'আপনার চোখদুটো তো পুরো টকটকে লাল হয়ে আছে!!' - আয়নায় অচিনকে দেখে প্রায় আঁতকে উঠেছিল পেশাদার গাড়িচালক ছেলেটা।
'ওঃ , ওটা কিছু না' - অস্বস্তি ঢাকতে অচিন কালো চশমাটা ব্যাগে না ঢুকিয়ে আবার দ্রুত পরে ফেলেছিল।
'চোখ উঠেছে নাকি?'
'না, আমার ধুলোতে সমস্যা আছে। শীতের শুরুতে এই সময়টায় পলিউশান বাড়ে। সেজন্যই বাইরে বেরোলে কালো চশমা পড়ে থাকতে বলেছে ডাক্তার। এখন হোটেলে গিয়ে ঘুমোলেই সকালে ঠিক হয়ে যাবে। আপনার নাম কি?'
'মৃন্ময়। আমাকে আপনি বলার দরকার নেই।'
'মনে থাকলে তুমি বলব। আসলে কাজের জায়গায় সবাইকে আপনি বলে বলে অভ্যাস হয়ে গেছে। '
মাঝে মাঝে এই এক দুদিনের জন্য ঝটিকা সফরে গিয়ে অন্য সব শহরে পাঁচতারা হোটেলগুলোতে থাকা অচিনের বিশেষ পোষায় না। তবু পরিচালক হিসেবে তার নিজেরই বানানো ছবি আর ওয়েব সিরিজের প্রচারের দায়িত্ব ফেলে দেওয়াও যায় না, তাই সেগুলো মুক্তির কয়েক সপ্তাহ আগে সময়মতন প্রযোজকদের অফিস থেকে ফোন পেলে ছোট কেবিন ব্যাগটা নিয়ে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়। সব ব্যবস্থা তারাই করে রাখে , অচিনকে শুধু তাল মেলাতে হয়।
কাল বেশ রাতে বিমানবন্দরে নেমে দেখেছিল তার নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সিনেমার বাকিরা একদিন আগেই পৌঁছে গেলেও, বাড়িতে কিছু কাজ থাকার জন্য এবারে অচিনেরই পৌঁছতে দেরি হয়ে গেছে। রাত্তির বেলাও বিমানবন্দরের ভেতরে ঝকঝকে দিনের মতন আলো থাকে বলে পুরো সময়টাই তার চোখে কালো চশমা। কিন্তু বাইরে বেরনোর পর গাড়িতে উঠে অন্ধকারে সে ব্যাগে চশমাটা ঢোকানোর জন্য মৃন্ময়কে বলেছিল গাড়ির ভেতরের আলোটা একবার জ্বালাতে।
কালোচশমা খোলার পরেই সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। মৃন্ময় তার লাল চোখ দেখে এমন চমকে উঠেছিল যে তারপর সারা রাস্তা আর মুখ খোলেনি, মনে হয় বুঝতে পেরেছিল অচিনকে যত তাড়াতাড়ি হোটেলে পৌঁছে দেওয়া যায় তত ভালো।
আজ সকালেও যখন সে ঘুম থেকে উঠে এই হোটেলের ষোলোতলার ছাদে ইনফিনিটি পুলে কিছু জলকন্যাদের সাঁতার কেটে দিগন্তে মিলিয়ে যাবার চেষ্টা করতে দেখছিল, তখনও বাকি দিনটা কিরকম যাবে সে চিন্তা অচিনের মনে আসেনি। পুলের থেকে একটু দূরে পাতা রঙিন ছাতাদের কৃত্রিম ছায়ার নীচে জলখাবার সাজানো টেবিলগুলো। ছাদের সীমানার দিকে গিয়ে ফুরফুরে মেজাজে শহরটা ওপর থেকে দেখতে দেখতে সে ভাবছিল – ইনফিনিটি পুলকে কি অসীম চৌবাচ্চা বলা যায়?
এখানে একটু বাদে অচিনের সিনেমার নায়িকার প্রোমোশনাল ফটোশুট হবে। অচিন দূর থেকে বড় ক্যামেরা, ট্রাইপড হাতে কোনো ডিজিটাল খবরের পোর্টালের দুজনকে এগিয়ে আসতে দেখল। গলায় হোটেলের ভিজিটর ট্যাগ।
কালো চশমা এখন অচিনের ব্যাগে। হোটেলের গাড়ি রাখার জায়গায় হাঁটতে হাটতেই অচিনকে দেখে মৃন্ময় গাড়ি থেকে হাত বের করে নাড়ছিল। কাছে গেলে বোতাম টিপে গাড়ির পিছনের দরজার লক খুলে দিল মৃন্ময়। নেমে এসে দরজাও খুলে দিতে যাচ্ছিল, অচিন হাত নেড়ে বারণ করে নিজেই খুলল।
'আপনার চোখ কেমন আছে আজ?'
'আজ সব ঠিক। রাত্তিরে ঘুমোলে ঠিক হয়ে যায়, কালই তো বলেছিলাম। যাকগে, আজ তুমি জানো কোথায় যেতে হবে?'
'জানি' - বলে মৃন্ময় গাড়িটাকে গড়াতে শুরু করে। হোটেলের গেট দিয়ে বেরিয়ে তাদের গাড়ি শহরের রাস্তায় যানজটের মধ্যে মিশে যায়। আরামের সিটে গা এলিয়ে পাঁচ মিনিট বাদেই অচিনের চোখ কিছুটা বুজে এসেছিল। আজকাল রাত্তিরে ভালো ঘুম হলেও এই হালকা ক্লান্তিটা থাকে, গা এলিয়ে দিলেই চোখ বুজে আসে। ডাক্তারদের জিজ্ঞ্যেস করলে তারা বলে মাঝবয়সের সঙ্গে এটা নাকি স্বাভাবিক।
মৃন্ময়ের চাপা আলতো একটা ব্রেকে জেগে উঠে অচিন দেখল সে তার এককালের কলেজের পাশ দিয়ে যাচ্ছে।
'মৃন্ময়, তুমি হলে গিয়ে সিনেমা দেখো?'
'ছুটি পেলে মেয়ে বউকে নিয়ে দেখতে যাই। তবে বানিয়ে বলব না, হলে কমই যাওয়া হয় এখন'
'তাহলে কোথায় বেশি দেখো? মোবাইলে?'
'হ্যাঁ, বাইরে বাইরে ঘুরতে হয় তো। অনেকক্ষণ গাড়ি দাঁড় করিয়ে বসে থাকতে হয়। সময় কাটাতে মোবাইলেই দেখতে খুব সুবিধা। বাড়িতে বৌ আবার টিভিতেই বেশি দেখে।'
'বেশ। ওই ক্যাফেটা আসতে এখনো কত দেরী? '
'প্রায় এসে গেছি। আর একটা সিগন্যাল পেরলেই।'
মৃন্ময় জানে না অচিন সিনেমা বানায় বা এ শহরে একটা ছবির প্রমোশনে এসেছে। হয়ত সে বা তার বৌ অচিনের বানানো সিনেমা দেখেছে , কিন্তু অচিনকে কেমন দেখতে জানে না। এমনিতেও ভাড়ার গাড়িচালকদের বারণ করে দেওয়া থাকে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে নিজের থেকে বেশি কথা না বলতে। কেউ প্রশ্ন করলে ভদ্রভাবে উত্তর দাও, ব্যাস।
ক্যাফেটার সামনে নেমে অচিন আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল। বাইরে লেখা আছে এখানে ইতালিয়ান খাবার পাওয়া যায়।
অচিনদা এবার তুমি আমাকে একটা সত্যি উত্তর দাও' - কফি খেতে খেতে এফেম চ্যানেলের রেডিও জকি সোহিনী বলল – 'অন এয়ার পুরো আড্ডাটা জুড়ে তো সেফ খেলে গেলে বস'
'প্রশ্নটা তো কর' – অচিন হাসছিল। তার কফিতে দুধ বেশি, কফি কম, চিনি নেই। অবেলায় বেশি কফি খেলে রাতে ঘুম আসতে সমস্যা হয় অচিনের।
একটু আগেই ক্যাফেতে রেসবুক আর ভিউটিউবে যারা ছবির কনটেণ্ট রিভিউয়ের চ্যানেল চালায় তাদের সঙ্গে কথাবার্তার দীর্ঘ এক একটা সেশন শেষ করে সে এখানে এসেছে। ছেলেমেয়েগুলো কেউ কেউ তো ইচ্ছাকৃত ভাবে ঘুরিয়ে তার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়েও প্রশ্ন করেছিল। অচিন ওসব প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে হাসি হাসি মুখে অনুরোধ করেছিল, যে নতুন ছবির প্রচার সে করতে এসেছে আলোচনা তাতেই সীমাবদ্ধ রাখার জন্য। ভিউ বাড়ানোর জন্য এই ডিজিটাল চ্যানেলগুলো কিছু একটা করে বিতর্ক শুরু করতে চায়, এদের সব ফাঁদে পা দিলে মুশকিল। নানাবিধ কুটিল প্রশ্নের বাউন্সার এবং ইয়র্কার সামলে এফএম অফিসে এসে চেনামুখ সোহিনীকে দেখে অচিন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। তাদের এফএম চ্যানেলের কথাবার্তা কিছু আগেই সম্প্রচারিত হয়ে গেছে, বেরিয়ে হোটেল যাবার আগে অচিন তাই সোহিনীর সঙ্গে কফি খাচ্ছিল। এখন আর কিছু রেকর্ড হচ্ছিল না।
'এই ধরো প্রোডিউসার যেরকম চাইছে সেরকম সিনেমাই তো তোমাকে বানাতে হবে। তাই অডিয়েন্সের হাওয়া যে রকম গল্পের দিকে, সেদিকেই ওরা সব টাকা ঢালবে। এই যেমন এখন তুমি একটা স্পেসিফিক প্রোডাকশান কোম্পানির হয়েই পরপর সব কাজ করে যাচ্ছ?'
'হ্যাঁ, এখনো অবধি আমি তো ওদের সঙ্গে পাঁচটা কাজ করলাম। দেখ, মেন ব্যাপারটা হচ্ছে লোকে এখন প্রচুর কনটেন্ট ওটিটিতে ডিজিটালি দিন রাত কনজিউম করছে। তাই সাপ্লাই দিতে প্রচুর কনটেন্ট তৈরিও হচ্ছে। হয়ত একসময় লোকে এগুলোতে ক্লান্ত হয়ে যাবে কিন্তু ততদিন পর্যন্ত এরকমই চলুক না। আমাদের তো এতে কাজের অভাব হচ্ছে না। আর আমি এগুলোর রাইটিং প্রসেসে ইনভল্ভড থাকি না। রিস্কি ব্যাপার , অনেক টাকাপয়সা ইনভল্ভড থাকে। আমার কাজ শুধু স্ক্রিপ্টটাকে ঠিকঠাক এগজিকিউট করা যাতে ওরা টাকা ফেরত পায়, দ্যাটস ইট। এটার জন্য ওরা আমাকে মোর দ্যান এনাফ পারিশ্রমিক দেয়।'
'যখন লোকে ক্লান্ত হবে, তখন?'
'তখন নিশ্চয় আরও নতুন কিছু ট্রেন্ড এসে যাবে। চক্রবত পরিবর্তন্তে। দ্য শো মাস্ট গো অন।'
কথাটা বলতে না বলতেই অচিনের চোখের পাতা দু তিনবার পড়ল। মনে মনে প্রমাদ গুনল সে। বাঁ চোখটা কটকট করছে। খুব খারাপ লক্ষণ।
ছেলেদের ওয়াশরুমটা ফাঁকা। অচিন হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে দু তিনবার মুখে চোখে ভালো করে জলের ঝাপটা দিল। তারপর পকেট থেকে একটা চোখের ড্রপ বার করল। আপৎকালীন ব্যবহারের জন্য এই জিনিসটা সবসময় তার সঙ্গে থাকে। দু চোখেই এক এক ফোঁটা করে নিল, তারপর দশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রাখল।
এবার একটু আরাম বোধ হচ্ছে। একটা কমোডের ফ্লাশের আওয়াজ শুনে অচিন চোখ খুলে দেখল আয়নায় পিছনে কোণের দিকে একটা বুথ থেকে সমুদ্র দরজা খুলে বেরোচ্ছে। রেডিও অনুষ্ঠানটা সরাসরি সম্প্রচারের সময় এই ছেলেটা ক্যামেরার পিছনে বসে তার আর সোহিনীর কথাবার্তা এফেম স্টেশনের ডিজিট্যাল পাতাগুলোয় লাইভ স্ট্রিম করছিল আর দর্শকদের পাঠানো প্রশ্নগুলো এগিয়ে দিচ্ছিল সোহিনীর সামনে। তার দিকে তাকিয়ে সমুদ্রকে হাসতে দেখে অচিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, সমুদ্র তাকে চোখের ড্রপটা নিতে দেখেনি।
ওয়াশরুম থেকে বেরোতে বেরোতে অচিন দেখল সমুদ্রও পকেট থেকে একটা ড্রপ বার করেছে। এটা অন্য একটা ড্রপ, যাতে চোখ শুকিয়ে না যায়। ডিজিটাল স্ক্রীন সময় বাড়ছে যাদের তারা আজকাল অনেকেই এটা ব্যবহার করে।
এফেম অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে অচিন দেখল মৃন্ময় কানে ইয়ারবাড গুঁজে সিট পিছনের দিকে হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সামনে হোল্ডারে রাখা মোবাইলে চলছে অচিনেরই বানানো একটা পুরোনো সিনেমা।
হোটেলে ফিরে অচিন ঘরে বসে না থেকে আবার ছাদেই একবার গেল। খোলা ছাদে অসীম চৌবাচ্চা জিনিসটা তার ভালই লাগে কারণ ওপর থেকে তোলা ড্রোন শটের মতন এই ব্যাপারটাও খুব ফটোজেনিক। সন্ধেবেলা চৌবাচ্চার নীচের নীল আলোগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, দূর থেকে মনে হচ্ছিল নীল রঙের কোনও চৌকো তেজস্ক্রিয় জেলি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে আলোর রশ্মিগুলো। জুতো মোজা খুলে রেখে অচিন হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে বসল সেই জেলির ভেতর। ক্লোরিন জলে অল্প বাতাসের ঢেউ। চারপাশ ফাঁকা। সকালের জলখাবারের টেবিলগুলো একপাশে সরানো, রঙিন ছাতাগুলো গুটিয়ে বেঁধে রাখা আছে, কাল ভোরবেলা আবার সাজানো হবে। ঈষদুষ্ণ জলে তার আরাম লাগছিল। এখানে ফিশ স্পার ব্যাবস্থা থাকলে, এই সময় পায়ে মাছগুলো কামড়ালে আরও ভাল লাগত। ফিশ স্পাতে, ছোট ছোট মাছেরা পায়ের পাতার পচা চামড়া ছেঁকে ধরে খেতে থাকে, একবার আরো বড় একটা হোটেলে থাকতে গিয়ে অচিন করিয়েছিল।
উঁচু হিলের জুতো পরে কেউ ঠক ঠক করে হেঁটে আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে অচিন দেখল মেয়েটার খুব বেশি বয়স নয়, কুড়ির আশেপাশেই হবে। তাকে চিনতে পেরে কথা বলতে চায়? কিন্তু হোটেলের ভেতরে এরকম ভাবে তো ঢুকে পড়ার কথা নয়। তাহলে আপাতত অচিনের মত এই মেয়েটিও হোটেলের একজন অতিথি?
'আপনি অচিন না?'
'হ্যাঁ, আপনি?'
'আমি বার্তা, ঠিক জানতাম আপনাকে এসময় পাওয়া যাবে'
'কি দরকার?'
'বসতে পারি এখানে?'
অচিন এ প্রস্তাবে সামান্য ইতস্তত বোধ করল - 'বসুন।'
'আমার মাসির নাম বৃন্দা, দাদুর নাম গৈরিক। আপনি ওদের চিনতেন, রাইট?'
'হ্যাঁ চিনব না কেন? আপনার দাদুর বাড়ি যেতাম আমি কলেজে পড়ার সময়।'
'আমাকে আপনি বলার দরকার নেই, তুমি বলতে পারেন।'
'তুমি তাহলে ওনার নাতনি?'
'হ্যাঁ, আপনি ওখানেই প্রথম ছবি পরিচালকের কাজ শিখেছিলেন?'
'ঠিক, তোমার দাদুকে দুটো টেলিফিল্মে অ্যাসিস্ট করার পর আমি বড় কিছু করব বলে এখান থেকে বাইরে চলে গেছিলাম। কিন্তু, তোমার দরকারটা বললে না?'
কলেজের সিনেমা ক্লাবের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বৃন্দার সঙ্গে বন্ধুত্ত্ব হবার পর অচিন সেই সময় থেকেই ছবি নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। কলেজ শেষের দিকে বৃন্দার দিদির বিয়েতে কলেজের সব বন্ধুরা মিলে গিয়েছিল, সেখানেই গৈরিকের সঙ্গে প্রথম আলাপ। এককালের নামকরা পরিচালক গৈরিক তখন আর বড়পর্দার ছবির প্রযোজক পাচ্ছিলেন না, টেলিছবি করতেন। ছবিতে কাজ করার ইচ্ছে দেখে তিনি অচিনকে বলেছিলেন মাঝে মাঝে শুটিঙে এসে সাহায্য করার জন্য। কিছুদিন তার সঙ্গে কাজ করে অচিন বুঝতে পেরেছিল আসল বড় ছবিতে হাতেকলমে কাজ শিখতে গেলে গৈরিক আর সাহায্য করতে পারবেন না।
'আমি তো মাস কম নিয়ে পড়ছি। এখন আমাদের একটা কোর্সে অল্প ভিডিও এডিটিং শেখাচ্ছে। আপনার পরের প্রজেক্টে কোনও এডিটিঙের কাজের ওপেনিং আছে? '
'এখন নয়, কলেজের পড়া শেষ হলে তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। আমার অফিসের নাম্বারটা রেখে দাও...'
'স্যার! স্যার! প্লিজ উঠুন, পুলের ধারে এভাবে ঘুমিয়ে পড়বেন না।'- হোটেলের এক কর্মচারী মেয়েটি অচিনকে কাঁধে টোকা মেরে ডাকছিল। অচিন চৌবাচ্চার জলে পা ডুবিয়ে রেখেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর একটু হলেই জলের মধ্যে পড়ে গিয়ে বড় বিপদ হয়ে যেতে পারত।
'থ্যাংকস এ লট' – বলতে বলতে অচিন মেয়েটার হোটেল ইউনিফর্মের মেরুন শাড়ির বুকের কাছে বাঁ দিকে লাগানো সোনালী রঙের নামের ফলকটা খেয়াল করল। এই হোটেল কর্মচারীর নামও বার্তা।
'আপনাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে?'
'নাহ আমি ম্যানেজ করে নেব, আর সমস্যা হবে না। তখন এমনিই ঠাণ্ডা হাওয়াতে একটু চোখটা লেগে গেছিল।'
গৈরিক নিজেই অচিনকে বলেছিলেন বড় পর্দায় কাজ করতে চাইলে বাইরে চলে যেতে। কিন্তু সেখানে গৈরিকের চেনা লোকেরাও টুকিটাকি কাজ দিতেন, তার নিজের লেখা স্ক্রিপ্ট ছবি করার জন্য কোনো প্রযোজক নেননি কোনো দিন। বহু নামী পরিচালকদের শুটিঙয়ের সহকারী হিসেবে দিনের পর দিন কাজ করত অচিন। এভাবেই প্রায় নয় দশ বছর চলার পর একদিন হঠাৎ অচিন চোখে হালকা ঝাপসা দেখছিল।
'ভয় পাবেন না। আপনাদের ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই আমার কাছে আপনার মত এই সমস্যা নিয়ে আসেন। নিজের ইচ্ছামত কাজ না পাবার দুশ্চিন্তা, জীবন যাপনের স্ট্রেস থেকেই আপনার চোখ দুটো খারাপ হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটা অপশন আছে, এক জোড়া কন্ট্যাক্ট লেন্স করাতে হবে, তারপর সবই ঠিকঠাক দেখতে পাবেন আপনি। নাহলে অন্ধ হয়ে যেতে পারেন।' - চোখের যাবতীয় পরীক্ষা করার পর অচিনকে জানিয়েছিলেন চোখের ডাক্তার।
‘সে কি ?? আর কোনো উপায় ?’
‘আরেকটা উপায় আছে কিন্ত সেটা মনে হয় আপনি পারবেন না। সেটা বাছলে আপনার চোখগুলো তুলে পাথরের চোখ বসাতে হবে। '
'না , পাথরের চোখের থেকে লেন্সই ভাল।'
'অবশ্যই, তবে যেহেতু নতুন লেন্সটা কৃত্রিম তাই আপনার শরীর এবং মন মাঝে মাঝে ওদেরকে ফরেন অবজেক্ট হিসেবে ট্রিট করতে পারে। ওটা শরীরের অটো ইমিউন ব্যাপার, শরীরের মালিকের হাতে নেই। আপনার ব্রেন বা চোখদুটো সেজন্য মাঝে মাঝে ওই লেন্সদেরকে পছন্দ করবে না। সেটা জানান দেবার জন্যই তখন চোখ চুলকোবে, লাল হয়ে যাবে, জল পড়বে... '
'সেটা বন্ধ করা যাবে না?'
'না, একটা ড্রপ দিয়ে দেব। দিনের বেলা সমস্যা হলে ড্রপটা ব্যবহার করবেন। চাইলে কালো চশমাও পড়ে থাকতে পারেন। রাত্তিরে চোখ দুটোকে বিশ্রাম দেবার জন্য চেষ্টা করবেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার। যতদিন বেঁচে থাকবেন ওষুধটা কিন্তু নিয়ে যেতে হবে। হুট করে নিজে থেকে বন্ধ করবেন না। আর লেন্সের ব্যাপারটা বাড়ির লোক ছাড়া বাইরের কাউকে নিজের থেকে জানানোর দরকার নেই, মনে থাকবে?'
লেন্স করানোর কয়েকদিন পরেই কাকতালীয় ভাবে সে নামকরা একটা প্রযোজনা সংস্থা থেকে ফোন পেয়েছিল। যেহেতু সহকারী পরিচালক হিসেবে সে কিছুটা নাম করে ফেলেছে ততদিনে, তাই ওরা বলেছিল অচিনকে পরিচালক হবার সুযোগ দেবার জন্য ডাকা হয়েছে কিন্তু নিজের স্ক্রিপ্টের ওপর নয়, বাকিদের লেখা যে স্ক্রিপ্টগুলো ছবি বানানোর জন্য জমা পড়বে এবং অনুমোদিত হবে, সেগুলোর পরিচালক হিসেবে।
কালকে মনে হয় কিছু টিভি চ্যানেলে যেতে হবে প্রোমোশনের কাজে। খোঁজ নিয়ে একফাঁকে গৈরিকবাবুর বাড়ি ঘুরে আসা যায়। সে অনেকদিন আগেই খবর পেয়েছিল গৈরিক মারা গেছেন, কিন্তু আর কোনও খবর নেওয়া হয়নি।
কুড়ি বছর আগেই টিভির যুগে কিছুটা হতাশাগ্রস্ত গৈরিক নিজের মনে বলতেন একসময় সিনেমা সূর্যাস্তের শিল্প হয়ে উঠবে। বলতেন - 'অচিন , সিনেমা বানাতে গিয়ে নিজের বলতে চাওয়া কথাগুলো ভুলে গিয়ে অন্যদের হাতের পুতুল হয়ে যেও না।' গৈরিক বলতেন তার চোখেও কোনো অসুবিধা হচ্ছে , দৃষ্টিশক্তি কমে আসছে দিন দিন। ডাক্তারকে দেখিয়ে লাভ হয়নি।
আয়নার দিকে তাকিয়ে অচিন সাবধানে প্রথমে বাঁ চোখের তারপর ডান চোখের কন্ট্যাক্ট লেন্সটা বের করে আনল। রাত্তির বেলা ঘুমোতে যাবার আগে এই দুটোকে সান্দ্র একটা তরলে ভিজিয়ে রাখতে হয়, এটাই নিয়ম। তাহলে লেন্সে সারদিনের জমে থাকা সমস্ত নোংরা বেরিয়ে গিয়ে পরেরদিন আবার সব পরিষ্কার দেখতে লাগে।
এখন এমনিতে বেশ দেখতে পায় সে। কিন্তু বাইরে বেরোতে বা কাজের সময় লেন্স ছাড়া অসুবিধা।
অচিন ফোনটা হাতে তুলে নিল। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে একবার বাড়িতে ফোন করতে হবে।