এক মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন গঙ্গাপদ রাত বারোটা নাগাদ চুপিসাড়ে ঘর থেকে বের হল। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। একফালি চাঁদ আকাশে ঝুলে আছে বটে তবে সে না থাকারই সমান। গঙ্গাপদ দ্রুতপদে হাঁটতে থাকে। দশঘরা পৌঁছতে কিছু না হোক এক ঘন্টা তো লাগবেই। মাঠের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি গেলে পনেরো মিনিট সময় বাঁচান যেত। কিন্তু সাবধানের মার নেই। কে মাঠ করতে উঠবে, আর দেখে ফেলবে গঙ্গাপদ যাচ্ছে রাতের আঁধার ঠেলে! গঙ্গাপদর খাটো করে পরা ধুতি, গায়ে একটা চাদর জড়ানো। পিঠে আছে ডাকহরকরাদের ঝুলি আর সঙ্গে এক ডিবে সর্ষের তেল। সেই নিয়ে এক গাছের ছায়া থেকে আরেক গাছের ছায়া ধরে ধরে সে যাচ্ছে।
দশঘরা গাঁয়ের সীমানায় এসে থামে গঙ্গাপদ। আর এগোনোর আগে প্রস্তুতি দরকার। একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় এসে থলি নাবিয়ে রেখে গায়ের উড়ানি আর পরণের ধুতি খুলে সারা গায়ে জবজবে করে সর্ষের তেল মেখে নেয়। উড়ানি আর ধুতিতে বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাই বেঁধে পুঁটলি করে গাছ থেকে ঝুলিয়ে দেয়। সর্ষের তেলের ডিবেটা গাছের তলায় ঘাসের আড়ালে রেখে সে কাঁধে থলি ঝুলিয়ে ক্ষিপ্রপদে মধু পালের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিল।
আশু পাল মারা গেছে বছর খানেক হল। আশু পালের খান্ডারনি বউ, মধু পালের মাতা-ঠাকুরানি কাত্যায়নী দেবী খাস চাকরকে নিয়ে তীর্থ করতে গয়া-কাশী বেরিয়েছেন। সেই সুযোগে, মুখরা শাশুড়ির অবর্তমানে মধু পালের বউ বাসন্তী ছেলেমেয়ে নিয়ে বর্ধমানে বাপের বাড়ি গেছে আজ তিন বছর পরে। বাড়িতে শুধু মধু পাল আর তার বোবা চাকর। বাড়ির পেছনের দিকে অবশ্য কতগুলো মুনিষ ঘুমোয়, তবে সে ঘর বাড়ির লাগোয়া নয়। এসব খবরই গঙ্গাপদ জানে।
হপ্তা দুয়েক আগে বাজারে নিতাইয়ের দোকানে বেলাবেলি বসে গঙ্গাপদ এক কাপ চা আয়েস করে খাচ্ছিল। হোক শালপাতা ফোটানো জলে এক চিমটে চা-পাতার চা। শীতটা যেরকম জমিয়ে পড়েছে তাতে নিতাইয়ের ওই যমের অরুচি চাও ভাল লাগছে। ত্যারচা করে রোদ এসে পড়েছে গায়ে। কতকগুলো শালিক তুরুক-তুরুক করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। গঙ্গাপদর মনে হল দিনটা বড় ভাল। মনে হতে হতেই দেখে বাজারের এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে একটা টেম্পো ঢুকছে। টেম্পোর আগমন তাদের বাজারে সুলভ নয়। সবাই হাঁ করে চেয়ে রইলে টেম্পোর দিকে। টেম্পোর পেছনে দুটো আলিসান আর পেল্লায় সিন্দুক নাচতে নাচতে বাজার পেরিয়ে ঢুকে পড়ল মধু পালের বাড়িতে। নিতাই বলল, "মধু পালের টাকা রাখার আর জায়গা হচ্ছে না গো। নতুন সিন্দুক কিনতে হল।" গঙ্গাপদ মনে মনে বলল, "ভাল, ভাল। দিনটা বড় ভাল।"
গেল হপ্তায় সেই নিতাইয়ের দোকানেই সেই অখাদ্য চা খেতে গিয়ে কার্তিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সেও চা খেতে এসেছিল। চা খাওয়া হয়ে গেলে দুজনে দুটো বিড়ি ধরিয়ে সুখদঃখের গল্প করছিল। কার্তিকই বলল, মধু পালের মা তীর্থে গেছেন আর বউকে রাখতে মধু পাল বর্ধমান যাবে। কার্তিককে ডেকে মধু পাল নতুন সিন্দুকের ওপরে ঠাকুর রাখার তাক করিয়েছে। ইলেক্ট্রিকের মিস্তিরি মন্মথকে দিয়ে টুনি বালবও লাগাবে। সিন্দুক বসিয়েছে নিজের ঘরে। যে ঘরে সে শোয়, সে ঘরে। চোখের আড়াল করতে চায়না। গঙ্গাপদ অলস গলায় জিগেস করল, "এদ্দিন সিন্দুক ছিল না? টাকাকড়ি রাখত কোথায়?" উত্তর গঙ্গাপদ জানে। সে নাহক কম বার আশু পালের বাড়িতে ঢোকেনি। নিচে যে ঘরে বসে আশু পাল-মধু পাল তেজারতির ব্যবসা চালায়, সে ঘরেই দুটো ঢাউস সিন্দুক আছে। কার্তিক বলল, "সে থাকবে না কেন। কিন্তু তাতে বুঝি আর টাকা আঁটছে না।" গঙ্গাপদ চুপচাপ বিড়ি খেতে খেতে কর্মপদ্ধতি ছকে ফেলেছিল।
গঙ্গাপদর ঠাকুদ্দা এককড়ি ছিল ডাকসাইটে চোর। গঞ্জের হেন গেরস্ত বাড়ি ছিল না, যেখানে এককড়ির সিঁদ পড়েনি। জমিদারমশাইয়ের সঙ্গে বাজি ধরে জমিদারবাড়ির সিন্দুক থেকে জমিদারগিন্নির বিয়েতে পাওয়া সাতনরি হার চুরি করে এনে জমিদারমশাইকেই ভেট দিয়েছিল। জমিদারমশাই খুশি হয়ে এককড়িকে তস্করবাচস্পতি উপাধি দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে কিছু জমিজিরেত। কিন্তু কড়ার করে নিয়েছিলেন যে এককড়ি বা তার উত্তরপুরুষ কেউ জমিদার বাড়িতে সিঁদ দেব না। তখন এককড়ির বয়েস কিছু না হোক হয়েছে। সে তস্করবাচস্পতি উপাধি পেয়ে খুশি মনে অবসরগ্রহণ করল।
এককড়ির দুই ছেলে - দুকড়ি আর তিনকড়ি। বড় ছেলে দুকড়ি বাপের লাইনে যায়নি, যদিও এককড়ি দু-ছেলেকেই হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিল। লোকে বলে দুকড়ির হাতের কাজ ছিল এককড়ির চেয়েও ভাল। কিন্তু দুকড়ি লাইন ধরল না। সে সাত ক্রোশ দূরের চালকলে কাজ নিয়ে সেই যে চলে গেছিল, আর গঞ্জে ফেরেনি। ফলে এককড়ির সাবেক পেশা বহনের দায়িত্ব বর্তেছিল তার ছোট ছেলে তিনকড়ির ওপর। তিনকড়ি হাতের কাজে বাপ বা দাদার মতন দড় না হলেও, সে কিছু ফেলনা চোর ছিল না। যৌবনে, গঞ্জের মোড়লের বাড়ি সিঁদ দিয়ে অনেকের আশীর্বাদ কুড়িয়েছিল। এ তিনকড়ির যৌবনের কথা। গঙ্গাপদ জন্মানোর পর থেকেই তিনকড়ির ব্যাবসায় ভাঁটা পড়তে শুরু করে। তার প্রধান কারণ গঞ্জেও অবস্থাপন্নরা মাটির বাড়ি ইঁট দিয়ে গেঁথে নিতে থাকে। তবে তিনকড়ির মাটি লেপা, চুন-সুরকির সেই ইঁটের গাঁথনি খুলে চুরি করার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু আগে মাটির ঘরে সিঁদ দিতে যেখানে এক ঘন্টাও লাগত না, সেখানে ইঁটে গাঁথনি খুলতে সময় তার প্রায় দেড় দুগুণ লাগত। তার ওপর ইঁটের গাঁথনি খুলতে গিয়ে বার কয়েক সিঁদকাঠিও ভেঙেছে। এমনকি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এককড়ির সাবেক, ভারী সিঁদকাঠিও ভেঁঙেছিল ওই করেই। পরে অবশ্য যুদ্ধের বাজারে তিনকড়ি সুলভে জার্মান সিলভারের সিঁদকাঠি বানিয়ে নিয়েছিল। সে যেমন মজবুত, তেমনই হালকা।
তিনকড়ির দূরদর্শিতা ছিল। সে বুঝেছিল বাড়ির ঘাঁতঘোঁত জানতে যে সময় ব্যয় করতে হয়, তার কিছুটা কমে যদি জানা যায় কোন বাড়ির কোন দেয়াল কমজোরি, কোন জানলার কাঠ তত মজবুত নয়, কোন চালের ঠেকনায় গোলমাল আছে। তাই সে বুদ্ধি করে ঘরামির কাজ নিয়েছিল। যদিও তার চোরখ্যাতির জন্যে গঞ্জের কেউ তাকে ঘরামির কাজ দিত না। কিন্তু তদ্দিনে তিনকড়িকে চৌর্যবৃত্তির পরিধি বাড়াতে হয়েছে। সে পাশের দু-চার গঞ্জে চৌর্যবৃত্তি শুরু করেছে। তবে ধকল পড়ত খুব। দিনে ঘরামির কাজ করে, বাড়ি ফিরে আবার রাতে মাইল দশেক হেঁটে অন্য গঞ্জে গিয়ে সিঁদ দিয়ে আবার সুয্যি ওঠার আগে ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে সকালে ঘরামির কাজের ধকল তিনকড়ির শরীরে আর দিচ্ছিল না। তাছাড়া, এক রাতে কাছকাছি অন্ততঃ তিন বাড়িতে সিঁদ না দিলে পড়তায় পোষায় না। আপ-ডাউন দশ-বারো মাইল হেঁটে আর তিন বাড়িতে সিঁদ দেওয়ার সময় থাকত না তিনকড়ির। কাজেই তার চৌর্যবৃত্তিতে ভাঁটা পড়েছিল। তাও বাপ-দাদার সাবেক পেশা বজায় রাখতে মাসে অন্ততঃ এক রাত কাজে বেরোত তিনকড়ি। আর সে যখন কাজে বেরোত, সঙ্গে নিত ছেলে গঙ্গাপদকে। গঙ্গাপদর তখন ষোল-সতেরো বছর বয়েস। লেখাপড়া কিছু শেখেনি। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বখামি করে বেড়াত। তিনকড়ি ছেলেকে কাজ শেখাতে লাগল। শুধু রাতের বেলা নয়, দিনের বেলার ঘরামির কাজেও গঙ্গাপদকে লাগিয়ে দিয়েছিল তিনকড়ি। এই করেই গঙ্গাপদ কাজ শিখেছিল।
তা গঙ্গাপদ কাজ শিখেওছিল ভাল। সিঁদ দেওয়া থেকে শুরু করে হুড়কো নাবানো, চাল বেয়ে নাবা - সবেতেই সে বাপের চেয়ে ভাল কৃতিত্ব দেখিয়েছে। তিনকড়ি গঙ্গাপদর কাজে বাপ এককড়ির ছায়া দেখতে পেত। তবে একটা কাজ গঙ্গাপদ পারত যা এককড়ি বা তিনকড়ি - কেউ কোনদিন করেনি। গঙ্গাপদ শিখেছিল কোথা থেকে সে এক রহস্য। সেটা হল সিন্দুক খোলা। গেরস্তবাড়ির সিন্দুক হোক কি দোকানের সিন্দুক, পঁচিশ ক্রোশের মধ্যে এমন কোন সিন্দুক ছিলনা যা গঙ্গাপদ খুলতে পারত না। সেবার যখন পল্টনরেখা জংশনে বণিকদের সোনার দোকানের তিন লিভারের ভারী লকের সিন্দুক ভেঙে নগদ চুরি হল, মহকুমার পুলিশ খুবই ধন্দে পড়েছিল। তাদের হিসেবে এ বাইরের বড় কোন চোরদলের কাজ। কারণ এ মহকুমার সিন্দুক খোলায় এমন দক্ষতা কোন চোর দেখাতে পারেনি। আর কে না জানে, মহকুমার সব চোরেদেরই পুলিশ ভাল চেনে। সে চুরির মীমাংসা হয়নি। গঙ্গাপদর গুপ্তবিদ্যা গুপ্তই রয়ে গেল। জেনেছিল শুধু স্যাকরা মধু। তিনকড়ি তার কাছেই গয়না গলাত, চার আনা হিস্যার কড়ারে। তারপরে শহরে গিয়ে বেচে আসত। তাও মধুকে তিনকড়ি গঙ্গাপদর নাম বলেনি। বলেছিল, "এক ভিন গাঁয়ের সাগরেদ পেয়েছি।"
এসব হল বহু আগের কথা। তখন বর্গাও হয়নি, ল্যান্ড সিলিংও আসেনি। তালডিঙা আর আশেপাশের অঞ্চল ছিল ভাগচাষিদের জায়গা। তালডিঙার চোদ্দ আনা জমি শোনা যায় নামে-বেনামে জমা হয়েছিল মধু পালের হাতে। মধু পাল তালডিঙার লোক নয়। মধু পালের বাড়ি দশঘরাতে। দশঘরা একেবারে গ্রাম নয়, গঞ্জ এলাকা। চালকল আছে, পোস্টাপিস আছে, পুরো থানা না থাকলেও পুলিশ চৌকি আছে। মধু পালের বাপ আশু পালের বাজারে চালের দোকান ছিল। যুদ্ধের বাজারে দশঘরার মারোয়াড়ির চালকল লুঠ হল। শোনা যায় লুঠের অধিকাংশ মাল ঢুকেছিল আশু পালের দোকানে। সেখানে যে কোন উপায়ে আশু পাল চাল হাওয়া করে দিল সে কেউ জানে না। তারপরে যুদ্ধের বাজারে কালোবাজারির পুরোনো গল্প - চাল অল্প অল্প করে ছেড়ে চড়া দামে বেচে আশু পাল লাল হয়ে গেল। বাজারের মোড়ে লাল শানবাঁধানো মেঝেওলা দোতলা পেল্লায় বাড়ি হাঁকালো, উঁচু পাঁচিল দিল, লোহার গরাদ দিল। বাড়ি না দুর্গ। জমি জিরেত কিনল বিস্তর। আর শুরু করল তেজারতির কারবার। চারদিকে অভাবী গাঁয়ে অভাবী মানুষ। তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। দায়ে-অদায়ে হাত পাততে আছে আশু পালই। আশু পাল ব্যবসায়ী ও মহাজন। সে হ্যান্ডনোট লিখিয়ে টাকা ধার দিত। এই করে আশেপাশের গাঁয়ের চোদ্দ আনা জমি হ্যান্ডনোট বেয়ে চলে গেল আশু পালের সিন্দুকে। আশু পাল, তস্য পুত্র মধু পাল। আশু ছেলেকে ব্যবসার গোপনতম বীজমন্ত্র শিখিয়ে গিয়েছিল। সব কিছু হ্যান্ডনোটে বাঁধা রাখা যাবে। কিন্তু খবরদার বাস্তুভিটে বাঁধা রাখবি না। বাস্তুভিটে যতদিন আছে লোকে না খেতে-পেয়েও ভিটে আঁকড়ে পড়ে থাকবে। জমি যদি বা হাতছাড়া হয় দেনার দায়, সে জমিতে তাও হাল দেবে। ফলে ছোট চাষিরা বাপ-দাদার জমি আশু পাল-মধু পালের কাছে বাঁধা দিয়ে নিজের জমিতে ভাগচাষি হয়ে গেল।
আর একটা কাজ আশু পাল শিখিয়েছিল ছেলেকে। দেনার অনাদায়ে লেখাপড়া করে জমির দখল নিবিনা। যদ্দিন লেখাপড়া না হচ্ছে, মুখ্যুগুলো মনে করবে জমি তাদেরই আছে। এদিকে সুদের মিটার চড়তেই থাকবে। সুদের পয়সা ছাড়াও, মা লক্ষ্মীর কৃপায়, তাদের ভাতকাপড়ের অভাবে নেই। ফসল তাদের। চালকল কিনে নিয়েছে আশু পাল অনেকদিন। বাজারে বড় চারটে দোকান। খাবে কে?
আশু পালের এই বাণিজ্যিক প্রসারে জমিদারের দেওয়া এককড়ির জমি বাঁধা পড়ল তিনকড়ির আমলে। দুকড়ি দূরের গঞ্জের চালকলে কাজ নিল। তিনকড়ি নিল ঘরামির কাজ। জীবনের স্রোত বয়ে চলে। ক্রমে নিজের জমিতে নিজেই ভাগচাষ করত করত তিনকড়ি। একেই এক ফসলা জমি। দাদন নিয়ে চাষ করে আর ঘরে কিছু ওঠে না। তিনকড়ির সংসার চলত ঘরামির কাজ করে। গঙ্গাপদ লায়েক হবার পরে, বিশেষে লক খোলায় হুনুরি হবার পরে, পরিবারে কিছু সুরাহা হয়েছিল।
অতি সহজেই গঙ্গাপদ পাঁচিল টপকে উঠোনে নেবে এল। সামনের লোহার গরাদে লাগানো মর্চে ধরা তালাও বিশেষ গোলমাল করল না। গোল বাঁধল তেজারতির ঘরের তালায়। পেল্লায় তালা ঝুলিয়েছে বটে মধু পাল। তবে সে তালাও অল্প মেহনতেই হার মানল গঙ্গাপদর কাছে। একটা হাল্কা মতন আলোর আভাস চরাচরে ভেসে আছে। তাতেই কাজ সারল গঙ্গাপদ। কিন্তু তেজারতির ঘরে ঢুকে দেখে ঘোর আঁধার। অল্প কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে গঙ্গাপদ চোখটাকে ধাতস্থ করে নিল। আর ভয় নেই। সে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে, দুটো তক্তাপোষের ওপর ফরাস পাতা। ফরাসের ওপর জলচৌকি বসানো। তক্তাপোষের পেছনে দুটো ঢাউস সিন্দুক। ঘরে একটা দরজা ছাড়া আর কোন দরজা-জানলা নেই। এইসব ঘরই চোরেরা বেশি ভয় করে, একমাত্রা দরজা আটকে গেলেই পালাবার পথ বন্ধ। তবে গঙ্গাপদ সেসব কিছু ভাবল না। পিতৃপুরুষের নাম করে, গুরুর নাম করে লেগে পড়ল গঙ্গাপদ সিন্দুকের পেছনে। গঙ্গাপদ জানে এই সাবেকী সিন্দুকগুলো দেখতে যত পোক্ত, কাজে তত নয়। গেঁজ থেকে সরু তার বের করে তার খেলা শুরু করে দিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চিচিং ফাঁক। সিন্দুকের ডালা খুলে দেখে থরে থরে নোট সাজানো। এরকমই তো হবার কথা। থলি খুলে সিন্দুক উপুড় করে নেয় গঙ্গাপদ।
দুটো সিন্দুক খালি করে ফিরতি পথ ধরে গাছতলায় এসে একটু জিরোতে বসল গঙ্গাপদ। শরীর ঠান্ডা হতেই রাজ্যের শীত এসে জেঁকে ধরল তাকে। টঙ থেকে পুঁটলি নাবিয়ে ধুতি পরে, উড়ানি জড়িয়ে একটা বিড়ি ধরায় গঙ্গাপদ। আজ যা দাঁও মেরেছে, তাতে আর এ জন্মে তাকে আর কাজ করে খেতে হবে না। একটু দূরের গাঁয়ে গিয়ে জমি-জিরেত কিনবে। আর কটা গরু। এবার একটা বিয়েও করে ফেলবে। তবে সবই রয়ে-সয়ে। হঠাৎ কিছু করতে গেলে লোকের চোখ টাটাবে। বিশেষতঃ মধু পালের ঘরে চুরির খবর আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চাউর হবে। পাশে পড়ে থাকা পেট-মোটা থলিতে হাত বোলায় গঙ্গাপদ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ফর্সা হতে শুরু করবে। আর বেশিক্ষণ বসে থাকা নিরাপদ হবে না। আর একটা বিড়ি খেয়েই উঠবে গঙ্গাপদ।
গ্রামের কাছে এসে হাঁপিয়ে পড়ে সে। এই দু-মানুষের লাশ বয়ে নিয়ে আসা কি চাট্টিখানি কথা। ঘরে গিয়ে জিরিয়েই চোরাই মাল লুকিয়ে ফেলতে করতে হবে। মধু পালের বাড়িতে চুরির খবর কোতোয়ালিতে পৌঁছলেই আগে তিনকড়ির বাড়ি হানা দেবে দারোগা। যদিও কেউ জানে না তিনকড়ি বা গঙ্গাপদ কেউ সিন্দুক খুলতে পারে বলে। তবু সাবধানের মার নেই। তবে তিনপুরুষের চোর তারা। চোরাই মাল হাপিসের লাইন পোক্ত করে করা আছে। গ্রামে ঢুকে শিবতলায় বসে একটু হাঁপ নেয় গঙ্গাপদ। এখানে আর লোভ সামলাতে পারে না সে। থলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা বান্ডিল বের করে আনে। আবছা আলোয় দেখে, এ কী! এ তো টাকা নয়। পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা তমসুক। গঙ্গাপদর মাথা ঘুরে এল। তবে কি সে টাকা ভেবে এক গোছা অকাজের কাগজ বয়ে নিয়ে এল! থলিতে হাত ঢুকিয়ে যতবার টাকা বের করতে যায়, বেরোয় তমসুক। গঙ্গাপদর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। গঙ্গাপদ থলি উপুড় করে দেয়। রাশি রাশি পাটের দড়ি বাঁধা তমসুক মাটির ওপর পড়ে পাহাড় হয়ে যায়। গঙ্গাপদ পাগলের মতন তার ভেতর টাকা খোঁজে। কিন্তু হায়! একটা নোটও নেই। রাগে-দুঃখে গঙ্গাপদ দেশলাই দিয়ে রাশিরাশি অর্থহীন কাগজ জ্বালিয়ে দেয়। ভোরের আলোয় এ এক অদ্ভুত বহ্নুৎসব।
সরলাবালা বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের মাস্টারমশাই সত্যগোপাল বটব্যালের বহুদিনের অভ্যেস ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পাঠ করা। আগে গীতা পড়তেন। যেদিন থেকে পার্টির লোকাল সেক্রেটারি হয়েছেন, সেদিন থেকে গীতা ছেড়ে ম্যানিফেস্টো পড়া শুরু। নিজের ঘরে তক্তাপোষে শিরদাঁড়া খাড়া করে বসে, পুব দিকের জানলা খুলে, চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে ম্যানিফেস্টো জপ করছিলেন সত্যগোপাল। হঠাৎ নাকে একটা পোড়া পোড়া গন্ধে এল। চোখ খুলে দেখে বাইরে শিবতলায় আগুন লেগেছে। কালো ধোঁয়া উঠছে। তড়িঘড়ি একটা তুষের চাদর গায়ে ফেলে সত্যগোপাল ছুটলেন শিবতলায়।
গিয়ে দেখেন একটা ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে। প্রশ্ন করে যা জানলেন, সকালে যাবার পথে ভিড়ের কেউ একজন দেখে গঙ্গাপদ এক রাশ কাগজ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কী কাগজ কেউ জানে না। সত্যগোপালের হাতে একটা আধপোড়া কাগজ তুলে দিয়ে বৃন্দাবন সাঁতরা জিগেস করল, "দ্যাখেন তো মাস্টারমশাই কী ল্যাখা আছে!" সত্যগোপাল সেটা আর আরও দু-চারটে আধপোড়া কাগজ পরে বুঝলেন এগুলো সব হ্যান্ডনোট। বিভিন্ন লোকের জমি বাঁধা রাখার হ্যান্ডনোট। গঙ্গাপদকে কাছে ডাকলেন সত্যগোপাল, "হ্যাঁরে গঙ্গা, এসব তুই কোথায় পেলি, আর জ্বালাচ্ছিসই বা কেন?" গঙ্গাপদ একটা গল্প খাড়া করে রেখেছিল। ভোরবেলা ভিনগাঁয়ে কাজে যাবে বলে বেরিয়ে শিবতলা দিয়ে যেতে দেখে এক বস্তা কাগজ পড়ে আছে, আর কালো কাপড় পড়া দুটো লোক সেগুলো ঘাঁটছে। এত ভোরে দুটো লোক এত কাগজ নিয়ে কী করছে দেখে গঙ্গার সন্দেহ হয়। তাকে দেখেই লোকগুলো ঊর্ধশ্বাসে পালিয়ে গেল। গঙ্গা বুঝল যে এগুলো চোরাই মাল। চোরাই মাল কীসের থেকে কী হয়ে যায় ভেবে সে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সত্যগোপাল গঙ্গাপদর কাঁধ ঝাকিয়ে আবেগমথিত গলায় বললেন, "তুই আজ কী পুন্যির কাজ করেছিস, তুই জানিস গঙ্গা? তুই আজ মহকুমার সব গরিবকে এতদিনের ঋণ থেকে মুক্তি দিলি! এ কাজ আমাদের দেশে আর কেউ করতে পারেনি। এ স্তালিনসম কাজ, মাও সে তুঙের মতন কাজ, লেনিনের মতন কাজ। তুইই আমাদের মুক্তিসূর্য। তোকে আমি বিধানসভায় পাঠাব, লোকসভায় পাঠাব। লোকে তোর নাম জানবে। দিকে দিকে তোর নাম ছড়িয়ে পড়বে - এসে গেছে ভারতের মুক্তিসূর্য কমরেড গঙ্গাপদ। তোর চোর নাম ঘুচে যাবে। চোরেদের সমাজে, রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা হবে।" কে একজন পেছন থেকে বলল, "মাস্টারকে জল দে, ফ্লো এসে গেছে মাস্টারের।"
আজও যদি কালনা হাইওয়ে থেকে ছোট বেলুন পেরিয়ে বাঁদিকে ছোট কাঁচা রাস্তা নিয়ে মাইল তিনেক যান, আপনি পোঁছে যাবেন তালডিঙার মোড়ে। তালডিঙার মোড়ে দেখবেন দোকানের গাদি লেগেছে। ভাতের হোটেল, পান-বিড়ির দোকান, প্লাস্টিকের দোকান, বাসনকোসনের দোকান, চায়ের দোকান, কাপড়জামার দোকান, রোলের দোকান - কী নেই! দেখলেই বুঝবেন ভারি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। আর গ্রামে ঢোকার মুখেই রাস্তার মোড়ে দেখবেন কালো পাথরের এক আবক্ষ মূর্তি। শ্বেতপাথরের ফলকে অনেক লেখাই উঠে গেছে, তাও পরিচিতিটুকু পড়া যায় - কমরেড গঙ্গাপদ ঢালি, এম.এল.এ।
.