মানুষের বাকী ইতিহাসের ভগ্নাংশ
ইতিহাসের কোন বিশেষ ক্ষণে এসে ব্যক্তির কণ্ঠের প্রসঙ্গ কি আলাদা গুরুত্ব পায়? কোন বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ব্যক্তির স্বর কি চাপা পড়ে যায় কৌম কিংবা সমষ্টির কণ্ঠের আড়ালে? রাজনৈতিক ইতিহাসের কোন বাঁকে এসে ব্যক্তির উন্মেষের “discrete identity” একটি “concrete reality” হয়ে ওঠে? উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে – “আধুনিকতা” যখন মধ্যগগনে – তখন অন্তত দুটি বিষয় বৌদ্ধিক স্তরে আলোচ্য বিষয়ের তালিকাভুক্ত হল। একদিকে “ঐতিহাসিকতা” এবং অন্যদিকে “রাজনৈতিক” হয়ে ওঠার ধারণা। (দীপেশ চক্রবর্তী, প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ) প্রাক-পুঁজিবাদী কৃষি অর্থনীতির সাথে জৈবিকভাবে যুক্ত কৃষক সিটিজেন বা “নাগরিক” হয়ে উঠলো। প্রশ্ন আসবে এরা কি পূর্ণত “body politik”-এর সদস্য হয়ে গেলো? তাহলে কণ্ঠরোধের প্রসঙ্গটিও ভিন্নমাত্রা নিয়ে হাজির হবে। পার্থ চ্যাটার্জী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন – “উচ্চবর্গের চেতনার স্বরূপ ও তার নিজস্ব-বিবর্তনের ধারা ঐতিহাসিকদের কাছে অনেক বেশি সহজবোধ্য। নিম্নবর্গের চেতনার সন্ধান জানা যায় নানা জটিল বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে।” (পার্থ চ্যাটার্জী সং, নিম্নবর্গের ইতিহাস) এবার উপনিবেশিক সমাজেও ব্যক্তিকে নিয়ে কিছু গোল বেঁধেছিল। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, “শিক্ষিত বাঙালি তার নিজের সমাজর মতামত সম্বন্ধে নিরুত্তাপ হয়ে ইংরাজরা কি বলল – নিন্দা করল না প্রশংসা করল – তাই নিয়ে মাথাব্যথা করত।” (তপন রায়চৌধুরী, ইউরোপ পুনর্দর্শন)
যে জানলোনা “how one becomes what one is”, জানলোনা self-preservation কাকে বলে সেখানে কোন কণ্ঠ কি উচ্চারণের জন্য পড়ে থাকে? রুদ্ধতা যেখানে আজন্ম সেখানে কণ্ঠরোধ শব্দটির অর্থই ভিন্নমাত্রা নেয়। আমরা যে কথাগুলো তৈরি করলাম আরেকজনের শ্রবণে পৌঁছে দেবার জন্য, যে শব্দগুলো সত্তার গভীরতম বিন্দু থেকে উৎসারিত হল নভোমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ার জন্য সেগুলো যদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অসমাপ্ত অসম্পূর্ণ বারিকণার মতো জন্ম নিয়েই শুষ্ক হয়ে হারিয়ে যায় তখনও তো আরেক অবস্থার সৃষ্টি হয় – রুদ্ধতার, কণ্ঠরুদ্ধতার। শরণ নিই শঙ্খ ঘোষের –
“কে তোমার কথা শোনে? তুমিই-বা শোন কার কথা?
তোমার আমার মধ্যে দু-মহাদেশের নীরবতা।”
যখন মনোজগতে বিচ্ছিন্ন, চরা পড়ে থাকা দারুচিনি দ্বীপের মাঝে নিষ্পত্র বৃক্ষ, বর্ণহীন পুষ্প আর নিঃসাড় অস্তিত্বপুঞ্জ রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি কথা কইতে চায়? যদি “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে” দাঁড়ায়, যদি আরেকবার বুঝতে চায় পল এল্যুয়ারের মতো –
“And by the power of a word I start my life again
I was born to know you
To name your liberty”?
যদি সে হঠাৎ জেনে ওঠে “আদিম অন্ধকারের মুখোস-দেবতা / তোমার একটিই আনন্দ / আমাদের মুখ ম্লান করে দেওয়া”? (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একটি অসমাপ্ত কবিতা)
প্রকৃতপক্ষে এরকম এক পরিস্থিতিকে বুঝতে চাইছি, খানিকটা জলছবির মতো, খানিকটা লেখচিত্রের মতোও – “গলায় যদি ঝুলিয়ে দাও পাথর / হালকা হাওয়ায় গন্ধ সে তো আতর / তাই নিয়ে যাই অবাধ জলস্রোতে - / …. এ-দুই চোখে দেখতে দিন বা না দিন / আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন / আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে” (শঙ্খ ঘোষ, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ”)। কিন্তু রাষ্ট্রের এই বিপুল উৎসবের মাঝে যখন ভগ্নদূত schitz-এর মতো কেউ একজন হাত তুলে বলে ওঠে “Ecce Homo – ঐ দ্যাখো মানুষ” তখন চরা পড়ে থাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মানুষগুলো আচমকা বুকের বাঁদিকে পকেটের নীচে থাকা অত্যাশ্চর্য হৃদয়টিকে আবিষ্কার করে ফেলে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি কবিতারও জন্ম হতে পারে –
দেখ, এই আমার স্বদেশ –
বন্ধুদের হাতে হাত, ধমনীতে উষ্ণ রক্ত,
সময়ের প্রসারিত রেখা ছুঁয়ে যায় বুক
করতলে বেড়ে ওঠে রৌদ্রের শিশুরা। (সব্যসাচী দেব, ‘সময় বাহুতে বাঁধে প্রচ্ছন্ন স্বদেশ’)
যখন আকাশের দিকে তাকালে রক্ত আকাশ দেখি, মাটির দিকে তাকালে তপ্ত মাটি আমাকে তর্জনী তুলে শাসায়, বাতাস যখন ভারী হয়ে থাকে কত লাশ হয়ে যাওয়া, গুম হয়ে যাওয়া দেহের কটু গন্ধে তখন আমাদের কাব্য আর কবির মাঝে ঢুকে পড়েন স্টিভ বিকো লাশ হয়ে, মাত্র ৩১ বছর বয়সে।
কণ্ঠরোধ – কখন? কিভাবে? কেন? আরো আরো আরো? এখানে কাম্যুর এক উপলব্ধি মনে পড়ে। ১৯৪৬-এর ১৯শে নভেম্বর লিখছেন – “The long dialogue among men has just come to an end. Naturally, a man who will not listen is a man to be feared. And so, along with those who have not spoken because they thought it useless, a vast conspiracy of silence has spread among us, a conspiracy sustained by those whose interests reside in silence.” (Albert Camus, Between Hell and Reason, p. 118) চকিতে শঙ্খ ঘোষ আরেকবার আমাদের স্মরণে চলে আসেন এরকম এক বাস্তবতার কাব্যিক ক্ষণে।
স্টিভ বিকোর (Steve Biko) কথায় আসি। ৩১ বছরের তরতাজা যুবক বিকো, সাহিত্যসৃজনের সাথে জড়িয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। আরেকটি বড়ো অপরাধ করেছিলেন – বর্ণবিদ্বেষী আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, আন্দোলন সংগঠিত করছিলেন। সেজন্য পুলিস তাঁকে জেলবন্দী করে স্রেফ ঘুষি মেরে মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলেছিল। একটি কণ্ঠ রোধ হল। কিন্তু সত্যিই কি হল? হলে তো আমার এ লেখায় তিনি আসতেনই না। তাঁর বইও বিক্রি হতনা নামী পুস্তকবীপণি থেকে। কণ্ঠ বোধহয় প্রকৃতপক্ষে কখনো রুদ্ধ হয়না। ওই লোরকার মতো – “বলেছিলুম কি না কবির হাত শেকলে বাঁধা থাকবে না।”
এলেইন স্কারি তাঁর অধুনা ক্ল্যাসিক গ্রন্থ The Body in Pain-এ যন্ত্রণা এবং ব্যথা নির্দিষ্টভাবে কি করে বোঝাতে গিয়ে বলছেন – “Physical pain does not simply resist language but actively destroys it, bringing about an immediate reversion to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being makes before language is learned.” (p. 4) স্টিভ বিকোর মতো ইস্পাত-দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাঙ্ময় অস্তিত্বকে “to a state anterior to language, to the sounds and cries a human being makesbefore language is learned”-এর স্তরে নিয়ে যেতে পারলে রাষ্ট্রের শক্তির একটি নমুনা মেলে বৈকি। রাষ্ট্র আমাদের অস্তিত্বকে প্রাক-ভাষা (বা ভাষ, যে অর্থেই ধরিনা কেন) পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম – এই বোধ উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও সেটা রাষ্ট্রের বিজয় তিলক হিসেবেই গ্রাহ্য হবে। আমাদের আশ্বস্ত হবার অন্য কারণও আছে। হার্ভার্ড এবং আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে cognitive neuroscience নিয়ে বিপুল উদ্যমে গবেষণা ও চর্চা চলছে। এ গবেষণার একটি অভিমুখ হল যারা আমেরিকান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অর্থাৎ হার্ডকোর টেররিস্ট তারা দৈহিক এবং মানসিক অত্যাচারের ঠিক কোন পর্যায়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে (to the sounds and cries a human being makes before language is learned) তার ব্রেইন ম্যাপিং করা এবং মস্তিষ্কের অ্যানাটমিতে কিরকম বায়োকেমিকাল পরিবর্তন হয় সেগুলোকে পরিমাপ করা। দেহ-রাজনীতির এ অন্য এক অধ্যায়।
কণ্ঠ যখন কথা বলে তখন তার অভিঘাত কিভাবে এসে পড়ে আরো দু-একটি উদাহরণ ইতিহাস ঘেঁটে দেখে নিই। চার্টিস্ট আন্দোলনের নেতা আর্নেস্ট জোন্স। শ্রমিকদের সংগঠিত করছিলেন, মার্ক্সবাদের সাথে পরিচয় ছিল, এমনকি প্রভাবিতও হয়েছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ তখনো অনেক দূরের ব্যাপার। ১৮৪৮ সালের ৬-ই জুন একটি জ্বালাময়ী, “রাষ্ট্রদ্রোহী” বক্তৃতা দিয়েছিলেন – “green flag of Chartism will soon be flying over Downing Street.” সে সময় সমগ্র পৃথিবীর অধীশ্বর ব্রিটিশ রাষ্ট্রের কাছে এ কি কোন সহনযোগ্য বিষয় হল? জোন্স চালান হলেন জেলের ১৩ ফুট বাই ৬ ফুটের একটি অন্ধকার খুপরিতে। তিনি কবি। কোন কাগজ কলমও তাঁকে দেওয়া হতনা। নিজের আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে প্রথম দুটি লাইন সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর মাস্টারপিস কাব্যগ্রন্থ The Revolt of Hindostan-এর। তিনি লিখলেন –
In part by force, but more by panic driven.
Victorious deluge! from a hundred heights
Rolls the fierce torrent of a people's rights,
And Sepoy soldiers, waking, band by band,
At last remember they've a fatherland!
Then flies the huxtering judge, the pandering
peer,
The English pauper, grown a nabob here!
লিখলেন –
A mighty shadow, deep, and stern, and still.
Threw o'er the fleet and flood each Indian hill;
The encampment's flag just reached the rising light,
Like lingering glory of the evening's fight:
One hour its last farewell majestic waved
Old England's pride, unchallenged and unbraved;
But a soft wind at sunrise, like God's hand,
Quietly bent it homeward from that land!—
Sad wound the weary numbers to the sea,
The signal's up, and Hindostan is free!
সাগরপারের একজন অবরুদ্ধ কিন্তু অনবদমিত কবি ও সংগ্রামী রুদ্ধকণ্ঠ উপনিবেশের মানুষকে জানিয়ে দিলেন – তুমি মুক্ত হবে। জানিয়ে দিলেন ইংরেজ ভিখারিরা ভারতে এসে নবাব বনে যায় (The English pauper, grown a nabob here)। কি তীব্র শ্লেষ! কি তীক্ষ্ণ ও মরমী ভালোবাসা মানুষের জন্য! মনে রাখতে ১৮৪৮ সালে লেখা এ কবিতার ৯ বছর পরে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল।
ইংল্যান্ড রাষ্ট্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শেলী লিখলেন England in 1819। রাজতন্ত্র, রাজপরিবার এবং এদের স্তাবকদের জন্য ঘৃণা ও বিদ্রূপের কি সম্ভার সাজিয়ে দিলেন কবি! ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রের গণতন্ত্র-গণতন্ত্র কবাডি খেলার প্রধান দুই দল টোরি আর হুইগদের নিয়ে লিখলেন অবিস্মরণীয় Similes For Two Political Characters of 1819।
তাঁর কলমে –
As from an ancestral oak
Two empty ravens sound their clarion,
Yell by yell, and croak by croak,
When they scent the noonday smoke
Of fresh human carrion:--
শুধু এটুকু নয়। কবিতাটি শেষ হচ্ছে –
Are ye, two vultures sick for battle,
Two scorpions under one wet stone,
Two bloodless wolves whose dry throats rattle,
Two crows perched on the murrained cattle,
Two vipers tangled into one.
সেসময়ের আধুনিক ইংল্যান্ড রাষ্ট্রে একটি প্রসারিত নাগরিক পরিসরের বাস্তব উপস্থিতির জন্য জোন্স কিংবা শেলিরা এভাবে রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেন, অগ্নিস্রবা সৃষ্টি করতে পারেন।
১৮৩৫ সালে লেখা একটা প্রবন্ধ/বই-এর উদাহরণ আমাদের কাছে আছে – A Journal of Forty-Eight Hours of the Year 1945। লেখক হিন্দু কলেজের ছাত্র কৈলাশ চন্দ্র ঘোষ। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল Calcutta Literary Gazette (or, Journal of Belles Letters, Science, and Arts)-এ (vol. III, new series, number 75, June 6, 1835)।
দীর্ঘ কাহিনীতে না গিয়ে সংক্ষেপে বলা যায় এ গল্পের নায়ক ২৫ বছরের যুবক ভুবনমোহন এবং তার দুজন বিশ্বস্ত সাথী হল গঙ্গানারায়ণ এবং পার্বতীচরণ। এ গল্পের সময় ভাইসরয়ের নামও তাৎপর্য পূর্ণভাবে দেওয়া হয়েছে Lord Fell Butcher এবং তার সামরিক জেনারেলের নাম John Blood-Thirsty। হিন্দু কলেজের হোস্টেলে (১৯৪৫-এ নামকরণ হয়ে গেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, যদিও ১৮৩৫-এ লেখা বলে কৈলাশচন্দ্র ঘোষ এ নাম জানতেন না) এক অসম যুদ্ধের কাহিনীর বর্ণনা আছে। কর্নেল ভাইসরয়কে ২৫ জন গোরা সৈন্যের মৃত্যু ও ২৫ জনের আহত হবার সংবাদ দিচ্ছে। কিন্তু দেশপ্রেমিক বিদ্রোহীরা মারা গেছে ৬ জন, ১৩ জন আহত। যুদ্ধ শুরু হবার আগে ভুবনমোহন ইংরেজ প্রতিনিধিকে স্পষ্ট স্বরে, নিরুদ্ধ কণ্ঠে জানায় – “Worthy Magistrate, I am sorry we are not able to comply with your proposition; we defy you to do your worst. You see before you men who will neither be terrified by the neighing of a steed, the waving of a sword nor the flashing of a gun. We are determined to assert our liberties, when every other resource has failed, by the strength of our arms. Go tell them that sent thee that we have resolved to hurl Fell Butcher from his seat, we have renounced the allegiance of the feeble and false Harry of England, and that we mean to abide by our own laws and parliaments!”
আমাদের এসময়ে শেলী এবং জোন্সের কথা মনে পড়বে নিশ্চয়ই!
শেষ অবধি অসম স্বাধীনতার যুদ্ধে ভুবনমোহন ও তার বাহিনী হেরে যায়। আক্ষরিক অর্থে যূপকাষ্ঠে তাকে প্রাণ দিতে হয়। তাকে যূপকাষ্ঠে নিয়ে যাবার মুহূর্তে তার শেষ কথাগুলো ছিল – “আমার সহযোদ্ধা এবং দেশবাসী! জন্মভূমির বুকে মৃত্যু হবার সান্ত্বনা বহন করছি আমি। আর যদিও বধ্যভূমিতে আমার জীবন দেওয়াই ছিল ঈশ্বরের অভিপ্রায়, সহযোদ্ধাদের উপস্থিতি আমার শেষ মুহূর্তগুলোকে আনন্দোচ্ছল করে তুলেছে। দেশরক্ষার জন্য আমার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু আমি ঢেলেছি এবং যদিও এখন সেই ক্ষণ সমাগত যে আমার ভঙ্গুর দেহকাঠামোর মধ্যেকার দুর্বল জীবন-স্ফুলিঙ্গ আমাকে ছেড়ে চলে যাবার মুখে, আমার আশা যে গৌরবোজ্জ্বল পথের সূচনা তোমরা করেছ সে পথেই তোমরা হাঁটবে।” ভাইসরয় এরকম বীরত্বের সঙ্গে পূর্বপরিচিত ছিলনা, যেমন নগ্ন দ্রৌপদীর উপচে পড়া তেজ দেখতে একেবারেই প্রস্তুত ছিলনা “সেনানায়ক”। এভাবেই সময়ের বদল হলেও কিছু কাঠামো আর উপাদান হাজারো সংস্কারের পরেও একরকমই রয়ে যায়। যাহোক, “While he (ভুবনমোহন) was going on in this strain, the viceroy struck with awe at the energy of the young patriot, dispatched an officer to conclude the scene immediately.” নিরুদ্ধ কণ্ঠের এই অবারিত দার্ঢ্য বহন করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য, “His hands were powerfully arrested, his head forcibly thrust between two wooden pillars and severed from his body at a single blow.” (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার, ভারতে ১৮৫৭ পূর্ববর্তী সময়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রকাশ্যে ফাঁসীতে ঝোলানোর ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার খুব আগ্রহী ছিলোনা, বিশেষ করে ১৮৩৫ সালে তো নয়ই। এখানে লেখকের মাথায় ফ্রান্সের গিলোটিনের ছবি কাজ করেছে বলে মনে হয়।)
ভারতের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের কাছে সিপাহী বিদ্রোহ খানিকটা “লিটমাস টেস্ট” ছিল তো বটেই। হিন্দু প্যাট্রিয়টের বিখ্যাত সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জী বিদ্রোহীদের ”হৃদয়হীন” বলে গালি দিয়েছেন। সিপাহী বা নিম্নবর্গের কণ্ঠ প্রাধান্যকারী ভাষ্যে জায়গা পায়নি। “পদ্মিনী উপাখ্যান”-এ রঙ্গলাল লিখলেন –
ইংরেজের কৃপাবলে মানস উদয়াচলে
জ্ঞানভানু প্রভায় প্রচার।
হে বিভো করুণাময় বিদ্রোহ বারিদচয়
আর যেন বিষ না বরিষে।।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পরম-কারুণিক ঈশ্বরের কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন –
হে নাথ করুণাময় নিবেদন তাই
তবপদে ইংরাজের জয়ভিক্ষা চাই।
এই মত রক্ষা করো তব অধিকার
ভারতে বিভ্রাট যেন নাহি ঘটে আর।।
এদের থেকে ভিন্নধর্মী ভাষ্য জন্ম নিয়েছে একই সময়ে গ্রামীণ জনসমাজে। গ্রামীণ কবি এবং কবিয়ালদের দল গান বাঁধছেন, ছড়া কাটছেন –
রাজা হল নিশান (ঈশান) বাবু, কালসাপ জমিদার।
গোলাপপুরের জমিদারের লুটলো বাড়িঘর।।
……………
শুনে হয় শঙ্কিত বিদ্রোহের ফটাং কত।
অস্থির হল জমিদার আর তালুকদার যত।।
(তথ্যসূত্রঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য, “বিক্ষুব্ধ সময় – নিস্তরঙ্গ সংস্কৃতি”, সাগ্নিক সংকলন, ১৯৯১)
১৮৭০ সাল নাগাদ এক পল্লীকবি কলকাতা বেড়াতে এসে সাধারণ লোকের অর্থকষ্ট দেখে মহারাণী ভিক্টোরিয়াকে সম্বোধন করে লেখেন –
পেটভরে পাই না খেতে
কাজ কি পথে,
কলের জলে, কাজ কি গ্যাসে?
করভার মুক্ত কর সয় না আর।
(সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, উনিশ শতকের কলকাতা ও সরস্বতীর ইতর সন্তান, পৃঃ ৩১৪)
কিন্তু সমাজের নীচের স্তরের এসমস্ত আবেগ, প্রক্ষোভ, অনুভূতি, প্রতিবাদ, নিবেদন ওপরের স্তরের মূল ভাষ্যে কোন জায়গা নিতে সক্ষম হয়নি। সমাজ যে body-politik এবং technique দিয়ে (ফুকোর ভাষ্যকে অনুসরণ করছি) চলে তার মাঝেই এর অন্তত আংশিক উত্তর আছে। আধুনিক রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে, যেমন ফুকো আমাদের দেখান, দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনে যেন ”Man-the-Machine”-এর স্ক্রিপ্টটি লেখা হয়েছিল। স্ক্রিপ্টের একদিকে ছিল “anatomico-metaphysical register”, আরেকদিকে “technico-political register” যা তৈরি করেছিল “a whole set of regulations and by empirical and calculated methods relating to the army, the school and the hospital, for controlling or coercing the operations of the body.” (Discipline and Punish, p. 136)
পরবর্তী সময়ে ফুকো আরো বিস্তারে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন – “’Government’ did not refer only to political structures or to the management of states; rather, it designated the way in which the conduct of individuals or of groups might be directed: the government of children, of souls, of communities, of families, of the sick. … To govern, in this sense, is to structure the possible field of action of others.” (“The Subject and Power”, 1982) এই যে অন্যের কর্মভূমির বিচরণক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা এর মাঝেই governmentality তথা প্রশাসনিকতার সার্থকতা। এখানেই বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠের উদ্ভব ও অন্য কণ্ঠের লুপ্ত ও সুপ্ত হয়ে থাকার মেকানিজম কাজ করে। যদিও আমাদের ভাবতে হবে এটা একরৈখিক কোন যাত্রা নয়।
একটি অমোঘ সত্য জানান দেবেশ রায় – “যে-কেন্দ্রকে ভাঙতে চেয়েছি – সাম্রাজ্যের, পেষণের, ক্ষমতার, শোষণের – সেই কেন্দ্রই আমরা গড়ে তুলেছি, দেশজুড়ে, আমাদের কল্পনা-মনন জুড়ে, আমাদের চেতনা জুড়ে। কোথায় গেল আমাদের মুক্তির আলোময় পরিধি, লবণাম্বুরাশির আভাচিক্কণ বেলাভূমি, অয়শ্চক্রনিভ দিগন্তময় দেশ, পর্বত যেখানে দেবতাত্মাআর গ্রাম-জনপদ যেখানে কেন্দ্রিকতা-নিরপেক্ষ এক-এক স্বাধীন কেন্দ্র। কেন্দ্রিকতা উদাসীন এক-এক স্বাধীন কেন্দ্র। এমনকি কেন্দ্রিকতা-বিরোধীও বটে।” (ব্যক্তিগত ও গোপন সব ফ্যাসিবাদ নিয়ে একটি বই, পৃঃ ১০৮)
মহাশ্বেতা দেবীর “স্তনদায়িনী” গল্পটিতে একবার প্রবেশ করা যাক। যশোদা হল প্রফেশনে মা। “নিজের স্তন দুটিকে বড়ো মহার্ঘ মনে হল তার। রাতে কাঙালীচরণ খুনসুড়ি করতে এলে সে বলল, ‘দেখ! এখন এর জোরে সংসার টানব। বুঝে শুনে ব্যবহার করবে।’ … গিন্নিমা কি তেরটা বিয়োয়নি? গাছের কি ফল ধরতে কষ্ট হয়?”
যশোদার স্তন তার সত্তা, তার agency, তার অস্তিত্ব, তার স্বর, তার জীবন্ত জাগতিক প্রকাশ, এমনকি তার নিরুচ্চার কণ্ঠ হয়ে ওঠে। এরপরে ক্যানসার-আক্রান্ত যশোদার স্তন? “ওর জন্যেই এত আকুলি-বিকুলি ছিল? – সেই মনমাতানো বুকের এই পরিণাম? হোঃ! মানবদেহ কিসসু নয়। তার তরে যে পাগল হয় সেও পাগল।” যশোদার ক্ষেত্রে ঈশ্বরত্ব-প্রাপ্তি কঠিন শ্লেষ আর বিদ্রূপ হয়ে বাজে – “এ সংসারে মানুষ ঈশ্বর সেজে বসলে তাকে সকলে ত্যাগ করে এবং সতত একলা মরতে হয়।” যশোদার মৃত্যুও ঈশ্বরের মৃত্যু।
এখানে নারী পুরুষ শাসিত রাষ্ট্রের কাছে একটি ভোগযোগ্য সামগ্রী যাকে চেটেপুটে খাওয়া যায়, যেকোনো কাজে ব্যবহার করা যায়।
অথচ ১৯৪৪-৪৫ সালে প্রকাশিত সরলাদেবী চৌধুরাণী তাঁর আত্মজীবনী “জীবনের ঝরাপাতা”-য় লিখছেন – “রাজনীতি এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে কোন পুরুষ কোন মেয়ের জন্য ‘seat’ ছাড়তে পরাঙ্মুখ, সবাই ‘আপ-কা-ওয়াস্তে’ – তাই অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি থেকে আরম্ভ করে বেঙ্গল কৌন্সিল-এসেম্ব্লি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য গুটিকত আলাদা ‘সেয়াত’ নির্ধারিত করা হয়েছে ... কিন্তু মেয়েরা যদি পুরুষ দেবতাদের বলে বসেন – “তোমার সিংহাসনটা আমায় ছেড়ে দাও না ভাই” – তাহলেই বিপদ, তাহলেই পুরুষের পৌরুষ বেরিয়ে পড়ে চোখ রাঙা করে বলে “কভী নেই”।” (দে’জ পাবলিশিং, ২০১৬, পৃঃ ১৪৬) সরলাদেবীর লেখার প্রায় ৮০ বছর পরেও ‘আধুনিক’ ভারত রাষ্ট্রে এ প্রশ্নের সমাধান হল না। আমরা আমরা লিঙ্গ বৈষম্যের সমাধান খুঁজতে নিজেদের মনকে পরিচ্ছন্ন করতে পারিনি। বরঞ্চ বলা যায়, আমরা এ প্রশ্নে আমাদের বিবেককে বিবশ করে রেখেছি। হয়তো বা এতেই আমাদের আনন্দ, আমাদের সিদ্ধি।
পরে আরও তীক্ষ্ণ ভাষায় বলছেন – “মনুর সময় হইতে আরম্ভ করিয়া অদ্যাবধি যাহা কিছু অধিকার নারী পাইয়াছেন, তাহা কেবল পুরুষদের আরাম ও সুবিধাকল্পে, নারীর দিক ভাবিয়া নহে। ছবিটা যদি সিংহের আঁকা হইত, সিংহ যেমন আর এক রকম করিয়া আঁকিত, তেমনই ধর্ম্মশাস্ত্র-রচনা নারীর হাতে পড়িলে শ্লোক কয়টা পুরুষকে উল্টা করিয়া পড়িতে হইত।” (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৭)
শক্তি চট্টোপাধ্যায় “ঋত্বিক, তোমার জন্য” পদ্যে উচ্চারণ করেছিলেন –
তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে
পোড়া পাথরের মতো পড়ে আছো বাংলাদেশে, পাশে
ঋত্বিক, তোমার জন্য তুচ্ছ কবি আর্তনাদ করে।।
স্পর্ধিত প্রকাশ ক্রম-অপসৃয়মান। আমরা সবাই খণ্ড মানুষ, স্পর্ধাহীন অ-সাহসী মানুষ। কিন্তু অনেকগুলো মানুষ জুড়ে গেলে? রুদ্ধ কণ্ঠ কথা বলতে পারে। নেরুদার মতো হয়তো বা বলে উঠতেও পারে এই মনুষ্যপুঞ্জ –
And you will ask: why doesn’t his poetry
speak of dreams and leaves
and the great volcanoes of his native land?
Come and see the blood in the streets.
Come and see
the blood in the streets.
Come and see the blood
in the streets!
আর আমাদের নিজেদের শঙ্খ ঘোষ আমাদের বলেন –
“শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?”