গেটের বাইরে থেকে একটি মেয়ে খুব কুণ্ঠিত স্বরে ডাকল, “স্যার, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল, ভেতরে আসতে পারি?”
মর্নিং ওয়াক সেরে বাড়ির ছোট্ট বাগানে একটু ঘোরাঘুরি করা ডাক্তার অমিয় সান্যালের বহুদিনের অভ্যেস। এ সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বন্ধুরাও তাঁকে বিরক্ত করে না। সকালের এই স্নিগ্ধ আলোয় তাঁর বাগানে ফুটে থাকা উজ্জ্বল ফুলগুলির সঙ্গ তাঁর মনে অত্যন্ত শান্তির অনুভূতি এনে দেয়। কোন উটকো লোকের উপস্থিতি সেই শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাক – সেটা তিনি পছন্দ করেন না। বিরক্ত হন খুব।
ডাক্তারবাবু বিরক্ত হয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন গেটের দিকে, বিরক্ত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার?”
“কিছু কথা ছিল স্যার, যদি একটু সময় দেন কাইণ্ডলি। বেশি সময় নেব না, – দশ-পনের মিনিট”।
ওঁদের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে হেমন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। হেমন্ত ডাক্তারবাবুর পরিচারক - সর্বক্ষণের সঙ্গী। সাধক সঙ্গীতজ্ঞদের যেমন দু একজন অপরিহার্য সঙ্গতদার থাকে – হেমন্তও তাই। বারান্দায় উঠে বেতের চেয়ারে বসতে বসতে ডাক্তারবাবু হেমন্তকে বললেন, “ভেতরে আসতে বল”। হেমন্ত মেয়েটিকে ডেকে ভেতরে চলে গেল নিজের কাজে।
শান্ত ও ধীর পায়ে মেয়েটি এল। হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গী করল। ডাক্তারবাবু মুখ তুলে তাকালেন – সামনের চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন। মেয়েটি বসল। মেয়েটির পরনে সস্তা চটকদার রঙের শাড়ি। পায়ে গোলাপি রঙের বাহারি প্লাস্টিকের স্যণ্ডেল। শাড়ির আঁচলে পুরো শরীর ঢেকে মেয়েটি চেয়ারে বসেছে আলগোছে - খুব সংকোচ নিয়ে। তবুও উগ্র এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবনের আভাস পেলেন মেয়েটির শরীরী ভাষায়। ডাক্তারবাবু বললেন, “কী বলবেন বলুন”
“আমি মিতালি। কলকাতার একটি পতিতা পল্লীতে আমার বাস। আমাদের মতো মেয়েদের আপনার কাছে আসার দুঃসাহস কখনো হয়নি, হবেও না। কিন্তু বাধ্য হয়েই...”
ডাক্তারবাবু কোন উত্তর দিলেন না, তাকিয়ে রইলেন মিতালির মুখের দিকে।
মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল মিতালি, তারপর বলল, “তিন চারজন এনজিও দিদি আসেন আমাদের পাড়ায়, নিয়মিত। আমাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করেন খুব। তাঁদের মুখেই আপনার নাম শুনেছি”। মিতালি আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মুখ তুলে বলল, “আপনি নাকি বেশ কয়েক বছর ধরে মেয়েদের শরীরে অদ্ভূত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন! তাতে নাকি...”
ডাক্তার অমিয় হাত তুলে মিতালিকে থামালেন, বললেন, “তোমাদের পেশার কোন মেয়ের সঙ্গে আমার কোনদিন সেভাবে পরিচয় হয়নি, মা। কিংবা হয়তো কখনো হয়েছে, পেশেন্ট হিসেবে, বুঝতে পারিনি। নিজের সত্যি পরিচয় দিয়ে তুমি যে কথা জানতে এসেছ, সে কথা তোমাদের জানা একান্ত জরুরি। কাজেই সব কথাই তোমাকে বলব, মন দিয়ে শোনো।
বিগত বছর তিরিশ বা হয়তো তারও কিছু বছর আগে থেকে – জাতিকাদের শরীরে আশ্চর্য এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই পরিবর্তনটি প্রথম ধরা পড়ে মুর্শিদাবাদ সদর হাসপাতালে। সেখানে একটি ছবছরের বালিকাকে রাতের অন্ধকারে কেউ বা কারা ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল। পরদিন সকালে সেই বালিকার দেহ উদ্ধার হলেও অপরাধীদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। পুলিশ জোর তদন্ত শুরু করেছিল এবং স্থানীয় নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, অপরাধী অচিরেই ধরা পড়বে, আইন আইনের পথেই চলবে। আইনের হাত থেকে কেউ রক্ষা পাবে না।
এদিকে ওই দিন দুপুরের দিকে হাসপাতালে জনৈক মধ্যবয়সী পুরুষকে তার বাড়ির লোক গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে আসে। আচ্ছন্ন অবস্থায় আনা ভদ্রলোকের অসুস্থতার প্রধান লক্ষণ ছিল তীব্র শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ এবং অনিয়মিত হার্টবিট। অ্যাডমিশনের সঙ্গে সঙ্গেই অক্সিজেন এবং স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ব্লাড টেস্টের ব্যবস্থা হল, ইসিজির ব্যবস্থাও করা হল। তারপর থরো চেকআপ করতে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোকের দু হাতে এবং কোমর থেকে নিম্নাঙ্গে – দুই পায়ে, উরুতে এবং বিশেষ করে দুদিকেরই ইনগুইনাল রিজিয়নে সিভিয়ার ইনফ্লামেশন রয়েছে। ইনগুইনাল রিজিয়ন হল বাংলায় যাকে আমরা উরুসন্ধি বা কুঁচকি বলি। আর ইনফ্লামেশন মানে প্রদাহ, তার মানে কী বলব - গভীর লাল রঙের দাগড়া-দাগড়া হয়ে সামান্য ফুলে উঠেছে জায়গাগুলো। আমাদের চামড়ায় পোকা-টোকার কামড়ে বা বিষাক্ত রস লেগে গেলে, যেমন হয় আর কি!
তখন আমার বয়েস বিয়াল্লিশ। ততদিনে আমার প্রায় সতের বছরের ওপর প্র্যাকটিসিং এক্সপিরিয়েন্স হয়ে গেছে – কিন্তু এরকম অ্যাকিউট ইনফ্লামেশন আগে কোনদিন দেখিনি। তারপরে আরো দেখলাম, লোকটির বুকে কাঁধে বেশ কিছু নখের আঁচড়ের ক্ষত – সেই ক্ষতগুলো ঘিরেও একই ধরনের ইনফ্লামেশন!
যাই হোক আমাদের মেডিক্যাল বিদ্যে-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা দিয়ে যথাসাধ্য চিকিৎসা শুরু করলাম – কিন্তু লোকটির কণ্ডিশন খারাপ হতে লাগল দ্রুত – রাত্রে যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা। শেষ অব্দি রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ লোকটি হার্ট ফেল করল – মারা গেল। পরিবারের লোকজনকে মৃত্যু সংবাদ দেওয়া মাত্র তারা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, আমাদের গাফিলতিতে তাদের পরমপূজ্য পিতৃদেবের মৃত্যু হয়েছে। দুজন জুনিয়ার ডাক্তার এবং একজন নার্সকে মারধর করল। আমার ভাগ্য ভালো – কেউ গায়ে হাত তোলেনি। তবে অশ্রাব্য গালাগালিতে আমার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দিয়েছিল। ভাঙচুর করেছিল বেশ কিছু চেয়ার টেবিল – ছিঁড়েখুঁড়ে নষ্ট করে দিয়েছিল বেশ কিছু ফাইল। ওরা চলে যাওয়ার প্রায় আধঘন্টা পরে পুলিশ এসেছিল পরিস্থিতি সামাল দিতে।
পরের দিন সকালে দুটি দেহেরই পোস্টমর্টেম হল। আমাদের কাছে যা রিপোর্ট এল – ওই লোকটিই বালিকা অভয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল। লোকটি ছিল মেয়েটির প্রতিবেশী – অতি পরিচিত জ্যেঠুমণি...। তবে আমাদের কাছে রিপোর্ট যাই আসুক – পরে সে রিপোর্ট বদলে দেওয়া হয়েছিল, কারণ ওই লোকটির রাজনৈতিক মহলে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। এবং যেহেতু অসহায় অভয়া এবং তার ধর্ষক লোকটি দুজনেরই মৃত্যু হয়েছিল, অতএব এ নিয়ে আমরাও কোন উচ্চবাচ্য করে জলঘোলা করাটা সমীচীন মনে করিনি।
তবে আমাদের কাছে লোকটির ব্লাড স্যাম্পল ছিল। ছিল মেয়েটির রক্তের নমুনাও। মেয়েটির রক্তে অস্বাভাবিক কিছু না পাওয়া গেলেও, লোকটির রক্তে পাওয়া গেল যথেষ্ট পরিমাণের বিষ, এবং তীব্র মাত্রার সেই বিষের কারণেই যে তার মৃত্যু হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। গোটা বিষয়টিই তখন গোপন রাখা হয়েছিল। আমাদের মধ্যে যে কয়েকজন জানতাম, অবাক হয়েছিলাম - লোকটির শরীরে এত পরিমাণে বিষ এল কোথা থেকে? তার ভিসেরার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কিন্তু কোন বিষের উল্লেখ ছিল না। তার মানে খাবার বা পানীয়ের সঙ্গে নয়, এ বিষ তার শরীরে ঢুকেছে সরাসরি রক্তে। বিষধর সাপের ছোবল থেকে আমাদের শরীরে যেভাবে বিষ রক্তে মেশে – হয়তো সেইভাবে। কিন্তু লোকটির কাঁধে ও পিঠে কিছু নখের আঁচড় ছিল। কিন্তু লোকটির নিম্নাঙ্গে সে ধরনের কোন ক্ষত চিহ্ন ছিল না। অথচ লোকটির অ্যাকিউট ইনফ্লামেশন ছিল দুই উরু এবং উরুসন্ধিতে। কেন? কী করে হল? ঠিক বোঝা গেল না। ব্লাড-স্যাম্পল থেকে যে বিষ পাওয়া গেল, তার অ্যানালিসিস করে দেখা গেল – এ ধরনের বিষ এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
অতএব একটা প্রশ্ন রয়েই গেল, এই বিশেষ ধরনের বিষটি লোকটির শরীরে কোথা থেকে এল?
আমরা অন্যান্য হাসপাতালের আরএমও এবং সুপারদেরকে এই বিষয়টি গোপনে কিন্তু সবিস্তারে জানালাম। প্রথমে কেউই বিশ্বাস করেননি, বরং আমাদের বিদ্রূপ করেছিল, বলেছিল আমাদের মাথা থেকে এসব উদ্ভট আইডিয়া মুছে ফেলতে।
এই ঘটনার কিছু দিন পরেই মেদিনীপুর হাসপাতাল থেকে বারো বছরের এক কিশোরী অভয়ার শ্লীলতাহানির সংবাদ এল। অপরাধী পুরুষটির বয়স ছিল বত্রিশ। মেয়েটিকে সে একটি নির্জন বাড়িতে নিয়ে যায় এবং জোর করে তাকে বিবস্ত্র করার পর, ঘটনাস্থলেই লোকটি অজ্ঞান হয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে মেয়েটি সেখান থেকে বাড়িতে পালিয়ে আসে। মেয়েটিকে নিয়ে তার পরিবারের লোক প্রথমে থানায় যায় এবং পরে মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি হয়। মেয়েটির বয়ান অনুযায়ী পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধীকে যখন গ্রেপ্তার করে, লোকটির তখনও জ্ঞান ফেরেনি। অতএব তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ক্ষেত্রেও অপরাধী যুবকটির হাতে, পায়ে, গালে, গলায় একই ধরনের ইনফ্লামেশন – লোকটির সেরে উঠতে সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিনমাস। বিচারে লোকটির পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।
আমাদের দেশে ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির ঘটনা যেহেতু সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে, অতএব এর পরেও বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে একই ধরনের ঘটনার প্রচুর সংবাদ আসতে লাগল। সৌভাগ্যক্রমে ভিকটিম কন্যাদের কেউই ধর্ষিত হয়নি – তার কারণ অপরাধীদের বিবেকবোধ নয়। তার কারণ অপরাধীরা তীব্র বিষক্রিয়ায় ঘায়েল হয়ে মেয়েগুলিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
যাই হোক আমার এই কৌতূহল এবং সত্য সন্ধানের প্রচেষ্টা আমার ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষদের পছন্দ হয়নি। সে কারণে আমার ওপর বাড়তে থাকে প্রশাসনিক চাপ এবং কর্মস্থলে কিছু সহকর্মীদের চরম অসহযোগিতা। যারা প্রশাসনের খুব কাছের লোক এবং আমড়াগাছি করে নানান সুযোগ সুবিধা উপভোগ করে”।
“আশ্চর্য! আপনি তো কোন অন্যায় করেননি। একটা অদ্ভূত অসুখের রহস্য খুঁজে বের করতে চাইছিলেন। তাতে ওদের আপত্তি কিসের?”
“কোন অন্যায় না করাটাই যে আজকের যুগে সবচেয়ে বড়ো অন্যায়, জানো না? সে যাগ্গে, আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে এলাম – একটি প্রাইভেট হাসপাতালে যোগ দিলাম – তার সঙ্গে ব্যক্তিগত চেম্বারে প্র্যাকটিস শুরু করলাম। প্রাইভেট হাসপাতালে সাধারণতঃ ধর্ষণের কেস নিয়ে কেউ আসে না, কাজেই এই বিষয়টা নিয়ে আরো গবেষণা করার কোন উপায় আমার রইল না।
কিন্তু কলকাতায় স্থিতু হওয়ার কয়েক মাস পরে – একদিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ আমার চেম্বারে এক দম্পতি এলেন। ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়েই আমি চমকে উঠলাম। লক্ষ্য করলাম তাঁর দু হাতের দিকেও এবং নিশ্চিত হলাম – আমার অনুমান সঠিক। ভদ্রলোক কি কোন মেয়ে বা মহিলার সঙ্গে জোরজবরদস্তি করতে গিয়েছিলেন?
কৌতূহল নিয়ে আমি আলাপ শুরু করলাম, চিকিৎসার ব্যাপারে নয়, ওঁর পারিবারিক অবস্থা জানার জন্য। ভদ্রলোক ও মহিলা দুজনেই ভালো চাকরি করেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে নামী স্কুলে লেখাপড়া করে – অর্থাৎ উচ্চবিত্ত সুখী পরিবার।
ভদ্রলোকের চিকিৎসার প্রসঙ্গ আসতে, আমি বললাম, ওঁনার চিকিৎসা এই চেম্বারে হওয়া সম্ভব নয়। ওঁনাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। সকাল সাড়ে দশটা-এগারোটা নাগাদ আমি যে প্রাইভেট হাসপাতালে বসি – সেখানে নিয়ে আসবেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভর্তি করে নেব। তবে আমার কিছু প্রশ্ন আছে, কোনরকম সঙ্কোচ না করে, নির্দ্বিধায় বলতে হবে – আমরা ছাড়া অন্য কেউ সে কথা জানবে না বা শুনবে না, কথা দিচ্ছি।
ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিক কখন থেকে এই উপসর্গ দেখা গিয়েছে? মহিলা বললেন, গতকাল মাঝরাতে।
আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মাঝরাতে? তখন আপনার স্বামী কোথায় ছিলেন?
কেন? বাড়িতে। আমাদের বেড রুমে! ডিনারের পর – ছেলেমেয়েরা তাদের ঘরে শুয়ে পড়েছে কিনা দেখে, আমরা রোজ যেমন বেডরুমে যাই।
তারপর কী হয়েছিল?
মহিলা বেশ একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, তার মানে? আপনি এবার কিন্তু আমাদের প্রিভেসিতে ইন্টারফিয়ার করছেন?
আমি খুব শান্ত স্বরেই বললাম, একটি ম্যারেড কাপল্ রাত্রে তাদের বেডরুমে স্বাভাবিক অবস্থায় কী করে সে কথা আমি জানি, ম্যাডাম। কিন্তু তাও জানতে চাইছি, কারণ তাতে আপনার হাজব্যাণ্ডের অসুখটা বুঝতে এবং সারাতে আমার সুবিধা হবে।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর, মহিলা বললেন, আমি কাল খুব টায়ার্ড ফিল করছিলাম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চাইছিলাম। ওকে আমি সেটা বললামও – জেনারালি ও খুব এমপ্যাথেটিক, কিন্তু সামহাউ কাল ও রেস্টলেস হয়ে উঠেছিল – আমি বারবার আপত্তি করা সত্ত্বেও জোর করছিল। তার কিছু পরেই যন্ত্রণায় ও কেমন যেন কুঁকড়ে গেল এবং ওর শরীরে ওই সিমটমগুলো ফুটে উঠতে লাগল। এরপর কাল সারারাত আমরা আর ঘুমোতে পারিনি...।
আমি মহিলাকে থামিয়ে বললাম, আর আমার কিছু শোনার নেই ম্যাডাম। এধরনের কেস এর আগেও অনেকগুলো হ্যাণ্ডল করেছি। কিন্তু সেগুলোর ভিকটিম ছিল রেপিস্ট পুরুষরা। তাই আপনার হাজব্যাণ্ডের সিমটম দেখে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। সুখী দাম্পত্যের মধ্যেও যে এমন ঘটতে পারে...। হাসপাতালে চলে আসুন – আর আমি এক্সপেক্ট করব, আপনিও আমাকে পূর্ণ কোঅপারেট করবেন, ম্যাডাম। যদি করেন, আমাদের চিকিৎসা শাস্ত্রে একটা নতুন অধ্যায় লেখা হতে পারে।
“মহিলা কোঅপারেট করেছিলেন”?
করেছিলেন বৈকি! তার পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে এই রহস্যভেদ সম্ভবই হত না। ওদের পরিবার এখন আমাদের একান্ত আপনজন। সম্পর্কে অনেকদিনই আমি মেয়েটির কাকু হয়ে গেছি। ভাইঝি, জামাই, নাতি-নাতনী নিয়ে আমার পরিবার এখন অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে”।
“কী জানতে পারলেন”?
“আমরা প্রকৃতিকে যতই জয় করতে চাই না কেন – প্রকৃতি তার বিবর্তনের কাজ ঠিকই চালিয়ে যায় – ধীরে ধীরে। প্রথম থেকেই অপরাধীদের ইনফ্লেমড স্কিন-স্যাম্পলের মাইক্রোস্কোপিক টেস্ট করে দেখছিলাম – খুব সূক্ষ্ম - খালি চোখে দেখা যায় না – স্কিনের মধ্যে অজস্র রোঁয়া ফুটে আছে, যার বায়োলজিক্যাল টার্ম সেটা (seta), প্লুরালে সেটাই বা সেটি (setae)। ইন ফ্যাক্ট যেখানে যেখানে ওই সেটি ঢুকেছে – সেখানেই দেখা দিয়েছে ইনফ্লামেশন।
শুঁয়োপোকার গায়ে প্রায়ই এধরনের সেটি থাকে। কেন থাকে? শুঁয়োপোকাদের অনেক শত্রু – তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। এমনকি তুলনায় আমাদের মতো অনেক বড়ো চেহারার প্রাণীদের গায়েও সেই সেটি বিঁধলে আমাদের অস্বস্তি হয়, চুলকায় – লাল হয়ে ছোটখাটো ইনফ্লামেশন হয়, তাই না? শুঁয়োপোকার সেটি সূক্ষ্ম হলেও চোখে দেখা যায়। কিন্তু ওই স্কিন স্যাম্পলে পাওয়া সেটি তার থেকেও বহুগুণ বেশি সূক্ষ্ম এবং অনেক বেশি বিষাক্ত।
এই সেটি বা রোঁয়া এল কোথা থেকে – সেটা বুঝতে পারছিলাম না। এই মেয়েটি সাহায্য করাতে সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেল।
কবে থেকে শুরু হয়েছে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় – তবে বেশ কিছু বছর ধরে – হয়তো তিরিশ বা তারও বেশি বছর আগে থেকেই মেয়েদের শরীরে আশ্চর্য এই বিবর্তন শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক রোমের পাশাপাশি, মেয়েদের শরীরে জন্ম থেকেই প্রায় অদৃশ্য এই সেটির সৃষ্টি হচ্ছে। ওই মেয়েটিকে পরীক্ষা করেই বুঝতে পারি – আপত্তি সত্ত্বেও ওর হাজব্যাণ্ড যখন মেয়েটিকে আদর করতে শুরু করে – যেখানে যেখানে স্পর্শ করেছে – গালে, গলায় বা ঘাড়ে চুমো দিয়েছে, পেটে পিঠে হাত বুলিয়েছে – ওই অঞ্চলের সেটি বিষ নিয়ে ঢুকেছে স্বামীর ঠোঁটে, গালে, দুই হাতে...। মেয়েটির শরীরে ওই জায়গাগুলি ছাড়া সর্বত্র ওই সেটি অক্ষত ছিল, যেখানে যেখানে স্বামী স্পর্শ করেছে - ছিল না শুধু সেই জায়গাগুলিতে। মনে হয়েছিল, ওই জায়গাগুলো তো তার মানে রোঁয়াবিহীন হয়ে গেল। ওগুলো আবার কি গ্রো করবে, নাকি ন্যাড়া হয়েই থেকে যাবে আজীবন? হ্যাঁ গ্রো করেছিল। দিন পনের পর মেয়েটিকে আবার যখন পরীক্ষা করি – দেখলাম কোন জায়গাই আর শূণ্য নেই – ভরে উঠেছে নতুন সেটিতে।
“কিন্তু এরকম ঘটতে থাকলে পরিস্থিতি তো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। মানুষ প্রেম করতে কিংবা ভালোবাসতে ভয় পাবে! সন্তান-সন্ততি না আসলে – রুদ্ধ হয়ে যাবে মানবজাতির প্রবাহ”!
“একদমই না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারো - সে রকম হওয়ার কোন কারণই নেই। ব্যাপারটা ঠিক কী ভাবে ঘটছে তোমাকে বলি। আমরা অনেকদিন ধরেই ব্যাড টাচ এবং গুড টাচ কি, জানি। ছোটদের স্কুলে অনেকদিন ধরেই তো এ নিয়ে সচেতন করা শুরু হয়েছে। এখানেও প্রাইম ফ্যাক্টর হচ্ছে ওই ব্যাড টাচ আর গুড টাচ। ছেলে মাকে, বাবা মেয়েকে কিংবা ভাই বোনকে, এমনকি সাধারণ ছেলেবন্ধুরাও কোন মেয়েবন্ধুকে স্বাভাবিক স্পর্শ করলে এই সেটি রিঅ্যাক্ট করে না। অর্থাৎ যাদের স্পর্শে মেয়েটির অস্বস্তি হয় না, সেক্ষেত্রে এই সেটি নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু যখনই শরীরে অস্বস্তিকর এবং অবাঞ্ছিত স্পর্শ লাগে, তখনই মেয়েটির শরীর অ্যালার্ট হতে থাকে এবং এই রোঁয়াগুলি অ্যাক্টিভ হতে থাকে। এবার যদি সেই ব্যক্তি ধর্ষক হয় – তার স্পর্শে মেয়েটির মনে যখন হিংস্র ঘৃণা ও ভয়ের সৃষ্টি হয় – এই রোঁয়াগুলিও তখন তীব্র বিষ প্রয়োগের জন্যে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। বিষের প্রাথমিক সঞ্চারেও যদি নরাধম পুরুষটি ক্ষান্ত না হয়, যদি সে মেয়েটির কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে গায়ের জোরে উপগত হওয়ার চেষ্টা করে – বিষক্রিয়ায় সেই নরাধম জ্ঞান হারাবে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে তার মৃত্যু অবধারিত। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে উরু, উরুসন্ধি এবং উপস্থের চারপাশে রোমের যেমন আধিক্য থাকে, তেমনই আধিক্য থাকে সেটিরও – সেই তীব্র বিষক্রিয়ার চিকিৎসা আমরা করতে পারিনি। তবে শিশু কিংবা বালিকারা এই ধরনের নরাধমের শিকার হলে, খুব স্বাভাবিক কারণেই বিষের তীব্রতা কম হয় – কারণ তাদের শরীরে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো রোমের উন্মেষ তো আর হয় না। তবে আমার বিশ্বাস, যে হারে বালিকা নির্যাতন হচ্ছে, তাদের রক্ষার্থে, কোনদিন প্রকৃতি হয়তো তাদের শরীরও ওই সূক্ষ্ম রোমে ঢেকে দেবে।
“আপনি বললেন, তীব্র বিষক্রিয়ার চিকিৎসা আপনারা করতে পারেননি। কেন, সেটা কি ইচ্ছাকৃত”?
“হতে পারে। এর বিরুদ্ধে কিছু একটা করতেই হবে – এমন উৎসাহ হয়তো আমাদের মনে জাগছে না। অন্ততঃ আমার মনে তো নয়ই। তার কারণ, প্রথমত, পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে আদালতের বিচার যে ভাবে বারবার প্রহসনে পরিণত হয় সে তো আমরা দেখেছি। সেক্ষেত্রে প্রকৃতির বিচারকে মেনে নিলে ক্ষতি কী? প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের মৃত্যু হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্প, ঝড়, সুনামিতে তো এক সঙ্গে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সে মৃত্যুর বিচার নিয়ে আমরা তো কখনো ভাবিত হই না? তাহলে মেয়েদের ওপরে ঘটে চলা কদর্য অপরাধের প্রতিকারের জন্য, সহজাত বিচারের ব্যবস্থা দিয়েই প্রকৃতি যদি মেয়েদের সৃষ্টি করে, সে বিচারকে বাধা দেব কেন?
এবং দ্বিতীয়ত, এই নিয়ে কোন গবেষণাই এখনো শুরু হয়নি। বিশেষ কোন হরমোনের কারণে মেয়েদের শরীরে এই সূক্ষ্ম রোঁয়াগুলি আসছে। কী ভাবে ওই বিষ তাদের শরীরে তৈরি হচ্ছে, এবং কী ভাবেই বা সেই বিষ সঠিক মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিটি রোমে রোমে – সে তথ্য আমাদের কাছে তো নেই। সাধারণ বিষক্রিয়ায় আমরা শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানোর চিকিৎসা করি, তীব্র বিষের ক্ষেত্রে অ্যান্টিভেনাম অ্যাপ্লাই করি। স্বল্প বিষের নিরাময় এখনও সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু বিষের মাত্রা বাড়লে তার প্রতিষেধক দরকার। তার জন্যে প্রয়োজন দীর্ঘ গবেষণার সুযোগ। সে সুযোগ আর দিচ্ছে কে?
তবে আমি মনে করি, প্রতিষেধক যতদিন না বেরোয় ততদিন মেয়েদের পক্ষেই মঙ্গল – চরম বিপর্যয় থেকে বহু মেয়েই পরিত্রাণ পেয়ে যাচ্ছে। এরকম ক্ষেত্রে আগে কী হতো? তদন্ত করা। প্রমাণ যোগাড় করা। সাক্ষী যোগাড় করা। মাসের পর মাস ধরে অভিযুক্তদের বয়ান - সাক্ষীদের বয়ান। সামনাসামনি বসিয়ে একসঙ্গে বয়ান। তদন্তকারীদের গোপন রিপোর্ট পড়ে বিচারপতিদের চমকে চমকে ওঠা। এত সবের পরেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে জামিন বা বেকসুর খালাস পেয়ে যাওয়া...। ফালতু এত সাতকাহনের দরকারই নেই... যেমন কর্ম তেমন ফল, একেবারে হাতেহাতে সাজা পেয়ে যাচ্ছে কালপ্রিটগুলো। বাড়াবাড়ি করলে হাতে পেয়ে যাচ্ছে যমের বাড়ির কনফার্মড টিকিটও!
এই মৃত্যু নিয়ে কোন বিতর্কও উঠবে না। কেউ বলবে না – প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে ফাঁসানো হয়েছে। কেউ বলবে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রেপ আটকানো যায়নি - যাবে না। এই সমস্যার সমাধান মৃত্যুদণ্ড হতে পারে না। সমস্যার সমাধানটা কি জিজ্ঞাসা করলে বলবে – সর্বস্তরে শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এদিকে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই লাটে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে সকল রকমের প্রচেষ্টা চলছে, অত্যন্ত আন্তরিকভাবে”।
“কিন্তু বিষয়টা গণ-মাধ্যমে প্রচার করে সকলকে সচেতন করা হচ্ছে না কেন? তাতে তো ছেলেরা ভয় পাবে, এরকম অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। মেয়েরাও নিশ্চিন্ত হতে পারবে”।
“তাই হয় নাকি? যারা দেশ চালায়, তারা সব কথা সবার কাছে বলবে কেন? দুরন্ত, দামাল সব মানুষগুলো, গণতন্ত্রের চেয়ারগুলোকে অক্টোপাসের মতো ধরে রাখার জন্যে, কত কত ভালো ভালো কাজ করছে নিত্যদিন, তারা দু-একদিন যদি কোন দুষ্টুমি করেই ফেলে – সেটাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখাই গণতান্ত্রিক দেশের নেতাদের কর্তব্য বৈকি। তাদের ভয় দেখিয়ে মেয়েদের নিশ্চিন্ত করবে, কোন আহাম্মক? কিন্তু তোমাদের এ বিষয়ে কৌতূহল কেন?”
“আমরা যে সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি, স্যার”।
“ক্ষতি? কিসের ক্ষতি?”
“আমাদের পেশায় পুরুষ নিয়ে কোন বাছবিচার তো করা চলে না, স্যার। সেখানে গুডটাচ-ব্যাডটাচ - যেমন আপনি বললেন, সেই বিলাসিতাও আমাদের করা চলে না। অতএব আমাদের ইচ্ছায় – অনিচ্ছায় পুরুষের হাতে শরীর মেলে ধরতেই হয়। কিন্তু মন তো নির্বিকার থাকে না, থাকতে পারে না, স্যার – তাতে পুরুষরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যারা নিয়মিত আসত, তারা প্রথম প্রথম দু-চারবার বুঝতে পারেনি, কিন্তু পরে তারাও বুঝতে পারছে। তারা আমাদের পাড়ায় আসা বন্ধ করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা খাব কি”?
ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ কোন কথা বললেন না, তাকিয়ে রইলেন তাঁর বাগানের দিকে। প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা প্রতিটি জীবন – গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি...। সভ্য মানুষ, সভ্যতার শুরু থেকেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে প্রতিদিন। এই সভ্যতাই একদিকে সৃষ্টি করেছে ধর্ষণ, অন্য দিকে এই মেয়েটির পেশা।
কিছুক্ষণ পর তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাকে এই কাজ ছেড়ে অন্য কোন কাজ করার উপদেশ দেওয়া অর্থহীন। কারণ সভ্য সমাজ তোমাকে কখনোই স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজই করতে হবে। তোমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাও, মা। দেখি কোন ওষুধ খুঁজে পাই কি না – যে ওষুধে কিছুক্ষণের জন্যে অসাড় হয়ে থাকবে তোমার মন। সে ওষুধ কতখানি ক্ষতি করবে তোমার শরীরের – সেটাও বুঝতে হবে। শরীরের সাংঘাতিক ক্ষতি স্বীকার করেও বহু কর্মীকে যেমন কাজ করে যেতে হয়, হয়তো তোমাকেও...”।
কথা শেষ করলেন না ডাক্তারবাবু মাথা নাড়তে লাগলেন আপন মনে। একটু পরে আবার বললেন, “আমরাই নির্বাচিত করি যে জনপ্রতিনিধিদের তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। সেই প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা ব্যর্থ বিচার-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলা যাবে না। বললেই ভয়ানক ক্ষতি। তার থেকে প্রকৃতির বিরুদ্ধেই যাওয়াই সমীচীন, সে ক্ষতিটা, যদিও অমোঘ, আসে ধীরে ধীরে। তবে ক্ষতি দুদিকেই – রাম মারুক কিংবা রাবণ – আমরা যে মারীচ”।