ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনব্যবস্থা পাকাপোক্তভাবে বাংলায় কায়েম হওয়ার আগে পর্যন্ত সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থার উচ্চপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। মুঘল আমলে যোগ্যতার ভিত্তিতে হিন্দুদের উচ্চপদে নিয়োগ করার যে প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই আমলের রমরমা যখন প্রায় অস্তাচলের মুখে তখনও বাংলায় সেই প্রথার কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, নবাবি আমলেই রামমোহনের ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ পরশুরাম বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার রাজসরকারে উচ্চপদে আসীন হন এবং ‘রায়-রায়ান্’ উপাধি পান। রামমোহনের পিতামহ ব্রজবিনোদ আলিবর্দি খাঁর শাসনকালে বিশিষ্ট রাজকর্মচারী ছিলেন, পিতা রামকান্ত রায়ও মুর্শিদাবাদ সরকারে কাজ করতেন। এমনকি ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা ও বিহারের দেওয়ানি লাভ করার পরে একদিকে বাংলায় রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় মহম্মদ রেজা খাঁ-র ওপর, অন্যদিকে সিতাব রায় বিহারের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান। এর অর্থ দাঁড়ায়, ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু হওয়ার আগে এই ব্যবস্থাটা সারা বাংলা জুড়েই ব্যাপকভাবে চালু ছিল।
একই রকম চিত্র দেখা যায় সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতেও। কৃষক-কারিগর-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা জমিদারের অধীনস্থ নিম্নপদের কর্মচারী নিয়োগের বিষয়েও এই পার্থক্য ছিল না। ফারসি রাজভাষা হিসেবে চালু থাকায় মুসলমান শিক্ষকদের কাছে হিন্দু ছাত্রদের ফারসি ভাষা শিক্ষাগ্রহণের চলও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। রামকান্ত পুত্র রামমোহনকে আরবি ও ফারসি শেখার জন্য পাটনায় পাঠিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রচলিত পাঠশালা শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমান ছাত্র কিংবা শিক্ষকদের মধ্যে তেমন ভেদাভেদের দৃষ্টান্তও পরিলক্ষিত হয় না।
কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে যখন অত্যধিক ভূমিরাজস্বের দায়ে মুসলমান জমিদাররা তাঁদের জমি বিক্রি বা নিলাম করতে বাধ্য হলেন এবং সরকারি প্রশাসনিক পদে তাঁদের সংখ্যা যখন দ্রুত কমতে থাকল, তখনই এই বিভাজনের বিষয়টি ক্রমশ স্পষ্ট হল। একদিকে কোম্পানির আর্থিক শোষণের একনিষ্ঠ সহযোগী কিছু হিন্দু দেওয়ান, বেনিয়ান, সরকার, মুনশি, খাজাঞ্চির ভুঁইফোঁড় জমিদার হিসেবে আত্মপ্রকাশ হল, অন্যদিকে ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার কারণে মুসলমান বণিকরা ধীরে ধীরে বাংলার অর্থনৈতিক মানচিত্র থেকে ক্রমশ সরে যেতে থাকলেন। অবশ্য তারও আগে বাংলার মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থা অপসারিত হওয়ার ফলে মুঘল প্রশাসনের কর্মীরাও অন্তর্হিত হতে শুরু করলেন। আর এই সুযোগে তাঁদের শূন্যস্থান দখল করে নিল ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় সৃষ্ট বাঙালি দেওয়ান, বেনিয়ান, গোমস্তা, দালালরা। মূলত নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদ থেকেই এই হিন্দু ভুঁইফোঁড়েরা বিদেশি কোম্পানির সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রভাবশালী দেশি সমর্থকশ্রেণি হিসেবে আবির্ভূত হল।
বাণিজ্যিক-প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলার অন্যতম প্রধানতম চালিকাশক্তি হিসেবে মুসলমানরা বিদায় নেওয়ার পরে, এই নবসৃষ্ট মুৎসুদ্দি সমর্থকশ্রেণিকে তুষ্ট করতে চতুর ও ধূর্ত কোম্পানির প্রত্যক্ষ মদতে চালু হল কৃত্রিম ‘আর্যতত্ত্ব’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের একদিকে থাকল বেদ-উপনিষদ-গীতার ঢালাও অনুবাদ ও নতুন নতুন ভাষ্য, অন্যদিকে চালু হল বাংলা ভাষা থেকে ‘অদরকারি’ আরবি-ফারসি-হিন্দুস্তানির ‘খাদ’ বিসর্জন দিয়ে বাংলার ‘নিখাদ’ সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়া। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রটিতে জোন্স ও কোলব্রুকের সাক্ষাৎ ভাবশিষ্য হিসেবে উদিত হলেন ডিগবির দেওয়ান রামমোহন। আর হ্যালহেড ও কেরির প্রদর্শিত পথে বাংলা ভাষা থেকে ‘যাবনী মিশাল’ ছাঁটার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করলেন ভবানীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ও তাঁর সুযোগ্য ছাত্র বিদ্যাসাগর।
তাই যে রামমোহন ১৮০৩-০৪ সালে প্রকাশিত তুহ্ফাৎ-উল্- মুওহাহিদিন্-এ অবতারবাদ, গুরুবাদ, অভ্রান্তশাস্ত্রবাদ, প্রত্যাদেশবাদ প্রভৃতি প্রচলিত সাম্প্রদায়িক ধর্মবিশ্বাসের সবগুলি লক্ষণকেই সম্পূর্ণ বর্জন করেছিলেন, সেই একই রামমোহন ১৯১৫ সালে বেদকে হিন্দুধর্মের সর্বাধিক প্রামাণ্য শাস্ত্রগ্রন্থ হিসেবে হাজির করলেন। অন্যান্য অ্যাব্রাহামিক ধর্মের মতো ‘হিন্দুধর্ম’ বলে যে এককেন্দ্রিক ধর্মের অস্তিত্ব কোনও কালেই ভারতবর্ষে ছিল না, তা পুরোপুরি বিস্মৃত হয়ে ‘আর্যতত্ত্ব’ রূপায়নকল্পে তিনি একে একে হাজির করলেন কেনোপনিষৎ (১৮১৬), ঈশোপনিষৎ (১৮১৬), মাণ্ডূক্যোপনিষৎ (১৮১৭) ও মুণ্ডকোপনিষৎ (১৮১৯)। একদিকে তিনি জানালেন যে বেদই সর্বাধিক প্রামাণিক এবং যা বেদবিরোধী তা শাস্ত্ররূপে গণ্য হবার যোগ্য নয়, অন্যদিকে গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮) প্রবন্ধে স্পষ্ট ঘোষণা করলেন ‘মনু অর্থের বিপরীত যে ঋষিবাক্য তাহা মান্য নহে’।
প্রসঙ্গত লক্ষণীয়, একের পর এক উপনিষদের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদের কারণ হিসেবে ১৮২৭ সালে ডিগবিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বেদান্তকে ‘the most celebrated and revered work of Brahmanical theology’ বলে উল্লেখ করলেন। আর সম্পত্তিতে মহিলাদের অধিকার হরণের বিষয়ে আলোচনা করাকালীন হ্যালহেড ও জোন্সের ঔপনিবেশিক হিন্দু আইনের বিন্দুমাত্র উল্লেখ না করে (কিংবা তাঁদের আড়াল করতে চেয়ে) দায়ভাগের উল্লেখ প্রসঙ্গে কোলব্রুকের অনুবাদের শরণাপন্ন হলেন! ফলে তাঁর কল্পিত হিন্দুধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জাঁকিয়ে বসল তীব্র ব্রাহ্মণ্যবাদ।
এর আগেই ব্রিটিশরা প্রচার করে যে, দীর্ঘ সাতশো বছর ইসলামি শাসনের ফলে ঐতিহ্যময় হিন্দু স্বর্ণযুগের গরিমা কলুষিত ও প্রায় অবলুপ্তির পথে। ফলে এই ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ মধ্যযুগের আঁধার কাটিয়ে হিন্দুদের ‘আলোকোজ্জ্বল’ আধুনিক যুগে প্রবেশ করতে চাইলে ব্রিটিশদের বদান্যতায় এ দেশে সভ্যতার সূর্যোদয়ের আলো গ্রহণ করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রথমে জোন্সের প্রাচ্যচর্চার উদার দাক্ষিণ্যে হিন্দুদের মধ্যে সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ়মূল ও সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তীকালে হিন্দুদের ‘উদ্ধার’ করা এবং তাদের মধ্যে মুসলমান বিদ্বেষের বীজ রোপণ করার কাজে পরিকল্পিতভাবে কোমর বেঁধে মাঠে নামে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। হ্যালহেড ও জোন্সের মতোই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি শব্দের আধিক্য নিয়ে একই মনোভাব পোষণ করতেন। এই কথাকে সমর্থন করে সজনীকান্ত দাস লিখেছেন—
১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে হালহেড এবং পরবর্তী কালে হেন্রি পিট্স ফরষ্টার ও উইলিয়ম কেরী বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতজননীর সন্তান ধরিয়া আরবী পারসীর অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে রীতিমত ওকালতি করিয়াছেন এবং প্রকৃতপক্ষে এই তিন ইংলণ্ডীয় পণ্ডিতের যত্ন ও চেষ্টায় অতি অল্প দিনের মধ্যে বাংলা ভাষা সংস্কৃত হইয়া উঠিয়াছে। ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে এই আরবী-পারসী-নিসূদন-যজ্ঞের সূত্রপাত এবং ১৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে আইনের সাহায্যে কোম্পানীর সদর মফস্বল আদালতসমূহে আরবী পারসীর পরিবর্তে বাংলা ও ইংরেজী প্রবর্তনে এই যজ্ঞের পূর্ণাহুতি। (বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস)
এর আগে বাংলা গদ্যের যেসব নিদর্শন– চিঠিপত্র, দলিল, ফরমান– পাওয়া যায়, সেখানেও সাধুভাষা প্রচলিত ছিল, কিন্তু সেই গদ্যে বাংলার পাশাপাশি আরবি-ফারসি-দেশি শব্দেরও বহুল প্রচলন ছিল। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, তৎকালীন জনপ্রিয় বাংলা লোকগাথা ও কথ্য কাহিনিগুলিতে ছিল মাত্র এক-তৃতীয়াংশ তৎসম (অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে গৃহীত এবং আদিরূপে অক্ষুণ্ণ) শব্দ, বাকি শব্দভাণ্ডারে তদ্ভব (অর্থাৎ সংস্কৃত থেকে বিকৃত ও প্রাকৃত ভাষায় রূপান্তরিত) এবং আরবি-ফারসি-তুর্কি ও পর্তুগিজ শব্দের আধিপত্য ছিল। কিন্তু ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পরে কেরির নেতৃত্বে যে বাংলা গদ্যচর্চা শুরু হয়, সেখানে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু প্রমুখ বাঙালি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বাংলাকে সংস্কৃতের দুহিতা জ্ঞান করে ব্যাকরণরীতি ও শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে সংস্কৃতের ওপর অত্যন্ত বেশি নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। ফলে তাঁরা এমন এক ধরণের ‘সাধু’ বাংলা গদ্যভাষা উদ্ভাবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যেখানে কথ্য ও প্রচলিত বাংলা ভাষা থেকে আরবি, ফারসি ও অন্ত্যজ শব্দগুলি সুচিন্তিত উপায়ে বিতাড়িত করা হয় এবং তার বদলে সংস্কৃত ও তৎসম শব্দ প্রবর্তিত করা হয়।
এই সাহেবদের প্রভাবে রামমোহন যখন ব্রিটিশ-উদ্ভাবিত আর্যতত্ত্বকে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করতে উঠে-পড়ে লাগেন, প্রায় সেই একই সময়ে বাংলা ভাষার ‘সংস্কৃতায়ন’ প্রকল্পের মুখ্য সহায়ক হিসেবে উঠে আসেন তাঁরই ‘বিরোধী’ বলে প্রচারিত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮২৩ সালে কলিকাতা কমলালয় গ্রন্থে প্রায় দুশোটি আরবি-ফারসি শব্দের তালিকা রচনা করে তিনি মন্তব্য করেন:
...ভদ্র লোকের মধ্যে অনেক লোক স্বজাতীয় ভাষায় অন্য জাতীয় ভাষা মিশ্রিত করিয়া কহিয়া থাকেন... ইহাতে বোধহয় সংস্কৃত শাস্ত্র ইহারা পড়েন নাই এবং পণ্ডিতের সহিত আলাপও করেন নাই তাহা হইলে এতাদৃশ বাক্য ব্যবহার করিতেন না স্বজাতীয় এক অভিপ্রায়ের অধিকভাষা থাকিতে যাবনিক ভাষা ব্যবহার করেন না।
পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা থেকে এই সব ‘যাবনিক’ শব্দ অপসারণে সচেষ্ট হন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার।
১২৪৫ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৩৮ সালে প্রকাশিত পারসীক অভিধান গ্রন্থে জয়গোপাল অতি সতর্কভাবে তৎকালীন কথ্য বাংলায় প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দগুলির পরিবর্তে সংস্কৃতাশ্রয়ী সাধুভাষা পুনঃস্থাপন করেন। গ্রন্থটির ভূমিকায় তিনি লেখেন—
এই ভারতবর্ষে প্রায় নয় শত বৎসর হইল যবন সঞ্চার হওয়াতে তৎসমভিব্যাহারে যাবনিক ভাষা অর্থাৎ পারসী ও আরবীভাষা এই পুণ্যভূমিতে অধিষ্ঠান করিয়াছে অনন্তর ক্রমে যেমন যবনদের ভারতবর্ষাধিপত্য বৃদ্ধি হইতে লাগিল তেমন রাজকীয় ভাষা বোধে সর্বত্র সমাদর হওয়াতে যাবনিক ভাষার উত্তরোত্তর এমত বৃদ্ধি হইল যে অন্য সকল ভাষাকে পরাস্ত করিয়া আপনি বর্ধিষ্ণু হইল এবং অনেক অনেক স্থানে বঙ্গভাষাকে দূর করিয়া স্বয়ং প্রভুত্ব করিতে লাগিল বিষয় কর্মে বিশেষত বিচারস্থানে অন্য ভাষার সম্পর্কও রাখিল না তবে যে কোন স্থলে অন্য ভাষা দেখা যায় সে কেবল নাম মাত্র। সুতরাং আমাদের বঙ্গভাষার তাদৃশ সমাদর না থাকাতে এইক্ষণে অনেক সাধুভাষা লুপ্তপ্রায়া হইয়াছে এবং চিরদিন অনালোচনাতে বিস্মৃতিকূপে মগ্না হইয়াছে যদ্যপি তাহার উদ্ধার করা অতি দুঃসাধ্য তথাপি আমি বহুপরিশ্রমে ক্রমে ক্রমে শব্দ সঙ্কলন করিয়া সেই বিদেশীয় ভাষাস্থলে স্বদেশীয় সাধু ভাষা পুনঃ সংস্থাপন করিবার কারণ এই পারসীক অভিধান সংগ্রহ করিলাম।
ইহাতে বিজ্ঞ মহাশয়েরা বিশেষরূপে জানিতে পারিবেন যে স্বকীয় ভাষার মধ্যে কত বিদেশীয় ভাষা লুক্কায়িত হইয়া চিরকাল বিহার করিতেছে এবং তাঁহারা আর বিদেশীয় ভাষার অপেক্ষা না করিয়াই কেবল স্বদেশীয় ভাষা দ্বারা লিখন পঠন ও কথোপকথনাদি ব্যবহার করিয়া আপ্যায়িত হইবেন এবং স্বকীয় বস্তু সত্ত্বে পরকীয় বস্তু ব্যবহার করাতে যে লজ্জা ও গ্লানি তাহা হইতে মুক্ত হইতে পারিবেন এবং প্রধান ও অপ্রধান বিচারস্থলে বিদেশীয় ভাষা ও অক্ষর ব্যবহার না করিয়া স্বস্ব দেশ ভাষা ও অক্ষরেতেই বিচারীয় লিপ্যাদি করিতে সম্প্রতি যে রাজাজ্ঞা প্রকাশ হইয়াছে তাহাতেও সম্পূর্ণ উপকার প্রাপ্ত হইতে পারিবেন।
এই গ্রন্থে প্রায় পঞ্চশতাধিক দ্বিসহস্র চলিত শব্দ আকারাদি প্রত্যেক বর্ণক্রমে সূচী করিয়া বিন্যস্ত করা গিয়াছে ইহার মধ্যে পারসীক শব্দই অধিক ক্কচিৎ আরবীয় শব্দও আছে...।
প্রায় আড়াই হাজার আরবি-ফারসি শব্দকে সংস্কৃত ভাষায় পুনঃস্থাপিত করেও শান্তি পাননি পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। বাংলা ভাষার এই ‘স্বদেশি’ ও ‘বিদেশি’ শব্দভাণ্ডার নিয়ে তিনি এতটাই চিন্তিত হন যে তিনি ‘পরবর্তী শ্রীরামপুর সংস্করণে কৃত্তিবাস ও কাশীদাসের উপর কলম চালাইয়া “অবিশুদ্ধ” মূলকে বিশুদ্ধ করিয়াছিলেন’। (সজনীকান্ত দাস, বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস)
পরবর্তী গ্রন্থ বঙ্গাভিধান-এও জয়গোপালের ভাষা নিয়ে এই ছুতমার্গ পরিলক্ষিত হয়।বঙ্গাভিধান-এর ভূমিকায় জয়গোপাল তর্কালঙ্কার লেখেন–
বঙ্গভূমি নিবাসি লোকের যে ভাষা সে হিন্দুস্থানীয় অন্য ২ [অন্য] ভাষা হইতে উত্তমা যে হেতুক অন্যভাষাতে সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক অত্যল্প কিন্তু বঙ্গভাষাতে সংস্কৃতভাষার প্রাচুর্য আছে বিবেচনা করিলে জানা যায় যে বঙ্গভাষাতে প্রায়ই সংস্কৃত শব্দের চলন যদ্যপি ইদানীং ঐ সাধুভাষাতে অনেক ইতর ভাষার প্রবেশ হইয়াছে তথাপি বিজ্ঞ লোকেরা বিবেচনা পূর্বক কেবল সংস্কৃতানুযায়ি ভাষা লিখিতে ও তদ্দ্বারা কথোপকথন করিতে চেষ্টা করিলে নির্বাহ করিতে পারেন এই প্রকার লিখন পঠন ধারা অনেক প্রধান ২ [প্রধান] স্থানে আছে। এবং ইহাও উচিত হয় যে সাধু লোক সাধুভাষাদ্বারাই সাধুতা প্রকাশ করেন অসাধুভাষা ব্যবহার করিয়া অসাধুর ন্যায় হাস্যাস্পদ না হয়েন।
বলা বাহুল্য, ‘সাধুভাষা’ ও ‘অসাধুভাষা’ নিয়ে জয়গোপালের মতোই তাঁর প্রিয় ছাত্র বিদ্যাসাগরও একই মত পোষণ করতেন।
মার্শালের প্রত্যক্ষ প্রণোদনা ও মার্শম্যানের বদান্যতার বদৌলত যে বেতালপঞ্চবিংশতি বাংলার স্কুলে স্কুলে অন্যতম পাঠ্যপুস্তক হিসেবে প্রচলিত হয়, সেখানে ছাত্রছাত্রীরা জীবনের প্রথমেই তাদের দৈনন্দিন ব্যবহৃত চলতি বুলির পরিবর্তে এই ধরণের সংস্কৃতাশ্রয়ী, সমাসবহুল, কৃত্রিম বাংলা গদ্যভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে বাধ্য হয়:
…যে স্থানে ত্রেতাবতার ভগবান রামচন্দ্র, দুর্বৃত্ত দশাননের বংশধ্বংসবিধানবাসনায়, মহাকায় মহাবল কপিবল সাহায্যে, শতযোজনবিস্তীর্ণ অর্ণবের উপর, লোকাতীত কীর্তিহেতু সেতুসঙ্ঘটন করিয়াছিলেন, তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, কল্লোলিনীবল্লভের প্রবাহমধ্য হইতে, অকস্মাৎ এক স্বর্ণময় ভূরুহ বিনির্গত হইল; তদুপরি এক পরম সুন্দরী রমণী, বীণাবাদনপূর্বক, মধুর স্বরে সঙ্গীত করিতেছে। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সেই বৃক্ষ কন্যা সহিত জলে মগ্ন হইয়া গেল। এই অদ্ভুত ব্যাপার দর্শনে বিস্ময়সাগরে মগ্ন হইয়া, তীর্থপর্যটন পরিত্যাগপূর্বক, আমি আপনকার নিকট ঐ বিষয়ের সংবাদ দিতে আসিয়াছি।
মনে রাখা প্রয়োজন, উদ্ধৃত অংশটি গ্রন্থটির দশম সংস্করণ (১৯৩৩ সংবৎ) থেকে গৃহীত। তাহলে এই সংস্করণটির ৩০ বছর আগে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে এই ভাষা আরও কত সংস্কৃতানুগ ছিল, আরও কত অপরিচিত শব্দে পরিপূর্ণ ছিল– তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
বাংলা ভাষাকে ‘মার্জিত’ করার উদ্দেশ্যে সুকুমারমতি ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তকে এই অকারণ অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করার রীতিকে তীব্র সমালোচনা করে শিবনাথ শাস্ত্রী জানান—
একদিকে পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অপরদিকে খ্যাতনাম অক্ষয়কুমার দত্ত, এই উভয় যুগপ্রবর্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত-বহুল হইয়া দাঁড়াইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়বাবু উভয়ে সংস্কৃত-ভাষাভিজ্ঞ ও সংস্কৃত-ভাষানুরাগী লোক ছিলেন; সুতরাং তাঁহারা বাঙ্গালাকে যে পরিচ্ছদ পরাইলেন তাহা সংস্কৃতের অলঙ্কারে পরিপূর্ণ হইল। অনেকে এরূপ ভাষাতে প্রীতিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ লোকের নিকট, বিশেষতঃ সংস্কৃতানভিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের নিকট, ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন ও দুর্বোধ্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। সে সময়ে পাঁচজন ইংরাজীশিক্ষিত লোক কলিকাতার কোনও বৈঠকখানাতে একত্র বসিলেই এই সংস্কৃতবহুল ভাষা লইয়া অনেক হাসাহাসি হইত। (রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ)
শুধু ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির তীব্র ব্রিটিশপ্রীতি ও চরম মুসলমান বিদ্বেষের প্রচুর নমুনা ছড়িয়ে রয়েছে তদানীন্তন বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুর নির্বাচন ও তার উদ্দেশ্যমূলক বিন্যাসেও।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৮৫৮ সালে বাঙ্গালার ইতিহাস-এর কলেবর ছিল ১৪১ পৃষ্ঠা। তত দিনে বাংলার প্রায় প্রতিটি প্রাথমিক স্কুলে এই ঢাউস বইটি পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এই বইতে বিদ্যাসাগর সিরাজউদ্দৌল্লাকে ‘নৃশংস রাক্ষস’রূপে চিহ্নিত করেন এবং হলওয়েলের অন্ধকূপ হত্যার মনগড়া কাহিনিকে জনমানসে দৃঢ়প্রোথিত করেন। অন্যদিকে ক্লাইভকে ‘অকুতোভয় ও অত্যন্ত সাহসী’, ‘অন্যবিধ পদার্থে নির্মিত’, ‘অতিশয় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেন। শাসক শ্রেণির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়, বাংলার এই বিকৃত ইতিহাসই হয়ে ওঠে বাংলার স্কুল-কলেজের অবশ্যপাঠ্য পাঠ্যপুস্তক। আর বিদ্যাসাগরের সৌজন্যে বাংলার কোমলমতি শিশুদের মনে সুচতুরভাবে রোপণ করা হয় ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য ও মুসলমান শাসনের প্রতি বিদ্বেষের বীজ। পরবর্তীকালে শাসকের এই ঘৃণ্য রাজনৈতিক কৌশলকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে রবীন্দ্রনাথ লিখবেন–
মুসলমান শাস্ত্র ও ইতিহাসের বিকৃত বিবরণ বাংলা বই কোথা হইতে সংগ্রহ করিয়াছে? অস্ত্র হস্তে ধর্মপ্রচার মুসলমানশাস্ত্রের অনুশাসন, এ কথা যদি সত্য না হয় তবে সে অসত্য আমরা শিশুকাল হইতে শিখিলাম কাহার কাছে? হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মনীতি ও ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে ইংরাজ লেখক যাহাই লিখিতেছে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রগণ কি তাহাই নির্বিচারে কণ্ঠস্থ করিতেছে না? এবং বাংলা পাঠ্যপুস্তক কি তাহারই প্রতিধ্বনি মাত্র নহে? (মুসলমান ছাত্রের বাংলা শিক্ষা, ১৩০৭)
এমনকি বিদ্যাসাগরের যে বর্ণপরিচয় বাংলার সর্বাধিক বিক্রীত প্রাইমার হিসেবে পরিগণিত হয়, তার প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে একটি মুসলমান চরিত্রও উপস্থাপিত হয় না।
এহেন বিভেদমূলক পাঠ্যপুস্তকের ঢালাও বিক্রিতে দুঃখিত হন মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এই ধরণের পাঠ্যপুস্তক বালকদের মনে যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করে তার উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান—
প্রথমে চাই মুসলমান বালক বালিকাদিগের পাঠ্যপুস্তক। কি পরিতাপের বিষয়, আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভাল ছেলে। কাসেম বা আবদুল্লা কেমন ছেলে, সে তাহা পড়িতে পায় না। এখান হইতেই তাহার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে পাঠ্যপুস্তকে রামলক্ষ্মণের কথা, কৃষ্ণার্জুনের কথা, সীতাসাবিত্রীর কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদিগেরই আখ্যান পড়িতে থাকে। স্বভাবতঃ তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের মধ্যে বড় লোক নাই। এই সকল পুস্তক দ্বারা তাহাকে জাতীয়ত্ব বিহীন করা হয়। হিন্দু বালকগণ ঐ সকল পুস্তক পড়িয়া মনে করে, আমাদের অপেক্ষা বড় কেহ নয়। মোসলমানরা নিতান্ত ছোট জাত। তাহাদের মধ্যে ভাল লোক জন্মিতে পারে না। এই প্রকারে রাষ্ট্রীয় একতার মূলোচ্ছেদন করা হয়। (আল-এসলাম পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ)
একই সমস্যার কথা উপলব্ধি করেন রবীন্দ্রনাথও। ১৩০৭-এর ভারতী-র কার্তিক সংখ্যায় তিনি লেখেন:
বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান যখন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, পরস্পরের সুখ-দুঃখ নানা সূত্রে বিজড়িত, একের গৃহে অগ্নি লাগিলে অন্যকে যখন জল আনিতে ছুটাছুটি করিতে হয়, তখন শিশুকাল হইতে সকল বিষয়েই পরস্পরের সম্পূর্ণ পরিচয় থাকা চাই। বাঙালি হিন্দুর ছেলে যদি তাহার প্রতিবেশী মুসলমানের শাস্ত্র ও ইতিহাস এবং মুসলমানের ছেলে তাহার প্রতিবেশী হিন্দু শাস্ত্র ও ইতিহাস অবিকৃতভাবে না জানে তবে সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষার দ্বারা তাহারা কেহই আপন জীবনের কর্তব্য ভালো করিয়া পালন করিতে পারিবে না।
... বাংলা বিদ্যালয়ে হিন্দু ছেলের পাঠ্যপুস্তকে তাহার স্বদেশীয় নিকটতম প্রতিবেশী মুসলমানদের কোনো কথা না থাকা অন্যায় এবং অসংগত।
ইংরাজি শিক্ষার যেরূপ প্রচলন হইয়াছে, তাহাতে ইংরাজের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, আচার-বিচার আমাদের কাছে লেশমাত্র অগোচর থাকে না; অথচ তাহারা বহুদূরদেশী এবং মুসলমানরা আমাদের স্বদেশীয়, এবং মুসলমানদের সহিত বহুদিন হইতে আমাদের রীতিনীতি পরিচ্ছদ ভাষা ও শিল্পের আদান-প্রদান চলিয়া আসিয়াছে। অদ্য নূতন ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে আত্মীয়ের মধ্যে প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যবধান দাঁড়াইয়া গেলে পরম দুঃখের কারণ হইবে। বাঙালি মুসলমানের সহিত বাঙালি হিন্দুর রক্তের সম্বন্ধ আছে, এ কথা আমরা যেন কখনো না ভুলি। (মুসলমান ছাত্রের বাংলা শিক্ষা)
কিন্তু ১৩০৭ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার অনেক আগে এই বাংলার গঙ্গা দিয়ে আরও অনেক জলই প্রবাহিত হয়ে যায়।
আমরা এখানে বাঙ্গালার ইতিহাস-এর যে সংস্করণের কথা উল্লেখ করেছি ঠিক তার পূর্ববর্তী বছরে দেশ জুড়ে সংঘটিত সিপাহি বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসকদের সন্ত্রস্ত করে তোলে। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের জনসাধারণ এই বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণ কিংবা সমর্থন করলেও বাংলার ভদ্রলোক ও ‘আলোকোজ্জ্বল’ হিন্দু শ্রেণি ছিল এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। এমতাবস্থায় সিপাহি বিদ্রোহের পরে ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের মোকাবিলা করার জন্য ব্রিটিশ শক্তি যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল মুসলমানদের প্রতিযোগী হিসেবে হিন্দুদের প্রতিষ্ঠা করা এবং এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সর্বভারতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া। এই বক্তব্যকে সমর্থন করে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন—
...১৮৬১ সাল থেকে আলেকজান্ডার ক্যানিংহামের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত নিয়মিত পুরাতাত্ত্বিক অভিযান ও খননকার্য এবং ম্যাক্সমুলার, উইলসন, ফার্গুসন, রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও অন্যান্যদের আরও জনপ্রিয় ধরনের রচনা শিক্ষিত ভারতবাসীর সামনে প্রাচীন ভারতবর্ষের অতীত গৌরব ও মহত্ত্ব, যা ভারতকে গ্রিস ও রোমের সঙ্গে এক আসনে স্থাপিত করেছিল, সে সম্পর্কে এক সুস্পষ্ট ও বৃহৎ চিত্র তুলে ধরে। এটি হিন্দুদের অতীত সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং পৃথিবীর ইতিহাসে তারা যে একদা এক মহান জাতিরূপে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল– এই চেতনায় হিন্দুদের উদ্দীপিত করে তোলে। এই চেতনা স্বাভাবিকভাবে তাদের মনে আত্মবিশ্বাসের বোধ জাগিয়ে তোলে এবং তাদের সামনে ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরে। ইউরোপীয় গবেষকদের দ্বারা প্রচারিত মতবাদ– ইউরোপের প্রাচীন ও বিখ্যাত জাতিসমূহ ও হিন্দুদের পূর্বপুরুষগণ একই মানব গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত; হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদ জগতের প্রাচীনতম সাহিত্যকীর্তি; উপনিষদে এমন সব সুগভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ আছে, যা এখনও মানুষ ধারণা করতে পারেনি... এই সব কিছু হিন্দুদের হৃদয়কে গভীরভাবে আলোড়িত করতে ব্যর্থ হয়নি। (History of the Freedom Movement in India, Vol. I)
ব্রিটিশদের তরফে এই উচ্চগ্রামী প্রচার হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সূচনা করে। শুরু হয় ‘নবজাগরণ’-এর দুই বহুল প্রচারিত ভগীরথ রামমোহন-বিদ্যাসাগরের পরবর্তী প্রজন্মের বহুনিন্দিত ঢক্কানিনাদ।
প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্য সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসকদের আকাশচুম্বী প্রশংসার ফলে একদল উচ্চশিক্ষিত বাঙালি হিন্দু ভাবধারার পুনরুজ্জীবনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই বিষয়ে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন নবজাগরণের অন্যতম ‘সূতিকাগার’ হিন্দু কলেজের আগমার্কা ইয়ং বেঙ্গল রাজনারায়ণ বসু। মেদিনীপুরে থাকাকালীন জাতীয় গৌরব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এহেন রাজনারায়ণ স্থাপন করেন ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা’। অবশ্য ১৮৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাজনারায়ণ পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরে আসার সামান্য আগে ১৮৬৫-র ৭ অগস্ট, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর The National Paper প্রতিষ্ঠা করেন এবং নবগোপাল মিত্রের ওপর পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁর ভাবনাকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য, রাজনারায়ণ ওই পত্রিকায় Prospectus of Society for the Promotion of National Feeling among the Educated Natives of Bengal শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটি পৃথক পুস্তিকা আকারে প্রচারিত হয় এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-তেও পুনর্মুদ্রিত হয় (চৈত্র ১৭৭৭ শক)।
এই ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা’-র প্রস্তাবে রাজনারায়ন লেখেন—
অধুনা ইউরোপীয় জ্ঞানালোক বঙ্গদেশে প্রবিষ্ট হইয়া এতদ্দেশীয় জনগণের মনকে চির নিদ্রা হইতে জাগরিত করিয়াছে। বঙ্গীয় সমাজে অবিশ্রান্ত আন্দোলন চলিয়াছে। পরিবর্তন ও উন্নতির স্পৃহা সর্বত্রই দৃষ্টিগোচর হইতেছে। নব্য-সম্প্রদায় প্রাচীন রীতি-পদ্ধতিতে বীতরাগ হইয়া সমাজ সংস্করণার্থ একান্ত উৎসুক হইতেছেন। ইতিমধ্যেই একদল যুবক হিন্দুসমাজ হইতে এককালে বিচ্ছিন্ন হইতে এবং হিন্দু নাম পর্যন্ত পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। আমরা পূর্বপুরুষদিগের নিকট হইতে যে সকল সুরীতি ও সুনীতি লাভ করিয়াছি তাহাও পাছে এই পরিবর্তনের স্রোতে ভাসিয়া যায় আশঙ্কা হইতেছে। যাহাতে শিক্ষিত দলের মধ্যে জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিত হইয়া এই ভয়ঙ্কর অমঙ্গল নিবারিত হয় এবং সমাজ সংস্কার সকল জাতীয় আকার ধারণ করে, তন্নিমিত্ত এতদ্দেশীয় প্রভাবশালী মহোদয়গণ একটি সভা সংস্থাপন করুন। জাতীয় গৌরবেচ্ছার উন্মেষণ ব্যতীত কোন জাতি মহত্ত্ব লাভ করিতে পারে নাই। সমগ্র ইতিহাস এই সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। (হিন্দু মেলার ইতিবৃত্ত)
বলা বাহুল্য, এই প্রস্তাবে ভারতবাসী বলতে রাজনারায়ণ শুধুমাত্র হিন্দুদেরই উল্লেখ করেন। এই প্রস্তাব থেকেই জন্ম হয় হিন্দু মেলার। যদিও রাজনারায়ণ নিজে এবং হিন্দু মেলার সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যার অন্যতম) উপলব্ধি করতে অপারগ হন যে, সেই অস্থির সময়ে সর্বভারতীয় ঐক্যসাধন সর্বাগ্রে প্রয়োজন, নিছক হিন্দু বা মুসলমান ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করা নয়।
প্রায় একই সময়ে নবগোপাল মিত্র হিন্দু মেলার বিশিষ্ট অঙ্গ হিসেবে ‘হিন্দু জাতির সর্বশ্রেণীর মধ্যে জাতীয় ভাবের বর্ধন এবং তাঁহাদিগের স্বাবলম্বিত যত্ন দ্বারা বিবিধ উন্নতি সাধন’ করার উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। কেবল হিন্দুরাই এই সভার সদস্য হতে পারতেন। এই জাতীয় সভায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ১৮৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, রাজনারায়ণ বসু ১৩ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ‘ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’-এ প্রচুর শ্রোতার সামনে ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন। ‘হিন্দু মেলা’ ও ‘জাতীয় সভা’ ধীরে ধীরে হিন্দু পুনরুত্থানবাদের সুপ্ত আগ্নেয়গিরিকে উপ্ত করে দেয়। অন্ধ ইংরেজ-অনুকরণপ্রিয়তা দূর করার জন্য তাঁরা যেমন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন, তেমনই ইংরেজ-অনুকরণপ্রিয়তা প্রতিরোধের একমাত্র অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন হিন্দুজাতির গৌরব বৃদ্ধিকেই।
উনিশ শতকের শেষ ভাগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়কে এক বিরাট সংকটের সম্মুখীন করে তোলে। হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের কর্মধারা যে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও চরম মুসলমান বিদ্বেষের সৃষ্টি করে, তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও হিন্দু বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশ মুসলমান জাতির অস্তিত্ব প্রচার করতে থাকেন এবং হিন্দু ‘জাতি’র সমান্তরাল মুসলমান ‘জাতি’ গঠনের জন্য বাস্তব কার্যক্রম গ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য, মুসলমান জাতি গঠনের প্রচেষ্টাও ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। আলিগড়ে অ্যাংলো-মহামেডান ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বড়লাট লর্ড নর্থব্রুকের ব্যক্তিগত দান ছিল ১০ হাজার টাকা। এইভাবেই হিন্দু পুনরুত্থানবাদীদের উত্থানকে রুখে দেওয়ার ও ভারতীয়দের বিভক্ত করার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রকে সফল করে তোলার পরিণতিস্বরূপ পরবর্তীকালে আলীগড় আন্দোলন ও মুসলিম লিগের উৎপত্তি হয়।
এই সামগ্রিক বিভাজনের প্রেক্ষাপটেই লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওড়িশা নিয়ে একটি প্রদেশ এবং মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে আর একটি নতুন প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। অবশ্য বঙ্গবিভাজনের পরিকল্পনা সংবলিত রিজলের চিঠিটির পূর্ণ বয়ান ইন্ডিয়া গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার আগে থেকেই বাংলার একাধিক বিপ্লবী সংগঠনের কার্যকলাপে হিন্দুয়ানির ছাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯০২ সালে কলকাতায় চালু হয় ‘শিবাজী উৎসব’। ওই সময়েই সরলা দেবী চালু করেন ‘বীরাষ্টমী ব্রত’। ১৯০৫-এর সেপ্টেম্বরে বঙ্গবিভাগের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার পরে ২৮ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিনে স্বদেশি সংকল্প গ্রহণ করা হয় কালীঘাট মন্দিরে। এর পাশাপাশি বাংলার ব্রিটিশবিরোধী একাধিক গুপ্ত সমিতির অন্যতম কর্মসূচী ‘দীক্ষাদান’ সম্পর্কে সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন—
যে সভ্যকে দীক্ষা দান করা হইত তাহাকে একবেলা হবিষ্যান্ন আহার করিয়া ও একবেলা উপবাসী থাকিয়া পরের দিন স্নান ও শুভ্রবস্ত্র পরিধান করিয়া দীক্ষা গ্রহণ করিতে হইত। দীক্ষাগুরু, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, পুষ্প-চন্দনাদি সাজাইয়া বেদ ও উপনিষদের মন্ত্রপাঠ করিয়া যজ্ঞ করিতেন। যজ্ঞের পর শিষ্য “প্রত্যালীঢ়াসন”এ উপবিষ্ট হইত এবং দীক্ষাগুরু শিষ্যের মাথার উপর গীতা ও তাহার উপর তরবারি স্থাপন করিয়া দক্ষিণদিকে দাঁড়াইতেন। শিষ্য দুই-হস্তে প্রতিজ্ঞ-পত্র ধারণ করিয়া এবং যজ্ঞাগ্নি সম্মুখে তাহা পাঠ করিয়া শপথ গ্রহণ করিত। তাহার পর শিষ্য যজ্ঞাগ্নি ও দীক্ষাগুরুকে প্রণাম করিয়া অনুষ্ঠান শেষ করিত। (ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম)
হবিষ্যান্ন গ্রহণ, কালীমূর্তির সামনে যজ্ঞ সম্পাদন, রুদ্রাক্ষের মালা, বেদ-উপনিষদের মন্ত্রপাঠ ইত্যাদি একাধিক হিন্দুধর্মের অনুষঙ্গ যেমন বঙ্গভঙ্গের বিরোধী মুসলমানদের দূরে ঠেলে দেয়, তেমনই মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা বঙ্গভঙ্গের সমর্থক ছিলেন তাঁদের সুবিধে করে দেয়। এই সুযোগে তাঁরাও পাল্টা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রচারে নেমে পড়েন।
অন্যদিকে বাংলার হিন্দু জমিদার ও শিল্পপতি সম্প্রদায় রাজনৈতিক কারণে নয়, মূলত অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত বিবেচনা করেই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। বাংলার ছোটলাট ফ্রেজারের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ করে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী জানান, বঙ্গভঙ্গের কারণে তাঁকে কলকাতা ও ঢাকা– উভয় জায়গাতেই জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে। শিল্পপতি নলিনবিহারী সরকার চট্টগ্রামের বিকাশের কারণে কলকাতার ব্যবসা ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বাংলার হিন্দু অভিজাত শ্রেণি যখন বঙ্গভঙ্গের কারণে তাঁদের সম্ভাব্য ক্ষতির খতিয়ান নিয়ে ব্যস্ত, তখন বাংলার অভিজাত মুসলমান শ্রেণি বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমান সমাজে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন।
১৮৮৬-তে সৈয়দ আহমদ খান প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স’। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় এই সংগঠনের বার্ষিক সম্মেলনেই মুসলিমদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লিগের জন্ম হয়। এ ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগীর ভূমিকা গ্রহণ করেন ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ। তাঁর ধারণা ছিল, এর ফলে তিনি বঙ্গ বিভাজনের পক্ষে সারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের সমর্থন সংগ্রহে সফল হবেন। নবগঠিত মুসলিম লিগের কার্যক্রমে স্থান পায় মুসলমানদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষার পক্ষে যাবতীয় দাবিদাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরা। অবশ্য সেই সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্যের মনোভাব জাগরুক রাখার প্রয়াস রাখার কথাও উদ্যোক্তারা বিস্মৃত হননি। এইভাবে ধুরন্ধর ইংরেজ তাদের নতুন অনুগত শ্রেণি হিসেবে মুসলমান সম্প্রদায়কে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। একই সঙ্গে তাদের কাছে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে হিন্দু অভিজাত শ্রেণির গুরুত্ব।
বঙ্গভঙ্গের প্রথম পর্যায়ে, এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি বঙ্গভঙ্গের অনেক আগে ১৩০৫ বঙ্গাব্দে তিনি দুই সম্প্রদায়ের মিলনের ওপর জোর দিয়ে লিখেছিলেন,
এক্ষণে যদি ভারতবর্ষীয় জাতি বলিয়া একটা জাতি দাঁড়াইয়া যায়, তবে তাহা কোনমতেই মুসলমানকে বাদ দিয়া হইবে না। যদি বিধাতার কৃপায় কোনোদিন সহস্র অনৈক্যের দ্বারা খণ্ডিত হিন্দুরা এক হইতে পারে, তবে হিন্দুর সহিত মুসলমানের এক হওয়াও বিচিত্র হইবে না। হিন্দু মুসলমানের ধর্মে না-ও মিলিতে পারে, কিন্তু জনবন্ধনে মিলিবে— আমাদের শিক্ষা আমাদের চেষ্টা আমাদের মহৎ স্বার্থ সেই দিকে অনবরত কাজ করিতেছে। (কোট বা চাপকান)
অন্য একটি প্রবন্ধেও তাঁর এই দৃঢ় বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করে তিনি জানান:
অন্য-দেশের কথা জানি না কিন্তু বাংলাদেশে যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বাংলায় হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা বেশি এবং হিন্দু-মুসলমানে প্রতিবেশিসম্বন্ধ খুব ঘনিষ্ঠ। কিন্তু আজকাল এই সমন্ধ ক্রমশ শিথিল হইতে আরম্ভ করিয়াছে। একজন সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান বলিতেছিলেন বাল্যকালে তাঁহারা তাঁহাদের প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ পরিবারদের সহিত নিতান্ত আত্মীয়ভাবে মেশামেশি করিতেন। তাঁহাদের মা-মাসিগণ ঠাকুরানীদের কোলে পিঠে মানুষ হইয়াছেন। (‘হিন্দু ও মুসলমান’, সাময়িক সারসংগ্রহ)
কিন্তু ১৯০৭ থেকে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা শুর হওয়ার পরে, পারস্পরিক মিলনের বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে তিনি এই আন্দোলন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে বাধ্য হন। অবশ্য তার আগেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধীদের দুই প্রধান অস্ত্র ‘স্বদেশি’ ও ‘বয়কট’ নিয়ে ক্রমেই তাঁর মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। পরবর্তীকালে এই বিষয়ে তাঁর একাধিক প্রবন্ধে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন তিনি।
‘স্বদেশি’ ও ‘বয়কট’-এর জোরালো বিরোধিতা করে তিনি হুবহু এই ভাষায় লেখেন,
...বঙ্গবিভাগের জন্য আমরা ইংরাজ-রাজের প্রতি যতই রাগ করি না কেন, এবং সেই ক্ষোভ প্রকাশ করিবার জন্য বিলাতি-বর্জন আমাদের পক্ষে যতই একান্ত আবশ্যক হউক-না, তাহার চেয়ে বড়ো আবশ্যক আমাদের পক্ষে কী ছিল। না, রাজকৃত বিভাগের দ্বারা আমাদের মধ্যে যাহাতে বিভাগ না ঘটে নিজের চেষ্টায় তাহারই সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করা।
সে দিকে দৃষ্টি না করিয়া আমরা বয়কট-ব্যাপারটাকেই এত একমাত্র কর্তব্য বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলাম, যে কোনো প্রকারেই হোক, বয়কটকে জয়ী করিয়া তোলাতেই আমাদের সমস্ত জেদ এত বেশিমাত্রায় চড়িয়া গিয়াছিল যে, বঙ্গবিভাগের যে পরিণাম আশঙ্কা করিয়া পার্টিশনকে আমরা বিভীষিকা বলিয়া জানিয়াছিলাম সেই পরিণামকেই অগ্রসর হইতে আমরা সহায়তা করিলাম।
আমরা ধৈর্য হারাইয়া, সাধারণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সুবিধা-অসুবিধা বিচারমাত্র না করিয়া, বিলাতি লবণ ও কাপড়ের বহিষ্কার-সাধনের কাছে আর-কোনো ভালোমন্দকে গণ্য করিতে ইচ্ছাই করিলাম না। ক্রমশ লোকের সম্মতিকে জয় করিয়া লইবার বিলম্ব আমরা সহিতে পারিলাম না, ইংরেজকে হাতে-হাতে তাহার কর্মফল দেখাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম।
এই উপলক্ষে আমরা দেশের নিম্নশ্রেণীর প্রজাগণের ইচ্ছা ও সুবিধাকে দলন করিবার আয়োজন করিয়াছিলাম, সে কথা স্বীকার করিতে আমাদের ভালো লাগে না, কিন্তু কথাটাকে মিথ্যা বলিতে পারি না। (সদুপায়, ১৩১৫)
কেন এই আন্দোলন সফল হতে পারল না তার কারণ বিশ্লেষণ করে ওই একই প্রবন্ধে তিনি জানান—
বস্তুতই তাহাদের জন্য আমাদের মাথাব্যথা পূর্বেও অত্যন্ত বেশি ছিল না, এখনো এক মুহূর্তে অত্যন্ত বেশি হইয়া উঠে নাই। আমরা এই কথা মনে লইয়া তাহাদের কাছে যাই নাই যে, ‘দেশী কাপড় পরিলে তোমাদের মঙ্গল হইবে এইজন্যই আমাদের দিনে আহার নাই এবং রাত্রে নিদ্রার অবকাশ ঘটিতেছে না।’ আমরা এই বলিয়াই গিয়াছিলাম যে, ‘ইংরেজকে জব্দ করিতে চাই, কিন্তু তোমরা আমাদের সঙ্গে যোগ না দিলে বয়কট সম্পূর্ণ হইবে না; অতএব ক্ষতি স্বীকার করিয়াও তোমাদিগকে দেশী কাপড় পরিতে হইবে।’
কখনো যাহাদের মঙ্গলচিন্তা ও মঙ্গলচেষ্টা করি নাই, যাহাদিগকে আপন লোক বলিয়া কখনো কাছে টানি নাই, যাহাদিগকে বরাবর অশ্রদ্ধাই করিয়াছি, ক্ষতিস্বীকার করাইবার বেলা তাহাদিগকে ভাই বলিয়া ডাক পাড়িলে মনের সঙ্গে তাহাদের সাড়া পাওয়া সম্ভবপর হয় না।
মুসলমানদের পাশাপাশি এক বৃহৎ সংখ্যক নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষও যে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেছিলেন, সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও তাঁর নজর এড়ায়নি। তাই তিনি নির্মোহ ভঙ্গিতে লিখতে পারেন–
জিজ্ঞাসা করি, বাজারে আগুন লাগাইয়া অথবা অনিচ্ছুক লোকের মাথা ভাঙিয়া যদি আমরা বিলাতি কাপড় ছাড়াইয়া একদল লোককে দেশী কাপড় ধরাই তবে বাহিরে মাত্র দেশী কাপড় পরাইয়া ইহাদের সমস্ত অন্তঃকরণকে কি স্বদেশীর বিরুদ্ধে চিরদিনের জন্য বিদ্রোহী করিয়া তুলি না। দেশের যে সম্প্রদায়ের লোক স্বদেশী-প্রচারের ব্রত লইয়াছেন তাঁহাদের প্রতি এই-সকল লোকের বিদ্বেষকে কি চিরস্থায়ী করা হয় না।
এইরূপ ঘটনাই কি ঘটিতেছে না! “যাহারা কখনো বিপদে আপদে সুখে দুঃখে আমাদিগকে স্নেহ করে নাই, আমাদিগকে যাহারা সামাজিক ব্যবহারে পশুর অপেক্ষা অধিক ঘৃণা করে, তাহারা আজ কাপড়-পরানো বা অন্য যে-কোনো উপলক্ষে আমাদের প্রতি জবরদস্তি প্রকাশ করিবে ইহা আমরা সহ্য করিব না”— দেশের নিম্নশ্রেণীর মুসলমান এবং নমশূদ্রের মধ্যে এইরূপ অসহিষ্ণুতা জাগিয়া উঠিয়াছে। ইহারা জোর করিয়া, এমন-কি, ক্ষতিস্বীকার করিয়াও বিলাতি সামগ্রী ব্যবহার করিতেছে। (তদেব)
যে পূর্ববঙ্গে একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন রবীন্দ্রনাথ, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলির ব্যবচ্ছেদ করে তিনি লেখেন—
ময়মনসিং প্রভৃতি স্থানে আমাদের বক্তারা যখন মুসলমান কৃষিসম্প্রদায়ের চিত্ত আকর্ষণ করিতে পারেন নাই তখন তাঁহারা অত্যন্ত রাগ করিয়াছিলেন। এ কথা তাঁহারা মনেও চিন্তা করেন নাই যে, আমরা যে মুসলমানদের অথবা আমাদের দেশের জনসাধারণের যথার্থ হিতৈষী তাহার কোনো প্রমাণ কোনোদিন দিই নাই; অতএব তাহারা আমাদের হিতৈষিতায় সন্দেহ বোধ করিলে তাহাদিগকে দোষী করা যায় না। ভাইয়ের জন্য ভাই ক্ষতিস্বীকার করিয়া থাকে বটে, কিন্তু ভাই বলিয়া একজন খামকা আসিয়া দাঁড়াইলেই যে অমনি তখনই কেহ তাহাকে ঘরের অংশ ছাড়িয়া দেয় এমনতরো ঘটে না। আমরা যে দেশের সাধারণ লোকের ভাই তাহা দেশের সাধারণ লোকে জানে না, এবং আমাদের মনের মধ্যেও যে তাহাদের প্রতি ভ্রাতৃভাব অত্যন্ত জাগরুক আমাদের ব্যবহারে এখনো তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।
পূর্বেই বলিয়াছি, সত্য কথাটা এই যে, ইংরেজের উপরে রাগ করিয়াই আমরা দেশের লোকের কাছে ছুটিয়াছিলাম, দেশের লোকের প্রতি ভালোবাসা-বশতই যে গিয়াছিলাম তাহা নহে। এমন অবস্থায় “ভাই” শব্দটা আমাদের কণ্ঠে ঠিক বিশুদ্ধ কোমলসুরে বাজে না— যে কড়িসুরটা আর-সমস্ত স্বরগ্রাম ছাপাইয়া কানে আসিয়া বাজে সেটা অন্যের প্রতি বিদ্বেষ। (তদেব)
দীর্ঘদিন সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতি তীব্র অবহেলা ও বিদ্বেষের পরিণাম যে কখনও ফলদায়ক, মঙ্গলকর হতে পারে না সেই তিক্ত অথচ বাস্তব সত্য উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্তর্নিহিত কারণকে চিহ্নিত করে তিনি জানান,
...আমরা ইহাদিগকে কাজে প্রবৃত্ত করিবার চেষ্টার পূর্বে এবং সঙ্গে সঙ্গে ইহাদের মন পাই নাই, মন পাইবার প্রকৃত পন্থা অবলম্বন করি নাই, আমাদের প্রতি ইহাদের অবিশ্বাস ও দূরত্ব দূর করি নাই। আমরা ইহাদিগকে নিজের মতে চালাইবার এবং কাজে লাগাইবারই চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু ইহাদিগকে কাছে টানি নাই। সেইজন্য সহসা একদিন ইহাদের সুপ্তপ্রায় ঘরের কাছে আসিয়া ইহাদিগকে নাড়া দিতে গিয়া ইহাদের সন্দেহকে বিরোধকেই জাগাইয়া তুলিয়াছি। ইহাদিগকে আত্মীয় করিয়া না তুলিয়াই ইহাদের নিকট হইতে অত্মীয়তা দাবি করিয়াছি। এবং যে-উৎপাত আপন লোক কোনোমতে সহ্য করিতে পারে সেই উৎপাতের দ্বারা ইহাদিগকে পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ দূরে ফেলিয়াছি। ...কখনো যাহাদের মঙ্গলচিন্তা ও মঙ্গলচেষ্টা করি নাই, যাহাদিগকে আপন লোক বলিয়া কখনো কাছে টানি নাই, যাহাদিগকে বরাবর অশ্রদ্ধাই করিয়াছি, ক্ষতিস্বীকার করাইবার বেলা তাহাদিগকে ভাই বলিয়া ডাক পাড়িলে মনের সঙ্গে তাহাদের সাড়া পাওয়া সম্ভবপর হয় না।
যদিও তাঁর এই ক্ষুরধার বিশ্লেষণের পরেও ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কোনও ইতিবাচক পরিবর্তনই ঘটেনি, তা আমরা পরবর্তী আলোচনাতে দেখতে পাব।
বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করার জন্য ‘নবোপার্জিত আর্য অভিমানকে সজারুর শলাকার মতো আপনাদের চারি দিকে কণ্টকিত করিয়া’ রাখা ‘শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে নূতন হিন্দুয়ানি অকস্মাৎ নারদের ঢেঁকি অবলম্বন করিয়া অবতীর্ণ’ হওয়া হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি যখন মুসলমানদের দোষারোপ করতে ব্যস্ত, সেই সময়ে প্রতিস্পর্ধী রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলনের ব্যর্থতার মূলস্বরূপ তুলে ধরেন দুটি কারণ– ক) মুসলমানদের প্রতি শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের তীব্র বিদ্বেষ ও খ) মূলত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটিকে সম্পূর্ণ একচেটিয়া অধিকারে রাখার তাগিদ থেকে তাঁদের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে দীর্ঘদিন দূরে সরিয়ে রাখা। ব্যাধি ও প্রতিকার (১৩১৫) প্রবন্ধে তিনি এই দুটি প্রসঙ্গেরই উল্লেখ করে তিনি বলেন—
আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। কথাটা যদি সত্যই হয় তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব কেন। দেশের মধ্যে যতগুলি সুযোগ আছে ইংরেজ তাহা নিজের দিকে টানিবে না, ইংরেজকে আমরা এতবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কী কারণ ঘটিয়াছে।
মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই– আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে– অতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।
হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনোমতেই নিষ্কৃতি নাই।
এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ।
ওই একই প্রবন্ধে শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ যে শিক্ষিত হিন্দুরাই, তার নির্ভীক উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন,
আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না।
উদ্দেশ্যসাধনের উপলক্ষে প্রেমের সম্বন্ধ পাতাইতে গেলে ক্ষুদ্রব্যক্তির কাছেও তাহা বিস্বাদ বোধ হয়– সে উদ্দেশ্য খুব বড়ো হইতে পারে, হউক তাহার নাম ‘বয়কট’বা ‘স্বরাজ’, দেশের উন্নতি বা আর-কিছু। মানুষ বলিয়া শ্রদ্ধাবশত ও স্বদেশী বলিয়া স্নেহবশত আমরা যদি সহজেই দেশের জনসাধারণকে ভালোবাসিতাম, ইংরেজি শিক্ষায় আমাদের পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদ না ঘটাইয়া মিলনকে যদি দৃঢ় করিতে পারিত, তাহাদের মাঝখানে থাকিয়া তাহাদের আপন হইয়া তাহাদের সর্বপ্রকার হিতসাধনে যদি আমাদের উপেক্ষা বা আলস্য না থাকিত, তবে আজ বিপদ বা ক্ষতির মুখে তাহাদিগকে ডাক পাড়িলে সেটা অসংগত শুনিতে হইত না।
একই প্রসঙ্গের অবতারণা তাঁর সমস্যা (১৩১৫) কিংবা হিন্দু-বিশ্ববিদ্যালয় (১৩১৮) প্রবন্ধেও পরিলক্ষিত হয়। প্রথম প্রবন্ধে তিনি বলেন—
এ কথা আমাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিতরূপেই জানা আবশ্যক ছিল, আমাদের দেশে হিন্দু ও মুসলমান যে পৃথক এই বাস্তবটিকে বিস্মৃত হইয়া আমরা যে কাজ করিতেই যাই-না কেন,এই বাস্তবটি আমাদিগকে কখনোই বিস্মৃত হইবে না। এ কথা বলিয়া নিজেকে ভুলাইলে চলিবে না যে, হিন্দুমুসলমানের সম্বন্ধের মধ্যে কোনো পাপই ছিল না, ইংরেজই মুসলমানকে আমাদের বিরুদ্ধ করিয়াছে।
ইংরেজ যদি মুসলমানকে আমাদের বিরুদ্ধে সত্যই দাঁড় করাইয়া থাকে তবে ইংরেজ আমাদের একটি পরম উপকার করিয়াছে– দেশের যে-একটি প্রকাণ্ড বাস্তব সত্যকে আমরা মূঢ়ের মতো না বিচার করিয়াই দেশের বড়ো বড়ো কাজের আয়োজনের হিসাব করিতেছিলাম, একেবারে আরম্ভেই তাহার প্রতি ইংরেজ আমাদের দৃষ্টি ফিরাইয়াছে। ইহা হইতে কোনো শিক্ষাই না লইয়া আমরা যদি ইংরেজের উপরেই সমস্ত রাগের মাত্রা চড়াইতে থাকি তবে আমাদের মূঢ়তা দূর করিবার জন্য পুনর্বার আমাদিগকে আঘাত সহিতে হইবে; যাহা প্রকৃত যেমন করিয়াই হউক তাহাকে আমাদের বুঝিতেই হইবে; কোনোমতেই তাহাকে এড়াইয়া চলিবার কোনো পন্থাই নাই।
আর দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে খানিকটা এই সুরেরই অনুবৃত্তি করে তিনি জানান–
হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুইপক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,— সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।
পরবর্তীকালে লোকহিত (১৩২১) প্রবন্ধে বঙ্গ বিভাজনের প্রশ্নে হিন্দু ও মুসলমান কেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে বিদ্রোহে ফেটে পড়ল না তার কারণকে নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন–
যে কারণেই হউক যেদিন স্বদেশী নিমকের প্রতি হঠাৎ আমাদের অত্যন্ত একটা টান হইয়াছিল সেদিন আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম।
সেই স্নেহের ডাকে যখন তাহারা অশ্রুগদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারি রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে একটা সাধারণ সামাজিকতা আছে, যে সামাজিকতার টানে আমরা সহজ প্রীতির বশে মানুষকে ঘরে ডাকিয়া আনি, তাহার সঙ্গে বসিয়া খাই, যদি-বা তাহার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য থাকে সেটাকে অত্যন্ত স্পষ্ট করিয়া দেখিতে দিই না — সেই নিতান্ত সাধারণ সামাজিকতার ক্ষেত্রে যাহাকে আমরা ভাই বলিয়া আপন বলিয়া মানিতে না পারি— দায়ে পড়িয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভাই বলিয়া যথোচিত সতর্কতার সহিত তাহাকে বুকে টানিবার নাট্যভঙ্গী করিলে সেটা কখনোই সফল হইতে পারে না।
বঙ্গবিচ্ছেদ-ব্যাপারটা আমাদের অন্নবস্ত্রে হাত দেয় নাই, আমাদের হৃদয়ে আঘাত করিয়াছিল। সেই হৃদয়টা যতদূর পর্যন্ত অখণ্ড ততদূর পর্যন্ত তাহার বেদনা অপরিচ্ছিন্ন ছিল। বাংলার মুসলমান যে এই বেদনায় আমাদের সঙ্গে এক হয় নাই তাহার কারণ তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনোদিন হৃদয়কে এক হইতে দিই নাই।
শুধু বঙ্গবিচ্ছেদের প্রশ্নেই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কাটাছেঁড়া করেননি, পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করা হিন্দু-মুসলমানদের সম্পর্কে যে ফাঁক ছিল, যে ফাঁকিও ছিল– সেই প্রসঙ্গেও তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আমাদের নজর এড়ায় না।
ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বিস্তর পালাবদল ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু মহাসভার আত্মপ্রকাশ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীর উল্কাসম উত্থান ইত্যাদি নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা একের পর এক অতি দ্রুত ঘটতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটেই সম্পূর্ণত গান্ধী পরিকল্পিত-ঘোষিত-নিয়ন্ত্রিত অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের শুরু এবং সেটা একই সঙ্গে আকস্মিকভাবে গান্ধীর একক সিদ্ধান্তে প্রত্যাহৃত আন্দোলনও বটে। যে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হিন্দু-মুসলমানের অভূতপূর্ব ঐক্য সম্মিলিত হয়েছিল, সেই একই আন্দোলনের আচমকা প্রত্যাহারে দেশ জুড়ে শুরু হয় অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
এই আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন,
বাংলাদেশে স্বদেশী-আন্দোলনে হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান মেলে নি। কেননা, বাংলার অখণ্ড অঙ্গকে ব্যঙ্গ করার দুঃখটা তাদের কাছে বাস্তব ছিল না। আজ অসহকার-আন্দোলনে হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান যোগ দিয়েছে, তার কারণ রুম-সাম্রাজ্যের অখণ্ড অঙ্গকে ব্যঙ্গীকরণের দুঃখটা তাদের কাছে বাস্তব। এমনতরো মিলনের উপলক্ষটা কখনোই চিরস্থায়ী হতে পারে না। আমরা সত্যতঃ মিলি নি; আমরা একদল পূর্বমুখ হয়ে, অন্যদল পশ্চিমমুখ হয়ে কিছুক্ষণ পাশাপাশি পাখা ঝাপটেছি। আজ সেই পাখার ঝাপট বন্ধ হল, এখন উভয় পক্ষের চঞ্চু এক মাটি কামড়ে না থেকে পরস্পরের অভিমুখে সবেগে বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। রাষ্ট্রনৈতিক অধিনেতারা চিন্তা করছেন, আবার কী দিয়ে এদের চঞ্চুদুটোকে ভুলিয়ে রাখা যায়। আসল ভুলটা রয়েছে অস্থিতে মজ্জাতে, তাকে ভোলাবার চেষ্টা করে ভাঙা যাবে না। (সমস্যা, ১৩৩০)
আসলে অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন যে নেহাতই একটা তাৎক্ষণিক জোড়াতালি, যার সুদূরপ্রসারী পরিণতি হিসেবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে প্রায় একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা, সে কথা উপলব্ধি করে একই প্রবন্ধে তিনি বলেন:
যেটা অবাস্তব, কোনোমতেই তার উপরে কোনো বড়ো সিদ্ধির পত্তন করা যায় না। মানুষ যখন দায়ে পড়ে তখন আপনাকে আপনি ফাঁকি দিয়ে আপনার কাছ থেকে কাজ উদ্ধার করবার চেষ্টা করে থাকে। বিভ্রান্ত হয়ে মনে করে, নিজেকে বাম হাতে ফাঁকি দিয়ে ডান হাতে লাভ করা যেতেও পারে। ... খেলাফতের ঠেকো-দেওয়া সন্ধিবন্ধনের পর আজকের দিনে হিন্দুমুসলমানের বিরোধ তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মূলে ভুল থাকলে কোনো উপায়েই স্থূলে সংশোধন হতে পারে না। এ-সব কথা শুনলে অধৈর্য হয়ে কেউ কেউ বলে ওঠেন, আমাদের চার দিকে যে বিদেশী তৃতীয় পক্ষ শত্রুরূপে আছে সেই আমাদের মধ্যে ভেদ ঘটাচ্ছে, অতএব দোষ আমাদের নয়, দোষ তারই- ইতিপূর্বে আমরা হিন্দু -মুসলমান পাশাপাশি নির্বিরোধেই ছিলুম কিন্তু, ইত্যাদি ইত্যাদি।– শাস্ত্রে বলে, কলি শনি ব্যাধি মানুষের ছিদ্র খোঁজে। পাপের ছিদ্র পেলেই তারা ভিতরে প্রবেশ করে সর্বনাশের পালা আরম্ভ করে দেয়। বিপদটা বাইরের, আর পাপটা আমার, এই কারণে বিপদের প্রতি ক্রোধ ও পাপের প্রতি মমতা করাই হচ্ছে সকল বিপদের সেরা।
এত কিছুর পরেও কেউই যদি রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুত্ববাদী বা মুসলমান বিদ্বেষী বলে প্রমাণে সচেষ্ট হন তবে সেটা যে নিছকই এক প্রকাণ্ড শয়তানি, সে কথা না বললেও চলে। পরবর্তী পর্বে এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিতে আমরা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত ওঁচাটে চোথাটির অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণে অগ্রসর হব।
[উদ্ধৃতিতে ব্যবহৃত সমস্ত নজরটান আমার]
দীপ
হেব্বি দিয়েছেন মশাই, ফাটিয়ে দিয়েছেন। আরও ভাল করে চেপে ধরেন দিকি এলেবেলেকে। ওনার যুক্তিগুলোয় ছ্যাঁদা দেখলেই রাঁদা মেরে দিন।
কিন্ত একটা কথা। প্রথম থেকেই নরাধম, কৃতঘ্ন কেন? ব্যক্তিগত আক্রমণ কেন? এলেবেলে খুন, রেপ, গোবধ কিছুই করেনি। আপনার আমার প্রিয় বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ওর নিজস্ব মূল্যায়ন রেখেছে। এটাই তো ইতিহাস চর্চা। আমার পছন্দ না হতে পারে। আপনার যুক্তির ধার যথেষ্ট নয়?
"ফজরে উঠিয়া আমি" বেড়ে হয়েছে। হাসি থামছেনা।