অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ ও বলিদানের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো। বিশেষভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় বাংলাদেশের মহিয়সী জননীদের; যাঁদের আত্মত্যাগ সফল করেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। এঁদের মধ্যে জাহানারা ইমামের নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। জাহানারা ইমামের মতো আরো অসংখ্য জননী সেদিন এই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁদের সবার উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করলেন বাংলাদেশের লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদ। লেখাটি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলাম।বাংলাদেশের মহিয়সী জননীরা, আপনাদের উদ্দেশ্যে সন্তানদের সশ্রদ্ধ প্রণাম!
--------------------------------------------------------------------
কসবা উপজেলার কুল্লাপাথর নামে একটা জায়গায় ৫১জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার একটি সমাধিস্থল আছে। সেটা কিভাবে গড়ে উঠেছে জানেন? তারজাতুন নেসা নামের এক মা, ওঁর সুপুত্র ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম, তিনি তাঁর স্বামী আবদুল মান্নানকে নিয়ে সেই এলাকায় এবং এলাকার আশেপাশে যুদ্ধে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন ওদের মৃতদেহ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। এই দুইজন পিতামাতা সেইসব মৃতদেহ পরম যত্নে গোসল করিয়ে দাফন করতেন। মোট একান্ন জন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে পরম সম্মান ও মমতার সাথে সমাধিস্থ করেছেন এই নারী ও তাঁর স্বামী। এইভাবে গড়ে উঠেছে সমাধিস্থলটি।
আজ যখন আমি আম্মা জাহানারা ইমামের কথা স্মরণ করবো বলে ফেসবুক খুলে লিখতে বসেছি, কেন জানিনা আমার আরেক মায়ের কথা মনে পড়লো- তারজাতুন নেসার কথা। আম্মা জাহানারা ইমামের সাথে এমনিতে তাঁর কোন মিল খুঁজে পাবেন না। জাহানারা ইমাম ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত, আধুনিক, লেখক, সংগ্রামী। তারজাতুন নেসা নিতান্ত অজ পাড়াগাঁয়ের একজন নারী; হয়তো লেখাপড়া সেরকম কিছু করেননি। ওঁদের দুইজনের মিল কেবল একটি জায়গায়; ওঁরা দুইজনই মুক্তিযোদ্ধার জননী। কেবল একটা জায়গায় ওঁরা দুইজনই অনন্যা, মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ এই দুই নারীকেই আমাদের সকলের আম্মার আসনে বসিয়েছে।
জাহানারা ইমামকে স্মরণ করি। সারা বছর আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন, পেশগত কাজ, রাজনীতি, শিল্প সাহিত্য কতো কিছু করি- সবসময় জাহানারা ইমামকে স্মরণ করি না। কেবল বিশেষ দিন এলে তাঁকে আমরা মনে করি। আজ সেরকম একটি দিন, আজ আম্মার মৃত্যুবার্ষিকী।
কথাগুলি লিখতে লিখতে মনে হলো, আমাদের দেশের না জানি কতো মা আছেন যাঁরা নিজের কলজে কেটে দিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতার জন্যে। জাহানার ইমাম তো একদিম মুখ ফুটেই বলেছিলেন ওঁর পুত্র রুমিকে; "যা, তোকে দেশের জন্যে কোরবানি দিয়ে দিলাম।" মুখে বলে ফেলেছেন বটে, বলে সারাদিন সারারাত আম্মা কেঁদেছেন; "হায় হায়, এটা কি বলে ফেললাম।" তিনি লিখেছেন এইসব কথা তাঁর বইতে। পড়বেন আপনারা। বাংলাদেশে জন্মেছেন, বাংলায় পড়তে পারেন লিখতে পারেন, আর মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়ে জাহানারা ইমামের এই স্মৃতিকথাটা পড়বেন না, এটা কি করে হয়!
জাহানারা ইমাম ছিলেন বাংলাদেশের সকলের কাছে সেইসব মায়ের প্রতিনিধি, সেইসব মায়ের প্রতীক, যে মায়েরা ওদের বুকের ধন্য উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্যে। তারজাতুন নেসা বলেন বা জাহানারা ইমাম বলেন বা এইরকম আরও অসংখ্য মায়েরা যারা ছিলেন, কেউ কেউ এখনো আছেন, ওঁদের নিয়ে আমরা খুব বেশী কিছু বলি না, লিখি না, আলোচনা করি না। এটা তো আমাদের স্বভাবের মধ্যেই আছে- মহিমময়ী মায়েদের কথা আমরা আলোচনা করতে চাই না। এই মায়েরা তো কেবল পুত্রকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন সেটাই তো কেবল না, তরজাতুন নেসা পুত্রের যুদ্ধে শরিক হয়েছেন ভিন্নভাবে, জাহানার ইমাম পুত্রের যুদ্ধের একটি অসমাপ্ত কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
আমাদের এই জননীরা, আমার দেশের পবিত্র ভূমি যতদিন থাকবে, মাগো, এই মৃত্তিকায় মিশে থাকবে তোমাদের আঁচলের সুবাস। এই দেশের প্রতিটি বৃক্ষে যত পুষ্প বিকশিত হবে, সেগুলিতে মিশে থাকে তোমাদের হাসি। আমরা যখন 'মা তো বদনখানি মলিন হলে' বলে গাইতে গাইতে কাঁদি, আমরা তোমাদের কথা মনে করে কাঁদি। যতবার যতদিন আমরা মুক্তিযুদ্ধের রণহুংকার 'জয় বাংলা' চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ করি, আমরা তোমার জন্যে করি। যখন বিজয়ের অহংকারে আমাদের মাথা আকাশ ছাড়িয়ে যায়- তখনো আমরা জানি, তোমাদের সন্তান হওয়ার চেয়ে বড় অহংকার আর কিছু নয়।
জাহানারা ইমামের বিদায়ের এই দিনে তাঁকে স্মরণ করি- আমাদের আম্মা। তোমাদের চরণে রাখি হাজার সালাম গো মায়েরা।