এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  সমাজ

  • ঔপনিবেশিক হিন্দু আইন : ৩ 

    এলেবেলে লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | সমাজ | ০২ আগস্ট ২০২৪ | ৪২১ বার পঠিত
  • হেস্টিংস-হ্যালহেড | কর্নওয়ালিস-জোন্স | রামমোহন থেকে কেরি কলিতানি
    ১৭৭৬ সালে হ্যালহেডের প্রথম হিন্দু আইন এবং তার ২০ বছর পরে জোন্সের দ্বিতীয় হিন্দু আইনটির মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসকরা এমন দুটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যাতে বাংলার নারীদের ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গটি আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে। প্রথমে ১৭৮৪ সালে কোম্পানি নতুন একটি রেগুলেশন জারি করে জানায়, এর পর থেকে কোম্পানির স্থানীয় ব্রিটিশ অফিসাররা কর সংগ্রাহক হিসাবে কোম্পানি-করযুক্ত বাংলার সমস্ত অংশের সমস্ত জমির কর কেবল পুরুষ ও প্রাপ্তবয়স্ক জমিদারদের থেকে সংগ্রহ করবে। জমিদাররা যদি নাবালক কিংবা ‘স্বীকৃত অক্ষমতা’ (acknowledged incapacity)-র মহিলা হন, তাহলে জমিদারদের খাজনার প্রকৃত প্রাপক হবেন একজন পুরুষ ব্যক্তি বা ওই জমিদারের সর্বাপেক্ষা দায়িত্বশীল ও বিশ্বাসযোগ্য কর্মচারী। []

    এরপর শুধু ১৭৯০ সালের দশসালা বন্দোবস্তেই নয়, এমনকি ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অষ্টম রেগুলেশনের ২০ সংখ্যক ধারায় কেবল জমির ‘প্রকৃত মালিকদের’ রাজস্ব প্রদানের দায়ভার দেওয়া হয়। এই ধারা অনুযায়ী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য যে জমিদারদের জমিদারি পরিচালনায় অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, তারা হল— ১. সরকার যেসব নারীকে জমিদারি পরিচালনায় অপারগ বলে গণ্য করে, ২. নাবালক, ৩. জমিদারি পরিচালনার জন্য অযোগ্য মূর্খ, উন্মাদ, বিকৃতমনা ও অন্যান্য দুর্বল ব্যক্তি এবং ৪. যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারি রাজস্ব বাকি রাখার পক্ষপাতী কিংবা ‘নষ্ট’ চরিত্রের লোক। [] ওই আইনে আরও বলা হয়, তারা যদি কোনও জমিদারির একক মালিক না হয়ে অংশীদার হয়, তবে তার বদলে অন্য অংশীদারেরা এই বন্দোবস্ত গ্রহণ করতে পারে। [] অতঃপর ১৭৯৬ সালে জোন্সের দ্বিতীয় ঔপনিবেশিক হিন্দু আইনটি গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হাজির হয়।

    উপর্যুপরি দুটি সরকারি রেগুলেশন ও দুটি হিন্দু আইন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা একাধিক মহিলা জমিদারদের আর্থিকভাবে কতটা অসহায় করে তোলে, তার সমর্থনে সামান্য তথ্য হাজির করলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১৭৯০ সালে দশসালা বন্দোবস্তের সময় বাংলার সরকারি রাজস্ব জমার মোট পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৯০ লক্ষ ৪০ হাজার সিক্কা টাকা। এই রাজস্বের প্রায় ৪০ শতাংশ জমা দিত মাত্র ৩টি জমিদার পরিবার— ১. বর্ধমান রাজপরিবার ৩২ লক্ষ ৬৬ হাজার টাকা (মোট রাজস্বের ১৭.১৫%), ২. রাজশাহী রাজপরিবার ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা (১১.৮১%) এবং ৩. দিনাজপুর রাজপরিবার ১৪ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা (৭.৭৯%)। [] অথচ মাত্র ১০ বছর পরে, কেবল বর্ধমান ছাড়া রাজশাহী রাজপরিবারের বাৎসরিক সদর জমা ২২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা থেকে মাত্র ৮৮ হাজার টাকায় ও দিনাজপুর রাজপরিবারের ১৪ লক্ষ ৮৪ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার টাকায় নেমে আসে। [] আর মহিষাদল, তমলুক, কর্ণগড় কিংবা মেদিনীপুর, রংপুর, রাজশাহীর একাধিক মহিলা জমিদার চলে যান সম্পূর্ণ বিস্মৃতির অন্ধকারে।

    বাংলায় মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে সর্বপ্রথম সোচ্চার হন রাজা রামমোহন রায়। ১৮২২ সালে প্রকাশিত Brief Remarks Regarding Modern Encroachments on the Ancient Rights of Females According to the Hindu Law of Inheritance পুস্তিকায় তিনি বাংলায় সতীদাহের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, যৌতুকের নামে কন্যাবিক্রয় শুরু হওয়া, কৌলীন্য প্রথার কারণে বহুবিবাহের বৃদ্ধি, ব্রহ্মচর্য পালনরতা বিধবার অস্তিত্ব অসহনীয় হয়ে ওঠা, নির্যাতিতা ও পরিত্যক্তা বিধবা বধূদের বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি নানাবিধ সামাজিক ব্যাধির প্রাদুর্ভাবের জন্য বাংলায় প্রচলিত দায়ভাগ প্রথাকে দায়ী করেন। তাঁর মতে, সমস্ত প্রাচীন হিন্দু স্মৃতিকার যথা যাজ্ঞবল্ক্য, কাত্যায়ন, নারদ, বিষ্ণু, বৃহস্পতি, ব্যাস প্রমুখ সর্বসম্মতিক্রমে মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে বিধবার উত্তরাধিকার স্বীকার করেছিলেন; কিন্তু পরবর্তীকালের টীকাকর্তা ও নিবন্ধকারগণ (দায়ভাগ-এর রচয়িতা জীমূতবাহন ও দায়তত্ত্ব-এর লেখক রঘুনন্দন, যাঁদের মতামত বাংলায় উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করার ক্ষেত্রে সর্বমান্য কর্তৃত্ব হিসেবে বিবেচিত) সেই অধিকার থেকে হিন্দু নারীদের বঞ্চিত করেছেন। []

    উদাহরণস্বরূপ জীমূতবাহন ও স্মার্ত রঘুনন্দনের ওপর দোষারোপ করে তিনি জানান: “[দায়ভাগ অনুযায়ী] যদি কোনও ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তাঁর সম্পত্তি ভাগ করতে ইচ্ছুক হন, তবে তাঁর পুত্রদের সঙ্গে কেবল অপুত্রক পত্নীদেরই সেই সম্পত্তির সমান অংশের অধিকারী করা উচিত; কিন্তু যদি তিনি তাঁর জীবদ্দশায় তা [তাঁর অপুত্রক পত্নীদের মধ্যে সম্পত্তি বিভাজন] না করেন, তাহলে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁরা সেই সম্পত্তির অধিকারী হবেন না।...
    এই ব্যাখ্যাকারীদের মতে, এমনকি যে স্ত্রীর কেবল একমাত্র পুত্র আছে, তাঁরও [স্বামীর সম্পত্তিতে] কোনও অধিকার নেই। পুরো সম্পত্তি তাঁর পুত্র পাবে; যদি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার পরে পুত্রের মৃত্যু হয়, তবে পুত্রবধূ সেই সম্পত্তির অধিকারী হবে। সেক্ষেত্রে পুত্র জীবিত থাকতে পুত্রের জননীকে [অন্নবস্ত্রের জন্য] তার কিংবা পুত্রবধূর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকতে হবে।” []

    এর পরিণতি কী দুঃখজনক হতে পারে, সে কথা জানিয়ে রামমোহন লেখেন: “এর ফলে স্বামীর মৃত্যুর পরে, সংসারের একদা গৃহকর্ত্রী বিধবা পত্নীকে পুত্রদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হতে হয় এবং পুত্রবধূদের লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। তিনি তাদের [পুত্র বা পুত্রবধূ] সম্মতি ব্যতিরেকে সামান্য অর্থও ব্যয় করতে পারেন না কিংবা সর্বনিম্ন মূল্যের কোনও জিনিস কিনতে পারেন না। পুত্রবধূ ও শাশুড়ির মধ্যে বিবাদ হলে, বধূর পক্ষ নিয়ে পুত্ররা প্রায়ই তাদের ওপর নির্ভরশীল জননীকে উৎপীড়ন করে। বহুবিবাহের প্রাবল্যবশত এ দেশে বিধবা বিমাতার সংখ্যা বেশি। এই কারণে অনেক অপুত্রক বিধবাকে সতীনপুত্র ও পুত্রবধূর কাছে যারপরনাই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।” []

    পুস্তিকাটির পরবর্তী অংশে বাংলায় সতীদাহের প্রাবল্যের জন্য বাংলায় প্রচলিত দায়ভাগ বিধিকে অপরাধী প্রতিপন্ন করে তিনি বলেন: “শুধু ধর্মীয় কুসংস্কার ও বাল্য-সংস্কারের কারণে হিন্দু বিধবারা স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দেন না। বরং স্বামীর মৃত্যুর পরে [তাঁর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে] বিধবাদের দৈনন্দিন যে পরিমাণ অবজ্ঞা ও অনাদরের মুখোমুখি হতে হয়, তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে তাঁদের জীবনের প্রতি মমতা কমে যায়। সুতরাং ইহকালের দুঃখ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে পরকালে অনন্ত স্বর্গসুখ ভোগের আশায় তাঁরা সহমৃতা হতে রাজি হয়ে যান।” [] ঠিক এর পরবর্তী অনুচ্ছেদে বিধবাদের সতী হওয়ার আরও একটি কারণের উল্লেখ করে তিনি জানান, এই অবস্থায় তাঁদের সামনে তিনটি পথ খোলা থাকে— ১) সমস্ত অত্যাচার সহ্য করে নীরবে ক্রীতদাসীর মতো দুর্বিষহ জীবনযাপন করা, ২) নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণ ও স্বাধীনতার জন্য অধর্মের পথ [পতিতাবৃত্তি] অবলম্বন করা এবং ৩) স্বামীর চিতায় আত্মবিসর্জন দেওয়া।

    অধিকাংশ সময় তাঁরা যে তৃতীয় পথটিই বেছে নেন, সে কথা জানিয়ে রামমোহন লেখেন: “যারা ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত, তাদের নজরে এড়াতে পারে না যে অন্য যে কোনও ব্রিটিশ প্রদেশের তুলনায় কেবল বাংলায় সতীদাহের সংখ্যা প্রায় দশগুণ। এই বৈষম্যের জন্য আমরা প্রধানত বাংলার বাসিন্দাদের বহুবিবাহ এবং তাঁদের [পত্নীদের] ভরণপোষণের ব্যাপারে তাদের সম্পূর্ণ অবহেলাকে দায়ী করতে পারি।” [১০] যদিও সতীদাহের সরকারি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলায় সতীদাহের প্রাবল্যের জন্য দায়ভাগ প্রথা কিংবা কৌলীন্য প্রথাকে আদপেই দায়ী করা চলে না।

    আমরা এই প্রবন্ধের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে দেখেছি যে, দুটি ঔপনিবেশিক হিন্দু আইন তৈরি করার সময়েই বাংলার মহিলাদের থেকে সম্পত্তির যাবতীয় অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে বিধবা নারীরা সংসারের গলগ্রহ হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেন। কিন্তু তার পরেও প্রচুর বিধবা নারী সতী হননি। তা ছাড়া, সতীদাহ প্রথার প্রতিটি ঘটনার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কিত বিশদ বিশ্লেষণ দেখায়, সতীদের মধ্যে মূলত দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমনকি সতীদের আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে জানা গেছে, এই প্রথা আদৌ ব্রাহ্মণ্যবাদের সমার্থক ছিল না। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিনয়ভূষণ রায় তাঁর গ্রন্থে জানান, ১৮১৫-১৮২৭ সময়কালীন বাংলার মোট ৫,৩৮৮ জন সতীর মধ্যে তিন উচ্চবর্ণ পরিবারের ছিলেন ৩,০৭৯ জন। এঁদের মধ্যে ছিলেন যথাক্রমে ব্রাহ্মণ ২০৭১ (৩৮%), কায়স্থ ৮০০ (১৫%) ও বৈদ্য ২০৮ (৪%) জন। বাকি ২,৩০৯ জন অন্ততপক্ষে ২০টি ভিন্ন জাতির বিধবা ছিলেন। [১১]

    আবার সারা বাংলা জুড়ে দায়ভাগ প্রথা প্রচলিত থাকলেও জেলাওয়াড়ি তথ্য থেকে দেখা যায়, মেদিনীপুর, যশোর কিংবা ২৪ পরগণায় বছরে গড় সতীর সংখ্যা ২০-র কম বা তার সামান্য বেশি ছিল। [১২] সর্বোপরি রামমোহনের এই মত নির্বিচারে গ্রহণ করলে জীমূতবাহন কিংবা রঘুনন্দনের আমল থেকেই অর্থাৎ দ্বাদশ বা ষোড়শ শতাব্দী থেকেই বাংলায় রমরমিয়ে সহমরণ (বা অনুগমন) অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। অথচ আমরা যদি মধ্যযুগীয় সাহিত্যে সহমরণের উল্লেখের বিষয়টিকে বাদও দিই, তাহলেও বাস্তবে বাংলায় এই চিত্র পরিলক্ষিত হয় না। কাজেই রামমোহন সতীদাহের প্রাবল্যের জন্য দায়ভাগ প্রথাকে দায়ী করলেও সেই দাবিকে বাস্তবসম্মত বলা চলে না।
    [প্রাক্‌-পলাশি বাংলায় সতীদাহের বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য পড়তে পারেন সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোমনাথ রায়ের চমৎকার দুটি প্রবন্ধ।]

    https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=15478

    https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=15477

    ঠিক একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় কৌলীন্য প্রথার বাড়বাড়ন্ত পূর্ববঙ্গে অনেক বেশি হলেও ঢাকা ডিভিশনে সতীর সংখ্যা (গড় ১৯) কলকাতা ডিভিশনের (গড় ৪১) চেয়ে অনেক কম ছিল। [১৩] এ কথার সমর্থনে মীনাক্ষী জৈন জানিয়েছেন, বাংলার মোট সতীর মধ্যে ৯৮% বিধবা একাই চিতায় আরোহণ করেন এবং মাত্র ১.৬% ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির সঙ্গে একাধিক বিধবা একসঙ্গে সতী হন। এঁদের মধ্যে ৫২টি ক্ষেত্রে ২ জন বিধবা, ৪টি ক্ষেত্রে ৩ জন ও ৩টি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪ জন বিধবা স্বামীর সঙ্গে সতী হন। সরকারি পরিসংখ্যানেও একজন পুরুষের সঙ্গে ৪ জনের বেশি বিধবা নারীর সতী হওয়ার একটি ঘটনারও উল্লেখ করা হয়নি। [১৪] সে হিসাবে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকার কারণে ১৮১৫-১৮২৮ পর্যন্ত সময়কালে বাংলায় সতীর সংখ্যা সাকুল্যে ১২৮ জন। ফলে বাংলায় বিপুল সংখ্যক সতী হলেও তার আধিক্যের জন্য কৌলীন্য প্রথাকে দায়ী করা চলে না।

    এই পুস্তিকায় আরও দুটি বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, পুস্তিকাটির প্রথমেই রামমোহন একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক পাদটীকা সংযোজন করেন। এই পাদটীকায় প্রথমে তিনি ভারতবর্ষের কল্পিত ‘স্বর্ণযুগ’-এর অবনতির জন্য মুসলমান শাসক ও  রাজপুত রাজাদের ‘স্বৈরাচার ও নিপীড়ন’-কে দায়ী করেন। পাদটীকার পরবর্তী অংশে মুসলিম শাসনের ‘অত্যাচার’ থেকে ‘মুক্তিদাতা’ ব্রিটিশ শাসকদের প্রভূত প্রশংসা করে তিনি বলেন: “(কয়েকটি প্রদেশ বাদে) বর্তমানে [ভারতবর্ষের] সমগ্র সাম্রাজ্য ব্রিটিশ শাসনের অধীনে রয়েছে এবং শাসকদের বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনা থেকে ইতিমধ্যে কিছু সুবিধা পাওয়া গেছে। [এই সুবিধার ফলে] ভবিষ্যতে শান্তি ও সমৃদ্ধির আশা করা ন্যায়সঙ্গত। তবে পরবর্তী প্রজন্ম এই সরকারের প্রকৃত সুবিধাগুলি সম্পর্কে বলার জন্য আরও উপযুক্ত হবে।” [১৫]

    দ্বিতীয়ত, এখানে তিনি জীমূতবাহন ও রঘুনন্দনের টীকাভাষ্যের যথেচ্ছ নিন্দা করলেও ঔপনিবেশিক হিন্দু আইন প্রবর্তন করার সময় হ্যালহেড ও জোন্স মনুর বিভিন্ন শ্লোক ও ভাষ্যের যে সুকৌশলী পরিবর্তন ঘটান, সেই বিষয়ে তিনি কোনও কথাই বলেন না। উপরন্তু ঔপনিবেশিক হিন্দু আইনের উপযোগিতার কথা উচ্চারণ করে তিনি বলেন: “১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়, ইউরোপীয় ভদ্রলোকদের মধ্যে সংস্কৃত [ভাষা] ও হিন্দু আইন সম্পর্কে এত স্বল্প লোক পরিচিত ছিলেন যে, হিন্দু আইনের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম [এমন] ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদ ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সুতরাং এই ধরনের বিষয়গুলিতে বিচারকদের বিচারপ্রক্রিয়াকে সহজতর করার জন্য, সরকারের তরফে বিভিন্ন জেলা আপিল আদালতে পণ্ডিতদের নিয়োগ করা অত্যন্ত বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এখন আমরা অনেক ইউরোপীয় ভদ্রলোক খুঁজে পাচ্ছি, যাঁরা পণ্ডিতদের থেকে সামান্য সহায়তা ছাড়াই আইনি বিষয়গুলি বিচার করতে সক্ষম। যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলারা বিশেষত উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে এই [ইউরোপীয়] ভদ্রলোকদের মতামতের সুবিধা পেতেন,  তাহলে তারা কত খুশি হতেন।” [১৬]

    রামমোহন সংস্কৃত ভাষা ও শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। ইংরেজি ভাষাতেও তাঁর যথেষ্ট বুৎপত্তি ছিল বলেই বেদান্ত বিষয়ক তাঁর প্রতিটি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ তিনি নিজেই করেন। অথচ সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত তাঁর দ্বিতীয় পুস্তকের শুরুতেই সেই একই ব্যক্তি যখন মনুস্মৃতির উদ্ধৃতির জন্য জোন্সের অনুবাদের সাহায্য নেন এবং সেই অনুবাদের যথার্থতা সম্পর্কে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেন না [১৭], তখন যে তিনি ঔপনিবেশিক হিন্দু আইনের বিন্দুমাত্র সমালোচনা করবেন না— তা সহজেই বোঝা যায়। আরও আশ্চর্যের কথা এই, সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত প্রথম পুস্তিকাটিতে বাংলায় সতীদাহের বাড়বাড়ন্তের জন্য রামমোহন দায়ভাগকে দায়ী করেন। অথচ তার মাত্র ৮ বছর পরে প্রকাশিত দ্বিতীয় পুস্তক Essay on the Rights of Hindoos over Ancestral Property according to the Law of Bengal -এ তিনি দায়ভাগ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন। লক্ষণীয়, এই পুস্তক রচনার ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব শ্রেণিস্বার্থের বিষয়টি নিহিত থাকার কারণে তিনি এখানে সতীদাহ নিয়ে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি।

    দ্বিতীয় পুস্তকে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করে রামমোহন বলেন, জীমূতবাহন-এর দায়ভাগ অনুসারে পৈতৃক ও স্বোপার্জিত সম্পত্তিতে বাঙালি হিন্দুর সম্পূর্ণ অধিকার আছে এবং তাঁরা তাঁদের ইচ্ছানুসারে সেই সম্পত্তি  দান বা বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু বিজ্ঞানেশ্বর-এর মিতাক্ষরা অনুযায়ী যেহেতু জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পৈতৃক সম্পত্তিতে পিতার সঙ্গে পুত্রের সমান স্বত্ব জন্মায়, সেহেতু পিতা তাঁর পুত্র ও পৌত্রদের সম্মতি ছাড়া তাঁর সম্পত্তি অবাধে দান বা বিক্রি করতে পারেন না। এই কারণে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের বিষয়ে বাংলার বাসিন্দারা অর্জিত এবং পৈতৃক সম্পত্তির মধ্যে কোনও পার্থক্য না করে জমি কেনার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে। [১৮]

    দায়ভাগ প্রথা বাংলায় জমি কেনাবেচার পক্ষে সুবিধাজনক হওয়ার ফলে এবং তার দৌলতে জমিদারশ্রেণির স্বল্প আয়াসে বিপুল বিত্ত অর্জনের স্বার্থে, এই প্রথাকে টিকিয়ে রাখার সওয়াল করে রামমোহন বলেন: “বাংলায় প্রচলিত আইনের নীতিগুলি [দায়ভাগ বিধি] যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে পরিচিত। বহু শতাব্দী যাবৎ এই ব্যবস্থার বৈধতা ও চিরস্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করে [পৈতৃক] ভূসম্পত্তি বিক্রি, দান, বন্ধক বা উত্তরাধিকার সূত্রে টুকরো করা হয়েছে। সুতরাং এই নীতিগুলির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশের আকস্মিক পরিবর্তন করা উচিত নয়। এভাবে আইনি বাধা প্রয়োগ করলে আদালতগুলি মামলাকারীতে পরিপূর্ণ হবে এবং যাদের ভূসম্পত্তিতে [কেনাবেচায়] প্রধান আগ্রহ রয়েছে, তাদের একটি বিশাল অংশকে কল্যাণ করার পরিবর্তে ধ্বংস করবে।” [১৯] এই মন্তব্যেই বাংলায় প্রচলিত দায়ভাগ প্রথা সম্পর্কে রামমোহনের প্রকৃত মনোভাব স্পষ্ট হয়ে যায়। জমি কেনাবেচার সুবিধার বিষয়টিই তাঁর কাছে দায়ভাগ বিধির ‘সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশ’ হয়ে ওঠে এবং গোটা বিধিটিকেই তিনি ‘যাদের ভূসম্পত্তিতে প্রধান আগ্রহ রয়েছে’, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন।

    এ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্যের সমর্থনে যুক্তি হাজির করে তিনি লেখেন: “ভূসম্পত্তির অধিকারী— স্বোপার্জিত বা পৈতৃক—  যে কোনও ব্যক্তি এখানে দীর্ঘ প্রতিষ্ঠিত আইনের সুবাদে তার সম্পত্তির উন্নতির জন্য বা ব্যবসায় কিংবা উৎপাদন ক্ষেত্রে সহজেই ঋণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। এর মাধ্যমে সে নিজের ও তার পরিবারকে সমৃদ্ধ করে এবং দেশের উপকার করে।” [] অথচ আমরা প্রায় সকলেই জানি যে, বাংলায় এই বন্দোবস্ত প্রচলনের কারণে নব্য জমিদাররা রাতারাতি অমিত ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে উঠলেও দেশের সিংহভাগ কৃষিজীবী জনসাধারণ অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু রামমোহন এখানে অম্লানবদনে ভূসম্পত্তির অধিকারী ব্যক্তিবর্গ ‘দেশের উপকার করে’ বলে জানান।

    শুধু তাই নয়, একই অনুচ্ছেদে বাংলায় দায়ভাগ বিধিকে বহাল রাখার তাগিদ থেকে তিনি প্রশ্ন তোলেন: “তাদের উত্তরাধিকারের আদর্শ বিধি মিতাক্ষরায় বেঁধে দেওয়া জঘন্য বিধিনিষেধের কারণে উচ্চ প্রদেশের একটি বিশাল অংশের [বাসিন্দাদের] ওপরে যে দারিদ্র্য নেমে এসেছে, বাংলার বাসিন্দাদের সেই পরিমাণ দারিদ্রে নিমজ্জিত করার মধ্যে কোনও বিচক্ষণতা আছে কি?” [২১] আমরা অবাক হয়ে দেখি, যে রামমোহন বাংলার মহিলাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বিচ্যুত করার জন্য দায়ভাগ প্রথাকে কাঠগড়ায় তোলেন, সেই একই রামমোহন অবলীলাক্রমে বাংলা জুড়ে দায়ভাগ বিধি বহাল রাখার জন্য জোরালো সওয়াল করেন। আসলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যদি মিতাক্ষরা বিধি অনুযায়ী পৈতৃক সম্পত্তি বিভাজনের বিষয়টি বাংলায় চালু হয়, তাহলে জমির পুঁজিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। ফলে জমির মালিকরা তাদের আয় বৃদ্ধি করে সেই বাড়তি পুঁজি ব্যবসাবাণিজ্যে লগ্নি করার ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হবে। তাই প্রথম পুস্তকে তিনি জীমূতবাহন ও রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের তুমুল সমালোচনা করলেও দ্বিতীয় পুস্তকটিতে শুধু তাঁদেরই নয়, এমনকি শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারেরও ভূয়সী প্রশংসা করেন। [২২]

    আঠারো শতকের শেষে মহিলাদের হাত থেকে আর্থিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে গোটা সমাজকে প্রবলভাবে পিতৃতান্ত্রিক করে তোলার পর্ব সাঙ্গ হলে উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে ঔপনিবেশিক শাসকরা সহসাই সতীদাহের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে। বিশেষত বাংলায় অনুষ্ঠিত সতীদাহের বীভৎস রূপকে ফুটিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক উইলিয়াম কেরি ও শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা সতীদাহ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত তথ্য হাজির করেন। যেমন ১৮০২ সালে, বাংলার তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির অনুরোধ মোতাবেক কলকাতার আশেপাশে ৩০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে সতীদাহ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের পরে কেরি জানান, ওই নির্দিষ্ট এলাকায় ১৮০৩-এ ৪৩৮টি সতীদাহ হয়েছে। [২৩]

    পরের বছর আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কেরি এই অঞ্চলের গঙ্গাতীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন স্থানে ১০ জন নির্ভরযোগ্য লোককে নিযুক্ত করেন। টানা ৬ মাস সেখানে থেকে তাঁরা মোট ৩০০টি সতীদাহ পর্যবেক্ষণ করেন। [২৪] কেরির হিসাব অনুযায়ী কেবল কলকাতার সন্নিহিত অঞ্চলের মধ্যে বছরে কমপক্ষে ৩০০টি সতীদাহ অনুষ্ঠিত হলে সারা বাংলা জুড়ে প্রতি বছরে প্রায় ১০ হাজার সতীদাহ হওয়ার কথা। এমনকি ১৮১৯ সালে ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া-য় এই সংখ্যক সতীদাহেরই উল্লেখ করা হয়। [২৫]

    কেরির পাশাপাশি শ্রীরামপুরের আরেক মিশনারি উইলিয়াম ওয়ার্ড A View of the History, Literature, and Mythology of the Hindoos গ্রন্থে প্রথমে সারা দেশ জুড়ে বছরে ৫ হাজার সতীদাহের কথা উল্লেখ করলেও পরের পৃষ্ঠাতেই সেই সংখ্যাটিকে ৫ থেকে ১০ হাজারে বাড়িয়ে দেন। এই বৃদ্ধির যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন: “ধরা যাক, হিন্দুস্থানে পাঁচ হাজার শহর এবং বড় গ্রাম রয়েছে এবং প্রতি বছরে এই স্থানগুলির প্রতিটি থেকে একজন বিধবাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে, তাহলে এদেশে প্রতি বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার অসহায় বিধবাকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। কিন্তু আমরা যদি কলকাতায় করা গণনার দ্বারা পরিচালিত হই তাহলে দেখা যাবে যে, একই অনুপাতে সমস্ত বড় শহর সহ প্রত্যেক গ্রামে বছরে অন্তত দুজন বিধবাকে পুড়িয়ে মারতে হবে। তাহলে পাঁচ হাজারের বদলে সংখ্যাটা দ্বিগুণ করতে হবে এবং দেখা যাবে, মাত্র বারো মাসের মধ্যে দশ হাজার বিধবা জ্বলন্ত চিতায় ভষ্মীভূত হয়ে মারা যাবে।” [২৬]

    এভাবে এক দিকে ব্রিটিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আইন জারি করে সতীদাহ উচ্ছেদ করার পক্ষে সওয়াল করতে থাকেন, অন্য দিকে হিন্দুধর্মের সমালোচনার জন্য ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল ও মিশনারিরা নানা ভুয়ো পরিসংখ্যানের মাধ্যমে সতীদাহের বিষয়টিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে হাজির করেন। এই পুরো প্রচারকার্যটি মুষ্টিমেয় ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল-ইউটিলিটারিয়ান গোষ্ঠীর কিছু পরিচিত মুখ যথা, উইলিয়াম উইলবারফোর্স, চার্লস গ্র্যান্ট, জেমস মিল, উইলিয়াম চেম্বার্স প্রমুখের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এঁদের সঙ্গে বিশ্বস্ত জুড়িদার হিসাবে থাকেন শ্রীরামপুরের পাদরি ত্রয়ী উইলিয়াম কেরি-জোশুয়া মার্শম্যান-উইলিয়াম ওয়ার্ড। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়, চার্লস গ্র্যান্ট তাঁর Observations on the State of Society among the Asiatic Subjects of Great Britain গ্রন্থে ভারতবর্ষে প্রতি বছরে প্রায় ৩৩ হাজার সতীদাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানান। [২৭] অনুরূপভাবে উইলিয়াম উইলবারফোর্সও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কেবল বাংলাতেই প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার বিধবাকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার কথা বলেন। [২৮] বিশেষত ইংল্যান্ডে এই সতীদাহের বিষয়টি কতটা প্রচারের আলো পায়, তা লন্ডনের বিখ্যাত দ্য টাইমস পত্রিকায় গোটা উনিশ শতক ধরে কেবল সতী নিয়েই কমপক্ষে ৪০টি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ প্রকাশিত [২৯] হওয়া থেকেই স্পষ্ট হয়।

    অথচ ১৮১৫ সাল থেকে সতীদাহ সম্পর্কিত সরকারি পরিসংখ্যান কিংবা তারও আগে ১৮০৩ সালে ক্লডিয়াস বুকাননের পেশ করা তথ্য বাংলায় অনুষ্ঠিত সতীদাহের এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে না। যেমন বুকানন কলকাতার ৩০ মাইলের মধ্যে ১৮০৩-এ ২৭৫টি এবং পরের বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ অক্টোবর— এই ৬ মাসে মোট ১১৬টি সতীদাহ নথিভুক্ত হওয়ার কথা জানান। [৩০] তবে এ বিষয়ে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বয়ান হাজির করেন বিচারপতি জন হার্বার্ট হ্যারিংটন। ১৮২৪ সালের সরকারি প্রতিবেদনে হ্যারিংটন গোটা বাংলা প্রেসিডেন্সিতে ৫ কোটি হিন্দু জনসংখ্যার উপস্থিতি এবং তাদের মৃত্যুহার ১: ৩৩ অনুমান করেন অর্থাৎ বছরে প্রতি হাজারে ৩০ জন। এর অর্থ, এখানে বছরে মোট ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যান। তিনি আরও অনুমান করে জানান, এর মধ্যে প্রতি ৬ জনের মৃত্যুতে একজন স্ত্রী বিধবা হন। সেই হিসাব অনুযায়ী ১৮১৫ থেকে ১৮২৮ পর্যন্ত প্রতি বছরে প্রায় আড়াই লক্ষ বিধবার মধ্যে ৪৩০ জন পিছু একজন বিধবা বা গড়ে মোট বিধবার মধ্যে প্রায় ৫৮০ জন সতী হন। যদি সংখ্যাটা ৬০০ ধরা হয়, তাহলেও সারা বছরে সতীর সম্ভাব্য সংখ্যা হওয়া উচিত মোট বিধবার মাত্র ০.২ শতাংশ। [৩১] হ্যারিংটনের পেশ করা সতীদের পরিসংখ্যান যে আদৌ অমূলক ছিল না, তা সরকারি পরিসংখ্যান থেকে আরও পরিষ্কার বোঝা যায়।

    হাজার জন হিন্দু বিধবার মধ্যে প্রতি বছরে মাত্র ২ জনের সতী হওয়া নিয়ে ইভ্যাঞ্জেলীয় ও মিশনারিদের এত হইচই করার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণকে বৈধতা দেওয়া। অথচ ১৮০০-১৮৫০ সাল পর্যন্ত সময়কালে ৭টি, ১৮৫০-১৮৭৫-এর মধ্যে ৬টি এবং ১৮৭৫-১৯০০-তে ২৪টি মিলিয়ে গোটা উনিশ শতক জুড়ে ভারতবর্ষে মোট ৩৭টি দুর্ভিক্ষ ঘটে। [৩২] এই অসংখ্য দুর্ভিক্ষের বলি হওয়া এ দেশের অগণিত পুরুষ, মহিলা ও শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে এই ইভ্যাঞ্জেলীয় ও মিশনারিরা বিন্দুমাত্র মাথাও ঘামায়নি।

    এ বিষয়ে ভারতীয় ‘সমাজসংস্কারক’-দের মনোভাবও খুব একটা আলাদা কিছু ছিল না। কোম্পানির আমলে বাংলার সামাজিক জীবনে গৃহদাস কিংবা পারিবারিক দাসব্যবস্থার যথেষ্ট রমরমা শুরু হয়। বিশেষত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন ও কৃষি-শিল্পের ধ্বংসসাধনের ফলে মানুষ বিক্রি করা প্রায় স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অপরিসীম দারিদ্র্যের চাপে মানুষ নিজের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের বিত্তবানদের কাছে গোলামির জন্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট ব্লাকুয়ার জানান, ১৮১৯ সালে গ্রামাঞ্চলে একজন পুরুষ দাসের দাম ছিল ২০ থেকে ২৪ টাকা এবং নারীদের জন্য আরও কম। দুর্ভিক্ষের সময় কলকাতার রাস্তায় শিশুদের ১২ আনা থেকে ৪ টাকার মধ্যে সহজেই পাওয়া যেত। [৩৩]

    বাংলায়, বিশেষত কলকাতায়, দাসব্যবসা এতটাই জাঁকিয়ে বসে যে তৎকালীন পত্রপত্রিকায় পণ্যদ্রব্যের মতো দাস কেনাবেচার বিজ্ঞপ্তি, দেশি-বিদেশি প্রভুদের দাস নির্যাতনের কাহিনি, অসহায় দাসদের পালানো, অভাব-অনটনের জ্বালায় গ্রামীণ মানুষের সামান্য মূল্যে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বিক্রি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সংবাদ নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে। এই বিষয়ে ১৮২৩ সালে সমাচার দর্পণ পত্রিকায় লেখা হয়: “কুবাণিজ্য বারণ— ...ইহারদের [দাসদের] মূল্য কিছু নিশ্চয় নাই স্থানভেদে মূল্য বিভিন্ন বালকের মূল্য চারি টাকা অবধি ১৫ টাকাপর্যন্ত স্ত্রী লোকের ১৬ টাকা অবধি ২৪ টাকাপর্যন্ত। পুরুষের মূল্য ২৪ টাকা অবধি এক শত ষাটিপর্যন্ত। এইরূপ দাসত্বগ্রস্ত অনেক লোক অতি কষ্টে কালক্ষেপ করিতেছে...।” [৩৪]

    এই প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, দাস কেনাবেচার কোনও নির্দিষ্ট মূল্য ছিল না। অঞ্চলভেদে এবং স্বাস্থ্য, বয়স ও কর্মক্ষমতা অনুসারে দাসদের মূল্য নির্ধারিত হত। দাস কেনাবেচার জন্য কোনও ব্যক্তির শাস্তি পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু দাসব্যবসা বিলোপের বিষয়ে ভারতীয় সমাজসংস্কারকদের স্বতঃস্ফূর্ত নৈতিক সমর্থন পরিলক্ষিত হয়নি। [৩৫] এই সমাজসংস্কারকদের অভিযুক্ত করে অমলকুমার চট্টোপাধ্যায় স্পষ্ট লিখেছেন: “রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং মহারাজা স্যার রাধাকান্ত দেবের মতো ভারতীয় সমাসংস্কারকরা তাঁদের দেশে [প্রচলিত] দাসপ্রথার বিরুদ্ধে কখনও একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তাঁরা বরং তাতে [দাসপ্রথা] পরোক্ষ সমর্থন যুগিয়েছেন।” [৩৬]

    উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে সতীদাহ যেমন সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছিল, তেমনই ওই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিধবাবিবাহ হয়ে উঠেছিল আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। এ কথা নিঃসন্দেহে সত্যি যে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ আইন পাস ও সমাজে তা চালু করার ক্ষেত্রে পরিশ্রমের কোনও কার্পণ্য করেননি, এমনকি এই প্রকল্পের সফল রূপায়ণের জন্য তিনি যথেষ্ট আর্থিক দায়ভারও বহন করেছিলেন। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না, সতীদাহের মতো বিধবাবিবাহের বিষয়টিও বাংলার প্রায় ৪০% মুসলমানের কাছে আলাদা কোনও তাৎপর্য বহন করেনি। শুধু তাই নয়, ১৮৫৬ সালে আইন পাস করার বহু আগে থেকেই উচ্চবর্ণ ব্যতীত অন্য বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে বিধবাবিবাহ যথেষ্ট প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করে জানান, হিন্দুদের সর্বমোট ৩৬টি জাতির মধ্যে ৩০টি জাতিতেই বিধবাদের পুনর্বিবাহ করার স্বাধীনতা ছিল। [৩৭]

    আইনটি পাস হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি সমাজে বহু দিন পর্যন্ত বিধবাবিবাহ আদপেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিধবাবিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করে বিনয় ঘোষ লেখেন: “...১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হবার পর উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত কয়েকটিমাত্র বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে ...। তাও দেখা গেছে বিধবাবিবাহ যাঁরা করতে অগ্রণী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে সাময়িক অর্থলোভে শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, কোনও আদর্শপ্রীতির জন্য বিবাহ করেন নি। ...বিধবাবিবাহ হিন্দুসমাজ গ্রহণ তো করেই নি, শিক্ষিত উচ্চসমাজে যাঁরা আদর্শের দিক থেকে একদা তা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরাও কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেন নি। বিধবাবিবাহের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সামাজিক প্রথা, যেমন নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা, যৌথপরিবার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি— যেমন ছিল ঠিক তেমনি রেখে শুধু প্রথা হিসেবে বিধবাবিবাহ সমাজে প্রচলিত হতে পারে না।” [৩৮]

    বিনয় ঘোষের মতো প্রায় একই কথা বলেছেন স্বপন বসু। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন: “বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন সমাজকে আলোড়িত করেছিল, ঝড় তুলেছিল বাঙালিসমাজে— কিন্তু সমাজে তা স্বীকৃতি পায়নি। লক্ষ লক্ষ বিধবার মধ্যে গোটা উনিশ শতকে একশোটিও বিধবাবিবাহ হয়েছিল কিনা সন্দেহ। ...অর্থাৎ যদিও বিদ্যাসাগরের আন্দোলন ছিল মূলত মানবিক, কিন্তু তাঁর আন্দোলনের সাফল্য আইন প্রণয়নেই সীমাবদ্ধ”। [৩৯]

    উনিশ শতকের সর্বোচ্চ আলোচিত এই দুই ‘তথাকথিত’ সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসকদের অতি উৎসাহের পেছনে লুকিয়ে থাকা আসল কারণটির চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়: “উনিশ শতকের ভারতবর্ষে, ‘নেটিভ’দের উন্নতিবিধান ও তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য সভ্যতার আলোক বিস্তারের এই ঔপনিবেশিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল— ভারতীয় রমণীকুল। ভারতবর্ষে সমকালীন ইংরেজ পর্যটক, আমলা, খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক— প্রায় সকলেই তাঁদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে, সরকারি নথিপত্রে, বারংবার ঘৃণা ও আতঙ্ক সহকারে বর্ণনা করতেন ভারতীয় নারীদের দুরবস্থা— সতীদাহ প্রথা, বহু-বিবাহ, বাল্য বিবাহ, বিধবাদের দুর্দশা, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। ঔপনিবেশিক কূটনীতিকরা এইসব তথ্য কাজে লাগিয়েছিল ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন টিকিয়ে রাখার সমর্থনে। তাদের স্বদেশে, উদীয়মান নারী-স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও ইংরেজ সমাজ সংস্কারকদের সহানুভূতি আদায়— এবং তার মাধ্যমে ব্যাপক ইংরেজ মধ্যবিত্ত সমাজের নৈতিক অনুমোদন (ভারতে ইংরেজ শাসনের সপক্ষে) লাভের উদ্দেশ্যে ইংরেজ আমলা ও তাদের তাত্ত্বিক সমর্থকেরা ভারতীয় নারীদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি সবিস্তারে বিজ্ঞাপিত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ সর্বসাধারণের সামনে যে ধারণাটা তুলে ধরা হয়েছিল তা হলো— ভারতবর্ষে নারীরা সবচেয়ে বেশি পদানতা ও পশ্চাৎপদতা; সুতরাং তাদের উদ্ধারের জন্য ইংরেজ শাসন প্রয়োজনীয়। এদেশে ইংরেজ শাসকদের শোষণ-লুণ্ঠন অত্যাচারের ইতিহাসকে চাপা দিয়ে তাদের ভারতীয় সমাজের সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যটাই এইভাবে উচ্চনাদে ঘোষিত হলো।” [৪০]

    এখানেই না থেমে এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন: “উনিশ শতকের ভারতবর্ষে, ইংরেজ ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকদের কাছে, ভারতীয় রমণীদের দুরবস্থার প্রশ্ন, তা থেকে তাদের মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা, দেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসন বজায় রাখার সমর্থনে একটা বড়ো যুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই যুক্তির প্রভাবে, এদেশে নিযুক্ত ইংরেজ প্রশাসক ও বিচারক এবং আগত ইংরেজ চাকুরিজীবী, শিক্ষাবিদ, ব্যবসাদার, ধর্মযাজক ও সংস্কারক, স্ত্রী-স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে তাঁদের পেশাগত অনুষ্ঠানে, এবং প্রচার অভিযানে মূল উপজীব্য করে তুলেছিলেন। এ প্রচারে— কখনও প্রত্যক্ষ কখনও পরোক্ষভাবে— যে বক্তব্যটা বেরিয়ে আসত, তা হলো এই: ভারতীয় রমণীরা, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজেই, তাদের স্ব-স্ব অতীতাশ্রয়ী রক্ষণশীল ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা অবদমিত ও শোষিত। সুতরাং পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কারমূলক আইন প্রণয়ন— ও খ্রিস্টীয় ধর্মে ভারতীয়দের ধর্মান্তরকরণ— একমাত্র এইসব সদুপায়েই ভারতীয় নারীদের মুক্তি সম্ভব!” [৪১] কাজেই নিরবচ্ছিন্ন শোষণ প্রক্রিয়া থেকে জনমানসের দৃষ্টি ফেরানো এবং একই সঙ্গে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের যুগ্ম প্রচেষ্টার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে ঔপনিবেশিক শাসকরা এই নাম-কা-ওয়াস্তে সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রদুটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথচ বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পরে, সারা দেশ জুড়ে হ্যালহেড-কথিত বিধবাদের ‘শালীনতা’ ও ‘সতীত্ব’ রক্ষা না করার অভিযোগ তুলে বিধবাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার প্রচেষ্টার নানা নিদর্শন পাওয়া যায়। বিশেষত ১৮৭০-এর আশেপাশে কলকাতার প্রধান বিচারালয়ে চলা দুটি মামলা খুবই উল্লেখযোগ্য।

    কলকাতার ধনী ও অভিজাত কুলীন পরিবারের রামগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ১৮৬১ সালে মারা যান, তখন তাঁর চারজন স্ত্রীর মধ্যে একমাত্র তাঁর চতুর্থ স্ত্রী জয়কালী দেবী বেঁচে ছিলেন। সুতরাং জয়কালীই স্বামীর সম্পত্তির অধিকারিণী হন। ১৮৬৭ সালে— অর্থাৎ তাঁর স্বামীর মৃত্যুর ৬ বছর পরে— জয়কালী একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। এই ঘটনার পরে, রামগোপালের পূর্বতন একজন স্ত্রীর কন্যা, মাতঙ্গিনী (যে নিজেকে রামগোপালের একমাত্র জীবিত বংশধর বলে দাবি করে) জয়কালীর বিরুদ্ধে ১৮৬৯-এ মামলা রুজু করে বলে, যেহেতু জয়কালী ‘অসতী’, সেহেতু তাঁর স্বামীর সম্পত্তিতে তাঁর আর কোনও অধিকার নেই এবং রামগোপালের একমাত্র কন্যা ও উত্তরাধিকারিণী হিসাবে মাতঙ্গিনীই তাঁর পিতার সম্পত্তির মালিকানার যোগ্য। [৪২] কিন্তু এই মামলার রায় শেষপর্যন্ত ‘অসতী’ জয়কালীর সপক্ষেই যায়। কলকাতা আদালতের প্রধান বিচারক স্যার বার্নস পিকক ও বিচারক ম্যাকফারসন জয়কালীর অনুকূলে রায় দিয়ে জানান, যদি একজন বিধবা তাঁর স্বামীর জীবদ্দশায় ‘অসতী’ হন, তাহলে তিনি তাঁর স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার হারাবেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পরে সেই নিয়ম বলবৎ হবে না, বিধবার উত্তরাধিকারের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে। [৪৩]

    ইতিমধ্যে ভারতবর্ষীয় সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভার পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ, এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রিভি কাউন্সিলের কাছে আবেদনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তাঁদের মূল বক্তব্য ছিল, যেহেতু বিধবাবিবাহ আইনের দ্বিতীয় ধারা অনুযায়ী পুনর্বিবাহিতা বিধবা তাঁর মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ‘মৃত’ বলে গণ্য হন, সেহেতু মৃত স্বামীর সম্পত্তির লোভে বিধবারা পুনরায় বিবাহববন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে ‘ব্যভিচারী’ জীবনযাপনের মাধ্যমে উক্ত সম্পত্তি হস্তগত করার সুযোগ নেবেন। মনে রাখা দরকার, প্রায় একই সময়ে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভার উৎসাহ দেখে বিদ্যাসাগর তাঁর বহুবিবাহ বিষয়ক প্রথম পুস্তকটি মুদ্রণের কাজ সমাপ্ত করে প্রচার করেন। ১৮৬৯ সালের ২৪ মার্চ, নবগোপাল মিত্রের ন্যাশনাল কাগজে ধর্মরক্ষিণী সভার সাফল্য কামনা করে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। [৪৪]  তবে সম্ভবত জয়কালী দেবী বনাম মাতঙ্গিনী দেবীর মামলাটি শেষ পর্যন্ত প্রিভি কাউন্সিলে পৌঁছয়নি, কারণ এ সম্পর্কে আদালতে আর কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।

    জয়কালী দেবীর মামলা নেহাতই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। ১৮৭৩ সালে, কলকাতা হাইকোর্টে অসতী বিধবার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত একটি চাঞ্চল্যকর মামলা শুরু হয়। অসমের গোলাঘাটের জনৈক অপুত্রক সম্পত্তিশালী ব্যক্তি গেণ্ডেলা (Ghindhela)-র মৃত্যু হলে, তাঁর বিধবা পত্নী কেরি কলিতানি উত্তরাধিকার সূত্রে সেই সম্পত্তির অধিকারিণী হন। কিছু দিন পরে মৃত ব্যক্তির জ্ঞাতি ভাই মণিরাম কলিতা গোলাঘাটের মুন্সেফের কাছে তাঁর ভাতৃবধূর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন যে, কেরি কলিতানি ব্যভিচারিণী, সুতরাং তাঁর স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করার তাঁর আর কোনও অধিকার নেই এবং মণিরাম স্বয়ং সেই সম্পত্তির আসল দাবিদার। গোলাঘাটের মুন্সেফ কেরির পক্ষে রায় দেন। বাদী মণিরাম এই রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে শিবসাগরের কমিশনারের কাছে আপিল করেন এবং কমিশনার মণিরামের পক্ষে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে কেরি কলিতানি কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন।

    ১৮৭৩-এর এপ্রিল মাসে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টে ওঠে। প্রথমে দ্বারকানাথ মিত্র ও বিচারপতি বেলির ওপর এই মামলার বিচারের ভার পড়ে। পরে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে তাঁরা হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চে পাঁচ জন বিচারপতিকে মামলাটির নিষ্পত্তি করার দায়িত্ব দেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে পূর্ণ মীমাংসা না হওয়ায় হাইকোর্টের সব বিচারককে নিয়ে একটি বোর্ড গঠন করে মামলাটির বিচার করা হয়। [৪৫]  এই মামলার শুনানির সময় এ সম্পর্কে হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, ভরতচন্দ্র শিরোমণি ও তারানাথ তর্কবাচস্পতিকে আদালতে আহ্বান করে তাঁদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিদ্যাসাগর আদালতে আসতে পারেননি। সংস্কৃত কলেজের অন্য তিনজন অধ্যাপকই জানান যে, হিন্দু শাস্ত্রমতে স্বামীর সম্পত্তিতে ‘অসতী’ বিধবার কোনও অধিকার নেই। [৪৬]

    এই পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি জাস্টিস রিচার্ড কাউচ-সহ আরও ৭জন ব্রিটিশ বিচারক রায় দেন যে, হিন্দু আইন মতে কোনও বিধবা একবার যদি তাঁর স্বামীর সম্পত্তির অধিকারিণী হন, তাহলে ব্যভিচারের অভিযোগ সত্ত্বেও তাঁকে কখনই সেই সম্পত্তির অধিকারচ্যুত করা যাবে না। কিন্তু বিচারপতিদের মধ্যেও বিষয়টি সম্পর্কে মতভেদ দেখা যায়। বিচারকমণ্ডলীর বাকি ৩জন— দুজন ইংরেজ বিচারপতি কেম্প ও গ্লোভার এবং একমাত্র বাঙালি বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র— এই রায়ের বিরোধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ (৭-৩) বিচারপতির রায়ে কলিতানি জয়লাভ করেন। [৪৭]

    কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট কেরি কলিতানির পক্ষে রায় দেওয়ার পরে, রায়কে উপলক্ষ করে কলকাতায় একাধিক জনসভা হয়। বাঙালি সম্পাদিত সংবাদপত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে এই রায়ের ফলে হিন্দু সমাজ বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। অধিকাংশ বাঙালি সম্পাদক-ই মামলার রায়ের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন। মধ্যস্থ পত্রিকা ‘হাইকোর্টের উক্ত নিষ্পত্তিতে হিন্দুসমাজ মহাক্ষুব্ধ, মহাভীত ও মহা অসন্তুষ্ট’ হয়ে ওঠে বলে জানায়। [৪৮]

    ওই বছরের ২০ এপ্রিল, পাথুরিয়াঘাটায় প্রসন্নকুমার ঠাকুরদের আদি বসতবাড়িতে রাজা কমলকৃষ্ণের সভাপতিত্বে জাতীয় সভার এক সাধারণ অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে প্রাণনাথ পণ্ডিত এ বিষয়ে অতীত ও তৎকালীন পণ্ডিতগণের অভিমত উদ্ধৃত করে একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ পাঠ করেন। প্রবন্ধ পাঠের পরে এ সম্পর্কে মনোমোহন বসু, নবগোপাল মিত্র, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু এবং হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ উকিল ভৈরবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তৃতা করেন। শুভেন্দুশেখর জানাচ্ছেন:  “রাজনারায়ণ বসু বলেন, ‘ইউরোপে স্ত্রীপ্রভুত্ব যেমন সমাজের ভিত্তি, এদেশে সতীত্ব তেমনি আমাদের সমাজ-ভিত্তি! পুরুষের বীরত্ব জন্য তাঁহাদের যেমন, স্ত্রী-সতীত্ব জন্য আমাদের তেমনি বড়াই।’ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি আবেগপূর্ণ বক্তৃতায় এই মর্মে বলিলেন, “হিন্দুজাতির সমুদয় ভাল ভাল রীতিপদ্ধতিই গিয়াছে, মাত্র স্ত্রীর সতীত্বটিই অব্যাহত ছিল। তাহাও এখন যাইবার উপক্রম হইয়াছে।” [৪৯]  অতপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রিভি কাউন্সিলে আপিল এবং এ দেশে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন করার জন্য সভায় একগুচ্ছ প্রস্তাব গৃহীত হয়। যদিও হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রিভি কাউন্সিলে যে আপিল হয়, সেখানেও হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। [৫০]

    ১৭৭৬ সালে হ্যালহেডের প্রথম হিন্দু আইনের মাধ্যমে বাংলার নারীদের হাত থেকে আর্থিক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা সূচিত হয়, ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত তা বহাল থাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিস্তর বাকবিতণ্ডার পরে যে হিন্দু কোড বিল পাস হয়, সেই সুবাদে নারীরা তাঁদের হৃত অর্থনৈতিক ক্ষমতার কিছুটা হলেও ফিরে পান।
    ****************************************************************
    উল্লেখপঞ্জি:
    ১. Indrani Chatterjee, ‘Monastic Governmentality, Colonial Misogyny, and Postcolonial Amnesia in South Asia’, History of the Present, Vol. 3, No. 1 (Spring 2013), p. 75
    ২. তদেব
    ৩. সিরাজুল ইসলাম, বাংলার ইতিহাস :ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ১২০
    ৪. তদেব, পৃ. ১৪৫
    ৫. তদেব, পৃ. ১৬৩
    ৬. Dr. Kalidas Nag and Debajyoti Burman (eds.), The English Works of Raja Rammohun Roy, Part I, Calcutta, 1958, p. 2
    ৭. তদেব, পৃ. ২-৩
    ৮. তদেব, পৃ. ৪
    ৯. তদেব, পৃ. ৫
    ১০. তদেব
    ১১. Benoy Bhushan Roy, Socioeconomic Impact of Sati in Bengal and the Role of Raja Rammohun Roy, Calcutta, 1987, p. 37
    ১২. Anand A. Yang, ‘Whose Sati? Widow Burning in Early-Nineteenth-Century India’; Sumit Sarkar & Tanika Sarkar (eds.), Women and Social Reform in Modern India: A Reader, Vol. I, New Delhi, 2017, p. 35
    ১৩. তদেব
    ১৪. Meenakshi Jain, Sati: Evangelicals, Baptist Missionaries, and the Changing Colonial Discourse, New Delhi, 2016, p. 191
    ১৫. Nag and Burman (eds.), The English Works of Raja Rammohun Roy, Part I, p. 1
    ১৬. তদেব, পৃ. ৯
    ১৭. তদেব, পৃ. ১২
    ১৮. তদেব, পৃ. ১৬-১৭
    ১৯. তদেব, পৃ. ১৮
    ২০. তদেব, পৃ. ১৯
    ২১. তদেব
    ২২. তদেব, পৃ. ৩৩-৩৪
    ২৩. Edward John Thompson, Suttee: A Historical and Philosophical Enquiry into the Hindu Rite of Widow-burning, London, 1928, p. 60
    ২৪. John Clark Marshman, The Life and Times of Carey, Marshman, and Ward, Vol. I, London, 1859, pp. 221-22
    ২৫. Joerg Fisch, Burning Women: A Global History of Widow Sacrifice from Ancient Times to the Present, (tr. Rekha Kamath Rajan), Calcutta, 2006, p. 233
    ২৬. Meenakshi Jain, Sati: Evangelicals, Baptist Missionaries, and the Changing Colonial Discourse, p. 182
    ২৭. তদেব, পৃ. ১৮৩
    ২৮. Joerg Fisch, Burning Women, p. 233
    ২৯. Andrea Major (ed.), Sati: A Historical Anthology, New Delhi, 2007, p. 62
    ৩০. Joerg Fisch, Burning Women, p. 233
    ৩১. Anand A. Yang, Whose Sati? Widow Burning in Early-Nineteenth-Century India, pp. 39-40
    ৩২. R. Palme Dutt, India Today, Bombay, 1947, p. 106
    ৩৩. Amal Kumar Chattopadhyay, Slavery in the Bengal Presidency under East India Company Rule, 1772-1843, Published Ph.D. thesis of London University, 1963, p. 52
    ৩৪. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত), সংবাদপত্রে সেকালের কথা, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৮৫
    ৩৫. A. K. Chattopadhyay, Slavery in the Bengal Presidency, pp. 330, 332
    ৩৬. তদেব, পৃ. ৪২১
    ৩৭. Aishika Chakrabaorty, Widows of Colonial Bengal: Gender, Morality, and Cultural Representation, Delhi, 2023, p. 51
    ৩৮. বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, কলকাতা, ১৪২৩, পৃ. ১৬২
    ৩৯. স্বপন বসু, বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস, সপ্তম পরিবর্ধিত সংস্করণ, কলকাতা, ২০২২, পৃ. ১৩৯
    ৪০. সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, উনিশ শতকের কলকাতা সরস্বতীর ইতর সন্তান, কলকাতা, দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ, ২০১৩, পৃ. ২১১
    ৪১. তদেব, পৃ. ২২০
    ৪২. তদেব, পৃ. ২০৮
    ৪৩. তদেব, পৃ. ২০৯
    ৪৪. Aparna Bandyopadhyay, ‘Hindu Revivalism and ‘Unchaste’ Widows in Colonial Bengal’, Gendered Asia: Special Issue of Asian Studies, Vols. XXXVI January 2018-December 2018, Nos. 1 and 2, p. 8
    ৪৫. কালীপ্রসন্ন দত্ত, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্রের জীবনী, কলকাতা, ১৮৯২, পৃ. ১০৯
    ৪৬. তদেব, পৃ. ১১০
    ৪৭. তদেব
    ৪৮. সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, উনিশ শতকের কলকাতা সরস্বতীর ইতর সন্তান, পৃ. ২১৭
    ৪৯. শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায় (সংকলিত ও সম্পাদিত), হিন্দু মেলার ইতিবৃত্ত, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ৭৪ 
    ৫০. কালীপ্রসন্ন দত্ত, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্রের জীবনী, পৃ. ১১১
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    হেস্টিংস-হ্যালহেড | কর্নওয়ালিস-জোন্স | রামমোহন থেকে কেরি কলিতানি
  • ধারাবাহিক | ০২ আগস্ট ২০২৪ | ৪২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Felebele | 2001:67c:2628:647:94af:c9ff:feb7:***:*** | ০২ আগস্ট ২০২৪ ২৩:০৭535615
  • "তাদের স্বদেশে, উদীয়মান নারী-স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও ইংরেজ সমাজ সংস্কারকদের সহানুভূতি আদায় — এবং তার মাধ্যমে ব্যাপক ইংরেজ মধ্যবিত্ত সমাজের নৈতিক অনুমোদন (ভারতে ইংরেজ শাসনের সপক্ষে) লাভের উদ্দেশ্যে ইংরেজ আমলা ও তাদের তাত্ত্বিক সমর্থকেরা ভারতীয় নারীদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি সবিস্তারে বিজ্ঞাপিত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ সর্বসাধারণের সামনে যে ধারণাটা তুলে ধরা হয়েছিল তা হলো — ভারতবর্ষে নারীরা সবচেয়ে বেশি পদানতা ও পশ্চাৎপদতা; সুতরাং তাদের উদ্ধারের জন্য ইংরেজ শাসন প্রয়োজনীয়।"
     
    ভাগ্যিস ইংরেজরা এরকম ভেবেছিল! ইংরেজরা না এলে এদেশে নারীমুক্তিও ঘটতো না, আর দলিতদের মধ্য থেকে আম্বেদকরও বেরিয়ে আসতেন না। ইংরেজ শাসনের ওপর সেই রাগ এলেবেলে চাড্ডিদের এখনও যায়নি।
  • :) | 2a03:4000:6:614:d803:40ff:fec3:***:*** | ০২ আগস্ট ২০২৪ ২৩:২৪535617
  • ভাগ্যে চার্চিল ছিল বলে অনেক অপোগণ্ড দুর্ভিক্ষে মরেছে, নইলে জনসংখ্যা আরও বাড়ত। রাসবিহারী বা সুভাষের মত চাড্ডির বদলে সাহেবভজা নেহরু আসাও বিরাট সৌভাগ্য।
  • কৌতূহলী | 115.187.***.*** | ০৩ আগস্ট ২০২৪ ০০:৪৫535624
  • @এলেবেলেদা
    ১) সরকারি পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিনয়ভূষণ রায় তাঁর গ্রন্থে জানান, ১৮১৫-১৮২৭ সময়কালীন বাংলার মোট ৫,৩৮৮ জন সতীর মধ্যে তিন উচ্চবর্ণ পরিবারের ছিলেন ৩,০৭৯ জন। এঁদের মধ্যে ছিলেন যথাক্রমে ব্রাহ্মণ ২০৭১ (৩৮%), কায়স্থ ৮০০ (১৫%) ও বৈদ্য ২০৮ (৪%) জন। বাকি ২,৩০৯ জন অন্ততপক্ষে ২০টি ভিন্ন জাতির বিধবা ছিলেন। 
    এটা আপনি লিখেছেন। তাঁর মানে তো উচ্চবর্ণের বাইরের নারীরাও সতীদাহের বলি হতেন,বরং বেশি হতেন।  তাহলে ''সতী শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরই সমস্যা ছিল'' বলে দলিত বুদ্ধিজীবীরা যা বলেন , সেটা সঠিক নয়?
    ২) ব্রিটিশরা কি কেবল হিন্দু আইনগুলোকেই অনুবাদ করে পুনর্লিখন করেন?ইসলাম আইনগুলোকে কি কোন ব্রিটিশ অনুবাদ করে পুনর্লিখন করেননি? এঁর উদ্দেশ্য কী? 
    ৩) এটা একটু অপ্রাসঙ্গিক কৌতুহল , প্রাচীন ভারতে নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার কি ছিল? হিন্দু বা ইসলাম কোন আইনেই? 
     
  • কৌতূহলী | 115.187.***.*** | ০৩ আগস্ট ২০২৪ ০০:৪৭535625
  • ৪)নারীর অধিকার বঞ্চনার ব্যাপারটা বুঝলাম।
    কিন্তু জ্যেষ্ঠ পুত্রদের অতিরিক্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সমস্ত পুত্রদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করার ফলে ক্ষুদ্র জমিদারি হয় ,এটাও বুঝলাম। কিন্তু ক্ষুদ্র জমিদারের থেকে রাজস্ব আদায় সুবিধা কেন? আর জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে বেশি সম্পত্তি পাইয়ে দেওয়াও তো পিতৃতান্ত্রিকই। তাহলে আগেও যে আইনটা ভাল ছিল , তা তো নয়। 
     
    ৫)আর একটা প্রশ্ন , একটু অপ্রাসঙ্গিক যদিও। 
    মনু কি কোন ব্যক্তি বিশেষ? নাকি গোষ্ঠী? 
    (এই দুটো প্রশ্ন প্রথম পর্বে করেছিলাম , আবার এখানে কপি করে দিলাম)
  • এলেবেলে | ০৪ আগস্ট ২০২৪ ১৪:২৯535704
  • কৌতূহলী, আপনি মোট ৫টি প্রশ্ন করেছেন। আমার সাধ্যমতো তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।
     
    ১. আপনার প্রথম প্রশ্ন সতীদাহ মূলত কাদের মধ্যে হত, তাই নিয়ে। আপনি নিজে যে পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করেছেন, তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সতীদের মধ্যে ব্রাহ্মণ বিধবাদের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৩৮% এবং উচ্চবর্ণের বিধবাদের মোট শতকরা হার ছিল ৫৭। এর অর্থ, বাকি ৪৩% নিম্নবর্ণের বিধবা বাংলায় সতী হয়েছিলেন। কাজেই এটি কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সমস্যা ছিল না। দলিত বুদ্ধিজীবীরা যদি গোটা ঘটনাকে সেভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন, তবে তা ভুল।
     
    একইভাবে অনেক মনে করে থাকেন যে কৌলীন্য প্রথা চালু থাকার কারণে প্রচুর বাল্যবিধবা সতী হতে বাধ্য হতেন। এটিও ভুল তথ্য। এ প্রসঙ্গে বিনয়ভূষণ রায় সতীদের বয়সের যে বিশ্লেষণ করেন, তা থেকে জানা যায় ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী সতীর সংখ্যা ছিল বাংলার সমস্ত সতীর ৫ শতাংশেরও কম। বরং ৬০ শতাংশ সতীর বয়স ছিল ৪১ বা তার বেশি। সরকারি পরিসংখ্যানেও বলা হয়, প্রায় অর্ধেক সংখ্যক সতীর বয়স ৫০ বা তার বেশি আর দুই-তৃতীয়াংশ সতীর বয়স ৪০ বা তার বেশি।
     
    ২. এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে ব্রিটিশরা যে একই সঙ্গে নতুন হিন্দু ও মুসলমান দেওয়ানি আইন চালু করার উদ্যোগ নেয়, তার উল্লেখ আছে। উল্লেখ আছে জোন্সের লেখা চিঠিরও যেখানে তিনি এই আইন চালু করার জন্য প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে উল্লেখ করেছেন রঘুনন্দনের দায়তত্ত্ব ও ঔরঙ্গজেবের চালু করা ফতোয়া-ই-আলমগিরির। এমনকি সরকারি টাকায় সংস্কৃত পণ্ডিতদের সঙ্গে আরবি-ফারসিতে অভিজ্ঞ মৌলবিদের নিয়োগের কথাও বলা আছে। আপনি দ্বিতীয় পর্বটা পড়ার সময় সম্ভবত এ বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গেছেন। আরও একবার পড়ে নিন। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে ব্রিটিশরা হিন্দু 'আইনের' পাশাপাশি ইসলামি আইনগুলোকেও অনুবাদ করে। 
     
    ৩. না, প্রাচীন ভারতে হিন্দু নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ছিল না। হিন্দু সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ খুব একটা প্রচলিতও ছিল না। রঘুনন্দনের মতে তিনটি ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হতে পারে - ক) নিম্নতর বর্ণের ব্যক্তির সঙ্গে সহবাসের ফলে স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে, খ) শিষ্য বা পুত্রের সঙ্গে সহবাসের ফলে স্ত্রী গর্ভবতী হলে এবং গ) স্ত্রী যদি অত্যন্ত ব্যসনাসক্তা হয় কিংবা ধননাশ করে। কিন্তু এসব কারণে যে আকছার বিবাহবিচ্ছেদ হত, এমনটা নয়।
     
    তবে হিন্দু মহিলারা আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতেন যা তদানীন্তন ইংল্যান্ডে অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। 
     
    ৪. 'জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে বেশি সম্পত্তি পাইয়ে দেওয়া'-টা নিয়ে একটু বলার দরকার আছে। পরিভাষায় এটাকে 'বিংশোদ্ধার' বলে। এর ফলে জ্যেষ্ঠভ্রাতা যে খুব বেশি সম্পত্তি পেতেন, এমনটা নয়। মনু যা লিখেছিলেন সে বিষয়ে একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। 
     
    ধরা যাক, পৈতৃক সম্পত্তির পরিমাণ ৮০ বিঘা জমি এবং মোট ভাই ৪ জন। তার বিশ ভাগের এক ভাগ মানে ৪ বিঘা জ্যেষ্ঠকে অতিরিক্ত দেওয়া হল। মধ্যমকে দেওয়া হল চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ অতিরিক্ত ২ বিঘা। সর্বকনিষ্ঠ পেল অতিরিক্ত ১ বিঘা। এবারে অবশিষ্ট ৭৩ বিঘা জমি সমানভাবে ভাগ করলে প্রত্যেকে পাবে ১৮.২৫ বিঘা। তৎকালীন যৌথ পরিবারে জ্যেষ্ঠপুত্রকে যেহেতু পিতৃতুল্য জ্ঞান করা হত, তাই এই ব্যবস্থা।
     
    'ক্ষুদ্র জমিদারের থেকে রাজস্ব আদায়' সুবিধাজনক কারণ ব্রিটিশ শাসকরা দেওয়ানি লাভের পরে বুঝতে পারে, জমিদারির আয়তন যত বেশি হবে তত তার 'বারগেনিং পাওয়ার' বাড়বে। আর তার অর্থ হল, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ঝঞ্ঝাট বৃদ্ধি। কাজেই তারা বছরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার সীমা নির্ধারণ করেছিল (ধরা যাক, বছরে ১ কিংবা ২ লাখ টাকা)। সেই সীমা ছাড়ালেই তারা বড় জমিদারিকে ভেঙ্গে অসংখ্য ছোট জমিদারি তৈরি করেছিল। এই কারণেই দেওয়ানি আদায়ের প্রথম দিকে বাংলায় যত জমিদার ছিলেন, তার ১০০ বছর পরে তাঁদের পরিমাণ অবিশ্বাস্য রকমে বৃদ্ধি পায়।
     
    ৫. আপনি এই লেখার অন্য একটি পর্বে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যাদের অধিকার ছিল কি না, তা জানতে চেয়েছিলেন। এই অধিকার কেবল অবিবাহিতা কন্যাদেরই ছিল না, এমনকি বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিতা কন্যাদেরও ছিল।
     
    জীমূতবাহন নির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, যদি কোনও পরিবারে চার পুত্র ও এক অবিবাহিতা কন্যা থাকে এবং মোট সম্পত্তির মূল্য হয় ১, তাহলে প্রত্যেক ভাই পাবে ১/৪ এবং বোনের অংশ হবে (১/৪ এর ১/৪) X ৪ = ১/১৬। এভাবে বোনের অংশ বিয়োগ করার পরে ভাইদের অংশ হবে ১/৪ - ১/১৬ = ৩/১৬
     
    যদি ব্যক্তিটি অপুত্রক হন এবং তার মৃত্যুর আগেই তার স্ত্রী মারা যান, তাহলে ওই অপুত্রক ব্যক্তির সম্পত্তি তার কন্যারা পাবে। এদের মধ্যে অবিবাহিতা কন্যার দাবি অগ্রগণ্য। বিবাহিতা কন্যাদের মধ্যে পুত্রহীনার থেকে পুত্রবতীর দাবি অধিকতর। 
     
    বিবাহিতা কন্যারা মায়ের স্ত্রীধনেরও দাবিদার। প্রথম দাবিদার হলেন পুত্র ও অবিবাহিতা কন্যা। তাদের ভাগ সমান। পুত্র না থাকলে পুরোটাই পাবে তার কন্যা। যদি তার অবিবাহিতা কন্যা না থাকে, তাহলে পুত্রবতী ও 'সম্ভাবিতপুত্রা' কন্যার দাবি অগ্রগণ্য।
     
    ৬. আমার জ্ঞান মতে, মনু কোনও গোষ্ঠীর নাম নয়, ব্যক্তিনাম। তিনি যে ধর্মশাস্ত্র রচনা করেছিলেন, তা বর্তমানে বিলুপ্ত। কালক্রমে অন্যান্য ঋষিরা তাকে সংক্ষিপ্ত করে সংকলন করেন। তবে প্রাক্‌-ব্রিটিশ আমলে মনু এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। থাকলে দায়ভাগ কিংবা মিতাক্ষরা চালু হয় না; মিতাক্ষরা বা দায়ভাগের এতগুলো ভাষ্য হয় না এবং মেধাতিথি ও কুল্লুকভট্টের টীকা হয় না। 
  • কৌতূহলী | 115.187.***.*** | ০৪ আগস্ট ২০২৪ ১৪:৫০535705
  • @এলেবেলেদা
    ধৈর্য ধরে আমার সব প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। হ্যাঁ ,লেখাটা আসলে অনেক বড় আর তথ্যবহুল হওয়ায় হিন্দু আইনের অনুবাদের দিকেই আমার মনোযোগ ছিল এটা ঠিক ,কিন্তু মুসলমান আইনের অনুবাদ নিয়েও আপনি আলোকপাত করেছেন ,দ্বিতীয়বার সেটাও পড়লাম।
     
    একটা ব্যাপার একটু ব্যাখা করলে ভাল হয়।
    'ক্ষুদ্র জমিদারের থেকে রাজস্ব আদায়' সুবিধাজনক কারণ ব্রিটিশ শাসকরা দেওয়ানি লাভের পরে বুঝতে পারে, জমিদারির আয়তন যত বেশি হবে তত তার 'বারগেনিং পাওয়ার' বাড়বে। আর তার অর্থ হল, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ঝঞ্ঝাট বৃদ্ধি।
    শুধু এইটুকু আর একটু ভাল করে বুঝতে চাইছি।কজ এন্ড এফেক্ট এঁর ব্যাপারটা ঠিক পরিস্কার হচ্ছে না। আসলে বিষয়টাতে আমার আগ্রহ আছে , কিন্তু বিষয়টাতে কাঁচা , তাই আপনাকে একটু ডিস্টার্ব করছি। 
    বাকি সব প্রশ্নেরই উত্তর পেয়ে গেছি
  • এলেবেলে | ০৪ আগস্ট ২০২৪ ১৫:৩০535709
  • হ্যাঁ, আমার পর্বগুলো আয়তনে বড় কারণ গোটা বিষয়টাকে উপস্থাপিত করতে গেলে এর কমে সম্ভব হয় না, অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাছাড়া আমি খেরোর খাতায় ফেসবুকের পোস্ট সাঁটছি না।
     
    হ্যাঁ, আমার লেখা তথ্যবহুল কারণ আমি সুখপাঠ্য ভ্রমণকাহিনি কিংবা স্মৃতিকথা বা গল্প লিখছি না। লিখছি একটা স্বল্প-পরিচিত ও স্বল্প-আলোচিত বিষয় নিয়ে যেখানে রেফারেন্স দেওয়াটা জরুরি বলে মনে করি। পাঠক হিসাবে আপনি তা পড়বেন কি না, সেটা আপনার বিষয়।
     
    বড় সম্পত্তিকে ভাঙলে প্রশাসকের বিস্তর সুবিধা। তার প্রথম কারণ, শরিকদের একজোট হয়ে শাসকের বিরোধিতার পথ বন্ধ করা। দ্বিতীয় কারণ, ভবিষ্যতে যাতে আর নতুন করে মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, ধলভূম, রংপুর কিংবা বিষ্ণুপুরের রাজা-জমিদারদের বিরোধিতার মুখোমুখি না হতে হয়, তার বন্দোবস্ত পাকা করা। তৃতীয় কারণ, বড় বড় জমিদারি বা ইকনমিক ইউনিট থাকা ব্রিটিশের পক্ষে থ্রেট। তারা বুঝতে পেরেছিল এর বদলে জমিদারিতে ভাগাভাগি হলে যৌথ পরিবারের ক্ষমতা কমে যাবে, প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবে। কাজেই মাঝারি আকারের জমিদারি হলেই তাকে ভেঙে দাও, নিজেদের কব্জায় রাখো। চতুর্থ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, খাজনা বকেয়া হলে যাতে কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি না হয়। বড় জমিদারির খাজনা বেশি, কাজেই তা বকেয়া থাকলে মুশকিল। ওই কারণেই প্রথমে হ্যালহেডের আইন এবং পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু। যাতে খাজনা বকেয়া থাকলেই সে জমিদারিকে নিলাম করা যায়। মনে রাখবেন, ১৭৯৩-৯৪ থেকে ১৮০৬-০৭ সালের মধ্যে বাংলা ও বিহারের মোট জমিদারি সম্পত্তির প্রায় ৪১ শতাংশ নিলামে বিক্রি হয়। 
  • কৌতূহলী | 115.187.***.*** | ০৪ আগস্ট ২০২৪ ২১:৩৮535733
  • @এলেবেলেদা, এবার বুঝলাম। 
    প্রতিটা উত্তরের জন্য অনেক ধন্যবাদ , কিন্তু একটা কথা , আমি আপনার লেখা বড় আর তথ্যবহুল বলেছি , সেটা কিন্তু ইতিবাচকভাবেই বলেছি , নেতিবাচকভাবে মোটেই বলিনি ,আর এঁর জন্য আপনার লেখা পড়ব না , সেকথাও বলিনি একবারও। 
    আপনার সব লেখাই পড়ি , এরপরও অবশ্যই পড়ব ,অবশ্যই বিদগ্ধ পাঠকদের মত মতামত দিতে পারব না , সাধারণ অনুসন্ধিৎসুর মতই মন্তব্য করব। 
    ভাল থাকুন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন