বছর দুয়েক আগে এই সময়ে অনেকেরই হোয়াটসঅ্যাপে একটি চোথা ঘুরে বেড়িয়েছিল। যাঁরা রবীন্দ্রনাথ না পড়েই রবীন্দ্রভক্ত, তাঁদের অনেকেই সেটা হুলিয়ে ফরওয়ার্ড করে বিজেপিকে আরও বেশি বেশি সার-জল দিয়ে পুষ্ট করেছিলেন। কিছু মানুষ অবশ্য সন্দেহও প্রকাশ করেছিলেন। সেটি যে আবার মওকা বুঝে ব্যবহৃত হবে না, সে সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। তবে এবারে এই ওঁচাটে চোথাটি পুনরায় ফরওয়ার্ড করার আগে এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী বলেছিলেন, সেটা একটু যাচাই করে নেওয়া ভালো।
চোথাটি শুরু হয়েছিল অবিকল এই ভাষায়— ‘সবাই আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। তিনি ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে কী বলেছেন সেটা জানা দরকার। যারা ইসলামকে শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম, সব ধর্ম সমান বলে চিল্লান তাদের থেকে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানী ছিলেন’। আর শেষ হয়েছিল এই কথাগুলো দিয়ে— ‘যেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো কবি মুসলিমের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন সেখানে বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও কীভাবে হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই এসব উচ্চারণ করি? অবাক্ হই, হতবাক্ হই। রবীন্দ্রনাথকে জানুন, চিন্তা করুন’। সঙ্গে টাকনা হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের নানা প্রবন্ধ ও চিঠি থেকে খাবলা মারা কিছু অংশ। আমরা প্রত্যেকটাকেই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখব।
১. যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে। (অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র : ১১)
অমিয় চক্রবর্তীকে ওইদিন লেখা পুরো চিঠি।
কল্যাণীয়েষু,
এইমাত্র তোমার প্রেরিত দুখানা প্যাম্ফলেট শেষ করে তোমাকে লিখতে বসলুম। মাদ্রাজ থেকে তোমাকে একখানা চিঠি পাঠিয়েছি বোধ হয় পেয়েচ। ভারতবর্ষের প্রদেশে প্রদেশে নাচগান বর্ষণ করে বেড়ানো এই আমার এক কাজ হয়েচে। হাসি পায় মনে করলে যখন ভাবি এই সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রনেতারা সমস্ত দেশ জুড়ে বক্তৃতামঞ্চে কন্গ্রেসের উত্তেজনা বিস্তার করে বেড়াচ্ছেন, তার গুরুত্ব সম্বন্ধে কারো মনে কোনো সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু কী স্তূপাকার অবাস্তবতা, কৃত্রিমতা। এক প্রদেশের সঙ্গে আর এক প্রদেশের অনেক কেবল ভাষাগত নয় স্থানগত নয় মজ্জাগত। পরস্পরের মানবসম্বন্ধ কেবল যে শিথিল তা নয়, অনেকস্থলেই বিরুদ্ধ। আমরা ভোটর ভাগ বিভাগ নিয়ে তুমুল তর্ক বাধিয়েছি, যেন অন্তরের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাক্লেও ভোটের সামঞ্জস্যে এই ফাটল ধরা দেশের সর্বনাশ নিবারণ করতে পারবে। আজকাল আমি সমস্ত ব্যাপারটাকে নিস্পৃহ বৈজ্ঞানিকভাবে দেখবার চেষ্টা করি; মরবার কারণ যেখানে আছে সেখানে মরেই এর চেয়ে সহজ কথা কিছুই নেই। পার্লামেন্টরি রাষ্ট্রতন্ত্র! একি বিলিতি দাওয়াইখানা থেকে ভিক্ষে করে আন্লেই তখনি আমাদের ধাতের সঙ্গে মিলে যাবে! নিয়ুয়র্কের আকাশ-আঁচড়া বাড়ি আমাদের পলিমাটির উপর বসিয়ে দিলে সেটা তার অধিবাসীদের কবর হয়ে উঠবে। সাদা কাগজের মোড়কে আমাদের ভাগে কী দান কী পরিমাণে এসে পৌঁছল সেটা বেশি কথা নয়, যাকে দেওয়া হচ্চে তারি পাঁচ আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে কতটা টেকে সেইটেই ভাববার বিষয়। সত্যি কথা বল্তে গেলে আমার আশ্চর্য্য বোধ হয় যে আমাদের এতখানি দিতে প্রস্তুত হয়েচে। সন্দেহ নেই যে এই দেওয়াটাই শেষ কথা নয়, এটা আমাদের ভবিষ্যতের বড়ো দাবীকে উত্তেজিত করে দেওয়া মাত্র— থলির মুখ খুলল, এর পরে শেষ পর্য্যন্ত থলি ঝেড়ে দিতে হবে,— ওর শিলমোহরটা এবার টুট্ল। বিদেশী সাম্রাজ্যের এতটা দাক্ষিণ্য ইংরেজজাতের ছাড়া আর কোনো জাতের হাত দিয়ে হতে পারত না। হয়তো এই দানের সঙ্গে সঙ্গে সুবুদ্ধিও আছে। জগৎ জুড়ে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘূর্ণিবাতাস জেগে উঠচে তাতে ভারতবর্ষের মন না পেলে ভারতবর্ষকে শেষ পর্যন্ত আয়ত্ত করা সম্ভব হতে পারে না। যে মুসলমানকে আজ ওরা সকলরকমে প্রশ্রয় দিচ্চে সেই মুসলমানই একদিন মুষল ধরবে। যাই হোক্, লুব্ধতা স্বভাবে প্রবল থাকলে সুবুদ্ধির দূরদর্শিতা কাজ করতে পারে না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস য়ুরাপের অন্য যে কোনো জাত এমন কি আমেরিকান কর্তা হলে ভারতবর্ষের গলার ফঁসে আরো লাগাত জোর— নিজেদের নির্ম্মম বাহুবলের পরেই সম্পূর্ণ ভরসা রাখত।— আমাদের তরফে একটা কথা বলবার আছে, ইংরেজের শাসনে যতই দাক্ষিণ্য থাক্ আজ পর্য্যন্ত না মিলল আমাদের উপযুক্ত শিক্ষা, না জুটল যথেষ্ট পরিমাণে পেটের ভাত, না ঘটল স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা। শাসনতন্ত্রের কাঠামো রক্ষা করতেই পুঁজি শেষ হয়ে আসে, প্রজাদের মানুষ করে তুলতে হাতে কিছুই থাকে না। এই ঔদাসীন্য আমাদের শতাব্দী ধরে হাড়ে মজ্জায় জীর্ণ করে দিল। আমাদের পাহারা আছে আহার নেই এমন অবস্থা আর কতদিন চল্বে। অথচ ওদের নিজের দেশে প্রজার অন্নাভাব সম্বন্ধে ওদের কত চিন্তা কত চেষ্টা। কেননা ওরা ভালো করেই জানে আধপেটা অবস্থায় কোনো জাতের মনুষ্যত্ব রক্ষা হয় না। আমাদের বেলায় সেই মনুষ্যত্বের মাপকাঠি ওরা ছোটো করে নিয়েছে তারি নির্ম্মমতা আমাদের সুদূর ভাবীকালকে পর্য্যন্ত অভিভূত করে রেখেছে। তাই মনে হয় নিজেদের স্বভাবগত সমাজগত প্রথাগত সকলপ্রকার দুর্ব্বলতা সত্ত্বেও নিজের দেশের ভার যে করেই হোক নিজেকেই নিতে হবে। পরের উপর নির্ভর করে থাকলে দুর্বলতা বেড়েই চলে, তা ছাড়া ইতিহাসের আবহমান দশাচক্রে অনন্তকাল ইংরেজের শাসন অচলপ্রতিষ্ঠ থাকতেই পারে না। নিজের ভাগ্য নানা ভুলচুক নানা দুঃখকষ্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়েই নিজে নিয়ন্ত্রিত করবার শিক্ষা আমাদের পাওয়া চাই।— সেই শিক্ষার আরম্ভপথ আমার অতি ক্ষুদ্র শক্তি অনুসারেই আমি নিয়েছিলুম। য়ুরোপের মতো আমাদের জনসমূহ নাগরিক নয়,— চিরদিনই চীনের মতোই ভারতবর্ষ পল্লীপ্রধান। নাগরিক চিত্তবৃত্তি নিয়ে ইংরেজ আমাদের সেই ঘনিষ্ঠ পল্লীজীবনের গ্রন্থি কেটে দিয়েছে। তাই আমাদের মৃত্যু আরম্ভ হয়েছে ঐ নীচের দিক দিয়ে। সেখানে কী অভাব কী দুঃখ কী অন্ধতা কী শোচনীয় নিঃসহায়তা, বলে শেষ করা যায় না। এইখানেই পুনর্ব্বার প্রাণসঞ্চার করবার সামান্য আয়োজন করেছি, না পেয়েছি দেশের লোকের কাছ থেকে উৎসাহ, না পেয়েছি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সহায়তা। তবু আঁকড়ে ধরে আছি। দেশকে কোন্ দিক থেকে রক্ষা করতে হবে আমার তরফ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর আমার এই গ্রামের কাজে। এতদিন পরে মহাত্মাজি হঠাৎ এই কাজে পা বাড়িয়েছেন। তিনি মহাকায় মানুষ, তাঁর পদক্ষেপ খুব সুদীর্ঘ। তবু মনে হয় অনেক সুযোগ পেরিয়ে গেছেন— অনেক আগে সুরু করা উচিত ছিল, এ কথা আমি বারবার বলেচি। আজ তিনি কন্গ্রেস ত্যাগ করেছেন। স্পষ্ট না বলুন এর অর্থ এই যে কন্গ্রেস জাতিসংঘটনের মূলে হাত দিতে অক্ষম। যেখানে কাজের সমবায়তা স্বল্প সেখানে নানা মেজাজের মানুষ মিল্লে অনতিবিলম্বে মাথা ঠোকাঠুকি করে মরে। তার লক্ষণ নিদারুণ হয়ে উঠেছে। এই সম্মিলিত আত্মকলহের ক্ষেত্রে কোনো স্থায়ী কাজ কেউ করতে পারে না। আমার অল্পশক্তিতে আমি বেশি কিছু করতে পারি নি কিন্তু এই কথা মনে রেখো পাবনা কন্ফারেন্স থেকে আমি বরাবর এই নীতিই প্রচার করে এসেচি। আর, শিক্ষাসংস্কার এবং পল্লীসঞ্জীবনই আমার জীবনের প্রধান কাজ। এর সংকল্পের মূল্য আছে, ফলের কথা আজ কে বিচার করবে।— খেলাচ্ছলে আমার তিনটে গানের ইংরেজি তর্জ্জমা করেছি তোমাকে এই সঙ্গে পাঠাই। ইতি ১৫ নবেম্বর ১৯৩৪
স্নেহানুরক্ত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. চল্লিশলাখ হিন্দু একলাখ মুসলিমদের ভয়ে মারাত্মকভাবে অভিভূত। (আনন্দবাজার পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, ৫.৯.১৯২৩)
কেবল এইটা খুঁজে পাইনি। যদি কেউ খুঁজে পেয়ে থাকেন তাহলে দেবেন।
৩. যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭, কালান্তর)
আমাদের দেশে যখন স্বদেশী-আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলেম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয় নি, বিরুদ্ধ ছিল; জননায়কেরা কেউ কেউ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক। জানি, ওরা যোগ দেয় নি। কিন্তু, কেন দেয় নি। তখন বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এত প্রবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য! কিন্তু, এতবড়ো আবেগ শুধু হিন্দুসমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল, মুসলমানসমাজকে স্পর্শ করল না! সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয় নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি।
আমি যখন আমার জমিদারি সেরেস্তায় প্রথম প্রবেশ করলেম তখন একদিন দেখি, আমার নায়েব তাঁর বৈঠকখানায় এক জায়গায় জাজিম খানিকটা তুলে রেখে দিয়েছেন। যখন জিজ্ঞেস করলেম, ‘এ কেন’ তখন জবাব পেলেম, যে-সব সম্মানী মুসলমান প্রজা বৈঠকখানায় প্রবেশের অধিকার পায় তাদের জন্য ঐ ব্যবস্থা। এক তক্তপোষে বসাতেও হবে অথচ বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা পৃথক। এ প্রথা তো অনেক দিন ধরে চলে এসেছে; অনেকদিন মুসলমান এ মেনে এসেছে, হিন্দুও মেনে এসেছে। জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে। তার পর ওদের ডেকে একদিন বলেছি, ‘আমরা ভাই, তোমাকেও আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে।’ তখন হঠাৎ দেখি অপর পক্ষ লাল টক্টকে নতুন ফেজ মাথায় দিয়ে বলে, আমরা পৃথক। আমরা বিস্মিত হয়ে বলি, রাষ্ট্র ব্যাপারে পরস্পর পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায়। বাধা ঐ জাজিম-তোলা আসনে বহুদিনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছোটো নয়। ওখানে অকূল অতল কালাপানি। বক্তৃতামঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই পার হওয়া যায় না।
আজকে দেখতে হবে, আমাদের হিন্দুসমাজের কোথায় কোন্ ছিদ্র, কোন্ পাপ আছে, অতি নির্মমভাবে তাকে আক্রমণ করা চাই। এই উদ্দেশ্য মনে নিয়ে আজ হিন্দুসমাজকে আহ্বান করতে হবে; বলতে হবে, পীড়িত হয়েছি আমরা, লজ্জিত হয়েছি, বাইরের আঘাতের জন্য নয়, আমাদের ভিতরের পাপের জন্য; এসো সেই পাপ দূর করতে সকলে মিলি। আমাদের পক্ষে এ বড়ো সহজ কথা নয়। কেননা, অন্তরের মধ্যে বহুকালের অভ্যস্ত ভেদবুদ্ধি, বাইরেও বহুদিনের গড়া অতি কঠিন ভেদের প্রাচীর। মুসলমান যখন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে মুসলমান সমাজকে ডাক দিয়েছে, সে কোনো বাধা পায় নি– এক ঈশ্বরের নামে ‘আল্লাহো আক্বর’ বলে সে ডেকেছে। আর আজ আমরা যখন ডাকব ‘হিন্দু এসো’ তখন কে আসবে। আমাদের মধ্যে কত ছোটো ছোটো সম্প্রদায়, কত গণ্ডী, কত প্রাদেশিকতা– এ উত্তীর্ণ হয়ে কে আসবে। কত বিপদ গিয়েছে। কই একত্র তো হই নি। বাহির থেকে যখন প্রথম আঘাত নিয়ে এল মহম্মদ ঘোরী তখন হিন্দুরা সে আসন্ন বিপদের দিনেতেও তো একত্র হয় নি। তার পর যখন মন্দিরের পর মন্দির ভাঙতে লাগল, দেবমূর্তি চূর্ণ হতে লাগল, তখন তারা লড়েছে, মরেছে, খণ্ড খণ্ড ভাবে যুদ্ধ করে মরেছে। তখনও একত্র হতে পারল না। খণ্ডিত ছিলেম বলেই মেরেছে, যুগে যুগে এই প্রমাণ আমরা দিয়েছি। কখনও কখনও ইতিহাস উদ্ঘাটন করে অন্য প্রমাণ পাবার চেষ্টা করি বটে; বলি, শিখরা তো একসময় বাধা ঘুচিয়েছিল। শিখরা যে বাধা ঘুচিয়েছিল সে তো শিখধর্ম দ্বারাই। পাঞ্জাবের কোথাকার জাঠ, কোথাকার কোন্ জাতি সব, শিখধর্মের আহ্বানে একত্র হতে পেরেছিল; বাধাও দিতে পেরেছিল; ধর্মকেও রক্ষা করতে এক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিবাজি একসময় ধর্মরাজ্যস্থাপনের ভিত গেড়েছিলেন। তাঁর যে অসাধারণ শক্তি ছিল তদ্দ্বারা তিনি মারাঠাদের একত্র করতে পেরেছিলেন। সেই সম্মিলিত শক্তি ভারতবর্ষকে উপদ্রুত করে তুলেছিল। অশ্বের সঙ্গে অশ্বারোহীর যখন সামঞ্জস্য হয় কিছুতেই সে অশ্ব থেকে পড়ে না; শিবাজির হয়ে সেদিন যারা লড়েছিল তাদের সঙ্গে শিবাজির তেমনি সামঞ্জস্য হয়েছিল। পরে আর সে সামঞ্জস্য রইল না, পেশোয়াদের মনে ও আচরণে ভেদবুদ্ধি, খণ্ড খণ্ড স্বার্থবুদ্ধি তীক্ষ্ম হয়ে ক্ষণকালীন রাষ্ট্রবন্ধনকে টুকরো টুকরো করে দিলে। আমার কথা এই যে, আমাদের মধ্যে এই-যে পাপ পুষে রেখেছি এতে কি শুধু আমাদেরই অকল্যাণ, সে পাপে কি আমরা প্রতিবেশীদের প্রতি অবিচার করি নে, তাদের মধ্যে হিংসা জাগিয়ে তুলি নে? যে দুর্বল সেই প্রবলকে প্রলুব্ধ করে পাপের পথে টেনে আনে। পাপের প্রধান আশ্রয় দুর্বলের মধ্যে। অতএব যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই– তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা। আপনার জন্যেও, প্রতিবেশীর জন্যেও আমাদের নিজেদের দুর্বলতা দূর করতে হবে। আমরা প্রতিবেশীদের কাছে আপিল করতে পারি, তোমরা ক্রূর হোয়ো না, তোমরা ভালো হও, নরহত্যার উপরে কোনো ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না– কিন্তু সে আপিল যে দুর্বলের কান্না। বায়ুমণ্ডলে বাতাস লঘু হয়ে এলে ঝড় যেমন আপনিই আসে, ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না, তেমনি দুর্বলতা পুষে রেখে দিলে সেখানে অত্যাচার আপনিই আসে– কেউ বাধা দিতে পারে না। কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটা উপলক্ষ্য নিয়ে পরস্পর কৃত্রিম বন্ধুতাবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি, কিন্তু চিরকালের জন্য তা হয় না। যে মাটিতে কণ্টকতরু ওঠে সে মাটিকে যতক্ষণ শোধন না করা হয় ততক্ষণ তো কোনো ফল হবে না।
আপনার লোককেও যে পর করেছে, পরের সঙ্গেও যার আত্মীয়তা নেই, সে তো ঘাটে এসেছে, তার ঘর কোথায়। আর তার শ্বাসই বা কতক্ষণ। আজ আমাদের অনুতাপের দিন, আজ অপরাধের ক্ষালন করতে হবে। সত্যিকার প্রায়শ্চিত্ত যদি করি তবেই শত্রু আমাদের মিত্র হবে, রুদ্র আমাদের প্রতি প্রসন্ন হবেন।
৪. কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭, কালান্তর)
হিন্দুতে মুসলমানে কেবল যে এই ধর্মমত ভেদ তা নয়, তাদের উভয়ের মধ্যে একটা সামাজিক শক্তির অসমকক্ষতা ঘটেছে। মুসলমানের ধর্মসমাজের চিরাগত নিয়মের জোরেই তার আপনার মধ্যে একটা নিবিড় ঐক্য জমে উঠেছে, আর হিন্দুর ধর্মসমাজের সনাতন অনুশাসনের প্রভাবেই তার আপনার মধ্যে একটা প্রবল অনৈক্য ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। এর ফল এই যে, কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন ঘটলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। তার কারণ এ নয়, মুসলমানের গায়ে জোর আছে, হিন্দুর নেই; তার আসল কারণ, তাদের সমাজের জোর আছে, হিন্দুর নেই। এক দল আভ্যন্তরিক বলে বলী, আর-এক দল আভ্যন্তরিক দুর্বলতায় নির্জীব। এদের মধ্যে সমকক্ষভাবে আপোষ ঘটবে কী করে। অত্যন্ত দুর্যোগের মুখে ক্ষণকালের জন্যে তা সম্ভব, কিন্তু যেদিন অধিকারের ভাগ-বাটোয়ারার সময় উপস্থিত হয় সেদিন সিংহের ভাগটা বিসদৃশরকম বড়ো হয়ে ওঠে, তার কারণটা তার থাবার মধ্যে। গত য়ুরোপীয় যুদ্ধে যখন সমস্ত ইংরেজ জাতের মুখশ্রী পাংশুবর্ণ হয়ে উঠেছিল, তখন আমাদের মতো ক্ষীণপ্রাণ জাতকেও তারা আদর করে সহায়তার জন্যে ডেকেছিল। শুধু তাই নয়, ঘোর বিষয়ী লোকেরও যেমন শ্মশানবৈরাগ্যে কিছুক্ষণের জন্যে নিষ্কাম বিশ্বপ্রেম জন্মায়, তেমনি যুদ্ধশেষের কয়েক দণ্ড পরেও রক্ত-আহুতি-যজ্ঞে তাদের সহযোগী ভারতীয়দের প্রতি তাদের মনে দাক্ষিণ্যেরও সঞ্চার হয়েছিল। যুদ্ধের ধাক্কাটা এল নরম হয়ে, আর তার পরেই দেখা দিল জালিয়ান-বাগে দানবলীলা, আর তার পরে এল কেনিয়ায় সাম্রাজ্যের সিংহদ্বারে ভারতীয়দের জন্যে অর্ধচন্দ্রের ব্যবস্থা। রাগ করি বটে, কিন্তু সত্য সমকক্ষ না হয়ে উঠলে সমকক্ষের ব্যবহার পাওয়া যায় না। এই কারণেই মহাত্মাজি খুব একটা ঠেলা দিয়ে প্রজাপক্ষের শক্তিটাকে রাজপক্ষের অনুভবযোগ্য করে তোলবার চেষ্টা করেছেন। উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষনিষ্পত্তিই তাঁর লক্ষ্য ছিল। এই আপোষনিষ্পত্তি সবল-দুর্বলের একান্ত ভেদ থাকলে হতেই পারে না। আমরা যদি ধর্মবলে রাজার সিংহাসনে ভূমিকম্প ঘটাতে পারতুম, তা হলে রাজার বাহুবল একটা ভালোরকম রফা করবার জন্যে আপনিই আমাদের ডাক পাড়ত। ভারতবর্ষে হিন্দুতে মুসলমানে প্রতিনিয়তই পরস্পর রফানিষ্পত্তির কারণ ঘটবে। অসমকক্ষতা থাকলে সে নিষ্পত্তি নিয়তই বিপত্তির আকার ধারণ করবে। ঝরনার জল পানের অধিকার নিয়ে একদা বাঘ ও মেষের মধ্যে একটা আপোষের কন্ফারেন্স বসেছিল; ঈশপের কথামালায় তার ইতিহাস আছে। উপসংহারে প্রবলতর চতুস্পদটি তর্কের বিষয়টাকে কিরকম অত্যন্ত সরল করে এনেছিল সে কথা সকলেরই জানা আছে। ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তা হলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সেই সমকক্ষতা তাল-ঠোকা পালোয়ানির ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয়পক্ষের সামাজিক শক্তির সমকক্ষতা।
৫. এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮, শান্তিনিকেতন)
মুসলমানধর্ম প্রবল ধর্ম, এবং তা নিশ্চেষ্ট ধর্ম নয়। এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিসাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তন কাজ করেছে।
এই আঘাতবেগ যখন অত্যন্ত প্রবল, তখনকার ধর্ম-ইতিহাস আমরা দেখতে পাই নে। কারণ, সে ইতিহাস সংকলিত ও লিপিবদ্ধ হয় নি। কিন্তু, সেই মুসলমান-অভ্যাগমের যুগে ভারতবর্ষে যে-সকল সাধক জাগ্রত হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের বাণী আলোচনা করে দেখলে স্পষ্ট দেখা যায়। ভারতবর্ষ আপন অন্তরতম সত্যকে উদ্ঘাটিত করে দিয়ে এই মুসলমানধর্মের আঘাতবেগকে সহজেই গ্রহণ করতে পেরেছিল।
সত্যের আঘাত কেবল সত্যই গ্রহণ করতে পারে। এইজন্য প্রবল আঘাতের মুখে প্রত্যেক জাতি হয় আপনার শ্রেষ্ঠ সত্যকে সমুজ্জ্বল করে প্রকাশ করে, নয় আপনার মিথ্যা সম্বলকে উড়িয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়। ভারতবর্ষেরও যখন আত্মরক্ষার দিন উপস্থিত হয়েছিল তখন সাধকের পর সাধক এসে ভারতবর্ষের চিরসত্যকে প্রকাশ করে ধরেছিলেন। সেই যুগের নানক রবিদাস কবীর দাদু প্রভৃতি সাধুদের জীবন ও রচনা যাঁরা আলোচনা করছেন তাঁরা সেই সময়কার ধর্ম-ইতিহাসের যবনিকা অপসারিত করে যখন দেখাবেন তখন দেখতে পাব ভারতবর্ষ তখন আত্মসম্পদ সম্বন্ধে কিরকম সবলে সচেতন হয়ে উঠেছিল।
ভারতবর্ষ তখন দেখিয়েছিল, মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়। দেখিয়েছিল, ভারতবর্ষের মর্মস্থলে সত্যের একটি বিপুল সাধনা সঞ্চিত হয়ে আছে যা সকল সত্যকে আত্মীয় বলে গ্রহণ করতে পারে। এইজন্যেই সত্যের আঘাত তার বাইরে এসে যতই ঠেকুক তার মর্মে গিয়ে কখনো বাজে না, তাকে বিনাশ করে না।
আজ আবার পাশ্চাত্যজগতের সত্য আপনার জয়ঘোষণা করে ভারতবর্ষের দুর্গদ্বাদের আঘাত করেছে। এই আঘাত কি আত্মীয়ের আঘাত হবে না শত্রুর আঘাত হবে? প্রথম যেদিন সে শৃঙ্গধ্বনি করে এসেছিল সেদিন তো মনে করেছিলুম সে বুঝি মৃত্যুবাণ হানবে। আমাদের মধ্যে যারা ভীরু তারা মনে করেছিল ভারতবর্ষের সত্যসম্বল নেই, অতএব এইবার তাকে তার জীর্ণ আশ্রয় পরিত্যাগ করতে হল বুঝি।
কিন্তু, তা হয় নি। পৃথিবীর নব আগন্তুকের সাড়া পেয়ে ভারতবর্ষের নবীন সাধকেরা নির্ভয়ে তার বহু দিনের অবরুদ্ধ দুর্গের দ্বার খুলে দিলেন। ভারতবর্ষের সাধনভাণ্ডারে এবার পাশ্চাত্য অতিথিকে সমাদরে আহ্বান করা হয়েছে– ভয় নেই, কোনো অভাব নেই– এইবার যে ভোজ হবে সেই আনন্দভোজে পূর্ব পশ্চিম এক পঙ্ক্তিতে বসে যাবে।
৬. হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, পরিচয়)
আমাদের দেশে ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ঐক্যলাভের চেষ্টা যখনই প্রবল হইল, অর্থাৎ যখনই নিজের সত্তা সম্বন্ধে আমাদের বিশেষভাবে চেতনার উদ্রেক হইল তখনই আমরা ইচ্ছা করিলাম বটে মুসলমানদিগকেও আমাদের সঙ্গে এক করিয়া লই, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। এক করিয়া লইতে পারিলে আমাদের সুবিধা হইতে পারিত বটে, কিন্তু সুবিধা হইলেই যে এক করা যায় তাহা নহে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজনসাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্যকে যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজনকে মানিবে না।
হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুইপক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,— সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।
মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কি না, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসংগত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।
৭. ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৮৫, ইতিহাস)
এ দিকে অনতিপূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খণ্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচণ্ড আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহারা যেন ভিন্ন ভিন্ন দুর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খণ্ড তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে অজ্ঞাত হইয়া বিরাজ করিতেছিল। কখন প্রচণ্ড সূর্যের উদয় হইল এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তুষারস্রুত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎকে চতুর্দিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইল।
তখন শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত; এবং বৌদ্ধধর্ম বিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতোহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। তখন ধর্মে সমাজে শাস্ত্রে কোনো বিষয়ে নবীনতা ছিল না, গতি ছিল না, বৃদ্ধি ছিল না, সকল বিষয়েই যেন পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, নূতন আশা করিবার বিষয় নাই। সে সময়ে নূতনসৃষ্ট মুসলমানজাতির বিশ্ববিজয়োদীপ্ত নবীন বল সম্বরণ করিবার উপযোগী কোনো একটা উদ্দীপনা ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল না।
নবভাবোৎসাহে এবং ঐক্যপ্রবণ ধর্মবলে একটা জাতি যে কিরূপ মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করে পরবর্তীকালে শিখগণ তাহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছিল।
কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুন্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। মুসলমানদের যুদ্ধের মধ্যে এক দিকে ধর্মোৎসাহ, অপর দিকে রাজ্য অথবা অর্থ-লোভ ছিল; কিন্তু হিন্দুরা চিতা জ্বালাইয়া স্ত্রীকন্যা ধ্বংস করিয়া আবালবৃদ্ধ মরিয়াছে– মরা উচিত বিবেচনা করিয়া; বাঁচা তাহাদের শিক্ষাবিরুদ্ধ সংস্কারবিরুদ্ধ বলিয়া। তাহাকে বীরত্ব বলিতে পার কিন্তু তাহাকে যুদ্ধ বলে না। তাহার মধ্যে উদ্দেশ্য অথবা রাষ্ট্রনীতি কিছুই ছিল না।
প্রসঙ্গত প্রবন্ধটির নাম ইতিহাস নয়, মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস।
৮. প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না। (হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)
পুরো চিঠিটা দিলাম।
কল্যাণীয়াসু
তুমি নিজেকে অত্যন্ত মিথ্যা পীড়ন কর। তোমার প্রতি আমার লেশমাত্র রোষ বা অবজ্ঞার ভাব নেই সে তুমি নিশ্চয় জানো তবু থেকে থেকে নিজের মধ্যে একটা বিপ্লব বাধিয়ে তোলো। তোমাকে উপলক্ষ্য করে আমি অনেক কথা বলি কিন্তু তোমাকে বলি নে। দেশের অসীম দুর্গতির কথায় মন যখন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তখন চুপ করে থাকতে পারি নে। ধর্ম্মে ও নিরর্থক আচারে হিন্দুকে শতধা বিভক্ত করে রেখেচে, বিদেশীর হাতে তাই পরাভবের পর পরাভব ভোগ করে আসচি। অন্তঃশত্রু এবং বহিঃশত্রুর হাতে মার খেয়ে খেয়ে আমাদের হাড় জীর্ণ। মুসলমান, ধর্ম্মে এক, আচারে এক, বাংলার মুসলমান, মাদ্রাজের মুসলমান, পাঞ্জাবের মুসলমান এবং ভারতবর্ষের বাইরের মুসলমান সমাজে সবাই এক, বিপদে আপদে সবাই এক হয়ে দাঁড়াতে পারে এদের সঙ্গে ভাঙাচুরো হিন্দুজাত পারবে না। আরো একবার আফগানিস্থানের পাঠানদের হাতে কানমলা খাবার দিন ঘনিয়ে আসচে। পি, সি, রায় অরণ্যে রোদন করচেন, বলছেন বাঙালীর অন্ন পরের হাতে যাচ্চে। কিন্তু বাংলার মুসলমানরা পিছয় নি— দেশে বিদেশে তাদের দেখেচি জীবিকা উপার্জ্জনে— কেননা বিধিনিষেধের নাগপাশ তাদের হাজার পাকে জড়িয়ে রাখে নি। মজ্জাগত অনৈক্যজনিত দুর্ব্বলতা এবং সহস্রবিধ বিধিনিষেধের বোঝা ঘাড়ে করে এই জাত বাঁচবে কী করে? সামাজিক অসম্মান থেকে বাঁচবার জন্যে প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃষ্টান হতে চলেচে— কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলমা পড়াবে তখন পরিতাপ করবারও সময় থাকবে না।
এই সব মনের দুঃখ তোমার কাছে মাঝে মাঝে ভাষায় প্রকাশ করি তাতে ক্ষতি হয়েচে কি? দেশের কথা চিন্তা করে যে কঠিন আঘাত আমাকে বাজচে সেটা তুমি ভেবে দেখ না কেন? দেশের জন্যে আমি তোমাকেও ভাবাতে চাই— তুমি কি দেশের মেয়ে নও? ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে বেদনা দিতে আমার একটুও ভালো লাগে না— কিন্তু বিধাতার অভিসম্পাতে যে বেদনা প্রায় বিশকোটি হিন্দুর প্রাপ্য চোখ বুজে নিজেকে ভুলিয়ে তুমি তার থেকে নিষ্কৃতি পাবে কী করে? এ সমস্ত ন্যায়শাস্ত্রের তর্ক নয়— এ সমস্ত দুর্ভাবনা চতুর্দ্দিকব্যাপী সুকঠোর বাস্তবতার উপরে প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রিক অধিকারের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আড়োচনা চল্চে আজকাল— যেন লঙ্কাভাগ করতে বসেচি অথচ সমস্ত লঙ্কাই যাচ্চে তলিয়ে। তুমি তো সন্তানের জননী, হিন্দুসমাজের ভবিষ্যৎ তোমার ছেলেমেয়েদের দুর্ব্বল স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়ে একদিন তুমি চলে যাবে। কিন্তু সে কী ভবিষ্যৎ, ভেবে দেখো।
আমার এই সমস্ত কথা শুনে কখনো মনে কোরো না তোমার প্রতি আমি নির্ম্মম। তোমার আচার বিচার যেমনি হোক্ না কেন তোমাকে আমি স্নেহ করতে পারব না আমার হৃদয় এত কৃপণ নয়। আমার প্রতি বিশ্বাস রেখো এবং ভুল বুঝে নিজেকে পীড়ন কোরো না। ইতি ১৬ অক্টোবর ১৯৩৩
দাদা
এসব কদর্য চোথার পরিমাণ এখন দিনদিন বাড়বে বই কমবে না। কাজেই যে যেখানে আছেন এই ধরণের চোথা পেলেই ছিঁড়ে উড়িয়ে দিন।
খুব দরকারি কাজ এলেবেলে।
ক'দিন আগে রমিত চ্যাটার্জি ও আমি এই পাতায় সামান্য চেষ্টা করেছিলাম। দু'বছর আগে চারনম্বর প্ল্যাটফর্ম ভালভাবে করেছিল। আপনি প্রত্যেকটার মূল লেখাটা পুরোপুরি তুলে দিয়ে অনেক সুবিধে করে দিলেন। আমি একটা ওয়ার্ড ফাইল বানিয়ে সেভ করছি রেডি রেকনার হিসেবে।
প্রসঙ্গতঃ আনন্দবাজারের ওই কথিত চল্লিশএর দশকের খবরটি নানা ভাবে খুঁজেও পাইনি। এটা মনে হয় পুরোপুরি ফেক।
দরকারি লেখা। ধন্যবাদ এলেবেলে।
এক নম্বরের ছবিগুলো দেখতে পাচ্ছিনা। এটা কি আরো সবার হচ্ছে?
না আমারই কিছু সমস্যা ছিল। এবার একের ছবি দেখতে পাচ্ছি।
এই লেখাটাও অসাধারন, বিশেষ করে এইসময়ে। এলেবেলের অনুমতি পেলে আমার দুয়েকটা হোয়া গ্রুপে ফরওয়ার্ড করতে পারি।
ধন্যবাদ। আমার হোয়া নেই বলে এসব অনেক কিছুই মিসিয়ে যাই।
এটা করা তে খুব ভালো হল। সবকটা এক জায়গায় আছে। মুখের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া যাবে ঝট করে।
আরেকটা কথা এই জন্ম শতাব্দী সংকলন বলে কি কিছু আছে আদৌ। কি একটা অন্য নাম তো ওই সংকলন টার।
টইপত্তর > আলোচনা > সমাজ ১৯ জানুয়ারি ২০২১ : রবীন্দ্রনাথ কেও ওরা ছাড়ছে না - Ramit Chatterjee
এই মুহূর্তের (ভবিষ্যতেও) প্রাসঙ্গিক সন্ধান। কিছুদিন আগে জনৈক বন্ধু 'হোঅ্যা'য় ছড়িয়ে যাওয়া কবির 'মুসলমান'সংক্রান্ত আবর্জনাটি পাঠিয়ে বেশ বিজয়গর্বে মতামত জানতে চেয়েছিলেন। তখন এসব সূত্রগুলি অনেক খুঁজে জড়ো করেছিলুম। এখন এক জায়গায় সঞ্চিত হয়ে মানুষের কাজে আসবে।
ধন্যবাদ এলেবেলে...
খুব দরকারি লেখা।
চমৎকার চমৎকার। একেবারে হোয়াটস্যাপ ফ্রেন্ডলি করে বানানো। অনেক ধন্যবাদ এলেবেলে।
সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এক বন্ধু কাম দাদার হোঅ্যায় আসা মেসেজের উত্তর খুঁজেছিলাম বছর দুয়েক আগে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে সোহম দাসের লেখাটায় কিছু মন্তব্যও করেছিলাম। এমনকি তাঁকে অমিয় চক্রবর্তী ও হেমন্তবালা দেবীকে লেখা চিটিদুটোও পাঠিয়েছিলাম। হঠাৎই মনে হল এগুলো এক জায়গায় করা থাকুক, যদি কারও কখনও কাজে লেগে যায়। তাই এই সামান্য প্রচেষ্টা। রমিতের লেখাটা বোধহয় মিস করে গিয়েছিলাম। ডিসিজনাব, অনুমতির প্রশ্নই নেই। নির্দ্বিধায় ফরওয়ার্ড করতে পারেন।
এলেবেলে, অনেক ধন্যবাদ।
পাঠকভেদে একই লেখার কতরকম ইন্টারপ্রিটেশন।
লেখাগুলো পুরো কনটেক্সটসহ কোট করলেই কি বক্তব্যটির কাউন্টার হয়? লেখকের মূল রচনার ইনটেন্ট ওই স্পেসিফিক লাইনগুলোর চেয়ে খুব আলাদা ছিল তা আদৌ বোঝা যাচ্ছে কি? বরং প্রমাণ হল কোটেশনগুলি সত্য। এটুকুতে হবে না। হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভটির কাউন্টার করতে হলে আরো লিখতে হবে।
তাই হবে হুজুর। শুধু দিন কয়েক সময় দিন। দরকারে হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক ভাবনাকে স্পষ্ট করার জন্য তাঁর অন্য কয়েকটি প্রবন্ধের উল্লেখও করব।
খাটুনির কাজ, ভালো কাজ, দরকারি কাজ। কুর্নিশ।
বড় করে লাভ হবে না। ছোটো এবং ক্রিস্প করতে হবে। শব্দের মিতব্যয়ীতা জরুরি। এই পয়েন্টগুলোর কাউন্টার, এর কাছাকাছি আয়তনে,বড় জোর এক-দেড় প্যারাগ্রাফে করতে হবে। নইলে লোকে পড়বে না। অন্য কোথাও প্রবন্ধে উপন্যাসে কী বলেছেন সেসব বেরোলে স্ববিরোধী রবীন্দ্রনাথ হতে পারে বড়জোর। এই কোটেশনের রবীন্দ্রনাথকে ভুল ইন্টারপ্রিট করা হচ্ছে সে প্রমাণ স্পেসিফিক ভাবে দিতে হবে। এইটে নিরঞ্জন ধর, অভিজিৎ রায় ঘরানা, অত সহজ হবে না।
ভালো লাগলো লেখাটা। হ্যাঁ, খুব খেটেখুটে সলিড লেখা। এলেবেলেকে প্রশংসা।
বড় করে লাভ হবে না। ছোটো এবং ক্রিস্প করতে হবে। শব্দের মিতব্যয়ীতা জরুরি। এই পয়েন্টগুলোর কাউন্টার, এর কাছাকাছি আয়তনে,বড় জোর এক-দেড় প্যারাগ্রাফে করতে হবে। নইলে লোকে পড়বে না। অন্য কোথাও প্রবন্ধে উপন্যাসে কী বলেছেন সেসব বেরোলে স্ববিরোধী রবীন্দ্রনাথ হতে পারে বড়জোর। এই কোটেশনের রবীন্দ্রনাথকে ভুল ইন্টারপ্রিট করা হচ্ছে সে প্রমাণ স্পেসিফিক ভাবে দিতে হবে। এইটে নিরঞ্জন ধর, অভিজিৎ রায় ঘরানা, অত সহজ হবে না।
এডিট করতে গিয়ে মনে হয় ১ নং আর ৮ নং এর চিঠিটা উড়ে গেছে। ইমেজ লিংক ছিল সম্ভবত। হোয়াটস্যাপ ফ্রেন্ডলি করতে ছবিগুলোকে ইমেজ থেকে টেকস্ট-এ আনতে হবে সম্ভবত। পর্ব-১ লেখা দেখে মনে হল ব্যাখ্যা গুলো আসবে। নইলে এখনো অবধি দেখা যাচ্ছে সত্যই রবীন্দ্রনাথ কথাগুলি বলেছেন। উদ্ধৃতির সাথে মূলের লেখার অর্থের পার্থক্যও বিশেষ নাই।
-- আপনি যতটাই টেকস্যাভি, আমি ততটাই আনাড়ি। তাই এডিট করার সময়ে চিঠিদুটো যে উড়ে গিয়েছে, সেটা নজরে পড়েনি। যাই হোক, এবারে চিঠিগুলোর টেক্সট এবং ইমেজ - দুটোই থাকল। হয়তো লেখাটির তৃতীয় পর্বে এই চোথাটির আদ্যোপান্ত কাটাছেঁড়া করব। তখন খাবলা মারা উদ্ধৃতিগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য স্পষ্ট হবে। এই ত্রুটির দিকে আমার নজর ফেরানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এই সুযোগে হেমন্তবালা দেবীকে লেখা চিঠিটির অসম্পূর্ণতাও দূর করা গেল।
আমার নিজের ইচ্ছে হল এই বিষয়ে গুরু সবাইকে টেক্কা মেরে বেরিয়ে যাবে। তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব।
এলেবেলেকে অনেক ধন্যবাদ।
গুরু অ্যাডমিন, এই লেখাটার পিডিফ পাওয়া যেতে পারে?
এয়ার, আপনি ওয়ার্ড ব্যবহার করলে নিজেই করে নিতে পারবেন। পুরোটা কপি করে ওয়ার্ডে ফেলুন। লেখার নাম আর লেখকের নাম মাথার উপরে লিখে নিন। এবার সেভ অ্যাজ করে পিডিএফ হিসেবে সেভ করুন।
ব্যাসস।
আরে, তাই তো। করে নিলাম।
ধন্যবাদ, দ!