ছবি: ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
আলো তেমন ঢোকে না, জানালাও স্যাঁতসেঁতে, শুধু একটা অদ্ভুত রঙের গন্ধ। পুরোনো রঙ, আগের ব্যবহার করা। কাঠে, দেওয়ালে পোকার গু, শীতকালের ধুলো। গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের হস্টেলের ঘরে বসে গগন টের পাচ্ছিল না সে কী আঁকছে। কি আঁকতে চাইছে। তার হাতে তুলি, কিন্তু ক্যানভাসে দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট পুরনো পুঁজ। জলরঙে সেই পুঁজের রঙটাও ঠিক সবজে সাদা আনতে পারবে না। সে এঁকে চলে ব্যস্ত তুলির টানে পুরীর সৈকত, পেন্সিল স্কেচে ফালিফালি মানুষ, কালিতে কীর্তন দৃশ্য। গগনের আঙুলের মাথায় তখনও শহরের পাঁকে পা না পড়া দোলাচল। একটু একটু করে অভ্যস্ত হচ্ছে ওড়নার গন্ধ, অবেলার ঘুমচোখ, পেন্সিল কাঠে দাঁতের দাগ। মফস্বলের একসময়ের জমিদার বাড়ির ছেলে সে, ভাইয়ের সাথে মিলে নতুন ধরনের ছবি দিয়ে পৃথিবীকে মুড়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে আজ সে কলকাতায়। তবু মন বসছে না। ভাবছে চৈতন্যদেবকে নিয়ে একটা সিরিজ আঁকলে কেমন হয়। ক্লাসে পেছনে দাঁড়িয়ে স্যার বলছিলেন, "এইভাবে না। আঁকো চোখ, মননকে তৈরী করে। যে দেশকে দেখতে পাও, যে ঐতিহ্য, আধ্যাত্মিক সরলতা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে গড়েছে তার ছবি ফুটিয়ে তোল। শিখো। স্কুল অব বেঙ্গল।"
গগন শিখছিল। অনেক কিছু শিখছিল। প্রাচ্যের অঙ্কন শৈলী, শিল্পের উদ্দেশ্য আরও অনেক কিছু। পুরোটা আয়ত্ত না হলেও, ডুলুং জলের মত স্নিগ্ধ কিছু তুলিটান শিখেছিল সে। আঙুল বুলিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করত, রং কাকে ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসা শব্দটা তখন ক্যানভাসে জায়গা পায়নি। আঙুল বোলাচ্ছিল কিন্তু কি একটা যেন খুঁজে পাচ্ছে না, জিভ মাঝে মাঝে শুকনো লাগছে, মাথা অনেক চিন্তায় ভার। তার আর ভালো লাগছে না আঁকা। এরকম আঁকা।
তিনমাস পর সে আর আঁকছিল না, লিখছিল। চিঠি। সাথীদের। লিফলেট। হয়ত ছেলেমানুষি লেখা। বিপ্লবী মতাদর্শের ছাপা লিফলেটের ফাঁকে রাখা তার লেখা জ্যান্ত জ্বলে থাকতে লাগল – আঁকা আর বিপ্লবের মাঝখানে যে গোপন সুর। "শিল্পের স্বাধীনতা নেই যদি সে রাষ্ট্রের চোখে চোখ রাখে।" "তুলির রঙই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।" সে রাতের পর রাত কাটাত – আর্ট স্কুল ছেড়ে – মেদিনীপুরের জঙ্গুলে গ্রামে। হাতে রং ছিল না, হাতে অস্ত্র ছিল না, শুধু কিছু শব্দ আর কয়েকটি ছবি। অথবা ছবির স্বপ্ন। সে আস্তে আস্তে দেখেছিল টিনের চালে গুলির ফুটো আঁকা হচ্ছে। শত্রু নামের কাদের যেন গলা কাটা দেহ ক্যানভাসে এসে পড়তে চাইছে। পুলিশের লাঠিতে এক চোখ হারানো নারী, অপলক তাকিয়ে আছে তার তুলিটানের অপেক্ষায়, সবকিছু দেখাতে চাইছে। সে আঁকত না, নাকি আঁকত। অন্য কোথাও।
একদিন ভোরে ঘুম ভাঙল গুলির শব্দে। ঘর থেকে বেরিয়ে গাছের গুঁড়ির পাশে সে দৌড়েছিল। দুটো গুলি তার পেছন দিয়ে চিরে দিয়েছিল বাতাস। তৃতীয়টি থেমে গিয়েছিল ঘাড়ের নিচে। এক এক করে শান্ত হয়ে উড়ে গিয়েছিল তার স্লোগান, কাগজ। রক্ত ছড়িয়ে পড়ছিল, সবুজ ঘাস লাল হয়ে উঠছিল, অর্থাৎ ক্রমশ বাদামি হচ্ছিল। সে চোখ বন্ধ করেছিল।
ভিতরের দিকে রঙিন পাতায় তলার দিকে মুদ্রিত কার্টুন। ঠোঁট বাঁকা এক মুখ, তার চোখ সংসদ ভবনের ছায়ায়। নিচে লেখা—"খোঁয়াড়ি কাটলে আর ভোটে দাঁড়াব না।" পরের কোনও একদিনের পাতায় মখমল বিছানায় শুয়ে থাকা মন্ত্রী, বুকের উপর কুকুর পা তুলে পেচ্ছাপ করছে। কিছু লেখা নেই, ঐটুকুই। কেউ হেসে ওঠে, কেউ বলে, “বেশি বাড় বেড়েছে”, পাঠক চা খেতে খেতে থমকে যায়। গগন এখন এইসব আঁকে। কার্টুন। সে এখন একটি ডাকসাইটে সংবাদপত্রের কার্টুনিস্ট। তার পরিচয় নেই, কৃতিত্ব নেই। ছাপা হয় শুধু তার এক প্যানেলের কাজ। সে খুঁটে খুঁটে দেখে শহর – বিজ্ঞাপনের পেছনে লুকোনো ভাঙা বারান্দা, সাট্টার ঠেক, ময়লা আবর্জনার পাশে পড়ে থাকা ভিখারির মুখে দিনাজপুরী মুখোশ কল্পনা করে। সে মুখ খুঁজে পায় নেতাদের মুখোশে, সে মানে খুঁজে পায় পাল্টে যাওয়া অলিগলি, বস্তির অন্ধকারে।
তার এখন একটা খাতা আছে, যেখানে সে রাখে পরবর্তী সব ব্যঙ্গচিত্র। খাতার নাম দিয়েছে কিম্ভুততন্ত্র। একটি ছবি—একটি খাঁচা, তার ভেতরে এক ভোটবাক্স। পাশে একটা লোক দাঁড়িয়ে, তার মুখ একটা টিভি স্ক্রিন। নিউজ ডিবেট চলছে। রাগে চিৎকারে লোকটার ছায়া স্ক্রিনটা ভেঙে দিচ্ছে। তার এসব ছবি, চুপচাপ সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। মিম হয়। তবে গগনের নামে হয় না কোনো মামলা, হয় কানাঘুষো, রটনা, চরিত্র হনন। ফেসবুকে পোস্ট, “ওটা শহুরে নকশাল, দেশবিরোধী। মেয়ে দোষও আছে। ঘরে আরশোলা ঢুকলে যা করা উচিত তাই করা দরকার ওর সঙ্গে।” প্রতিবেশী চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে, বলে, “ও ভালো ছেলে ছিল, কিন্তু এখন শুনি গাঁজা খায়।” সংবাদপত্রের চাকরিটা যায়।
ক্রমশ মুখোশ পরে গগন রাস্তায় বেরোতে থাকে। ভিড় কম এমন রেল স্টেশনে সারা দুপুর কাটায়। লুকিয়ে আঁকে ইঁটের টুকরো দিয়ে সিমেন্টের ক্যানভাসে। পিঠে ব্যাগ, তাতে একচেটিয়া রঙতুলি, পেন্সিল, চারকোলের বদলে কড়া ডোজের ক্লোনাজ়েপাম নিয়ে ঘোরে। কিন্তু ভিতরে তাও কোথাও কোথাও কুয়াশাটা যাচ্ছে না। মাথা ঠেকে যাচ্ছে কাদের যেন শব্দে। কারা যেন তাকে ইয়ার্কি করে নজরবন্দী করে তাকেই একটা জ্যান্ত কার্টুন বানাচ্ছে আস্তে আস্তে। একদিন সে পায়ে হেঁটে চলে যায় দক্ষিণ শহরতলিতে, পাঁচতলা একটা মলের ছাদে উঠে দাঁড়ায়। চারদিকে আলো, রঙিন আলো, কিন্তু ক্যানভাসে কিছুই আঁকার মত পায় না সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে, নীচে ছোট হয়ে আসা গাড়ির দিকে, মানুষের দিকে, যারা মাথা তোলে না। তার মনে হয় এটা একটা কার্টুন প্যানেল। নিজেকেই তার কিম্ভুত, দৃঢ় ভাবে মনে হওয়ায় সে চোখ বন্ধ করে ঝাঁপ দেয়। প্যানেলের সাথে থেঁতলে যায়।
বিদেশী গ্যালারিতে প্রদর্শনী। আলো, কাঁচ, খোদাই করা হাই-ক্লাস। কিউবিস্ট ফর্মে সাঁওতাল নারী, গ্রামের প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য, আল্পনার নতুন জ্যামিতি। বিষয়কে কেন্দ্র করে অদ্ভুত আলো দিয়ে স্তরের ব্যাখ্যা, তাতে ত্রিভুজ, ঘূর্ণি, ছায়া মিশে গেছে চুপিসাড়ে অথচ অবলীলায়। রঙ আসছে আলো বোঝাতে। লাল, কালো, হলুদ, বাদামি, বেগুনি। পেছনে বসে গগন। মুখে হাসি নেই, উদাসীন অনীহা। অনুবাদকের মুখে শোনা যায়, “ভারতীয় কিউবিস্ট শিল্পী গগন বলেন, বাস্তব নয়, ক্যানভাসে অনুভব আঁকতে হয়।” তার গলার নিচে বাঁধা টাইটা গগনের চোখে পড়ে।
ক্রমশ গগন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়ে যান। আর্ট রিভিউতে তাকে নিয়ে আলোচনা – “ভারতের আধুনিক বিমূর্ত শিল্পের প্রধান কণ্ঠস্বর।” সে দেশের নামকরা আর্ট স্কুলগুলোতে যায়, বক্তব্য রাখে। শিক্ষার্থীরা মোবাইলে ছবি তোলে। গগন তখন চুপ করে থাকে। হাসে না। মুখর হয় না।
এখন তার স্টুডিওয় আলমারিতে সারি সারি ক্যানভাস। সিরিজ ভিত্তিক কাজ। “মাটির সোঁদা জ্যামিতি”, “রাতের মহুয়া দেহ”, “মেঠো রাস্তার চিলেকোঠা।” সে প্রতিদিন একটি করে ক্যানভাস তৈরি করে, রুটিনে বাঁধা। সকাল আটটা, জলখাবার, স্টুডিও, দুপুরে ডাল-ভাত-মাছ, আবার স্টুডিও। রাত্রে সাদা মদের সঙ্গে সামান্য বাদাম। কোনো শব্দ নেই, তাড়াহুড়ো নেই কেবল ক্যানভাসে রঙের শব্দ। আঁকতে আঁকতে তার হাত কাঁপে না, চোখও না। শুধু মাঝে মাঝে থেমে যায়। ব্রাশ থেমে যায় মাঝ-আঁকায়। টানা তিন মিনিট সে বসে থাকে একরঙা মেঝের দিকে তাকিয়ে। কি যেন মনে করার চেষ্টা করে। ঘাড়ের কাছে হাত বোলায়। মনে করতে পারে না। তারপর আবার।
একদিন ক্যানভাস। গোলাপকে কিউবিস্ট কায়দায় ধরার চেষ্টা করে। পাঁপড়িগুলো যেন ছুরি দিয়ে কাটা, ফালাফালা। কেন্দ্র নেই। বদলে শুধু একপাশে সরানো ঘূর্ণি। আঁকতে আঁকতে থামে। আসলে সে মাথা নিচু করে বুকের ব্যাথাটার আমোদ নিচ্ছিল। ব্রাশ নামিয়ে রাখার আগেই তার মুখটা লাফিয়ে পড়ে যায় ক্যানভাসের উপর। রক্ত ছড়িয়ে পড়ে ধীরে, গাঢ় রঙ মিশে যায় আঁকা ছবির রেখার সাথে। পাঁপড়ির মতো ছড়িয়ে পড়া রক্তের লাভা এক নিখুঁত কিন্তু থ্যাঁতলানো গোলাপ তৈরি করে।