ভারতভূমির রাষ্ট্র হয়ে ওঠা
বাইরে থেকে রোপণ করা বা এনগ্র্যাফটেড আধুনিকতার যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠলো নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষণীয় যে যেখানে ইউরোপের একটি বড়ো অংশ প্রায় ৩০০ বছর ধরে ধীরে ধীরে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, ভারতে তা অর্জিত হয়েছে মাত্র কয়েকটি দশকে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে যেভাবে ব্যক্তির অভ্যুদয়, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তি-নাগরিকের সহাবস্থান, সমাজ বা কৌমের অবস্থান বিলুপ্ত হওয়া এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (সেক্যুলারিজম) পরিসর তৈরি হয়েছে ভারতে তা হয়নি। ভারতে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং একক ব্যক্তির একক ভোটাধিকার চালু হল সেগুলো মূলত সমাজের উপরের স্তরের রাজনৈতিক ক্ষমতা-চিহ্ন, নীচের স্তরের সামাজিক ক্ষমতা নয়। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে মধ্যস্থতাকারী কোন সামাজিক পরিসর নেই, রয়েছে নাগরিক পরিসর বা সিভিল স্পেস। সামাজিক পরিসরের জোরালো উপস্থিতির সময় আধুনিকতা নির্মিত নাগরিকতার রাষ্ট্রিক ভাষ্য ছাড়াও আরও অনেক স্বর এবং কণ্ঠ, আত্মপ্রকাশ করে। বিখ্যাত উদাহরণ হিসেবে ১৯৬০-এর দশকের প্যারিসের ছাত্র বিদ্রোহ বা আমেরিকায় ভিয়েতনাম বিরোধী আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক Occupy Wall Street” বা “Another World is Possible” কিংবা, বিশেষ করে, একেবারে হালের “#Black Lives Matter” আন্দোলনের কথা মনে পড়বে। এরকম একটি পরিসরে নাগরিক হবার ধারণার সাথে নাগরিক না-হবার, অ-নাগরিকের ধারণাও সামাজিক পরিসর অর্জন করে।
কিন্তু ভারতের মতো দেশে যদি জাতি-রাষ্ট্র তৈরিই হয় ভিন্ন প্রেক্ষিতে এবং ভিন্ন উপাদান নিয়ে? রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রবণতাটি হয়ে ওঠে কেন্দ্রাভিমুখী। ভারত রাষ্ট্রের জন্মলগ্নেই রয়ে গেলো অন্তর্লীন গঠনগত বিরোধ। অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব নিয়ে আধুনিক ভারত গড়ে ওঠার এক অসামান্য আখ্যান সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই’। “অদ্ভুত জিনিস এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জৎ বাড়ে, বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জৎ বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” “বোটের” সুতোয় রাষ্ট্রের সাথে বাঁধা পড়ে একক ঢোঁড়াই, তখনো নাগরিক হয়ে উঠেছে কিনা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে তার গ্রাম অর্থাৎ ব্যক্তি-সমাজ-কৌম-রাষ্ট্র-নাগরিকতার এক আখ্যান। “বলান্টিয়ারদের” দয়ায় নগণ্য ঢোঁড়াই “রামরাজ্য কায়েম করবার কাজে, কাঠবেড়ালীর কর্তব্যটুকু করবার সুযোগ পেয়ে গেল।” ঢোঁড়াইয়ের মননে বা সাইকি-তে যোগসূত্র তৈরি হল “মহাৎমাজীর” সাথে – ইমাজিনড কমিউনিটিজ। এর অবস্থান আধুনিকতার চেনা ডিসকোর্সের বাইরে। ঢোঁড়াইয়ের ভিন্ন যাত্রা শুরু হয়। আধুনিক ভারতের “পাক্কী” রাস্তার বাঁকে ঢোঁড়াই। কিন্তু তার নাগরিকতার মধ্যে রয়ে যায় ভগ্নাংশের উপাদান।
১৯৪৭-পরবর্তী ভারতে অনুসৃত ইউরোপীয় আধুনিকতার ভাষ্যের উপাদানের মাঝে নিহিত যুক্তি অনুসরণ করে আমরা বুঝতে পারি রাষ্ট্রে নাগরিকদের ধরা হবে একেকটি integer (পূর্ণসংখ্যা) হিসেবে। এখানে ভগ্নাংশ অনুমোদিত নয়। মণিপুরী বা কাশ্মিরী বলে আলাদা কিছু হয়না। ওগুলো ভগ্নাংশ, পূর্ণসংখ্যা ভারতীয় নয়। এরকম এক সামাজিক মানসিকতা তৈরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হল ভাষা। আবার পূর্ণসংখ্যা পজিটিভ হতে পারে। পূর্ণ সংখ্যা নেতিবাচকও হতে পারে। গোরখপুরের শিশু বিশেষজ্ঞ ডঃ কাফিল খান – সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ না থাকার ফলে কতগুলো বাচ্চা স্রেফ মরে গেলো, বাইরে থেকে অক্সিজেন জোগাড় করে ডাক্তারবাবু বাঁচালেন অনেকগুলো প্রাণ, তারপরে ৮ মাস জেল খাটলেন। এখানেও তো আবার অন্য বিপদ আছে – আমাদের বিবশ হয়ে যাওয়া সম্মিলিত সংবেদনশীলতা আর ঐতিহাসিক আর সামাজিক বিস্মরণ। কিন্তু নেগেটিভ পূর্ণসংখ্যারা কখনো গৌরি লঙ্কেশ, কখনো কালবুর্গী, কখনো আখলাক, কখনো আসিফা, কখনো পানেসার নামে নিঃশেষ হয়ে যায়। এসবের মাঝে অলক্ষ্যে নাগরিক পরিসরের যতটুকু স্থান রয়েছে তার সঙ্কোচন ঘটেছে, রাজনৈতিক চরিত্রের পৌরুষীকরণ হচ্ছে, নৈতিকতার প্রশ্নগুলো বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষিতে আপনমনে ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুম পাড়িয়েও দেওয়া হয়, যাকে বলে এথিকাল ট্র্যানকুইলাইজেশন (ethical tranquilization)।
কতসব অ-পূর্ণ রাশি! নাগরিক-অনাগরিক, ভারতপ্রেমী-রাষ্ট্রদ্রোহী, হিন্দি-অহিন্দি, কেন্দ্রের ভারত-প্রান্তের ভারত, ক্ষমতার ভারত-ক্ষমতাহীনের ভারত, ক্রিকেটের ভারত-ডাংগুলির ভারত, টেনিসের ভারত-গোল্লা ছুটের ভারত, কমপ্লানের ভারত-ডিম খেতে চাওয়া মিড-ডে মিলের ভারত! সবাইকে প্রকাশ করতে হবে পজিটিভ পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে? কিংবা চিহ্ন-জ্ঞাপক কোন শ্লোগান দিয়ে? শ্লোগান এবং নির্মিত কিছু শব্দসমষ্টি শুষে নেয় চিন্তাকে – যে চিন্তাহীনতা রাষ্ট্র এবং ক্ষমতার অধীশ্বরেরা দাবী করে। যেমনটা ‘হীরক রাজার দেশে”-তে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। রাষ্ট্র তো বারেবারে একটি কথাই বলছে। হয় তুমি ভারতীয়, নয় তুমি ভারতীয় নও। এর মাঝে রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠার নানা রকমের কৃৎ-কৌশল রয়েছে, আছে ক্রমশ ঘৃণাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। হিংসাকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী (spectcularization) করে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে এগুলো নিজের নিয়মেই সহনীয় হয়ে উঠবে।
আরেকভাবে দেখলে নিজভূমে পরবাসী হবার সমস্ত সম্ভাবনা খোলা থাকলো একটি আধুনিক তথা parochial রাষ্ট্রের কাছে। এ অবস্থাকে জয়া চ্যাটার্জি উদ্বাস্তু সমস্যার প্রেক্ষিতে বুঝেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে – “Building new nations, as one commentator has observed, is a ‘refugeegenerating process’. Efforts to create homogeneous nation states change some subjects into minorities who find themselves on the ‘wrong’ side of new borders or in the ‘wrong’ state, with the ‘wrong’ ethnicity, language or religion. Minorities are made to feel they should belong somewhere else, that they should be ‘nationals’ of some other new state made up of ‘people like them’.” তিনি দেখেছেন – “In the aftermath of empire, such migrations have profoundly transformed the demographic landscapes of the modern world.” হ্যাঁ, এভাবেই গড়ে উঠেছে আধুনিক রাষ্ট্র – exclusionary politics-কে আশ্রয় করে।
রাষ্ট্রের এরকম এক ভবিতব্যে শিক্ষকেরা হয়ে যাবে educational managers, শিক্ষাদান সংক্রান্ত নানারকমের টেকনিক্যাল কাজকর্ম সামলাবেন। ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার কোন জ্ঞানভিক্ষু হিসেবে অবস্থান তৈরি হবেনা। সিলেবাসও সেভাবে তৈরি হবে, যেমন সাম্প্রতিক দিল্লি বা জওহারলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। অঁরি জির (Giroux) শিক্ষার প্রেক্ষিতে “ক্ষমতা”-র ভূমিকা নিয়ে এক জায়গায় বলছেন – “Power, in this case, becomes a form of cultural production, linking agency and structure through ways in which public and private representations are concretely organized and structured within schools.”
এক নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ হচ্ছে যার ভিত্তিতে রয়েছে শুধুমাত্র তাৎক্ষণিকতা-নির্ভরতা, শুধুমাত্র বর্তমানকে যাপন করা। অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের লুম্পেনরা আলোয় আসার, রাজপথের দখল নেবার, ক্ষমতার বৃত্তের সাথে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে। স্পষ্ট ভাষায় ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করবে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেবে “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যায়। আমাদের এতদিনের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে ঠিক এই গল্পগুলো তৈরি হচ্ছেনা। এখানে রাষ্ট্র শুধু অতিরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে এমন নয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে লুম্পেনদের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীদের প্রয়োজন পড়েনা। কারণ তাদেরকেও তো একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। রবীন্দ্রনাথকেও কোথাও কোথাও সিলেবাস থেকে বাদ দেবার প্রস্তাব এসেছে। কর্পোরেট পুঁজির জগতে হয়তো তিনি বেমানান। ইতিহাসের পুনর্লিখন চলছে। ১৮৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সতর্ক করেছিলেন – “কুৎসিত বেশে সজ্জিত বর্বরতাপূর্ণ এই বৈষয়িকতা মানবিকতার বিরুদ্ধে এক প্রবল অভিশাপ, কারণ পূর্ণতার শক্তির উপরে ক্ষমতার প্রমত্ত আদর্শ চেপে বসেছে। … শক্তিমানের কাছে এই প্রলোভন যতটা সর্বনেশে, দুর্বলের কাছে তা আরও বেশি ভয়ঙ্কর। … আমাদের জীবন হয়ে উঠুক বহিরঙ্গে সহজ আর অন্তরঙ্গে মহীয়ান। আর্থিক শোষণ ও বিরোধের উপরে নয়, সামাজিক সহযোগের ভূমিতে আমাদের সভ্যতা দৃঢ়ভিত্তি লাভ করুক।” (ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ)
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অন্যতম প্রস্তুতি ছিল গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভোট। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে ঢোঁড়াই বুঝতে পারে – “অদ্ভুত জিনিষ এই ‘বোট’। হঠাৎ টাকা পেলে লোকের ইজ্জত বাড়ে, এর অভিজ্ঞতা ঢোঁড়াইয়ের জীবনে আগে হয়েছে। বোটও সেই রকম রাতারাতি লোকের ইজ্জত বাড়িয়ে দেয়, কেবল যে বোট দেবে তার নয়, সারা গাঁয়ের।” (সতীনাথ ভাদুড়ি, ঢোঁড়াই চরিত-মানস) এখানে অব্যর্থভাবে মনে পড়বে বেনেডিক্ট অ্যন্ডারসনের Imagined Communities-এর কথা – “anonymous performance of citizenship”. কোন ভগ্নাংশে একে দেখা যাবেনা – হয় শূন্য কিংবা ১, এরকম পূর্ণ রাশিতে তোমার পরিচয়। তুমি একইসাথে ভারতীয় এবং পাকিস্তানী হতে পার না। “গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থা তো একটি শক্তপোক্ত secularizing process – এমনটাই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু জাতের সমস্যা, বিভাজন, পারস্পরিক হিংস্রতা রয়েই গেলো। আবার ঢোঁড়াইয়ে ফিরি – “আমাদের সাহায্যেই ভোটে কংগ্রেসি জিতেছিল আগেরবার। এবার তাই আমরা ঠিক করেছি কুর্মছত্রি, কুশবাহাছত্রি, আর যদুবংশছত্রি এই তিন জাত মিলে রাজপুত ভূমিহারদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব।” এর উত্তর ৬২ বছরেও মিললো না। The answer my friend is blowing in the wind!
ঢোঁড়াই দেখেছিল – “আর পূবের দিকের টুরমেনের ফারমের সিধা রেল লাইনের কাছে কাঠের ইস্টিশন করেছে ফৌজের সাহেবরা। বড় বড় চালা তুলেছে সেখানে। গোরু, ঘোড়া, ছাগল, খচ্চর, ভেড়ায় ভরা। সব বেলুচি ফৌজ মুসলমান নইলে এত কসাই আর কে হবে। অথচ মুসলমানরা চটবে বলে উট আর শুয়োর রাখেনি সরকার।” সেনাবাহিনীতে সাম্প্রদায়িকীকরণ অনেক পরে আবুল কালাম আজাদও অনুভব করেছিলেন – “This injected communal poison in the army which till then had been free from it.” আজাদ একথা বলছেন ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্টের অব্যবহিত আগে। ঢোঁড়াই আরো আগে একই বিষয় নিজের বাস্তবতা দিয়ে অনুভব করছে!
কিভাবে অখণ্ড ভারতবর্ষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাদের ক্ষমতার লোভে টুকরো টুকরো হল সে নিদারুণ ঘটনা বিস্তৃত জানার জন্য অন্তত তিনটি বইয়ের কথা উল্লেখ করবো – (১) জয়া চ্যাটার্জীর Bengal Divided এবং The Spoils of Partition, (২) রজতকান্ত রায়ের “পলাশী থেকে পার্টিশন” এবং (৩) সুমিত সরকারের Modern India: 1885-1947।
কি হল তারপরে? উর্বশী বুটালিয়ার The Other Side of Silence-এর oral history, personal narrative, government documents ইত্যাদি সব নথিভুক্ত করেছে। তাঁর হিসেবে – “Twelve million people were displaced. Nearly one million died. Some 75,000 women were raped, kidnapped, abducted, forcibly impregnated by men of the ‘other’ religion, thousands of families were split apart, homes burnt down and destroyed, villages abandoned.” (p. 35) আরো মর্মান্তিক হল “while abducted women then entered the realm of silence, women who were killed by families, or who took their own lives, entered the realm of martyrdom.” (p. 158) একদল নারীর যাত্রা পরম নৈঃশব্দে এবং বিস্মৃতিতে যাদের কোথাও কোন চিহ্ন নেই (স্রেফ মুছে গেলো), আরেকদল অর্জন করলো শহীদের মর্যাদা। স্বাধীনতার কি অট্টহাস্যময় পরিহাস!
বীণা দাস তাঁর Transactions in the Construction of Pain প্রবন্ধে জানাচ্ছেন – “The bodies of the women were surfaces on which texts were to be written and read – icons of the new nations.” কিন্তু বিপরীত ঘটনাও ঘটলো – “But women converted this passivity into agency by using metaphors of pregnancy…” অর্থাৎ, সন্তান ধারণ করার বিশেষ বায়লোজিক্যাল ক্ষমতাকে নারী তার agency হিসেবে ব্যবহার করছে – গর্ভধারণ করতে পারা যেন তার একমাত্র আইডেন্টিটি।
পরিবার, নারীত্ব, চিরকালীন বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, দেশহারা-ভূমিহারা-আশ্রয়হারা-নির্বান্ধব হবার তীক্ষ্ণ বর্ণনা ধরা আছে An Epic Unwritten: The Penguin Book of Partition Stories-এ। সাদাত হাসান মান্টোর “সাহে” গল্পে হিন্দুদের সাথে একসাথে সারাজীবন, বংশ পরম্পরায় বেড়ে ওঠা বন্ধু মুমতাজ শেষ অব্দি লাহোর যাবার জাহাজে উঠে পড়লো। সেসময় “After his bags had all been taken to the cabin, he took us out onto the deck. For a long time he gazed out of the place where sky and sea came together. He then took Juggal’s hand in his and said, ‘How perfectly deceptive … this meeting of the sky and the sea, and yet so incredibly delightful too!’” মান্টোর আরেকটি বিখ্যাত গল্প “টোবা টেক সিং”-এ পাগলা গারদের এক পাগল জিজ্ঞেস করে – If they were in India, where on earth was Pakistan? And if they were in Pakistan, then how come that until only the other day it was India?” অন্য একজন পাগল গাছের ওপরে উঠে পড়ে জানায় সে ভারত বা ভিন্ন কোন ভূমিখণ্ডে নেই – এক নিরালম্ব অবস্থা। গল্পের প্রধান চরিত্র বিষান সিং ১৫ বছর ধরে শুধু দাঁড়িয়েই ছিল। তারপরে তাকে যখন জোর করে ভারতে পাঠানো হবে তখন এই চূড়ান্ত মানসিক আর শারীরিক ধকল সে নিতে পারেনা, পড়ে থাকে তার প্রাণহীন দেহ – There behind the barbed wire, on one side, lay India and behind more barbed wire, on the other side, lay Pakistan. In between, on a bit of earth which had no name, lay Toba Tek Singh.” “নো ম্যান’স ল্যান্ডে” পড়ে রইলো মানুষটি যার কোন দেশ নেই। মান্টো তাঁর “সহায়” গল্পের (মূল উর্দু থেকে অনুবাদ সঞ্চারী সেন) শুরু করছেন এভাবে – “এমন কথা বলোনা যে এক লাখ হিন্দু আর এক লাখ মুসলমান মারা গেছে। দু লাখ মানুষ যে মারা গেছে সেটাও আসল ট্র্যাজেডি নয়। আসল ট্র্যাজেডি হল মৃত্যুগুলো খুব বেহিসেবি হয়েছে। এক লাখ হিন্দু মেরে মুসলমানরা ভেবেছিল হিন্দুধর্ম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তা হয়নি, হিন্দুধর্ম রয়ে গেছে, রয়ে যাবে। তেমনি এক লাখ মুসলমান মেরে হিন্দুরাও আনন্দে বগল বাজিয়েছিল যে ইসলাম খতম হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব আপনাদের সামনে হাজির, ইসলামের গায়ে আঁচড়টুকুও লাগেনি। তারা নির্বোধ, যারা মনে করে বন্দুক দিয়ে ধর্ম শিকার করা যায়। ধর্ম, ন্যায়, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এ সবকিছুই আমাদের শরীরে নয়, আত্মায় অবস্থান করে। ছুরি, কৃপাণ, গুলিতে এদের ধ্বংস করা যাবে কী করে?”
“রাইত কতো হইলো? উত্তর মেলে না!”
কৃষণ চন্দরের “পেশোয়ার এক্সপ্রেস” গল্পটি একবার স্মরণ করি। পেশোয়ার এক্সপ্রেস এখানে নিজের মনে কাহিনী শোনায়। এক ট্রেন ভর্তি জবাই হওয়া হিন্দু ভারতে আসছে, ফিরতি ট্রেনে ট্রেনভর্তি হিন্দুদের হাতে কাটা মুসলিম দেহ নজরানা হিসেবে ফেরত যাচ্ছে। ট্রেনটি গোঙায়। অবশেষে সেই মেয়েটিকে পেয়ে গেলো দাঙ্গাবাজেরা – “মেয়েটি ওদের হাতে নিহত হল। জঙ্গলের শুকনো ঘাসের ওপর মেয়েটি ছটফট করতে করতে মারা গেল। আর তার হাতের বইখানা রঞ্জত হল তারই দেহের রক্তে। বইটা ছিল সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা।” জন স্ট্র্যাচির Why One Should Be A Socialist। “সে তো নারী ছিল। হতো কারও প্রিয়তমা অথবা জননী। আর এখন সে এই জঙ্গলে পড়ে আছে লাশ হয়ে। শকুন আর শেয়ালেরা তার লাশ ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা বইটা জানোয়ারেরা ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। বিপ্লবের দরজা আর কেউ খুলছে না। কেউ কিছু বলছে না।”
আমাদের স্বাধীনতা পরিক্রমা আপাতত “শান্তি কল্যাণ” নিয়ে শেষ হল বেশ জবরভাবে বুঝতেই পারছেন। শুধু ৬২ বছর পরেও বিস্মৃতির অতলান্ত গহ্বর থেকে উঠে আসা স্কন্ধ কাটা মানুষগুলো বারেবারে বেসামাল করে দেয়। শিকাগোর হে মার্কেটের শহীদ অগাস্ট স্পাইসের গলায় ফাঁসীর দড়িতে টান পড়ার আগে তার শেষ কথা ছিল – “The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today.” (History As It Happened, p. 199)
আর আমাদের বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের কানে যেন মন্ত্রোচ্চারণ করেন –
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে বলে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল ;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমণীকে বুকে টানে; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।