রেলের রানিং রুমের কাজটা চলে গেল। একসঙ্গে ছাঁটাই হল তিরিশজন কর্মচারী। নতুন কনট্রাক্টে বাইশজন চাকরি ফেরত পেল। ভালো বাংলায় যাকে বলে পুনর্বহাল। শিখা ফেরৎ পেল না।
শিখা যে রানিং রুমে সবজি তরকারি কুটনো কোটার আট হাজারি চাকরিটা ফেরৎ পেল না, তার কারণ শিখা মেয়েমানুষ। এবং বিগতযৌবনা।
বাইশজন মাঝবয়সী পুরুষমানুষ ফের গিয়ে কাজে জয়েন করলো। কন্ট্র্যাক্টর নতুন অল্পবয়সী মেয়েদের কিচেনের কাজে নিল। শোভন তরফদারের এই বৈষম্যমূলক আচরণের পেছনে কতটা মেয়েবাজি আর কতটা বদমায়েশি আছে, তার হিসেবনিকেশ করার আগে শিখার একটা নতুন কাজ জোটানো দরকার ছিল। ঘাড়ের ওপর লোনের বোঝা নিঃশ্বাস ফেলছে।
ছোট ছেলে একটা কাজের খবর এনেছিল কিন্তু শিখার সেটা তেমন মনে ধরেনি। গুল ফ্যাক্ট্রিতে রান্নার মাসির কাজ। কুড়ি জন লোকের রান্না। শিখার ডান হাত ভাঙার পর থেকে আর ভারি রান্নার কাজ করতে চায়না। বড় বড় হাঁড়ি, ডেকচি, কড়াই উনুনে ওঠানো, নামানোর শক্তিও আর নেই, তেতে পুড়ে বিশজনের রান্না করার হ্যাপাও সয় না। শিখা ঝাঁঝিয়ে না করে দিয়েছে। শরীর ভাঙছে দিন দিন, এখন টের পায়। কোমর থেকে একটা ব্যথা শিরশির করে পায়ের পাতা পর্যন্ত নেমে যায়। মাথা ভারভার লাগে। পাঁচমিনিটের কলপ দিয়ে ঢাকা, নয়তো যে হারে চুল পাকছে, শিখার লজ্জাই করে।
কাজ ভয় পায় না সে। শুধু শরীর আর সবটা দেয় না। এটাই লোকজনের কাছে স্বীকার করা যায় না। শুধু বাইরের লোক কেন, বাড়ির লোক, নিজের লোকের কাছেও বলার যুত হয় না, শরীর আর অত টানতে চায় না রে!
রানিং রুমের কাজে একবেলা খাওয়া ছিল, পি এফ ছিল, দুপুর দুটোয় ডিউটি শেষ, বাড়ি ফিরে টিপকলের জলে স্নান সেরে একপশলা আরামের ঘুম ছিল। সে কাজ যে এইভাবে গণছাঁটাইয়ে চলে যাবে, কে ভেবেছিল।
রেলের ডিউটির আগে শিখা টানা চারবাড়ি রান্নার কাজ করেছে। তখন বয়স কম ছিল, শরীরে ধক ছিল বেশি। পার বাড়ি দেড় থেকে দুঘন্টা, ভাত, ডাল, একটা সবজি, মাছ বা মাংস। শিখার হাত এক্সপ্রেস ট্রেনের বেগে চলে। একবেলা রান্নার প্রচুর বাড়ি মেলে। দুপুর আড়াইটার মধ্যে ছুট্টি। এই করে ছেলে দুটোকে বড় করেছে শিখা। এখন তারা লায়েক হয়েছে। বিয়ে শাদি করেছে। ছানাপাণা হয়েছে। তবে কেউ বাড়ি ছাড়েনি এখনো। একসঙ্গেই থাকে। শিখার ইচ্ছে হয় না আর বিকেলের কাজে লাগে। সন্ধের পর নাতি নাতনি কোলে কাঁখে নিয়ে সিরিয়াল দেখা বরং ঢের ভালো।
মোটের ওপর শিখা কাজ খুঁজছিল হন্যে হয়ে। শিখা অথবা শিখারা, সকলেই মোটা করে টেনে সিঁদুর পরে। শনিবার দিন করে মেটে সিঁদুর। শিখারা মানে শিখা অথবা শান্তি অথবা অণিমা। স্বামী নিরুদ্দেশ। দুটো বা তিনটে বাচ্চা দিয়ে স্বামী নামক লোকটি চলে গেছে অন্যত্র। কোন খোঁজ নেই আর। জানা নেই বেঁচে আছে কি না আছে। থাকার মধ্যে আছে জ্বলজ্বল করে পরা সিঁদুর আর পেটের ছেলেপুলে। একটা পাকাঘর আর বারান্দা। ঘরের মধ্যে পার্টিশন করে দুই ছেলের দুই বৌ নিয়ে সংসার। শিখা বারান্দাতে শোয় বড় ছেলের বড় বেটিকে নিয়ে। ময়না অন্তপ্রাণ তার। সাত মাসে জন্মেছিল ময়না, মায়ের দুধ পায়নি একফোঁটা। শিখা হাত পা ডলে চার বছরের করেছে। ন্যাওটা বাচ্চা এখনো তার কাপড় ধরে থাকে সারাদিন। কিন্তু একটা কাজ শিখার খুব দরকার। অন্তত দশহাজারি।
আনিসুলের মা দশবছর কাজ করে গেছে রায়বাড়িতে। তখন বড়গিন্নি ছিল, জ্যেঠা ছিল। তারা গত হলে বাড়ি চলে গেল প্রোমোটারের হাতে। একটা বাড়ি ছিল, তাতে সাত জন লোক ছিল। দুটো কাজের লোকে দিব্যি চলে যেত। বাড়ি ভেঙে যখন পাঁচতলা ফ্ল্যাট উঠলো, পাড়াশুদ্ধ লোক হায় হায় করলো। পাড়াতে আর একটাও বাড়ি থাকলো না। সব ফ্ল্যাট। এবার জলের লেভেল আরো নামবে। শিখারা বা শিখা কিন্তু খুব খুশি হয়েছিল। পাঁচতলা ফ্ল্যাট মানে পাঁচ চারে কুড়ি ঘর লোক। তার মানে কাজের মানুষের ডাক পড়বে বেশি। মাইনে নিয়ে দরকষাকষিও করা যাবে বেশ। কিন্তু ফ্ল্যাটের লোক একজোট হয়ে কাজের মানুষের বেতন বেঁধে দিল। ঠিকে দুই, রান্না তিন হাজার। রায়বাবুরা নিজেদের জমি বলে দু দুখানা ফ্ল্যাট পেল, কিন্তু আনিসুলের মা আর কাজ পেল না। ফ্ল্যাটের লোক ঠিক করেছে মুসলমান কাজের লোক রাখা যাবে না। কথাটা শুনে শিখা এবং শিখারা খুশিই হয়েছিল কিন্তু এটাও মানতে হবে যে শিখার রেলের কাজ ছুটে যাবার পর দত্তবাড়ির কাজটা আনিসুলের মা ই যোগাড় করে দিয়েছিল।
দত্তবাড়িতে সারাদিনের কাজ। ছজন লোক। দুটো অবশ্য বাচ্চা। কিন্তু যমজ বাচ্চা। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। আড়াই তিন বয়স হবে। কিন্তু তাদের মায়ের শরীর এখনো পুরো সারেনি। রান্নার লোক ছাড়াও একজন সারাদিনের লোক চাই বাচ্চা সামলানো, কাপড় চোপর কাচাকাচির জন্য। আনিসুলের মা, বেতো রুগি প্রচুর কাজের খোঁজ রাখে। শিখা কাজে ঢুকে গেছিল। আনিসুলের মা আগে থেকেই বলে দিয়েছিল, ও বাড়িতে ছুটিছাটা কম। যদি ছুটি নিস, আগে থেকে বলে নিবি। হঠাৎ হঠাৎ না বলে কামাই দিবি না।
সে কথা কি আগে থেকে বলা যায়? শিখার নাতনির যদি হঠাৎ করে সকাল থেকে পেট ছাড়ে, কিংবা জ্বর হয়, কিংবা ধরো বড় ছেলের বৌটার হঠাৎ পেট ব্যথা শুরু হয়, তাহলে শিখা করবে কি? কাজে ঢোকার আগে অত কিছু শর্ত রাখা যায় না। মাইনে পত্র দেখে শিখা কাজে লেগে গেল।
রায়তী দেখল বৌটা লম্বা। দোহারা। বেশ পেটানো শরীর। তার মানে খাটিয়ে হবে। দোতলা বাড়ি। যমজ বাচ্চা নিয়ে সে পেরে ওঠে না। তারওপর দুটোই ভীষণ দুরন্ত। সিজারের পরপর গল ব্লাডার অপারেশন। রায়তীর লোক ছাড়া চলবে না। শাশুড়ি অবশ্য অনেক কাজ কর্ম করেন। সকালে উঠে চা করা থেকে ঘর দোর ঝাড়মোছ একপ্রস্থ করে ফেলেন লোক আসার আগেই। কিন্তু বাচ্চা সামলাতে পারেন না। এবং শিশুদুটি কোলে উঠতে চায় অনবরত। শিখাকে দিয়ে চলবে। রায়তী কড়া করে বলে রাখল, কামাই করবে না।
কামাই করে শিখা করবেই বা কি? ভোর ছটায় উঠে একরত্তি ঘর বারান্দা ঝাড় দেওয়া। ছোট ছেলের বৌ দশটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। কাজেই পার্টিশনের একদিক ঝাড়ু পড়ে না। চায়ের পাট শিখার ওপর। ছেলেরা চা পাউরুটি খেয়ে বেরিয়ে গেলে শিখা এক তরকারি নামিয়ে ফেলে কাজে বেরোয়। বেরোনোর আগে পই পই করে বড় বৌকে বলে যায়, বাচ্চাদের সামলে রাখবি। রাস্তায় যেন না বেরোয়। ঘরের উল্টোদিকে বিশাল বিল। পানায় ভরা। সাপ, খোপ, বিছে কিলবিল করছে। সেদিন টিভির ওপর উঠে বসেছিল একটা সাপ। চকচকে গা। ফণা তুলে বসেছিল। শিখার বুক ধরফর করে।
রায়তী জিজ্ঞেস করলো, বন দপ্তরে খবর দাওনি?
ওখানে খবর দিলে সাপ ধরে বটে, কিন্তু গেরস্তের ঘর থেকে নগদ পাঁচশ টাকাও নেয়। অতএব খবর দেয়াদেয়ি নেই। বড়ছেলে বস্তা চাপিয়ে সাপ ধরে নিয়েছে।
রায়তী টোস্টে একটা কামড় দিয়ে বলেছিল, তারপর?
তারপর সাপ ছেড়ে এসেছে রেল লাইনে।
যত সাপ ধরা পড়ে, সব রেল লাইনেই ছেড়ে আসার সিস্টেম।
চৈত্র মাসে যেদিন ঝড় উঠলো, সেই একদিন কামাই করলো শিখা। ঝড়ে আম পড়েছে অনেক। কচি আম। আম কুড়ালো শিখা, শিখারা এবং আনিসুলের মা। এ আমে ভালো হবে আমচুর। চৈতালি চুণা বলে আনিসুলের মা। এই সময়ের আমচুরে অনেক উপকার।
রায়তী বাচ্চাদের শীতের পোশাক কেচে তুলছে এখন। দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো শিখার জন্য। তারপর বাথরুমে ঢুকলো। মেজাজ বেশ গরম হয়ে থাকল।
পরদিন শিখা পাঁচমিনিট আগেই ঢুকলো।
রায়তীর শাশুড়ি কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো, ফোনে জানাতে পারোনি আসবে না?
শিখা বাচ্চাদের এঁঠো তুলতে তুলতে বললো, ফোনে চার্জ ছিল না। ঝড়ে কারেন্ট চলে গেছিল না?
শিখার বাড়িতে পাঁচখানা ফোন। একটাতেও চার্জ ছিল না একথা হজম করে রায়তী ও তার শাশুড়ি সেইসময়ের মতো হাঁফ ছেড়েছিল এবং প্রথম মাসটি শিখা আর একদিনও কামাই করেনি।
শুরু হল পাঁচ মাস থেকে। রায়তী ইতিমধ্যে শিখার ওপর নির্ভর করা শুরু করেছে এবং শিখা সেটা বেশ বুঝেও গেছে। শিখা তিনমাসের অ্যাডভান্স চেয়ে বসলে রায়তী ব্যোমকে গেল। শাশুড়ি মুখ ভার করে থাকল। শিশুরা ইতিমধ্যে শিখার বেশ কোলঘেঁষা হয়ে গেছে এবং শক্তপোক্ত গঠনের শিখা দুটো বাচ্চাকে দুই কাঁখে নিয়ে ছাতে ঘুরতে পারে, অনন্ত সময় ধরে খাওয়াতে পারে। এইসময়ে তার ময়নার মুখ মনে পড়ে কারণ ময়না নিজের মাকে মা ডাকে না, শিখাকে মা বলে। ঐ একটা জায়গায় লৌহপেশীর শিখা অতি দুর্বল। ময়না জন্মের পর থেকে তার কাছেই ঘুমায়। এবার বারান্দার ছাদটা সারাতেই হবে। বাচ্চা খুব ভুগছে।
তিন মাসের অ্যাডভান্স এসে রফা হল দুমাসে সেইদিন যেদিন হাসপাতালের মেয়ে ডাক্তার খুন হল। খুন শুনেই রায়তী বলেছিল, শুধু কি খুন হবে? নিশ্চয়ই রেপড অ্যান্ড মার্ডার্ড। মেয়েটা নাকি নাইট ডিউটিতে ছিল।
দিনটা স্পষ্ট মনে আছে শিখার। বৌদি টাকাটা দিয়ে বলেছিল, অ্যাডভান্স নিয়ে আবার কামাই করা শুরু করো না। শিখা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলেছিল, একদম কামাই হবে না। আমার লোহার শরীর। যদি দু একদিন ছুটি নিই, আনিসুলের মা এসে ঠেকার কাজ চালিয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না। এ তো আর ফ্ল্যাট বাড়ি না যে আনিসুলের মা ঢুকতে পারবে না।
বিকেলে শিখারা যখন গপ্পে বসেছিল একসঙ্গে, টিভিতে বারবার ডাক্তার মেয়েটার কথা বলছিল। তার বাপ মা বন্ধু বান্ধব সবাইকে দেখাচ্ছিল। শিখারা মুড়ি মাখা খেতে খেতে সাধারণত এইসময় "বাঁশরির বিয়ে" বা "নয়নতারা" সিরিয়াল দেখে। সেদিন কেউ সিরিয়াল দেখেনি। শিউলির মা বলেছিল, "মেয়েমানুষ ঘরে থাকাই ভালো, কোন দরকার ছিল ডাক্তার হবার?" শিখাও একরকম তাইই ভাবছিল। আর ভাবছিল, ডাক্তার মেয়েটা ডিউটি দিয়ে পেশেন্টদের ঘরেই থেকে গেলে পারত টেবিলে মাথা টাথা দিয়ে ঘুমিয়ে। প্রাণটা বেঁচে যেত। বড় বৌ বলেছিল, ছত্রিশ ঘন্টা ডিউটি মা, শরীরে সয় না। বেচারা ঘুমাতে গিয়েছিল।
টাকা দেওয়ার পনেরোদিন পর থেকে শিখা কামাই শুরু করলে। রায়তী এটাই ভয় পাচ্ছিল। অ্যাডভান্স যে দিয়েছে সেটা বর বা শ্বশুরকে বলা যাবে না। ফোন করেনি শিখা। দুদিনের দিন রায়তী ফোনে পেল তাকে।
ময়নার জ্বর। আউটডোরে বসে আছে।
খবর দাওনি কেন?
অপরপ্রান্ত নিরুত্তর।
কবে আসবে কাজে?
কাল যাবো বৌদি।
শিখার আসা জরুরি ছিল। রায়তী মিছিলে যাবে। মৃতা ডাক্তারের জন্য শোকমিছিল বেরোবে। শুরু হবে রাত দশটায়। কাজের চাপ পড়েছে বিস্তর। বাচ্চা দুটোকে ঘুম পাড়াতে বিস্তর বেগ পেতে হয়। শাশুড়ির দ্বারা হবে না, বরের দ্বারাও হবে না। মিছিল শুরু হয়েছিল সাড়ে দশটায়। সারা শহর হেঁটে বাড়ি ফিরল যখন, তখন রাত দেড়টা। মাথা বেশ ব্যথা।
তার পরের দিন এলো না শিখা। তার পরের দিনও না।
নাতনি হাসপাতালে ভর্তি।
রায়তীর একশো দুই জ্বর। বাচ্চাদুটো ঘ্যান ঘ্যান করছে। কেউ সামলাতে পারছে না।
টানা ছʼদিন কামাই করে শিখা এলো। নির্বিকার। কোনও হেলদোল নেই। শুধু চোখ আরো সরু। তীক্ষ্ণ।
ময়না কেমন আছে?
জ্বর কমেনি বৌদি। হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছি।
বাড়ি যাওয়ার সময় রায়তী কিছু আপেল, কলা দিয়ে দিল। চুপচাপ চলে গেল শিখা।
আবার দুদিন নেই। ফোন করেও না। ধরেও না। আনিসুলের মাও আসে না।
রায়তীর মাথায় আগুন জ্বলছে।
আবার এলো একদিন। ময়না ভালো নেই। জ্বর কমছে না। বমি।
ডাক্তার দেখাচ্ছো?
আজ নিয়ে যাবো বড় ডাক্তারের কাছে। ছেলে টোটো নিয়ে ফিরলেই যাবো।
বাচ্চাকে তার মায়ের কাছে রেখে তো কাজে আসলে পারো। দেখছো আমার কী অবস্থা।
বাচ্চার মা সব পারেনা বৌদি। খানিক আমি করে আসি। বাচ্চার মাও কাজে যায় তো। এখন নিজের মাকে আনি রেখেছি।
ডাক্তার মেয়ের মৃত্যুর প্রতিবিধান চেয়ে প্রায় রোজ মিছিল। হাসপাতাল কেন ভাঙা হল? কেন লোপাট হল প্রমাণ? মেয়েরা রাত দখল নাও।
রায়তী শ্লোগান লিখলে শাশুড়ি বলে, আমাকেও নিয়ে যাস মিছিলে। আহা, ফূটফুটে মেয়েটা মরে গেল।
শিখা আবার কামাই করলো তিনদিন।
এবার ছাড়া ওকে। শাশুড়ি বলে। অন্য লোক দেখ।
ফোনে শিখা বললো, নাতনির জন্ডিস। ঝাড়াতে নিয়ে যাব পীরের কাছে।
রাগে পিত্তি জ্বলে গেল রায়তীর।
ডাক্তার কী বলেছে?
ওষুধ তো খাওয়াচ্ছি। কিন্তু না ঝাড়ালে হবে না। পরশু থেকে আসব।
তারপর দেড়মাস। কত অপেক্ষা করা যায়? ডাক্তারের বাবা মা কাঁদছেন...টিভিতে দেখায়।
আর আসেনি শিখা। অনেক খোঁজ করে বিলের ধারে ওর বাড়িতে গেছিল একদিন রায়তী। দরজায় তালা।
শিখা তখন মেয়েদের মেসবাড়ির রান্নায়। ময়নাকে নিয়ে এসেছে ট্যাঁকে করে। সকালে বাড়িতে কেউ থাকে না। বড় ছেলে বেরিয়ে যায় টোটো নিয়ে সাতসকালে। বৌ কাজের বাড়ি ধরে সাতটায়। ছোটছেলের বৌ পেছন পাড়ায় বাপের বাড়ি চলে যায় নিজের বাচ্চাদের নিয়ে। ছোট ছেলে ঘুমায় অনেক বেলা পর্যন্ত। ময়না একাই খেলতো ঘরে বসে। একা থাকতে পারছে না আর।
শিখাও একা রাখতে পারছে না তাকে।
কাউকে বলতেও পারছে না। কাজের বাড়িতেও বলতে পারেনি বৌদিকে।
ডাক্তার বলেছে খুব সাবধানে রাখতে।
রক্তে ভাসাভাসি হয়ে পড়েছিল ময়না।
মেয়েঅঙ্গের মুখ ছিঁড়েছে নির্মমভাবে। এমন ভাবে ছিঁড়েছে যে মলদ্বারের সঙ্গে মিশে গেছে। ব্লিডিং থামাতেই ছয়দিন। কেবল তড়পাচ্ছে মেয়ে। ভয় পাচ্ছে প্রবল।
কাউকে বলা যায় না এসব কথা। দেড় দুমাস কামাই করে ফের কাজের বাড়িতে যাওয়া যায়?
আনিসুলের মা কে বলেছিল কাজে নিতে। রায়তীর শাশুড়ি রাজি হয়নি।
আনিসুলের মা এখন অনেক বুড়ো হয়েছে। বাড়ি বসে পুজোর পন্চদ্রব্য খবরের কাগজে প্যাক করে। সিঁদূর। আবির। হরিতকি। ধান। গম। মাসে চার পাঁচহাজার টাকা রোজগার হয়।
ছোট ছেলে বৌ নিয়ে চলে গেছে বাড়ি থেকে।
ময়নাকে আর চোখের আড়াল করে না শিখা।
মিছিলে গেলেও টানতে টানতে নিয়ে যায়।
যদি কোনদিন চিৎকার করতে শেখে।