এক
- ইমেল পেয়েছেন?
মেয়েটা মাথা না তুলেই আমাকে প্রশ্ন করল। তার মুখে হালকা আকাশী নীল রঙের সার্জিকাল মুখোশ। কাউন্টারের ওপর দিয়ে চিরকুট তার দিকে এগিয়ে দিয়েছি।
ইমেল না পেলে কেউ ইচ্ছে করে এই জায়গায় ঘুরতে আসে না। এখানে এমনকি ব্যাগ নিয়ে পর্যন্ত ঢোকা যায় না। বাইরে লকারে রেখে আসতে হয়। তার ওপর এই শহরে না থাকলেও শুধু এই কাজের জন্যই দূর থেকে আসতে হয়েছে কারণ এদের কোনো শাখা নেই।
- আজ আপনার বায়োমেট্রিক হবে তো? আর মেডিক্যাল এক্সাম?
মেয়েটা তার সামনের স্ক্রিনে আমার ফাইল চেক করছিল, পিছলে নাকের নিচে নেমে আসা মুখোশটাকে আবার টেনে ওপরে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল।
- আপনার মেডিক্যালের কাগজ জমা দেওয়া বাকি আছে। ঐটা না দেওয়া পর্যন্ত বায়োমেট্রিক জমা দিতে পারেন কিন্তু প্রসেস হবে না। নিয়ম নেই।
- আরো সময় লাগবে?
- মেডিক্যাল না করলে ওই দেশে যাওয়া যায় না।
- আগে জানাননি কেন?
- আমরা এখানে শুধু চাকরি করি। আপনি যে দেশে যেতে চাইছেন সেখানকার এমব্যাসির নই। আমাদের কাজ চেকলিস্টের খোপে টিক মেলানো। আপনার মেডিক্যাল সার্টিফিকেট লাগবে দেখাচ্ছে।
বিরক্তিকর। মানে এখানে আরও কদিন আমাকে হোটেলে থাকতে হবে। আর আমি যে কিছুদিন বাদে একটা অন্য দেশে চলে যাব, সেকথা বাড়ির লোক আর উপাসনা ছাড়া কেউ জানে না।
উপাসনা ইতিহাস নিয়ে পড়েছে। দেশে থাকার সময় ও রাত জেগে অনলাইনে বাইরের স্কুলের পড়ুয়াদের হোমওয়ার্ক করে দিত। তারপর সেই টাকা জমিয়ে নিজেই স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে। গবেষণার বিষয় হিসেবে এখন বোঝার চেষ্টা করছে কেন আমরা কিছু কিছু নির্দিষ্ট জিনিস ভুলে যাই অথচ একইসঙ্গে কিছু কিছু জিনিস মনে রেখে দিই। অথবা কিভাবে জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি এসব ইতিহাস থেকে মুছে যায়। এই সমস্ত গোলমেলে প্রশ্নের উত্তর খোঁজাকে মেমোরি স্টাডিজ বলে। ও সহজ করে বললেও শুনে মনে হয় খুবই জটিল কোনো বিষয়, ভালো বুঝতে পারি না। আমি অবশ্য এমনিতেও ওর মত এত পড়াশুনো বুঝি না, শুধু মনে হয় সুযোগ পেলেই বহুদূরে কোথাও চলে যাই যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না, সেখানে নতুন জীবন শুরু করা যাবে।
- এই যেমন ধর, নোটবইতে হালকা পেন্সিলে লিখলে বা আঁকলে ইরেজারে সহজেই মুছে দেওয়া যায়। কিন্তু খুব চাপ দিয়ে পেন্সিলে ছবি আঁকলে বা লিখলে পরের পাতাগুলোয় দাগ পড়ে। ওপরের পাতার ছবিটা মুছে বা ছিঁড়ে ফেলে দিলেও নিচের পাতাগুলোর কাগজে সেই স্মৃতি থেকে যায়। পরে কেউ ওই পাতাগুলোর ওপর পেন্সিল ঘষলে আবার হারিয়ে যাওয়া ছবি ফুটে ওঠে। স্কুলে ট্রেসিং কাগজ ব্যবহার করতাম না? সেইরকম। এইসব জিনিস নিয়ে আমরা কাজ করি। তুই কবে আসবি এখানে?
উপাসনা ভিডিও কলে এরকম যা সব বলে, নিজের চোখেই প্রায়শ দেখতে পাই। অফিস যাতায়াত করতে করতে দেখি অতি সাম্প্রতিক ইতিহাসই কিভাবে ক্রমশ ক্ষয় পেতে পারে। রাস্তায়, প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে তিন ফুট দুরত্বে ফাঁক ফাঁক করে আঁকা সাদা বা হলুদ বৃত্তদের খেয়াল করি যারা পথচলতি জুতোদের ঘষায়, বৃষ্টির রোদেজলে মুছে এসেছে। পোশাকের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠা ঘামে চটে যাচ্ছে মেট্রোর দুই সিটের মাঝখানে তৃতীয় সিটের পিঠে সাঁটা সামাজিক দূরত্ত্ব বজায় রাখার লালহলুদ স্টিকার।
আমার প্যান্টের পিছনের পকেটে লুকিয়ে থাকা ওয়ালেটে একগাদা সাদা রশিদ। এটিএম থেকে বেরোনো টাকার হিসেব বা স্থানীয় ট্রেন-বাসের। অনলাইনে আনানো খাবারের বিল। বাইকের পার্কিং টিকিট বা তেলের। হাইপারমার্টের মাসকাবারির লম্বা ফর্দ। এই সমস্ত রশিদ এখন এমন কালিতে ছাপা হয় যে কদিন পরেই নিজে থেকে ধীরে ধীরে আবছা হতে থাকে। আরো কিছু পাতা একেবারে সাদা হয়ে গেছে, ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলে কোথাকার রশিদ সেসব কিছুই আর মনে পড়ে না। এছাড়া আমার অফিসব্যাগের সামনের চেনে এই একইরকম মুছে যাওয়া কালিতে ছাপা সাদা থেকে হলদেটে হতে থাকা অনেকগুলো প্লেনযাত্রার বোর্ডিং পাসও জমে আছে। ফেলব ফেলব করে ফেলা হয়নি।
তারপর এই যে এখন এসব হাবিজাবি ভাবছি , হু হু করে কুড়িতলা উঠে যাওয়া ভারহীন , নিঃশব্দ অফিস লিফটে অন্য কারুর কান থেকে জোরে ছিটকে আসা গানবাজনা আমার অন্যমনস্কতা ভেঙে দিচ্ছে। কানে গানবাজনা গোঁজা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুখ মনে করতে চেষ্টা করি। চেনা চেনা লাগছে। এরকম অনেকেই এই তিন বছরে বিয়ে হয়ে বাচ্চাদের মা হয়ে গেছে। ব্যস্ত দুপুরবেলা খাওয়ার পর তারা বাড়ির বয়স্কদের কাছে রেখে আসা বাচ্চাদের সঙ্গে ভিডিও কলে হাত নাড়ে, হাসে। তারপর অফিসে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে অবাক হয় যে তাদের বাচ্চারা কাল থেকে প্রথম স্কুলে যেতে শুরু করবে, কোথা দিয়ে সময় চলে গেল।
এরা আমাকে দেখলে এমন ভাব করে যেন আমি পাহাড়ি ঝরনার স্বচ্ছ স্ফটিক জল, যার মধ্যে দিয়ে রঙিন মাছেদের সাঁতার দেখা যায়। অর্থাৎ, তাদের চোখে আমি প্রায় অদৃশ্য। হাই হ্যালো কিচ্ছু করে না।
তিন বছর বাড়ি থেকে কাজ করার পর হঠাৎ অফিস সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছে। সপ্তাহে দু দিন। কিন্তু লোকজনের গড়িমসি। অভ্যাস হয়ে গেছিল। ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে এতদিনে তাও তারা দুদিন করে আসতে শুরু করেছে। সামনের বছর থেকে শোনা যাচ্ছে সপ্তাহে তিনদিন আসতে হবে।
অফিসে আরো অনেককিছু এতদিনে বদলে গেছে। সেখানে ঢোকার মুখে একটা ক্যামেরা। তার পাশে একটি পাতলা টিভি স্ক্রিনে যদি মাথার চারপাশে সবুজ একটা বর্গক্ষেত্র ফুটে ওঠে, অফিসে ঢোকা যাবে। লাল বর্গক্ষেত্র ফুটে ওঠা মানে শরীর ঠিক নেই, জ্বর, সেদিন বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার।
ভেতরে দেওয়ালে দেওয়ালে স্যানিটাইজার ডিস্পেন্সার। চ্যাটচ্যাটে আঠালো তরলে জমে আছে বুদ্বুদ। হাত নিচে নিয়ে গেলেই একদলা ছ্যাত করে হাতে পড়ে। ভুল করে সেই সান্দ্র আঠায় ধোয়া হাতের আঙ্গুল ঠোঁটে বা জিভে লেগে গেলে তেতোভাব।
খাবার জলের ফিল্টারের বোতামেও আর হাত ছোঁয়াতে হয় না। নির্দিষ্ট দূরত্বে আঙুলের ডগা রাখলে সাদা আলো নীল হয়ে কাগজের কাপে জল পড়ে, আঙ্গুল সরিয়ে নিলে সে নীল আলো সাদা হয়ে থেমে যায়।
ইউরিনালের সামনে তাকালে মাঝে মাঝে লাল আলোর ঝিলিক। সেন্সর, সামনে থেকে কেউ সরে গেলে বুঝতে পারে এবং তখন নিজে থেকেই জল সাদা পাথরের গায়ে গড়িয়ে যায়। এই ব্যবস্থা অবশ্য আগেই ছিল।
টয়লেটে বেসিনের পাশে সাবান বেরনোর জায়গা থেকে হাত মোছার কাগজ বের করা, হাত শুকোনোর যন্ত্র সবই এখন এইরকম স্পর্শহীন। স্বয়ংক্রিয়। সাবানে কমলালেবুর গন্ধ।
বিশাখা একবার আমাকে বলেছিল অফিসে মেয়েদের টয়লেটে আয়নাবেসিনের সামনে দু তিনজন বসার জন্য একটা ছোট সোফা রাখা থাকে, যা অফিসে ছেলেদের টয়লেটে থাকে না।
অফিসে পুরোনো জায়গায় বসলেও কিছু কিছু চেয়ার, ডেস্ক খালি আছে। আমার পাশেই সেরকম এক চেয়ার আছে যেখানে আগে একজন মেয়ে বসত, এখন ফাঁকা। তার এখানে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। আমরা, যারা এ অফিসে আবার ফেরত এসেছি, সবাই সেটা জানি। কিন্তু যারা একবার এ অফিস ছেড়ে চলে যায়, তাদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলা বারণ। কেউ অফিস ছেড়ে দিলে তাদের শেষদিনের পাঠানো ইমেলে লেখা থাকে - "ইট টেকস ওয়ান মোমেন্ট টু সে হ্যালো বাট ইট টেকস ফরএভার টু সে গুডবাই।" অথবা এরকমও লেখা থাকে - "এই পৃথিবী এক ছোট জায়গা এবং আবার একদিন আমাদের দেখা হবে।" তার কিছুদিন পরেই অফিসের চ্যাটে, মানে যেখানে অফিস সহকর্মীদের সঙ্গে কাজের কথা বলা হয়, তাদের নামের পাশে প্রথমে 'ডিঅ্যাক্টিভেটেড' দেখায়, আরো কিছুদিন বাদে তাদের ছবি সাদাকালো হয়ে যায়। আরো কিছুদিন বাদে চিঠিবাক্সে তাদের পাঠানো কাজের চিঠিগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রতি ডেস্কের নিচে একখানা করে প্যাকিং বাক্স রাখা। ভেতরে আগে এইসব ডেস্কে যারা বসত তাদের জিনিস। অফিস বন্ধ হবার সময় হাউসকিপিং বাক্সে ঢুকিয়ে বাদামি রঙের মোটা সেলোটেপ মেরে দিয়েছিল। কয়েকজন বাক্স খুলেছে, বেশিরভাগ বন্ধ। ওই মেয়েটার মত কেউ কেউ পুরোনো কিউবিকলে ফিরে আসেনি। কাজের জায়গা বদলে ফেলেছে বা অন্য কিছু, এখানে বাক্স পড়ে আছে। এগুলো তো আর অনন্তকাল এখানে পড়ে থাকবে না, কেউই নিয়ে না গেলে একটা সময়ের পর হাউসকিপিং কিছু ব্যবস্থা করবে নিশ্চয়।
আমার বসার জায়গার সামনে সাদাবোর্ডে বেশ কিছু আঠামাখানো ছোট ছোট চৌকো হলদে কাগজ লাগানো আছে। সেগুলোতে নানারকম সংখ্যা, বর্ণমালা লেখা। কারুর ফোন নাম্বার বা পাসওয়ার্ড নয়। কোনো কারণে লিখে রাখা হয়েছিল, এখন একমনে তাকিয়ে থাকলেও সেসবের উদ্দেশ্য বিধেয় কিছুই মনে পড়ে না। এগুলোও ফেলে দেওয়া দরকার।
এই শহরে কোনো নদী নেই। উপাসনা একবার বলেছিল নদী ছাড়া কোনো শহর জন্মাতে পারে না। যে শহর নদীহীন জন্মায় ও বেড়ে ওঠে, তা আসলে জোর করে তৈরী, কৃত্রিম। এখন মরুভূমির দিক থেকে ধেয়ে আসছে গরম বাতাস। বাইরে চুয়াল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপপ্রবাহ। হাত দিলে বোঝা যায় গরম হয়ে আছে কাঁচের দেওয়াল। বাইরে উড়ালপুলের ছায়ার নিচে, মিনারদের আড়ালে মানুষের জটলা।
পাঁচ ঘন্টা কাজের পর এখন অর্ধেক আকাশে ঘন কালো মেঘ আর বাকি অর্ধেকে শেষ বিকেলের মরে আসা আলো। দেখতে দেখতে ঝমঝম বৃষ্টি। মোটা মোটা শীল পড়ছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়া সমস্ত গাড়ির আলো জ্বলে আছে। অফিসের সবাই উদ্বিগ্ন তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। কেউ কেউ বৃষ্টির ছবি তুলতে ব্যস্ত। এইসব বিকেলের রোদ ঝলমলে বৃষ্টিতে রংধনু দেখতে পাবার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু আচমকা এরকম বৃষ্টি হলে জল জমা এবং রাতের দিকে আধঘন্টা আলো চলে যাওয়া অবধারিত। যেখানে থাকি সেখানে ইনভার্টারে একখানা আলো আর একটা পাখা কোনোমতে চলে। কোনো প্লাগ পয়েন্ট চলে না। মোবাইলে চার্জ ফুরোলেই চিত্তির, উপাসনার সঙ্গে কথা বলা যাবে না।
বেশ কিছুবছর আগেও একবার আমি এরকম একটানা বৃষ্টিতে বহুক্ষণ অফিসে আটকে পড়েছিলাম। বাইরে মাইলখানেক লম্বা শামুকের গতি অথবা নিথর, সর্পিল গাড়ির লাইন জমে ভুগল ম্যাপে রাস্তাগুলো লালে লাল হয়ে উঠেছিল। আমি আর বিশাখা অফিসে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করেছিলাম।
দুই
খুব ঠান্ডা এখানে। কম্বলের ভেতর জেগে উঠি। বাইরের করিডোরে জোরে কেউ দরজা টেনে বন্ধ করল।
দেওয়ালজোড়া কাঁচের জানলার ওদিকে ঝকঝকে শহর। রাতকে দিন বলে ভ্রম হয়। অন্য এক দেওয়ালে মানুষসমান আয়নার পাশে এক দরজা। সেও টেনে দেখেছি, বন্ধ। ঘরে টিভি আছে কিন্তু বোবা। খোল ফাঁকা রিমোটের পেটে কোনও ব্যাটারি নেই। রুম সার্ভিসে ফোন করে দুবার চেয়েছি। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ফোন থেকে শুধু নয় টিপলে রিসেপশন, সাত টিপলে রুম সার্ভিস এইসবে ফোন করা যায়। খাবার এনে তারা দরজায় বেল বাজায়, টেবিলে সাজিয়ে দেয়।
ভারী দরজায় কান পাতলে ওপারে পাঁচতারা হোটেলের করিডোর দিয়ে কেউ হেঁটে যায়। আগত পায়ের শব্দে জ্বলে ওঠে করিডোরের স্বয়ংক্রিয় আলো। কেউ জোরে জোরে হেসে ওঠে। রুম সার্ভিস দিনে তিনবার এসে বন্ধ দরজাগুলোর পাশে রাখা নোংরা কাপ প্লেট সরিয়ে নিয়ে যায়।
এই সমস্ত হোটেলের ঘরে চাবি ব্যবহার হয় না। দরজা খোলার জন্য হোটেল থেকে দেওয়া একটা সাদা কার্ড ছোঁয়াতে হয়। তারপর ভেতরে ঢুকে সেই কার্ড দেওয়ালে এক চৌখুপিতে আটকালে তবে ঘরের আলোপাখা ইত্যাদি চালু হয়। নতুন জায়গা বলে অন্ধকারে সুইচের অবস্থান ইত্যাদিতে ধাতস্থ হতে কিছুদিন সময় লেগেছে।
পুরু শব্দনিরোধক কাঁচের ওপারে শহরের পানশালার থেকে উদ্দাম গানবাজনা আর মেয়েদের হাসি ভেসে আসে। ওপরের তলা থেকে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ। মাঝে মাঝেই রাত দুটো পেরিয়ে গেলে এই আওয়াজ শুরু হয়। ঠিক যেন মহা আনন্দে পুরো ঘর দৌড়ে বেড়াচ্ছে কেউ। খালি পায়ে লাফাচ্ছে মেঝের ওপর। একতলার লবিতে রাতভর বিলিয়ার্ডস খেলে কেউ। ৭ , ১১ , ১৫ সংখ্যা লেখা রঙিন বেগুনি, কমলা, সবুজ বলগুলিকে সশব্দে লাঠি ঠুকে গড়িয়ে দেয় সবুজ চাদরের ওপর।
এভাবেই বুঝতে পারি, সরাইখানায় থাকতে থাকতে কীভাবে আমার মনের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। একজায়গায় নোঙর ফেলে শান্তভাবে ঘুমোনো খুব দরকার, এখন মনে হয়।
নরম বিছানায় শুয়ে নকল সিলিংয়ের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে এক লাল বিন্দুর ঝিলিক। ওখানে ধোঁয়া বোঝবার যন্ত্র বসানো আছে। আগুন লাগলেই শব্দ করে জেগে উঠবে।
আধো অন্ধকারে বিছানার নিচে হাতড়ে একটা কালো রঙের হাড় খুঁজে পাই। কাছে এনে দেখি হাড় নয়, মেয়েদের মাথার চুলের ক্লিপ। একটা দাঁত ভাঙা। মেয়েরা প্রায়ই হোটেলে থাকতে এসে এই জিনিসটা হারিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।
আমি উপাসনাকে মোবাইলের আলো-আঁধারি স্ক্রিনে ডাকি। অনেকক্ষণ কথার পর একসময় সে স্ক্রিন থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়ে।
তিন
নিস্তরঙ্গ আকাশের থেকে প্লেন থর থর কাঁপতে কাঁপতে নিচের মেঘসমুদ্রে ঝাঁপ দিল। রানওয়েতে অবতরণ শুরু হবে এক্ষুনি।
- আমি কিন্তু আরেকটা নতুন গল্প লিখতে শুরু করেছি। তুই যেমন কদিন ভিসার কাজে হোটেলে গিয়ে ছিলি, ধর যদি কোনো কারণে সেখানে কেউ মাসের পর মাস আটকে পড়ল। তারপর সেখানে থাকতে থাকতে একসময় সে সময়ের হিসেব গুলিয়ে ফেলল। গল্পের শুরুটা এরকম -"খুব ঠান্ডা এখানে। কম্বলের ভেতর জেগে উঠি।..."
এত সব পড়াশুনোর ফাঁকেও উপাসনা কিছু লেখালেখি করে। সেগুলো আমাকে শোনায় কিন্তু অন্য কোথাও পাঠায় না কারণ ও মনে করে একই সঙ্গে কেউ ইতিহাসবিদ এবং গল্পকার হতে পারে না। ওর কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল, কিছুদিন আগে এক বিমানবন্দরে এরকম বারোঘন্টা আটকে ছিলাম। দুখানা বিমান কোম্পানি একসঙ্গে জুড়ে যাচ্ছিল বলে তাদের পাইলটরা আর কেবিন কর্মীরা আচমকা ধর্মঘট করেছিলেন। পরপর উড়ান বাতিলের জন্য আরো অনেকে আটকে পড়েছিলেন সেদিন। বিপুল বিশৃঙ্খলা, বন্দরে জনসমুদ্র থৈ থৈ করছিল। আজ সেসবের চিহ্ন নেই। বন্ধ বোর্ডিং দরজার বাইরে স্টিলের চেয়ারের সারিতে ঘুমন্ত বালক বালিকারা। সুদৃশ্য হাতব্যাগ থেকে বের করা ছোট্ট গোলাকার আয়নায়, রোদচশমা পড়া মেয়েরা লিপস্টিক ঠিক করে নিচ্ছে।
যেটা ওকে বলতে পারলাম না, আজকে টার্মিনালেই বিশাখা আমার চোখে চোখ রেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। একা ছিল না, কোলে ছোট শিশু ইত্যাদি স্পষ্ট খেয়াল করতে পারিনি। তারপর মনে পড়ল আমি এন ৯৫ মুখোশ পরে আছি, ফলে দূর থেকে না চেনা স্বাভাবিক। বিশাখাকে আমি চিনতে পেরেছি কারণ ওর মুখে কোনো মুখোশ ছিল না।
অনেকক্ষণ প্লেনে বসে থাকলে ট্রলির ভেতরের জিনিসে, জামাকাপড়ে একরকম ঠান্ডা গন্ধ লেগে যায়। বাইরে রাস্তায় যানজটের সিগন্যালে সারি সারি নতমুখ সিসিটিভি। আধা তৈরি হয়ে পড়ে থাকা সারি সারি মেট্রো পিলার আর শাটার নামানো স্টেশনের সিঁড়ি। গাড়ির ড্যাশবোর্ডে মাকালীর ছবির সোনালি ফ্রেমকে ঘিরে লাল জবার মালা। সামনের ক্যাবের পিছনের জানলা দিয়ে বেরিয়ে থাকা আধপোড়া সিগারেট ধরা হাত। পাশেই পথচলতি অটো করে কোলে এক বিশালাকৃতি গাঢ় খয়েরী রঙের ভালুক পুতুল বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক মেয়ে। রাস্তার ধারে ঘট ঘট আওয়াজ করছে আখ মাড়াইয়ের গাড়ি। গরম চলে যাবার আগে শেষ ছোবল মেরে যাচ্ছে।
ডিজিটাল ছবি তোলা এবং মুছে ফেলা সহজ। বিশাখার সঙ্গে আমার তোলা ছবি ফোন বা মেঘমুলুক থেকে অনেকদিন মুছে দিয়েছি। তাহলে বিশাখা মন থেকে আমায় মুছে ফেলেছে এটা ধরে নিয়ে আমিও যদি বিশাখাকে মন থেকে মুছে ফেলি, আমাদের আর কোনো ইতিহাস থাকবে না।
- এহ হে। আপনার অনলাইন পেমেন্ট?
- হুঁ
- তাহলে নামার সময় খুচরো দু পাঁচটাকা দিয়ে বউনি করে যাবেন। সকালে প্রথম গাড়ি বার করলাম।
এই যে শহরে আমি জন্মেছি এবং বড় হয়েছি, সেখানেও আমি মাঝে মাঝে ইতস্তত ঘুরতেই আসি। বড় রাস্তা থেকে ভেতরে ঢুকলে এক ভাঙাচোরা গলিতে পর পর বাড়ির গায়ে 'বিপজ্জনক বাড়ি' লেখা পুরসভার নোটিশ। যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসা হাওয়ায় নোনাধরা তাদের দেওয়াল ফাটিয়ে বেরোচ্ছে চারাগাছ। সেরকম এক বাড়ির জীর্ণ তালা মারা, খিল চাপানো দরজার পাশে সাদাপাথরের ফলকে লেখা 'সৌদামিনী ভবন'। অথচ আমি নিশ্চিত এই বাড়ি সৌদামিনীর স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে। এখন উপাসনার মত কেউ চাইলে বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখতে পারে কিন্তু সৌদামিনীর আসল স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। এক শহীদ যুবকের নামে নাম রাখা এই গলিও অনেক পুরোনো, যাকে এক ভোররাতে কুপিয়ে মারার পর, স্মৃতির উদ্দেশ্যে গলির নাম বদলে দেওয়া হয়। কিন্তু সে নামকরণের পিছনের রাজনৈতিক হত্যার ইতিহাস ইদানিংকার স্থানীয় লোকেরা জানে না।
- এই অন্ধগলিগুলোকে আমাদের রিসার্চ গ্রূপে কি বলে জানিস? পরে আরেকদিন বলব।
ঘুরতে ঘুরতে, চুল কাটার দোকানের সামনে পুরোনো স্কুল কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যারা এখনো এই শহর ছেড়ে চলে যায়নি। দেখা হলেই এই বন্ধুরা সবাই বলে ভাবভঙ্গিতে, চেহারায় আমি একেবারে আগের মত একই রকম আছি, একটুও পাল্টাইনি।
রাস্তার একপাশে মিষ্টির দোকানের ক্যাশিয়ার দোকানের নাম ঠিকানা ছাপা চ্যাপ্টা কাগজ ভাঁজ করে দ্রুত ত্রিমাত্রিক বাক্স বানিয়ে ফেলছিল। যারা কিনছে, বাড়ি গিয়ে খাবে বলে দুখানা রঙিন ইলাস্টিকের কো অর্ডিনেটে আড়াআড়ি বাক্সের ভেতরকার মিষ্টিদের আটকে দিচ্ছিল।
- কাগজের বাক্সটা হোটেলের গল্প। মিষ্টিগুলো চরিত্র। আর ইলাস্টিক দুটো স্মৃতি। স্মৃতি সেই রঙিন ইলাস্টিকের মত - টানলে বেড়ে যায়, আবার ছেড়ে দিলে কমে আসে। বেশি টানলে ছিঁড়েও যেতে পারে।
- এখনো ওই হোটেলের গল্পটা শেষ হয়নি?
- না, শেষ হলে পুরোটা পাঠিয়ে দেব। পড়ে নিবি।
উপাসনা তিন চার মাস, কখনো সারাবছর ধরে এক একখানা গল্প লেখে। আমি জানি ওর কাছে এরকম বহু গল্প জমানো আছে যেগুলো শুরু হয়েও শেষ হয়নি। এ গল্পটাও না সেরকম হয়ে যায়।
সন্ধ্যে দেবার শাঁখের আওয়াজ হচ্ছিল। পিন বসে ছিল পাতাদার ময়লা চা দোকানে। সে ইদানিং অটোয় করে মিছিলে হাঁটে। সব দলের জনসভায় যায়। ফিরে এসে পাতাদাকে গল্প করে - এই দল বিরিয়ানি খাওয়াল আজ। ওই দল ডিম ভাত। ঝোলা থেকে সাদা ডুম বার করে দোকানের হোল্ডারে ক্যাঁচকোঁচ শব্দে লাগাচ্ছিল পাতাদা। কিছুদূর হাঁটলে এক সরকারি বাস কারখানা ছিল। বহুদিন বন্ধ থাকার পর ভেঙে এখন বহুতল। পাতাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম - কারা থাকে ওখানে? বলল ওখানে যারা থাকে কেউ এ দোকানে চা খেতে আসে না।
এরকম প্রথমবার নয়। আমার এরকম বিদঘুটে অভ্যেস আছে। বহুদিন আগে যেখানে থাকতাম বা এককালে চা খেতাম অথবা যারা পাহারা দিত অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি, তাদের সামনে অকারণ আচমকা গিয়ে দাঁড়ানোর। যদি চিনতে পারে। বেশিরভাগই চট করে চিনতে পারে না, সেজন্য ধীরে ধীরে এককালের খুব চেনা জায়গায় নিজেকে হঠাৎ অচেনা মনে হয়, মনে একরকম ধাক্কা লাগে। মানুষসমেত আস্ত জায়গাগুলো বদলে যায়। আরো অনেকদিন আগে, অন্য এক শহরে বাইক চালিয়ে অফিস থেকে ফেরার সময় এক বিকেলে খুঁজে পেয়েছিলাম স্বচ্ছ ঝিল। কদিন আগে সেখানেই ফিরে গিয়ে দেখেছি তার তীরে লম্বা লম্বা ঘাস। সাদা ফেনা ভেসে বেড়াচ্ছে। কারা যেন ময়লা ফেলে রোজ। মাঝে মাঝে সেইসব ফেনায় আগুন লেগে যায় যা সহজে নিভতে চায় না।
অফিসের এতদিনের ফাঁকা চেয়ার, ডেস্কগুলো এবার ভরে যাচ্ছে। দুপুরবেলা খাবার সময় গমগমে ক্যান্টিনে ফাঁকা টেবিল আর পাওয়া যায় না। আমার পাশের ফাঁকা চেয়ারেও কাজে নতুন যোগ দেওয়া অন্য কোনো মেয়ে বসে এখন। কদিন আগেই তার বিয়ে হয়েছে। বিকেলের দিকে সে তার মায়ের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে। পাশে বসে থাকলেও সেসব কথাবার্তার সারমর্ম কিছুই বোঝা যায় না।
দূতাবাসে কাঁচের সারি সারি ছোট ছোট কাউন্টার। কাঁচের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। উল্টোদিকে বসে থাকা একজন কেউ কিছু রুটিন প্রশ্নোত্তরের পর বলে দেয় ছাড়পত্র পাওয়া যাবে কি না। আসলে নাকি আগে থেকেই সব ঠিক করা থাকে কাকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। তাও লাইনে দাঁড়ানো অনেকের হাতে মোটা কাগজের ফাইলপত্র, কিসের কে জানে।
যে লাইনে আমাকে দাঁড় করালো, সেখানে একজন প্রায় আমার সমবয়সী মেয়ে বসে আছে আর কাগজপত্র দেখতে দেখতে ডান হাতে অনবরত একটা পেন্সিল চরকিপাক ঘোরাচ্ছে। কথাবার্তা শেষ করে ঠোঁট উল্টে সামনে দাঁড়ানো কাউকে বলল - "দুঃখিত, আপনার ভিসার আবেদন আমরা রিজেক্ট করছি। নেক্সট।"
সিঁড়ি ভেঙে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে এসেও কারুর মুখের সামনে মেট্রোর দরজা বন্ধ হয়ে গেলে যেভাবে তারা মেট্রোর ভেতরের মানুষদের দিকে তাকিয়ে থাকে, প্রত্যাখ্যাত লোকটি আমাদের দিকে সেরকম একঝলক তাকিয়ে চলে গেল।
কলেজে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবার সময় আগে থেকেই আমরা ভাবতাম দুধরনের ইন্টারভিউ প্যানেল থাকে। সিলেকশান এবং রিজেকশান প্যানেল। সিলেকশান প্যানেলে ঢুকলে অল্প প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই কেল্লাফতে, আর উল্টোটায় মন্দ কপাল। এক এক ঘরে প্যানেলগুলো আলাদা আলাদা বসত। কোন ঘরে কোন প্যানেল আমরা জানতাম না। ইন্টারভিউ দিতে ঢুকলে বোঝা যেত কার কপালে কোন প্যানেল পড়ল। বেরিয়ে আমরা এভাবেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাকিদের দিকে তাকাতাম।
আজকের লাইনে এখনো আমার আগে দুজন। তাই অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিলাম, উপাসনা ওর হোটেলের গল্পকে কিভাবে শেষ করতে পারে। যদিও আমি কখনো কিছু লেখার চেষ্টা করিনি, তাও এটুকু সময় কাটাতে মনে মনে গল্প বানাতে ক্ষতি নেই। সেদিনের পর আর উপাসনা ওই গল্প নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। মানে গল্পটা ওর শোবার ঘরের কাঠের মেঝে ঢাকা দেওয়া গালিচার তলায় শুয়ে আছে, আর শেষ করবে না, আমি জানি।
চার
একটি খালের ওপরের সেতুতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এক সাইকেল। পিছনে হেমন্তে একটি গাছের পাতা ঝরে যাওয়া ডালপালা আর রঙিন বাড়ির সারি।
প্রায় রোজই আমি এই ছবিটা দেখি। উপাসনা ভিডিও কল করলেই এটা তার পিছনের দেওয়ালে টাঙানো থাকে।
প্রতি বছরই এই সময় পারদ পতনের সঙ্গে সঙ্গেই এ শহরে দৃশ্যমানতা এত কমে যায় যে তিনহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকেও দেখা যায় না। সকালবেলা খবরে বলছিল ঘন কুয়াশার জন্য কেউ যেন বাইরে না বেরোয় এই দুদিন। দৃশ্যমানতা খুব বেশি কমে যাবার জন্য লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিমানবন্দরের এপ্রনের দুধারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উড়োজাহাজদের ডানায় একটুও পলক পড়ে না। সবুজ লাল আলোর তফাৎ করতে না পেরে, লাইনে পরপর থেমে যায় রেলগাড়িরা। মহাসড়কে একগাদা গাড়ি তালগোল পাকিয়ে একে অন্যের ওপর উঠে যেতে থাকে।
এই কুয়াশা বিষাক্ত। কিছুক্ষণ খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালে চোখ জ্বালা, কাশি। এই কদিন দিনের বেলা পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালে কিছুই দেখতে পাই না। রোদ উঠলেও এই কুয়াশা গলে যায় না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু পিছিয়ে যেতে থাকে দিগন্তের দিকে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া হাড়ে কামড় বসায়।
এ কদিন রুম সার্ভিসের ছেলে মেয়েরা দিনের বেলাতেও হোটেল থেকে বেরোতে বারণ করছিল। বলছিল দৃশ্যমানতা এত কম হবার সুযোগ নিয়ে যুদ্ধ লাগতে পারে। সেজন্য বিদ্যুৎ শুধু দিনের বেলা থাকে। রাতে বাইরে মিটমিটে অন্ধকার। তারা সবাই ছোটবেলায় লোডশেডিংয়ের স্মৃতিমেদুর কথা ফিসফিস করছিল। কাঁচের লণ্ঠনে নীল কেরোসিনের জ্বলে ওঠার পর জমে থাকা কালো অন্ধকারের দাগ। বিষাক্ত কুয়াশাভেজা কংক্রিটের মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ উঠে আসায় সবাই যেন আবার সেই পুরনো অন্ধকারের ওম খুঁজে পাচ্ছিল। কিন্তু ওরা বলছিল আর কয়েকদিন বাদে সব ঠিক হয়ে যেতে পারে। তখন বেরিয়ে নতুন আঁকার খাতা কিনে নিতে হবে।
সময় কাটাতে পুরোনো নোটবইতেই আঁকিবুকি কাটি। যত দিন যায়, সে আঁকার খাতা শেষ হয়ে আসে। ফলে প্রথম পাতায় আঁকা ছবির ছাপ মুছে আসে।
আমার একটা বড় হেডফোন আছে যেটা শুধু ব্লুটুথ তরঙ্গে কাজ করে কারণ সেটা ছাড়া সংযোগকারী তারটা অনেকদিন আগে হারিয়ে ফেলেছি। আঁকাআঁকির সময় আমি সেই নীলদাঁতের হেডফোনে গান শুনি, ইদানিং সেখানে মাঝে মাঝে আওয়াজ ঝিরঝির করে। শব্দতরঙ্গের মাঝখানে কিছুটা আওয়াজ যেন হঠাৎ হঠাৎ খেয়ে নেয় কেউ। বোঝা যায় হোটেলের ইন্টারনেট বিরক্ত করছে, চলে যাচ্ছে এক দু সেকেন্ডের জন্য, আবার ফেরত আসছে। ইন্টারনেট চলে গেলে একটি খুদে ডাইনোসর দুপায়ে দৌড়ে লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে থাকে একের পর এক কাঁটাগাছ।
এই হেডফোন স্পর্শে কাজ করে। বাঁদিকে একবার আঙুল চাপলে গান থেমে যায়। ডানদিকে দুবার আঙুল চাপলে পরের গানে চলে যায়। আমার জোরে গলা খাকরানির শব্দ পেলেও নিজে থেকে তার আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অথবা মাথা থেকে খুলে টেবিলে শুইয়ে রাখলে পাঁচ মিনিট বাদে নিজেই নিভে যায়। চাপালে বাইরের কোনো শব্দ কানে আসে না।
আজ উপাসনার কাছে শহরের কর্তৃপক্ষের থেকে মেসেজ এসেছে যে তার বাড়ির কাছে রাস্তা খুঁড়তে গিয়ে বোমা পাওয়া গেছে। বহু বছর আগে এক যুদ্ধের সময় প্লেন থেকে ফেলা বোমা যা মাটিতে আঘাত করেও ফাটেনি। এতদিন নিষ্ক্রিয় ছিল, এখন রাস্তা মেরামতির জন্য খুঁড়তে গিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তাই সবাইকে বাঙ্কারে চলে যেতে হবে, নিরাপদ আশ্রয়ে, যতক্ষণ না মাটিতে গেঁথে থাকা সেই প্রাচীন বোমাকে নিষ্ক্রিয় করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ আর উপাসনার সঙ্গে কথা হবে না।
আমারও একটা ভুল হয়ে গেছে আজ সারাদিন মোবাইল চার্জ দেওয়া হয়নি। রাতে আলো জ্বলবে না বলে সকেটে লাগানোর জন্য হোটেলের দরজা খোলার সাদা কার্ডের এখন কোনো কাজ নেই। এতদিনে মোবাইলের টর্চের অতিবেগুনি আলোতে ভাল করে কার্ডটা দেখলাম। সাদা কার্ডে পাঁচতারা অত্যাধুনিক হোটেলের আপাত অদৃশ্য নাম ফুটে উঠেছে - "সৌদামিনী ভবন"।
মায়াবী হেডফোন চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে কতক্ষণ। ফুরোতে না চাওয়া মাঝরাতে বিছানায় শুয়ে আমার বুকের বাঁদিক মুচড়ে ওঠে এবং চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায়। হঠাৎ সন্দেহ হয়, বহুদিন ধরে এই হোটেলে থাকতে থাকতে উপাসনা আসলে আমাকে ক্রমশ ভুলে যাচ্ছে। স্লেটে চকখড়ি দিয়ে লেখার মত উপাসনা শুধু তার কোনো অসমাপ্ত গল্পে আমায় লিখে রেখেছে, সেটুকুই আমার অস্তিত্ব, যেকোনো সময় মুছে দেবে। আমি যেন এখন ওর কোর্সওয়ার্কে বর্ণিত সেই জরাজীর্ণ অন্ধগলিতে ঢুকে পড়েছি, যেখানে শুধু স্মৃতিদের নিরালম্ব ভেসে থাকা। যে গলিগুলোকে ওরা ওদের রিসার্চ গ্রূপে কি নামে ডাকে আমাকে বলতে ভুলে গেছে।
একথা বোঝার সঙ্গে সঙ্গে জলের ওপরকার গাছের ছায়ার মত আমার সত্তা কেঁপে ওঠে, ভেঙে যায়। ছোট ছোট তরঙ্গে তাদের ভাঙ্গা টুকরোগুলো কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে ধীরে ধীরে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে যেতে থাকে। ফোনে নেটওয়ার্ক বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব মুছে গেছে এখন, টাওয়ারের সমকৌণিক ত্রিভুজে কাটাচিহ্ন। চার্জ ফুরিয়ে আসা ফোনের নীল স্ক্রীন ভেঙে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসে অন্ধকার। সারা বিছানায় ছড়িয়ে যায় টুকরো টুকরো কাঁচ। সে অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতেও একসময় মনে হয়, দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ। আলো আসেনি এখনো তাই দরজার বেল বাজবে না। কুয়াশা গলে গিয়ে প্লেন চলাচল আবার শুরু হল কি? আমি শেষ পর্যন্ত যেতে না পারলেও উপাসনা নিজেই চলে এল?