১৭৭৬ সালে হ্যালহেডের আইনটি চালু করার সময়ে, ইংরেজরা রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালালেও কোনও স্থায়ী সমাধানের উপায় খুঁজে পায়নি। বরং এই আমলে অস্বাভাবিক হারে রাজস্ব আদায়ের কারণে, বাংলা ও বিহারের কতিপয় ক্ষমতাশালী রাজা ও জমিদার যে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে, তা আমরা আগের পর্বে দেখেছি। কিন্তু প্রথমে হ্যালহেডের আইন ও পরে ১৭৯৩-এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে, এই জমিদারশ্রেণি ক্রমে শাসকের প্রতি বৈরী মনোভাব পরিত্যাগ করে তাদের প্রধান সমর্থক হয়ে ওঠে। প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই বৃহত্তম প্রভাবশালী অংশটিকে পারস্পরিক স্বার্থসূত্রে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার পরে, ঔপনিবেশিক শাসকরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসাবে নারীদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে আরও প্রান্তিক করে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে।
এই পরিস্থিতিতে হ্যালহেডের A Code of Gentoo Laws-এর ২০ বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ শাসকরা দ্বিতীয় একটি আইন তৈরি করার প্রয়োজন অনুভব করে। দ্বিতীয় আইনটির মাধ্যমে ভারতবর্ষের হিন্দু বা মুসলমান প্রজাদের ন্যায়বিচার দেওয়ার বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। বরং এই ২০ বছরের মধ্যে তারা প্রচলিত রাজস্ব ব্যবস্থায় যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় এবং সেই পরিবর্তনের ফলে ভারতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক জগতে যে বিপুল রদবদল ঘটে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখাই ছিল এই নতুন আইন প্রবর্তনের একমাত্র প্রেরণা।
কোম্পানির শাসকবর্গের এই মনোভাবকে আইনের মাধ্যমে প্রতিফলিত করার জন্য, হেস্টিংসের আমলে ১৭৮১ সালে পাস হয় নতুন আইন ‘The Act of Settlement’। এই আইনের ১৭ সংখ্যক ধারায় বলা হয়: “সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও জমির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় এবং দু-পক্ষের মধ্যে চুক্তি ও লেনদেনের সমস্ত বিষয়, মুসলমানদের ক্ষেত্রে মুসলমান আইন ও ব্যবহার এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দু আইন ও ব্যবহার দ্বারা নির্ধারিত হবে।” [১] প্রধানত সম্পত্তির উত্তরাধিকারের বিষয়টিই যে এই আইন প্রবর্তনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, আইনের এই ধারাটি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেটলমেন্ট অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পরে, ১৭৮৩-র ২৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের পিউনি জজ (puisne judge) হিসাবে কলকাতায় পদার্পণ করেন উইলিয়াম জোন্স। [২] এবার তিনি শাসকের কাঙ্ক্ষিত আইনটি প্রবর্তনের কাজে নিজেকে সমর্পণ করেন। অবশ্য তার আগেই তিনি আদালতে নিযুক্ত জজপণ্ডিতদের বিচারকে উল্টে দিয়ে তাঁর নিজস্ব রায়দান প্রক্রিয়া শুরু করে দেন।
১৭৮৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর, জজপণ্ডিতদের যোগ্যতার ওপর চূড়ান্ত অনাস্থা প্রকাশ করে চার্লস চ্যাপমানকে তিনি জানান: “এই নিরিবিলি জায়গায় [কৃষ্ণনগর] আমি ধীরগতিতে কিন্তু নিশ্চিতভাবে সংস্কৃত অধ্যয়নের বিষয়ে অগ্রসর হচ্ছি। কারণ আমি আর আমাদের [আদালতের] পণ্ডিতদের— যারা তাদের খেয়ালখুশি মতো হিন্দু আইন পরিচালনা করে— দয়াদাক্ষিণ্য সহ্য করতে পারি না...।” [৩] একই মনোভাব প্রকাশ করে ১৭৮৭-র ১৬ অগস্ট জন শোরকে (পরবর্তীকালে যিনি ভারতবর্ষের তৃতীয় গভর্নর জেনারেল হবেন) জোন্স লেখেন: “...আমি আরবি ও সংস্কৃত অধ্যয়ন করে আদালতকে সহায়তা করছি এবং এখন আমাদের ওপর মুসলমান বা হিন্দু আইনজীবীদের ভুল মতামত চাপিয়ে দেওয়াকে অসম্ভব করে দিয়েছি।” [৪] পরের বছরের ১৯ মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিসকেও একই কথা বলেন তিনি: “...যদি আমরা [বিচার সম্পর্কে] কেবল দেশীয় আইনজীবী ও পণ্ডিতদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি, তাহলে তাদের দ্বারা [আমরা] যে প্রবঞ্চিত হতে থাকব না, সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।” [৫] সংস্কৃতের পকড় নিয়ে যখন একের পর এক দাম্ভিক উচ্চারণ করছেন জোন্স, তখন তাঁর সংস্কৃত শিক্ষার বয়স সাকুল্যে দু-বছরও পার হয়নি।
এই সুযোগে এহেন উইলিয়াম জোন্সের সংস্কৃত চর্চার সামান্য হদিশ নেওয়া যাক। জোন্স লন্ডনে নানা ভাষা শিখলেও সংস্কৃত জানতেন না। কলকাতায় আসার আগে অক্সফোর্ডে শিক্ষক রেখে আরবি শিখেছেন তিনি— এমনটা অবশ্য জানা গেছে। ১৭৮৩ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হয়েছেন বটে, অথচ তখনও অবধি সংস্কৃতর ‘স’ জানেন না। ফলে মুনশিদের দিয়ে আরবি, ফারসি আর হিন্দুস্থানি মারফত কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন কোনও ক্রমে। ১৭৮৩-র ২৫ সেপ্টেম্বর কলকাতায় আসা ইস্তক সংস্কৃত নিয়ে তাঁর কোনও উৎসাহের কথা জানা তো যাচ্ছেই না, বরং উইলকিন্সকে ১৭৮৪-র ২৪ এপ্রিল তিনি জানাচ্ছেন ‘life is too short and my necessary business too long for me to think at my age of acquiring a new language’। [৬] এদিকে আদালতে সংস্কৃত শাস্ত্রবিচার করে রায় দিতে হয়, জোন্সের যাকে বলে একেবারে বেইজ্জত অবস্থা। হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের খপ্পর থেকে নিজেকে বাঁচাতে ১৭৮৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, তিনি উইলিয়াম পিট (জুনিয়র)-কে জানান তাঁর সংস্কৃত শেখার আসল মনোবাসনার কথা। ভাষা হিসাবে সংস্কৃত শেখা তাঁর উদ্দেশ্যে নয়, আসলে তিনি ভাষাটা শিখতে আগ্রহী যাতে তিনি ‘may be a check on the Pundits of the court’। [৭]
এর আগে অর্থাৎ ভারতবর্ষে পদার্পণ করার প্রায় বছর খানেকের মধ্যে, এই উদ্দেশ্যে তিনি কাশীতে হাজির হন। যদিও সেখান থেকে তাঁকে ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরতে হয়। এবারে ১৭৮৫-র সেপ্টেম্বর মাসে, তিনি সংস্কৃত শিক্ষায় হাতে খড়ি নিতে পাড়ি জমান নবদ্বীপ। ৮ সেপ্টেম্বর প্যাট্রিক রাসেলকে চিঠি লিখে তিনি জানাচ্ছেন, সেখানে তাঁর যাওয়ার একমাত্র কারণ হল এমন একজন উপযুক্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্ধান করা, যাঁর থেকে তিনি ‘the rudiments of that venerable and interesting language’ [৮] আয়ত্ত করে স্মৃতিশাস্ত্র অনুবাদ করতে পারেন। কিন্তু তাঁর বয়ান অনুযায়ী দুর্গাপুজোর কারণে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণেরা তখন নবদ্বীপ ছেড়ে দূরস্থ যজমানদের বাড়িতে চলে গেছেন।
যদিও এ বিষয়ে জোন্স যে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করেন, সেই তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত রাজেশ কোছারের Sanskrit and the British Empire গ্রন্থ থেকে জানা যায়। কোছারের গবেষণা অনুযায়ী ১৭৮৫ সালে দুর্গাপুজো অক্টোবরের প্রথম দিকে শুরু হয়। কাজেই নবদ্বীপের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণদের দুর্গাপুজোর প্রায় তিন সপ্তাহ আগে তাঁদের যজমানদের বাড়িতে চলে যাওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না। [৯] তা ছাড়া গোটা নদীয়া জেলায় জোন্সের জন্য কোনও সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণকে পাওয়া যায়নি, এ কথাও বিশ্বাস করা কঠিন। বিশেষত যেখানে জোন্সের মতো উচ্চপদস্থ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তার পক্ষে অন্তত একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পাওয়ার বিষয়টি অতি সাধারণ ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হওয়ার কথা। সম্ভবত কোনও ব্রাহ্মণ পণ্ডিত তাঁকে সংস্কৃত শেখাতে রাজি না হওয়ার ফলে জোন্স বাধ্য হয়ে এ ব্যাপারে পুজোর অজুহাত দেন।
যাই হোক, অনেক চেষ্টা করেও শিক্ষক হিসাবে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাউকে না পেয়ে তিনি অব্রাহ্মণ (বৈদ্য) রামলোচন পণ্ডিতকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা ফেরেন। কৃষ্ণনগর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর লেখা চিঠিতে উইলকিন্সকে জোন্স জানাচ্ছেন, তিনি এবারে রামলোচনের থেকে হিতোপদেশ পড়া শিখবেন। [১০] শুধু তাই নয়, রামলোচনের যাদুগুণে মাত্র এক বছরের মধ্যে তিনি সংস্কৃততে এত পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে, ১৭৮৬ সালের ২৩ অক্টোবর জোন্স হেস্টিংসকে জানান, তিনি হিতোপদেশ -এর অনুবাদ করে ফেলেছেন এবং কিছু দিন পরেই ‘compiling a complete Digest of Indian laws’ [১১] -এর কাজে হাত দেবেন।
হেস্টিংসকে চিঠি লেখার মাসছয়েক আগে, ওই বছরের ৬ মে স্যার জন ম্যাকফারসনকে লেখা চিঠিতে এই বিষয়ের বিশদ বিবরণ দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে জোন্স জানান: “ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমানদের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ আমার দেশবাসীকে উপহার দেব— এই আমার আন্তরিক ইচ্ছা। এই ইচ্ছার বশে আমি বহু দিন থেকে পরিশ্রম করছি। এ সম্পর্কে অশুদ্ধ ফারসি তরজমায় লিখিত একটি গ্রন্থের সাহায্যে আমি প্রাচীনতম সংস্কৃত আইনবিষয়ক গ্রন্থগুলি পাঠ করতে সক্ষম হয়েছি। গত বছর আমি সর্বশ্রেষ্ঠ আরবি আইনগ্রন্থ অনুবাদ করেছি। [বর্তমানে] আমি ইংরেজিতে মনু অনুবাদ করা শুরু করেছি। আমার একার দ্বারা যা সম্ভব, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমি তা সম্পূর্ণ করব এবং এ বিষয়ে আমি মন্ত্রী, চ্যান্সেলর, বোর্ড অব কন্ট্রোল ও ডিরেক্টরদের লিখব। ...যাঁরা আমাকে জানেন না, তাঁরা মনে করতে পারেন যে আমি ভারতবর্ষের জাস্টিনিয়ান হওয়ার উদ্দেশ্যে বা অর্থের লোভে এই কাজে অবতীর্ণ হয়েছি। কিন্তু কেবল সাধারণের সুবিধা ও উপকার করতে পারব, এই আনন্দটুকু ছাড়া অন্য কোনও পার্থিব সুবিধা লাভের আকাঙ্ক্ষায় আমি এই ধরণের কাজে হস্তক্ষেপ করিনি।” [১২] যে জোন্স ১৭৮৫ সালে সংস্কৃত শিখতে শুরু করেন, সেই একই ব্যক্তি অজ্ঞাত যাদুমন্ত্রে পরের বছরেই মনু অনুবাদ করা শুরু করে দেন! এহ বাহ্য, ‘ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমানদের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ’ তাঁর দেশবাসীকে উপহার দেওয়ার বিষয়টিও তাঁর অন্যতম বাসনা হয়ে ওঠে। তবুও নিছক শাসক পক্ষের লোক হওয়ার দৌলতে, এহেন ‘আইনজ্ঞ’ ও ‘সংস্কৃতজ্ঞ’ জোন্স যে শাসকদের নয়নের মণি হবেন, সে তো জানা কথা। তাই তাঁর ওপরই অর্পিত হয় হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য দুটি নতুন আইন বানানোর দায়িত্ব। আর জোন্সও শাসকের বাঞ্ছিত আইন প্রণয়নের কাজে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েন।
দায়িত্ব পেয়েই তাঁর পূর্বসুরী হ্যালহেডের আইনটির অনুবাদের বিষয়ে নানাবিধ ত্রুটি আবিষ্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জোন্স। তাঁর অনূদিত মনুসংহিতা-র ভূমিকায় তিনি লেখেন, এই নতুন আইন প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য হল যাবতীয় ‘natural defects in the old jurisprudence of this country’-কে বিদায় করে তাকে ‘accommodate it justly to the improvements of a commercial age’ [১৩] করা। তবে হ্যালহেডও যেহেতু শাসক পক্ষের লোক, সেহেতু আগের আইনটির যাবতীয় ত্রুটিবিচ্যুতির দায়ভার তিনি ফারসি অনুবাদকদের ওপর চাপিয়ে দেন। লক্ষণীয়, হ্যালহেড তাঁদের ওপর যে এই দোষারোপ করেননি, তা তাঁর লিখিত ভূমিকাতে স্পষ্ট। কিন্তু জোন্স শুধু আদালতের সরকারি জজপণ্ডিতদের ওপর অবিশ্বাস জ্ঞাপনই করেন না, ফারসি অনুবাদকরাও তাঁর অবিশ্বাসের আওতায় চলে আসতে বাধ্য হন।
১৭৮৮ সালের ১৯ মার্চ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসকে লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটিতে জোন্স বলেন: “...যদিও হ্যালহেড বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁর ভূমিকা পালন করেছিলেন, তবুও [ভাষান্তরের সময়ে] তিনি যে ফারসি অনুবাদ ব্যবহার করেন, তার সঙ্গে মূল সংস্কৃতের অনেক পার্থক্য আছে। [এই আইনে] অনেকগুলি প্রয়োজনীয় অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়েছে, যদিও [মূল] পাঠ্যটি ব্যাখ্যা করা বা উন্নত করার জন্য নিরর্থকভাবে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু টীকা সংযোজিত হয়েছে।” [১৪] চিঠিটির এই অংশ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়, হ্যালহেডের আইনটিতে মূল সংকলন গ্রন্থ থেকে অনুবাদের সময়ে প্রচুর সংযোজন-বিয়োজন ঘটে। এই ত্রুটির জন্য জোন্স যতই ফারসি অনুবাদকদের দায়ী করুন না কেন, শাসকের গোপন মনোভাব আর গোপন থাকে না।
নতুন আইনটি চালু করার ক্ষেত্রে শাসকের মূল উদ্দেশ্য ছিল— ক) নারীদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সমাজে তাঁদের ব্রাত্য ও প্রান্তিক করে দেওয়া ও খ) তাঁদের জীবনধারণের জন্য কেবল পুরুষদের কৃপার ওপর নির্ভরশীল করে তোলা। তাই অত্যন্ত পরিকল্পিভাবে জোন্স তাঁর আইনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসাবে নারীদের চূড়ান্ত অবমাননাকারী পিতৃতান্ত্রিক মনুকে বেছে নেন। মনুকে কেবল ‘son or grandson of BRAHMA’ বলেই নিশ্চিন্ত হতে পারেন না জোন্স, বরং মনুসংহিতা-কে আপামর হিন্দুর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য, তাঁকে চিহ্নিত করেন ‘not the oldest only, but the holiest of legislators’ [১৫] রূপেও।
মনুসংহিতা নারীদের সম্পর্কে এত পরস্পরবিরোধী ও অশ্লীল উক্তিতে ভর্তি, যা থেকে সহজেই বোঝা যায় সমাজকর্তারা তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে এই ধর্মশাস্ত্রটিতে প্রচুর সংযোজন ও বিয়োজন ঘটিয়েছিলেন। এত বিচ্যুতি সত্ত্বেও গ্রন্থটিতে নারীদের জন্য যে সামান্য অধিকারটুকু বজায় ছিল, তাকেও সমূলে উৎপাটিত করতে উদ্যোগী হন জোন্স। মনুসংহিতা-র বিভিন্ন অধ্যায়ে বিবৃত নানা শ্লোক এবং জোন্সের সূক্ষ্ম সুকৌশলী কারিকুরির বিশদ আলোচনা করলে, বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। তবে এই বিষয়ে প্রথমে আমরা মনুসংহিতা-তে নারী সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী শ্লোকের নমুনা দেখব।
উদাহরণস্বরূপ, তৃতীয় অধ্যায়ে যে মনু নারীকে সম্মান দেন এই উক্তি করে:
যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্ব্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।। ৩. ৫৬
(যে কুলে স্ত্রীলোকেরা পূজিত হন, সেখানে দেবতারা প্রসন্ন হন। আর যে কুলে এঁদের অনাদর হয়, সে বংশে সকল কর্ম নিষ্ফল হয়)। [১৬] সেই একই মনু নবম অধ্যায়ে অবলীলায় লেখেন:
নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিতিঃ।
সুরূপম্বা বিরূপম্বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে।। ৯.১৪
(স্ত্রীরা রূপ বিচার করে না, যুবক বা বৃদ্ধ তা-ও দেখে না, সুরূপ বা কুরূপ হোক, পুরুষ পেলেই তার সঙ্গে সম্ভোগ করে)। [১৭] তিনি লিখতে পারেন:
শয্যাসনমলঙ্কারং কামং ক্রোধমনার্জ্জবম্।
দ্রোহভাবং কুচর্য্যাঞ্চ স্ত্রীভ্যো মনুরকল্পয়ৎ।। ৯.১৭
(শয়ন, উপবেশন, অলংকার, কাম, ক্রোধ, কুটিলতা, পরহিংসা, ঘৃণিত আচরণ— সৃষ্টিকালে এইগুলি স্ত্রীলোকের [স্বভাবগত করে] মনু স্বয়ং কল্পিত করেছেন)। [১৮] সুতরাং মনুর মতে, নারী ক্রোধী, কুটিল ও হিংসুটে। তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, অলংকারের লোভ ও বয়স নির্বিশেষে পুরুষদের প্রতি ঝোঁক।
চূড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিকতার পূজারী মনু নারীদের এতটাই অবিশ্বাস করেন যে, একাকী পুরুষকে জননী, ভগ্নী এমনকি কন্যার সঙ্গেও নির্জন গৃহে বাস করতে নিষেধ করে দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি বলেন:
স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ দূষণম্।
অত[হো]র্থান্ন প্রম্যাদন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ।।
অবিদ্বাংসমলং লোকে বিদ্বাংসমপি বা পুনঃ।
প্রমদা হুৎপথং নেতুঃ কামক্রোধবশানুগম্।।
মাতা স্বস্রা দুহিত্রা বা ন বিবিক্তাসনো ভবেৎ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি।। ২. ২১৩-১৫
(পুরুষদের দূষিত করাই নারীদের স্বভাব, তাই পণ্ডিতেরা নারী সম্পর্কে কখনও অমনোযোগী হন না। কোনও পুরুষ নিজেকে বিদ্বান মনে করে নারীর নিকট বাস করবেন না, যেহেতু কামক্রোধের বশীভূত নারী বিদ্বান-অবিদ্বান নির্বিশেষে পুরুষকে অনায়াসে উন্মার্গগামী করতে সমর্থ হয়। যেহেতু শক্তিশালী ইন্দ্রিয়সমূহ বিদ্বান ব্যক্তিকেও বশীভূত করে, সেহেতু মা, বোন বা মেয়ের সঙ্গেও পুরুষ নির্জন গৃহে থাকবে না)। [১৯] সহজ কথায়, কেবল নারী হওয়ার অপরাধে মা, বোন কিংবা মেয়ে কাম-ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ছেলে-ভাই-বাবাকে বশীভূত করে বিপথে নিয়ে যেতে পারে।
মনুর মতে স্বামী দুশ্চরিত্র হতে পারেন, কামুক হতে পারেন। তা সত্ত্বেও স্ত্রী তাঁকেই দেবতার মতো সেবা করবেন:
বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈর্ব্বা পরিবর্জ্জিতঃ।
উপচর্য্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ।। ৫. ১৫৪
(পতি সদাচারবিহীন, কামুক বা গুণহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রী সর্বদা দেবতার ন্যায় পতির সেবা করবে)। [২০] আর সেই ‘দেবতার ন্যায় পতি’ মারা গেলে স্ত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট হবে এই শ্লোকটি:
কামন্তু ক্ষপয়েদ্দে[হং] পুষ্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ।
ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু।। ৫. ১৫৭
(পতি মৃত হলে স্ত্রী পবিত্র ফুল-ফল-মূলাদি খেয়ে দেহ ক্ষীণ করবেন, কিন্তু পরপুরুষের নামগ্রহণও করবেন না)। [২১] শুধু তাই নয়, এ বিষয়ে মনু আরও নির্দেশ দেন:
অপত্যলোভাদ্ যা তু স্ত্রী ভর্ত্তারমতিবর্ত্ততে।
সেহ নিদামবাপ্নোতি পতিলোকাচ্চ হীয়তে। ৫. ১৬১
(স্ত্রীলোক ব্যভিচার দ্বারা সন্তান উৎপাদন করবেন না, তা করলে তিনি ইহকালে নিন্দিত হন এবং পরলোকে সেই পুত্র দ্বারা স্বর্গলাভ হয় না)। [২২] মনুর কাছে স্ত্রী সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র, সন্তান উৎপাদন ছাড়া তার স্বতন্ত্র সত্তা থাকতে পারে না বলে তিনি মনে করেন।
তাই গর্ভবতী স্ত্রীর প্রশংসা করে তিনি জানান:
প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রিয়ং শ্রিয়শ্চ গেহেষু ন বিশেষো[হ]স্তি কশ্চন।। ৯.২৬
(স্ত্রীর গর্ভধারণ অতিশয় মঙ্গলকারক, এজন্য তারা বস্ত্রালঙ্কারাদি প্রদানে বহু সম্মানের যোগ্য ও গৃহের শোভাজনক হয়, এমনকি স্ত্রী ও শ্রী— উভয়ের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। নিঃশ্রীক গৃহ যেমন শোভা পায় না, নিঃস্ত্রীক গৃহও তেমন শোভা পায় না)। [২৩] অন্য দিকে পতি কেমন হবেন, সে সম্পর্কে মনু বলেন:
ভার্য্যায়ৈ পূর্ব্বমারিণৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্ম্মণি।
পুনর্দ্দারক্রিয়াং কুর্য্যাৎ পুনরাধানমেব চ।। ৫. ১৬৮
(সুশীলা ভার্যা আগে মারা গেলে তার দাহকার্য সম্পন্ন করে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করবেন অথবা শ্রৌত বা স্মার্ত অগ্নি গ্রহণ করবেন)। [২৪] নারীকে বিধবা হওয়ার পর কঠোর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে দেহ ক্ষয় করার নির্দেশ দেন মনু, অথচ পুরুষকে পত্নী মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার পরেই নতুন পত্নী গ্রহণ করার অনুমতি দেন। আর নারীদের অবমাননাকারী এই পিতৃতান্ত্রিক মনুকেই গুরুঠাকুর ঠাউরান জোন্স।
কিন্তু জোন্স কি সত্যিই মনুকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন? মনুসংহিতা-কে আইনে রূপান্তরিত করার সময়ে তিনি কি সত্যিই মনুর উল্লিখিত নির্দেশাবলীকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন? ১৭৯৪ সালে তিনি Institutes of Hindu Law: Or, the Ordinances of Menu, According to the Gloss of Culluca নামে মনুসংহিতা-র যে অনুবাদ করেন, সেই গ্রন্থের ভূমিকাতে মনুর প্রতি জোন্সের এই শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গির কোনও নিদর্শন আদৌ মেলে না। বরং সেখানে তিনি সোজাসুজি মনুস্মৃতিকে ‘system of despotism and priestcraft’ বলে চিহ্নিত করে স্পষ্ট লেখেন: “…it is filled with strange conceits in metaphysics and natural philosophy, with idle superstitions, and with a scheme of theology most obscurely figurative, and consequently liable to dangerous misconception; it abounds with minute and childish formalities, with ceremonies generally absurd and often ridiculous; the punishments are partial and fanciful….” [২৫] তবুও কেবল শাসকের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মনুসংহিতা-কে ‘the most venerable text in the Indian scripture’ ও ‘those laws are actually revered, as the word of Most High’ [২৬] বলে, তাকেই আইন হিসাবে চিহ্নিত করেন তিনি।
হিন্দু আইনের সংকলন গ্রন্থটির জন্য জোন্স অনুবাদক ও লিপিকর হিসাবে কাদের নিযুক্ত করেছিলেন, ১৭৮৮ সালের ১৩ এপ্রিল লর্ড কর্নওয়ালিসকে লেখা জোন্সের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি থেকে সে বিষয়ে বিশদে জানা যায়। সেই চিঠিতে কর্নওয়ালিসকে জোন্স জানান, হিন্দু আইনের জন্য তিনি বাংলার পণ্ডিত রাধাকান্ত শর্মা ও বিহারের পণ্ডিত সবুর তিওয়ারি এবং লিপিকররূপে মহতাব রায়কে নির্বাচিত করেছেন। [২৭] আসলে জোন্সের মূল পরিকল্পনা ছিল, মিতাক্ষরা ও দায়ভাগের জন্য দুটি আলাদা সংকলন গ্রন্থ তৈরি করা। সেই অনুযায়ী সবুর তিওয়ারি (পাঠান্তরে সর্বরী ত্রিবেদী) ১৭৮৯ সালে বিবাদসারার্ণব নামে একটি সংকলন প্রস্তুত করেন। কিন্তু এটি প্রকাশিত হয়নি, অনূদিত হয়নি এমনকি কখনও সুপ্রিম কাউন্সিলে পাঠানোও হয়নি। ইতিমধ্যে ১৭৮৮-র অগস্ট মাসে একটি নতুন সংকলন গ্রন্থের জন্য জোন্স ত্রিবেণীর কিংবদন্তি সংস্কৃত পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। [২৮] অবশেষে ওই বছরের ২২ অগস্ট, কর্নওয়ালিসের অনুমতিক্রমে মাসিক ৩০০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে নিযুক্ত করেন জোন্স। [২৯]
জোন্স যে সরকারিভাবে ‘হিন্দু’ আইন সংকলন করার পাশাপাশি ‘মুসলমান’ আইন সংকলন করার দায়িত্বও পান— সে কথা আগেই বলা হয়েছে। এ বিষয়ে তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিসকে ১৭৮৮-র ১৯ মার্চ লেখা দীর্ঘ চিঠিতে তাঁর পরিকল্পনার কথা বিশদে জানিয়ে জোন্স লেখেন: “বহু দিন থেকেই আমার বাংলা ও বিহারের বিচারবিভাগের দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ইচ্ছা ছিল। ...হিন্দু ও মুসলমান— এই দুই সম্প্রদায়ের মামলা-মোকদ্দমা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বিশেষ বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী নিষ্পন্ন হওয়াই বাঞ্ছনীয়, কারণ তারা তাদের আবহমানকাল ধরে প্রচলিত ব্যবস্থাগুলিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং একেবারে নতুন কোনও আইনের সাহায্যে তাদের মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা প্রচলিত হলে, তারা অত্যন্ত নিপীড়িত হচ্ছে বলে মনে করতে পারে। ...হিন্দু ও মুসলমানদের বিধিব্যবস্থাগুলি প্রধানত সংস্কৃত ও আরবি— এই দুই কঠিন ভাষার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। খুব কম ইউরোপীয়ই এই ভাষা শিক্ষা করবে, কারণ এর মাধ্যমে তাদের কোনও পার্থিব লাভ হবে না। অথচ যদি আমরা [বিচার সম্পর্কে] কেবল দেশীয় আইনজীবী ও পণ্ডিতদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি, তাহলে তাদের দ্বারা [আমরা] যে প্রবঞ্চিত হতে থাকব না, সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।” [৩০]
জোন্স যাঁদের মুখাপেক্ষী থাকতে চান না, অতঃপর সেই পণ্ডিত ও মৌলবিদেরই কাজে লাগিয়ে নতুন সংকলন গ্রন্থ তৈরি করার বাসনা নিয়ে একই চিঠিতে তিনি জানান: “[রোম সম্রাট] জাস্টিনিয়ানের ব্যবস্থাশাস্ত্র (Digest)-কে আদর্শ করে আমরা যদি এ দেশীয় বিজ্ঞ আইনজীবীদের সাহায্যে হিন্দু ও মুসলমান বিচারব্যবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ সংকলিত করাই এবং যথাযথভাবে তার ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে এক এক খণ্ড সদর দেওয়ানি আদালত ও সুপ্রিম কোর্টে রেখে দিই, তাহলে বিচারকেরা [তাঁদের] প্রয়োজন মতো এই সংকলন গ্রন্থ দেখতে পারবেন; ফলে পণ্ডিত বা মৌলবিরা আমাদের ভুল পথ দেখাচ্ছে কি না, তা ধরা সহজ হবে। ...আমাদের এই সংকলনের কাজ অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। আমরা কেবল উত্তরাধিকারী এবং চুক্তি-সংক্রান্ত আইনগুলি সংকলন করতে চাই, কারণ সচরাচর এই দুই ধরনের মামলাই বেশি হয়। ...আপাতত এই কাজের জন্য খুব কঠিন পরিশ্রমও করতে হবে না। এ সম্পর্কে সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় দুটি গ্রন্থ আছে। তার প্রথমটি কয়েক শতাব্দী আগে এই প্রদেশেরই রঘুনন্দন নামে একজন ব্রাহ্মণ প্রণয়ন করেন...। দ্বিতীয়টি বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের হুকুমে তাঁরই রাজত্বকালে ‘ফতোয়া-ই-আলমগিরি’ নামে পাঁচটি খণ্ডে সংকলিত হয়— আমার কাছে যার একটি নিখুঁত এবং সুসংহত অনুলিপি আছে। [এ ছাড়া] ...হেস্টিংসের অনুরোধক্রমে হিন্দু আইনের যে গ্রন্থ সংকলিত হয়েছিল, সেটিও একই উদ্দেশ্যে কার্যকর হবে।” [৩১] যদিও তাঁর সংকলিত ও অনূদিত গ্রন্থে জোন্স রঘুনন্দনের দায়তত্ত্ব-কে সামান্যতম গুরুত্ব না দিয়ে হ্যালহেডের আইন সংকলনটির ওপর যাবতীয় গুরুত্ব আরোপ করেন।
চিঠিটিতে তিনি যে সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন, তা থেকে জানা যায় হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক আইনের জন্য নির্বাচিত গ্রন্থগুলির সংকলন ও অনুবাদের জন্য দুজন পণ্ডিত, দুজন মৌলবি— একজন শিয়া ও অন্যজন সুন্নি সম্প্রদায়ের— এবং দুজন লিপিকরের জন্য পারিশ্রমিক বাবদ যথাক্রমে মাসিক ২০০ টাকা ও ১০০ টাকা হিসাবে মাসে মোট খরচ হবে ১ হাজার সিক্কা টাকা। তবে এই বিশাল অঙ্কের পারিশ্রমিকের লোভে তাঁরা যাতে দীর্ঘদিন এ কাজে ব্যাপৃত না থাকতে পারেন, সেই কারণে তাঁদের কাজটি সম্পন্ন করার সময়সীমাও নির্দিষ্ট করে দিয়ে তিনি চিঠিতে জানান: “তিন বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ সংকলনটি শেষ করে তা লিপিবদ্ধ করতে হবে, যার মেয়াদ শেষ হলে তাদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে।” [৩২] যেহেতু রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের মূল বিবাদ-বিসংবাদটি সংস্কৃত ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থে বিধৃত শ্লোকসমূহের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, সেহেতু এই অধ্যায়ে আমরা মুসলমান আইনের বদলে কেবল ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন গ্রন্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা হিন্দু আইনের বিষয়টিতেই আমাদের আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখব।
এই গুরুদায়িত্ব পাওয়ার পরে, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন সংকলন গ্রন্থটিতে হিন্দুদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সম্ভাব্য সমস্ত বিষয়ে মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, নারদ, বৃহস্পতি, কাত্যায়ন প্রভৃতি ধর্মবেত্তাদের মতামত উদ্ধৃত করেন। অবশেষে তাঁর সহকারীদের প্রত্যক্ষ সহায়তায়, প্রায় চার বছর (১৭৮৮-১৭৯২) অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে তিনি প্রণয়ন করেন হিন্দু আইনের সংকলন বিবাদভঙ্গার্ণব। কিন্তু গ্রন্থটির অনুবাদ শেষ করার আগেই ১৭৯৪ সালের ২৭ এপ্রিল জোন্স মারা যান। তাঁর অবর্তমানে গভর্নর জেনারেল জন শোরের নির্দেশে হেনরি কোলব্রুক ১৭৯৬-এর ডিসেম্বরে সংকলন গ্রন্থটির অনুবাদ সম্পন্ন করেন। ১৭৯৭ সালে অনুবাদটি A Digest of Hindu Law on Contracts and Successions শিরোনামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ঔপনিবেশিক শাসকদের মনোবাঞ্ছা পূরণের উদ্দেশ্যে, এই সংস্কৃত গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করার সময়ে মহিলাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কিত কোন অংশটিতে জোন্স অতিরিক্ত নিজস্ব ব্যাখ্যা সংযোজন করেন, তা আমরা পরবর্তী আলোচনাতে দেখতে পাব।
মহিলাদের ক্ষেত্রে জোন্সের এহেন পক্ষপাতমূলক আচরণেরও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বর্তমান। ব্রিটিশ শাসকদের দ্বিতীয় আইনটি চালু করার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। এ কথা ঠিক, জোন্সের এই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যাবতীয় আর্থিক দায়ভার বহন করার সরকারি অনুমতি দেন লর্ড কর্নওয়ালিস। তবে যে সময়ে এই অনুবাদকর্মটি সমাপ্ত হয় (ডিসেম্বর ১৭৯৬), তত দিনে ভারতবর্ষের তৃতীয় গভর্নর জেনারেল জন শোর প্রশাসনিক ক্ষমতায় এসে গেছেন। এমনকি গভর্নর জেনারেল হওয়ার আগেও তাঁর মনোভাব যে এ বিষয়ে তাঁর পূর্ববর্তী শাসকদের থেকে আলাদা কিছু ছিল না, তারও একাধিক নিদর্শন পাওয়া যায়।
সম্পত্তি পরিচালনার ক্ষেত্রে মহিলাদের অযোগ্য মনে করে শোর তাদের ‘passive instruments’ রূপে সংজ্ঞায়িত করেন এবং মহিলাদের পরিবর্তে কোনও পুরুষ কর্মচারী বা মহিলাদের পুরুষ আত্মীয়স্বজনদের সেই দায়িত্ব পালনের পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এ বিষয়ে তিনি স্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করে লেখেন: “আমি মহিলা জমিদারদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করব, যা তাদের [সম্পত্তি] পরিচালনার বিরুদ্ধে আপত্তিগুলিকে শক্তিশালী করে সম্ভবত একটি নিয়মের প্রয়োজনীয়তার পরামর্শ দেবে এবং তারা [রাজস্ব] সংগ্রহের বিষয়ে অক্ষম বলে ঘোষণা করবে। ...তারা তাদের কর্মচারীদের কাছে নিছকই নিষ্ক্রিয় যন্ত্র মাত্র এবং তাদের প্রধান ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপিত করা হলেও [তারা] অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেনদেন সম্পর্কে অজ্ঞ।” [৩৩] এ প্রসঙ্গে জন শোর মনুর বিখ্যাত শ্লোক ‘পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে’-এর উল্লেখ করে নারীদের সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে মহিলা জমিদারদের ‘disqualified from management and interference in the collections’ [৩৪] বলে ঘোষণা করেন।
হেস্টিংস, হ্যালহেড, কর্নওয়ালিস ও জন শোরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জোন্স তাঁর অনুবাদের একটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করে নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কিত হ্যালহেডের রেখে যাওয়া ফাঁকটিকে পুরোপুরি ভরাট করে দেন। মনুসংহিতা-য় লিখিত আছে:
ঊর্দ্ধং পিতুশ্চ মাতুশ্চ সমেত্য ভ্রাতরঃ সমম্।
ভজেরন্ পৈতৃকং রিকথ্মনীশাস্তে হি জীবতোঃ।। ৯. ১০৪
(পিতা ও মাতার মৃত্যুর পরে ভ্রাতৃগণ মিলিত হয়ে পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ করবে; কারণ, তাঁরা জীবিত থাকতে পুত্রগণ [সম্পত্তির] অধিকারী নয়)। [৩৫] অথচ এই শ্লোকটির অনুবাদের সময়ে জোন্স অতিরিক্ত ভাষ্য হিসাবে সংযোজন করেন, ‘unless the father chooses to distribute it’। [৩৬] [নজরটান জোন্সের] যদিও পিতা তাঁর সম্পত্তির পরবর্তী উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজস্ব পছন্দটি কীভাবে— মৌখিক না লিখিত— ব্যক্ত করবেন, সে বিষয়ে আইনে ইচ্ছাকৃতভাবেই কোনও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়নি। অতঃপর এই আইনি ফাঁকের সাহায্য নিয়ে, পিতার মৃত্যুর পরে বিধবা স্ত্রীকে তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ন্যায্য সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাঁর জীবদ্দশাতেই পুত্ররা নিজেদের মধ্যে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা করতে শুরু করে।
এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটির ফলে যেমন বিধবা স্ত্রীকে তাঁর জীবদ্দশাতেই স্বামীর সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তেমনই অবিবাহিতা কন্যাদেরও পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। নবম অধ্যায়ের অন্য একটি শ্লোকে এ বিষয়ে মনু বলেন:
স্বেভ্যো[হং]শেভ্যস্তু কন্যাভ্যঃ প্রদদ্যুর্ভ্রাতরঃ পৃথক্।
স্বাৎ স্বাদংশাচ্চতুর্ভাগং পতিতাঃ স্যুরদিৎসবঃ।। ৯. ১১৮
ভরতচন্দ্র শিরোমণি এই শ্লোকটির দীর্ঘ ব্যাখ্যা করে একদম শেষ বাক্যে জানিয়েছেন: (...পিতার মরণোত্তর পুত্রের ন্যায় অবিবাহিতা কন্যারাও অংশিনী হইবে এবং বিবাহব্যয়ের অবশিষ্ট যাহা থাকিবে, তাহা কন্যারা পাইবে, এরূপ অংশ ভগিনীদিগকে না দিলে পতিত হয়)। [৩৭] কিন্তু জোন্সের অনুবাদের ‘সৌজন্যে’ অবিবাহিতা কন্যারাও এ বিষয়ে যাবতীয় অধিকার হারাতে বাধ্য হন।
এইভাবে একে একে দায়ভাগের অনুল্লেখ, বিধবা স্ত্রীর জীবিত অবস্থায় সন্তানদের পিতৃসম্পত্তির বিলিবন্টন, স্ত্রীধনের বিলোপসাধন পর্বের একদম শেষ পর্যায়ে বিধবা স্ত্রী ও অবিবাহিতা কন্যাদের সম্পত্তির ন্যায্য অধিকারের প্রসঙ্গটিকে পুরোপুরি খতম করে দেন জোন্স। মনুসংহিতা ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রকে নিছক আত্মরক্ষার ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে নারীদের ওপর নিজস্ব ভাষ্যের তলোয়ারটি সুনিপুণ হস্তে চালনা করেন তিনি, অথচ কোথাও রক্তপাতের সামান্যতম চিহ্নটুকুও দেখা যায় না।
(আগামী পর্বে শেষ হবে।)
***********************************************************************
উল্লেখপঞ্জি:
১. Footnote 2, Letter No. 485; Garland Cannon (ed.), The Letters of Sir William Jones, Vol. II, Oxford, 1970, pp. 794-95
২. S. N. Mukherjee, Sir William Jones: A Study in Eighteenth-Century British Attitudes to India, Cambridge, 1968, p. 76
৩. Letter No 418; Garland Cannon (ed.), The Letters of Sir William Jones, Vol. II, pp. 683-84
৪. Letter No 465; তদেব, পৃ. ৭৬২
৫. Letter No 485; তদেব, পৃ. ৭৯৫
৬. Letter No 388; তদেব, পৃ. ৬৪৬
৭. Letter No 396; তদেব, পৃ. ৬৬৪
৮. Letter No 416; তদেব, পৃ. ৬৮০
৯. Rajesh Kochhar, Sanskrit and the British Empire, New York, 2021, p. 42
১০. Letter No 417; Garland Cannon (ed.), The Letters of Sir William Jones, Vol. II, p. 682
১১. Letter No 446; তদেব, পৃ. ৭১৮
১২. Letter No. 433; তদেব, পৃ. ৬৯৯
১৩. William Jones, Institutes of Hindu Law: Or, the Ordinances of Menu, According to the Gloss of Culluca, Calcutta, 1796, p. iv; এরপর কেবল Institutes of Hindu Law লেখা হবে।
১৪. Letter No 485; Garland Cannon (ed.), The Letters of Sir William Jones, Vol. II, p. 797
১৫. William Jones, Institutes of Hindu Law, p. iv
১৬. ভরতচন্দ্র শিরোমণি, মনুসংহিতা, পৃ. ২১৭
১৭. তদেব, পৃ. ৭৫৯
১৮. তদেব, পৃ. ৭৬০
১৯. তদেব, পৃ. ১৭২-৭৩
২০. তদেব, পৃ. ৪৬৯
২১. তদেব, পৃ. ৪৭০
২২. তদেব, পৃ. ৪৭১
২৩. তদেব, পৃ. ৭৬৩
২৪. তদেব, পৃ. ৪৭৩
২৫. William Jones, Institutes of Hindu Law, p. xv
২৬. তদেব, p. xvi
২৭. Letter No. 487; Garland Cannon (ed.), The Letters of Sir William Jones, Vol. II, p. 802
২৮. S. N. Mukherjee, Sir William Jones: A Study in Eighteenth-Century British Attitudes to India, pp. 137-38
২৯. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৭২০
৩০. Letter No. 485; Garland Cannon (ed.), The Letters of Sir William Jones, Vol. II, pp. 794-95
৩১. তদেব, পৃ. ৭৯৫-৯৭
৩২. তদেব, পৃ. ৭৯৮
৩৩. Shore’s Minute of 18th June 1789; W. K. Firminger (ed.), The Fifth Report from the Select Committee of the House of Commons on the Affairs of the East India Company, Vol. II, Calcutta, 1917, p. 72
৩৪. তদেব, পৃ. ৭৩
৩৫. ভরতচন্দ্র শিরোমণি, মনুসংহিতা, পৃ. ৭৮৮
৩৬. William Jones, Institutes of Hindu Law, p. 258
৩৭. ভরতচন্দ্র শিরোমণি, মনুসংহিতা, পৃ. ৭৯৩
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।