প্রাককথন
General Report on Public Instruction (GRPI) 1849-50 থেকে শুরুতেই জানা যাচ্ছে হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন জাতের ছাত্ররা ছিলেন – ব্রাহ্মণ ১৫, বৈদ্য ৮, কায়স্থ ২৪, তাঁতি ৩, নাপিত ৪, কামার ২, এবং কৈবর্ত্য ৩ জন। একটি নোটে জানানো হয়েছিল সেশনের শুরুতে ছাত্রের সংখ্যা ছিল ১২০ জন। পরবর্তীতে এর মধ্যে ২ জন মারা যান, ১১ জন কলেজ ছেড়ে যান এবং ১২ জনকে অনিয়মিত হবার দরুন কলেজ থেকে নাম কেটে দেওয়া হয়। (GRPI 1849-50, পৃঃ ১২০)
এরপরে GRPI (1850-51)-এর রিপোর্ট থেকে জানা যায় এই শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগ মিলে ১১৯ জন ছাত্র ভর্তি হয়েছে। দেশীয় ছাত্রদের মধ্যে ৯ জন মুসলমান। বাকিরা হিন্দু। তাদের মধ্যে জাতের বিভাজন ছিল – ব্রাহ্মণ – ২৩, বৈদ্য – ৮, কায়স্থ – ৩২, তাঁতি – ৪, ক্ষৌরকার – ২, বেণিয়া – ৬, কৈবর্ত – ২, তিলি – ১, সদগোপ – ১ মোদক – ১। কলেজে ক্লাস করার জন্য ঘড়ির সময় ধরে আসা, নিয়মিত ক্লাসে হাজিরা দেওয়া এবং শিক্ষাক্রমের নিয়ম মেনে প্রশ্নপত্রের উত্তর ও নিয়মিত পাঠাভ্যাস তৈরি করা সবকিছুর সম্মিলিত ফল হিসেবে জন্ম নিল আধুনিকতার উপযোগী এক নতুন শৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিকতার নিয়মাবলী (discipline and governance)।
খেয়াল করলে বুঝবো, “caste” তথা জাত বিভাজন অক্ষত রইল। একে ছাত্রদের সংখ্যানুপাতে বিচার করে বার্ষিক রিপোর্টে পেশও করা হল। কিন্তু গ্রামীণ বা চলে-আসা ভারতীয় সমাজের ধরনে বিষয়টিকে উচ্চ-নীচ সামাজিক প্রভেদ হিসেবে আর বিচার করা হচ্ছেনা। এক নতুন “সেকুলার সোশ্যাল হায়েরার্কি” তৈরি হল। এর অভ্যন্তরে জাত বিষয়টি বহাল তবিয়তে বেঁচে রইল, কিন্তু একটি রোপিত আধুনিকতা বা “এনগ্র্যাফটেড মডার্নিটি”র চাদর একে পরিয়ে দেওয়া হল। মেডিক্যাল কলেজ সহ হিন্দু কলেজ বা হুগলী মহসিন কলেজের মতো উচ্চশিক্ষার যে নামী প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হল তার অঘোষিত বাতাবরণ রচিত হল যে জাত আর প্রধান পরিচয় নয়। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনের বাইরে প্রশস্ত আঙ্গিনায় কাঠামোটি অটুট রইল।
আরও দুয়েকটি বিষয় লক্ষণীয় – (১) অনেক ছাত্রকেই কলেজে পৌঁছুনোর জন্য যাতায়াতে দৈনিক ১২ থেকে ১৬ মাইল পথ রোজ হাঁটতে হত (এখন আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে), এবং (২) যে গ্রামে ছাত্ররা থাকত সেখানে সঠিক সময় বলে দেবার কেউ নেই, কোন উপায় নেই। সহজভাবে বললে, মেডিক্যাল কলেজ ও হিন্দু কলেজকে কেন্দ্র করে যে নাগরিক ও সভ্য কলকাতা গড়ে উঠছে তার সাথে ৬ বা ৮ মাইল দূরের জনপদের, যা তখনো গ্রাম, চরিত্রগত পার্থক্য বিস্তর। Clock-time-কে কেন্দ্র করে এই ছাত্রদের সাথে শিক্ষা তথা রাষ্ট্রের নতুন সম্পর্ক জন্ম নিচ্ছে, নির্ণীত হচ্ছে। নাগরিক হয়ে উঠছে ছাত্ররা। অথচ এই ছাত্রদের উৎসস্থল গ্রামগুলো এই clock-time-এ বাঁধা পড়েনি। রাষ্ট্রের সাথে বন্ধন দুর্বল। নাগরিকত্ব গড়ে উঠছে এমনটাও বলা সঙ্গত হবেনা। সে কলকাতার মধ্যে একাধিক কলকাতা ছিল।
আমরা নজর করব, একটি সেকুলার পাঠক্রমের মধ্য দিয়ে ছাত্ররা রাষ্ট্রের ঈপ্সিত অনুগত, সুশীল, বাধ্য এবং শৃঙ্খলাপরায়ন নাগরিক হবার পাঠ গ্রহণ করলেও যখন কলেজের রিপোর্ট পেশ করা হচ্ছে তখন খুব পরিষ্কার ভাষায় ছাত্রদের জাতিগত বিন্যাস আলোচিত হচ্ছে। সেকুলার শিক্ষার মাঝে কম্বলে চাপা দেবার মতো করে জাত তথা caste-এর প্রসঙ্গ স্পষ্টভাবে উৎকীর্ণ হয়ে থাকছে। Caste এবং সেকুলারিটির মধ্যেকার এই টানাপোড়েন নিয়েই ভারতীয় সমাজ বিবর্তিত হয়েছে। এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজ তথা ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ এ ঘটনার ক্ষেত্রে একটি চোখে-আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার মতো উদাহরণ।
এজন্য মেডিক্যাল কলেজের এবং আধুনিক মেডিক্যাল শিক্ষার ইতিহাস শুধু চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ কোন শিক্ষাদানের ইতিহাস নয়। এ ইতিহাস নতুন রাষ্ট্রের উপযোগী নতুন নাগরিক তথা সিটিজেন তৈরির ইতিহাস (রাজা-প্রজার ইতিহাসকে অতিক্রম করে)। পরবর্তীতে সমগ্র ভারত জুড়ে ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে governance-এর (সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় একে ‘প্রশাসনিকতা’ বলেছেন) নতুন টেকনিক ছড়িয়ে পড়েছে বিস্তৃত সমাজজীবনে। আধুনিক রাষ্ট্রের চৌহদ্দির বাইরে বিপুল জনতা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের মেডিক্যাল নজরদারির আওতায় চলে এল। শুধু তাই নয়, এরা ক্রমাগত আধুনিক হাইজিন, স্যানিটেশন এবং হেলথ প্রোগ্রামগুলোর technique আয়ত্ত ও আত্মীভুত করে নিল। নতুন অর্থ নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র মানুষের চেতনায় স্থান পেল।
এই বার্ষিক রিপোর্টের “Conduct of the Students of Hindustani Class” অংশে জানানো হল “several of them were engaged in a riot with persons on the outside of the College walls, which led to the interference of the police, by whom ten of the pupils were seized and taken before the Magistrate, who punished all of them by fines.” (পৃঃ ৮৬) এরকম “বিপজ্জনক” ঘটনার প্রেক্ষিতে কাউন্সিল অফ এডুকেশন হস্তক্ষেপ করে এবং তদন্তের পরে ৬ জন স্টাইপেন্ডিয়ারি ছাত্র এবং ৪ জন ফ্রি ছাত্র “were dismissed from the school.” এ ঘটনা বাধ্য, অনুগত, সুশীল নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে এমন অশনি সংকেত বহন করেছিল যে লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Medical Times and Gazette: A Journal of Medical Science, Literature, Criticism, and News (New Series, vol. 5, July 3 to December 25, 1852)-এও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। “Bengal Medical College” শীর্ষক সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে বলা হল – “It appears necessary to enforce a strict discipline in the school, as towards the end of the session some the students were engaged in a riot with persons outside the College walls, which led to the interference of the police, whom ten of the pupils were seized and taken before the magistrate, who punished them all of them by fines.” (Medical Times and Gazette, পৃঃ ২৫) এর আগেও আমরা ছাত্রদের তরফে উপনিবেশিক সিস্টেমের subversion করার ঘটনা দেখেছি – সিস্টেম যতই বাইরের আবর্জনাময় “নেটিভ পরিবেশ” থেকে আলাদা করে ধুয়েমুছে পরিচ্ছন্ন নাগরিক তৈরির চেষ্টা করুক না কেন। এটাই সমাজের আভ্যন্তরীন গতিময়তা, জনসমাজের ধারা।
আমরা Rules and Rugulations (১৮৪৯)-এ দেখেছি ভারতীয় রোগীদের খাদ্যের জন্য যেখানে দৈনিক বরাদ্দ ১ আনা, ইউরোপীয় রোগীদের ক্ষেত্রে সে বরাদ্দ দৈনিক ৪ আনা। এখানেও দেখতে পাচ্ছি – ১০০ জন ইউরোপীয় রোগীর জন্য মাসিক খাদ্য বরাদ্দ ৭০০ টাকা, অথচ ২৫০ জন ভারতীয় রোগীর জন্য সে বরাদ্দ ৩০০ টাকা।
তথাকথিত সেক্যুলার মেডিসিনের মধ্যেও জাতিগত বা বর্ণবৈষম্য প্রকটভাবে চোখে পড়ে এবং সেটা এখনও আছে। এজন্য গবেষকদের একাংশের ব্যাখ্যায় একে “racial medicine” বললে অত্যুক্তি হয়না। বিশেষ করে কোভিডের সময়ে আমেরিকা এবং ইউরোপে এটা ভীষণ প্রকট হয়ে এসেছে। এদেশে প্রচ্ছন্ন থেকেছে, কিংবা আমরা কোন কথা বলিনি। তাহলে মোদ্দা ব্যাপার হল, ভারতের বিশেষ পটভূমিতে একদিকে জাতের বিভাজন (casteism), অন্যদিকে বর্ণবিভাজন (racism) দুটি সামাজিক বিষয়ই একসঙ্গে জুড়ে গেল।
এখানে ভেবে দেখা দরকার, যেসব ছাত্ররা (সংখ্যায় অনেক কম) সুযোগ, শিক্ষা এবং মেধার জোরে মেডিক্যাল কলেজে উচ্চবর্ণের ছাত্রদের সাথে এক পঙক্তিতে বসে লেখাপড়া শিখছে তাদের মাঝে ভিন্ন একটি প্রবণতাও কাজ করে থাকতে পারে।
ভারতীয় সমাজজীবনে জাতের অস্তিত্ব
ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক এম এস শ্রীনিবাস একে “Sanskritization”/”Westernization”-এর ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন (“A Note on Sanskritization and Westernization”, The Far Eastern Quarterly, Vol. 15, No. 4 (Aug., 1956), pp. 481-496) । তাঁর পর্যবেক্ষণে – “The caste system is far from a rigid system in which the position of each component caste is fixed for all time. Movement has always been possible, and especially so in the middle regions of the hierarchy. A low caste was able, in a generation or two, to rise to a higher position in the hierarchy by adopting vegetarianism and teetotalism, and by Sanskritizing its ritual and pantheon. In short, it took over, as far as possible, the customs, rites, and beliefs of the Brahmins, and the adoption of the Brahminic way of life by a low caste seems to have been frequent, though theoretically forbidden. This process has been called "Sanskritization" ... in preference to "Brahminization"...”
এরপরে আরও পরিষ্কার করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন – “Economic betterment thus seems to lead to the Sanskritization of the customs and way of life of a group. Sometimes a group may start by acquiring political power and this may lead to economic betterment and Sanskritization. This does not mean, however, that economic betterment must necessarily lead to Sanskritization. What is important is the collective desire to rise high in the esteem of friends and neighbors, and this should be followed by the adoption of the methods by which the status of a group is raised.”
যদিও আরেক প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় শ্রীনিবাসের এ ধারণাকে ভিন্নভাবে দেখেছেন। পার্থ বলছেন – “এই প্রক্রিয়ায় দেখা যেত যে নিম্নতর জাতি উচ্চজাতির আচার-ব্যবহার আদব-কায়দা অনুকরণ করে দাবি জানাচ্ছে, আমরা মোটেই নিকৃষ্ট নই, ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে আমরা উচ্চজাতিরই সমান। এই দাবির সঙ্গে যুক্ত থাকত নবলব্ধ আর্থিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতা যার জোরে সেই জাতি, বা তার নেতৃস্থানীয় অংশ, ধর্মাচারের ক্ষেত্রেও অধিকতর মর্যাদার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করত ... ফলে ‘সংস্কৃতায়ন’ প্রক্রিয়ার মধ্যেও প্রকাশ পেত উচ্চনীচের সংঘাত।” (“জাত-জাতি-জাতীয়তাবাদ”, ইতিহাসের উত্তরাধিকার, আনন্দ, ২০০৯, পৃঃ ৮৮) এ লেখাতেই পরে তিনি খানিকটা পরিহাসছলে বলছেন – “এখন কিন্তু উলটোটাই দেখা যায় বেশি। সরকারি তালিকায় কে কত নীচে বসবে, তারই প্রতিযোগিতা চলছে।” (পৃঃ ৮৯)
বিবেক কুমার সাম্প্রতিক সময়ে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন – “২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত ২৪টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদিত ১,৬৮৮টি প্রফেসর পদের মধ্যে মাত্র ২৯ জন প্রফেসর এবং ৩,২৯৮টি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদের মধ্যে মাত্র ৯০ জন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ছিলেন category-র। শতকরা হিসেবে এ সংখ্যা যথাক্রমে ২.৭৩% এবং ৪.৪%, যেখানে সাংবিধানিকভাবে SC-দের জন্য সংরক্ষণ ১৫% হওয়া বাধ্যতামূলক।
উচ্চতর শিক্ষার বহিষ্কারক চরিত্র (exclusive) আরও পরিষ্কার হয়ে যায় যখন আমরা দেখি যে SC এবং ST ক্যাটিগরিতে থাকা ছাত্রের শতকরা হিসেব যথাক্রমে ১৩.৫% এবং ৪%। এটা প্রমাণ করে যে আমাদের উচ্চতর শিক্ষার কাঠামোটি বহত্ব-বর্জিত।” (“Discrimination on Campuses of Higher Learning: A Perspective from Below”, EPW, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৬, পৃঃ ১২-১৫)
আরও সাম্প্রতিক সময়ে ৪টি স্বীকৃত সংস্থার (Forum Against Oppression of Women, Forum for Medical Ethics Society, Medico Friend Circle, Peoples' Union of Civil Liberties, Maharashtra) যৌথ উদ্যোগে প্রস্তুত “The Steady Drumbeat of Institutional Casteismঃ Recognize Respond Redress” শিরোনামের ফাইনাল রিপোর্টে (২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১) বলা হয়েছে – “জাতের ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগ (hierarchy) এবং ব্রাহ্মণ আধিপত্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুধর্ম নিরন্তর সক্রিয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সামাজিকভাবে এই জাতের বিভাজনকে চিরস্থায়ী হিসেবে রাখার জন্য, যাতে “হেজেমনিক” মতাদর্শগত ক্ষমতাকে ভারতীয় সমাজের ওপরে রক্ষিত হয়। ভিন্ন জাতের মধ্যে বিবাহ (যাকে আম্বেদকর বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন “exogamous marriage” হিসেবে) ২০১১ সালে ছিল মাত্র ৫.৮২%, এবং চার দশকে এই প্রবণতার কোন ঊর্ধমুখী চিত্র দেখা যায়নি।”
রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে – “অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজে দুটি গ্রুপের ছাত্র দেখা যায় – একদল আসে প্রাধান্যকারী ও প্রভাবশালী জাতগুলো থেকে এবং অন্যান্যরা প্রান্তিক জাতের ও ট্রাইবের ... প্রান্তিক জাতের এবং সমাজের ছাত্রদেরকে সামাজিক হায়েরার্কির ক্ষেত্রে ‘তাদের অবস্থান’ বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং এটা সাধারণ প্র্যাকটিস যে তাদের মধ্যে হীনমন্যতা জন্ম নেয়, তাদের নিজেদেরকে অযোগ্য মনে হয়। এই প্রবণতার পরিধি হচ্ছে একদিকে এই ছাত্রদের বারংবার মনে করিয়ে দেওয়া যে তারা এই ইন্সটিটিউশনের একেবারেই অনুপযুক্ত, অন্যদিকে তাদেরকে বারংবার খোলাখুলি বলা হয় যে কলেজ ক্যান্টিন এবং মেসে তারা যে মানের খাবার পাচ্ছে তার জন্য তাদেরকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।” (পৃঃ ৪৬-৪৭)
কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের তরফে ২০১৯ সালে লোকসভায় পেশ করা হিসেব অনু্যায়ী দেখা যাচ্ছে, ২৩টি আইআইটিতে ৬,০৪৩ জন ফ্যাকাল্টি সদস্যের মধ্যে ১৪৯ জন SC, এবং ২১ জন ST – মোট ফ্যাকাল্টি সংখ্যার ৩%-এরও কম। একই ছবি দেখতে পাওয়া যাবে সর্বভারতীয় ১৩টি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (IIMs) এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এমনকি এইমস-এর মতো মর্যাদাশালী আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুবিদিত মেডিক্যাল শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে এই জাত-বিভাজনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০০৭ সালে প্রোফেসর থোরাট কমিটির রিপোর্ট পেশ করা হয়। সে রিপোর্টে রেকমেন্ড করা হয় – “The Committee recommends that the AIIMS should set up a special office called “Equal Opportunity Office” to deal with all the issues relating to SC, ST and OBC students. This office should implement the remedial coaching programs and other schemes for the SC/ST students. It should also serve as an office which will address the grievances of SC/ST students and also other problems. It should be headed by a senior faculty and supported by one more faculty with proper supporting staff and funding.” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯৯)
ল্যান্সেট-এর মতো মান্য মেডিক্যাল জার্নালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে “The health of India: a future that must be devoid of caste” (নভেম্বর ২৯, ২০১৪)। এ প্রতিবেদনে বলা হয় – “This ingrained inequality has led to tacit acceptance of the caste system, which has created, among other challenges, a preventable epidemic of mortality among women and children. Indeed, many of India’s health indicators fare poorly in comparison with its neighbouring countries and economic peers.” (পৃঃ ১৯০১)
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল (Global Health)-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (“Is health politically irrelevant? Experimental evidence during a global pandemic”, ২৫ অক্টোবর, ২০২০, পৃঃ ১-৮) বলা হয় – “ভারতের জাতপাত ব্যবস্থা একটি ‘disabling myth’ যা নারী এবং শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য এবং ন্যায়পরায়তাহীন মৃত্যুহারের দ্যোতক ... সবচেয়ে ধনী ৯৩% মানুষ পরিষ্কার করার জন্য সাবান এবং জল ব্যবহার করতে পারে, যেখানে সবচেয়ে নীচের দিকে থাকা ২৫% মানুষও এগুলোর নাগাল পায়না। সবচেয়ে কম সম্পদ থাকা নীচের তলার মানুষের প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জনও জল, সাবান এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্ন হবার উপাদান থেকে বঞ্চিত। উঁচু জাতির মানুষেরা প্রাধান্যপূর্ণভাবে ধনী (57% of the upper castes are in the richest two quintiles), যেখানে শিডিউলড ট্রাইবদের ৭০% এবং শিডিউলড কাস্টদের ৫০% belong to the lowest two quintiles.”
এখানে গান্ধী-শিষ্য নির্মলকুমার বসুর মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। বসু লিখছেন – “হিন্দুরা যে কোনও কালে, কামার, কুমার, স্যাকরা, ব্যবসায়ী, চাষি সকলকে লইয়া একটা যৌথ পরিবার গড়িবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, যে পরিবারের মধ্যে সকলের আয় সম্মিলিত হইয়া অবশেষে বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষের প্রয়োজন মতো ব্যয়িত হইত, শাস্ত্রগ্রন্থে কোথাও তাহার প্রমাণ নাই।” (“হিন্দু সোশ্যালিজম”, বাঙালির সাম্যবাদ চর্চা, সম্পাঃ শিপ্রা সরকার, অনমিত্র দাস, আনন্দ, ২০১৯, পৃঃ ১৮৭)
ঐতিহাসিক হিতেশরঞ্জন সান্যাল “স্বরাজ” নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন – “প্রথম বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনের সময় (১৯০৫-১৯১১) বিভিন্ন রাজনৈতিক কাজকর্মে ও অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের রচনায় সার্বভৌমিকতা অর্থে স্বরাজের তাৎপর্য স্পষ্ট, আরও প্রসারিত হয়। বিদেশী শাসন, পণ্য, শিক্ষা ও ধ্যানধারণার পরিবর্তে স্বদেশী চালাইবার যে চেষ্টা এই সময় হইয়াছিল তাহার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে ভারতীয় সার্বভৌমিকতা প্রতিষ্ঠা।” (স্বরাজের পথে, প্যাপিরাস, ২০১৪, পৃঃ ১) নজর করলে বুঝবো, এই প্রকল্পের মধ্যে অস্পৃশ্য বা দলিত শ্রেণীর কোন অবস্থান নেই।
এরকম সামগ্রিকতার মধ্যে নৈবদ্যের ওপরে বাতাসার মতো করে “প্রদর্শনী” হিসেবে রয়েছেন ১ জন দলিত শ্রেণীর রাষ্ট্রপতি এবং ২ জন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি – কে জি বালাকৃষ্ণন এবং ভূষণ রামকৃষ্ণ গাভাই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তী জুটমিলের শ্রমিকদের নিয়ে তাঁর গবেষণা গ্রন্থ Rethinking Working-Class History – Bengal 1890-1940 (১৯৮৯)-এ দেখিয়েছেন – আমরা শ্রমিক শ্রেণী বলতে ইউরোপীয় ধারণায় যে সংহত, খানিকটা সমসত্ত্বও বটে এবং একধরনের সামাজিক লক্ষ্য নিয়ে গঠিত শ্রেণী বা ক্লাসের কথা ভাবি সেরকমটা ভারতের প্রেক্ষিতে হুবহু খাপ খায়না – “The close and contradictory existence of a religious, and potentially divisive, outlook and an antiemployer, and hence potentially uniting, mentality was thus characteristic of the collective public acts of the jute-mill work force.” (পৃঃ ১৯৪)
ভারতে জাতের বৈষম্য – মার্ক্স, গান্ধী এবং আম্বেদকর
ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক লুই দুমোঁর অধুনা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ Homo Hierarchicus: Caste System and Its Implication ১৯৬৭ সালে ফরাসী ভাষায় (১৯৭০ সালে প্রথম ইংরেজি সংস্করণ) প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটি ভারতের জাত-ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বোঝার জন্য একটি অত্যাবশ্যক গ্রন্থ। বইয়ের শিরোনাম লক্ষণীয় – হোমো হায়েরির্কাস (নীচু থেকে উঁচুতে থাকবন্দী মানুষ)।
গ্রন্থের শুরুতেই তিনি জানান – “আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা থেকে জাতভিত্তিক ব্যবস্থা মূল ভাবাদর্শের দিক থেকে এতটাই পৃথক যে আধুনিক পাঠকেরা নিঃসন্দেহে এ বইটি সম্পূর্ণ পাঠ করার তাগিদ খুব সামান্যই অনুভব করবে।” এখানে পাঠকেরা খেয়াল করবেন “আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা” শব্দবন্ধ। অর্থাৎ ইউরোপীয় সমাজের আভ্যন্তরীণ বিকাশের সাথে ভারতের সমাজ কাঠামোর পার্থক্য খুব প্রকট। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানাচ্ছেন – “এত জাতের উপস্থিতি আমাদের একটি মৌলিক সামাজিক শিক্ষা দেয় – হায়েরার্কি। আমরা আধুনিক সমাজে এর বিপরীত নীতিসমূহ গ্রহণ করেছি।” (পৃঃ ২)
দুমোঁর ধারণায় – “আধুনিক সমাজের বিপরীতে ট্র্যাডিশনাল বা ঐতিহ্যাশ্রয়ী সমাজে সাম্য এবং স্বাধীনতার (ইক্যুয়ালিটি এবং লিবার্টি) একেবারে অজানা। এবং সংক্ষেপে বললে, ব্যক্তির ধারণাও অজানা।” (পৃঃ ৮) এবং “জাত কোন কুলুঙ্গি (niche) বা বিভাগ (block) নয়, কিন্তু সাধারণত অনেক subcaste-এর উপভাগে বিভক্ত, অন্তত গোড়ার স্তরে”। (পৃঃ ৬১)
আর বেশি প্রলম্বিত না করে অল্পকথায় বলা যায়, ভারতের মতো সমাজে ব্যক্তি নেই, আছে জাতি, সাম্য নেই, আছে উচ্চনীচের ভেদ, প্রতিযোগিতা নেই, আছে পারস্পরিক নির্ভরতা। (পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯১)