এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  সমোস্কিতি

  • বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন

    এলেবেলে লেখকের গ্রাহক হোন
    সমোস্কিতি | ০৯ এপ্রিল ২০২৩ | ৩২৬২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৮ (১০ জন)
  • ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় হিসেব কষে দেখান যে, চর্যাপদ-এর হাজার দুয়েক শব্দের মধ্যে খাঁটি তৎসম (অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে গৃহীত এবং আদিরূপে অক্ষুণ্ণ) শব্দের পরিমাণ ছিল শতকরা পাঁচ ভাগের মতো। পরবর্তীকালে চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে এই সংখ্যাটা শতকরা ১২.৫ ভাগে দাঁড়ায়। আর মধ্যযুগের কোনও কোনও কাব্যে সংস্কৃত শব্দের পরিমাণ ছিল মোট শব্দের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এ তো গেল কাব্যসাহিত্যের কথা। অন্যদিকে, তৎকালীন জনপ্রিয় বাংলা লোকগাথা ও কথ্য কাহিনিগুলিতে ছিল মাত্র এক-তৃতীয়াংশ তৎসম  শব্দ, বাকি শব্দভাণ্ডারে তদ্ভব (অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে বিকৃত ও প্রাকৃত ভাষায় রূপান্তরিত) ও দেশি শব্দের আধিপত্য ছিল।

    অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলা গদ্যের কিছু নিদর্শন যেমন— চিঠিপত্র, দলিল, ফরমান ইত্যাদি পাওয়া যায়। এই সময়ের বাংলা গদ্যের নমুনা হিসেবে আমরা দেবেশ রায়ের গ্রন্থে পাই: “বিশেষ অনেক দিবসের পরে তোমার পত্র পাইয়া সবিশেষ জ্ঞাত হইলাম। তুমি এক মহাজন করিয়া তিন হাজার টাকা কর্জ লইয়া মোকাম খাষদহ চাল খরিদ করিতে গিয়াছ, সে ভালই করিয়াছ। ইহা না করিলে তোমার গুজরান কী রূপে চলিবেক? তোমার বাটীর খরচ আটভারি, পরিজন অনেকগুলিন। তোমরা কোন রূপে প্রতুল করিয়া পরিজনের ভরণপোষণ করহ ইহার বাড়া আর আমার আনন্দ নাই। জেয়াদা কী লিখব, জ্ঞাত করিলাম, তারিখ ১২ চৈত্র।” আর আনিসুজ্জামানের গ্রন্থ থেকে আমরা প্রচলিত বাংলা গদ্যের যে চলন দেখি, তা এইরকম: “সুপ্রতিষ্ঠিত শ্রী বাবুরাম চোপড়ে গোমান্তে আড়ঙ্গে নারায়ণপুর লিখ নং প্রয়োজনঞ্চ বিশেষঃ আড়ঙ্গ মজকুরের এক চালান ১২৪৩ থান কাপড় পাঠাইয়াছিলে। সদর যাচাইতে ৭৬৫ থান চুক্তি সহি হইয়া, নিরস বেজাতদিগের সর্ব ৪৭৮ থান ফেরত হইয়া যাচাইয়ের ফর্দ সংবলিত আড়ঙ্গে যাইতেছে। দৃষ্টি করিয়া তাঁতিলোককে ফেরত দিবে। এ চালানে বার শত কয়েক থান কাপড় আসিয়া ৪৭৮ থান ফেরত হইল।” এই দুটি উদাহরণ থেকেই এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায়, তৎকালীন বাংলা গদ্যেও তৎসম ও তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি আরবি-ফারসি-দেশি শব্দেরও বহুল প্রচলন ছিল।
     
    কিন্তু ১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের উপনিবেশ স্থাপনের পর থেকেই বাংলা গদ্যের এই স্বাভাবিক চলনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার এ কথার সমর্থনে জানান: “It was when the Pandits of the College of Fort William at Calcutta began writing text-books to order, that the vicious habit of writing in strings of Sanskrit words and phrases, with a Bengali verb or particle here and there, came in, and partly paralysed the Bengali literary style (in prose) for half a century.” ঠিক কী কারণে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের হাতে বাংলা ভাষা এতটা সংস্কৃত শব্দবহুল হয়ে উঠল, সে ইতিহাসটা জানা প্রয়োজন।

    বস্তুতপক্ষে ষোড়শ শতক থেকেই ইউরোপীয় দার্শনিকরা মানুষের ‘আদি’ ভাষার সন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, পৃথিবীর সমস্ত ভাষাই সেই আদি ভাষা থেকে সৃষ্ট। এই আদি ভাষাকে তাঁরা ‘পবিত্র’ ও ‘অভিজাত’ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। ফলে সমগ্র ইউরোপের জন্য এই আদি ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল লাতিন, গ্রিক ও হিব্রু। ১৭৬৯ সালে হার্ডার Essay on the Origin of Language প্রবন্ধে পৃথিবীর সমস্ত ভাষাকে একটিমাত্র ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে যুক্তি দেখান। এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পরে, এই আদি ভাষার ধারণাটি আরও জোরালো হয়। অতঃপর শ্বেতাঙ্গদের (বর্তমানের পরিভাষায় ককেশিয়ান) ভাষাকে শ্রেষ্ঠতম ধরে নিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর নির্মাণ শুরু হয় এবং সেমেটিক (প্রধানত আরবি) ও হ্যামিটিক (উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত) ভাষাসমূহকে অ-শ্বেতাঙ্গদের (মূলত বাদামি বর্ণের মানুষজন) ভাষা হিসেবে চিহিত করা হয়। এই ভাষাশ্রেণির একদম শেষ স্তরে আশ্রয় নেয় ‘কালা আদমি’-দের নিগ্রিটিক (জুলু) বা সুদানিক (ইথিওপিয়া থেকে সেনেগাল অবধি প্রচলিত) ভাষাগুলি। এভাবে তিনটি স্তরে থাকবন্দি হয় পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা।

    যদিও এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীতে সংস্কৃতকে স্থান দেওয়া হয়, কিন্তু ব্রিটিশরা তাকে অতীত ভারতবর্ষের লুপ্ত গরিমা হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা এ কথা প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে যে, সংস্কৃত ‘মৃত’ ভাষা এবং তার সঙ্গে বর্তমান উপমহাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। অথচ তখনও যে সংস্কৃত সাহিত্যের অনেক আখ্যান-উপাখ্যানের নিদর্শন দেশীয় ভাষাতেও পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল— এই সহজ কথাটা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বিস্মৃত হয়। এই প্রকল্পে ইচ্ছাকৃত অথচ অনৈতিহাসিকভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে ফারসিকে বাদ দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এই প্রক্রিয়ার আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে যেমন আরবিকে বাতিল করা হয়, তেমনই তদানীন্তন ভারতবর্ষে প্রচলিত সমস্ত দেশীয় ভাষাকে হয় ‘তদ্ভব’ নতুবা অপকৃষ্ট ‘দেশি’ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে এখানেও ভাষাকে তিনটি স্তরে থাকবন্দি করে ফেলার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

    হার্ডারের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার ঠিক ৯ বছর পরে, A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থে হ্যালহেড স্পষ্ট জানান, বাংলা ভাষার ‘forms of letters’, ‘modes of spelling’ এবং ‘choice of words’ সবই ‘equally erroneous and absurd’। ফলে তাদের লেখায় ফারসি, আরবি ও হিন্দুস্থানি শব্দ গিজগিজ করে। মোদ্দা কথা, বাঙালি বলতে-লিখতে জানে না, তাই নিজের ভাষায় গুচ্ছের অন্য ভাষার শব্দ গুঁজে দিয়ে ভাষাটাকে অকারণে ‘দুর্বোধ্য’ ও ‘দুষ্পাঠ্য’ করে তোলে। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, মুসলমান শাসনের আগে, বাংলা ভাষায় প্রয়োজনমাফিক সংস্কৃত শব্দসম্ভার আহরণ করা হত বলে বাংলা ভাষার প্রকৃতি অকৃত্রিম ও সরল ছিল। কিন্তু মুসলমান শাসনকর্তাদের অত্যাচারের ফলে ও সমস্ত বিষয়ে রাজভাষা ফারসির ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়ার কারণে, বাংলা ভাষার শুদ্ধতা নষ্ট হয়ে গেছে এবং বহু আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে গেছে।
     
    এই গ্রন্থে হ্যালহেড রীতিমতো গর্বভরে জানান, তিনিই প্রথম ইউরোপীয় যিনি ‘আবিষ্কার’ করেছেন ‘the Bengal language merely as derived from its parent Shanscrit’। ১৭৮৬-র ২ ফেব্রুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটির তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনের বক্তৃতায়, ‘ভারততত্ত্ববিদ’ উইলিয়াম জোন্স হ্যালহেডের পথ ধরেই দেখান যে গ্রিক, লাতিন ইত্যাদি ভাষার শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে সংস্কৃতের মিল যথেষ্ট। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, হ্যালহেড আদপেই সংস্কৃত জানতেন না। তিনি যে বাংলা ভাষাটাও খুব ভালো জানতেন, তেমনটাও বলা চলে না। আর জোন্স যখন দৃপ্ত ভঙ্গিতে গ্রিক ও লাতিন ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের সাযুজ্যের কথা ঘোষণা করছেন, তখন তাঁর সংস্কৃত শিক্ষার বয়স সাকুল্যে তিন বছরও পার হয়নি।

    এই বক্তৃতায় জোন্স যখন ভারতীয় বৈদিক ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্মদাতারূপে আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পশ্চিমি হেলেনিক-লাতিন আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আত্মীয়তা ‘আবিষ্কার’ করেন, তখন থেকেই ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের প্রাচীন যুগকে প্রথমে ‘আর্য’ ও পরে ‘হিন্দু’ যুগ হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। তাঁর আবিষ্কারের সূত্রে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে কোনও কোনও গবেষক প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন যে হিন্দু ও ইউরোপীয়দের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই, কারণ উভয় সম্প্রদায়ই আর্য গোষ্ঠীর বংশোদ্ভূত। পাশাপাশি একই সময়ে, ব্রিটিশরা অত্যন্ত সুকৌশলে ভারতীয় মধ্যযুগকে ‘মুসলিম শাসনের দুঃশাসনের সমার্থক ও হিন্দু গৌরবের পতনের কাল’ প্রতিপন্ন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে।
     
    এই ভ্রান্ত ইতিহাস নির্মাণের পেছনে প্রধানত দুটি কারণ বিদ্যমান ছিল। প্রথমত, আন্তর্জাতিক স্তরে আনুমানিক ষষ্ঠ শতক থেকে ভূমধ্যসাগরে মুসলিম আধিপত্য বিস্তার, স্পেনে উম্মাইয়াদ কর্তৃত্ব স্থাপন, শার্লম্যানের আমলে ফ্রান্সের সীমান্তে খ্রিস্টান-মুসলিম সংঘর্ষ, দীর্ঘ সময়ব্যাপী ক্রুসেড— এই সবই পশ্চিমি ঐতিহাসিকদের তীব্র মুসলমানবিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টির সহায়করূপে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে নয়, আঞ্চলিকভাবেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা এই ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়েরই করায়ত্ত ছিল। ফলে এ দেশে এসেও বাংলা, মহীশূর, অযোধ্যা, দিল্লি প্রভৃতি স্থানের মুসলমান নবাব-সম্রাটদের  শাসনক্ষমতা থেকে উৎখাত করেই ব্রিটিশ শক্তি ভারতবর্ষ অধিকার করে। তাই ভারতবর্ষ অধিকারের প্রথম দিন থেকেই ব্রিটিশ রাজশক্তি মুসলমান সম্প্রদায়কে তার সবথেকে বিপদের কারণরূপে গণ্য করে। দিল্লির বাইরের একটা বিরাট অংশ যে অধিকাংশ সময় স্বাধীন ছিল কিংবা মুসলিম অধিকৃত হলেও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছিল, মধ্যযুগেও যে মুসলিম বিজয়ী ও অমুসলিম বিজিতদের মধ্যে সম্প্রীতি-সমন্বয় এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ছিল— এমন ধারণাকে এই কৃত্রিম বিভেদকামী যুগ বিভাজন পর্বে সুচতুরভাবে ভুলিয়ে দেওয়া শুরু হয়।

    একই সঙ্গে ইংরেজরা প্রচার করে যে, দীর্ঘ সাতশো বছর ইসলামি শাসনের অত্যাচার ও ধর্মান্ধতার ফলে ঐতিহ্যময় হিন্দু স্বর্ণযুগের গরিমা কলুষিত ও প্রায় অবলুপ্তির পথে। ফলে এই ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ মধ্যযুগের আঁধার কাটিয়ে হিন্দুদের ‘আলোকোজ্জ্বল’ আধুনিক যুগে প্রবেশ করতে চাইলে, ব্রিটিশদের বদান্যতায় এ দেশে সভ্যতার সূর্যোদয়ের আলো গ্রহণ করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রথমে জোন্সের প্রাচ্যচর্চার উদার দাক্ষিণ্যে হিন্দুদের মধ্যে সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ়মূল ও সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তীকালে হিন্দুদের ‘উদ্ধার’ করা এবং মুসলমান শাসনকে ‘বিদেশি’ শাসন হিসেবে প্রতিপন্ন করার কাজে পরিকল্পিতভাবে কোমর বেঁধে মাঠে নামে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।
     
    হ্যালহেডের মতোই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান উইলিয়াম কেরি, বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি শব্দের আধিক্য নিয়ে একই মনোভাব পোষণ করতেন। এ প্রসঙ্গে সজনীকান্ত দাস লেখেন: “১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে হালহেড এবং পরবর্তী কালে হেন্‌রি পিট্‌স ফরষ্টার ও উইলিয়ম কেরী বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতজননীর সন্তান ধরিয়া আরবী পারসীর অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে রীতিমত ওকালতি করিয়াছেন এবং প্রকৃতপক্ষে এই তিন ইংলণ্ডীয় পণ্ডিতের যত্ন ও চেষ্টায় অতি অল্প দিনের মধ্যে বাংলা ভাষা সংস্কৃত হইয়া উঠিয়াছে। ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে এই আরবী-পারসী-নিসূদন-যজ্ঞের সূত্রপাত এবং ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে আইনের সাহায্যে কোম্পানীর সদর মফস্বল আদালতসমূহে আরবী পারসীর পরিবর্তে বাংলা ও ইংরেজী প্রবর্তনে এই যজ্ঞের পূর্ণাহুতি। ...এই যজ্ঞের ইতিহাস অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক, ...সাহেবেরা সুবিধা পাইলেই আরবী-পারসীর বিরোধিতা করিয়া বাংলা ও সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিতেন, ফলে দশ পনর বৎসরের মধ্যেই বাংলা-গদ্যের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়াছিল।”১০ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও একই কথা বলেছেন। ভাষাবিরোধের সঙ্গে সম্প্রদায়-বিরোধের প্রসঙ্গ টেনে তিনি জানান: “সাহেবরা সুবিধা পেলেই ফার্সি আরবি শব্দকে বাদ দিয়ে বাংলা গদ্যের আকৃতি ও প্রকৃতি সংস্কৃত-ঘেঁষা করতে চাইতেন। মুসলনমানদের কাছ থেকে ইংরেজ ভারত অধিকার করেছিল, তাই বোধ হয় মুসলমানদের প্রতি কোনোরূপ সদয়ভাব না দেখিয়ে নিরীহ হিন্দুদের উপরই আকর্ষণটা স্পষ্টতর করবার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল...।”১১ এহেন কেরির অধীনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতরা যে বাংলা ভাষা থেকে যাবতীয় আরবি-ফারসি-হিন্দুস্তানি শব্দকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে তাকে ‘নিখাদ’ সংস্কৃতগন্ধী করে তুলবেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

    কিন্তু ঠিক কিসের বিনিময়ে আমাদের বাংলা এতটা সংস্কৃতগন্ধী হয়ে উঠল, সেটা দেখে নেওয়া জরুরি। প্রথমত, বাংলায় ১২০৫-০৬ থেকে ১৩৩৮ অবধি তুর্কি, ১৩৩৮-১৫৭৫ পর্যন্ত তুর্কি-পাঠান এবং ১৫৭৬-১৭৫৭ অবধি মুঘল শাসন বজায় থাকলেও বাঙালি কোনও অর্থেই পরাধীন ছিল না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এই আমলেই রচিত হয় কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত, একাধিক মঙ্গলকাব্য, বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত (১৫৩৫), লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল (১৫৩৭) এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত (১৬১২)। দ্বিতীয়ত, সেই আমলে যেমন একাধিক মুসলমান কবি বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেন; সৈয়দ আলাওল লেখেনপদ্মাবতী কাব্য; তেমনই রামপ্রসাদ সেন কিংবা ভারতচন্দ্রের সাহিত্যকর্মেও বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্রাত্য ছিল না।

    এই বিষয়ে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন: “ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত-মণ্ডলী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন, বঙ্গভাষা তেমনই সুধী-সমাজের অপাংক্তেয় ছিল— তেমনই ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।
    কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবারীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল।
    মুসলমান বিজয় বাঙ্গলাভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল,— তাঁহারা ইরান, তুরাণ যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভৃমি, সেইদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভুমি হইল। তাঁহারা বাণিজ্যের অছিলায় এদেশ হইতে রত্নাহরণ করিতে আসেন নাই, তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুর মত এদেশ-বাসী হইয়া পড়িলেন। হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল।”১২ অতঃপর তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এই কথা লিখে: “এ হেন প্রতিকূল ব্রাহ্মণ-সমাজ কি হিন্দুরাজত্ব থাকিলে বাঙ্গলাভাষাকে রাজসভার সদর দরজায় ঢুকিতে দিতেন? সুতরাং কথা মুক্তকঠে বলা যাইতে পারে যে, মুসলমান সম্রাটেরা বাঙ্গলাভাষাকে রাজ দরবারে স্থান দিয়া ইহাকে ভদ্র সাহিত্যের উপযোগী করিয়া নূতন ভাবে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।”১৩ [নজরটান সংযোজিত] কিন্তু হায়, যাঁদের দৌলতে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে পরিগণিত হল; যে ভাষার শব্দভাণ্ডারে বাংলার সঙ্গে একই পঙ্‌ক্তিতে স্থান করে নিল অজস্র আরবি-ফারসি-হিন্দুস্তানি শব্দ; সেই বাংলা ভাষাই হ্যালহেড-জোন্স-কেরির দৌলতে হয়ে উঠল সংস্কৃতঘেঁষা।

    আসলে এই বাংলা গদ্যের মূল উদ্দেশ্য নিছক সাহিত্যচর্চা ছিল না, বরং তা ছিল শাসনযন্ত্রকে মসৃণ রাখার জন্য শাসক ও শাসিতের মধ্যে ভাব বিনিময়ের একটি নীরস কেজো মাধ্যম মাত্র। সেই কারণে এই মাধ্যমের পূর্ণ পকড়টা ব্রিটিশরা নিজেদের হাতে রাখে। দেবেশ রায়ের মতে: “এই বাংলা গদ্যচর্চায় সংস্কৃত পণ্ডিতরা সাহেবদের যোগ্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। সাহেবরা বাংলা জানতেন না— কিন্তু তাঁরা বাংলা গদ্যে কী লেখা হবে, সেই বিষয়টি অতি স্পষ্টভাবে জানতেন। সংস্কৃত পণ্ডিতরাও বাংলা গদ্য জানতেন না— কিন্তু তাঁরা ঐ বিষয়ের উপযুক্ত ভাষা কী হতে পারে তার একটা আন্দাজ জানতেন।”১৪ সাহেব ও সংস্কৃত পণ্ডিতদের মধ্যে এই কার্যকর সমঝোতার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল: “ইংরেজদের দিক থেকে সংস্কৃত পণ্ডিতরা যেমন বাংলা ভাষার সাহেববোধ্য রূপের মাধ্যম হয়ে উঠেছিলেন, তেমনি হিন্দু ব্রাহ্মণদের দিক থেকে সাহেবরা হয়েছিলেন ব্রাহ্মণদের ‘লুপ্ত-গৌরব’ পুনরুদ্ধারের মাধ্যম।”১৫ আর তাই, হ্যালহেড ও জোন্সের দেখানো পথ ধরে বিদেশি সাহেবদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও দেশি পণ্ডিতদের সক্রিয় সহযোগিতায় শুরু হয় বাংলা ভাষা থেকে ‘অদরকারি’ আরবি-ফারসি-হিন্দুস্তানির ‘খাদ’ বিসর্জন দিয়ে বাংলার ‘নিখাদ’ সংস্কৃতায়ন প্রকল্প।

    ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পরে কেরির নেতৃত্বে যে বাংলা গদ্যচর্চা শুরু হয়, সেখানে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু প্রমুখ বাঙালি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বাংলাকে সংস্কৃতের দুহিতা জ্ঞান করে ব্যাকরণরীতি ও শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে সংস্কৃতের ওপর অত্যন্ত বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। ফলে তাঁরা এমন এক ধরণের বাংলা গদ্যভাষা উদ্ভাবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যেখানে কথ্য ও প্রচলিত বাংলা ভাষা থেকে আরবি, ফারসি ও অন্ত্যজ শব্দগুলি সুচিন্তিত উপায়ে বিতাড়িত করে তার বদলে সংস্কৃত ও অর্ধ-তৎসম শব্দ প্রবর্তিত করা হয়।

    ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয় রামরাম বসু প্রণীত প্রথম মুদ্রিত মৌলিক বাংলা গদ্যগ্রন্থ রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র। এই গ্রন্থের কোথাও কোথাও আরবি-ফারসি শব্দের বাহুল্য দেখে ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হলেও আসলে যেখানে যেখানে মুসলমান শাসনকর্তা অথবা শাসনকার্য বা রাজস্ববিষয়ের উল্লেখ আছে, কেবল সেসব জায়গাতেই আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে রীতিমতো পরিসংখ্যান হাজির করে শিশিরকুমার দাশ জানান, প্রায় ১৪,৯৭৬ শব্দবিশিষ্ট গ্রন্থটিতে ফারসি শব্দের পরিমাণ মাত্র ৩.৪ শতাংশ।১৬  বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যখন রামরাম বসু পরের বছর লিপিমালা­­-য় (১৮০২) লেখেন: “এই মতে প্রেমাশক্ত সতী ও মাতাকে প্রণাম করিয়া আর ২ [আর] সমস্ত ভগিনী ও অমাত্যগণকে সম্ভাষ করিয়া যজ্ঞ স্থানে পিতার নিকটে যাইয়া প্রণাম করিলে দক্ষ তাহাকে দেখিবা মাত্রেই হরকোপে কোপিত হইয়া শিব নিন্দায় প্রবর্ত হইল। কহিল কন্যে তুমি কিমর্থে এখানে আসিয়াছ তোমার স্বামী ভূতের পতি শ্মশান মসানে তাহার অবস্থিতি হাড় মালা গলায় সাপ লইয়া তাহার খেলা বাদিয়ার বেশ তোমার কপাল মন্দ অতএব এমত ঘটনা তোমাকে হইয়াছে আমি তাহাকে নিমন্ত্রণ করিলাম না। এ দেবসভা আমি ব্রহ্মার পুত্র বাদিয়ার নিমন্ত্রণ দেবসভায় হইতে পারে না। সতী কহিলেন পিতা এমত কুৎসা মহাদেবের প্রতি কহ কেন মহাদেব দেবদেব ব্রহ্মা বিষ্ণু ইত্যাদি যাহার পদযুগে শরণাগত হয় যে হর মহাবীর ত্রিপুরাসুরকে সংহার করিলেন যে হর কালকূট পান করিয়া সৃষ্টি রক্ষা করিলেন তাহাকে কুৎসাবাক্য তোমা ব্যতিরেক কেহ কহে না তুমি এই অনুচিত ক্রিয়া কেন কর।”১৭ রামরাম বসুর মতো মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের গদ্যরীতিতেও আমরা একই গদ্যভঙ্গীর পুনরাবৃত্তি দেখতে পাব।

    ১৮০২ সালে প্রকাশিত বত্রিশ সিংহাসন-এ পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার সংস্কৃতাশ্রয়ী বাংলা গদ্যের নমুনা রাখেন এইভাবে: “এই বৃত্তান্ত লোক পরম্পরাতে ধারাপুরীর রাজা ভোজ শুনিলেন। অনন্তর রাজা কৌতুকাবিষ্ট হইয়া মন্ত্রী সামন্ত সৈন্য সেনাপতির সহিত মঞ্চের নিকটে গিয়া কৃষকের ব্যবহার প্রত্যক্ষ দেখিয়া আপনার অত্যন্ত বিশ্বাসপাত্র এক মন্ত্রীকে মঞ্চের উপরে বসাইলেন। সেই মন্ত্রী যাবত মঞ্চের উপর থাকে তাব্ত রাজাধিরাজের প্রায় প্রতাপ ও শাসন ও মন্ত্রণ করে। ইহা দেখিয়া রাজা চমৎকৃত হইয়া বিচার করিলেন যে এ শক্তি মঞ্চের নয় এবং কৃষকেরও নয় এবং মন্ত্রীরও নয় কিন্তু এ স্থানের মধ্যে চমৎকার কোনহ বস্তু আছেন তাহারি শক্তিতে কৃষক রাজাধিরাজ প্রায় হয়।”১৮ এই মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের একটি মন্তব্য থেকে কথ্য ভাষা বা ‘ইতর’ বাংলা সম্পর্কে পণ্ডিতসমাজের মনোভাব বেরিয়ে আসে।

    বেদান্তচন্দ্রিকা-য় (১৮১৭) তিনি লেখেন: “...যেমন রূপালঙ্কারবতী সাধ্বী স্ত্রীর হৃদয়ার্থবোদ্ধা সুচতুর পুরুষেরা দিগম্বরী অসতী নারীর সন্দর্শনে পরাঙ্মুখ হন তেমনি সালঙ্কারা শাস্ত্রার্থবতী সাধুভাষার হৃদয়ার্থবোদ্ধা সৎ পুরুষেরা নগ্না উচ্ছৃঙ্খলা লৌকিক ভাষা শ্রবণমাত্রেতেই পরাঙ্মুখ হন।”১৯ [নজরটান সংযোজিত] প্রসঙ্গত, ১৮১৫ সালে প্রকাশিত বেদান্ত গ্রন্থ-তে সর্বপ্রথম এই সংস্কৃতবহুল বাংলা গদ্যকে ‘সাধু’ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেন রামমোহন। এ ভাষায় কাদের অধিকার সম্ভব, তা তিনি নির্ধারণ করে দেন এই কথা বলে: “জাঁহাদের সংস্কৃতে বুৎপত্তি কিঞ্চিতো থাকিবেক আর জাঁহারা বুৎপন্ন লোকের সহিত সহবাস দ্বারা সাধু ভাষা কহেন আর সুনেন তাঁহাদের অল্প শ্রমেই ইহাতে অধিকার জন্মিবেক।”২০ সুতরাং, এ ভাষার শ্রেণিচরিত্র বেশ স্পষ্ট। অতীতের সামন্ততান্ত্রিক হিন্দু সমাজের সংস্কৃতজ্ঞ উঁচু জাতের এবং অন্যান্য করিৎকর্মা লোকেরা যাঁরা ইংরেজ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের নব্যপ্রাপ্ত অর্থবলে উনিশ শতকের কলকাতার ‘ব্যুৎপন্ন লোকের সহিত সহবাস’ করতে সক্ষম’, কেবল তাঁদের জন্যই সাধু বাংলা ভাষা।

    এই মনোভাবের কারণে তদানীন্তন সংস্কৃত পণ্ডিতরা আরবি-ফারসির বিরুদ্ধে এতটাই বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, ১৮২৩ সালে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলিকাতা কমলালয় গ্রন্থে প্রায় দুশোটি এই রকম শব্দের তালিকা রচনা করে মন্তব্য করেন: “...ভদ্র লোকের মধ্যে অনেক লোক স্বজাতীয় ভাষায় অন্য জাতীয় ভাষা মিশ্রিত করিয়া কহিয়া থাকেন ...ইহাতে বোধহয় সংস্কৃত শাস্ত্র ইহারা পড়েন নাই এবং পণ্ডিতের সহিত আলাপও করেন নাই তাহা হইলে এতাদৃশ বাক্য ব্যবহার করিতেন না স্বজাতীয় এক অভিপ্রায়ের অধিকভাষা থাকিতে যাবনিক ভাষা ব্যবহার করেন না।”২১ পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা থেকে এই সব ‘যাবনিক’ শব্দ অপসারণে সচেষ্ট হন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার।
     
    ১২৪৫ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৩৮ সালে প্রকাশিত পারসীক অভিধা গ্রন্থে শিক্ষিত পাঠকরা যাতে তৎকালীন কথ্য বাংলায় প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দগুলি চিনে নিয়ে বাদ দিতে পারে, আর তার পরিবর্তে অধিক হারে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে পারে— সেই উদ্দেশ্যে গ্রন্থটির ভূমিকায় জয়গোপাল লেখেন: “এই ভারতবর্ষে প্রায় নয় শত বৎসর হইল যবন সঞ্চার হওয়াতে তৎসমভিব্যাহারে যাবনিক ভাষা অর্থাৎ পারসী ও আরবীভাষা এই পুণ্যভূমিতে অধিষ্ঠান করিয়াছে অনন্তর ক্রমে যেমন যবনদের ভারতবর্ষাধিপত্য বৃদ্ধি হইতে লাগিল তেমন রাজকীয় ভাষা বোধে সর্বত্র সমাদর হওয়াতে যাবনিক ভাষার উত্তরোত্তর এমত বৃদ্ধি হইল যে অন্য সকল ভাষাকে পরাস্ত করিয়া আপনি বর্ধিষ্ণু হইল এবং অনেক অনেক স্থানে বঙ্গভাষাকে দূর করিয়া স্বয়ং প্রভুত্ব করিতে লাগিল বিষয় কর্মে বিশেষত বিচারস্থানে অন্য ভাষার সম্পর্কও রাখিল না তবে যে কোন স্থলে অন্য ভাষা দেখা যায় সে কেবল নাম মাত্র। সুতরাং আমাদের বঙ্গভাষার তাদৃশ সমাদর না থাকাতে এইক্ষণে অনেক সাধুভাষা লুপ্তপ্রায়া হইয়াছে এবং চিরদিন অনালোচনাতে বিস্মৃতিকূপে মগ্না হইয়াছে যদ্যপি তাহার উদ্ধার করা অতি দুঃসাধ্য তথাপি আমি বহুপরিশ্রমে ক্রমে ক্রমে শব্দ সঙ্কলন করিয়া সেই বিদেশীয় ভাষাস্থলে স্বদেশীয় সাধু ভাষা পুনঃ সংস্থাপন করিবার কারণ এই পারসীক অভিধান সংগ্রহ করিলাম।”২২ [নজরটান সংযোজিত] প্রায় আড়াই হাজার আরবি-ফারসি শব্দকে সংস্কৃত ভাষায় পুনঃস্থাপিত করেও শান্তি পাননি তিনি।

    বাংলা ভাষার এই ‘স্বদেশি’ ও ‘বিদেশি’ শব্দভাণ্ডার নিয়ে তিনি এতটাই চিন্তিত হন যে, পরবর্তী গ্রন্থ বঙ্গাভিধান-এর ভূমিকায় জয়গোপাল তর্কালঙ্কার লেখেন: “বঙ্গভূমি নিবাসি লোকের যে ভাষা সে হিন্দুস্থানীয় অন্য ২ [অন্য] ভাষা হইতে উত্তমা যে হেতুক অন্যভাষাতে সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক অত্যল্প কিন্তু বঙ্গভাষাতে সংস্কৃতভাষার প্রাচুর্য আছে বিবেচনা করিলে জানা যায় যে বঙ্গভাষাতে প্রায়ই সংস্কৃত শব্দের চলন যদ্যপি ইদানীং ঐ সাধুভাষাতে অনেক ইতর ভাষার প্রবেশ হইয়াছে তথাপি বিজ্ঞ লোকেরা বিবেচনা পূর্বক কেবল সংস্কৃতানুযায়ি ভাষা লিখিতে ও তদ্দ্বারা কথোপকথন করিতে চেষ্টা করিলে নির্বাহ করিতে পারেন এই প্রকার লিখন পঠন ধারা অনেক প্রধান ২ [প্রধান] স্থানে আছে। এবং ইহাও উচিত হয় যে সাধু লোক সাধুভাষাদ্বারাই সাধুতা প্রকাশ করেন অসাধুভাষা ব্যবহার করিয়া অসাধুর ন্যায় হাস্যাস্পদ না হয়েন।”২৩ ‘সাধুভাষা’ ও ‘অসাধুভাষা’ নিয়ে জয়গোপালের মতোই তাঁর প্রিয় ছাত্র বিদ্যাসাগরও একই মত পোষণ করতেন।

    ১৮৫৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির আলোচনা সভায়, বেথুন সোসাইটির পক্ষ থেকে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই উপলক্ষে লিখিত সংস্কৃতভাষা সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব প্রবন্ধের উপসংহারে বিদ্যাসাগর জানান: “...সংস্কৃতভাষানুশীলনের এক অতি প্রধান ফল এই যে, ইদানীন্তন কালে ভারতবর্ষে হিন্দী, বাঙ্গালা প্রভৃতি যে সকল ভাষা কথোপকথনে লৌকিক ব্যবহার প্রচলিত আছে, সে সমুদয় অতি হীন অবস্থায় রহিয়াছে। ইহা একপ্রকার বিধিনির্বন্ধস্বরূপ হইয়া উঠিয়াছে যে, ভুরি পরিমাণে সংস্কৃত কথা লইয়া সকল ভাষায় সন্নিবেশিত না করিলে তাহাদের সমৃদ্ধি শ্রীবৃদ্ধি করা যাইবেক না। কিন্তু, সংস্কৃতভাষায় সম্পূর্ণরূপ বুৎপত্তিলাভ ব্যতিরেকে, তৎসম্পাদন কোনও মতে সম্ভাবিত নহে।”২৪ [নজরটান সংযোজিত] তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ বেতালপঞ্চবিংশতি-তে (১৮৪৭) ভিড় করে আসে প্রাড়্‌বিবাক, বৈয়র্থ, ভুরুহ, মলিম্লুচ, মহানস প্রভৃতি অপ্রচলিত শব্দ। শুধু তাই নয়, বর্ণপরিচয়-এর প্রথম ভাগে অক্ষর পরিচয়ের একেবারে প্রাথমিক স্তরে শিশুদের ক্রমাগত ঐরাবত, ঔষধ, মহিষ, শঠ, ঈষৎ, আলয়, ধবল, শকট, গরল, রজক, পাষাণ, দধি, নিধি, গিরি, অশনি, দিবস, নিবিড়, কীট, গীত, শশী, শীতল, অলীক, তরণী, ভূষণ ইত্যাদি অজস্র অপরিচিত শব্দের সঙ্গেই পরিচিত হতে হয় না; তাদের আত্মস্থ করতে হয় ‘অপূপ’ বা ‘আরূঢ়’ জাতীয় অপ্রচলিত শব্দ ও বানানও। আর বর্ণপরিচয়-এর দ্বিতীয় ভাগে সারা বইটি জুড়ে বিরাজ করে সাধু রীতির গদ্য সমন্বিত তাড্যমান, অযয্য, গৃধ্র, ধ্রিয়মান, হ্রিয়মান, গ্লপিত, নিষণ্ণ, স্নপিত, নিহ্নব, তিগ্ম, উল্মুক, জিহ্মিত ইত্যাদি অগণিত অপ্রচলিত শব্দ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে তাঁর বাতিক ছিল না বলেই ছদ্মনামে লিখিত প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলিতে তিনি দেদার আরবি-ফারসি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে তাঁর বাতিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল।

    বাংলা ভাষাকে ‘মার্জিত’ করার উদ্দেশ্যে সুকুমারমতি ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকে এই অকারণ অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করার  রীতিকে তীব্র সমালোচনা করে শিবনাথ শাস্ত্রী জানান: “একদিকে পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অপরদিকে খ্যাতনাম অক্ষয়কুমার দত্ত, এই উভয় যুগপ্রবর্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত-বহুল হইয়া দাঁড়াইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়বাবু উভয়ে সংস্কৃত-ভাষাভিজ্ঞ ও সংস্কৃত-ভাষানুরাগী লোক ছিলেন; সুতরাং তাঁহারা বাঙ্গালাকে যে পরিচ্ছদ পরাইলেন তাহা সংস্কৃতের অলঙ্কারে পরিপূর্ণ হইল। অনেকে এরূপ ভাষাতে প্রীতিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ লোকের নিকট, বিশেষতঃ সংস্কৃতানভিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের নিকট, ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন ও দুর্বোধ্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।”২৫ পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়াকে আরও শাণিত ভাষায় আক্রমণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

    সংস্কৃত কলেজের পণ্ডিতদের পাঠ্যপুস্তক রচনার ভাষাগত ত্রুটির প্রতি দিক্‌নির্দেশ করে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা ভাষা প্রবন্ধে লেখেন: “আমাদিগের দুর্ভাগ্যক্রমে যে সময়ে ইংরেজ মহাপুরুষেরা বাঙালিদিগকে বাংলা শিখাইবার জন্য উদ্যোগী হইলেন, সেই সময়ে যে-সকল পণ্ডিতের সহিত তাঁহাদের আলাপ ছিল তাঁহারা সংস্কৃত কালেজের ছাত্র। তখন সংস্কৃত কালেজ বাংলায় একঘরে। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা তাঁহাদিগকে যবনের দাস বলিয়া সঙ্গে মিশিতে দিতেন না। তাঁহারা যে-সকল গ্রন্থাদি পড়িতেন তাহা এ দেশমধ্যে চলিত ছিল না। এমনকি দেশীয় ভদ্রসমাজে তাঁহাদের কিছুমাত্র আদর ছিল না। সুতরাং তাঁহারা দেশে কোন্ ভাষা চলিত কোন্ ভাষা অচলিত, তাহার কিছুই বুঝিতেন না। হঠাৎ তাঁহাদিগের উপর বাংলা পুস্তক প্রণয়নের ভার হইল। তাঁহারাও পণ্ডিতস্বভাবসুলভ দাম্ভিকতাসহকারে বিষয়ের গুরুত্ব কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া লেখনী ধারণ করিলেন।
    পণ্ডিতদিগের উপর পুস্তক লিখিবার ভার হইলে তাঁহারা প্রায়ই অনুবাদ করেন। সংস্কৃত কালেজের পণ্ডিতেরাও তাহাই করিলেন। তাঁহারা যে-সকল অপ্রচলিত গ্রন্থ পাঠ করিয়াছিলেন তাহারই তর্জমা আরম্ভ করিলেন। রাশি রাশি সংস্কৃত শব্দ বিভক্তি পরিবর্জিত হইয়া বাংলা অক্ষরে উত্তম কাগজে উত্তমরূপে মুদ্রিত হইয়া পুস্তকমধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল।”২৬ প্রবন্ধটির প্রায় শেষভাগে চূড়ান্ত হতাশা ব্যক্ত করে তিনি জানান: “এই শ্রেণীর লেখকের হস্তে বাংলাভাষার উন্নতির ভার অর্পিত হইল। লিখিত ভাষা ক্রমেই সাধারণের দুর্বোধ্য ও দুষ্পাঠ্য হইয়া উঠিল। অথচ এডুকেশন ডেস্‌প্যাচের কল্যাণে সমস্ত বঙ্গবাসী বালক এই প্রকারের পুস্তক পড়িয়া বাংলাভাষা শিখিতে আরম্ভ করিল। বাংলাভাষার পরিপুষ্টির দফা একেবারে রফা হইয়া গেল।”২৭ শিবনাথ শাস্ত্রী ও হরপ্রসাদ শাত্রীর মতোই ভাষাপ্রয়োগের ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকগুলিতে সংস্কৃত শব্দের এহেন বাহুল্যের বিরোধিতা করেন দুই দিকপাল সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ।

    বাংলা ভাষা কেন এতটা সংস্কৃতগন্ধী হয়ে উঠল, তার নিপুণ বিশ্লেষণ করে বাঙ্গালা ভাষা শীর্ষক প্রবন্ধের শুরুতে বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন: “তখন পুস্তকপ্রণয়ন সংস্কৃত ব্যবসায়ীদিগের হাতে ছিল। অন্যের বোধ ছিল যে, যে সংস্কৃত না জানে, বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রণয়নে তাহার কোন অধিকার নাই, সে বাঙ্গালা লিখিতে পারেই না। যাঁহারা ইংরেজিতে পণ্ডিত, তাঁহারা বাঙ্গালা লিখিতে পড়িতে না জানা গৌরবের মধ্যে গণ্য করিতেন। সুতরাং বাঙ্গালায় রচনা ফোঁটা-কাটা অনুস্বারবাদীদিগের একচেটিয়া মহল ছিল। সংস্কৃতেই তাঁহাদিগের গৌরব। তাঁহারা ভাবিতেন, সংস্কৃতেই তবে বুঝি বাঙ্গালা ভাষার গৌরব; যেমন গ্রাম্য বাঙ্গালী স্ত্রীলোক মনে করে যে, শোভা বাড়ুক না বাড়ুক, ওজনে ভারি সোনা অঙ্গে পরিলেই অলঙ্কার পরার গৌরব হইল, এই গ্রন্থকর্তারা তেমনি জানিতেন, ভাষা সুন্দর হউক বা না হউক, দুর্বোধ্য সংস্কৃতবাহুল্য থাকিলেই রচনার গৌরব হইল।”২৮ আদর্শ বাংলা ভাষা কেমন হওয়া উচিত তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করে এবং ভাষায় বাংলা ও সংস্কৃত শব্দের ভারসাম্য বজায় রাখার পক্ষে রায় দিয়ে তিনি জানান: “যদিও আমরা এমন বলি না যে, “ঘর” প্রচলিত আছে বলিয়া গৃহ শব্দের উচ্ছেদ করিতে হইবে, অথবা মাথা শব্দ প্রচলিত আছে বলিয়া মস্তক শব্দের উচ্ছেদ করিতে হইবে; কিন্তু আমরা এমত বলি যে, অকারণে ঘর শব্দের পরিবর্তে গৃহ, অকারণে মাথার পরিবর্তে মস্তক, অকারণে পাতার পরিবর্তে পত্র এবং তামার পরিবর্তে তাম্র ব্যবহার উচিত নহে। কেন না, ঘর, মাথা, পাতা, তামা বাঙ্গালা; আর গৃহ, মস্তক, পত্র, তাম্র সংস্কৃত। বাঙ্গালা লিখিতে গিয়া অকারণে বাঙ্গালা ছাড়িয়া সংস্কৃত কেন লিখিব?”২৯ বাংলা ভাষার মর্যাদার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন বঙ্কিম, পরবর্তীকালে তার দিগন্তকে আরও প্রসারিত করেন রবীন্দ্রনাথ।

     সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়ার আবশ্যিক অংশ হিসেবে যে বাংলা গদ্যসাহিত্যের সূত্রপাত হয়েছিল, সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। ভাষার কথা প্রবন্ধে সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি লেখেন: “...বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূত্রপাত হইল বিদেশীর ফরমাসে, এবং তার সূত্রধার হইলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, বাংলা-ভাষার সঙ্গে যাঁদের ভাসুর ভাদ্রবউয়ের সম্বন্ধ। তাঁরা এ ভাষার কখনো মুখদর্শন করেন নাই। এই সজীব ভাষা তাঁদের কাছে ঘোমটার ভিতরে আড়ষ্ট হইয়া ছিল, সেইজন্য ইহাকে তাঁরা আমল দিলেন না। তাঁরা সংস্কৃত-ব্যাকরণের হাতুড়ি পিটিয়া নিজের হাতে এমন একটা পদার্থ খাড়া করিলেন যাহার কেবল বিধিই আছে কিন্তু গতি নাই। সীতাকে নির্বাসন দিয়া যজ্ঞকর্তার ফরমাসে তাঁরা সোনার সীতা গড়িলেন।”৩০ এই কারনে প্রাণহীন কৃত্রিম গদ্য তৈরি হয়েছিল বলেই শেষ পর্যন্ত তা বাংলা গদ্যের জন্য সুখকর হয়নি। তাঁর মতে: “যদি স্বভাবের তাগিদে বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সৃষ্টি হইত, তবে এমন গড়াপেটা ভাষা দিয়া তার আরম্ভ হইত না। তবে গোড়ায় তাহা কাঁচা থাকিত এবং ক্রমে ক্রমে পাকা নিয়মে তার বাঁধন আঁট হইয়া উঠিত। প্রাকৃত বাংলা বাড়িয়া উঠিতে উঠিতে প্রয়োজনমত সংস্কৃত-ভাষার ভাণ্ডার হইতে আপন অভাব দূর করিয়া লইত।
    কিন্তু বাংলা গদ্য-সাহিত্য ঠিক তার উল্টা পথে চলিল। গোড়ায় দেখি তাহা সংস্কৃত-ভাষা, কেবল তাহাকে বাংলার নামে চালাইবার জন্য কিছু সামান্য পরিমাণে তাহাতে বাংলার খাদ মিশাল করা হইয়াছে। এ একরকম ঠকানো। বিদেশীর কাছে এ প্রতারণা সহজেই চলিয়াছিল।”৩১ কিন্তু বাংলা ভাষা-ব্যবহারকারীরা যে শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক গদ্যের ফাঁক ও ফাঁকি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, তার কারণ রবীন্দ্রনাথের মতে, বাংলাভাষীদের কাছে নিজেদের ভাষার সজীব ও প্রাণবন্ত উপস্থিতির নজির সবসময়েই হাজির ছিল। তাই বাংলা ভাষার বাঞ্ছিত চলনের প্রসঙ্গে তিনি লেখেন: “যদি কেবল ইংরেজকে বাংলা শিখাইবার জন্যই বাংলা গদ্যের ব্যবহার হইত, তবে সেই মেকি-বাংলার ফাঁকি আজ পর্যন্ত ধরা পড়িত না। কিন্তু এই গদ্য যতই বাঙালীর ব্যবহারে আসিয়াছে ততই তাহার রূপ পরিবর্তন হইয়াছে। এই পরিবর্তনের গতি কোন্ দিকে? প্রাকৃত বাংলার দিকে। আজ পর্যন্ত বাংলা গদ্য, সংস্কৃত-ভাষার বাধা ভেদ করিয়া, নিজের যথার্থ আকৃতি প্রকৃতি প্রকাশ করিবার জন্য যুঝিয়া আসিতেছে।”৩২ [নজরটান সংযোজিত] আমাদের মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই চলমান লড়াইয়ে অংশ নিয়ে বাংলা গদ্যের মুক্তির জন্য একদিকে তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করেছেন, অন্যদিকে তার ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

    এই লেখার একেবারে শুরুতে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কথা এসেছে। শেষও করতে চাইছি আরেক বিখ্যাত ভাষাচার্য মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর কথার মাধ্যমে। ১৩২৪ বঙ্গাব্দে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মিলনীর দ্বিতীয় অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে তাঁর অভিভাষণের শেষে ড. শহীদুল্লাহ দ্বিধাহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন: “একদল অন্ধ সংস্কৃতভক্ত বাংলা ভাষার মধ্যে প্রচলিত আরবী পারসী শব্দগুলিকে যাবনিক বলিয়া বর্জন করিতে চাহেন। আমি বলি আগে তাঁহারা বাংলাদেশ হইতে যবনকে দূর করুন, পরে ভাষা হইতে যাবনিক শব্দগুলি দূর করিবেন। যখন সংস্কৃত ভাষা হোরা, কেন্দ্র, জামিত্র, দীনার প্রভৃতি গ্রীক শব্দ এবং ইকবাল, ইন্দুরার, মুকাবিলা প্রভৃতি আরবী শব্দ গ্রহণ করিয়াছে, তখন বাংলা ভাষার বেলায় আপত্তি কেন? ঐ সকল আরবী-পারসী শব্দ বাংলা ভাষার অস্থিমজ্জাগত হইয়াছে। ভাষা হইতে ইহাদিগকে তাড়ান সহজ ব্যাপার হইবে না। দোয়াত, কলম, কাগজ, জামা, কামিজ, কমর, বগল প্রভৃতি এবং আইন আদালতে প্রচলিত সর্বসাধারণের সহজবোধ্য হাজার খানিক শব্দ ত্যাগ করিয়া নূতন শব্দ গড়িলে তাহা নামের জোরে পুস্তকে চলিতে পারে বটে, কিন্তু তাহা ভাষায় চলিবে না। বাংলা ভাষায় আরবী, পারসী, তুরকী, ইংরাজি, ফরাসী, পর্তুগীজ প্রভৃতি যে কোন ভাষার শব্দ বেমালুম খাপ খাইয়া গিয়াছে, তাহারা নিজেদের দখলী স্বত্ববলে বাংলা ভাষায় থাকিবে। তাহাদিগকে তাড়াইতে গেলে জুলুম করা হইবে।”৩৩ 
     
    বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের বিরুদ্ধে এর চেয়ে জোরালো উচ্চারণ আর কী-ই বা হতে পারে?
    ************************************************************
    উল্লেখপঞ্জি:
    ১. Suniti Kumar Chatterji, The Origin and Development of the Bengali Language, Part I, Calcutta, 1926, pp. 219-20
    ২. তদেব, পৃ. ২২০
    ৩. দেবেশ রায়, আঠার শতকের বাংলা গদ্য, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ৭
    ৪. আনিসুজ্জামান, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, চট্টগ্রাম, ১৯৮২, পৃ. ৩৮
    ৫. Suniti Kumar Chatterji, The Origin and Development of the Bengali Language, Part I, p. 220
    ৬. Nathaniel Brassey Halhed, A Grammar of the Bengal Language, Hoogly, 1778, p. 178
    ৭. তদেব, পৃ. ২০৭-০৮
    ৮. তদেব, p. xxi
    ৯. William Jones, The Works of Sir William Jones, Vol. I, London, 1799, p. 26
    ১০. সজনীকান্ত দাস, বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস, কলকাতা, ১৩৬৬, পৃ. ৩২-৩৩
    ১১. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রামমোহন তৎকালীন সমাজ সাহিত্য, কলিকাতা, ১৩৭৯, পৃ. ৩৪
    ১২. দীনেশচন্দ্র সেন, ‘বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব’, বিচিত্রা,  মাঘ ১৩৩৫, পৃ. ১৮৩
    ১৩. তদেব, পৃ. ১৮৬
    ১৪. দেবেশ রায়, উপনিবেশের সমাজ বাংলা সাংবাদিক গদ্য, কলকাতা, ১৯৯০, পৃ. ৬৯
    ১৫. তদেব, পৃ. ৭২
    ১৬. Sisirkumar Das, Early Bengali Prose: Carey to Vidyasagar, Calcutta, 1966, pp. 84-86
    ১৭. রামরাম বসু, লিপিমালা, শ্রীরামপুর, ১৮০২, পৃ. ১১১-১২
    ১৮. মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, বত্রিশ সিংহাসন, উপক্রমণিকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, শ্রীরামপুর, ১৮০৮, পৃ. ৬-৭  
    ১৯. অজিতকুমার ঘোষ (সম্পাদিত), রামমোহন রচনাবলী, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃ. ৬৩৩
    ২০. তদেব, পৃ. ৭
    ২১. ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলিকাতা কমলালয়, কলকাতা, ১২৩০, পৃ. ২৪-২৫  
    ২২. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কলকাতা, ১৩৪৯, পৃ. ১৮-১৯
    ২৩. তদেব, পৃ. ১৯-২০
    ২৪. গোপাল হালদার (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ১৩০-৩১
    ২৫. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ৯২-৯৩
    ২৬. দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য (সম্পাদিত), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৯৮১, পৃ. ৫৬৪
    ২৭. তদেব, পৃ. ৫৬৪
    ২৮. যোগেশচন্দ্র বাগল (সম্পাদিত), বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৩৬৯
    ২৯. তদেব, পৃ. ৩৭২
    ৩০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা শব্দতত্ত্ব, কলিকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৪২, পৃ. ৫
    ৩১. তদেব, পৃ. ৫-৬
    ৩২. তদেব, পৃ. ৬
    ৩৩. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আমাদের ভাষাসমস্যা; মোশাররফ হোসেন খান (সম্পাদিত), বাংলা ভাষা সাহিত্যে মুসলিম অবদান, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ৪৭
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • সমোস্কিতি | ০৯ এপ্রিল ২০২৩ | ৩২৬২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    লোকটা - Kunal Basu
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • এলেবেলে | ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:৫২527891
  • সমরেশবাবু, আপনি আমার এই লেখাটায় একবার অন্তত চোখ বুলাতে পারেন।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন