বহুদিন পরে এবার লিখতে এলাম, দুটো পর্ব লিখে উধাও হয়ে গেছিলাম শূন্যে শূন্যে অশান্ত কর্মময়তার বাতাসে, এরমধ্যে কত কি-ই না ঘটে গেছে- কিন্তু এবার থেকে, একটা নতুন বছরের শুরুতে চেষ্টা করছি, নিজের লেখালিখির পথটা নতুন করে খুঁজে নেওয়ার- কিছু না হোক একটু তো আত্মমোক্ষণ করা দরকার, গান চেষ্টা করলাম, আঁকিবুঁকিও, কিন্তু কোনটাই কিছু লাগল না। চেষ্টা করব এবার থেকে অন্তত সপ্তাহে একবার করে লিখতে বসার, আমিও যে লেখালিখি কিছু করতে পারি সরস্বতীর প্রসাদগুণে-সে কথা ভোলার জো হল।
অনেক বিষয়ে লেখা যেত, আগের পর্বে বলেছিলুম কখনো কথা বলব স্কুল কলেজে র্যাগিং এর অভিজ্ঞতা নিয়ে, একজন ক্যুইওর পার্সন হিসাবে- সেটা নিয়ে লিখতে পারতাম, এতোদিনে পার্কস্ট্রিটের সেই নিশ্চিন্ত কালেজি ঘেরাটোপ ছেড়ে একবছর বাড়ি বসে পড়াশোনা করে চলে এসেছি উত্তরপ্রদেশের একটি :চোখ: :চোখ: :ফুটি: :ফুটি: তে (এই জায়গাটা যে বুঝতে পারবে, সে জেন জি লিঙ্গোর সুনীতিকুমার- মানালি বা মল্লারের ওপর আমার ভরসা আছে, তবে মানালি বোধহয় আমার মতো ছ্যাঁচড়া টাইপ না, বেশ টিপিকাল সিরিয়াস পড়ুয়া ধরনের) , বা এই সম্প্রতি ছায়ানটের ওপরে আক্রমণের ঘটনাটা আমার মনে tolerance towards islam এর ওপর কিরকম অভিঘাত ফেলেছে( literally the last straw that broke the camel's back and made me Islamophobic) - আরো অনেক কিছুই কলমের আগায়, থুড়ি আঙুলের ডগায় টাইপ করতে গিয়ে চলে আসছে, কিন্তু একটু রয়েসয়ে লিখি- আসলে ওইজন্যই লিখতে ভয় পাই, লেখালিখি বা যেকোনো ধরনের সৃষ্টিকাজ আসলে বড়ো পরিশ্রমের কাজ, বিনাকাজে বসে চুপ করে ভাবনাস্রোতে তলিয়ে যেতে বা ভাবনাগুলো উড়িয়ে দিতে যত ভালো লাগে, তত যেন আর কিছুই লাগে না, সাধে কি মুজতবা আলি বলেছিলেন স্বর্গে যাওমার একটা সুবিধাই হলো সেখানে সবকিছুই বিনা আয়াসে সাধ্য।
আপাতত একটা ছোট বিষয় দিয়ে মুখপাতটুকু করি, দেখি কোথাকার গুলিসুতো কোথায় গড়ায়।
দূরদর্শন শান্তিনিকেতনের ইউটিউব চ্যানেলে এবারের খৃষ্টোৎসবের( হ্যাঁ এই বানানই রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন তাঁর খৃষ্ট-সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলিতে) অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং শুনছিলাম- এইসব অনুষ্ঠানগুলো মোটামুটি আমি সবই দেখি কিন্তু একবারে বসে টানা দেখতে পারি না, ওই কাজ করতে করতে বা শুয়ে শুয়ে চালিয়ে দিয়ে ফাঁকা ঘরে শুনি, গলা মেলাই গানে, আবৃত্তিতে, আমার নিভৃতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী এসব গান কবিতা গীতি আলেখ্য শ্রুতিনাটকেরা, কোভিড ও তৎপরবর্তী সময়ে ছায়ানটের এতো অনুষ্ঠান দেখেছি আমি অনলাইনে, বর্ষবরণের নতুন-পুরোনো রেকর্ডিং, শারদোৎসব বা দূরশিক্ষণ প্রয়াস হিসেবে গানের নিবিড় পাঠ এপিসোডগুলো, ওইসব সীমান্তপারের মানুষগুলো- সঞ্জিদা খাতুন, লাইসা আহমেদ লিসা, খায়রুল আনাম শাকিল, সেমন্তী মঞ্জরী, আরেকটি মেয়ে আছে কি বড়ুয়া যেন, একটু লম্বা তেকোনা মুখটা আর চোখের পাতা একটু ভারি, খুব ভালো গায়কি, শান্তিনিকেতনের পলাশি ঘোষ, বা এপার বাংলার অরিত্র পাণ্ডা, অঙ্কন চট্টোপাধ্যায়দের মতোই নবীন প্রতিভাময়ী শিল্পী রবিগানের- এদের সাথে একধরনের parasocial সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে গানের মাধ্যমে, সঞ্জিদা খাতুনের 'শান্তিনিকেতনের দিনগুলি' পড়ে, তাই সঞ্জিদা খাতুন মিতা হকদের প্রয়াণ বা ছায়ানটের ওপর আক্রমণ এতো বিচলিত করে ব্যাক্তি আমিকে।
কিন্তু যে কথা বলছিলাম সেখানে ফেরত আসি। তো ওই অনুষ্ঠানের গান শুনছি সব, রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শুরু করে ক্যারল গাওয়া হল,বাইবেল থেকে পাঠ হল ( রামকৃষ্ণ মিশনের যিশুপুজোর থেকে ঢের ভাল জিনিস আমি বলব), আচার্যের অভিভাষণ হল( এ প্রসঙ্গে একটু খোঁচা দিই- এবারের ৭ই পৌষের প্রভাতী উপাসনায় প্রধান অতিথির, সম্ভবত অবাঙালি, কোন সরকারি হোমরা চোমরা হবেন আর কি, বিচ্ছিরি বাংলা উচ্চারণে দীর্ঘ ভাষণ শুনতে কী বিরক্ত লাগছিল কি আর বলি।) , সঙ্গীতভবনের দুই গুণী অধ্যাপিকার মধ্যে অর্পিতা দত্ত গাইলেন 'জীবন যখন শুকায়ে যায়', একটু বেশিই ম্যানারিজম এল পরিবেশনায়। এরপরেই আচার্যের ভাষণ শেষে, মানিনী মুখোপাধ্যায় ধরলেন "শান্তি করো বরিষণ" আর আমার কানে বঁড়শির মতো বিঁধে গেল সব সুর- অপূর্ব পরিবেশনা এককথায়। Real time এ লাইভ অনুষ্ঠানে ওই স্তরের পরিবেশনা যে সম্ভব, সেটাই অভাবনীয়। ৩৭ মিনিটের মাথায় শুরু করে ৩ মিনিট ১০ সেকেন্ড ধরে আমার কানে যে কি সুধা বর্ষণ করলেন আমিই জানি। এই গানটা দেখেছি গীতবিতান ঘাঁটবার সময়, খুব কৌতূহল হয়নি শোনার কখনো, এবার tagoreweb খুলে দেখতেই হলো।
রাগ দেখি তিলক-কামোদ লেখা আছে, কিছু অনেকটাই দেশ আসছে সুরের বিন্যাসে। তাল সুরফাঁকতাল। ইউটিউবে উল্লেখযোগ্য পরিবেশনা বলতে রয়েছে পূর্বা দাম, স্বাগতালক্ষ্মী, সুবিনয় রায়ের পুত্র সুরঞ্জন রায়ের(zahid Hussain এর চ্যানেলে এটা সুবিনয় রায়ের গাওয়া উল্লিখিত আছে, সেটা ভুল- প্রসঙ্গত এই zahid Hussainএর চ্যানেলটি একটি রত্নখনি বিশেষ, কতো যে গান, বিশেষত রবীন্দ্রসঙ্গীত- রমা মণ্ডল থেকে শুরু করে রেণুকা দাশগুপ্ত, সতী দেবীদের রেকর্ড, পাই ওঁর চ্যানেলে আর ভিডিও এডিটিং গুলো আমার খুব পছন্দের, বেশ গোলাপি রানি সব নয়নতারা ফুলের ছবি দেওয়া থাকে, আর আমি লক্ষ্য করেছি, কণিকার গানগুলো সবসময়ই ছবি দেওয়া থাকে বিকেলের বিষণ্ণ আলোয় হলুদ ফুলের, কখনোই গোলাপি বা লাল ফুল না- এই সব youtube channel গুলো যেগুলো আমার গান শোনার নিয়মিত ঠেক, এগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে কখনো লেখার ইচ্ছা আছে- anjan chakraborty থেকে purna chowdhury(ইনি খুব সম্ভবত প্রয়াত কারণ এনার চ্যানেলে কোনো আপলোড নেই বহুদিন হল), অধুনা প্রয়াত alo kunduর sound wing gramophone records, geetibichitra(এখানে সব রবীন্দ্র গীতিনাট্যগুলোর গীতি আলেখ্যর পরিচ্ছন্ন বাহুল্যবর্জিত রেকর্ডিং আর শ্রীলা সেন, প্রতিমা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া অনেক রবীন্দ্রগানের রেকর্ডিং আছে) ইত্যাদি।)
প্রসঙ্গে ফেরত আসি। এই তিনটে যে পরিবেশনা শুনলাম এই গানের, মানিনীকে শোনার পর; খুবই যথাযথ, স্বরলিপি অনুসারী। সুরঞ্জনের গলায় তো স্পষ্ট সুবিনয় রায়ের গায়কির ছাপ। কিন্তু মানিনীর গলায় গানটা বোধহয় আমার আজীবন কানে লেগে থাকবে এরপর থেকে। মানিনীর গায়কি শুনে মনে হল খুব সম্ভবত নীলিমা সেনের কাছ থেকে উনি এই গানটা তুলেছেন কখনো, কারণ প্রথম লাইনটা শুনেই আমি চমকে উঠেছিলাম, মনে হয়েছিল নীলিমাই যেন গাইছেন আর আমার চোখ সেসময় ফোনের ওপর ছিল না তাই আমি অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, বিশ্বভারতী কি এখন পুরনো শিল্পীদের গানই চালাচ্ছে অনুষ্ঠানে।
মানিনী শুরু করেন প্রথম লাইনটা দুবার গেয়ে। 'শান্তি করো বরিষণ নীরবধারে' এই অংশটুকু প্রথমে গেয়ে তারপর পূর্বা প্রবেশ করেছিলেন গানের মূল অংশে, ধুয়ো হিসেবে ফিরিয়ে এনেছিলেন ওই অংশটুকু আর শেষ আবর্তনে শুধুই প্রার্থনাটুকু জেগে থাকে "শান্তি করো বরিষণ", "নীরবধারে" অংশটুকু নীরব থাকে। কিন্তু মানিনী পুরো লাইনটাই বেশ ভেঙে ভেঙে গাইলেন দুবার-এটি তো দু লাইনের গান, ধ্রুপদ ভাঙা। নীরবধারে কে আমি প্রথমে শুনছিলাম নিবিড়ধারে, আর নিবিড়ধারে বললেও মাত্রার কিছু গোলমাল হয়না বা অর্থবিকৃতি ঘটে না এমনিতে, কিন্তু নীরবধারে লেখার কারণটা বোধহয় পরের অংশটায় আছে। এই এক লাইনেরই পুরো অন্তরাটা -" শান্তি করো বরিষণ/নীরবধারে(এখানে একটা সুন্দর মীড় আর ঘূর্ণির কাজ আছে আমার ভারি পছন্দ হয়েছে)/নাথ চিত্তমাঝে(আবার এখানে ভুল শুনছিলাম, ক্লান্ত চিত্ত মাঝে, যেহেতু নাথে একটু আ-কারে গলা ঘুরবে গমক দিয়ে, আর মাঝে তে নীচের পা পর্যন্ত যাবে, আমার গলায় ফিসফিস করে আওয়াজ বেরোচ্ছে ওই জায়গাটা গুনগুন করতে গিয়ে)/সুখে দুখে সব কাজে/ নির্জনে জনসমাজে(এই জনসমাজে কথার প্রয়োগটা খুব চিত্তাকর্ষক; জনসমাজ বলতে লোকের ভিড় সান্নিধ্য এসব বুঝিয়েছেন আবার এই সমাজের সকলের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক সে প্রার্থনাও কি করেছেন এই শব্দ প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে?)"
এরপর সবচেয়ে সুন্দর অংশটা, অন্তরা। অন্তরা হলো-"উদিত রাখো নাথ/ তোমার প্রেমচন্দ্র(এখানে কিছু কাজ আছে বটে, একদম দেশ আঙ্গিকে স্বরবিন্যাস, আর 'র' তে র্রে-র্পা লাগলে সত্যিই যেন প্রেম ঘন হয়ে নিটোল পূর্ণচাঁদ উদয় হচ্ছে মনে হচ্ছে হৃদয়ে, আর বুঝতেও পারছি যেন এই শান্তিবরিষণ, "বরিষ ধরা মাঝে" র মতো শান্তিবারি না বরং এই প্রেমচন্দ্রের শান্তিকিরণ)/অনিমেষ মম/লোচনে/ গভীর তিমিরমাঝে।"(এ গান শোনার পর হয়তো যতোবারই খুব crisis এর মূহুর্ত আসবে জীবনে, বুকের মধ্যে তাকালে পূর্ণ একটা চাঁদ দেখতে পাব)
তো মানিনী দুবার আস্থায়ী গেয়ে অন্তরায় ঢুকলেন, দুবার ফিরে ফিরে গাইলেন "উদিত রাখো নাথ/তোমার প্রেমচন্দ্র", কি অনায়াসে তারে চড়াচ্ছেন গলা অথচ মুখের একটি পেশিকুঞ্চন পর্যন্ত হচ্ছে না, কণিকার সার্থক উত্তরসূরী বলতেই হয়। এস্রাজ আর গলা একইসাথে বাজছে আর জুড়ে যাচ্ছে পরস্পরের সাথে। একবার আস্থায়ী গেয়ে অন্তরা গাইলেন একই নিয়মে, ফের আস্থায়ী দুবার গেয়ে 'শান্তি করো বরিষণ ' দিয়ে শেষ। সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে গেল এই পরিবেশনা।
(বাপরে লেখালিখি করা কিছু কাজ বটে! এইটুকু লিখতে দুঘন্টা লেগে গেল শীতের রাত্তিরে, আজ এটুকুই থাক, ফিরে আসব এখন থেকে নিয়মিত, নিজের উদ্যমেই)