এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  ইদের কড়চা  ইস্পেশাল

  • ইদ যাত্রার গল্প

    মুহাম্মদ সাদেকুজ্জামান শরিফ
    ইস্পেশাল | ইদের কড়চা | ৩১ মার্চ ২০২৫ | ১৩৪ বার পঠিত
  • অলঙ্করণ : রমিত


    ইদের মজা হচ্ছে ইদ আসি আসি করছে সেই মুহূর্তটা। এসে গেলেই তো গেল, শেষ! তাই আসি আসি সময়টাই সেরা। আর সে সময়টাতে সেরা মুহূর্ত হচ্ছে ইদের আগের রাত। যাকে বলে চান রাত। কী কাজে, কী ঝামেলায় যে রাত কত হয়ে যায় আল্লাহ মালুম। এই ঘড়ি দেখলাম আটটা, একটু পরেই দুম করে সাড়ে এগারোটা, আচ্ছা এবার উঠি উঠি করতে দেড়টা! আরে সকালে নামাজ আছে, বাড়ি চল...!

    এই সময়টা শুরু হয় আরও আগে, মানে আসি আসি করছে ইদ, কিন্তু লোকজন যার যার কাজে ব্যস্ত। মুহূর্তটা আসে হচ্ছে ছুটির ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে। ছাত্র অবস্থায় যখন প্রথম প্রথম ঢাকায় গেছি বা জীবনে প্রথম যে বার ইদের ছুটিতে বাড়ি ফিরছি, ওহ! সে কী উত্তেজনা! বাড়ি ফিরছি ইদে, এতদিন দেখে আসছি বড় ভাইয়েরা ফিরে, পাড়া প্রতিবেশীরা ফিরে, এবার আমার পালা। বাড়ি ফেরার মন্ত্র জানা নাই আমার। বিন্দুমাত্র চিন্তা করি নাই এখন বাসে চাপ থাকবে, টিকেট পাওয়া মুশকিল হবে। যখন আমার মনে হয়েছে টিকেটের কথা, সিট বুকিংয়ের কথা, তখন সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে, কোনো ভালো বাসে কোনো সিট নাই! এ আবার কী যন্ত্রণা, টাকা দিব, টিকেট কেটে বাসে উঠব, সিটে বসে বাড়ি ফিরব, এর মধ্যে এত প্যাঁচ কেন? শেষে লোকাল বাসে উঠেছিলাম। ঢাকা থেকে শেরপুর ১৯০ কিলোমিটার, এই পথ আসতে সময় লাগল মাত্র আট ঘণ্টা!

    তবে শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল। এই ভুল আর করি নাই। আগে থেকেই টিকেট, সিট সব বলে কয়ে রাখতাম। মুশকিল হচ্ছে আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন ঢাকা থেকে শেরপুর বাসের মান খুব খারাপ ছিল, দুই একটা বাসই ছিল কোনোমতে সার্ভিস দিয়ে যেত। নিয়মিত চলাচলের জন্য ওই সব বাসের লোকজনের সাথে খাতির তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মুক্তার ভাই নামে একজন ছিল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে বাস চলত একটা, তিনি এই গাড়ির সুপারভাইজার ছিলেন। এই মুক্তার ভাই আমাদের জন্য রহমত স্বরূপ আবির্ভূত হলেন। কোনো কারণে বুকিং না দিতে পারলেও সমস্যা নাই, বাস ছাড়ার আগে মহাখালীতে উপস্থিত হলেও হবে, মুক্তার ভাই ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নিয়ে যাবে আমাকে বা আমাদের মত শেরপুর শহরের যারা আছি তাদেরকে।

    প্রসঙ্গত বলে রাখি, মুক্তার ভাই এখন একজন আইনজীবী! তিনি এই গাড়ির সুপারভাইজারের চাকরির পাশাপাশি আইনে পড়তেন, একদিন পাশও করে ফেললেন, বার থেকে সনদও পেয়ে গেলেন। এখন রীতিমতো উকিল সাহেব! মাঝে মধ্যে দেখা হলে কথা হয়, দারুণ লাগে উনার এই সাফল্য।

    সে যাই হোক, ইদ যাত্রার গল্প বলছিলাম। আমি বাসে স্বস্তি খুঁজে পাওয়ার আগে আরও নানা কাণ্ড করেছিলাম। এর মধ্যে বড় কাণ্ড হচ্ছে ট্রেনে যাওয়ার চেষ্টা! যারা জানেন না তাদেরকে জানিয়ে দেই, ইদে ঢাকা থেকে ট্রেনে নিরুপায় না হলে আসা উচিত না। আপনি স্মার্ট মানুষ, ছুটি হিসাব করে একদম আপনার মনের মতো দিনে টিকেট কেটে বসে আছেন, কোনো সমস্যা নাই। বিপদ হচ্ছে আপনার মন মতো মানে হচ্ছে বহু মানুষের মন মতো। সেদিনই ছুটি হয়েছে অফিস। তিনটার মধ্যে বের হয়ে যাবেন অফিস থেকে, সাড়ে চারটায় ট্রেন। কী দারুণ না? কিন্তু না, এই প্ল্যান করলে আপনি মরছেন। কেন? কারণ হচ্ছে সবাই এই চিন্তাই করছে। ফলাফল হচ্ছে সবাই ট্রেনের সামনে হাজির। বাংলাদেশের গণ পরিবহনের সাধ্য নাই সবাইকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার। তাহলে উপায়? সবাই ট্রেনে করে যাবে বলে নিয়ত করেছে। ট্রেনে দাঁড়িয়ে, বসে কোনোমতে চলে যাওয়া যাবে, এই হচ্ছে নিয়ত। এই নিয়তের ফলে যা হয় তা হচ্ছে ট্রেনে পা ফেলার উপায় থাকে না। কমলাপুর থেকে ট্রেন ছাড়বে, আপনি ভাবছেন বিমানবন্দর থেকে উঠবেন! ঠাইত মারা যাবেন! ট্রেন আসবে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেন না। তাকিয়ে দেখবেন ট্রেন আর দেখা যায় না, জানালা, দরজা দিয়ে মানুষ উপচে পড়ছে, ট্রেনের ছাদেও জায়গা নাই, সেখানেও তিল ধরার জায়গা নাই। কষ্ট করে উঠে বসলেন, বুদ্ধি করে যে টিকেটটা কাটছেন সেই সোনার হরিণের কাছ পর্যন্ত আপনি এই জীবনেও পৌঁছাতে পারবেন না। মাঝে মধ্যে স্টেশনে থামলে নেমে জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখবেন যে ওই যে আপনার সিট, কোনো একজন ভুঁড়িওয়ালা সেই প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যেই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, যার কাঁধের উপরে একজন বসে আছে, পায়ের নিচে বসে আছে আরও দুইজন। যে জানালা দিয়ে দেখছেন সেই জানালায়ও একজন বসা, সে আপনার উঁকিঝুঁকি পছন্দ করছে না, ধমক দিয়ে হয়তো সরিয়ে দিবে আপনাকে! আপনি আবার দরজা ধরে ঝুলে গেলেন, ট্রেন চলবে, একদিন, ঠিক একদিন পৌঁছে যাবেন জামালপুর স্টেশনে!

    আমি করলাম সেই দুঃসাহসিক কাজটা। না, টিকেট কাটি নাই ট্রেনের। কারণ যে ট্রেনের টিকেট কেটে সিটে বসা যায় না, সেই ট্রেনের টিকেট কেটে লাভ কী? কমলাপুর থেকে এক বড়ভাই যাবে শেরপুর, তাকে বললাম, ভাই আপনে আমার জন্য জায়গা ধরে আসবেন, আমি বিমানবন্দর স্টেশন থেকে উঠব। আমি সেই চিল মুডে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্টেশনে বসে আছি, আমার কোনো চিন্তাই নাই, আমার জন্য জায়গা ধরে আসছে একজন কমলাপুর থেকে। বিমানবন্দর স্টেশনে গিজগিজ করছে মানুষ, তার মধ্যে আমার একবারের জন্য চিন্তা হচ্ছে না এর মধ্যে কিছু তো যাবে জামালপুর, এরা কই উঠবে, কীভাবে যাবে? তাদের চিন্তা তারা করবে, আমার তো এই সব নিয়ে ভাবনা নাই! ভাবনা শুরু হলো যখন ট্রেনকে আসতে দেখলাম! ও আল্লাহ গো! ট্রেন কই? আগাগোড়া ট্রেন দেখা যায় না, মানুষ আর মানুষ! তখন আমি ফোন দেয়া শুরু করলাম সেই বড়ভাইকে। তিনি ফোন ধরে বললেন, ঠ বগিতে আসো। বগির নম্বরও তো দেখা যায় না! আরেক মুশকিল না? আমি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছি তখন। কারণ এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না ট্রেন। এর মধ্যে আমাকে উঠতে তো হবে। একসময় পাইলাম ঠ নম্বর বগি। আবার ফোন, ভাই কই? আমি দেখছি একচুল জায়গা নাই বগিতে। এখন? তিনি বললেন মাঝামাঝি আসো। গেলাম, আবার ফোন, কই ভাই, যামু কেমনে? তিনি বললেন, আরে নিচে কী দেখো? উপরে দেখো! আমি উপরে তাকিয়ে দেখি ভাই আমার আরাম করে ছাদে বসে আছে, একটা ব্যাগ দিয়ে আমার জন্য জায়গা রেখেছে ছাদে!

    প্রবল রোমাঞ্চ লাগল মুহূর্তের জন্য, একটু পরেই ভয়ের একটা শিরশিরানি শুরু হলো। কিন্তু সময় নাই, যা করার এখনই করতে হবে। ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলাম উপরে, তিনি লুফে নিলেন। জানালায় পা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম, টান দিয়ে তুলে নিলেন ছাদে! আমার জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে শুরু হলো ঐতিহাসিক জার্নি! যতটা ভয়ের মনে হয়েছে ততটা ভয়ের না আসলে। ট্রেন একটা ছন্দে যায়, বাসের মতো হুট করে ব্রেক করে না, গতিও দুম করে ওঠে না, তাই ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা নাই। একটু ধাতস্থ হতেই চারদিকে নজর দেওয়া শুরু করলাম। ছাদ দেখলাম খুব উদার সব ব্যাপারেই। সবাই সবাইকে সাহায্য করছে, চিনে না জানে না, টান দিয়ে তুলে নিচ্ছে, কেউ চিৎকার করে বলছে, ব্যাগটা ধরেন ভাই, বলেই ছুঁড়ে মেরেছে। ধরা হচ্ছে সেই ব্যাগ। এক সময় কই থেকে জানি এসে হাজির হচ্ছে, এসে ব্যাগের মালিকানা দাবি করছে। ট্রেনের ভেতরে যেমন বাদাম, বুট, চানাচুর, মুড়ি চিঁড়া ভাজা বিক্রি হয়, এখানেও সব আছে, চলন্ত ট্রেনেই ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছে ফেরিওয়ালারা চিরুনি আর আলতা, পাউডার।

    একটু পরেই ট্রেনের ছাদের ব্যাকরণ জেনে গেলাম। গাছের ডাল আসলে সামনে থেকে চিৎকার করে জানিয়ে দেওয়া হয়, ডাল ডাল… সবাই শোনা মাত্রই বসা থেকে শুয়ে পড়ছে! কী যে উত্তেজনা! এদিক সেদিক হলে সর্বনাশ। সর্বনাশ দেখলাম আরেকটা, এর মধ্যেই তিন তাসের জুয়ার পার্টি চলে আসছে। তিন চারজনের একটা গ্রুপ। প্রতিটা বগিতে যাচ্ছে, নিজেরাই খেলা শুরু করছে, আর সমানে জিতছে একেকজন। এদের জিতার হার দেখে যেই মাত্র সাধারণ একজন খেলতে বসল, সেই মাত্র শুরু হলো ধরা খাওয়া। আমি দেখলাম প্রতি বগিতে ওরা দশ মিনিট করেও থাকে না। বসছে, হুটহাট নিঃস্ব করে দিয়ে চলে যাচ্ছে পরের বগিতে। আমাদের বগিতে আসতেই বললাম, কেউ খেইলেন না, কেউ জিতবেন না আপনেরা। কে শোনে কার কথা! একটু পরে ইস ইস, কী হইল বলার সময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি তাদের।

    আমি ছাদের যাত্রী না, চেহারায় সম্ভবত এটা লেখা আছে বা আমার পোশাক-আশাকে। কয়েকজন আনসার উঠছে ছাদে। টাকা নিচ্ছে সবার কাছ থেকে। কেন? কোনো কারণ নাই। নিচ্ছে, এতগুলো মানুষ মাগনা মাগনা যাচ্ছে ইদে বাড়ি, তারা ডিউটি দিচ্ছে, তাকে কিছু দিয়ে যাবে না? কিছুর মূল্য তারাই নির্ধারণ করেছে, ৫০ টাকা। এবার আমাদের বগির মানে বগির ছাদের লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি যেন কিছু একটা বলি, ধমক দিয়ে বলি যে কীসের টাকা? ছাদে আবার কীসের ভাড়া? আমার সাথের বড়ভাইয়ের দিকে তাকালাম, তিনি আমার ছাদ বিশেষজ্ঞ। তিনি আমাকে ইশারা দিলেন, আমি চুপ করে বসে রইলাম। আনসারও যথেষ্ট বুদ্ধিমান, তারা এদিকে আসল না। দেখি দেখি, টাকা দেন তো বলে বলে চলে গেল আমাদেরকে পার হয়ে।

    এদিকে আরেক ক্যাচাল। কী নিয়ে যেন তর্ক লেগে গেল আমার সাথের বড়ভাইয়ের সাথে আরেক লোকের। তুমুল তর্ক! আমাদের সাথে তর্ক করে কেউ পার পেয়ে যাবে? ছাড়মু নাকি হালারে? কিন্তু আমাদের দুইজনের ভয় হচ্ছে এই লোক তো জামালপুর পর্যন্ত যাবে না, পথে নামবে। এখন যদি নেমে লোকজন ডেকে আনে? আরও ভয় হচ্ছে যদি এই লোকের বাড়ি গফরগাঁও হয়? গফরগাঁওয়ের লোকজনের সাথে সম্ভবত সারা বাংলাদেশের কোনো এলাকার লোকজন লাগতে যাবে না। দেশের সবচেয়ে কুখ্যাত স্টেশন হচ্ছে গফরগাঁও। মনে আছে একবার আমি ট্রেনে আসছি জামালপুর থেকে, সিটে বসেই আসছি। গফরগাঁওয়ে আসার পরে সবাই ধুপ ধাপ জানালা লাগিয়ে দিচ্ছে! আমি তো বুঝতেছি না কী হচ্ছে। একজন আমাকে ধমক দিল, গফরগাঁও স্টেশন আসছে, আপনে জানলা লাগান না কেন? তাড়াতাড়ি জানলা লাগান! তো সেই গফরগাঁওয়ের লোক হলে রক্ষা আছে? তর্ক, ঝগড়া করে আমরা বসে আছি। বড়ভাই বলল শরীফ, ওর হাবভাব যদি দেখি লোকজন ডাক দিবে তাইলে ওরে কিন্তু ছাড়া যাব না, ছাড়লে কিন্তু আমরা শেষ। তুমি হাত, পাটা সামলায়ও, আমি ওর মুখ ঠেসে ধরমু, পরের স্টেশনে ছাইড়া দিমুনে! আজকে লিখতে বসে বুঝতে পারছি কী ভয়ংকর পরিকল্পনা করেছিলাম। লোকটা ট্রেনের ছাদের ঝগড়া বেশিদূর টেনে নেওয়ার ইচ্ছা রাখে নাই, তাই গফরগাঁওয়েই নিজের জিনিসপত্র নিয়ে চুপচাপ নেমে গেছিল। লোকটা যদি জানত তার জন্য কী পরিকল্পনা করে বসে আছি আমরা, তাহলে কাহিনি হয়ত অন্য রকম হত!

    শেরপুরে ট্রেন লাইন নাই। আজও নাই, কোনো কালেই ছিল না। আমরা জামালপুর নামি, সেখান থেকে শেরপুরে আসি সিএনজিতে বা অটোতে, বাসেও এক সময় আসা হত, তবে তা বহু আগের কথা। সেদিন জামালপুর নেমে বুঝলাম আকাম একটা করছি। চেহারা পুড়ে শেষ, ধুলাবালুতে চুল শেষ। কিন্তু যে উত্তেজনা, যে রোমাঞ্চ অনুভব করেছি, তা আজ পর্যন্ত ভুলি নাই। এরপরে শখ করে আরও কয়েকবার ট্রেনের ছাদে চড়েছি, আমার বন্ধু রনি থাকত রাজশাহী, আমার এই গল্প শুনে ও একবার ঢাকা আসল। দুইজনে মিলে ছাদে চড়ে বসেছিলাম। ব্যাকরণে ভুল করেছিলাম। দেখি ময়মনসিংহের পরে ছাদ ফাঁকা! কেমন যেন ভয় লাগা শুরু করেছিল। সারা ট্রেনের ছাদে কেউ নাই, আমরা দুইজন ছাড়া। যদিও পরে আর ভয় থাকে নাই। একটু পরেই জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। চাঁদ ছিল আকাশে, ধকধক করছে জ্যোৎস্না, যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ প্রান্তর। তখন সম্ভবত ফসল তোলা হয়ে গেছে, খালি মাঠ পড়ে আছে। দূর কোনো প্রান্তে কোনো গ্রাম আছে হয়ত, সেখানকার দুই একটা বাতির আভাস দেখা যাচ্ছে, দ্রুত চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে, সাথে রনির গলায় অসাধারণ গান...!

    ইদের ফিরতি গল্প কিন্তু এতো জমাট না। কারণ বাড়ি থেকে ফিরতে হচ্ছে, বাড়ির লোকজনই নিশ্চিত করত বাসের টিকেট। তাই ফেরার গল্প সব সময়ই নিরামিষ। ফেরার সময় এমনেই কলিজা ফেটে যায় অবস্থা, কে যায় কষ্ট করে ঢাকা? এরপরেও একবার এক কাণ্ড হয়ে গেল! আমার সাথে এলাকার এক ছোট বোন। রনির কথা বললাম, ওর গার্লফ্রেন্ড। আমরা দুইজন ঢাকা ফিরছি। সবচেয়ে ভালো বাসে সিট বুক দেওয়া। এই বাসওয়ালা করল একটা আকাম। ওরা ঢাকা থেকে এসে বুক টুক দেখে নাই, বাস স্ট্যান্ডে লোকে লোকারণ্য অবস্থা। দাঁড়াতেই সিট ফিলাপ, ওরাও দাঁড়ায় নাই, চলে গেছে অমনেই! আমি সময়ের একটু আগে ফোন দিয়েছি যে বাস আসছে, কখন ছাড়বেন? ওরা বলে, ভাই আমরা অলরেডি ময়মনসিংহ! আমি পড়লাম না বিপদে। এদিকে ওই মেয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে আসছে বাসস্ট্যান্ডে। এখন? বাড়ি ফিরে যাবো? তখন আমি চাকরি করি, আমাকে যেতেই হবে। আমি বললাম আমাকে যেতেই হবে, তুমি কালকে আসো। ও বলল না ভাই, আপনে যেমনে যাবেন আমিও অমনেই যাবো, বাড়ি আর ফিরে যাবো না আজকে। উপায়? উপায় হচ্ছে ভেঙে ভেঙে যাওয়া। সিএনজি দিয়ে গেলাম ময়মনসিংহে। সেখানে গিয়ে দেখি আমার মতো বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব মানুষ মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ডে এসে হাজির। যে বাসের টিকেট দিচ্ছে সেই বাস তখনও ঢাকায়ই, আসবে পরে নিয়া যাবে। সেই বাসের টিকেটও কিনতে হবে পৌনে এক মাইল লম্বা লাইন ধরে! আমরা সেই রাস্তায় গেলাম না। অন্য একটা বাস ডাকছিল, ঢাকা ঢাকা, চলেন! আমরা উঠে বসলাম। এবং ভুলটা করলাম আবার। বাস গেল ভালোই। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এসে ওদের মতি পরিবর্তন হয়ে গেল। লম্বা জ্যাম, অনেক দূর পর্যন্ত জ্যাম। ওরা হিসাব করল এই জ্যাম ঠেলে চৌরাস্তা পার হয়ে ঢাকা যেতে হলে কমসে কম আরও দেড় দুই ঘণ্টার বেশি লাগবে। ওরা করল কী বলে বসল, আমরা আর যাব না, গাড়ি এখানেই ঘুরবে! ওরা জানে ময়মনসিংহে প্রচুর যাত্রী আছে, আবার গেলে আবার বাস পূর্ণ করে চলে আসতে পারবে, তাই এই বুদ্ধি। আমি একা হলে তো চিন্তা করতাম না, সঙ্গে এই মেয়ে! জীবনে যত অ্যাডভেঞ্চারের শখ ছিল সব মিটে গেছিল আমার। রাত বাজে তখন দশটার উপরে, এখন আমি কেমনে কী করব? ইদের পরে ফিরছি, দুইজনেরই সাথে ম্যালা ব্যাগ-ট্যাগ। এইসব নিয়ে শুরু করলাম হাঁটা। দেড় দুই কিলোমিটার হেঁটে চৌরাস্তা পার হয়েছিলাম। এতগুলো ভারি ব্যাগ নিয়ে আমার জীবন শেষ। চৌরাস্তা গিয়েও অন্য কোনো বাস পাই না। পরে সাতশ টাকা দিয়ে সিএনজি ঠিক করলাম, ওই মেয়ের বাসায় পৌঁছে দেবে, মানে জিগাতলায়, চৌরাস্তা থেকে জিগাতলা, সাতশ টাকা! দিয়েছি এই কাফ্ফারা! এরপরে কানে চিমটি, এমন দায়িত্ব আর জীবনে নিমু না।

    এখন যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব হয়ে গেছে। আজকে যখন এই লেখা লিখছি, তখন সব দিক থেকেই খবর আসছে যে সবাই আরামেই বাড়ি যেতে পারছে এবার। লম্বা ছুটি একটা কারণ, সবাই এক সাথে রওনা দেয়নি এবার, তাই চাপ কম পড়েছে রাস্তায়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে বেশ কিছু এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়ে গেছে এর মধ্যে। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে এবার। বাসে বাড়ি ফেরার সময় যন্ত্রণাই ছিল এই জ্যাম। বাংলাদেশে এমন রেকর্ড আছে যে ইদের আগের দিন রওনা দিয়েছে, জ্যামের কারণে ইদের নামাজ রাস্তাতেই পড়েছে মানুষ! মানে ১৪/১৫ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগছে ঢাকা থেকে একজনের দিনাজপুর যেতে বা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম যেতে! এখন যমুনার উপর দিয়ে রেল সেতু হয়ে গেছে, যার কারণে ট্রেনেরও সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারছে মানুষ।

    মানুষ বাহবা দিচ্ছে শান্তির পায়রাকে, যেন সাত আট মাসেই এই রাস্তা, সেতু সব তৈরি হয়ে গেছে! দেশের মানুষের আইকিউ কম, সেই সাথে স্মৃতিশক্তিও কম। কী আর করা, তকদিরে আছে আমাদের এই, এর চেয়ে ভালো আর কী হবে?

    সবাইকে ইদের শুভেচ্ছা, ইদ মোবারক।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ৩১ মার্চ ২০২৫ | ১৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ৩১ মার্চ ২০২৫ ২১:৩১542029
  • হা হা উত্তর আর পশ্চিম ভারতে দেওয়ালীর সময় ট্রেনের এমন অবস্থা হয়। তবে মাথায় চড়তে হয় না অবশ্য। 
    ঈদ মোবারক।  
  • aranya | 2601:84:4600:5410:1932:5449:bf9f:***:*** | ৩১ মার্চ ২০২৫ ২১:৩৫542030
  • সুন্দর 
  • b | 117.238.***.*** | ০১ এপ্রিল ২০২৫ ২১:৩৯542045
  • কুম্ভমেলাতেও . 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন