ভারতীয় সমাজে জাত এবং মার্ক্সের বিচার
আমরা এবারে দেখতে চাইব, সমাজ গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে মার্ক্সের কি ধারণা ছিল। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বয়ানে এসবের সংক্ষিপ্ত এবং প্রায়-পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা আমরা জেনে নেব। পার্থ বলছেন – “ভারতবর্ষ নিয়ে পড়াশোনা কিংবা লেখার সময় মার্কস-এর চিন্তায় একটাই মূল প্রশ্ন ছিলঃ ভারতীয় সমাজের ঐতিহাসিক অগ্রগতির সম্ভাবনা কী, কোন পথে সে অগ্রগতি সম্ভব, সে পথে বাধা কোথায়? বিশ্ব-ইতিহাসের ক্রমবিকাশের যে ছক তিনি ইউরোপের সমাজবিবর্তনের ধারা থেকে আবিষ্কার করতে চাইছিলেন, বলা বাহুল্য সেই ছকের সঙ্গে মিলিয়েই ভারতবর্ষ নিয়ে এই প্রশ্ন জেগেছিল তাঁর মনে। কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগে বসে ইউরোপের ইতিহাসের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে প্রাচ্যের সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে নানা রকম বৈসাদৃশ্যই প্রধানত চোখে পড়েছিল ইউরোপীয় পণ্ডিতদের – মার্কস-এরও। মার্কসের ক্ষেত্রে যেটা লক্ষণীয় সেটা হল যে মার্কস-এর চিন্তা কিন্তু এক জায়গায় থেমে থাকেনি। ১৮৫০-এর দশক থেকে তাঁর শেষ জীবনে ১৮৮১-৮২ পর্যন্ত এ বিষয়ে মার্কস যতই খোঁজখবর করেছেন, ততই পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদী বিকাশের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তিনি সচেতন হয়েছেন, অন্যদিকে প্রাচ্য-সমাজের বিবর্তনের স্বকীয় রূপগুলি সম্পর্কেও তাঁর ধারণা স্পষ্টতর হয়েছে। এই প্রসঙ্গে এশিয়ার দেশগুলিতে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে, ঔপনিবেশিক অনুপ্রবেশের ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে তাঁর মতামতও মৌলিকভাবে পালটে গেছে।” (“বাঙ্গালার গ্রাম-সমাজ সম্পর্কে কার্ল মার্কস”, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১০১)
১৮৪৬ সালে মার্ক্সের প্রথম প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ The German Ideology প্রকাশিত হয়। একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি বলেন – “legislation may perpetuate land ownership in certain families, or allocate labour as a hereditary privilege, thus consolidating it into a caste system. In all these cases, and they have all occurred in history, it seems that distribution is not regulated and determined by production but, on the contrary, production by distribution.” (লরেন্স অ্যান্ড উইশার্ট সংস্করণ, ১৯৭৪, পৃঃ ১৩৬) বোঝা যাচ্ছে, এসময় থেকেই জাত তথা caste-এর বিষয়টি সম্ভবত তাঁকে ভাবাচ্ছিল।
১৮৫৩ সালের জুন মাসে নিউ-ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন-এর জন্য লন্ডনে বসে মার্ক্স যখন “The British Rule in India” লিখছেন তখন অবধি তাঁর চিন্তায় ছিল ব্রিটিশের মারফৎ ধনতান্ত্রিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার static তথা নিশ্চল ভারতীয় সমাজের মধ্যেকার সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটাবে। সেসময়ে তিনি লিখছেন – “এটা সত্য যে ইংল্যান্ড ভারতে একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটাচ্ছে, যদিও কেবলমাত্র নিজেদের হীনতম স্বার্থ থেকে এবং নির্বোধের মতো এগুলোকে বল পূর্বক বলবৎ করছে। কিন্তু সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হল, এশিয়ার সামাজিক অবস্থার মূলগত বিপ্লব ছাড়া মানবজাতি কি এর লক্ষ্যের দিকে পৌঁছতে পারবে? যদি তা না হয়, ইংল্যান্ড যত অপরাধই করুক না কেন সে ইতিহাসের অসচেতন হাতিয়ার হিসেবে এই বিপ্লব ঘটানোর কাজটি করছে।”
এ প্রবন্ধেই তিনি লিখলেন – “অবৈধ ব্রিটিশ অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের তাঁত শিল্প ভেঙ্গে দিয়েছে এবং চরকাকে ধ্বংস করেছে। ইউরোপের বাজার থেকে ইংল্যান্ড প্রথমে ভারতীয় তুলোকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তারপরে ইংল্যান্ডের পাকানো সুতো (twist) ভারতের বাজারে আমদানি করেছে। এবং সবশেষে, তুলোর মাতৃভূমি-তুল্য সমস্ত দেশের বাজার নিজেদের তুলো দিয়ে প্লাবিত করেছে। ১৮১৮ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে গ্রেট ব্রিটেন থেকে ভারতে পাকানো তুলোর রপ্তানি ৫,২০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯২৪ সালে ভারতে ব্রিটিশ মসলিনের বড় জোর ১,০০০,০০০ গজ ছিল, ১৯৩৭ ব্রিটেন থেকে রপ্তানি করা মসলিনের পরিমাণ বেড়ে ৬৪,০০০,০০০ গজেরও বেশি হয়েছে। কিন্তু একই সময়ে ঢাকার (মসলিন উৎপাদনের মূল কেন্দ্র) জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ১৫০,০০০ থেকে ২০,০০০-এ। ভারতের যে শহরগুলো তাদের বস্ত্রশিল্পের জন্য এতদিন সুপ্রসিদ্ধ ছিল সেগুলোর এভাবে শুকিয়ে যাওয়াকেও সবচেয়ে খারাপ পরিণতি বলা যাবেনা। আরও খারাপ হচ্ছে, ব্রিটিশের বাষ্পশক্তি এবং বিজ্ঞান ভারতের সমগ্র ভূমি থেকে কৃষি এবং উৎপাদন শিল্পের যে সমন্বয় ছিল তাকে উৎখাত করে দিয়েছে।”
সমাজ বিপ্লবের তথা মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অসীম সম্ভাবনা নিয়ে সম্ভবত তাঁর সমকালে অন্য কোন চিন্তাবিদ এত গভীরভাবে ভাবেননি। তবে মনে হয় এসময় মার্ক্সের ধারণায় ছিল যে আবহমান কাল ধরে চলে আসা ভারতের সমাজ জীবনে যেখানে একই ব্যক্তি একইসাথে কৃষক ও উৎপাদক, এই কাঠামোটি ভেঙ্গে গিয়ে নতুন শ্রেণীর (class) উদ্ভব হবে ইতিহাসের নতুন চালিকাশক্তি হিসেবে। তখনও পর্যন্ত জাতের (caste) প্রশ্ন তাঁকে সেভাবে ভাবায়নি। কিন্তু caste থেকে class-এ উত্তরণ/রূপান্তর হবে এরকম কোন তত্ত্বও তাঁর তত্ত্বায়নে পাওয়া যাবেনা।
এরপরে ১৮৫৩ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে একই পত্রিকায় লিখলেন “The Future Results of British Rule in India”। এ লেখায় তিনি জানালেন – “ওরা (ইংরেজরা) দেশীয় শিল্পকে উপড়ে ফেলে দেশীয় জনসমাজকে ভেঙ্গে দিয়েছে, এবং সমাজের যাকিছু মহান এবং উচ্চভূমিতে ছিল, সমস্তকিছুকে সমতল করে দিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে এদের শাসনকালের যে পাতাগুলো লেখা হচ্ছে তাতে ধ্বংসের কাহিনীর বাইরে প্রায় আর কিছু নেই। পুনরুজ্জীবনের কোন চিহ্নরেখা এই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে প্রায় দেখাই যাচ্ছেনা। তা সত্ত্বেও এটা শুরু হয়েছে।”
১৮৭৭ সালের নভেম্বর মাসে “OTECHESTVENN!YE ZAPISKI” (ইংরেজিতে Annals of the Fatherland) পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর কাছে একটি চিঠিতে লেখেন – “ভীষণভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ ঘটনাসমূহ যেগুলো বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক বাস্তবতায় জন্ম নিয়েছে সেগুলো একেবারে পৃথক ফলাফলের জন্ম দিয়েছে। এরকম প্রতিটি বিবর্তনকে আলাদা করে পর্যবেক্ষণ এবং তুলনা করলে যে কেউ সহজে বুঝতে পারবে এগুলোর অন্তর্নিহিত সত্যিকে, কিন্তু এরকমটা ঘটা কখনও সম্ভব নয় যে কেউ এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে একটি ‘master key a general historico-philosophical theory, the •supreme virtue of which consists in being super-historical’ রয়েছে।” যদি থাকে তাহলে একে আর ঐতিহাসিক বলা যাবেনা, বলতে হবে “super-historical”। (Marx and Engels – Selected Correspondence, সংশোধিত ২য় সংস্করণ, প্রোগ্রেস পাবলিশার্স, ১৯৬৫, পৃঃ ৩১৩)
মার্ক্স তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা এবং বিশ্বের চিরস্থায়ী সম্পদ ক্যাপিটালঃ এ ক্রিটিক অফ পলিটিকাল ইকোনমি (আমেরিকান সংস্করণ, ১৯০৬)-তে লিখছেন – “the conversion of fractional work into the life-calling of one man, corresponds to the tendency shown by earlier societies, to make trades hereditary; either to petrify them into castes, or whenever definite historical conditions beget in the individual a tendency to vary in a manner incompatible with the nature of castes, to ossify them into guilds.” (পৃঃ ৩৭৩)
অর্থাৎ, বলবার কথা এই যে ইউরোপের সামাজিক বিকাশের ধারার সাথে একেবারে মেলেনা প্রাচ্যের এদিকগুলোর বিশিষ্টতা তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত ক্রমাগত ভাবিয়েছে। এর মধ্যে caste একটি উপাদান। আরেকটি উপাদান হল Asiatic Mode of Production। তাঁর চিন্তা এক জায়গায় থেমে থাকেনি। এবং, একইসাথে, তাঁর অনুগামীদের সতর্ক করেছেন এই বলে যে বিশ্বের বিভিন্ন বৈচিত্র্যসম্পন্ন ভিন্ন ভিন্ন সমাজের মুক্তির জন্য কোন একটি সব-খোল চাবি তথা masterkey নেই।
১৯৭৪ সালে লরেন্স ক্রেডার সম্পাদিত The Ethnological Notebooks of Karl Marx (Van Gorcum & Company, Netherlands) থেকে আমরা জানতে পারি ১৮৮১-৮২ সাল পর্যন্ত মার্ক্স (প্রয়াত ১৮৮৩ সালে) এশীয় দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য সক্রিয়ভাবে চিন্তা করেছেন। তিনি চারজনের লেখা – Lewis Henry Morgan, Sir Henry Sumner Maine, Sir John Budd Phear and John Lubbock – মন দিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। লেখাগুলোর পাশে জার্মান ইংরেজি মিশিয়ে নোট রেখেছেন।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতের গ্রাম ব্যবস্থা নিয়ে লেখা ফিয়ারের ১৮৮০ সালে প্রকাশিত The Aryan Village in India and Ceylon বইটি। এই বইয়ের এক জায়গায় ফিয়ার লিখছেন – “The chief development of the Boistobs originated with Chaitanya, who preached purity, meditation, and the equality of all men, without distinction of sect or caste, before God. He threw aside all ceremonies and outward symbols. And a certain freedom from caste trammels and disregard of religious observances”। এ অংশটুকু মার্ক্স আলাদা গুরুত্ব দিয়ে নোট করেছেন। (The Ethnological Notebooks of Karl Marx, পৃঃ ২৬০)
Phear-এর মূল বইটির এক জায়গায় রয়েছে – “in some villages, where the occupation of a caste, say the weavers caste, has died a natural death , the members forced to earn their livelihood by manual labour, amongst other employments take to labour on the land for wages.” (The Aryan Village in India and Ceylon, পৃঃ ১৫) মোদ্দা কথা হল, কিছু কিছু গ্রামে জাত-ভিত্তিক পেশার “স্বাভাবিক মৃত্যু” ঘটেছে, জীবন নির্বাহের জন্য এদের মজুরি তথা শ্রমশক্তির ওপরে নির্ভর করতে হয়। এখানে আমাদের মনে আসবে শরৎচন্দ্রের কালজয়ী কাহিনী “মহেশ”-এর কথা যেখানে ভূমিহীন কৃষক সব হারিয়ে পাড়ি দেয় চটকলের শ্রমিক হবার অজানা জীবনের পথে। মনে পড়বে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি-র কথা।
বোঝা যায়, ১৮৫৩ সালে মার্ক্সের ভারত নিয়ে ভাবনা ১৮৮১ সালে এসে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে। একটি চির-প্রশ্নশীল মন এবং সজীব চিন্তন এই দীর্ঘ সময় ধরে সক্রিয় থেকেছে এবং চিন্তার সরণী ধরে সম্মুখে অগ্রসরমান হয়েছে।
মার্ক্সের চিন্তাভূমিতে থাকা Asiatic Mode of Production নিয়ে আমি এখানে কোন আলোচনায় যাচ্ছিনা। তবে এটুকু উল্লেখ করাই যায় যে ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের জন্য মিশরীয় স্কলার সামির আমিন একে “tribute-paying mode” বলে আখ্যায়িত করেন (“Modes of Production and Social Formation”, Ufahamu: A Journal of African Studies, 4 (3), 1974)। পরবর্তীতে অনেক গবেষকই “tributary mode of production” দিয়ে বিষয়টিকে বুঝতে চেয়েছেন।
গান্ধী এবং আম্বেদকর নিয়ে আলোচনার আগে একেবারে হালে (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২১) লেখা ক্রিস্তফ জাফ্রেলোর Modi’s India: Hindu Nationalism and the Rise of Ethnic Democracy থেকে দেখে নিই। জাফ্রেলো ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের উল্লেখ করে বলছেন – “সোশ্যাল মিডিয়ার পথিকৃৎ ব্যবহারের সঙ্গে বিজেপি সমান্তরালভাবে ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতি নিম্ন জাতের পটভূমি থেকে উঠে আসা কিছু প্রার্থীকে নির্বাচনে লড়াইয়ের জন্য মনোনয়ন দেবার কায়দা গ্রহণ করেছিল। এই কৌশল সহজ হয়েছিল এ কারণে যে জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণ সমানভাবে সমস্ত Scheduled Castes and Other Backward Classes-এর অন্তর্ভুক্ত মানুষদের সামাজিক সুবিধে দেয়নি ... মহারাষ্ট্রে মাহার জাতের মানুষ যারা একসময় আম্বেদকরের পার্টিকে সমর্থন করেছিল তারা বিজেপির সমর্থনে কথা বলল ... উল্লেখজনকভাবে, দরিদ্র SC এবং OBC মানুষেরা মধ্যবিত্ত SC এবং OBCদের তুলনায় বিজেপিকে অনেক বেশি ভোট দিয়েছে।” (পৃঃ ৩২৯-৩৩০)
এগুলো জাত নিয়ে ব্যবহারিক রাজনীতির দিক যা ভোটের আবাদে ভালো ফসল ফলায়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি ভারতের সমস্ত পার্টিকে এখানে টেক্কা দিয়েছে। আরেকটি ভিন্ন চরিত্রের ব্যবহারিক দিক নিয়ে এ প্রবন্ধের শুরুতেই আলোচনা করেছি – যেখানে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের একদিকে সামাজিকভাবে তার জাত কি এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আবার অন্যদিকে তাকে জায়মান নতুন রাষ্ট্রের উপযোগী সুশীল ও বাধ্য তৈরি করার লক্ষ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে “সেকুলার” শিক্ষাক্রমের মধ্যে।
আম্বেদকর এবং গান্ধী তাঁদের সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান থেকে জাতের অবস্থান বুঝতে চেয়েছেন। উপনিবেশিক ভারতের বিশিষ্টতায় রাজনীতিতে জাতের অংশগ্রহণের চরিত্র কি এবং কোন প্রক্রিয়ায় হতে পারে কিংবা ভারতে যে সামাজিক কাঠামো সহস্রাধিক বছর ধরে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে সেটাকে অক্ষুণ্ণ রেখে আদৌ একাজটি করা সম্ভব কিনা এ বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
অরুন্ধতী রায় সম্পাদিত আম্বেদকরের Annihilation of Casteঃ The Annotated Critical Edition, (ভার্সো, ২০১৪) পুস্তকে “The Doctor and the Saint” শিরোনামে অরুন্ধতী রায়ের নিজের একটি সুদীর্ঘ ভূমিকা বা স্বতন্ত্র গবেষণাজাত লেখা রয়েছে। সে লেখাটি থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যায় আলোচনাকে সহজ করার জন্য। পরবর্তীতে The Doctor and the Saint: Caste, Race, and Annihilation of Caste, the Debate Between B.R. Ambedkar and M.K. Gandhi শিরোনামে বই হিসেবে প্রকাশিত হয় (Chicago, Heymarket Books, 2017)।
অরুন্ধতী লিখছেন – “অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে গান্ধীর প্রচারাভিযান যা কার্যকরীভাবে করেছিল তাহ’ল শতাব্দী-প্রাচীন ক্ষতের ওপরে মলমের প্রলেপ দেওয়া (to rub balm on injuries that were centuries old)। বিপুলসংখ্যক এই অস্পৃশ্য মানুষদের কাছে, যারা এতদিন ধরে ক্রমাগত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়েছে, সমস্ত ক্ষেত্রে কেবল বিতাড়িত এবং ক্ষতবিক্ষত হয়েছে (accustomed only to being terrorised, shunned and brutalised), তাদের মাঝে গান্ধীর এই মিশনারি কার্যকলাপ কৃতজ্ঞতা এবং পুজো করার মতো বোধের জন্ম দেবে। গান্ধী এটা জানতেন, তিনি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। আম্বেদকর রাজনীতিবিদ ছিলেন না। অথবা কোন হিসেবেই ভালো রাজনীতিবিদ নন। গান্ধী জানতেন কিভাবে দাক্ষিণ্যকে একটি ঘটনায়, একটি থিয়েটারে, আতশবাজির মতো তাক-লাগানো প্রদর্শনীতে পরিণত করা যায় (how to make charity an event, a piece of theatre, a spectacular display of fireworks)। একারণে, যখন ডক্টর (আম্বেদকর) দীর্ঘস্থায়ী নিরাময় খুঁজে চলেছেন, সন্ত (গান্ধী) সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ করেছেন এবং placebo বিতরণ করে চলেছেন।” (পৃঃ ১৩০)
জাত এবং গান্ধী
এ প্রবন্ধের পরিসরে গান্ধী কিংবা আম্বেদকর দুজনের কাউকে নিয়েই বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ নেই। তবে উভয়েরই সামান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা নিয়ে আলোচনা করা যায় – cherry-picking-কে পরিহার করে।
গান্ধী গুজরাতিতে গুজরাতি জার্নাল নব-জীবন-এ caste নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন। আম্বেদকর সে লেখার ইংরেজি অনুবাদ করেন। এ লেখাতে গান্ধী বলেন – “আমি বিশ্বাস করি হিন্দু সমাজ যে দাঁড়িয়ে আছে তার কারণ হচ্ছে এটা জাত-ব্যবস্থার ওপরে প্রতিষ্ঠিত ... যে সমাজ জাত-ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারে তার অবশ্যই অনন্য সাংগঠনিক ক্ষমতা রয়েছে ... জাত-ব্যবস্থার প্রাথমিক শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে একটি রেডিমেড পদ্ধতি রয়েছে। প্রতিটি জাতই তার জাতের শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে পারে। জাতের রাজনৈতিক ভিত্তিও আছে ... জাতের অন্য নাম হল নিয়ন্ত্রণ। জাত-ব্যবস্থা আনন্দ-উল্লাসের ক্ষেত্রে সীমারেখা টেনে দেয়। আনন্দ উপভোগের জন্য জাত-ব্যবস্থা কখনও একজনকে তার জাতের সীমা লঙ্ঘনের অনুমতি দেয়না। বিভিন্ন জাতের একসাথে বসে খাওয়া বা অসবর্ণ বিবাহকে আটকানো হল এই জাত-ব্যবস্থার মূল অর্থ। অভিজ্ঞতা এ কথা বলেনা যে বিভিন্ন জাতের একসাথে বসে খাওয়া কোন বন্ধুত্বের জন্ম দেয় ... জাত-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা এবং পশ্চিমী ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করার অর্থ হল হিন্দুরা বংশগত পেশার নীতিমালাকে বিসর্জন দেবে, যা জাত-ব্যবস্থার আত্মা স্বরূপ। বংশগত নীতি হল শাশ্বত নীতি। একে পরিবর্তন করার অর্থ হল চরম বিশৃঙ্খলার জন্ম দেওয়া ... জাত-ব্যবস্থা সমাজের একটি প্রাকৃতিক বিন্যাস। ভারতে একে ধর্মের আবরণ দেওয়া হয়েছে।” (Dr. Babasaheb Ambedkar Writings and Speeches, Vol. 9, ২০১৪, পৃঃ ২৭৫-২৭৬)
আমেরিকান থিওলজিস্ট ডঃ জন আর মটের সাথে (ডঃ মট ১৯৪৬ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান) গান্ধীর ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে একটি কথোপকথন হয়েছিল। সে কথোপকথনে মটের একটি প্রশ্নের উত্তরে গান্ধী জানান – “ডঃ মট আপনি কি মনে করেন যে আপনি একটি গরুর কাছে আপনার গসপেল প্রচার করবেন? ভালো কথা, অস্পৃশ্যদের একটি অংশ বোধবুদ্ধির ক্ষেত্রে গরুর চেয়েও নিকৃষ্ট।” (যোগেন্দ্র যাদব, “Discussion of Mahatma Gandhi with John R. Mott” May 8, 2013, Gandhi Research Foundation, Jalgaon, Maharashtra, India) যাদবের ব্লগে গেলে এ লেখার সন্ধান পাওয়া যাবে।
অরুন্ধতী জানাচ্ছেন যে ১০ জানুয়ারি ১৯২৭-এ “মহদ সত্যাগ্রহে”র (১৯২৭ সালের ২০ মার্চ আম্বেদকারের নেতৃত্বে হাজার হাজার দলিতদের নিয়ে মহারাষ্ট্রের মহদ বা মাহাদ অঞ্চলে যে ঐতিহাসিক সত্যাগ্রহ হয়েছিল) প্রাক্কালে গান্ধী তাঁর স্পনসর এবং বন্ধু জি ডি বিড়লাকে একটি চিঠিতে জানান “অর্থের জন্য আমার তৃষ্ণা প্রশমিত হয়না। আমার এখন অন্তত ২,০০,০০০ টাকা প্রয়োজন – খাদি, অস্পৃশ্যতা এবং শিক্ষার জন্য।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১০৬) বিড়লা Margaret Bourke-White-কে (লাইফ ম্যাগাজিনের যিনি চিত্র সাংবাদিক ছিলেন) বলেন – “অকপটে বললে, আমরা মন্দির বানাই বটে তবে মন্দিরে বিশ্বাস করিনা। মন্দির বানাই ধর্মীয় মানসিকতা ছড়িয়ে দেবার জন্য।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩০) এই ধর্মীয় মানসিকতা প্রকৃতপক্ষে উচ্চবর্ণ নিয়ন্ত্রিত, প্রধানত ব্রাহ্মণ ও বেনিয়া নিয়ন্ত্রিত, জাত-ব্যবস্থাকে ভারতীয় সমাজে চিরস্থায়ী রাখার ধর্ম।
অরুন্ধতী আরও জানাচ্ছেন – “বাল্মীকিদের (অস্পৃশ্যদের মধ্যেও নীচুতলার) প্রতি গান্ধীর মনোযোগ, তাঁর অতি-প্রচারিত “ভাঙ্গি বস্তি”তে যাওয়া, রাজনৈতিক লভ্যাংশ দিয়েছে। যদিও এটা ঘটনা যে ভাঙ্গিদের তিনি অনুকম্পা এবং ঘৃণার চোখেই দেখতেন।” (পৃঃ ১০২)
এখানে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে গান্ধী প্রসঙ্গে ইতি টানা যায়। আমেরিকান সাংবাদিক লুই ফিশারের সাথে গান্ধীর কথোপকথন থেকে (জুন ৬, ১৯৪২) জানতে পারি গান্ধীর কাছে ফিশার জানতে চান “তাঁকে কংগ্রেস দল নিয়ে আলোচনার জন্য বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল। অতি উচ্চপদস্থ ব্রিটিশরা, আমি স্মরণ করলাম, আমাকে বলেছেন যে কংগ্রেস বৃহৎ ব্যবসায়ীদের ক্রীড়নক এবং গান্ধীকে বোম্বের মিল মালিকরা সমর্থন করে, তিনি যতটা চান ততটা অর্থ দেয়। “এর মাঝে কতটা সত্যি আছে?”। গান্ধী প্রত্যুত্তরে বলেন – “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এগুলো সত্যি”, গান্ধী সহজভাবে জানান। “কংগ্রেসের কাছে এর কাজকর্ম চালানোর মতো যথেষ্ট অর্থ নেই। আমরা শুরুর দিকে ভেবেছিলাম প্রতিটি সদস্যের কাছ থেকে প্রতিবছর ৪ আনা (প্রায় ৮ সেন্ট, আমেরিকান মুদ্রায়) করে চাঁদাসংগ্রহ করলে কাজ চলে যাবে। কিন্তু এ দিয়ে কোন কাজ হলনা।” “(Louis Fisher, A Week with Gandhi, George Allen & Unwin Ltd, পৃঃ ৫১)
এরকম একটা অবস্থানে থেকে জাত-ব্যবস্থা এবং সামাজিক রূপান্তরের বিষয়ে কেউ ভাবছেন বা ভাবতে পারেন একথা ভাবনায় আনা অলীক কল্পনা মাত্র।
খানিকটা প্রসঙ্গের বাইরে হলেও (আবার এক অর্থে প্রাসঙ্গিকও বটে) ইহুদিদের ওপরে হিটলার এবং নাৎসীবাহিনীর অত্যাচার নিয়ে গান্ধীর অভিমত আলোচনা করা যেতে পারে। হরিজন পত্রিকায় (১৭.১২.১৯৩৮) “Some Questions Answered” শিরোনামের একটি প্রবন্ধে লিখলেন – “সবচেয়ে পাথুরে হৃদয়কেও অহিংস হবার কষ্টভোগ গলিয়ে দেয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, যদি ইহুদিরা তাদের আত্মিক ক্ষমতাকে সাহায্য করার জন্য কেবলমাত্র অহিংসা থেকে উদ্ভূত শক্তিকে ডেকে নিতে পারে তাহলে Herr Hitler তাদের সাহসিকতার কাছে মাথা নত করবে। এমন ঘটনা মানুষদের সাথে ব্যবহার করার সময় হিটলার এখনও অবধি বৃহদাকারে প্রত্যক্ষ করেনি। যদি এই শক্তি দেখানো যায় তাহলে যে দেখাচ্ছে তার অধিকারে থাকবে সেই শক্তি যা হিটলারের storm trooperদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। শক্তির এই প্রদর্শনী কেবল তখনই সম্ভব যখন সত্যের ঈশ্বর এবং অহিংসার প্রতি (তথা ভালোবাসা) জীবন্ত বিশ্বাস রয়েছে।” (Collected Works of Mahatma Gandhi, vol. 74, পৃঃ ২৯৮)
ইহুদিদের গণহত্যা তথা Holocaust নিয়ে গান্ধীর ধারণা ছিল এরকম – “হলোকস্ট বা ঐতিহাসিক গণহত্যাকে পেছন ফিরে দেখে গান্ধী বলেছিলেন, হিটলার ৫০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে। আমাদের সময়ে এ ঘটনা বৃহত্তম অপরাধ। কিন্তু ইহুদিরা তাদেরকে এক ঘাতকের ছুরির সামনে নিজেদের উৎসর্গ করবে। তাদের উচিত পাহাড়ের চূড়া থেকে নিজেদেরকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া ...”
তিনি আরও বলেছিলেন, যদি ইহুদিরা নিজেরাই সম্মিলিতভাবে আত্মহত্যা করে তাহলে তাহলে সেটা হবে এক “বীরত্ব”।” (“Repudiating Gandhian pacifism in the face of mass murder”, The Jerusalem Post, মার্চ ৩১, ২০১৬) গান্ধীর হিসেবে ৫০ লক্ষ ইহুদির মৃত্যু হলেও তাঁর ইহুদিদের জন্য পরামর্শ ছিল যে তারা যেন ঘাতকের ছুরির সামনে নিজেদের উৎসর্গ করে। তাহলে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ তাদের “বীরত্ব”কে স্মরণে রাখবে। এরকম পরামর্শও বাস্তবে দেওয়া সম্ভব? আমাদের স্বাভাবিক বাস্তব বোধ থেকে এরকম ধারণাকে নিতান্ত অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব বলে মনে হওয়া আদৌ অস্বাভাবিক নয়।
আমরা একটু গভীরে নজর করলে অন্য একটি দার্শনিক/মতাদর্শগত সত্যকেও হয়তো হৃদয়ঙ্গম করতে পারব। প্রকৃত অর্থে গান্ধী ইহুদিদেরকে রাষ্ট্রের তরফে সমাজে যে স্থিতাবস্থা রয়েছে তাকে মান্য করার পরামর্শ দিচ্ছেন নানা অছিলায় (লঘু করে বললে) – কখনো সত্যাগ্রহের অবলম্বন, কখনো নিষ্ক্রিয়ভাবে আত্মাহুতি দেবার কথা বলে। এর সাথে ভারতে জাত নিয়ে গান্ধীর যে সুস্পষ্ট অভিমত ছিল তার মিল এখানেই যে নীচুজাত/অস্পৃশ্যদের “হরিজন”-এর মতো শ্রুতিকটুর পরিবর্তে কোমল নাম দিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টিকে লঘু করে ভারতের সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষা করার জন্যই চেষ্টা করে গেছেন।
“এটিক” এবং “এমিক” – সমাজের বাইরের ও ভেতরের বিতর্ক
বিস্তৃতভাবে এ বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য আরও অনেক পুস্তক এবং প্রবন্ধের মধ্যে একটি হল টমাস হেডল্যান্ড, কেনেথ পাইক এবং মারভিন হ্যারিস সম্পাদিত বই Emics and Etics: The Insider/Outsider Debate (সেজ প্রকাশনা)। বইটি ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়। সহজভাবে বলকে, এ বইয়ে “এমিক” শব্দটিকে শবতত্ত্ব, নৃতত্ত্ববিদ্যা এবং সমাজতত্ত্বের দিক থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে – যাঁরা স্থানীয়ভাবে মানুষের মাঝে অবস্থান করেন এবং বোঝার চেষ্টা করেন মানুষ কিভাবে ভাবছেন এবং সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেন। এঁরা একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি নিয়েই কথা বলেন। এই অর্থে গান্ধী বা আম্বেদকর ভারতীয় সমাজের ভেতরের লোক বা “ইনসাইডার”। বিপরীতদিকে, “এটিক” approach হল “বাইরের লোক” হিসেবে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সমাজের মধ্যেকার যোগসূত্র খোঁজার ও বোঝার ধারাবাহিক ও নিরলস প্রয়াস। এই অর্থে মার্ক্সের ভারতের সমাজব্যবস্থা বোঝার ও ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা “এটিক” অবস্থান।
আমাদের বর্তমান আলোচনার এদুটি অবস্থানের পারস্পরিক সংযোগ আছে, আবার নেইও। যারা আগ্রহী পাঠক তাঁরা এ বিষয়ে আরও অনেকদূর ভাবতে পারবেন। এ কারণে এ প্রসঙ্গকে ছুঁয়ে যাওয়া।
আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬)
এক দরিদ্র, অস্পৃশ্য পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষটি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিকসের মতো দুটি বরেণ্য প্রতিষ্ঠান থেকে দুবার ইকনোমিকসে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। লন্ডনে আইন শিক্ষার বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র Gray’s Inn-এ আইন শিক্ষার জন্যও তিনি তাঁর নাম ১৯১৬ সালে নথিভুক্ত করেন। ১৯১৬ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার’স থিসিস হিসেবে লেখেন “Castes in India: Their Mechanism, Genesis and Development”, এবং প্রায় ৪০ পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা এ থিসিসটি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্থ্রোপোলজি বিভাগের সেমিনারে পাঠ করেন ৯ মে, ১৯১৬ সালে। ১৯১৭ সালের মে মাসে Indian Antiquary জার্নালে (Vol. XLVI) লেখাটি প্রকাশিত হয়।
এ থিসিসে তিনি কতকগুলো প্রণিধানযোগ্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ভারতে caste-এর ব্যাপারে বিদেশী শ্রোতাদেরকে বলেন – আমি যে বিষয়টি আলোচনা করতে যাচ্ছি তার জটিলতা নিয়ে স্মরণ করানোর কিছু নেই। আমার চেয়ে সূক্ষ্ম মনন এবং শক্তিশালী কলম জাতের রহস্যময়তা খুলে ধরার কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ বিষয়টি এখনও “অব্যাখ্যাত” অঞ্চলের মধ্যে পড়ে, যদি “un-understood” নাও বলি।” (Annihilation of Caste and Other Essays, Mapple Classics, ২০২১, পৃঃ ১০১)
আম্বেদকর তাঁর থিসিসে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি বলছিলেন তাহলো – “একক সংখ্যায় “caste” বলা বস্তুত অবাস্তব বিষয়। “Castes” কেবলমাত্র বহুবচনে অস্তিত্ব লাভ করে ... জাতের ক্ষেত্রে সাহসভরে সামাজিক বিধিকে লঙ্ঘন করেছে যে পাপী তার ক্ষেত্রে কোন করুণা কাজ করেনা।” (পৃঃ ১২১)
তাঁর বক্তব্যে যুক্তি দিয়ে দৃঢ়তা নিয়ে বলা হয়েছিল – “ভারতে জাতের অর্থ হচ্ছে কৃত্রিমভাবে জনসমাজকে কেটে স্থায়ী এবং নির্দিষ্ট এককে পর্যবসিত করা, যেখানে এন্ডোগ্যামি বা অন্তর্বিবাহের প্রথার ফলে একজন আরেকজনের সাথে মিশে যাবার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে যে সিদ্ধান্তটিতে উপনীত হওয়া যায় তাহলো Endogamy is the only characteristic that is peculiar to caste ...” (পৃঃ ১০৫-১০৬) পরবর্তীতে বললেন – “এভাবে এন্ডোগ্যামিকে এক্সোগ্যামির (বহির্বিবাহ বা অসবর্ণ বিবাহ) ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার নির্গলিতার্থ হচ্ছে জাতের সৃষ্টি করা।”(পৃঃ ১০৭) বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবারও মনে করতেন যে হিন্দুদের ক্ষেত্রে caste হচ্ছে হিন্দুদের একেবারে ভিত্তি/প্রতিষ্ঠান। আম্বেদকরের ১৯১৬-এর থিসিসের অনেকদিন পরে আরেক বিদগ্ধ সমাজতাত্ত্বিক আঁদ্রে বেতেই (Andre Betteile) বলবেন – “caste may be defined as a small and named group of persons characterised by endogamy, hereditary membership, and a specific style of life which sometimes includes the pursuit by tradition of a particular occupation and is usually associ:lted with a more or less distinct ritua l status in a hierarchical system.” (Caste, Class and Power: Changing Patterns of Stratification in Tanjore Village, ১৯৬৫, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া প্রেস, পৃঃ ৪৬)
কার্যত, জাত-ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হিন্দু সমাজের ভিত্তি এন্ডোগ্যামির (স্ব-জাতের মধ্যে বিবাহ) সাথে, একদিক থেকে ভাবলে, হিটলারের অনুসৃত কেবলমাত্র সবল আর্যজাতির মধ্যে বিবাহবন্ধন, ইউজেনিকস এবং, পরিণতিতে, হলোকস্টের মাঝে বৌদ্ধিক পার্থক্যরেখা (ইউরোপীয় দেশ, উন্নত বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক মোড়ক ছাড়া) খুব প্রকট এমনটা বলা যাবে বলে মনে হয়না।
এবারে আম্বেদকরের সবচেয়ে আলোচিত এবং বিখ্যাত প্রতিবেদন (যা ১৯৩৬ সালে জাত-পাত-তোড়ক মণ্ডলের অধিবেশনে পঠিত হয়, এবং পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়) অ্যানিহিলেশন অফ কাস্ট (পূর্বোক্ত মেপল ক্ল্যাসিকস সংস্করণ, ২০২১) নিয়ে স্বল্প আলোচনা করবো। এ লেখায় তিনি দেশের সাংবিধানিকতা এবং রাজনৈতিক বৈধতার গোড়ার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন –
“That the makers of political constitutions must take account of social forces is a fact which is recognised by no less a person than Ferdinand Lassalle, the friend and co-worker of Karl Marx. In addressing a Prussian audience in 1862, Lassalle said:
The constitutional questions are in the first instance not questions of right but questions of might. The actual constitution of a country has its existence only in the actual condition of force which exists in the country: hence political constitutions have value and permanence only when they accurately express those conditions of forces which exist in practice within a society.” (পৃঃ ২৫)
তিনি এ লেখায় প্রশ্ন করেছিলেন – “একথা কি বলা যায় যে ভারতের প্রোলেতারিয়েত শ্রেণী, যেরকম দরিদ্র অবস্থায় আছে, ধনী এবং দরিদ্র ছাড়া আর কোন পার্থক্য বুঝতে পারেনা? একথা কি বলা যায় যে ভারতের দরিদ্র শ্রেণী জাত অথবা ধর্মীয় বিশ্বাস, উঁচু অথবা নীচু ছাড়া আর কোন পার্থক্যকে স্বীকার করেনা? যদি ঘটনা এটাই হয় তাহলে ধনীদের বিরুদ্ধে প্রোলেতারিয়েতদের সংগ্রামে কি ধরনের unity of front আশা করা যেতে পারে? যদি প্রোলেতারিয়েতরা unity of front তৈরি করতে না পারে তাহলে কিভাবে বিপ্লব হওয়া সম্ভব?” (পৃঃ ৩৩)
এ বক্তব্য থেকে আমাদের নজরে আসবে – ভারতের বিশেষ প্রেক্ষিতে ধনী, দরিদ্র, প্রোলেতারিয়েত শ্রেণী ইত্যাদির মাঝে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে জাত। প্রোলেতারিয়েত শ্রেণী যদি এদের সাথে যুক্ত ফ্রন্ট বা unity of front তৈরি করতে না পারে তাহলে সমাজ পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম সফল হওয়া সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে আম্বেদকরের অন্য একটি পর্যবেক্ষণ ভেবে দেখা জরুরী – “জাত ব্যবস্থা কেবলমাত্র শ্রমের বিভাজন নয়। এটা শ্রমিকদের মাঝেও বিভাজন ... অন্য কোন দেশে শ্রমের বিভাজন কোনভাবেই শ্রমিকদের ক্রমবিন্যাসের সাথে যুক্ত নয়।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৫। নজরটান মূল লেখায়)
আম্বেদকর হিন্দুত্বের মূল বনিয়াদকে অস্বীকার করেছিলেন। ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিলেন। এবং জাত-ব্যবস্থার বিনাশ সাধন হিন্দু সমাজকাঠামোর বিনাশের সাথে সংপৃক্ত, এটা তাঁর বিশ্বাস ছিল। তাঁর যুক্তি ছিল – “হিন্দুরা বর্বরদের সভ্য করার জন্য যে কোন মানবিক কাজ করেনি শুধুমাত্র এখানেই শেষ নয়, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা স্বজ্ঞানে Hinduism-এর সীমারেখার মাঝে বসবাসকারী নীচুজাতদের উঁচু জাতের সাংস্কৃতিক মানে আরোহণ করতে বাধা দিয়েছে ... সত্যি করে বললে, কে বেশি ভালো এবং শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য – মুসলমানেরা এবং খ্রিস্টানরা যারা অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের (যারা এদের বলা মুক্তির মার্গকে মানেনি) গলা চেপে ধরেছে অথবা হিন্দুরা যারা মুক্তির আলো ছড়িয়ে দেবেনা, যারা নীচু জাতকে অন্ধকারে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবে, যারা তাদের সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উত্তরাধিকার ভাগ করে নেবেনা তাদের সাথে যারা প্রস্তুত হয়ে আছে নিজেদের আত্মগঠনের জন্য হিন্দু সজ্জাকে (make-up) গ্রহণ করতে? আমার এ কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে যদি মহমেডানরা নিষ্ঠুর হয়ে থাকে তাহলে হিন্দুরা নীচ মানসিকতা রক্ষা করে, এবং নীচতা নিষ্ঠুরতার চেয়ে বেশি খারাপ।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৪৭-৪৮)
তাঁর সুচিন্তিত ভাবনায় ছিল – “একটি আদর্শ সমাজ গতিময় হবে, এক প্রান্তের পরিবর্তন অন্য প্রান্তে পরিবহনের জন্য বিভিন্ন প্রবাহীপূর্ণ হবে। একটি আদর্শ সমাজে সচেতনভাবে বিভিন্ন সুবিধা জ্ঞাপন করা হবে এবং ভাগ করে নেওয়া হবে ... In other words there must be social endosmosis ... গণতন্ত্র কেবলমাত্র সরকারের একটি ধরন নয়। প্রাথমিকভাবে এটা হল সম্মিলিতভাবে বাঁচার পথ, পরস্পরযুক্ত যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা। অপরিহার্যভাবে পাশের মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের মনোভাব হল গণতন্ত্র।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫৬)
আমরা কি এরকম গণতন্ত্রের সহজ স্বাভাবিক আবহাওয়া অর্জন করতে পেরেছি? এ লেখায় আম্বেদকর বললেন যে কার্ল মার্ক্স অর্থনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত করার জন্য প্রোলেতারিয়েতদের বলেছিলেন “তোমাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার আর কিছু নেই”। কিন্তু, তাঁর বিচার অনুযায়ী, মার্ক্সের এই শ্লোগান জাত-নির্ভর হিন্দু সমাজের জন্য অর্থহীন। কারণ? উত্তর তিনিই দিয়েছেন – “Castes form a graded system of sovereignties, high and low, which are jealous of their status and which know that if a general dissolution came, some of them stand to lose more of their prestige and power than others do. You cannot, therefore, have a general mobilisation of the Hindus (to use a military expression) for an attack on the caste system.” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৮৩)
এজন্য তিনি জোর দিয়েছিলেন “reason” এবং “morality”-র অনুশীলনের ওপরে। (পৃঃ ৮৭) সময় অতিক্রম করার সাথে সাথে ২০২২ সালের ভারতবর্ষে আমরা ক্রমশ সামাজিকভাবে, সামগ্রিকভাবে এ দুটি চর্চা থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যাচ্ছি।
অন্যত্র অমোঘ এক বার্তা দিয়েছিলেন আম্বেদকর – “একজন হিন্দু একটি জাতে জন্মায়, সেই জাতের সদস্য হিসেবে মারা যায়, এখান থেকে পালানোর পথ নেই। জাত-হীন কোন হিন্দু থাকতে পারেনা, জাত থেকে পলায়ন করতে পারেনা। এবং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জাতের বাঁধুনিতে বেঁধে থেকে জাতের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং ঐতিহ্যের, যেগুলোর ওপরে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, একজন বাহক হয়ে ওঠে।” (The Essential Writings of B. R. Ambedkar, ed. Valerian Rodrigues, ২০০২, পৃঃ ১০২)
শেষ কথা
গান্ধীর সমসাময়িক পণ্ডিতা রমাবাইয়ের কথা আমাদের স্মৃতিতে আসতে পারে। রামাবাই একক নারী হিসেবে সেসময়ের কঠিন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে, জাত-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। যদিও আমাদের বর্তমান আলোচনায় তিনি খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নন।
একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। ঘটনাটি অরুন্ধতী তাঁর পূর্বোল্লিখিত “The Doctor and the Saint” লেখাটিতে উল্লেখ করেছেন। বছর চল্লিশের সুরেখা ভোটমাঙ্গে মহারাষ্ট্রের ভাণ্ডারা জেলার খেরলাঞ্জি গ্রামের “অস্পৃশ্য” তথা শিডিউলড ট্রাইব জাতের বাসিন্দা ছিল। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাড়ির দুই নারী সুরেখা এবং প্রিয়ংকাকে গ্রামের মাঝে নগ্ন করে প্যারেড করানো হয়। এবং পরিবারের ৪ জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অপরাধ? তাদের নিজেদের জমি উচ্চবর্ণের মানুষ দখল করতে চাইলে ওরা নিজেদের সম্বলটুকু বাঁচানোর জন্য বাধা দেয়। উইকিপিডিয়াতে “Khairlanji massacre” এন্ট্রিতে এ ঘটনার বিবরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। বিস্তৃত খবর রয়েছে।
এখানে আমাদের মালালা ইয়ুসাফজাইয়ের কথা মনে পড়বে নিশ্চয়ই। মালালা তাঁর নির্ভীক ভূমিকার জন্য নোবেল পুরষ্কার অব্দি পেয়েছেন। আর সুরেখা? উত্তর দিয়েছেন অরুন্ধতী – “সুরেখা ভোটমাঙ্গে এবং তার সন্তানেরা মুক্ত বাজারের বন্ধু এক গণতন্ত্রে বাস করত। এজন্য রাষ্ট্রসংঘের তরফে ভারত সরকারের কাছে ‘I am Surekha’-র মতো কোন পিটিশন দেওয়া হয়নি। এমনকি কোন রাষ্ট্রপ্রধানের তরফে ক্রোধ প্রকাশ করে বার্তাও দেওয়া হয়নি। এমনটাইতো হবার কথা ছিল, কারণ আমরা চাইনা আমাদের ওপরে কোন daisy-cutters বোমা পড়ুক (যেমনটা আফগানিস্তানে পড়েছিল) এবং আমরা জাত ব্যবস্থা প্র্যাকটিস করি।” (“The Doctor and the Saint”, পৃঃ ২০)