ইরফানকে চলে যেতেই হবে। যেভাবে বন্দুকের শরীর ঝাঁকিয়ে ছিটকে বেরিয়ে যায় নিক্ষিপ্ত ছররা, কিংবা যেভাবে বাঁধ না মানা তেজ নিয়ে কক্ষচ্যুত হয় উল্কা। ঠিক সেভাবে।
ইরফান জানে, ওর ভিতরে এক সুপ্ত সন্ন্যাস রয়েছে। তার এই ত্রিশোর্ধ জীবন এযাবৎ কোনও আধ্যাত্মিক আলোকধারায় বাঁক নেয়নি ঠিকই, তবে খুব শীঘ্রই সে বিবাগী হবে। একটা উদাসীনতা বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে তাকে টেনে নিয়ে যাবে এই সাংসারিক হট্টমেলার চেনা চৌহদ্দি ছাড়িয়ে। সেই যাওয়া হবে অনাড়ম্বর। বিদায় সম্ভাষণ দুরস্ত, টুঁ শব্দটিরও সুযোগ নেই সেখানে। ইরফান জানে।
দিনক্ষণ সম্বন্ধীয় বিস্তারিত না জানলেও, সে জানে খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে চলেছে এমনই কিছু। রক্তের প্রবাহে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসতে থাকা সেই বৈরাগ্যকে অনুভব করতে করতেই ইরফান বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে দীর্ঘ টান দেয়।
মেঘভাঙা উজ্জ্বল সোনালি রোদ টেরচা হয়ে পিছলে যাচ্ছে ওর সদ্য ক্ষৌর করা গাল হয়ে। ঘামের একটা চিকন রেখা আস্তে আস্তে গড়িয়ে যাচ্ছে ঘাড় বেয়ে। আরেকটা নামছে রগ ছুঁয়ে। কপালের উপরের চুলের একটা পাকানো ঘুরলি নেমে এসেছে বামদিকের ভ্রু ঘেঁষে।
চোখ ছোট করে ধোঁয়ার স্বতঃভঙ্গুর রিঙগুলোকে গ্রিলে বসে থাকা একটা ফড়িঙয়ের দিকে টিপ করে এতক্ষণ ছাড়ছিল ইরফান। ভিতরের ঘর থেকে তৎক্ষণাৎ ঝংকার দিয়ে উঠল রমিলা, —এই কী ব্যাপার গো তোমার? ঘড়িতে কটা বাজে সে খেয়াল আছে?
চমকায় ইরফান। তার আধবোজা চোখ দুটো খুলে গেছে সহসা। ফড়িংটাও উড়ে গিয়ে বসছে অন্যত্র। পাশের গলি দিয়ে ধুনুরিরা চলে যাচ্ছে ধুনকিতে একটানা আওয়াজ তুলে। প্রতিবেশীর মোবাইলে বাজছে কর্কশ রিংটোন। তারই মধ্যে একটা কালিপটকা ফাটতেই চীৎকার করে উঠল খানকতক কচিকাঁচা।
ইদানীং ইরফান যেন একটু বেশিই দেখছে। শুনছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। বিবাগী হওয়ার আগে মানুষ কি এভাবেই লক্ষ্য করে যায় নিজের অভ্যস্ত পারিপার্শ্বিককে! এই সুযোগে কাছের মানুষদেরও কি একটু বেশিই নজর-আন্দাজ করে। ইরফান অবশ্য টের পায় না তেমন, বরং সব মিলিয়ে একটা অনাকাঙ্ক্ষা অবস্থান করে। একটা অনীহা, একটা নিঃস্পৃহতা।
বারান্দা থেকেই সে উঁকি দেয় ঘরে। খাটে উপুড় হয়ে মগ্নচিত্তে ভিডিও গেম খেলছে মান্তু। এক মাথা কোঁকড়ানো চুল। টাটকা রোদের মত গায়ের রঙ। মুখ চকচক করছে ঘামতেলে। চাউনিতে উপচে ওঠা দস্যিপনা। সামনের নভেম্বরে কত হবে মান্তু? ছয় … না সাত… নাকি ছয়? একটা শ্বাস ফেলে ইরফান। কী লাভ আর এত তত্ত্বতালাসে!
কিচেন থেকে ফের রমিলার তর্জন শোনা যায়, —কী করছ বলবে? তখন থেকে টেবিলে ঠাণ্ডা হচ্ছে ব্রেকফাস্ট। বাথরুম থেকে বেরিয়েছ সেই কোন যুগে !
ইরফানের খুব ইচ্ছে করল আজ বলেই দেয় সবটা। বলে দেয়, গত মাসেই সে চাকরিতে রেসিগনেশন দিয়েছে। নিয়ম মেনে রোজই বাড়ির বাইরে যাচ্ছে ঠিকই, তবে সে তো নিজের অন্য এক আস্তানায়। যার খবর রমিলা জানে না, জানবেও না কখনো।
আজ হয়ত বলেই দিত, তবে বেড়াতে যাওয়ার কথাটা মনে পড়তেই শেষমুহুর্তে জিভের ডগা থেকে ফিরিয়ে নিল শব্দগুলো। আজ সন্ধ্যায় ট্রেন ধরছে ওরা। যাবে দার্জিলিং থেকে সামান্য কিছুটা দূরের এক অফবিট ডেসটিনেশনে। কয়েকটা দিন কাটিয়ে তারপর ফেরা। গোটা পরিকল্পনাটাই রমিলার, তাই যাওয়া নিয়ে উচ্ছ্বাস ওরই সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে চাকরি ছাড়ার বিষয়টা বলে ওকে দুশ্চিন্তার অথৈ জলে ঠেলে দেওয়াটা নেহাতই নিষ্ঠুরতা।
ইরফান বারান্দার দিকের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নির্লিপ্ত জবাব দেয়, —বেরোতে দেরি আছে। সেকেন্ড হাফে মিটিং। তারপর আর কথা না বাড়িয়ে টেবিলে এসে বসে।
রমিলা মৃদু ধমক দেয়, —আশ্চর্য! আমি কি সেটা হাত গুনব! বললে পরেই দিতাম। এত অন্যমনস্ক থাকো আজকাল!
—ও, বলিনি না! ঠিক আছে… দিয়েছ যখন… অবশ্য হাতে একটু সময় নিয়েই বেরোব ভাবছি। একবার ব্যাঙ্কে যেতে হবে। সেই যে পুরনো একটা একাউন্টে তোমাকে নমিনি করলাম, কাল দেখি নামের বানানাটাই ভুল। শেষের ‘এ’ হয়ে গেছে ‘ও’।
—এত একাউন্ট! এত ব্রাঞ্চ! সব একটা জায়গায় কেন যে ট্রান্সফার করে নাও না!
কফির কাপে নিঃশব্দে অন্যমনস্ক চুমুক দেয় ইরফান, —তুমি সুবিধে মত করে নিও পরে।
— মানে? রান্না ঘর থেকে প্রায় সঙ্গেসঙ্গে মুখ বাড়িয়েছে রমিলা। ইদানীং ইরফানের কথায় বৈরাগ্যের সুর দেখলেই সে কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
ইরফান অপ্রস্তুত হয়ে কথা পাল্টায়, —বলছি জয়েন্ট একাউন্টগুলো ট্রান্সফার করে নেব তোমার সময় মত।
—তাই বললে?
—হ্যাঁ, তাছাড়া আর কী!
রমিলা পলকের জন্য থমকায়। একটা মুহূর্ত ভাবে। তারপর কিছুটা আশ্বস্ত হয়েই ফিরে গিয়ে বলে, —সময়ে ফিরো। ট্রেন সাড়ে সাতটায়, খেয়াল আছে নিশ্চয়।
একটা সুঘ্রাণ আসছে। ভাতের মাড়। সেই সুঘ্রাণ বুকে টেনে নিয়ে ইরফান অন্যমনস্ক গলায় প্রশ্ন করে, —আমরা শেষ কবে ‘ড্রিল’ দিয়েছিলাম?
রান্নাঘরে ছ্যাঁক করে একটা শব্দ হল। গরম তেলে কিছু পড়ল। তারপর একটানা খুন্তি নাড়ার শব্দ। ইরফান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর একই প্রশ্ন করে আবার, —রমি, শেষ কবে ‘ড্রিল’ দিয়েছিলাম?
রান্নাঘর থেকে তারস্বরে কেটেকেটে উত্তর দেয় রমিলা, —শুনেছি। আসছি।
ইরফান সুযোগ পেলেই ইদানীং রমিলাকে নিয়ে ‘ড্রিল’ দেয়। ইরফানের অবর্তমানে রমিলা কিভাবে ওদের যাবতীয় স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি গুছিয়ে রাখবে তারই এক কাল্পনিক প্রতিরূপ। কোথায় কোন একাউন্ট, কতটা বিনিয়োগ ইত্যাদি সংক্রান্ত সমস্ত খুঁটিনাটি রমিলাকে তখন তোতাপাখির মত মুখস্থ বলে যেতে হয়। মিউচুয়াল ফান্ড, শেয়ার, ইনস্যুরেন্স, পিপিএফ, বন্ড ইত্যাদির ঠিকুজিকুষ্ঠি। এছাড়া পৈতৃক ভিটেবাড়ির দলিল, ফ্ল্যাটের কাগজপত্র, ব্যাঙ্কের লকারে গচ্ছিত সোনাদানা। আগাপাস্তলা সবটার হিসেব নেয় ইরফান। মনঃপূত উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়ে না।
রমিলা কিচেন টাওয়েলে হাত মুছতে মুছতে টেবিলের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, —যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। অনেক কাজ ওদিকে।
ইরফান স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে চোখ তুলে তাকায়।
—হল কিছুদিন, গলায় ঝাঁজটা চেপে রেখে রমিলা মাথা নেড়ে বলে, — কিন্তু আজ অন্তত এসব পেড়ো না। এমনিতেই রান্না ঘরে কাজের অনেক ঝামেলা।
ইরফান জোর করে না। বেড়াতে যাওয়া নিয়ে রমিলা কতখানি এক্সাইটেড সেটা ও বোঝে। খামোকা সেটাকে স্পয়েল করবে না। তাই চোখ কুঁচকে কেবল মৃদু হাসে, — মনে আছে তো সব?
—আছে। কিন্তু আমার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে এসব আলোচনা।
—বিরক্ত লাগে বুঝতে পারছি, কিন্তু আলোচনাটা জরুরি। ধরে নাও অপরিহার্য।
এই ‘অপরিহার্য’ শব্দটা ইরফান এতটাই দৃঢ়স্বরে উচ্চারণ করে যে রমিতার নিটোল মুখে আশঙ্কার ছায়া
খেলে যায়। থমথমে গলায় সে বলে ওঠে, —আজকাল এত অন্যমনস্ক থাকো। বারবার এই ব্যাঙ্ক, কাগজ, দলিল এসবের প্রসঙ্গ তোলো… সব ঠিক আছে তো?
ইরফানের বলতে ইচ্ছে করে, —কিছু প্রশ্নের যেমন ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’য়ে উত্তর হয় না। তেমনই কিছু প্রশ্নের ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ এই দুটো উত্তরই প্রযোজ্য। রমি, তুমি ‘হ্যাঁ’ এর প্রত্যাশায় প্রশ্নটা করছ। কী লাভ উত্তর জেনে!
নিঃশব্দে খাবার খেয়ে চলে ইরফান, কফিতে চুমুক দেয়।
—কিছু বলছ না যে! আশঙ্কায় গলা দুলে যায় রমিলার।
তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়েছে ইরফান। ঝকঝকে হেসে বলে, — হ্যাঁ রে বাবা। সব ঠিক আছে।
—ঠিক তো?
—ঠিক।
রমিলা নিশ্চিন্ত হয়। আহ্লাদী গলায় বলে, —তাড়াতাড়ি ফিরছ তো আজ?
অকপট হেসে ঘাড় নাড়ে ইরফান।
রমিলা আর এক মুহূর্তও সময় খরচ করে না। আলতো হেসে লঘু পদক্ষেপে চলে যায় নিজের কাজে। রমিলাকে একটু অন্যরকম ভাবে আজকাল দেখে ইরফান। নাক চোখ ঠোঁট মিলিয়ে একটা মানুষের চেহারার যে যোগফল ঠিক সেরকম দেখা নয়। আভিজাত্যের লক্ষণ বা বুদ্ধির দীপ্তি খোঁজাও নয়। রমিলার মুখময় আজকাল কী যেন এক খেলা করে যায়। বর্ষার দিনে ঘন মেঘের যেমন স্নিগ্ধ ছায়া পড়ে মাটিতে খানিকটা সেরকম স্নিগ্ধতা। বেলা বাড়লে শীতের কুয়াশা কেটে গিয়ে মিঠে রোদের যে কবোষ্ণতা, কিছুটা সেরকমও। কিংবা এও হতে পারে, এসবই আসলে ইরফানের মনগড়া। তার ভিতরের সুপ্ত সন্ন্যাস হয়ত তাকে এসব দেখিয়ে পরীক্ষা করে। দেখতে চায়, এখনও কতটা লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে সে।
কফির মাগে শেষ চুমুকটা দিয়ে উঠে পড়ে ইরফান। একবার উঁকি মেরে দেখে মান্তু যথারীতি মোবাইলে মত্ত। উত্তেজনায় চকচক করছে ওর চোখ–মুখ। হয় মনস্টার নিকেশ করছে, নয়ত দুর্গম দুস্তর উপত্যকায় লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা। —আর কতক্ষণ চলবে মোবাইল! দূর থেকেই ছেলেকে ঈষৎ ধমক দেয়।
ধমক খেয়েই মোবাইল রেখে বাবাকে হাতের ইশারায় ডাকে মান্তু।
অন্য সময় হলে ইরফান হয়ত উচ্ছ্বাসে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরত। নাক ডুবিয়ে দিত ওর একমাথা চুলে। কিন্তু আজ নিজের ভিতরে তৈরি হওয়া এক কাঠিন্যকে আরও বেশি করে অনুভব করছে সে। ইরফান অটল থেকে নিরাসক্ত গলায় বলে, —আজ স্কুল যাও নি। খাতার কাজগুলো বিকেলের মধ্যে কমপ্লিট করবে, আমি এসে চেক করব কিন্তু। বলেই আর দাঁড়ায় না ইরফান। জুতোটা গলিয়ে দরজা টেনে দিয়ে সিঁড়িতে নেমে যায়।
সত্যিই তো, কী লাভ! সমস্ত সম্পর্কের ইমারতকে ধূলিসাৎ করে বেরিয়ে যেতে হবে তাকে। কোথায় যাবে জানে না, যেতে হবে সেটুকু কেবল জানিয়ে দেয় ভিতরের এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কণ্ঠস্বর।
সব শুনেটুনে সুখিলাল একটা প্রকাণ্ড শ্বাস ফেলে পার্কের বেঞ্চে শিরদাঁড়া ঠেকিয়ে শরীর ছেড়ে দেয়, —সে না হয় হল। কিন্তু কী এমন ঘটল যে, আপনাকেই গা ঢাকা দিতে হচ্ছে! আমার মতন বাহারওয়ালি রাখছেন না তো আবার ?
হাসে ইরফান, —তা জেনে আপনার লাভ ?
গা দুলিয়ে দুলিয়ে খুব হাসে সুখিলাল, —কিছু না ... এমনিই। পুরুষ মানেই খোঁচড় কিনা। অবশ্য সেসব হলেও, ও মামলা হ্যান্ডেল করে নেওয়ার জন্য আপনি একাই কাফি।
কথাটায় আর প্রশ্রয় দেয় না ইরফান। মুহূর্তের মধ্যে মুখ থেকে হাসি মুছে ফেলে প্রসঙ্গ বদলায়, —বেশ …তাহলে ধরে নিচ্ছি, আপনি রাজি। যবে যেখানে বলবো, করে দেবেন কাজটা। ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলা থাকবে। কয়েকটা পে-প্যাল, রেমিটলি, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নও রেডি থাকবে। তার ডিটেল আপনাকে দিয়ে দেব, সাথে ক্যাশ আর আমার কাজের জায়গার চাবি। এছাড়া কিছু অফসোর একাউন্টের ডিটেল এবং লিংকও পাঠিয়ে দেব সময়মত। আমার স্ত্রীয়ের নামে নকল কোম্পানি, ভুয়ো ফার্ম রেজিস্টার করে কাজটা শুরু করবেন। আর হ্যাঁ, লোটো বা লটারির অপশনটাও দেখতে পারেন। আপনি এগুলো ভালো বুঝবেন, আমি আর কী বলি। মোটকথা সবশুদ্ধ কাজটা তুলে দিচ্ছেন। এবং অপেক্ষাকৃত সেফ অপশনে। যাতে আমার স্ত্রীকে এতটুকু হ্যাপা পোয়াতে না হয়। তাতে কিছু বেশি দক্ষিণা লাগে, তাই সই। আপনার যা পারিশ্রমিক তাই দেওয়া হবে, প্রয়োজনে অনেকটা বেশি।
মন দিয়ে শুনতে শুনতে শেষের কথাটায় সুখিলাল ইয়া বড় জিভ কাটে, হাতজোড় করে। তারপর খুব সন্ত্রস্ত গলায় মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, —ছি ছি! এসব বলবেন না ! আপনার কাছে আমি ঋণী। কোন পরিস্থিতি থেকে কাদের হাত থেকে আমাকে বের করে এনেছিলেন, সে কী ভুলে গেছি! ফিজ পার্সেন্টেজ পারিশ্রমিক এগুলো আপনার জন্য নয়। বলতে বলতেই ইরফানের ডানহাত নিজের দুই করতলে চেপে ধরে সুখিলাল।
এই বলা এবং হাত চেপে ধরার মধ্যে যে সততা ও আন্তরিকতা রয়েছে সেটা টের পায় ইরফান। সে মানুষ চেনে। সুখিলাল তাকে ঠকাবে না। আর একান্তই যদি সেরকম কিছু ঘটে, তার ব্যবস্থাও ইরফান নেবে। তা সে বৈরাগ্যসাধনের যে স্তরেই থাকুক না কেন।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সুখিলাল, ছেদ পড়ল ভদ্রলোকের মোবাইল বেজে ওঠাতে।
এর আগে রমিলাকে হাতে গুনে এক দুবারই মিথ্যে বলেছে ইরফান। নিজের নিভৃত অজ্ঞাত ডেরাতে গেলেও জানিয়েছে, কাজে যাচ্ছি। রমিলা খুঁটিয়ে জানতে চাইনি কী কাজ। জেনেছে অফিসেরই কোনও দায় বা দায়িত্ব।
ইদানীং অবশ্য লাগাতার মিথ্যে বলতে হয়। মূলত চাকরি ছাড়ার পর থেকে। উপায়ই বা কী! বেশ কয়েকটা কাজ এবার তাকে গুটিয়ে নিতে হবে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রায়ই জানান দিচ্ছে, হাতে সময় আর বেশি নেই। কিছু একটা ঘটবে এবার। হয়তো ভিতরের সেই সুপ্ত সন্ন্যাস তেড়েফুঁড়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে, কিংবা মৃত্যুই হয়ত মুখোমুখি দাঁড়াবে হাতে অন্য এক দুনিয়ার ছাড়পত্র নিয়ে। কী একটা টানছে যেন ! ইদানীং নির্ঘুম রাত কাটে। শরীরে নয়, একটা অস্বস্তি শরীর ছাড়িয়ে নেমে যায় আরও অনেকটা গভীরে। দিনের আলোও আজকাল বড্ড অসহ্য মনে হয়। শব্দ গন্ধ স্পর্শ সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যই হঠাৎ করেই যেন চড়া কম্পাঙ্কে ধরা দিচ্ছে। শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ভিতরের এক প্রছন্ন সত্তা।
চাকরিটা ইরফান ছেড়েছে নেহাত ম্যানেজারের সাথে বচসার কারণে নয়, চাকরি ছেড়েছে সেই আভ্যন্তরীণ সত্তার ইন্ধনে। একটা প্রছন্ন সংকেত তাকে প্রস্তুত থাকতে বলছে। অবশ্য চাকরি ওর রুজিরুটির অবলম্বন কোনোদিনই ছিল না। বাস্তবিকই, সাইবার সিকিউরিটির এই কর্পোরেট গোলামি ছিল অর্থ উপার্জনের একটা লোক দেখানো ভড়ং মাত্র।
হয়তো এসব কোনোদিনই জানতে পারবে না রমিলা। জানলেও কতটা বুঝবে সন্দেহ আছে। ভুল বোঝারই সম্ভাবনা বেশি। অবশ্য ইরফান সংসার ছাড়লে এই প্রসঙ্গগুলোই তখন অপ্রাসঙ্গিক নেহাতই অবান্তর।
ছেড়ে যাওয়ার কাজটা বেশ কঠিন, ইরফান জানে। অবশ্য কাজটা ততক্ষণই কঠিন, যতক্ষণ না চৌকাঠের বাইরে প্রথম পদক্ষেপটা পড়ছে, তারপর কাজটা কি আর ততটাও কঠিন? এর উত্তর অবশ্য পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষ।
কিন্তু 'কবে যাবে' এই প্রশ্নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা — যাবে কোথায়! কোন মুলুকে। কার আশ্রয়ে। নেহাত রাস্তায় পড়ে থেকে সে যে মোক্ষ লাভ করবে না, এটুকু সম্যক জ্ঞান ইরফানের আছে। কিন্তু সেই অদৃশ্য শক্তি কি ওকে চালিত করবে অভিপ্রেত গন্তব্যের দিকে? প্রশ্ন একটা নয়, এক্ষেত্রে অনেকগুলো।
এই প্রশ্নগুলোই আজকাল ইরফানের মাথার ভিতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে দেয়। উত্তরের দিকে যতই ধাবিত হয়, যন্ত্রণার প্রকোপ ততই বাড়ে, আর বাড়ে মিথ্যার বোঝা।
এই যেমন আজ নিউটাউন যায় নি, তার বদলে এসেছে ঢাকুরিয়া লেকে। ওই যে সামান্য দূরে থলথলে নধর চেহারার মাড়োয়ারি মধ্যবয়স্ক গাঁকগাঁক করতে করতে মোবাইলে কথা বলছেন, উনি ইরফানের ক্লায়েন্ট, সুখিলাল। নামটা সত্তর আশির দশকের বড়বাজারের জাঁদরেল কারবারির মতো শোনালেও, ইনি কোনও গদির মালিক বা আড়তদার নন। জাতে মাড়ওয়ারি, তবে আপাদমস্তক বাঙালি। এঁর কাজের ধরণও কিছু ভিন্ন। একটা অফিস আছে দক্ষিণ কলকাতার এক কর্মব্যস্ত চত্বরে, তবে সেটা একটা কেমোফ্লেজ। এর আসল ব্যবসা অন্যত্র। এবং সর্বত্র। ব্যবসার ডালপালা সমগ্র পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা কোণাতেই ছড়ানো। ধুরন্ধর লোক। যোগাযোগের পরিধিও নেহাত কম নয়। মাঝারি আমলা ছোটখাটো মন্ত্রীর সাথেও দৈনিক ওঠাবসা।
সুখিলাল কালো দুনিয়ার এক নামজাদা মানি লন্ডরার। সোজা কথায় কালো টাকাকে সাদা বানানোর কারিগর। এ ব্যাপারে ওর জুড়িদার অন্তত পূর্ব ভারতে নেই। সুখিলালের আন্তর্জাতিক মারুকলে কালো টাকা ঢাললে, তা বেরিয়ে আসে সাদা হয়ে। বদলে সুখিলালের থাকে একটা পার্সেন্টেজ। মুনাফা সাংঘাতিক, তবে বিস্তর ঝক্কি ও ঝুঁকি।
কিন্তু প্রশ্ন হল, সুখিলাল ইরফানের ক্লায়েন্ট কীভাবে ? মানি লন্ডারিং এর-ই বা ওর প্রয়োজন পড়ছে কেন?
ইরফান যখন কলেজ ওয়েব সাইটের ব্যাক এন্ডে SQL Injection পাঠিয়ে তাদের ডেটাবেস থেকে রমিলার নাম্বার তুলে এনেছিল, তখন ওর বয়স মোটে সতেরো। কম্পিউটার সায়েন্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। স্নাতকের তৃতীয় বছরে বাংলার এক নামজাদা দৈনিক পত্রিকার ওয়েবসাইট হ্যাক করেছিল সে। আর মাস্টার্সের দ্বিতীয় বছরে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ অপারেটিং সিস্টেম বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল উপমহাদেশের দুঁদে কোডারদের।
কিছু মানুষ থাকে এরকম, এক একটা বৃত্তি যেন ছেলেখেলা হয়ে ওঠে তাদের কাছে। ইরফান তাদেরই প্রতিনিধি। চাকরি ওর পেশা নয়, একটা মুখোশ মাত্র। বাকি সময়টা সে তার রাজারহাটের স্টুডিও ফ্ল্যাটে ফ্রিল্যান্সিং করে। হ্যাকিং সংক্রান্তই নানাবিধ কাজ। ডার্ক ওয়েবে 'লিকড' হওয়া ইনফরমেশন সরিয়ে ফেলা থেকে স্ক্যামারদের চক্কর থেকে বের করে আনা, এমনকি চাইল্ড পর্ণ ওয়েবসাইট সম্পূর্ণ নির্মূল করা পর্যন্ত। এছাড়া বড় বড় বিদেশী সংস্থা ‘বাগ বাউন্টি প্রোগ্রাম’, ‘পেনিট্রেশন টেস্টিং’ এর কাজে ইরফানদের মতন হ্যাকারদের সাথে চুক্তি করে। বৈধ কাজ, তবে আয়ের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রাখতে হয় অবৈধ খাতে। ট্যাক্সের ভয়ে নয়, বেনামী থাকার সতর্কতায়। ডিজিটাল দুনিয়াতে কে কাকে কিভাবে নজরে রাখছে একথা বলা প্রায় অসম্ভব। অজ্ঞাতকুলশীল থাকাটাই একজন হ্যাকারের সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং আবশ্যিক শর্তও।
কখনো-সখনো কেউ কেউ নিজের ন্যুড ফটো বা ভিডিও সরিয়ে দেওয়ার বরাতও দেয়। অনেক ক্ষেত্রে পেমেন্ট হয় ক্রিপ্টোকারেন্সিতেও। অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও অনেকে ফরমায়েশি যোগাযোগ করেন। হরকিসমের আইন বহির্ভূত চাহিদা। স্ত্রী, বয়ফ্রেন্ড, বন্ধু, আত্মীয়, বাবা-মা — মানুষ হাঁটকে দেখতে চায় অন্য মানুষকে। কল লিস্টের ঠিকুজিকুষ্ঠি, মেসেজের ক্রমবর্ধমান যাতায়াত, এক একজন আবার হ্যাক করতে বলে বিশেষ মানুষের ওয়েব ক্যামকে। এসব কদর্য ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগান দেয় সে। মানুষ সংকুচিত হয়ে গেছে একটা চওড়া সার্চবারে। চেতন অবচেতন সবই বাধা পড়েছে হাতের মোবাইলে। তাতে পোয়াবারো ওদের মত হ্যাকারদের। আগে অবশ্য এসব কাজে ইরফানের রক্ত গরম হয়ে যেত, এখন অবশ্য একরকম বিবমিষা জাগে।
ইরফান ইচ্ছে করলেই ইশরো বা ডিআরডিও জয়েন করতে পারত, কিংবা সরকারের ডিজিটাল ফরেনসিক বিভাগে। তবে সেখানে দায়বদ্ধতার দরুন ডার্কওয়েবের সাথে যোগাযোগের সমস্ত সুতো কাটতে হত।
ইরফানের বেশির ভাগই বিদেশী ক্লায়েন্ট। আলেকালে ঠেকায় পড়ে ডার্ক ওয়েবে দু'একজন দেশি ক্লায়েন্টও যোগাযোগ করেন, তবে সে নেহাতই ব্যতিক্রম।
এই যেমন সুখিলাল, বছর দুয়েক আগের ঘটনা, তার মেয়ে গিয়েছিল পার্টিতে। তারপর যথাক্রমে ... মদ, ড্রাগ, নেশায় চুর হয়ে উদ্দাম যৌনতা। ৪৭ টা ওয়েবসাইটে ডিস্ট্রিবিউট হয়েছিল ভিডিওটা। পর্ণ সাইটে 'দেশি' ক্যাটাগরির শব্দবন্ধে ট্রেন্ড হতেও শুরু করে। সেই ভিডিওর ডিজিটাল সিগনেচার ধরে পুরো ওয়েব দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেয় ইরফান। যে ছেলেটি প্রথম ওয়েবসাইটে ভিডিওটা আপলোড করে, তার মোবাইলে স্পাইওয়্যার পাঠিয়ে অরিজিনাল ভিডিওটাকেও সরায়। এছাড়া একটা রুটিন watchdog প্রোগ্রাম রাখে, যাতে পরবর্তীকালে সেই ভিডিও আবার কোনও ওয়েবসাইটে আপলোড হলে, তার সিগনেচার ধরে রিপোর্ট হতে পারে। ঝক্কির কাজ, তবে নাওয়া খাওয়া ভুলে সুখিলালকে সেবার বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিয়েছিল ইরফান।
সেই সুখিলাল, ইরফানের প্রতি যার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই, ওই যে এগিয়ে আসছে কাঁচুমাচু মুখে।
মোবাইল পকেটে রেখে সুখিলাল একটু বিব্রত হয়ে বলে, —একটু সমস্যা হয়ে গেছে। একবার শালাবাবুর চেম্বারে যেতে হবে।
—কোনও খারাপ খবর?
— না না সেরকম কিছু না। ওই শালাবাবুর জায়গা জমি নিয়ে একটু সমস্যা চলছে। কাল বা পরশু কাইন্ডলি একটু আসুন না আমার ওদিকে। আরও ডিটেলে বসে কথা বলি।
ইরফান সামান্য ভেবে নিয়ে বলে, —কটা দিন থাকছি না, ফিরে এসে পরের উইকেন্ডে ফোন করছি।
সুখিলাল মাথা নেড়ে অমায়িক হেসে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়, —কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। এভরিথিং উইল বি অ্যারেঞ্জড।
সুখিলাল চলে যেতেই বুকভরে একটা দীর্ঘ শ্বাস নেয় ইরফান। গাঢ় শ্বাস প্রশ্বাসগুলোকেও আজকাল সে যেন অনুভব করছে অতিমাত্রায়। ওর সমগ্র অস্তিত্বটাই যে ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে উঠছে তাতে সন্দেহ নেই।
এটাই হয়তো সপরিবারে শেষ বেড়াতে যাওয়া। হয়তো কেন, এটাই শেষ! সে নিয়ে অবশ্য বিচলিত যতখানি, তার চেয়ে হাজার গুন উৎকণ্ঠা রয়েছে নিরুদ্দেশ পরবর্তী অধ্যায়ের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। যে ক্ষতিটা রমির হবে, যে বঞ্চনার শিকার হবে মান্তু, তার খেসারত হয় না। ইরফানের রেখে যাওয়া টাকা আরাম দেবে, নিদারুণ পীড়া থেকে মুক্তি দেবে কি! হয়ত ওদের দুজনই ইরফানকে খুঁজবে আঁতিপাঁতি, যতদিন না পর্যন্ত ইরফান নামটা একটা কনসেপ্টের মত শোনায়।
মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি! সব সন্ন্যাসের প্রেক্ষাপটেই কি কাছের মানুষের নিদারুণ চীৎকার লুকিয়ে থাকে না! বিবাগী হতে গেলে সবার আগে তো নৃশংসই হতে হয়।
নিজের রক্তের প্রবাহে সে যে এক সর্বগ্রাসী উন্নাসিকতাকে বয়ে নিয়ে চলেছে তা তো জানতই। দু দশক আগের এক সন্ধ্যায়, নিম ডাল থেকে নিজেরই যমজ ভাইকে ঝুলতে দেখে রচিত হয়েছিল এর পটভূমি। দুটো পেপার মিলিয়ে অংকে পাস মার্কস তুলতে না পেরে গলায় রশি নিয়েছিল ফারহান।
একটা মার্কশিট টপ করে গিলে ফেলেছিল আস্ত একটা মানুষকে।
ইরফানের মার্কশিট! ফারহান ফেল করেছে, ওদিকে জেলাতে প্রথম হয়েছে ইরফান। হৈচৈ, লোকজন, সাংবাদিক, হুলুস্থুল কান্ড।
ঈশান কোণে মেঘের একটা চাঙড় সেদিন থমকে ছিল প্রায় সারাটা দিন। সেই মেঘ সমগ্র আকাশ জুড়ে যখন বিভীষিকার মতন ভেঙে পড়ছে, তখন ঝড়ের মুখে গাছের ডাল থেকে বিপন্ন এক পাখির বাসার মত দুলছে ফারহান। ঝুলন্ত মরদেহ যেন এক অপার্থিব তৈলচিত্র। আকাশের প্রেক্ষাপটে বজ্রপাত যেন মুহুর্মুহু আগুন জ্বেলে দিচ্ছে। সেই নৈসর্গিক ক্যানভাসে ফুটে আছে তার ভাই। হাওয়ার দাপট, চীৎকার, কান্না। বৃষ্টির গরম ফোঁটারা অনুভূত হচ্ছে ঠোঁটে চোখে গালে। এসবের মধ্যেই ইরফানের চেতনায় ছড়িয়ে যাচ্ছে এক নৈর্ব্যক্তিক শূন্যতা।
মৃত্যুই ইরফানকে চিনিয়েছিল ওর ভিতরের প্রছন্ন বৈরাগ্যকে। ভিতরের সেই ভাবকে আগলে রাখাই ছিল ওর দায়িত্ব। এর পুঁজি করেই একদিন তাকে যেতে হবে নির্বাণের অভিমুখে। যে রাস্তা দিয়েই হাঁটুক না কেন, এই নির্ধারিত গন্তব্যকে খণ্ডাতে পারবে না সে, টলাতে পারবে না নিয়তির অব্যর্থ টিপকে।
সেই দায়িত্ব পালনে অবশ্য বিচ্যুতি ঘটেছে অনেকটাই। অপরাধ করেছে রমিলাকে কাছে টেনে। মান্তুকে পৃথিবীতে আসতে দেওয়াটাও হয়েছে মস্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। তাও সব পিছুটানকে মাড়িয়ে তাকে যেতেই হবে নির্বেদে। ততদিন এই চমৎকার অভিনয়ের যন্ত্রণামুখর পালা জারি রাখতেই হবে।
নিদ্রা আর তন্দ্রার মাঝের এক ঘুমপাড়ানিয়া এলাকায় দাঁড়িয়েছিল ইরফান। শরীরজোড়া এক ঝিমঝিমে অচেতনতার মাঝেই তীব্র আলোর একটা স্রোত ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বন্ধ দুচোখের পাতায়। সেই ধারালো আলোর বল্লম প্রাণপণে খুঁচিয়ে চলেছে, এক অখণ্ড ঘোর থেকে তাকে টেনে তুলতে। ওর সমগ্র চেতনা তাও বারবার ডুবে যেতে চাইছে আরও গভীর অনাবিল অসাড়তায়।
চোখমুখে একটা ঠাণ্ডা কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে ইরফান। স্বপ্ন? তাহলে এত শব্দ কেন? শব্দের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে টুকরো শব্দ। কণ্ঠস্বরে মিশছে একাধিক কণ্ঠস্বর। শব্দগুলো যেন খুব ধীর লয়ে চোঙা ফুঁকে কেউ পাঠিয়ে দিচ্ছে ওর কর্ণকুহরে, যেভাবে স্বপ্নের মধ্যে শব্দকে প্রত্যক্ষ করে মানুষ। কথা বলছে অনেকে একসাথে।
—এহঃ! ওই মেয়েমানুষটার ঘিলু বেরিয়ে গেছে রে!
— ইশ! বাচ্চা মেয়েটার নাড়িভুঁড়ি ঝুলছে দ্যাখ! মাথার অর্ধেকটা নেই।
—আরে ওদিকে হাতটা রাখ, লোকটাকে বের করব কীভাবে!
ইরফানের মুখমণ্ডল জুড়ে আবার সেই হিমশীতল স্পর্শ! শব্দ আর স্পর্শের যুগলবন্দীতে চেতনায় ফিরছে সে। মাথাটা এখনও সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেউ পাঁজাকোলা করে তুলছে ওকে, শুইয়ে দিচ্ছে মাটিতে।
ও এখন কোথায়? …ট্রেন! হ্যাঁ, ট্রেনে ছিল… তারপর…তারপর একটা প্রবল শব্দ ! সমগ্র অস্তিত্বটাই যেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। পৃথিবীটা দলে-পিষে লণ্ডভণ্ড হতে হতে কোথায় যে ছিটকে পড়ল সে।
ধীরে ধীরে চোখ খোলে ইরফান। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ঘুটঘুটে মেঘলা আকাশকে মাঝেমধ্যেই এপার ওপার চিড়ে দিচ্ছে বিদ্যুতের রেখা। সবটা ঠাওর হয় না। এটুকু বোঝে তার চোখ মুখ ভেজা। জলের ঝাপটা দিয়েছে কেউ। চারিদিকে জমাট অন্ধকার। বিক্ষিপ্ত কিছু আলো ইতিউতি ঠিকরে উঠছে।
একটু একটু করে নিজেকে ফিরে পাচ্ছিল ইরফান, মিলছে শরীরে একাধিক যন্ত্রণার খোঁজ। শরীর জুড়ে অজস্র ছেঁড়াকাটা। মাথা আর শরীরের বোঝাপড়া তখনও নির্ভুল হয়নি, তাও এটুকু বুঝছে, ট্রেন এক্সিডেন্ট করেছে! অনেক মানুষের চীৎকার। একটানা হৈচৈ। কান্নার শব্দ। আর্তস্বরে কারোর নাম ধরে ডাকছে কেউ।
খুব সাবধানে পাশ ফেরার চেষ্টা করছিল ইরফান। শরীর ঘুরল না, মাথাটাই কাত হল শুধু একপাশে। আর ঠিক তখনই একটা জোরালো বিদ্যুতের আলো আছড়ে পড়ল চরাচরের উপর। আর পড়তেই ওর সমস্ত অস্তিত্ব ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে।
একটার পর একটা বগি তছনছ হয়ে উল্টে আছে। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অজস্র মানুষের হাহাকার। কয়েকটা মুহূর্ত একটা দুঃস্বপ্নকে প্রত্যক্ষ করার মত স্তব্ধ হয়েছিল ইরফান, ঠিক তখনই মনে পড়ল ওরা বেড়াতে যাচ্ছিল। টিকিট একসাথে হয়নি। ও ছিল পরের কুপে।
রমি! মান্তু! শব্দদুটো ফ্যাসফ্যাসে গলায় উচ্চারণ করতেই ইরফানের হৃৎপিণ্ড দড়াম করে লাফিয়ে উঠেছে। রক্তে একটা বিধ্বংসী ঝড় শুরু হয়ে গেছে। পিঠে, মাথায়, বাঁ হাঁটুতে, ডান হাতের কব্জিতে প্রবল যন্ত্রণা। সেসব উপেক্ষা করেও বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় ইরফান উঠে বসল। শিথিল স্নায়ু টান টান হয়ে উঠছে। নিজেকে ফিরে পাচ্ছে সে।
ইরফান দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই হাঁহাঁ করে ছুটে এসেছেন এক ভদ্রলোক, —আরে কী করছেন! পড়ে যাবেন যে মশাই।
তোয়াক্কা না করে ইরফান উঠে দাঁড়ায়। ভদ্রলোককে সজোরে ঠেলে দিয়ে দু’পা এগোতেই শরীর টলে যায়, চোখে বন্ধ করে বসে পড়ে,ফের ওঠে, জিনে পাওয়া মানুষের মত একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে একটু একটু করে হেঁটে যায়। উদ্ভ্রান্তের মত তারস্বরে চীৎকার করতে থাকে, —রমি! মান্তু! রমি! মান্তু! রমিইইই…
আঁতিপাঁতি খোঁজ চালায় ইরফান। মাথা গলিয়ে দেয় ধ্বংসাবশেষের দুরূহ কোনাতেও। ঢুঁড়ে ফেলে গোটা চত্বর।
সময় এগোয়, বাড়তে থাকে লাশের সারি। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলা উৎকণ্ঠা নিয়ে ইরফান ঝুঁকে পড়ে খুঁটিয়ে দেখে থ্যাঁতলানো বিকৃত শরীরগুলোকে। উফ, কী মর্মান্তিক সে অনুভূতি! যেন হাড়িকাঠে মাথা পেতে রেখেছে, যে কোনও মুহূর্তে উদ্যত খাঁড়া নেমে আসবে।
মেঘলা আকাশে দিনের ঝাপসা ঘোলাটে আলো ফোটে। চোখেমুখে পঙ্গু ভিক্ষুকের আর্তি নিয়ে ইরফান ছুটে যায় এক একটা সক্রিয় সপ্রাণ ভিড়ের দিকে, বুকের মধ্যে রক্তের কল্লোল জাগে, পরক্ষণেই বুকভরা আশা ধক করে নিভে ম্লান হয়ে ওঠে। এখানেও নেই! তবে কী…
ইরফান দাঁড়াচ্ছে না একটা মুহূর্তও। তাড়স বাড়ছে আঘাতজনিত বেদনার। শরীরের দুঃসহ যন্ত্রণাকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে হারানোর আতঙ্ক। সম্ভব অসম্ভবের এক বিপজ্জনক পেন্ডুলামে ঝুলে আছে সে। সাংঘাতিক কিছু ভাবনা মাথার ভিতরের ঘোলা জলে খলবল করে উঠছে।
এই রুদ্ধশ্বাস খোঁজ চলতে চলতে ঠিক যখন ইরফানের মনে হচ্ছিল নিয়তি একেবারে পেড়ে ফেলেছে তাকে, তখনই একটা কণ্ঠস্বর অনেকটা দূর থেকে আর্তস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, —মান্তু, তোর বাবা!
ইরফান নিমেষে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
মান্তু আর রমি ছুটে আসছে একটা দুঃস্বপ্নকে দলিত মথিত করে। হাঁটু দুমড়ে মাটিতে বসে পড়েছে ইরফান, তার বুক ভরে উঠছে কানায়-কানায়, শিরশির করছে চোখের শিরা।
মান্তুকে বুকে জাপটে ধরতেই সে অনুভব করছে, তার ভিতরে আড়মোড়া ভাঙতে থাকা সেই সুপ্ত সন্ন্যাসটা আবার যেন গভীর ঘুমের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে।
প্রবল আশ্লেষে রমিকে জড়িয়ে ধরে তার গালে গাল ঠেকিয়ে ইরফান বলছে, —আমার আর যাওয়া হল না জানো!
—কোথায়?
ইরফান এর উত্তর জানে না। সে কেবল জানে এই না যাওয়াতে কোনও খেদ নেই, আছে শুধু জীবনের অভিপ্রায়।