কৌতূহলী, আপনি মোট ৫টি প্রশ্ন করেছেন। আমার সাধ্যমতো তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।
১. আপনার প্রথম প্রশ্ন সতীদাহ মূলত কাদের মধ্যে হত, তাই নিয়ে। আপনি নিজে যে পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করেছেন, তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সতীদের মধ্যে ব্রাহ্মণ বিধবাদের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৩৮% এবং উচ্চবর্ণের বিধবাদের মোট শতকরা হার ছিল ৫৭। এর অর্থ, বাকি ৪৩% নিম্নবর্ণের বিধবা বাংলায় সতী হয়েছিলেন। কাজেই এটি কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সমস্যা ছিল না। দলিত বুদ্ধিজীবীরা যদি গোটা ঘটনাকে সেভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন, তবে তা ভুল।
একইভাবে অনেক মনে করে থাকেন যে কৌলীন্য প্রথা চালু থাকার কারণে প্রচুর বাল্যবিধবা সতী হতে বাধ্য হতেন। এটিও ভুল তথ্য। এ প্রসঙ্গে বিনয়ভূষণ রায় সতীদের বয়সের যে বিশ্লেষণ করেন, তা থেকে জানা যায় ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী সতীর সংখ্যা ছিল বাংলার সমস্ত সতীর ৫ শতাংশেরও কম। বরং ৬০ শতাংশ সতীর বয়স ছিল ৪১ বা তার বেশি। সরকারি পরিসংখ্যানেও বলা হয়, প্রায় অর্ধেক সংখ্যক সতীর বয়স ৫০ বা তার বেশি আর দুই-তৃতীয়াংশ সতীর বয়স ৪০ বা তার বেশি।
২. এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে ব্রিটিশরা যে একই সঙ্গে নতুন হিন্দু ও মুসলমান দেওয়ানি আইন চালু করার উদ্যোগ নেয়, তার উল্লেখ আছে। উল্লেখ আছে জোন্সের লেখা চিঠিরও যেখানে তিনি এই আইন চালু করার জন্য প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে উল্লেখ করেছেন রঘুনন্দনের দায়তত্ত্ব ও ঔরঙ্গজেবের চালু করা ফতোয়া-ই-আলমগিরির। এমনকি সরকারি টাকায় সংস্কৃত পণ্ডিতদের সঙ্গে আরবি-ফারসিতে অভিজ্ঞ মৌলবিদের নিয়োগের কথাও বলা আছে। আপনি দ্বিতীয় পর্বটা পড়ার সময় সম্ভবত এ বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গেছেন। আরও একবার পড়ে নিন। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন যে ব্রিটিশরা হিন্দু 'আইনের' পাশাপাশি ইসলামি আইনগুলোকেও অনুবাদ করে।
৩. না, প্রাচীন ভারতে হিন্দু নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ছিল না। হিন্দু সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ খুব একটা প্রচলিতও ছিল না। রঘুনন্দনের মতে তিনটি ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হতে পারে - ক) নিম্নতর বর্ণের ব্যক্তির সঙ্গে সহবাসের ফলে স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে, খ) শিষ্য বা পুত্রের সঙ্গে সহবাসের ফলে স্ত্রী গর্ভবতী হলে এবং গ) স্ত্রী যদি অত্যন্ত ব্যসনাসক্তা হয় কিংবা ধননাশ করে। কিন্তু এসব কারণে যে আকছার বিবাহবিচ্ছেদ হত, এমনটা নয়।
তবে হিন্দু মহিলারা আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতেন যা তদানীন্তন ইংল্যান্ডে অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল।
৪. 'জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে বেশি সম্পত্তি পাইয়ে দেওয়া'-টা নিয়ে একটু বলার দরকার আছে। পরিভাষায় এটাকে 'বিংশোদ্ধার' বলে। এর ফলে জ্যেষ্ঠভ্রাতা যে খুব বেশি সম্পত্তি পেতেন, এমনটা নয়। মনু যা লিখেছিলেন সে বিষয়ে একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
ধরা যাক, পৈতৃক সম্পত্তির পরিমাণ ৮০ বিঘা জমি এবং মোট ভাই ৪ জন। তার বিশ ভাগের এক ভাগ মানে ৪ বিঘা জ্যেষ্ঠকে অতিরিক্ত দেওয়া হল। মধ্যমকে দেওয়া হল চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ অতিরিক্ত ২ বিঘা। সর্বকনিষ্ঠ পেল অতিরিক্ত ১ বিঘা। এবারে অবশিষ্ট ৭৩ বিঘা জমি সমানভাবে ভাগ করলে প্রত্যেকে পাবে ১৮.২৫ বিঘা। তৎকালীন যৌথ পরিবারে জ্যেষ্ঠপুত্রকে যেহেতু পিতৃতুল্য জ্ঞান করা হত, তাই এই ব্যবস্থা।
'ক্ষুদ্র জমিদারের থেকে রাজস্ব আদায়' সুবিধাজনক কারণ ব্রিটিশ শাসকরা দেওয়ানি লাভের পরে বুঝতে পারে, জমিদারির আয়তন যত বেশি হবে তত তার 'বারগেনিং পাওয়ার' বাড়বে। আর তার অর্থ হল, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ঝঞ্ঝাট বৃদ্ধি। কাজেই তারা বছরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার সীমা নির্ধারণ করেছিল (ধরা যাক, বছরে ১ কিংবা ২ লাখ টাকা)। সেই সীমা ছাড়ালেই তারা বড় জমিদারিকে ভেঙ্গে অসংখ্য ছোট জমিদারি তৈরি করেছিল। এই কারণেই দেওয়ানি আদায়ের প্রথম দিকে বাংলায় যত জমিদার ছিলেন, তার ১০০ বছর পরে তাঁদের পরিমাণ অবিশ্বাস্য রকমে বৃদ্ধি পায়।
৫. আপনি এই লেখার অন্য একটি পর্বে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যাদের অধিকার ছিল কি না, তা জানতে চেয়েছিলেন। এই অধিকার কেবল অবিবাহিতা কন্যাদেরই ছিল না, এমনকি বিশেষ ক্ষেত্রে বিবাহিতা কন্যাদেরও ছিল।
জীমূতবাহন নির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, যদি কোনও পরিবারে চার পুত্র ও এক অবিবাহিতা কন্যা থাকে এবং মোট সম্পত্তির মূল্য হয় ১, তাহলে প্রত্যেক ভাই পাবে ১/৪ এবং বোনের অংশ হবে (১/৪ এর ১/৪) X ৪ = ১/১৬। এভাবে বোনের অংশ বিয়োগ করার পরে ভাইদের অংশ হবে ১/৪ - ১/১৬ = ৩/১৬
যদি ব্যক্তিটি অপুত্রক হন এবং তার মৃত্যুর আগেই তার স্ত্রী মারা যান, তাহলে ওই অপুত্রক ব্যক্তির সম্পত্তি তার কন্যারা পাবে। এদের মধ্যে অবিবাহিতা কন্যার দাবি অগ্রগণ্য। বিবাহিতা কন্যাদের মধ্যে পুত্রহীনার থেকে পুত্রবতীর দাবি অধিকতর।
বিবাহিতা কন্যারা মায়ের স্ত্রীধনেরও দাবিদার। প্রথম দাবিদার হলেন পুত্র ও অবিবাহিতা কন্যা। তাদের ভাগ সমান। পুত্র না থাকলে পুরোটাই পাবে তার কন্যা। যদি তার অবিবাহিতা কন্যা না থাকে, তাহলে পুত্রবতী ও 'সম্ভাবিতপুত্রা' কন্যার দাবি অগ্রগণ্য।
৬. আমার জ্ঞান মতে, মনু কোনও গোষ্ঠীর নাম নয়, ব্যক্তিনাম। তিনি যে ধর্মশাস্ত্র রচনা করেছিলেন, তা বর্তমানে বিলুপ্ত। কালক্রমে অন্যান্য ঋষিরা তাকে সংক্ষিপ্ত করে সংকলন করেন। তবে প্রাক্-ব্রিটিশ আমলে মনু এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। থাকলে দায়ভাগ কিংবা মিতাক্ষরা চালু হয় না; মিতাক্ষরা বা দায়ভাগের এতগুলো ভাষ্য হয় না এবং মেধাতিথি ও কুল্লুকভট্টের টীকা হয় না।