"আমার সাথে একবার মৃত্যুর দেখা হয়েছিল। সে আজ থেকে এগারো বছর আগে। তিনি আমার মাথায় স্নেহের হাত রেখেছিলেন। কিন্তু থাকেননি ভদ্রলোক। আমিই থেকে গেছিলাম। পরে, অনেক পরে ধীরে ধীরে অচেতনতা, অ্যামনেশিয়া, পেইনকিলার ইনজেকশন সবার কোলাকুলি থেকে বেরোবার শেষে আস্তে আস্তে বুঝেছিলাম মৃত্যু আমার জন্য কি রেখে গেছেন। একটা খিলান, যা দিয়ে অন্য কোনো জগতে পা রাখা যায়।"
'ছায়ার পাখি' বইয়ের লেখাগুলি পড়তে পড়তে পাঠক ক্রমাগত লেখকের পিছু পিছু সেই খিলানের জগতের ভেতরে ডুবে যেতে থাকেন। নাচোর কাছ থেকে লেখক শুকিয়ে যাওয়া সমুদ্রশ্যাওলা কেনেন যা নাচোর নানা আন্দিজের ওপার থেকে এনেছিল। সেই পাতা পোড়া ধোঁয়ায় আছে ঘুমিয়ে পড়ার, বদলে যাবার নিদুলি মন্ত্র। অনেক রাতে একলা জেগে লেখক সেই অন্য দুনিয়ার গান শুনতে পান। বালেনা মাঝ সমুদ্রে পথ হারানো, ভয় পাওয়া ক্লান্ত নাবিকদের ওই গান গেয়ে বাড়ি ফিরে আসতে বলে। মস্তিস্ক ইলিউশনিস্ট তাকে সাইরেনদের মরণ জাদুর গান বলে উপকথা লেখে।
ওর নাম বিভ্রম। তাকে সব অনুভূতিরা পাত্তা দেয়নি। শুধু দুজনের হাত ধরেছিল বিভ্রম - দৃষ্টি আর ঘ্রাণ। ঘুমপাড়ানি বুড়োর মত বিভ্রম লেখকের চোখের বারান্দায় একটা সাদা কাঠের রকিং চেয়ার রেখে চলে গেছে। মাঝে মাঝে এসে বসে রোদ্দুরে কি বৃষ্টিদিনে, তারাদের রাতে। চেয়ারে বসে আপনমনে দোল খায়।
সেখানে ছায়ামানুষরা কখনো ভয়েড নামের আলখাল্লা চাপিয়ে আসে আর লেখকের বন্ধু হয়ে ওঠে -
"আমি [ফরাসিতে বন্ধু], আমার একটা গাছ ছিল, তাতে আবির রঙের থোকা থোকা ফুল ফুটত, জানতে?"
"হ্যাঁ, পমপম ফুল"
"আমার একটা খুশি লেখার খাতা ছিল। রোজ রাতে তাতে অন্তত তিনটে খুশি লেখা পড়ত। বেশিরভাগ দিনেই সংখ্যাটা দশ ছাড়িয়ে যেত। জানতে?"
"হ্যাঁ। সেই খাতাটা এখন তোমার খাটের নিচে পুরোনো জুতোর বাক্সের মধ্যে শুয়ে থাকে। অর্ধেকের ওপর সাদা পাতা নিয়ে।"
জোহানেস ভার্মিয়েরের আঁকা, হ্যান্স এন্ডারসনের ছোট জলকন্যার গল্প, নরওয়ের দেবতা জেন্ডার ফ্লুইড লোকি, একানড়ে সব মিলেমিশে যায় এই দুনিয়ায়। সেখানে আলোর অন্যরকম রং। কথা বলা খরগোশ, ভেড়ার ছানা, জ্ঞানের পেঁচা লেখককে সেই দুনিয়ার দরজার সন্ধান দেয়। সেখানে লেখক 'রাইড দ্য ওয়াইল্ড হর্স' ধ্যানের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন যেখানে প্রতিটি অনুভূতি একেকটা উদ্দাম বুনো ঘোড়ার মত। অথবা ব্ল্যাকআউট ডাইনিং যেখানে এক রেস্তোরাঁ আর তার খাবার টেবিল লেখকের কাছে আর্ট গ্যালারি আর ছবির প্রদর্শনী হয়ে ওঠে।
শুরুর দিকে যে "অচেনা অনুভূতিরা বালিয়াড়ির ছায়ায় গা ঢাকা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করে।", ধীরে ধীরে জীবনস্রোতে সেই ইন্দ্রিয়গুলিই লেখকের বন্ধু হয়ে ওঠে - "নিকষজাত নতুন আমি আজ রং শুনতে পারি, গন্ধ দেখতে পাই। স্বাদ ছুঁতে আর স্পর্শ শুনতে কিংবা খেতে।"
'জিহ্ব' লেখায় পাঠক আরো গভীর বুঝতে পারেন সেকথা -
"আমার দাঁতে অনেকটা জীবন জড়িয়ে গেছে। … রাত্রির কোনো পায়ের শব্দ নেই। ওরা বলে। ঠিক না ভুল কে জানে? আমি কিন্তু ওর আসার শব্দ শুনতে পাই রোজই। কয়লার আঁচে সেঁকা মোটা মোটা রুটি, তুর ডাল, ঝাল কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতার চাটনি, শুনতে পাই জিভের মধ্যিখানটায়।…নরম হাতে জড়িয়ে ধরেছিল, গাঢ় গানাশ, ডার্ক চকলেটের। ওকে তোমরা অন্ধকার বলে ডাকো, সত্যি?"
দুর্ঘটনার ট্রমাকে জয় করে লেখক বুঝতে শেখেন ভয়, দুঃখর মত নেতিবাচক অনুভূতিগুলিকেও, যা জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ -
"ভয় বড় দুঃখী লোক। আমি চাই ওর ভালো হোক। কে মুক্তি দেবে ওকে? সবাই ওকে ঝাঁটা মেরে তাড়িয়ে দেয়। ছুঁচলো লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রোয়াক থেকে নিচে ফেলে দেয়। ভয় ছোট্ট একটা কান ছেঁড়া, লোমওঠা কুকুর বাচ্চার মত তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে। একবারটি তাকিয়ে দেখে না কেউ ওর দিকে। শুধু তাড়িয়ে তাড়িয়ে দিলে ও ফিরে আসবে না তো কি করবে? আমি ভয়কে বলি, ভালো হোক তোমার, দুঃখী বন্ধু।"
"আমি দুঃখকে থাকতে দিই, ভয়কে, কান্নাকে। ওরা ঠেলে ফেলে দেয় আমাকে। আমি কাঁটার ঝোপের ওপরে শুয়ে থাকি। আমি জানতে পারি সিদ্ধার্থ আছেন, কোথাও কোনোখানে।
দুশ্চিন্তা ওর যমজ বোন; দুঃখের। ওর পোশাক গাঢ় ছাই রঙের। ওর হাতে একটা ধাতুর যন্ত্র থাকে সবসময়। র্যাদা চালায় ও, আমার তুলতুলে আঢাকা মনের ওপরে। বিরামহীন। প্রমিথিউসের যকৃতের মত রোজ রাতে ঘুমের সময় সেই মন পুরো হয়ে ওঠে। যাতে পরদিন আবার ঘষে ঘষে কুরিয়ে নিতে পারে দুশ্চিন্তা। বিরামহীন।"
"আমার দেওয়ালে ক্রিসেনথিমাম ফুলরা আজকাল আরো একটু হালকা রঙের গল্প করে। বেখাপ্পা চেয়ার আয়েসি বুড়োমানুষের মত শীতের রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার পুরোনো খাতা খাটের নিচেকার জুতোর বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে রাতটেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে ডানা নাড়ায়। টিংকারবেলের মত। "
পড়লে মনে হয় নিঃশব্দ অন্ধকার রাতে টেবিলে জ্বলা একটুকরো আলোর পাশে বসে পিছনের দেওয়ালে পড়া নিজস্ব ছায়াগুলি লিখে রেখেছেন লেখক। এই ন'খানা আলো ছায়ার সংকলন প্রকাশ করে বৃহত্তর পাঠকসমাজের সামনে নিয়ে আসার জন্য জন্য গুরুচন্ডা৯র বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। এই বইয়ের সুলিখিত ভূমিকায় ইন্দ্রাণীর যেমন মনে হয়েছে ক্ষীরোদ নট্টের বাজানো সেই ঢোলের কথা -"স্পষ্ট, সৎ, মায়া ও মহিমাময়। গভীর অন্ধকারে আমের মুকুল ঝরার শব্দ শোনা যায় যেখানে।" প্রচ্ছদের রাতের আলোআঁধারির ছবি দেখলে জ্ঞানী পেঁচার বলা সেই কথা মনে পড়ে - "পর্দাতে যা দেখায় সবটাই স্বপ্ন নয়, বুঝলে? পর্দা বেড়ে উঠে কখনো চারদিক ঘিরে নেয়। বুঝলে?"
এই বইয়ের লেখাগুলি নিজেকে সেই ক্ষত থেকে সারিয়ে তোলার, বিষতীরের ফলা টেনে উপড়নোর 'হিলিং'য়ের অংশ হিসেবেই কগনিটিভ জার্নালিং বলে পাঠক বুঝতে পারবেন। অভিযোগ একটিই, বইটি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।
"আলোর কোমল চোখের মধ্যে আমি আজ অঙ্গুলিমালকে দেখতে পেলাম। তিনি গভীর শান্তি পেয়েছিলেন। যখন সবাই ওঁকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল, তারপরে। আমি সত্যিকে দেখতে পেলাম আজ। শব্দহীনতায়।"
"বাঁধন আলগা হয়ে যাওয়াকে আজকাল ভয় পাই না আর। তিনি বলে গেছিলেন; আমার রিয়ালিটি আলাদা। এ গাড়ি যাবে না। আমায় অন্য গাড়ি নিতে হবে। আমার বড় ভালবাসায় বেঁচে থাকা আমার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে আছে। অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। "
"আমি হাঁটছি। কোত্থাও পৌঁছনোর তাড়া নেই আমার এখন আর। কোত্থাও পৌঁছনোর দরকারও নেই। আমার মধ্যেকার আমি, আমার ভালোবাসার আমি, আর আমার নিজের পরম ভালোবাসা - হাত ধরে চলছি এই রাস্তা বেয়ে। সবসময় কোথাও না কোথাও পৌঁছতেই বা হবে কেন?"
এই বই সেই উত্তরণের যাত্রাপথ। পথের শেষ কোথায় পাঠকরা কেউই জানি না যেহেতু, তাই লেখকের কাছে পরবর্তী লেখাসমূহের প্রত্যাশা আরো বেড়ে যায়। কারণ শেষ পর্যন্ত, লেখকের ভাষাতেই - "জীবনের মত দক্ষ স্টেজ ম্যাজিশিয়ান আর কেউ নেই।"