়সে নবীন। এর জল নাকি বিখ্যাত। পাথরও হজম হয়ে যায়। ওরা সবাই সেই জল খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেল্ল। আর খিদে পাচ্ছে না। এইখান থেকে আর কাদা নেই। এই যে আদুড় সবুজ ঘাস, ছেলে মেয়েগুলোর অস্তিত্ত্বে সামিল হতে লাগলো ক্রমশ। সেলুলোজ মাড়িয়ে শালপাহাড়ের দেখা পেল ওরা শেষে। "পরেশ ড্রাগ এডিক্ট, রবীনদা চেষ্টা করছিল ওকে সারানোর"। শম্ভুদার কাছে এই চমকে দেওয়া তথ্য শোনার আগেই ওরা চড়ে বসেছে শালপাহাড়ের অর্ধেক। এলাকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। আরেকটু ওপরে উঠলেই রঙিন ম্যাপ হয়ে যাবে চারপাশ। উত্তরে রেলস্টেশন, উত্তর-পূর্বে আশ্রম, দক্ষিণে রাজ্যের সীমানা, পশ্চিমে কিছু এলোমেলো ছেলে-মেয়ে যেন লোকালয়ে আর ফিরবে না ভেবেই জড়ো হয়েছে। "দাদাআ.., আমার হিসি পেয়েছে।" ভোঁদার হাত ধরে শম্ভুদা আড়াল দেখিয়ে দিয়ে এলো। "তারপর.." সাথী জলের বোতলটা এগিয়ে দিলো। "সেরেই উঠছিলো জানিস", রূপক যোগ দিলো, "শুনলাম প্রায় মাস দুয়েক সারভাইভ করেছিলো নেশাভাঙ ছাড়াই, তারপর গতকাল হঠাৎ।" সন্ধ্যার কাছে এতক্ষনে যত পুটুস ফুল জমেছিলো সব খাদের দিকে উড়িয়ে দিল। নিচের থেকে, বহু নিচের থেকে হাওয়া এলো। পাহাড়ের হাওয়ায় সেকয়েকটা হলুদ-বেগুনী ফুল সন্ধ্যাদির সালোয়ার ছুঁয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে পড়লো। "ভোঁদা কোথায় গেলো?" বলে সন্ধ্যা যাকে খুঁজতে চলে গেলো, সে ভোঁদা নয় অবশ্যই। রিয়া দেখলো হাওয়ার টানে সন্ধ্যার ওড়না শাল গাছের ডালে ডালে কিসব বলে যাচ্ছে দিয়ে যাচ্ছে। ওড়নায় ঢাকছে পাতা, সরে যাচ্ছে, আর কাঁধ নেড়ে সায় দিচ্ছে পাতারা। রিয়াও সঙ্গ নিলো। "কি হলো?" রূপক অবাক। "কিছু না", সাথী শান্তভাবে জবাব দিলো। এখন এখানে সুপ্রিয়, সাথী আর শম্ভু। রূপক আরো একটু নিচে যেখানে জল জমে আয়না হয়েছে সেখানে গুহা খুঁজতে গেল। সুপ্রিয় দেখলো রূপকদাকে আগলে রেখেছে আসেপাশে উড়ে বেড়ানো সাদা-হলুদ প্রজাপতিরা। বৃষ্টি আসার আগে আলো বাতাসের স্তরে সাদা কার্পেট সাজিয়ে আপ্যায়নের তরিবত শুরু হয়েছে। প্রায় অদৃশ্য অগুনতি জলকনায় সূর্য শান্ত হয়ে এসেছে অনেক। খানিক আগের ঝকমকে ল্যান্ডস্কেপ এখন প্যাস্টেল রঙের। কেউ নেই ক্ষেতে-জমিতে। শস্যদের খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে অভিভাবকরা চলে গেছে আকাশের হাতে ছেড়ে। মাঝে মাঝে ক্ষেতের ওপর দিয়ে কালো কালো ছায়ারা ভেসে যাচ্ছে, দৃশ্যমান হচ্ছে আর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। "এই সময়ে কোন গান মনে পড়ছে বলতো?" শম্ভুদার অশরীরী প্রশ্নের সুপ্রিয় উত্তর দিলো, "অশোকা সিনেমার বাঁশি, ওই যে থিম ইন্সট্রুমেন্টালটা, শুনেছো তুমি?" "আরে, তোর সাথে তো খুব জমবে আমার! আমিও তো ওটার কথাই ভাবছিলাম, সন্দীপ চৌটা কি অসাধারণ বাজিয়েছেন বল, ওটাতে অনু মালিকের কোনো হাত নেই।" আর কিছুই বলার ছিল না। সুরটা দুজনেরই মাথায় ভাসতে লাগলো। ওদের মাথা থেকে বেরিয়ে সাথীকেও ছুঁয়ে যাচ্ছিলো হয়তোবা। তিনজনে এখন বৃষ্টির অপেক্ষায়। সাথী খোঁপাটা খুলে দিল।



    সুপ্রিয় ওর মাকে বলেছিল, শম্ভুদার সাথে একবার কথা বলবে। "ওদের ফোন নাম্বারই তো আমার কাছে নেই রে, কি করে বলবি?" অরুণিমা নিরুপায়। এখন সুপ্রিয়র কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। মাসির গিফট। লাকি আলীর ক্যাসেট কেনার আগে শম্ভুদার সাজেশনটা খুব জরুরি। "দাঁড়া দেখবো, ভোম্বলকে বলে, ওর কাছে পাওয়া যাবে।" আশ্বাস পেল মায়ের কাছে। পাহাড়ে ভেজার পর মাস চারেক পেরিয়ে গেছে। ওরা কথা রাখতে পারেনি। ফিরে গিয়েছিল আশ্রমে, ফিরে এসেছিল নিজের নিজের বাড়ি। বেরোনোর আগে সাথীদির দেওয়া একটা কাগজ শম্ভুদার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েওছিল। পরে, আপাত সময় ব্যায়ের শেষে বুঝেছিল এসব ক্লিশে, 'বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবে কী, সে?'। শেষ দিনের পরীক্ষা দিয়ে ফিরেই কৈলাশ খেরের 'আল্লা কে বন্দে' চালাচ্ছিল সজোরে। অরুণিমা এসে একটা ইনল্যান্ড চিঠি দিলো সুপ্রিয়র হাতে। গেলু মামার পাঠানো। শম্ভুদা নেই, বাস্তবে আর নেই। হেপাটাইটিস বি নিয়ে নার্সিং হোমে গেছিলো আর ফেরেনি। পারলৌকিক কাজে যেতে লিখেছে ওদের। "বাদলোঁ কি গেহরাই মে, শুনেছিস? শুনবি, ওর পপুলার গানগুলোর চেয়ে অন্যগুলো অনেক অন্যরকম", সুযোগ পেলেই সুপ্রিয়কে হিন্দি পপ কৃষ্টির সৃষ্টি রহস্য বোঝাতে ছাড়তোনা শম্ভুদা। বাঁ হাতে ঘন করে লাল তাগা বাঁধা। সেই হাত এখনও চোখ বুজলেই নিস্পৃহে সুপ্রিয়র হাত থেকে সাথীর দেওয়া কাগজটা চেয়ে নেয়, যখন-তখন। "হ্যাঁরে, কিছু করতে পারলি না!" চিঠিতে নাম্বার দেওয়া ছিল। মা কাঁদছিলো আর ঘুলিয়ে যাচ্ছিলো ডায়ালটোন। ফের রিং, "আয় ভোঁদার সাথে কথা বলবি।" চোখ মুছতে মুছতে ডাকলো অরুণিমা। রিসিভারের দিকে এক পলক তাকিয়ে, সুপ্রিয় ছুটল ছাদের দিকে। কার্নিশের ধারে গিয়ে বসে হাঁপালো খানিক। ম্যাজমেজে সূর্য হেলে আছে। কংক্রিটের এই বিন্যাসে সুখী দুঃখী পাহাড় নেই, অভিমানী ক্ষেত-শস্য নেই, অনবদ্য সেলুলোজ নেই, অকারী-ইয়েলো গ্রানাইট নেই। মাথায় বাঁশির সুর আছে নেপথ্যে। শম্ভুদাই এনে দিয়েছে হয়তো। আচ্ছা, সাথীদিকে কেউ জানিয়েছে?



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০৩ অক্টোবর ২০২৫ | ৭৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    জুবিন  - Rajat Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2607:fb91:4c21:664d:b158:cff9:695d:***:*** | ০৩ অক্টোবর ২০২৫ ২১:১১734620
  • অত্যন্ত ভালো লাগল। হাওয়া দিলে আলোয় আলোয় ঠোকাঠুকি লাগা, ব্যথাদের চকমক করে ওঠা, পুকুরের ক্ষত পদ্মের ক্ষত, উইলি ওয়াঙ্কার ফ্যাক্টরি ও চকোলেট গলে রাস্তা তৈরী করা, সাথীদি'র চুলের ঝর্না মাটি ছুঁয়ে তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে খাটের তলার অন্ধকার তৈরী করছে.... লেখকের অনুভূতির সুক্ষ্মতা আর তা শব্দে ধরার ক্ষমতা অসাধারণ! আর অলংকরণ তো অসম্ভব সুন্দর!
  • বলে যাই  | 165.225.***.*** | ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:১১734635
  • যেন একটা নরম বাতাস বয়ে এলাম।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন