১
“কাঁদিস না, পাখি। কাঁদিস না। লোকজন কী ভাবছে বল তো?” আশে পাশে লোকজনের দিকে তাকিয়ে বিশু বলল।
“কী আবার ভাবছে? যা ভাবছে ভাবুক। তুমি কী কিছু ভেবেছো আমাদের জন্যে? ভাবলে এমন করতে পারতে?”
“অবুঝ হোস না, মা। মন দিয়ে কথাটা শোন। তোদের জন্যে ভেবেছি বলেই, অন্য পথে যাইনি। কী করবো বল? মাতারা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাজটা চলে যাবার পর ভদ্রস্থ কোন কাজ পেলাম না যে। কম চেষ্টা করেছি? চুরি চামারি করতে তো যাইনি! সেটা করলে খুব ভালো হত বুঝি?”
“তাই বলে, তুমি এভাবে আমাদের ছোট করলে, বাবা? কাজ না হয় নাই করতে! আমি স্কুল ছেড়ে দিতাম। মা আর আমি মিলে কিছু একটা কাজ ঠিক জোগাড় করে নিতাম। কিন্তু আমরা জানলে এমন কক্ষণো করতে দিতাম না। কক্খনো না। সংসারটা ঠিক চালিয়ে নিতাম”।
“অতই সহজ নয় রে, মা। জোয়ান বাপ বেকার ঘরে বসে থাকবে, আর আমার বাচ্চা মেয়েটা লেখাপড়া ছেড়ে কাজে বেরোবে? নে নে সেই থেকে খুব ধমকাচ্ছিস আমাকে। ধমক খেয়ে কী আর পেট ভরে রে? খুব খিদে পেয়েছে। তোর পায়নি? চল দুজনে মিলে আজ পেট ভরে ভাত খাই”।
“তুমি খাও। আমি খাবো না। আমার খিদে নেই”।
“অ। তাই বুঝি? তাহলে আমারও খিদে নেই। চল তাহলে ওই পার্কের ভেতর ছায়া দেখে বসে একটু জিরিয়ে নিই”।
“সত্যি বলছি, আমার খিদে নেই। তুমি খাও না”। বিশুর চোখের কোণে মায়াবি স্নেহের হাসি, সে বলল, “তুই সত্যি বলছিস আর আমি মিথ্যে বলছি নাকি? আমারও তো খিদে নেই। তোর জন্যেই বলছিলাম”। পাখি এবার ফিক করে হেসে ফেলল। তার চোখের কোলে এখনো জলের বিন্দু, কিন্তু মুখের বিষণ্ণভাব অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে, বলল, “আচ্ছা চলো, আমারও খিদে পেয়েছে।”
“আমারও”। বিশুও হেসে ফেলে বলল। দুজনে মিলে ভাতের হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বিশু বলল, “এদিকে কোথায় এসেছিলি। বাড়িতে বলিসনি তো!”
“অণিমাদি হঠাৎ খবর দিল, বলল একটা চাকরির সন্ধান আছে। এখনই ইন্টারভিউ দিয়ে যা”।
“ওঃ তাই? ইন্টারভিউ দিলি? কেমন হল?”
“হয়ে গেছে”। অবাক হয়ে বিশু মেয়ের মুখের দিকে তাকাল, বলল, “কী হয়ে গেছে? চাকরি?”
“হ্যাঁগো, হ্যাঁ”
“সে কথাটা এতক্ষণ বলিসনি? উল্টে আমাকে খালি বকেই যাচ্ছিস, সেই থেকে? কাজটা কী?”
“বেরিয়ে এসে এমন আনন্দ হচ্ছিল, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। তারপর তোমাকে এ অবস্থায় দেখেই তো মাথা গরম হয়ে গেল”।
“আচ্ছা, আচ্ছা। সে না হয় হয়েছে। কিন্তু কাজটা কী, সেটা বললি নাতো?”
“রিসেপসনিস্ট। মাইনে কত জানো?”
“কতো?”
“চোদ্দ হাজার। তার ওপর পঞ্চাশটাকা করে ডেলি টিফিন অ্যালাউন্স। তাছাড়া পিএফ, গ্র্যাচুইটি, ইএসআই”।
ফুটপাথের ধারে লোকনাথ পাইস হোটেলের সামনে এসে গিয়েছিল ওরা। বিশু টেবিলের ওপর থেকে জগ তুলে মেয়ের হাতে দিতে দিতে বলল, “এখন ওসব কথা থাক, খেয়ে নিয়ে পার্কে বসে, তোর সব কথা শুনবো। যা মুখে চোখে একটু জল দে, হাতটাও ধুয়ে আয়”। মেয়ের পর বিশু নিজেও মুখ হাত ধুয়ে একটা বেঞ্চে বসল। কোলের কাছে ক্রাচদুটো খাড়া করে রেখে, তার পাশের জায়গায় হাতের চাপড়ে ধুলো ঝেড়ে, সে মেয়েকে বলল, “আয়, বোস”।
ওরা বেঞ্চে বসতেই লোকনাথ পাইস হোটেলের পৃথুলা মাসি দুটো থালা নিয়ে এসে, ওদের সামনে রাখল। পাখি দেখল, গোটা থালায় ছড়িয়ে দেওয়া অনেকটা ভাত, তার ওপরেই একপাশে এক টুকরো লেবু, পেঁয়াজ, একটা কাঁচালংকা। আরেক পাশে একটু আলুভাজা। থালা দুটো ওদের সামনে ঠক ঠক করে নামিয়ে দিয়ে মহিলা চলে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার ফিরে এল, বড়ো একটা থালায়, চারটে বাটি নিয়ে। দুটো করে বাটি ঠক ঠক করে নামিয়ে রাখল ওদের দুজনের থালার পাশে। একটায় ডাল, আরেকটায় পাঁচমিশালি তরকারি।
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিশু বলল, “নে শুরু কর। আর কী নিবি? মাছ না মাংস? মাংসই বলি, কী বল? দুটো হাফপ্লেট নিলে দিব্যি হয়ে যাবে”। ভাতের মধ্যে ডাল ঢেলে পাখি আলুভাজা দিয়ে খাওয়া শুরু করে, মাথা নেড়ে সম্মতি দিল, “মাংসই বলো। চিকেন তো?”
“হ্যাঁ, চিকেন। খাসি এরা বানায় না বোধহয়। দিদি এদিকে দুটো হাফপ্লেট মাংস দিও তো!”
মহিলা এখন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে অন্য খদ্দেরের টাকা পয়সার হিসেব করছিল, টাকা গুনতে গুনতে বলল, “ও বিলু, আজ কোনদিকে সুয্যি উঠেছে রে? ল্যাংড়া-বিশু মাংস চাইছে! আমার হাত জোড়া, দিয়ে আয় তো বাবা, দুটো হাফপ্লেট”। কথাটা বিশু আর তার মেয়ে পাখি দুজনেই শুনল। বিশু দেখল, মেয়ের মুখটা লজ্জায় অপমানে এতটুকু হয়ে গেল। তার দু চোখ আবার জলে ভরে উঠল, ভাতের থালায় টপটপ করে ঝরতে লাগল তার অশ্রু। বিলু বলে ছেলেটা দু হাতে দুটো প্লেট নিয়ে এসে নামিয়ে দিল ওদের থালার পাশে। পাখি মুখ নিচু করে রইল, লাল টুকটুকে ঝোলের মধ্যে ভেসে থাকা দু পিস মাংস আর আলুর মস্তো টুকরোটার দিকে তাকিয়েও দেখল না।
আনন্দ করে খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেল বিশুর। সে জানে মেয়ে এরপরে আর কিছুই খাবে না। খেলও না। থালার মধ্যে ভাত নাড়াচাড়া করে, সময় কাটাল, যতক্ষণ বিশুর খাওয়া না শেষ হয়। বিশু কিছু বলল না। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতেও তার ভরসা হল না।
হাতমুখ ধুয়ে, খাবারের দাম মিটিয়ে, বিশু বেঞ্চের পাশে খাড়া করে রাখা ক্রাচদুটো নিয়ে মেয়েকে বলল, “চ”। ওরা ফুটপাথ থেকে যখন নেমে আসছে, মহিলার খড়খড়ে গলা শুনতে পেল, “সে কী রে বিলু? মাংসের বাটিতে হাতই দেয় নি? আমাদের মাংস রান্না পছন্দ হবে কেন, জমিদারের দুলালী কী না?”
২
পার্কের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বিশু মেয়েকে জিগ্যেস করল, “বাড়ি যাবি কখন?”
“দেরি আছে। সাতটার সময় অফিসে আবার যেতে বলেছে”।
“সাতটার সময়? অফিস তখনও খোলা থাকবে?”
“বললো তো। বড়ো সায়েব নাকি নেই, ছটা-সাড়ে ছটায় আসবেন। তিনি এসে সই করলে, আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে দেবে”।
“ও। তা সে ভালই হবে। আজ তাহলে একসঙ্গেই ফিরবো”।
“আমি তোমার সঙ্গে ফিরবো না, বাবা”।
মেয়ের পাথরের মতো কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলল, “আচ্ছা রে মা, আচ্ছা। আর রাগ করে থাকিস না। আমি পা খুলে সোজাই হাঁটবো, হয়েছে?”
বিশু মেয়েকে নিয়ে মস্ত একটা নিমগাছের নিচে বসল। ক্রাচদুটো পাশে শুইয়ে রাখল। তারপর বাঁপায়ের লতপতে প্যান্টের পা গুটিয়ে তুলল উরু অব্দি। পাখি দেখল, হাঁটু থেকে পাটা ভাঁজ করে, খুব শক্ত করে বাঁধা দাবনার সঙ্গে।
“তুই একটু বোস। আমি আসছি”। বিশু পাছা ঘষটে নিমগাছের মোটা গুঁড়ির আড়ালে চলে গেল। সেখানে মাটিতে বসে প্যান্ট খুলে ফেলল, এখন তার পরনে শুধু আণ্ডারওয়্যার! তারপর দাবনার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা পাটা খুলে নিল। তারপর আবার প্যান্টটা পরে নিল। এতক্ষণ শক্ত করে বাঁধা আড়ষ্ট পায়ের আড় ভাঙতে ভাঙতে, সে হেঁটে এসে বসল মেয়ের পাশে। হাসতে হাসতে বলল, “নে এবার হয়েছে? আর তো তোর বাবা ল্যাংড়া নয়?”
মাঠের অন্য দিকে চারপাঁচটা শালিকের ঝগড়া দেখতে দেখতে পাখি বলল, “আর কী হবে? মুখ যা পোড়ার সে তো পুড়িয়েই দিয়েছ! আচ্ছা বাবা, এ কাজে নামার আগে আমাদের কথা তোমার একবারও মনে হল না”?
বিশু কোন উত্তর দিল না। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনতে লাগল। এই সেই মেয়ে! এতটা বড়ো কবে হয়ে গেল? চোখের সামনে থেকেও বিশু বুঝতেই পারেনি এতদিন! সরকারি হসপিটালের মেঝেয় প্রতিমার কোলের কাছে পাখি ঘুমোচ্ছিল। এত্তোটুকু একটা পাখির মতোই। কাপড়ে জড়ানো পাখিকে খুব সাবধানে কোলে নিতেই পাখি ঘুম ভেঙে তাকিয়ে ছিল অচেনা বিশুর মুখের দিকে। কাঁদেনি, কিন্তু তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর কী ভেবে কে জানে ফোকলা মুখে হেসেছিল। আর সেদিনই বিশু বুঝেছিল, তার পাঁজরের খাঁচার মধ্যে থাকা এতদিনের প্রাণপাখিটা, সেখানে আর নেই। সেটা এখন তার কোলে, কাপড়ে জড়ানো ছোট্ট পুতুলের মতো এই মেয়েটা। মেয়ের নাম রেখেছিল পাখি।
পাখি রাগে দুঃখে অপমানে বকেই চলেছে, আর তার দু চোখ বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। বিশু কিছু বলল না। পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে, মন দিয়ে শুনতে লাগল পাখির অভিযোগ। পাখি কথা বলুক, কথা বলে হাল্কা করুক নিজেকে। চোখের জলে ধুয়ে ফেলুক মনের যত্তো অভিমান। একটা সময় পাখি চুপ করে গেল, আর কথা বলছে না। ওড়নার খুঁটে চোখ মুছছে বারবার।
বিশু আরও কিছুক্ষণ পরে বলল, “বাইরের একজন হোটেলউলির কথায় কী আসে যায়, মা? এতটা উতলা হস না। মাথা ঠাণ্ডা করে একটু বোঝার চেষ্টা কর। আমার মাতারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চাকরিটা চলে গেছে, বছর সাতেক হল। আমাদের মতো লোকের কত আর জমানো পয়সা থাকে, সে তো তুই বুঝিস! চারমাস, ছমাস চাকরির খোঁজে কতজনের কাছে গেছি! একজনের কাছে দুমাস কাজ করার পর, একটা পয়সাও দিলে না। উপরন্তু দুম করে ছাড়িয়ে দিল। বলেছিল, দু মাসের মাইনে পরে সময় মতো দিয়ে দেবে। সে সময় তার আজও হয়নি, পাখি! সে সময় এই হোটেলউলি কোথায় ছিল? তখন তুই ইস্কুলে সেভেন কি এইটে পড়িস, মনে আছে? আমাদের তিনজনের সংসার খরচ, দায়দৈব। তুই আমার একমাত্র মেয়ে, তোর আনন্দ খুশি। আমি হার মানিনি, পাখি। তোদের বুঝতেও দিইনি। ঠিকই বলেছিস, তোর মা হয়তো চারবাড়ি রান্নার কাজ করত। তুই স্কুলের পড়া ছেড়ে খবরের কাগজ কেটে ঠোঙা বানাতিস। কিংবা মুড়ি বা প্লাস্টিকের কারখানায় কাজে লেগে যেতিস! আর আমি? একটা বেকার মানুষ তোদের পয়সা হাতিয়ে রোজ গিয়ে বসতাম রেললাইনের ধারে চুল্লুর ঠেকে! মাঝরাত্রে পাড়া জাগিয়ে ঘরে এসে হাল্লা করতাম, “অ্যাই পাখি দরজা খোল”। সেই অপমান আর লজ্জা কী আজকের ওই হোটেলউলির অপমানের থেকে কম হত? বল না, পাখি?
একটা নিশ্চিন্ত কাজের খোঁজে আমি যখন পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন একদিন ফাঁড়ির মোড়ে আফজলদার সঙ্গে দেখা। আফজলদা একসময় মাতারা ইঞ্জিনিয়ারিংএর হেড মার্কার ছিল। আমাকে নিজে হাতে কাজ শিখিয়েছিল। জানিনা কেন, আমার ওপর তার বেশ একটা টান ছিল, ভালোবাসত - সেটা তখনই টের পেতাম। আফজলদা হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে, মাতারা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। কেন গেল, কোথায় গেল, অনেকদিন খোঁজ করেছিলাম, কোন খবরই পাইনি। আফজলদা ছেড়ে যাওয়ার বছর দুয়েক পরেই মাতারা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা পথে বসলাম।
আফজলদার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল। দেখলাম আমাকে ও ভোলেনি। জিগ্যেস করল, আমি এখন কী করছি। সব কথাই খুলে বললাম। সব শুনল মন দিয়ে, তারপর বলল, “আমার কাছে কাজ করবি? প্রেস্টিজ নেই। তোদের আবার ভদ্রলোক হওয়ার খুব গুমোর আছে না? তোরা সব ইস্কিল্ড্ মিস্ত্রি! সে সব থাকলে চলবে না। কিন্তু মাস গেলে ছ-সাত হাজার রোজগার হয়েই যাবে। সবদিন সমান যাবে না, কোনদিন বেশি, কোনদিন কম। তবে যদ্দিন অন্য কোন কাজ না পাস, চালাতে পারিস”।
আমি জিগ্গেস করলাম, “কী কাজ আফজলদা? চুরি, চামারি, পকেটমারি”? আফজলদা হো হো করে হাসল, বলল, “সে মুরোদ তোর যে হবে না, সে কথা আমার থেকে ভালো আর কে জানে রে, হতভাগা? চল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ বকা যায়? চা খেতে খেতে কথা বলব”।
বড়ো রাস্তা ছেড়ে সরু গলির ভেতরে ডানদিক, বাঁদিক অনেক মোড় ঘুরিয়ে সে আমাকে নিয়ে গেল, ঘিঞ্জি একটা বস্তির ভেতরে। অত ঘিঞ্জি বস্তির মধ্যেও আছে খোলা উঠোনের মতো ছোট্ট একটা জায়গা। দেখলাম, সেখানে বসে আছে বেশ কয়েকজন কানা, খোঁড়া, হাত লুলা লোক। দু জনের পায়ে বিশ্রী দগদগে ঘা। তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আফজলদা বলল, “এই যে বস্তিটা দেখছিস, এখানেই আমার বহুদিনের বাস। আমার বাসাটা সামনের দিকে। এরাও সবাই এই বস্তিতেই থাকে। আমি যখন মাতারায় টার্নারের কাজ করে, মোটামুটি ভালই কামাচ্ছি, এরা তখন সব উঠতি ছোকরা। কাজ নেই কম্মো নেই। বাপ-মায়ের হোটেলে কোনরকমে ভাতটা জুটে যায়। মায়েরা লোকের বাড়ি ঝি-গিরি করত। বাপেরা সারাদিন রিকশা চালিয়ে সন্ধের ঝোঁকে ঠেকে বসে সস্তার মাল খেত ভর পেট। রাত্রে বাসায় ফিরত টাল খেতে খেতে, মুখে অশ্রাব্য বুলি। নেশার ঘোরে ওদের মাকে পেটাত, ছেলেমেয়েদেরকেও পেটাত, তারপর হড় হড় বমি করে পড়ে থাকত এই উঠোনের এক কোনাতে। ভোরের কুকুর এসে তাদের মুখ শুঁকত”।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আফজলদা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর আবার বলল, “সেই বাপে তাড়ানো, মায়ের মুখ-ঝামটা খাওয়া ছোকরাগুলো সব এখন দিব্যি করে-কম্মে খাচ্ছে। ওই যে – কানা, খোঁড়া, লুলা লোকগুলো দেখছিস, ওরাই। ওদের কেউই কানা নয়, খোঁড়া নয়, লুলাও নয়। কিন্তু ওভাবেই ওরা নিজেদের সাজিয়ে তোলে, তারপর বেরিয়ে পড়ে এই শহরের পথে পথে। সারাদিনে খারাপ কামাই হয় না। বৃষ্টি-বাদলার দিনে একটু মন্দা চলে ঠিকই, কিন্তু এমনিতে দিনে দেড়শ-দুশো তো হয়েই যায়। যারা একটু মনকাড়া নাটক করতে পারে – তাদের দিনে আড়াই-তিনশ পর্যন্ত হয়ে যায় দেখেছি। তাছাড়া পুজো-পরবে, ঠিক-ঠাক জায়গায় বসতে পারলে দিনে হাজার টাকাও উঠে যায়। যেমন ধর, তোদের দুর্গাপুজো, কিংবা আমাদের রমজান মাসে, ইদের দিনে। আর সব থেকে বেশি আয় হয় বড়োদিনের সময় চিড়িয়াখানা বা ভিক্টোরিয়ার বাইরে কোথাও ঘাঁটি গাড়তে পারলে”।
ওই লোকগুলোর দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আফজলদার কথা শুনছিলাম। আফজলদার কথা শেষ হতে আফজলদার মুখের দিকে তাকালাম। আফজলদা হাসল, বলল, “কী ভাবছিস? লেগে পড়বি? নাকি আফজলদার ওপর খুব ঘেন্না হচ্ছে? বিশু-মিস্ত্রিকে শেষ অব্দি ভিখিরি বানানোর মতলব আঁটছে! চল, চা খাই।”
প্লাস্টিকের কাপে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আফজলদা বলল, “তোকে ল্যাংড়া সাজিয়ে দেব, বিশু - কেউ ধরতে পারবে না। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে, কিন্তু সাত-দশদিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবি। বগলে লাগানোর ক্রাচ-টাচ সব দিয়ে দেব – দোকানের শৌখিন ক্রাচ নয়, আমাদের হাতে বানানো বাঁশের – প্লাস্টিকে মোড়া বগলের গদি সমেত। এসবের জন্যে আমাকে রোজ কুড়িটাকা করে দিবি, সবার থেকে আমি তিরিশ করে নিই – তুই বলেই কুড়ি। আমার ফিক্স রেট – পুজোপার্বণে বেশি কামালে, তার থেকে আমি কোন ভাগ নিই না, সেটা সবই তোর”।
আমার মনের মধ্যে সে সময় যে কী তোলপাড় চলছিল সে কথা তোকে বলে বোঝাতে পারবো না, পাখি। আমি আফজলদাকে বললাম, আমাকে এক-দুদিন সময় দাও আফজলদা, ভেবে দেখি। আফজলদা বলল, “কাজ পেয়ে গেলে আলাদা কথা। কিন্তু ভেবে ভেবে আর সময় নষ্ট করিস না, বিশু। লেগে পড় – দেখবি এটাও একটা পেশা। ইজ্জত নেই ঠিকই, তবে পেটটা চলে যাবে। ইজ্জত ফুটিয়ে – ফ্যান গেলে ভাতের মতো পেট ভরানো যায় না রে বিশু। পেট ভরাতে দুমুঠো ভাতই লাগে!”
দুদিন পরেই আফজলদার সঙ্গে দেখা করে লেগে পড়লাম। সেই থেকেই চলছে। তুই বড়ো হয়ে গেলি, ইস্কুল ছেড়ে কলেজে উঠলি, পাশও করে গেলি। আজ এসেছিস এই চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। এসবের পিছনে আছে আফজলদার হাত আর বিশু-মিস্ত্রি নয়, ল্যাংড়া-বিশুর লড়াইয়ের গল্প”। কথা শেষ করে বিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, তারপর ম্লান হেসে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “আফজলদা ঠিকই বলেছিল। ইজ্জত সামলাতে গেলে এসবের কিছুই করতে পারতাম না। আমার বুকের পাখিকে নিয়ে, আমাদের ছোট্ট সংসারটা ছারখার হয়ে যেত”।
পাখি এতক্ষণ মাথা নিচু করে শুনছিল। মুখ তুলে বাবার মুখের দিকে যখন তাকাল, বিশু দেখল মেয়ের চোখে জলের ধারা। পাখি অস্ফুট স্বরে বলল, “আমাদের এতদিন কিছুই জানাওনি কেন? তুমি কী সত্যি আমাকে এবং মাকে আপনজন বলে মনে করো, বাবা? যদি করতে নিজেকে কখনো এভাবে ছোট করতে পারতে না”।
বিশু হাসল, বলল, “পাগলি। আপনজন বলেই তো তোদের গায়ে আঁচ লাগতে দিইনি”।
“ঠিকই, কিন্তু নিজেকে ঝলসে গিয়েছ প্রত্যেকদিন”।
“ধূর খেপি, ওভাবে ভাবছিস কেন? তোদের একটু খুশি আর শান্তির জন্যেই আমার এই কষ্ট স্বীকার। যখন তোর হাসিমুখের “বাবা” ডাক শুনি, ও কষ্টকে কষ্ট বলে মনেই হয়না। একের পর এক পরীক্ষা পাশ করে তুই যখন উজ্জ্বল মুখে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিস, আমার বুকটা ভরে তুলেছিস আনন্দে – তখন এই কষ্ট আবার কষ্ট ছিল নাকি?”
“আমার এ চাকরিটা হয়ে গেলে, তোমাকে কিন্তু এসব ছাড়তে হবে, বাবা”।
“আচ্ছা সে দেখা যাবে”।
“দেখা যাবে নয়, আজই আফজল আংকলকে গিয়ে এইসব ধরাচূড়ো জমা দিয়ে আসবে”।
বিশু হাসল, বলল, “বললাম তো হবে”।
৩
সাতটার একটু আগেই পাখি অফিসে ঢুকল। উল্টোদিকের ফুটপাথে গাছের অন্ধকারে মিশে বিশু দাঁড়িয়ে রইল। তাকিয়ে রইল অফিসঘরের উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করতে থাকা বন্ধ কাচের দরজাটার দিকে। ওইরকমই উজ্জ্বল হয়ে উঠতে চলেছে কি, তাদের ভবিষ্যৎ? তার মেয়ের, তার নিজের এবং ওর মায়ের? কিন্তু কতটুকুই বা বয়েস মেয়েটার? এই বয়েস থেকেই সংসারের সম্পূর্ণ ভার নিতে নিতে, তার চোখের সামনেই যে মেয়েটা অকালে বুড়িয়ে যাবে! ওর নিজস্ব শখ-আহ্লাদ, আশা-স্বপ্ন সব যে মুড়িয়ে যাবে অচিরেই! আজ নিজের চোখেই পাখি সব দেখেছে, বুঝেছে। সব জেনেশুনে পাখি তার বাবাকে আর কী ছেড়ে দেবে এই উঞ্ছবৃত্তির পথে? কক্খনো দেবে না।
কিন্তু বিশুই বা নতুন কোন্ কাজের সন্ধান পাবে, যার উপার্জনে সংসার নিশ্চিন্তে চলতে পারবে! আর পাখির উপার্জনে আসবে কিছুটা বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য এবং ওর ভবিষ্যতের নিরাপত্তা! আগামীকাল থেকেই কর্মহীন বিশু কী জবাব দেবে পাখির মাকে, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় পরিজনকে? মেয়ে চাকরি পাওয়া মাত্র কাজ-কর্ম ছেড়ে তার ঘরে বসে যাওয়া – সবার কাছেই দৃষ্টিকটু হয়ে উঠবে না? সবাই ভাববে পাখির বাপটা কী ভীষণ স্বার্থপর। মেয়ের ঘাড়ে চেপে নিশ্চিন্ত সুখে খাবে বলেই – বিশু দুম করে কাজটা ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে গেল! শুধু ভাববে না, বলবে, উঠতে বসতে গঞ্জনা দেবে। সে সব কথা পাখিও কী সইতে পারবে? বিশেষ করে সে যখন জানে, তার বাবা কী ভাবে সংসার চালিয়ে এসেছে এতদিন!
এমনিতেই মেয়েটা একার রোজগারে সংসার চালাতে হিমসিম খাবে – তার ওপর এই যন্ত্রণা হবে তার উপরি পাওনা। বিশু জানে, পাখি মরে গেলেও আজকের কথা সে কাউকেই মুখ ফুটে বলতে পারবে না, এমনকি হয়তো নিজের মাকেও না। মেয়ের এই কষ্টের কথা চিন্তা করে, বিশু স্বস্তি পাচ্ছিল না। এই অদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায়ও তার জানা নেই। তার নিজের এবং পাখি নামের তার বুকের পাখিটির অসহায় ভবিষ্যতের ভাবনাতে বিশু বিষণ্ণতায় ডুবে রইল বহুক্ষণ।
অফিসের কাচের দরজাটা আচমকা খুলে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে বের হল পাখি। পাখিকে ওভাবে আসতে দেখে চমকে উঠল বিশু। কী হয়েছে পাখির? পাখির পিছনেই উজ্জ্বল আলোকিত দরজা দিয়ে চকিতে বের হল মুশকো চেহারার একটা লোক, চেঁচিয়ে বলল, “অ্যাই মাগি, পালাচ্ছিস কোথায়? ধরতে পারলে শেষ করে দেব, শালী, দাঁড়াঃ...”। পাখি বিশুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “বাবা, আমাকে বাঁচাও। ওরা ধরতে আসছে”। পাখির দুই চোখ বিস্ফারিত আতঙ্কে। বিশু পাখিকে আড়াল করে রাস্তায় নামল, হাতে তুলে নিল আফজলদার দেওয়া একখানা ক্রাচ, চুকচুকে বাঁশের তলায় লোহার গুল বসানো। সেটা বাগিয়ে ধরে দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, হিসহিসে স্বরে বলল, “চলে আয়, হারামজাদা, দেখি তোর মুরোদ”।
মুশকো লোকটা এমন প্রতিরোধ আশা করেনি, থমকে দাঁড়িয়ে গেল ওপারের ফুটপাথে। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিশুর দিকে। এখন উন্মুক্ত উজ্জ্বল দরজায় এসে দাঁড়াল জনৈক ভদ্রলোক, পরনে তার কোট-প্যান্ট, ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। পরিস্থিতি বুঝে নিল লহমায়, গম্ভীর গলায় বলল, “যেতে দে শংকর, চলে আয়, ঝামেলা বাড়াস না”। মুশকো লোকটা নেড়ি কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে আরেকবার বিশুর দিকে তাকাল, বলল, “আপনি বললেন বলে, স্যার, তা না হলে আমি শুয়োরের বাচ্চাকে আজ...” উজ্জ্বল দরজা খুলে ঢুকে গেল ভেতরে। সমস্ত আতঙ্ক ও উত্তেজনা গ্রাস করে, ওদের পিছনে বন্ধ হয়ে গেল কাচের উজ্জ্বল দরজাটা।
বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বিশু, তারপর ঘুরে তাকাল পাখির দিকে। ক্রাচদুটো তুলে নিয়ে একটা হাত ধরল পাখির, বলল, “চল বাড়ি যাই। ঠিক কী হয়েছিল বল তো”।
গাছের ছায়ায় ছায়ায় ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কান্নাধরা গলায় পাখি বলল, “জঘন্য নোংরা সে সব কথা আমি তোমায় বলতে পারবো না, বাবা। জিগ্যেস করো না”। বিশু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের দিকে তাকাল, আলো-আঁধারিতে মেয়ের বিষণ্ণ মুখটা দেখে তার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল যন্ত্রণায়, বলল, “যা হবার হয়ে গেছে, ওসব এখন ভুলতে চেষ্টা কর। চোখে মুখে জল দিয়ে, তুই বরং এখন বাড়ি যা। আমি আফজলদার ওখান হয়ে যাবো, একটু দেরি হবে।”
“দেরি হোক বাবা, আমি তোমার সঙ্গেই ফিরবো”।
“আমি কিন্তু আফজলদার কাজটা চালিয়ে যেতে চাই”।
“বুঝেছি বাবা। এমন বেইজ্জতির পর...কোন মুখে আর..”
বিশু কিছু বলল না, মেয়ের হাত ধরে, মাথা নিচু করে ফুটপাথের আলো-আঁধারি আড়ালে হাঁটতে লাগল।