“১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাস হইতে সঞ্জীবচন্দ্র-সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শনে’ ‘আনন্দমঠ’ ধারাবাহিকভাবে বাহির হইতে থাকে; ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য মাসে উহা সমাপ্ত হয়। ১২৮৯ সালেই (ইংরেজী ১৮৮২ খ্রীঃ) পুস্তকাকারে ‘আনন্দমঠের’ প্রথম সংস্করণ “কলিকাতা জনসন প্রেসে শ্রীরাধানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক মুদ্রিত” হইয়াছিল।” (বঙ্কিম-শতবার্ষিক সংস্করণ, আনন্দমঠ, (১৮৯২ খ্রীস্টাব্দে মুদ্রিত পঞ্চম সংস্করণ হইতে), সম্পাঃ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সজনীকান্ত দাস, দ্বিতীয় মুদ্রণ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, পৌষ ১৩৫৪, ভূমিকা) প্রথম সংস্করণে ছিল ১৯১ পৃষ্ঠা, ৫ম সংস্করণ ২১১ পৃষ্ঠায় সম্পূর্ণ হয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস আনন্দ মঠ পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশের (১৮৮২ সাল) প্রায় ১৫০ বছর পরে আজ নতুন করে একথা বলার প্রয়োজন নেই যে যে সামান্য কয়েকটি পুস্তক সময়ের সীমাকে অতিক্রম করে আসমুদ্র হিমাচলকে প্রভাবিত করেছে – বিশেষ করে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সংগীত বন্দেমারতম্ – শুধু ভারতে কেন, সমগ্র বিশ্বেই এর তুলনা মেলা ভার। James Campbell Ker-এর কথায় – “The greeting “Bande Mataram became the war-cry of the extremist party in Bengal; it was raised at political meetings to welcome the popular leaders and ... also occasionally as a shout of defiance of Eropeans in the street.” (Political Trouble in India 1907-1917, Calcutta, 1960, পৃঃ ৩০)
এমনকি ভারতের সর্বশক্তিসম্পন্ন শাসক দল বিজেপির X হ্যান্ডেলে আনন্দ মঠ-কে গৌরবান্বিত করে মন্তব্য করা হয়েছে –
উল্লেখযোগ্য, মুজফফর আহমেদের মতো সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত কমিনিস্ট নেতা তাঁর আমার জীবন ও ভারতের কমিনিস্ট পার্টি, ১৯২০-১৯২৯-এ বলছেন – তাঁর যৌবনকালে সন্ত্রাসবাদীরা আনন্দমঠ থেকে উদ্দীপনা সংগ্রহ করত এবং বন্দেমাতরম সঙ্গীতের প্রসঙ্গে প্রশ্ন রাখছেন যে একজন একেশ্বরবাদী মুসলিম যুবক কিভাবে এরকম বিগ্রহ-কেন্দ্রিক সঙ্গীত গাইতে পারে? তাছাড়া সন্ত্রাসবাদীদের এ আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী হলেও চরিত্রের দিক দিয়ে সাম্প্রদায়িক ছিল। এজন্য তিনি নিজেকেও এর থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। আহমেদ জানাচ্ছেন, ১৯২৩-২৪ সাল নাগাদ অনুশীলন সমিতি-র একজন বড়ো নেতা জেলে ঢুকে জেল অফিসে আদেশ করেছিলেন তাঁর সেলে দেবী কালীর ছবি টাঙ্গানোর জন্য। যদিও তিনি মুক্তকণ্ঠে জানিয়েছেন, শুধু হিন্দু যুবকেরা নয় মুসলিমরাও অতীতে একইভাবে অনেক হিন্দু-বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়েছে। কিন্তু মুসলিমদের আন্দোলন, আহমেদের মতে, অনেক বৃহৎ পরিসরে ছিল। কৃষক সমাজও এতে অংশগ্রহণ করেছিল।
পুলিস রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৯০৭ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ঢাকা জেলায় মুসলিমরা বিভিন্ন জায়গায় জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবকদের আক্রমণ করেছিল, যারা বন্দেমাতরম ধ্বনি দিচ্ছিল। ঐতিহাসিক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণে – “In the first two decades of the twentieth century we have occasional reports of Muslim opposition to Vande Mataram. In the 1920s what is new is a critique of Bankim and his works in ideological terms from the Muslim point of view.” (Vande Mataram: The Biography of a Song, Penguin Books, 2003, পৃঃ ২৬)
এই সংগীতের আনন্দ মঠ উপন্যাসে প্রবেশের কাহিনীও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ললিতচন্দ্র মিত্র তাঁর স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন, “বঙ্গদর্শন” পত্রের কার্যাধক্ষ্য রামচন্দ্র মহাশয়ের লক্ষ্য ছিল “বঙ্গদর্শনের” পৃষ্ঠা পূরণ করা। এজন্য বঙ্কিম গানটি লিখে “বঙ্গদর্শনের” পৃষ্ঠা ভরাট করলেন। বঙ্কিম এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন – “এ গানের মর্ম্ম তোমরা এখন বুঝিতে পারিবে না; যদি পঁচিশ বছর বাঁচিয়া থাক, তখন দেখিবে, এই গানে বঙ্গদেশ মাতিয়া উঠিবে। মহাঋষির এই ভবিষ্যদ্বাণী যে আজ সত্যে পরিণত হইয়াছে, তাহা আর কাহাকেও বুঝাইতে হইবে না।” (ললিতচন্দ্র মিত্র, ‘বন্দে মাতরম্’, বঙ্কিম-প্রসঙ্গ, সম্পাঃ সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, ১৯২২, পৃঃ ২৮৭) এই সংগীতটির বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা সুরারোপিত হয়েছে। সরলাদেবী চৌধুরাণী-র জীবনের ঝরাপাতা থেকে জানা যায় যে সরলাদেবী বন্দে মাতরম-এ সুরারোপ করে রবিমামাকে শুনিয়েছিলেন। তিনি গানটি পিয়ানোয় বাজিয়েছিলেন। রবিমামা খুশি হয়েছিলেন এবং গেয়েছিলেন। সম্ভবত এ সুরই অধুনা প্রচলিত বন্দে মাতরম সংগীতের সুর কাঠামো।
এ ঘটনাও ঐতিহাসিকভাবে জানা যায় যে “১৯৩৫-র ব্রিটিশের ভারত শাসন আইনে প্রদেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হলে বাংলায় প্রথম সরকার গঠন করে মুসলিম লীগ। সেই সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে এবং প্ররোচনায় মুসলিম লীগ নেতা মওলানা আকরম খানের নেতৃত্বে কলকাতার প্রকাশ্য রাজপথে শতশত কপি ‘আনন্দমঠ’ পোড়ানো হয়।“ আনন্দবাজার পত্রিকায় (১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৭) ‘আনন্দমঠের বহ্নি উৎসব’ প্রবন্ধে রেজাউল করিম লিখেছিলেন – “সেদিন বাংলার রাজধানী কলিকাতার বুকে লীগপন্থী মুসলমানদের মহতী সভায় বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত অথবা ‘কুখ্যাত’ পুস্তক ‘আনন্দঠে’র মহাসমারোহে বহ্নি উৎসব হইয়া গেল, সভ্য জগৎ স্তম্ভিত চিত্তে দেখিল, ভারতের একটি সুবৃহৎ নগরে, বহু শিক্ষিত এবং সাহিত্য সেবকের সম্মুখে এবং সম্মতিক্রমে এমন একটি অনাচার হইয়া গেল, যাহা বর্বরতায় মধ্যযুগের ধর্মান্ধ জ্ঞানবৈরীদের সমস্ত অত্যাচারকে ম্লান করিয়া দিল।” (রেজাউল করিম, বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ, কলকাতা, র্যাডিক্যাল, ২০১৪, পরিশিষ্ট, পৃঃ ৭৭)
শিক্ষিত ব্রিটিশ রাজপুরুষেরাও সমধর্মী মন্তব্য করেছিলেন শতাধিক বছর আগে। স্যার ভার্নে লভেট (Verney Lovett) লিখছেন – “Bande Mataram and other effusions of a more militant character were eagerly taken up by the masses of of Hindu youths who thronged the numerous schools and colleges in Bengal ... The whole agitation was Hindu, and was strongly resented by the muhammadans, who form the majority in Eastern Bengal, and had derived substantial and obvious advantages from the new arrangements. But the latter controlled no newspapers of importance, and had few orators to voice their wishes.” (A History of the Indian Nationalist Movement, New York, 1920, পৃঃ ৬৩) “বন্দে মাতরম” সংগীতের গুরুত্ব বুঝেছিলেন লভেট – “The novel contained a song which was adopted as a Marsellaise (ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত) by athe anti-Partitionists.” (পৃঃ ৬২)
শিশির কুমার দাস তাঁর A History of Indian Literature, Volume VIII, 1800-1910: Western Impact: Indian Response (দিল্লী, ১৯৬০) পুস্তকে মন্তব্য করছেন – “আনন্দ মঠ প্রাথমিকভাবে একটি ভালো সৃষ্টির নমুনা হিসেবে স্মরণে থাকবে না, থাকবে “as an example of narrative structure, which is particularly Bankim’s own, a combination of romantic and the realistic, a mixture of religion and politics ... where the dominant political trends of the time merged and were transformed into a myth.” (পৃঃ ২১৪)
বিমানবিহারী মজুমদার তাঁর Militant Nationalism in India: And Its Socio=Religious Background (1897-1917) (Calcutta, 1966) পুস্তকে জানাচ্ছেন – “Bankim Chandra Chatterjee’s Ananda Math is as much an epoch-making work as Rousseau’s Social Contract and Karl Marx’s Das Capital.” (পৃঃ ১৮১)
শিশির কুমার দাস তাঁর পূর্বোল্লেখিত পুস্তকে কতকগুলো ভাবনার যোগ্য পর্যবেক্ষণ রেখেছেন। সেগুলোকে আমার কথায় পরপর সাজালে এরকম হবে – (১) যে বছর (অর্থাৎ ১৮৮২ সালে) আনন্দ মঠ প্রকাশিত হয় সে বছরেই প্রথম হিন্দি উপন্যাস পরীক্ষা গুরু প্রকাশিত হয়, (২) আনন্দ মঠ সে ধরনের ঐতিহাসিক উপন্যাস যা অতীতের বিভিন্ন টুকরোকে একটি সূতোয় বাঁধতে চেষ্টা করেনা, বরঞ্চ ইতিহাসকে ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক লক্ষ্যে এবং এর মাঝে নতুন অর্থ প্রবেশ করানো হয়, (৩) “it ends tamely, declaring the importance and significance of the historical role of the British rule in India.”, (৪) তিনি কেবলমাত্র সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নানা খুঁটিনাটি পরিবর্তন করেছেন “to fit them into the activities of secret societies, about which he read in Italian history, but also incorporated contemporary materials, such as the exploits of Vasudev Balwant Phadke. What grew out was a political novel with far-reaching implications.”, (৫) বঙ্কিমের উপন্যাসের অতি-মানুষ (চিকিৎসক) হিন্দু ভারতের ব্যাপারে বলেছেন এবং উপন্যাসে বঙ্কিমের আখ্যানের মধ্য দিয়ে প্রায়শই মুসলমানদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে। (পৃঃ ২১৩)
লেখক আরও বলছেন, বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে ধর্ম এবং রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন – “This is the first Indian novel where the dominant political trends of the time merged and transformed into a myth”। (পৃঃ ২১৪)
শিশির কুমার দাসের বিশ্লেষণ থেকে আমরা একাধিক বিষয়ের সম্মুখীন হলাম। প্রথমত, ব্রিটিশ শাসনের আবাহনে উপন্যাস শেষ হয়েছে; দ্বিতীয়ত, ইতিহাসকে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক লক্ষ্যে; তৃতীয়ত, এর জন্য বঙ্কিম ইতিহাসের রূপান্তর ঘটিয়েছেন; চতুর্থত, বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের কার্যকলাপ এই উপন্যাসে ছায়া ফেলেছে; এবং পঞ্চমত, উপন্যাসের সামগ্রিক আখ্যান জুড়ে মাঝে মাঝেই মুসলমানদের প্রতি ঘৃণার বীজ বপন করা হয়েছে। আমরা এগুলো নিয়ে ধাপে ধাপে আলোচনায় আসব। শিশির কুমার দাসের বক্তব্য সমর্থিত হয় আরো একটি পর্যবেক্ষণ থেকে। ডঃ মণি কামেরকার এবং ডঃ এইচ এম ঘোড়কে তাঁদের লেখা “Militant Nationalist Movement in Maharashtra, 1876-191” প্রবন্ধে বলেছেন – “A surprising fusion occurred of the principles enunciated by Mazzini and those of Hindu philosophy.” (Compiled in Militant Nationalism in India, 1876-1947, ed. Amitabha Mukherjee, Calcutta, Institute of Historical Studies, 1995, পৃঃ ৯)
তবে এখানে একটি পর্যবেক্ষণ আমাদের কাছে চেতাবনি হিসেবে থাকা ভালো। বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের প্রামাণ্য জীবনীকার ভি এস যোশী মন্তব্য করছেন – “১৮৭৯ সালে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাসুদেব বলবন্ত তাঁর বিখ্যাত ইস্তাহার প্রকাশ করেছিলেন। এটা ছিল এরকম এক জোরদার দলিল যেখানে ভারতের অর্থনৈতিক শোষণের মূলে যে ব্রিটিশ নীতি তার বিরোধিতা করা হয়েছিল এবং দাবী করা হয়েছিল “natural rights” হিসেবে রায়তদের অর্থনৈতিক অব্যাহতি। (Vasudeo Balvant Phadke: First Indian Rebel against British Rule, বোম্বে, ১৯৫৯, পৃঃ ৬৫) এবং এই ইস্তাহারের কপি গভর্নর, কলেক্টর, আর অন্যান্য উচ্চপদস্থ ও সাধারণ সরকারি অফিসারদের কররমস্থল ও বাসভবনের গায়ে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। (পৃঃ ৬৬) আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, যোশীর ভাষ্যে, “The tremor of the political earthquake in the Deccan was now increasingly felt in London ... Citing the reports of the revolt in the British press, the Earl of Carnarvan asked the Secretary of State for India in the House of Lords: ‘Are the reports correct? ... Can the noble Viscount throw any light on the matter?” (পৃঃ ৮৭)
বাসুদেবের ঘোষণাপত্র এবং খোদ ভারত-ভাগ্য-বিধাতা ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে এর “রাজনৈতিক ভূমিকম্প”-র অভিঘাত সৃষ্টি হবার সঙ্গে আনন্দ মঠ-এর মূল সুরের পার্থক্য এখানেই যে বাসুদেব ব্রিটিশ অপশাসন এবং অর্থনৈতিক শোষণের অবসান এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক নিগর থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, যেখানে বঙ্কিমের উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনকে আবাহন করা হয়েছে। এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার বিষয়ে (অন্তত এ উপন্যাসে) কোন বক্তব্যই নেই।
কলকাতা থেকে ১৯১৭ সালে প্রথম প্রকাশিত জেমস ক্যাম্পবেল কার-এর Political Trouble in India, 1910-1917 গ্রন্থে কার (Ker) জানাচ্ছেন – “A work of fiction which exercised great influence over the Bengali revolutionaries was the novel entitled Ananda Math (The Abbey of Bliss) by Bankim Chandra Chatterjee...” (পৃঃ ২৯) এরপরে লেখক জানাচ্ছেন, আনন্দ মঠ-এর কাহিনী ১৭৭২ থেকে ১৭৭৪ পর্যন্ত বিস্তৃত তথাকথিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহের আদলে তৈরি। বলছেন – “বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে বন্দে মাতরম সঙ্গীতটি গাওয়া হত ... যদিও গানের শব্দগুলো যথেষ্ট নিরীহ কিন্তু এদেরকে ব্যবহার করা হত বিপ্লবের সাথে সংহতির এবং সরকারকে অগ্রাহ্য করার বাহ্যিক চিহ্ন হিসেবে।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০)
এমনকি আনন্দ মঠ-এর প্রভাব এত গভীর এবং সুদূরপ্রসারী ছিল যে, এ পুস্তক থেকে জানা যায়, ইতিহাস-বিশ্রুত পরম বীরত্বব্যঞ্জক বাঘা যতীনের দলের বিপ্লবী ছেলেরা আনন্দ মঠ-এর ‘সন্তান’-দের অনুসরণে নিজেদের নাম পরিবর্তন করে উপন্যাসের চরিত্র জীবানন্দ ইত্যাদি নাম গ্রহণ করেছিলেন। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৫)
এরকম আরও বহুসংখ্যক ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের একের পর এক সমাহার না করেও প্রায় সমস্ত পাঠকের মনে এ প্রশ্নটি আসা খুব অস্বাভাবিক নয় যে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে উপন্যাস হিসেবে আনন্দ মঠ এবং সঙ্গীত হিসেবে ‘বন্দেমাতরম’ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হবার আগেই জনমানসে দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ বেশ গভীরভাবে বপন করেছিল। নানা বিরুদ্ধ সাক্ষ্য হাজির করলেও বাঙলি জনমানসে জন্ম নেওয়া এ বিভাজন, অন্তত ১৯৪৭ পর্যন্ত, একটি গভীর দুরপনেয় ক্ষত তৈরি করেছিল – সম্ভবত তার দাগ এখনও ওঠেনি। এর পরোক্ষ প্রমাণ হল বিজেপি-র এক্স হ্যান্ডেলে আনন্দ মঠ-কে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞাপিত করা। এমনকি রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর History of Freedom Movement in India, Vol. 1 (কলিকাতা, ফার্মা কে এল এম, ১৯৬২)-এ বলছেন – “This aspect (pantheon worship) of Anandamath and the imagery of Goddess Kali leave no doubt that Bankim Chandra’s nationalism was Hindu rather than Indian.” (পৃঃ ৩০২)
এ হেন আনন্দমঠ নিয়ে আমরা আরেকবার আলোচনায় প্রবৃত্ত হলাম এ প্রবন্ধে। এ উপন্যাসে জন্মভূমিকে “মা” হিসেবে কল্পনা করে পুজোর আলোচনা রয়েছে। এ উপন্যাস প্রকাশের ৭ বছর আগে পুস্তকাকারে প্রকাশিত কমলাকান্তের দপ্তর –এও পুজোর প্রসঙ্গ এসছে। তবে সেটা হিন্দুদের দুর্গা পুজো। এপুজোর ধরণ থেকে আনন্দমঠ-এর পুজোর ধরন বদলে গিয়েছে। শাক্ত পুজো বৈষ্ণবদের পুজোয় রূপান্তরিত, যদিও কার্যত সে পুজোও শাক্ত পুজো। “হিন্দু জাতিকে স্বাধীন দেখিবার আকাঙ্খা বঙ্কিমের মনে কখনও নির্বাপিত হয় নাই ... তাঁহার ‘আনন্দমঠের শেষ দৃশ্যে বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে লইয়া গিয়েছে।” (বঙ্কিম-শতবার্ষিক সংস্করণ, আনন্দমঠ, পূর্বোক্ত, ভূমিকা)
পুজোর এরকম বিবরণ আনন্দ মঠ-এর বিশেষ পটভূমিতে ভিন্ন চরিত্রের পুজোয় রূপান্তরিত হয়েছে। সে আলোচনায় যাবার আগে যে ঐতিহাসিক পটভূমি অর্থাৎ উপনিবেশিক বাংলার সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হয়েছিল সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক।
লেখকেরা সময়ের সাথে নতুন চিন্তার সমাহারে – কখনো নান্দনিকতা, কখনো চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা, কখনো ইতিহাসের সাথে অধিকতর সমীপবর্তী করার জন্য – একই লেখার পরিমার্জনা করেন। নতুন নতুন সংস্করণ হয়, রচনাও বিভিন্ন সময়েই ভিন্নতর রূপ ধারণ করে – এটাই স্বাভাবিক রীতি এবং পরিণতি। বঙ্কিমের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা ঘটেছে স্বাভাবিক নিয়মেই।
তথ্যের আলোকে আলোচ্য উপন্যাসের বিষয়ে দু-একটি প্রাথমিক বিষয় বলে নেওয়া যাক। বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত উপন্যাসের পাঠ এবং শেষ সংস্করণের পাঠান্তর তুলনা করলে ২৫৯ ক্ষেত্রে পাঠভেদ দেখা যায়। (অপর্ণা ভট্টাচার্য, বঙ্কিম-উপন্যাসের মূল রূপ ও রূপান্তর, ২০১৮, পৃঃ ২৮৩) আরও গুরুত্বপূর্ণ হল – “ইংরেজকে শ্ত্রুরূপে দেখাতে চাননি বলে এবং বিদ্রোহের ইঙ্গিত রচনায় রাখতে চাননি বলেই এই পরিবর্তনটুকু করেছেন (পঞ্চম সংস্করণের ভূমিকা প্রসঙ্গে)।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৭) লেখকের বয়ানে – “বঙ্গদর্শনে আমরা যে ‘আনন্দমঠ’কে পেয়েছি এবং সেখান থেকে যেসব আমরা উপরে উদ্ধৃত করেছি ও পরে যা শেষ সংস্করণে বর্জিত হয়েছে তার মধ্যে ইংরেজের প্রতি বঙ্কিম বিদ্বেষসূচক কোনো মনোভাব পোষণ করেছেন এমন কথা বলা যায় না।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১৮)
চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিশ্রমী গবেষণার ফসল আনন্দ মঠঃ উৎস সন্ধানে-তে (আনন্দ, ২০০৮) বন্দ্যোপাধ্যায়ও অনেক পরিবর্তনের নমুনা তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে একটি হল সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংক্রান্ত তথ্য। আপাতত আমরা শুধুমাত্র এ বিষয়টিতে সীমাবদ্ধ থাকছি। চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুস্তক থেকে জানতে পারছি, দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) প্রকাশিত হবার পরে অনেকে জানতে চেয়েছিলেন “ঐ গ্রন্থের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি না। সন্ন্যাসি-বিদ্রোহ ঐতিহাসিক বটে, কিন্তু পাঠককে সে কথা জানাইবার বিশেষ প্রয়োজনের অভাব।” আনন্দ মঠ-এর প্রথম দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়ে যাবার পরে তৃতীয় সংস্করণের ‘বিজ্ঞাপনে’ বঙ্কিম লিখলেন, “এবার পরিশিষ্টে বাঙ্গালার সন্ন্যাসী বিদ্রোহের যথার্থ ইতিহাস উদ্ধৃত করিয়া দেওয়া গেল।” তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে Gleig’s Memoirs of the Life of Warren Hastings এবং Hunter’s Annals of Rural Bengal এই বই দুটি থেকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংক্রান্ত অংশ উদ্ধৃত করে দেওয়া হল। (আনন্দ মঠঃ উৎস সন্ধানে, পৃঃ ২৬)
এখানে একাধিক ঐতিহাসিক প্রমাদ আছে। বঙ্কিমের সন্ন্যাসীরা ব্রাহ্মণ কায়স্থের ছেলে এবং চৈতন্যদেবের মতো সত্ব গুণ সম্পন্ন বৈষ্ণব নয়, তমো গুণবিশিষ্ট বৈষ্ণব। উদাহরণ দেওয়া যাক। আনন্দ মঠ-এর প্রথম সংস্করণে সত্যানন্দ এবং মহেন্দ্রর কথোপকথন এরকম –
“সত্য। সন্তানেরা বৈষ্ণব ...
মহে। বৈষ্ণবের অহিংসাই পরম ধর্ম্ম।
সত্য। সে চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব। নাস্তিক বৌদ্ধধর্ম্মের অনুকরণে যে অপ্রকৃত বৈষ্ণবতা উৎপন্ন হইয়াছিল, এ তাহারই লক্ষণ। প্রকৃত বৈষ্ণবধর্ম্মের লক্ষণ দুষ্টের দমন, ধরিত্রীর উদ্ধার ... চৈতন্যদেবের বৈষ্ণবধর্ম্ম প্রকৃত বৈষ্ণধর্ম্ম নহে – উহা অর্ধেক ধর্ম্ম মাত্র ... আমরা উভয়েই বৈষ্ণব – কিন্তু উভয়েই অর্দ্ধেক বৈষ্ণব। কথাটা বুঝিলে? ...” (প্রথম খণ্ড, একবিংশ পরিচ্ছেদ, পৃঃ ৮২-৮৩) এ কথোপকথনের পরে সত্যানন্দ সত্ব, রজঃ এবং তমোগুণ নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সন্তান সম্প্রদায় যে তমোগুণের উপাসনা করে সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। সত্যানন্দের এ পরিচ্ছেদের শেষ উক্তি – “আমরা রাজ্য চাহি না – কেবল মুসলমানেরা ভগবানের বিরোধী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।”
যে কোন পাঠক সাধারণ কৌতুহলবশে এখানে প্রশ্ন করতে পারে, ইংরেজরা কি ভগবানের উপাসক? বরঞ্চ ইতিহাস তো একেবারেই বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। খ্রিস্টানরা প্রবলভাবে পৌত্তলিকতা বিরোধী ছিল এবং তাদের ধর্মাচরণ কিছু ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ।
সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের ব্যাপারে বলার কথা, অন্তত ১৬শ শতাব্দী থেকে উত্তর, পশ্চিম ভারত এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে ফকির (সাধারাণত মুসলিম), সন্ন্যাসী (ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের সংঘবদ্ধ লুঠেরা বাহিনী) এবং নাগা সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র বাহিনী বিহার, বাংলা, ওড়িশা, এলাহাবাদ, কাশী, ভোজপুর, উজ্জ্বয়িনী প্রভৃতি অঞ্চলে ফকির-সন্ন্যাসীর বেশে রীতিমতো লুঠতরাজ চালাতো এবং বিভিন্ন সময়ে জায়গিরদার বা জমিদারদের ভাড়াটে বাহিনী হিসেবেও কৃতবিদ্য ছিল। এরা ছিল শাক্ত। সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের বিস্তৃত ঐতিহাসিক বিবরণের জন্য যামিনী মোহন ঘোষ-এর পরিশ্রমধন্য গবেষণা গ্রন্থ Sannyasi and Fakir Raiders in Bengal (Calcutta, 1930) অবশ্যপাঠ্য। লেখক জানাচ্ছেন – “Entering Bengal by about the same route as the Sannyasis as far as the north of the Purnea district, the Fakirs went south towards Dinajpur and Malda districts. In the former district lies the shrine of Nek Mardan, Dinajpur a Muhammadan Pir or saint, where a fair is held in his honour on the first day of the Bengali year. There are other places of pilgrimage in the Dinajpur district such as the tomb of Pir Badar-ud-din near Hemtabad, and the monument of Mullah Ala-ud-din near Damdama.” (পৃঃ ২৭) আরও জানা যায় – “From the description of the Naga Sannyasis (Giri Sect of Sannyasis) given above, it would appear that the caste, system peculiar to the Hindu religion found a place even in the ascetic orders of the religion and the fighting castes amongst the various orders of Sannyasis bore the generic name of Naga although they kept the surname of the order.” (পৃঃ ১৯) অর্থাৎ এদের মধ্যে জাত বিভাজনও প্রবলভাবে ছিল। সশস্ত্র সন্ন্যাসীদের একটি ছবি নীচে দিচ্ছি। (সৌঃ Sannyasi and Fakir Raiders in Bengal )
মন্বন্তরের সময়কালে সরকারি সৈন্যদের ওপরে সন্ন্যাসী-ফকিরদের আক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে যায় – “The raiders continued their attacks during the next cold weather and several detachments of Pargana sepoys under Lieut. Keith were despatched to Rangpur against them. They were cut off and Lieut. Keith was killed in action in December, 1769, on the borders of Morung.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০)
উইলিয়াম হান্টার-এর The Annals of Rural Bengal, Vol. 1 (লন্ডন, ১৮৬৮)-এও সন্ন্যাসী-ফকিরদের আক্রমণের বর্ণনা রয়েছে – “A month later, the banditti had grown to ‘near a thousand people,’ and were preparing for an organized invasion of the lowlands. Next year we find the freebooters firmly established in Beerbhoom; strong positions occupied by their permanent camps; the hereditary prince unable to sit for an hour on his state cushion, much less to appear in the field; the public revenue intercepted on its way to the treasury, and the commercial operations of the company within the district at a stand.” (পৃঃ ১৫)
এখানে আরেকটি তথ্য আমাদের গোচরে থাকা ভালো। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশেরা সমগ্র ওড়িশা এবং বাংলার সুবেদারি পেলেও বীরভূম সহ কিছু অঞ্চল তখনও মুসলিম শাসনাধীন ছিল। এ অঞ্চলের আঞ্চলিক শাসক ছিলেন মহম্মদ রেজা খান। এর ফলে বীরভূমকে ঘটনাস্থল হিসেবে দেখানো এবং অত্যাচারী শাসক হিসেবে মুসলিমকে চিহ্নিত করা বঙ্কিমের পক্ষে সহজ ছিল (যদিও আননদ মঠ-এর পরবর্তী সংস্করণগুলোতে বিদ্রোহের স্থানকে উত্তরবঙ্গে সরিয়ে নিয়ে যান, তবে এটা ঘটে প্রথম দুটি সংস্করণের পরে)।
১৯৬৬ সালে প্রথম প্রকাশিত সুপ্রকাশ রায়ের ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম-এ ‘সন্ন্যাসী’ বিদ্রোহীদের যে কেবলমাত্র হিন্দু পরিচায় ছিলনা, এতে নিপীড়িত মুসলিম কৃষক এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ও অংশগ্রহণ করেছিল সে বিষয়ে বিপুল পরিমাণ সরকারি দলিল-দস্তাবেজের ভিত্তিতে তাঁর পর্যবেক্ষণ – “এই সংগ্রামে যাহাতে দেশের সকল শ্রেণী, এমন কি জমিদারগণও বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহার জন্য বিদ্রোহের নায়কগণ, বিশেষত মজনু শাহ, একান্তভাবে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই চেষ্টার ফলে ইংরেজ বণিকদের ও ইংরেজ সরকারের বহু দেশীয় কর্মচারী বিদ্রোহীদের সাহায্যে অগ্রসর হইয়াছিল, এমনকি তাহাদের অনেকে চাকরি ছাড়িয়া বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়াছিল।” (পৃঃ ৩৪) অধিকন্তু, “ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ও তাহার সমর্থকগণ প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছে যে, বিদ্রোহীরা ‘জনসাধারণের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করে ও জনসাধারণের উপর উৎপীড়ন করে।” কিন্তু ইহা যে মিথ্যা তাহার প্রমাণ ইংরেজ কর্মচারীদের চিঠিপত্র হইতেই পাওয়া যায়।” (পৃঃ ৩৫)
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বিস্তৃত বিবরণের জন্য ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পুস্তকের ২০ থেকে ৫২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নিয়ে হান্টার-এর গ্রন্থ তো রয়েছেই, এছাড়াও অসংখ্য গবেষণা গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ রয়েছে। এ প্রবন্ধের পাঠকদের একটি বড়ো অংশ এসমস্ত লেখার সাথে বিলক্ষণ পরিচিত। ফলে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার কোন প্রয়োজন অনুভব করছি না।
হান্টার জানাচ্ছেন ১৭৬৯ সালের শীতে যে দুর্ভিক্ষ বাংলাকে ছারখার করে দিয়েছিল তা পরের দু প্রজন্মেও সারিয়ে তোলা যায়নি। তাঁর বর্ণনায় – “At an early period of the year pestilence had broken out. In March we find smallpox at Moorshedabad, where it glided through the Viceregal mutes, and cut off the Prince Syfut in his palace. The streets were blocked up with promiscuous heaps of the dying and dead. Interment could not do its work quick enough; even the dogs and jackals, the public scavengers of the East, became unable to accomplish their revolting work, and the multitude of mangled and festering corpses at length threatened the existence of the citizens.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৭)
স্মল পক্স তথা বসন্তের বর্ণনা বঙ্কিমের উপন্যাসেও আছে। “রোগ সময় পাইল, জ্বর, ওলাউঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষতঃ বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখেন না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকামধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া ভয়ে পলায়।” (আনন্দ মঠ, প্রথম সংস্করণ, পৃঃ ৫)
দুর্ভিক্ষের সময়ে “Honest John Shore” নামে পরিচিত একজন অল্পবয়সী সৎ রাজপুরুষ তথা সিভিল সার্ভেন্ট বাংলার শাসনব্যবস্থায় যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে প্রায় ৪০ বছর বাদে তখনও দুর্ভিক্ষের টাটকা স্মৃতি নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সে কবিতা তখনকার পরিস্থিতি বোঝার জন্য এখনও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
Still fresh in memory's eye the scene I view,
The shrivelled limbs, sunk eyes, and lifeless hue;
Still hear the mother's shrieks and infant's moans,
Cries of despair and agonizing groans.
In wild confusion dead and dying lie; —
Hark to the jackal's yell and vulture's cry,
The dog's fell howl, as midst the glare of day
They riot unmolested on their prey!
Dire scenes of horror, which no pen can trace,
Nor rolling years from memory's page efface. (Memoir of the Life and Correspondence of John Lord Teignmouth. By His Son Lord Teignmouth, Vol. 1, London, 1843, পৃঃ ২৫)
বঙ্কিম দুর্ভিক্ষের বর্ণনা দিয়েছেন – “জোতজমা বেচিল। তার পর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তার পর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কেনে? খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাষ খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া, রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।” (প্রথম সংস্করণ, প্রথম খণ্ড, প্রথম অধ্যায়, পৃঃ ৪-৫)
দুর্ভিক্ষে কতজন মারা গিয়েছিল? কার্যত এ প্রশ্ন অবান্তর। কোন হিসেবে অন্তত দেড় কোটি মানুষ, কোন হিসেবে বাংলার এক তৃতীয়াংশ, কোন হিসেবে এক পঞ্চমাংশ মানুষ মারা গিয়েছিল। বঙ্গভূমি শ্মশানে রূপান্তরিত হয়েছিল। এবং পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাংলার পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৮৯৩)-এর মতোই এটাও সম্পূর্ণ মনুষ্যসৃষ্ট ছিল।
গ্লেইগ তাঁর পুস্তকে লিখছেন – “The loss of life occasioned by this calamity was fearful; it has even been estimated at one-third of the population of the province; and the detriment to the revenue, which depended always on the results of the harvest, fully kept pace with it.” (G. R. Gleig, Memoirs of the Life of the Right Hon. Warren Hastings, Vol. I, London, 1841, পৃঃ ২০৭)
পরবর্তীতে গ্লেইগ জানাচ্ছেন – “the lands had suffered unheard of depopulation by the famine and mortality of 1769. The collections, violently kept up to their former standard, had added to the distress of the country, and threatened a general decay of the revenue, unless immediate remedies were applied to prevent it.” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৯)
এ কথাও জানা যাচ্ছে, মহম্মদ রেজা খানের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলো ছিল – (১) দুর্ভিক্ষের সময়ে চালের বিক্রির ব্যাপারে একচেটিয়া অধিকার রক্ষা করা, এবং (২) টাকা তছরুপ করা। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৮৩)
(বাংলায় বিবরণটি বঙ্কিম-শতবার্ষিক সংস্করণ, আনন্দমঠ, যদুনাথ সরকারের “ঐতিহাসিক ভূমিকা” থেকে গৃহীত। ইংরেজি বিবরণ পূর্বোক্ত Memoirs of the Life of the Right Hon. Warren Hastings থেকে সংগৃহীত)
আমরা ওপরে শিশির কুমার দাসের বিশ্লেষণে আনন্দ মঠ রচনার ক্ষেত্রে বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের প্রচ্ছন্ন প্রভাবের একটি ইঙ্গিত দেখেছিলাম। বিমানবিহারী মজুমদার তাঁর প্রাগুক্ত পুস্তকে এ নিয়ে বেশ খানিকটা বিশদে আলোচনা করেছেন। তাঁর যুক্তিক্রম পরপর সাজালে এরকম – (১) ফাড়কের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় নভেম্বর, ১৮৭৯ সালে এবং বঙ্কিম তাঁর আনন্দ মঠ রচনা শেষ করেন ১৮৮০ সালে, (২) যে “immediate cause” ফাড়কের মধ্যে শপথ (‘destroying the English’)-এর জন্ম দিয়েছিল তার কারণ ছিল পশ্চিম ভারতের ১৮৭৬-৭৭ সালের ভয়াবহ বন্যা এবং নিরাশ্রয়, নিরন্ন মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা – “The spectacle of their sad plight confirmed Wasudev in his belief that all that evil was a direct consequence of a foreign rule; and he decided to end the rule as quickly as possible.”, (৩) ফাড়কে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তোলার জন্য সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। ফাড়কে গভীরভাবে ধার্মিক ছিলেন এবং মানুষের মুক্তির জন্য ব্রিটিশের হাতে জীবন উৎসর্গ করতে উদগ্রীব ছিলেন। মজুমদার মন্তব্য করছেন – “The Santanas of Ananda Math bear a resemblance to Phadke than the Sannyasis of the Insurrection who went about naked.”, (৪) ফাড়কে তাঁর আত্মজীবনী্তে যেমন বলেছেন সেরকম আনন্দ মঠ-এও (অষ্টম অধ্যায়) সন্ন্যাসীরা সরকারের ট্রেজারি লুঠ করে। কার্যত এ ঘটনা ফাড়কের অসমাপ্ত আকাঙ্খার প্রতিফলন, (৫) আনন্দ মঠ-এর অষ্টাদশ অধ্যায়-এ জেল ভেঙ্গে বিদ্রোহীদের মুক্ত করার কাহিনী রয়েছে। এরকম কোন ঘটনা বাংলায় আক্রমণকারী সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ইতিহাসে পাওয়া যায়না। (Militant Nationalism in India and Its Socio-Religious Background (1897-1917), কলিকাতা, ১৯৬৬, পৃঃ ১৮৪-১৮৬)
চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধায় তাঁর আনন্দ মঠঃ উৎস সন্ধানে-তে বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কে এবং আনন্দ মঠ-এর পরোক্ষ সংযোগ নিয়ে তিনটি পূর্ণ অধ্যায় ব্যয় করেছেন। (পৃঃ ২৯-৫৯) বাসুদেবের জীবনকাহিনী সংক্ষেপে বিবৃত করে তাঁর মন্তব্য – “শিবাজি চেয়েছিলেন হিন্দু রাজ্য গড়তে; বাসুদেবের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।” (পৃঃ ৩১) চিত্তরঞ্জন জানাচ্ছেন – “সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩ নভেম্বরের (১৮৭৯) ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য়। এই দীর্ঘ প্রবন্ধে বাসুদেবের আত্মজীবনী থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে ... এমন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের প্রতি কোন ভারতীয়ের হৃদয় না আকৃষ্ট হয়? বঙ্কিমের মতো স্বদেশহিতৈষী লেখকের মনে নিশ্চয়ই ‘অমৃতবাজার’-এর সম্পাদকীয় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।” (পৃঃ ৪১) তাঁর সিদ্ধান্ত – “বাসুদেবের জীবন থেকে পেয়েছিলেন উপন্যাসের কাঁচা মাল বা কাঠামোটি; পরিবর্জন ও সংযোজন করে তার শিল্পরূপ দিয়েছেন বঙ্কিম আপন প্রতিভায়। তাই বাসুদেবের অবিকল প্রতিরূপ ‘আনন্দ মঠ’-এ নেই, কিন্তু প্রেরণা উপলব্ধি করা যায়।” (পৃঃ ৫৯)
অমৃতবাজার পত্রিকা-র পূর্বোল্লেখিত সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল – “the establishment of the Republic ... would have been entirely fulfilled ... He talks of the establishing a republic in the place of British Govt. ... Phadke had a noble soul, but a poor head ... the blood of the patriots is very fertile”। (পৃঃ ১০৯-১১১)
বাসুদেব ফাড়কে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এবং তাঁর ডায়ারির জন্য দ্রষ্টব্য Source Material for A History the Freedom Movement in India (Collected from Bombay Government Records), Vol. I, 1818-1885 (1957)। এ আকর গ্রন্থে ফাড়কে সম্বন্ধে সূচনাতে বলা হয়েছে – “Wasudeo Balwant Phadke was one of the earliest revolutionaries of Maharashtra who resorted to violent methods in an endeavour to rid the country of foreign rule. In 1879 he actually tried to raise an army of Ramoshis, Dhangars, etc., to wage war against the British Government. In the nature of things, such a campaign was bound to be a shortlived and very small affair. But the movement has significance in the sense that it represents a deliberate and conscious effort, ineffectual and crudely conceived as it was, to rise in rebellion against foreign domination. Stories of Wasudeo Balwant’s exploits had evoked considerable interest in contemporary times.” (পৃঃ ৭৩)। এ পুস্তকে ফাড়কের জীবন সহ পূর্ণাঙ্গ ডায়ারি নিয়ে আলোচনা বিস্তৃত হয়েছে ৭৩ থেকে ১২৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।
এ পুস্তকেই জানানো হয়েছে – “Wasudev wished to establish a republican government, but the accomplishment of this object was no easy matter, unless all the people were of the same mind with him.” (পৃঃ ১২৮)
মূল আলোচনায় যাবার আগে প্রয়োজনীয় দুয়েকটি তথ্য সংযোজন করা যায়। ১৯০৬ সালে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত কৃত আনন্দ মঠ-এর প্রথম ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় The Abbey of Bliss শিরোনামে (যদিও বঙ্কিম জীবিত থাকাকালীন ব্রিটিশ সরকারের নজরদারির প্রয়োজনে যে অনুবাদগুলো হয়েছিল সেগুলোকে গণ্য করা হচ্ছেনা।)।
নরেশচন্দ্র এ বইয়ের ভূমিকায় জানান – “বঙ্কিমচন্দ্র স্পষ্টতই ভেবেছিলেন, যে জাতীয়তাবাদ ভারতে সম্ভবপর হতে পারে তা হল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। ... এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ধারণা থেকে দুটি অতি অশুভ পরিণতির সম্ভাবনা খুলে গিয়েছিল। প্রথমটি হল, অধুনা-প্রচলিত (new-fangled) দেশপ্রেমিক দেব এবং দেবীদের সাহায্যে হিন্দুদের সমস্ত দেবদেবীকে (Hindu Pantheon) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, এবং দ্বিতীয়টি হল, মুসলমানদের জন্য ‘morbid dislike’ তৈরি করা যা এ উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে।” (পৃঃ viii) প্রায় সমধর্মী কথা বলেছেন Ronaldshay তাঁর The Heart of Aryavarta: A Study of the Psychology of Indian Unrest (London, 1925) গ্রন্থে। তাঁর অভিমতে এরকম ঘটনাসমূহ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে – “as giving the sanction of religion to deeds of violence.” (পৃঃ ১১০)
মনে হয়, প্রায় ১০০ বছর আগের এই পর্যবেক্ষণে ভারতের বর্তমান অবস্থার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি।
আমি আমার আলোচনায় পূর্বাপর প্রথম সংস্করণটি ব্যবহার করেছি – যদিও পরের সংস্করণগুলোতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করেছিলেন বঙ্কিম। কিন্তু মৌলিক বক্তব্য মূলগতভাবে পরিবর্তিত হয়নি।
প্রথম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে বললেন – “বাঙ্গালার স্ত্রী অনেক অবস্থাতেই বাঙ্গালীর প্রধান সহায়। অনেক সময়ে নয়। সমাজ বিপ্লব, অনেক সময়েই আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী। ইংরেজেরা বাঙ্গালা দেশ অরাজকতা হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। এই সকল কথা এই গ্রন্থে বুঝান গেল।”
তাঁর বর্ণনায় – “মীরজাফর গুলি খায় ও ঘুমায়। ইংরেজ টাকা আদায় করে ও ডেসপ্যাচ্ লেখে। বাঙ্গালি কাঁদে আর উৎসন্ন যায়।” (প্রথম অধ্যায়, সপ্তম পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১৯-২০) পরবর্তীতে – “সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া শোয়াস্তি নাই, ঘরে ঝি বউ রাখিয়া শোয়াস্তি নাই ... আমাদের রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল ... এ নেড়েদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানি থাকে?’ (প্রথম খণ্ড, দশম পরিচ্ছেদ, পৃঃ ৩১) এ অবধি উপন্যাসের স্বাভাবিক গতিতে, চলনপ্রবাহে কথাগুলো এসেছে বলে বিবেচনা করা চলে।
সন্তানেরা প্রচলিত দেবী বন্দনার প্রতিস্থাপন করলেন দেশ মাতৃকার বন্দনা দিয়ে – “আমরা অন্য মা মানি না – জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। আমরা বলি, জন্মভূমিই জননী; আমাদের মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বন্ধু নাই, - স্ত্রী নাই, পুত্র নাই, ঘর নাই, বাড়ী নাই, আমাদের আছে কেবল সেই সুজলা, সুফলা, মলয়জশীতলা, শস্যশ্যামলা, -” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৮) কমলাকান্তের থেকে ভিন্ন এক পুজোর উদ্বোধন হল। একাদশ পরিচ্ছেদের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে দেবী মুর্তির বিভিন্ন রূপের বিস্তৃত ঔপন্যাসিক চিত্রায়ন রয়েছে – পরিপূর্ণভাবে হিন্দু পরিকল্পনা, এখানে অন্য কোন বিশ্বাসের কোনরকম স্থান নেই। সেই বিখ্যাত উক্তি – “জগদ্ধাত্রী মূর্তি ... মা – যা ছিলেন ... কালীমূর্তি ... মা যা হইয়াছেন ... সুবর্ণনির্ম্মিতা ... দশভূজা প্রতিমা ... এই মা যা হইবেন।” (একাদশ অধ্যায়, পৃঃ ৩৫-৩৭)
এর পরে মুসলিম বিদ্বেষ ধীরে ধীরে সজ্ঞানে বুনে দেওয়া হতে লাগল উপন্যাসের বাকি আখ্যান জুড়ে। মহেন্দ্র ‘সন্তান’ ভবানন্দকে জিজ্ঞেস করছেন – “তবে ইংরেজ আর মুসলমানে এত তফাৎ কেন?” ভবানন্দের উত্তর – “ধর, এক ইংরেজ প্রাণ গেলে পলায় না, মুসলমান গা ঘামিলে পলায় – শরবত খুঁজিয়া বেড়ায় ... একটা গোলা দেখিলে মুসলমানের গোষ্ঠীশুদ্ধ পলায় – আর গোষ্ঠীশুদ্ধ গোলা দেখিলে ত একটা ইংরেজ পলায় না।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩২)
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ থেকে জানতে পারছি – “প্রকৃত সন্ন্যাসী যাহারা তাহার সকলেই পেটের দায়ে কাশী প্রয়াগাদি অঞ্চলে পলায়ন করিয়াছিল।” (পৃঃ ৫০) অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ থেকে পাঠক জানতে পারে – “এই যবনপুরী ছারখার করিয়া অজয়ের জলে ফেলিয়া দিব। এই শূয়ারের খোঁয়াড় আগুনে পোড়াইয়া মাতা বসুমতীকে আবার পবিত্র করিব ... তিনি আজ মুসলমানের কারাগারে বন্দী।” (পৃঃ ৭০) “সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে মুক্ত করিয়াই তাহারা যেখানে মুসলমানের গৃহ দেখিল আগুন ধরাইয়া দিতে লাগিল।” (পৃঃ ৭২) একাদশ পরিচ্ছেদ – “সত্য। তাই। আমরা রাজ্য চাহিনা – কেবল মুসলমানেরা ভগবানের বিরোধী বলিয়া তাহাদের সবংশে নিপাত করিতে চাই।” (পৃঃ ৮৪)
কোন অনুসন্ধানী পাঠক অতি সঙ্গত একটি প্রশ্ন তুলতেই পারে, ইংরেজরা কি ভগবানের উপাসক, যে কারণে এদের সবংশে নিপাত করা যাবেনা? অথচ বলবন্ত ফাড়কে তো ব্রিটিশদের সবংশে নিপাতই করতে চেয়েছিলেন। তাহলে দুটি ক্ষেত্রে ব্যাখ্যার জন্য বা লেখকের বক্তব্যকে বৈধতা দেবার জন্য যুক্তিক্রম কি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হবে? খ্রিষ্টান মিশনারিদের এদেশে আগমনের ঐতিহাসিক কারণ কি ছিল? ভগবৎ-মহিমা প্রচার করা? ইতিহাস কি সে কথাই জানায় আমাদের?
সন্তানেরা “যেখানে মুসলমানের গ্রাম পায় দগ্ধ করিয়া ভস্মাবশেষ করে।” (দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১০৬) এরপরেই বলছেন – “এই সময়ে প্রথিতনামা ভারতীয় ইংরেজকুলের প্রাতঃসূর্য্য ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেব ভারতবর্ষের গবর্নর জেনেরল।” (তদেব, পৃঃ ১০৭) পরে পরিষ্কার ব্যাখায় করে বললেন – “ইংরেজ যে ভারতবর্ষের উদ্ধারসাধনের জন্য আসিয়াছিল, সন্তানেরা তখন তাহা বুঝে নাই। কি প্রকারে বুঝিবে? কাপ্তেন টমাসের সমসাময়িক ইংরেজরাও তাহা জানিতেন না। তখন কেবল বিধাতার মনে মনেই এ কথা ছিল ... কাপ্তেন টমাস শাহেব নিষ্কণ্টক হইয়া সাঁওতাল-কুমারীদিগের গুণগ্রহণে মনোযোগ দিলেন। তখনকার ইংরেজরা এখনকার ইংরেজদিগের ন্যায় পবিত্রচরিত্র ছিলেন না।” (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১১০)
এখানে এসে আমরা সম্ভবত একাধিক অস্বস্তিকর বিষয়ের মুখোমুখি হলাম –
(১) ফাড়কে যেখানে আপামর ভারতবাসীর জন্য ব্রিটিশ শোষণ-মুক্ত “রিপাবলিক” ভারত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইস্তাহার প্রকাশ করেন, ব্যর্থ সশস্ত্র সংগ্রাম করেন, সেখানে বঙ্কিমের সন্তানেরা বুঝেই উঠতে পারেনি যে ইংরেজরা “ভারতবর্ষের উদ্ধারসাধনের জন্য আসিয়াছিল”। উপন্যাসে কাহিনীর বুনটে আগাগোড়া চরিত্র বদলে গেল, কেবলমাত্র লড়াইয়ের ছায়াটুকু ছাড়া।
(২) ইংরেজরা “প্রাতঃসূর্য্য ওয়ারেন হেস্টিংস সাহেব”-এর আমলে অর্থাৎ যখন বনিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড রূপে রূপান্তরিত হয়ে গেছে সেসময়ের ইংরেজদের সঙ্গে হেস্টিংস-পূর্ব ব্রিটিশ শাসনের মাঝে মৌলিক ফারাক আছে – লেখক এমনটাই জানালেন পাঠকদের। সাঁওতাল-কুমারীরা সেসময়ে ইংরেজ লালসার মৃগয়াক্ষেত্র। কিন্তু উপন্যাসে কাহিনীর মাঝে এমনভাবে এসেছে যে খুব দূষণীয় কিছু এমনটা মনে হয়না।
(৩) “তখন কেবল বিধাতার মনে মনেই এ কথা ছিল” – এরকম প্রসঙ্গের অবতারণা করলে উপন্যাস বিচারের সমস্ত যুক্তিই বোধ করি নিঃশেষিত হয়ে ফুরিয়ে যায়।
সন্তানদের সঙ্গে ‘যুদ্ধের’ সময় টমাস হঠাৎ করে আবিষ্কার করে যে সে একজন “অপূর্ব সুন্দরী স্ত্রীমূর্তি”। সে সাহেবকে বলে – “হিন্দু মোছলমানে মারামারী হইতেছে তোমরা মাঝখানে কেন? আপনার ঘরে ফিরিয়া যাও।” (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১১২) লড়াইয়ের মূল ভরকেন্দ্র এ সংলাপ থেকে পরিষ্কার। পরে যোগ বিয়োগ পরিমার্জনা ইত্যাদি করলেও প্রথম প্রকাশের সময় অন্তর্নিহিত সুরটি ধরা পড়ে।
সপ্তম পরিচ্ছেদে “গম্ভীর মেঘগর্জনবৎ তানে” গানের উল্লেখ আছে –
ম্লেচ্ছ নিবহনিধনে কলয়সি করবালং
ধূমকেতু মিব কিমপি করালং” (পৃঃ ১৩০)
যেহেতু আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইংরেজরা এসেছে ভারত-উদ্ধারে ফলে ম্লেচ্ছ নিধনের ভরকেন্দ্র মুসলমান ছাড়া অন্য কেউ হওয়া সম্ভব নয়। “মার, মার, নেড়ে মার!” এখানে আর কোন অতিরিক্ত অর্থ বহন করেনা। পাঠকেরা জানতে পারে, যুদ্ধে ইংরেজের ক্ষয় হয় তবু ভাঙ্গে না! “ইংরেজের অতুল বল, অতুল সাহস, অতুল অধ্যবসায়।” (একাদশ পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১৪৭)
দ্বাদশ পরিচ্ছেদে সত্যানন্দকে ধীরানন্দ জানান – “সবাই লুটিতে বাহির হইয়াছে। গ্রাম সকল এখন অরক্ষিত। মুসলমানের গ্রাম আর রেশমের কুঠি লুটিয়া সকলে ঘরে যাইবে।” (পৃঃ ১৫৬) ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদে সন্তানদের তাণ্ডব রীতিমতো রোমহর্ষক। “কেহ শত্রুসেনার অস্ত্র, কেহ বস্ত্র অপহরণ করিতে লাগিল। কেহ মৃতদেহের মুখে পদাঘাত, কেহ অন্য প্রকারে উপদ্রব করিতে লাগিল। কেহ গ্রামাভিমুখে, কেহ নগরাভিমুখে ধাবমান হইয়া, পথিক বা গৃহস্থকে ধরিয়া বলে “বল বন্দে মাতরং নহিলে মারিয়া ফেলিব।” কেহ ময়রার দোকান লুটিয়া খায়, কেহ গোয়ালার বাড়ি গিয়া হাঁড়ি পাড়িয়া দধিতে চুমুক মারে, কেহ বলে “আমরা ব্রজগোপাল আসিয়াছি, গোপিনী কই?” (পৃঃ ১৫৯)
‘মব ভায়োলেন্সের’ অতি চমৎকার চিত্রায়ন। বিশেষ করে “বল বন্দে মাতরং নহিলে মারিয়া ফেলিব” অংশটুকুতে মনে হয় গত এক দশকে ভারতবর্ষে ঘটে চলা ঘটনার চলচ্ছবি দেখছি। একই সঙ্গে “আমরা ব্রজগোপাল আসিয়াছি, গোপিনী কই?” যেন সেই উন্মত্ত দাঙ্গাবাজ লুঠেরার দল যারা গুজরাট, উত্তর প্রদেশ বা হরিয়ানায় ঘুরে বেড়ায়।
এ বর্ণনার অব্যবহিত পরেই লেখক আমাদের জানাচ্ছেন – “গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্ব্বস্ব লুটিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিতে লাগিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল “মুই হেঁদু।” (পৃঃ ১৬০)
এ বর্ণনার সাথে ১৯৪৭-এর দাঙ্গা-বিধ্বস্ত ভারত ভূখণ্ডের কিংবা বর্তমান ভারতের একাধিক প্রদেশের কথা স্মরণ করাবে। এত গ্র্যাফিক এ বর্ণনা! উপন্যাসের অধিকাংশ পাঠক উপন্যাসের আভ্যন্তরীন dynamics-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতে এ ঘটনাক্রমকে স্বাভাবিক ঘটনা এরকম বলে ভেবে নেওয়াটাই দস্তুর হয়ে যায়।
“বীরভূমি ইংরেজ মুসলমানের হাত ছাড়া হইয়াছে! ... কিন্তু এই সময়ে ভগবানের নিয়োগে ওয়ারেন হেস্টিংস কলিকাতার গবর্নর জেনেরল। ওয়ারেন হেস্টিংস মনকে চোখ ঠারিবার লোক নহেন – তাঁর সে বিদ্যা থাকিলে আজ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কোথা থাকিত?” (ষোড়শ পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১৬৯-১৭০)
এখানে ঐতিহাসিক সত্যের খাতিরে একটি তথ্যের উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভগবানের নিয়োগে যে ওয়ারেন হেস্টিংসের আগমণ, অন্তত বঙ্কিমের মতে, সে হেস্টিংস ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার পরে ১৭৮৭ থেকে ১৭৯৫-এর মধ্যে “ইম্পিচমেন্ট ট্রায়াল”-এর মুখোমুখি হন। ২১ মে, ১৭৮৭ সালে হেস্টিংসকে লন্ডনের Serjeant-at-Arms অ্যারেস্ট করে পার্লামেন্টে হাউস অফ লর্ডস-এ Impeachment Committe-র সামনে বিচারের জন্য হাজির করে।
একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় – “in 1774 he became the First Governor General of Bengal with a salary of $150,000, a position which he held until 1785. In 1787 he was impeached by the House of Commons ... political misconduct. When, therefore, it was found by the House of Commons that Warren Hastings should be prosecuted for high crimes and misdemeanors committed in East India, it was at the same time determined that he should be tried by impeachment before the House of Lords because of the magnitude of the cause, the remoteness from London of the offense and because of the great wealth and powerful influence of the man. The Commons impeached Hastings on twenty-two separate charges covering 426 pages.” (Robert Stone, “The Trial of Warren hastings”, American Bar Association Journal, Vol. 13, No. 7 (JULY, 1927), pp. 398-403. এ ছাড়াও দ্রষ্টব্যঃ মিঠি মুখার্জি, “Justice, War, and the Imperium: India and Britain in Edmund Burke’s Prosecutorial Speeches in the Impeachment Trial of Warren Hastings”, Law and History Review Fall 2005, Vol. 23, No. 3, পৃঃ ৫৮৯-৭০৬)
বঙ্কিমের মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষ যিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাকরি করেছেন এবং যিনি ভারত ও পৃথিবীর সমকালীন ঘটনাবলি নিয়ে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন, তিনি এই বিষয়ে কিছু জানতেন না এটা অসম্ভব একটি ঘটনা। সে সময়ের পৃথিবীতে হেস্টিংস-এর বিচার এবং ইমপিচমেন্ট রীতিমত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। তাহলে এটা ধরে নেওয়া কি খুব অসঙ্গত হবে যে উপন্যাসে ভগবান-প্রেরিত ভারতের উদ্ধারকর্তা হিসেবে ইংরেজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাঠকদের কাছে ইতিহাসের এ অংশটুকু বঙ্কিম একেবারে মুছে (erase) দিলেন এবং একই সঙ্গে মুসলিম-বিদ্বেষের সুতো নিপুণতার সাথে বুনে দিলেন?
সন্তানদের সাথে মুসলমানদের শেষ যুদ্ধের শেষ লগ্নে মহেন্দ্রর মুখে আমরা সংলাপ পড়ছি – “হরে মুরারে! উঠ! মুসলমানের বুকে পিঠে চাপিয়া মার। লক্ষ সন্তান পর্বত পিঠে।” (দ্বিতীয় অধ্যায়, অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১৮১) বিংশ পরিচ্ছেদে সত্যানন্দ এবং চিকিৎসকের কথোপকথন এরকম –
“তোমার কার্য সিদ্ধ হইয়াছে, মুসলমানরাজ্য ধ্বংস হইয়াছে। আর তোমার এখন কোন কাজ নাই। অনর্থক প্রাণিহত্যার প্রয়োজন নাই। ... হিন্দুরাজ্য এখন স্থাপিত হইবে না – তুমি থাকিলে এখন অনর্থক নরহত্যা হইবে। অতএব চল।”
সত্যানন্দ অশ্রুসজল চোখে জিজ্ঞাসু –
“হে প্রভু! যদি হিন্দুরাজ্য স্থাপিত হইবে না, তবে কে রাজা হইবে? আবার কি মুসলমান রাজা হইবে? ... হায় মা! তোমার উদ্ধার করিতে পারিলাম না – আবার তুমি ম্লেচ্ছের হাতে পড়িবে।”
“চিকিৎসক বলিলেন, “সত্যানন্দ কাতর হইও না। যাহা হইবে, তাহা ভালই হইবে। ইংরেজ আগে রাজা না হইলে আর্য্যধর্ম্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই ... তেত্রিশ কোটি দেবতা আর্য্যধর্ম্ম নহে, সে একটা লৌকিক অপকৃষ্ট ধর্ম্ম; তাহার প্রভাবে প্রকৃত আর্যধর্ম্ম – ম্লেচ্ছেরা যাহাকে হিন্দুধর্ম বলে, তাহা লোপ পাইয়াছে। প্রকৃত হিন্দুধর্ম্ম জ্ঞানাত্মক, কর্ম্মাত্মক নহে। সেই জ্ঞান দুই প্রকার, বহির্ব্বিষয়ক ও অন্তর্ব্বিষয়ক। ... কিন্তু বহির্ব্বিষক জ্ঞান আগে না জন্মিলে অন্তর্ব্বিষয়ক জ্ঞান জন্মিবার সম্ভাবনা নাই। ইংরেজ বহির্ব্বিষয়ক জ্ঞানে অতি সুপণ্ডিত; লোকশিক্ষায় বড় সুপটু। সুতরাং ইংরেজকে রাজা করিব। ... অতএব হে বুদ্ধিমন্ – ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে নিরস্ত হইয়া আমার অনুসরণ কর। ... এই সন্তান বিদ্রোহের কারণে তাহারা রাজ্য শাসনের ভার লইতে বাধ্য হইবে ... জ্ঞান লাভ করিয়া তুমি স্বয়ং সকল কথা বুঝিতে পারিবে।” (বিংশ পরিচ্ছেদ, পৃঃ ১৮৮-১৮৯)
উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটছে এভাবে – “জ্ঞান আসিয়া ভক্তিকে ধরিয়াছে – ধর্ম্ম আসিয়া কর্ম্মকে ধরিয়াছে; বিসর্জন আসিয়া প্রতিষ্ঠাকে ধরিয়াছে ... সত্যানন্দ প্রতিষ্ঠা; মহাপুরুষ বিসর্জ্জন।”
কিন্তু এসবের পরেও বঙ্কিম সম্ভবত কিছু পরিমাণে রাজরোষের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সরাসরি প্রমাণ না থাকলেও পরোক্ষ প্রমাণ রয়েছে। শ্রীশ্রীচন্দ্র মজুমদারকে বঙ্কিম একান্ত আলাপচারিতায় ঝাঁসির রাণী সম্পর্কে বলেছিলেন “প্রাচ্যদিগের মধ্যে এই একমাত্র স্ত্রীলোক পুরুষ” এবং রাণীর বীরত্ব নিয়ে উপন্যাস লেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল – “আমার ইচ্ছা হয় একবার সে চরিত্র চিত্র করি, কিন্তু এক ‘আনন্দমঠেই’ সাহেবরা চটিয়াছে, তাহলে আর রক্ষা থাকবে না।“ (কাছের মানুষ বঙ্কিমচন্দ্র, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫)
আনন্দ মঠ নিয়ে তণিকা সরকার মন্তব্য করেছেন – “The Muslim ruler, an individual, is expanded for ideological purposes into an entire community.” (Hindu Nationalism in India, permanent black, 2022, পৃঃ ২৫) তাঁর পরবর্তী পর্যবেক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ – “The narrative proceeds by establishing correspondence among three levels: in the novel’s time-space, in the song, and among the three images in the temple.” (তদেব, পৃঃ ৪৮)
তণিকা প্রশ্ন করছেন – “Does the novel put an interrogation mark against its own vision by underlining the brutalisation that it must bring forth?” এ প্রশ্নগুলো এ প্রবন্ধের পাঠকদেরও ভাবাবে আশা করি।
তবে আজকের সমাজের একটি বড়ো অংশের মাঝে প্রায়-চিন্তাহীন, প্রবাহে ভেসে-যাওয়া মননে এই দীর্ঘ প্রবন্ধ কতটুকু ভাবনার তরঙ্গ তৈরি করতে পারবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। এখানেও বঙ্কিমের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। বন্ধু-প্রতিম ললিতচন্দ্র মিত্রকে নাকি বলেছিলেন – “As a patriotic work ‘আনন্দমঠ’ খুব ভালো বটে, কিন্তু উহাতে আর্ট কম।” (বঙ্কিম-শতবার্ষিক সংস্করণ, আনন্দ মঠ (১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে মুদ্রিত পঞ্চম সংস্করণ হইতে গৃহীত), ভূমিকা)
কালীপ্রসন্ন ঘোষকে লিখিত একটি চিঠিতে বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ সম্পর্কে এ ভাবে উল্লেখ করেছেন – “আমি বা আনন্দমঠ লিখিয়া কি করিব আর আপনি বা তাহার মূলমন্ত্র বুঝাইয়া কি করিবেন? এ ঈর্ষাপরবশ আত্মোদরপরায়ণ জাতির উন্নতি নাই। বল “বন্দে উদরং”।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১।0)
বর্তমান সময়ের উপযোগী ভারি মূল্যবান একটি ঘোষণা বই কি!