এ কথা স্বীকার করতেই হবে, আঁটি সেলের যে বা যাঁরা এই জঘন্য চোথাটি বানিয়েছেন, তিনি বা তাঁরা খুঁটিয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন এবং পড়েছেন বলেই এই মারপ্যাঁচটা কষতে সক্ষম হয়েছেন। যেহেতু সামান্য ভুলচুক (প্রবন্ধের বা চিঠি প্রাপকের নামে ভুল) ছাড়া উদ্ধৃত অংশগুলি উক্ত লেখাগুলিতে রয়ে গেছে, ফলে অনেক সময় সাধারণ পাঠকের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও যথেষ্ট। এই প্রেক্ষিতেই আমরা এবারে উদ্ধৃতিগুলিকে বিশ্লেষণ করে দেখব।
হিন্দু-মুসলমানের মিলনের প্রকৃত অন্তরায় হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আজীবন সংখ্যাগুরু হিন্দুর দমনমূলক মানসিকতাকে দায়ী করেছেন এবং একাধিক প্রবন্ধে পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের সমান স্তরে তুলে আনার জন্য বারংবার হিন্দুদের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। আমাদের মধ্যে বিদ্যমান এই বিভেদের বাতাবরণকে নির্ভুল নিশানা করে তিনি লিখেছেন,
মানুষকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা যাহাদের অভ্যাস নহে, পরস্পরের অধিকার যাহারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে সীমাবদ্ধ করিয়া রাখিবার কাজেই ব্যাপৃত– যাহারা সামান্য স্খলনেই আপনার লোককে ত্যাগ করিতেই জানে, পরকে গ্রহণ করিতে জানে না– সাধারণ মানুষের প্রতি সামান্য শিষ্টতার নমস্কারেও যাহাদের বাধা আছে– মানুষের সংসর্গ নানা আকারে বাঁচাইয়া চলিতে যাহাদিগকে সর্বদাই সতর্ক হইয়া থাকিতে হয়– মনুষ্যত্ব হিসাবে তাহাদিগকে দুর্বল হইতেই হইবে। যাহারা নিজেকেই নিজে খণ্ডিত করিয়া রাখিয়াছে, ঐক্যনীতি অপেক্ষা ভেদবুদ্ধি যাহাদের বেশি, দৈন্য অপমান ও অধীনতার হাত হইতে তাহারা কোনোদিন নিষ্কৃতি পাইবে না। (দেশের কথা)
তাই স্বাভাবিকভাবেই যে কালান্তর গ্রন্থ থেকে দু-দুটি প্রবন্ধের অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়েছে লোকহিত (১৩২১) প্রবন্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি—
যদি নিজেদের হৃদয়ের দিকে তাকাই তবে একথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, ভারতবর্ষকে আমরা ভদ্রলোকের ভারতবর্ষ বলিয়াই জানি। বাংলাদেশে নিম্নশ্রেণীর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা যে বাড়িয়া গিয়াছে তাহার একমাত্র কারণ হিন্দু ভদ্রসমাজ এই শ্রেণীয়দিগকে হৃদয়ের সহিত আপন বলিয়া টানিয়া রাখে নাই।
আমাদের সেই মনের ভাবের কোনো পরিবর্তন হইল না অথচ এই শ্রেণীর হিতসাধনের কথা আমরা কষিয়া আলোচনা করিতে আরম্ভ করিয়াছি। তাই এ-কথা স্মরণ করিবার সময় আসিয়াছে যে, আমরা যাহাদিগকে দূরে রাখিয়া অপমান করি তাহাদের মঙ্গলসাধনের সমারোহ করিয়া সেই অপমানের মাত্রা বাড়াইয়া কোনো ফল নাই।
রবীন্দ্রনাথ এই ‘হিন্দু ভদ্রসমাজ’-এর ওপর কেন এত খাপ্পা ছিলেন, তার প্রকৃত কারণ এর আগের পর্বে বিশদে উল্লিখিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে একই প্রবন্ধে তিনি তাই নিঃসন্দিগ্ধ চিত্তে উচ্চারণ করতে পেরেছেন:
আমরা পরের উপকার করিব মনে করিলেই উপকার করিতে পারি না। উপকার করিবার অধিকার থাকা চাই। যে বড়ো সে ছোটোর অপকার অতি সহজে করিতে পারে কিন্তু ছোটোর উপকার করিতে হইলে কেবল বড়ো হইলে চলিবে না, ছোটো হইতে হইবে, ছোটোর সমান হইতে হইবে। মানুষ কোনোদিন কোনো যথার্থ হিতকে ভিক্ষারূপে গ্রহণ করিবে না, ঋণরূপেও না, কেবলমাত্র প্রাপ্য বলিয়াই গ্রহণ করিতে পারিবে।
এই কারণে গোটা আলোচনায় ‘ছোটোর উপকার’ করার ক্ষেত্রে ‘বড়ো’-র মানসিকতার বিষয়টিকে সর্বদা মাথায় রাখা দরকার।
১. যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে। (অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র : ১১)
এখানেও তিনি আমাদের অন্তরে নিরন্তর বয়ে চলা বিভেদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে লিখছেন–
রাষ্ট্রনেতারা সমস্ত দেশ জুড়ে বক্তৃতামঞ্চে কন্গ্রেসের উত্তেজনা বিস্তার করে বেড়াচ্ছেন, তার গুরুত্ব সম্বন্ধে কারো মনে কোনো সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু কী স্তূপাকার অবাস্তবতা, কৃত্রিমতা। এক প্রদেশের সঙ্গে আর এক প্রদেশের অনেক কেবল ভাষাগত নয় স্থানগত নয় মজ্জাগত। পরস্পরের মানবসম্বন্ধ কেবল যে শিথিল তা নয়, অনেকস্থলেই বিরুদ্ধ। আমরা ভোটর ভাগ বিভাগ নিয়ে তুমুল তর্ক বাধিয়েছি, যেন অন্তরের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাক্লেও ভোটের সামঞ্জস্যে এই ফাটল ধরা দেশের সর্বনাশ নিবারণ করতে পারবে।
এই ‘অন্তরের মধ্যে সামঞ্জস্য’ বিধানের উপায় নির্দেশ করে ওই চিঠিতে তিনি বলছেন,
তাই মনে হয় নিজেদের স্বভাবগত সমাজগত প্রথাগত সকলপ্রকার দুর্ব্বলতা সত্ত্বেও নিজের দেশের ভার যে করেই হোক নিজেকেই নিতে হবে। পরের উপর নির্ভর করে থাকলে দুর্বলতা বেড়েই চলে, তা ছাড়া ইতিহাসের আবহমান দশাচক্রে অনন্তকাল ইংরেজের শাসন অচলপ্রতিষ্ঠ থাকতেই পারে না।
কিন্তু এই সামঞ্জস্য বিধান তো রাতারাতি সম্পন্ন হতে পারে না। তার প্রস্তুতি চাই, অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠার দৃঢ় মানসিকতা চাই। সেটা পাওয়া যাবে যে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমরা তাঁদের [মুসলমানদের] বঞ্চনা করেছি, সেই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন করে। ইংরেজ প্রবর্তিত চাকরিনির্ভর শহুরে শিক্ষাব্যবস্থার পুনারবৃত্তি নয়, বরং এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণস্পন্দন হবে গ্রামীণ ভারতবর্ষ।
তিনি কিন্তু নেহাত তাত্ত্বিক বুলি আউড়ে তাঁর দায়িত্ব সম্পন্ন করছেন না, রীতিমতো হাতেকলমে প্রয়োগ করে দেখছেন তাঁর তত্ত্বকে। তিনি নিজে রাস্তা আবিষ্কার করেছেন। এবারে সেই রাস্তায় শুরু করছেন তাঁর সংস্কারের কার্যক্রম—
চিরদিনই চীনের মতোই ভারতবর্ষ পল্লীপ্রধান। নাগরিক চিত্তবৃত্তি নিয়ে ইংরেজ আমাদের সেই ঘনিষ্ঠ পল্লীজীবনের গ্রন্থি কেটে দিয়েছে। তাই আমাদের মৃত্যু আরম্ভ হয়েছে ঐ নীচের দিক দিয়ে। সেখানে কী অভাব কী দুঃখ কী অন্ধতা কী শোচনীয় নিঃসহায়তা, বলে শেষ করা যায় না। এইখানেই পুনর্ব্বার প্রাণসঞ্চার করবার সামান্য আয়োজন করেছি, না পেয়েছি দেশের লোকের কাছ থেকে উৎসাহ, না পেয়েছি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সহায়তা। তবু আঁকড়ে ধরে আছি। দেশকে কোন্ দিক থেকে রক্ষা করতে হবে আমার তরফ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর আমার এই গ্রামের কাজে।
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য ‘পল্লীজীবনের গ্রন্থি’ কেটে দিয়ে যে ব্রিটিশ তার বিভেদমূলক নীতিকে ভারতবর্ষের জনজীবনে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, তাকে এতটা সফল করে তুলেছে যে আমরা এমনকি আত্মঘাতী হতেও পিছপা নই– সেই ‘শনিরূপী’ ছিদ্রকে প্রাণপণে রুখতে চান রবীন্দ্রনাথ। তিনি স্পষ্ট বলেন:
আমার অল্পশক্তিতে আমি বেশি কিছু করতে পারি নি কিন্তু এই কথা মনে রেখো পাবনা কন্ফারেন্স থেকে আমি বরাবর এই নীতিই প্রচার করে এসেচি। আর, শিক্ষাসংস্কার এবং পল্লীসঞ্জীবনই আমার জীবনের প্রধান কাজ।
এই প্রসঙ্গে ‘পাবনা কন্ফারেন্স’-এ তাঁর বলা কথার দিকে আমাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
১৩১৪ বঙ্গাব্দে (১৯০৮) পাবনা প্রদেশিক সম্মিলনী-র সভাপতির অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ জানান—
আগুন যখন আমাদের নিজের ঘরেই লাগিয়াছে তখন দুই পক্ষ দুই দিক হইতে এই অগ্নিকে উষ্ণবাক্যের বায়ু-বীজন করিয়া ইহাকে প্রতিকারের অতীত করিয়া তুলিলে, তাহার চেয়ে মূঢ়তা আমাদের পক্ষে আর কিছুই হইতে পারিবে না। পরের কৃত বিভাগ লইয়া দেশে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছে শেষে আত্মকৃত বিভাগই যদি তাহার পরিণাম হয়, ভারতের শনিগ্রহ যদি এবার লর্ড্ কার্জন-মূর্তি পরিহার করিয়া আত্মীয়মূর্তি ধরিয়াই দেখা দেয়, তবে বাহিরের তাড়নায় অস্থির হইয়া ঘরের মধ্যেও আশ্রয় লইবার স্থান পাইব না। (সমূহ)
এই যে ‘আত্মকৃত বিভাগ’-এর আশঙ্কা, ‘আত্মীয়মূর্তি’-তে শনিগ্রহকে দেখতে পাওয়ার আতঙ্ক– তার একমাত্র কারণ যে ইংরেজি শিক্ষায় অগ্রসর হয়ে মুসলমানদের আরও পেছনে ঠেলে দেওয়ার দুর্মর বাসনা এবং তার দৌলতে সামাজিক মানমর্যাদা ও অর্থ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির প্রতি আমাদের এক অতি অন্যায্য আকাঙ্ক্ষা, সে কথা একবারের জন্যও বিস্মৃত হন না তিনি। এই অন্যায়ের সম্মানজনক প্রতিকারের রাস্তার জানান দিয়ে তিনি বলেন:
এ দিকে একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদের খড়্গ দেশের মাথার উপর ঝুলিতেছে। কত শত বৎসর হইয়া গেল, আমরা হিন্দু ও মুসলমান একই দেশমাতার দুই জানুর উপরে বসিয়া একই স্নেহ উপভোগ করিয়াছি, তথাপি আজও আমাদের মিলনে বিঘ্ন ঘটিতেছে।আমরা গোড়া হইতে ইংরেজের ইস্কুলে বেশি মনোযোগের সঙ্গে পড়া মুখস্থ করিয়াছি বলিয়া গবর্মেন্টের চাকরি ও সম্মানের ভাগ মুসলমান ভ্রাতাদের চেয়ে আমাদের অংশ বেশি পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। এইরূপে আমাদের মধ্যে একটা পার্থক্য ঘটিয়াছে। এইটুকু কোনোমতে না মিটিয়া গেলে আমাদের ঠিক মনের মিলন হইবে না, আমাদের মাঝখানে একটা অসূয়ার অন্তরাল থাকিয়া যাইবে। মুসলমানেরা যদি যথেষ্টপরিমাণে পদমান লাভ করিতে থাকেন তবে অবস্থার অসাম্য-বশত জ্ঞাতিদের মধ্যে যে মনোমালিন্য ঘটে তাহা ঘুচিয়া গিয়া আমাদের মধ্যে সমকক্ষতা স্থাপিত হইবে। যে রাজপ্রসাদ এতদিন আমরা ভোগ করিয়া আসিয়াছি আজ প্রচুর পরিমাণে তাহা মুসলমানদের ভাগে পড়ুক, ইহা আমরা যেন সম্পূর্ণ প্রসন্নমনে প্রার্থনা করি। (তদেব)
এখানে লক্ষণীয় ‘ছোটোর উপকার’ করার ক্ষেত্রে ‘বড়ো’-র মানসিকতার বিষয়টি। প্রার্থনাটি যেন ‘প্রসন্নমনে’ করা হয়, নতুবা ‘আমাদের মাঝখানে একটা অসূয়ার অন্তরাল থাকিয়া যাইবে’।
৩. যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭, কালান্তর)
কিন্তু আমাদের দুর্বলতার উৎস অনুসন্ধানে আগ্রহী না হয়ে সত্যিই কি এই কথা নির্বিবাদে মেনে নেব? তা তো সম্ভব নয়। মজার কথা এই, আমাদের হয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই দুর্বলতার কারণটি আমাদের সামনে তুলে ধরে লেখেন—
আজকে দেখতে হবে, আমাদের হিন্দুসমাজের কোথায় কোন্ ছিদ্র, কোন্ পাপ আছে, অতি নির্মমভাবে তাকে আক্রমণ করা চাই। এই উদ্দেশ্য মনে নিয়ে আজ হিন্দুসমাজকে আহ্বান করতে হবে; বলতে হবে, পীড়িত হয়েছি আমরা, লজ্জিত হয়েছি, বাইরের আঘাতের জন্য নয়, আমাদের ভিতরের পাপের জন্য; এসো সেই পাপ দূর করতে সকলে মিলি। আমাদের পক্ষে এ বড়ো সহজ কথা নয়।
তিনি তো এই ছিদ্রের উৎস সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল।
তাই ‘ছিদ্র’ যে হিন্দু সমাজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে কথা তিনি যেমন জানেন, তেমনই সেই ‘ছিদ্র’কে ‘নির্মমভাবে’ আক্রমণ করার উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন সেই সমাজের বাসিন্দাদের ওপরেই। তাঁর মতে, এতদিন চালিয়ে আসা কৃতকর্মের জন্য তাঁদেরকে ‘পীড়িত’ ও ‘লজ্জিত’ হতে হবে। সেই ‘পাপ’ দূর করে সকলকে মিলিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে হবে তাঁদেরই। নতুবা এই ‘পাপ’ শুধু আমাদেরই ‘অকল্যাণ’-এর কারণ হয়ে উঠবে না, তা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশীদের প্রতি ‘হিংসা জাগিয়ে’ তুলবে। যদি ‘পাপ’ দূরীভূত করার কোনও উদ্যম আমাদের তরফ থেকে আশু গৃহীত না হয়, তবে–
কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটা উপলক্ষ্য নিয়ে পরস্পর কৃত্রিম বন্ধুতাবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি, কিন্তু চিরকালের জন্য তা হয় না। যে মাটিতে কণ্টকতরু ওঠে সে মাটিকে যতক্ষণ শোধন না করা হয় ততক্ষণ তো কোনো ফল হবে না।
কাজেই কণ্টকতরু-কে উপড়ে ফেলে মাটি শোধন করতে হলে:
আজ আমাদের অনুতাপের দিন, আজ অপরাধের ক্ষালন করতে হবে। সত্যিকার প্রায়শ্চিত্ত যদি করি তবেই শত্রু আমাদের মিত্র হবে, রুদ্র আমাদের প্রতি প্রসন্ন হবেন।
বলা বাহুল্য, ‘পাপ’ যেহেতু আমাদের সেহেতু তার ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করার দায়ও আমাদের।
৪. কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭, কালান্তর)
আবারও হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যসাধনের জন্য মুসলমানদের সর্বপ্রথমে হিন্দুদের সঙ্গে সমকক্ষতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। এই মারামারির মূল চিহ্নিত করে তিনি জানান—
তার কারণ এ নয়, মুসলমানের গায়ে জোর আছে, হিন্দুর নেই; তার আসল কারণ, তাদের সমাজের জোর আছে, হিন্দুর নেই। এক দল আভ্যন্তরিক বলে বলী, আর-এক দল আভ্যন্তরিক দুর্বলতায় নির্জীব। এদের মধ্যে সমকক্ষভাবে আপোষ ঘটবে কী করে। অত্যন্ত দুর্যোগের মুখে ক্ষণকালের জন্যে তা সম্ভব, কিন্তু যেদিন অধিকারের ভাগ-বাটোয়ারার সময় উপস্থিত হয় সেদিন সিংহের ভাগটা বিসদৃশরকম বড়ো হয়ে ওঠে, তার কারণটা তার থাবার মধ্যে।
অধিকারের প্রসঙ্গে যদি আমাদের ‘থাবার মধ্যে’ বিভেদের মূল বীজ নিহিত থাকে, তাহলে সমস্যার সমাধান অসম্ভব। তাই,
ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তা হলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সেই সমকক্ষতা তাল-ঠোকা পালোয়ানির ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয়পক্ষের সামাজিক শক্তির সমকক্ষতা।
এখানেও হিন্দু-মুসলমানে সমকক্ষতা স্থাপনে আগ্রহী হতে হবে ওই সিংহের থাবাধারীদেরই।
৫. এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮, শান্তিনিকেতন)
এ কথা ঠিক যে ‘ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে’। কিন্তু তা কোনও ভাবেই ভারতবর্ষকে আত্মিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি কারণ—
সেই যুগের নানক রবিদাস কবীর দাদু প্রভৃতি সাধুদের জীবন ও রচনা যাঁরা আলোচনা করছেন তাঁরা সেই সময়কার ধর্ম-ইতিহাসের যবনিকা অপসারিত করে যখন দেখাবেন তখন দেখতে পাব ভারতবর্ষ তখন আত্মসম্পদ সম্বন্ধে কিরকম সবলে সচেতন হয়ে উঠেছিল।
ভারতবর্ষ তখন দেখিয়েছিল, মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়। দেখিয়েছিল, ভারতবর্ষের মর্মস্থলে সত্যের একটি বিপুল সাধনা সঞ্চিত হয়ে আছে যা সকল সত্যকে আত্মীয় বলে গ্রহণ করতে পারে। এইজন্যেই সত্যের আঘাত তার বাইরে এসে যতই ঠেকুক তার মর্মে গিয়ে কখনো বাজে না, তাকে বিনাশ করে না।
৬. হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, পরিচয়)
এই অংশেও রবীন্দ্রনাথ আগের মনোভাবে অটুট থাকেন। তিনি খোলাখুলি স্বীকার করেন, হিন্দু ও মুসলমানের অনৈক্যের মুল কারণ দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব। এই অভাবের মূল কারণ হল, ‘বড়ো’-র ‘ছোটোর উপকার’ করার পরিবর্তে তাকে যে কোনও মূল্যে বঞ্চিত করে নিজের আরও ‘বড়ো’ হতে চাওয়ার হীন স্বার্থবুদ্ধি। পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্ককে যারা কেবল নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার উপায় হিসেবে বিবেচনা করে, সেখানে নিজের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে যে ‘ছোটো’-র পক্ষে ‘বড়ো’-র উপকার করার বিষয়ে আদৌ আগ্রহী হওয়া সম্ভব নয়– সেই সারসত্য উপলব্ধি করে তিনি লেখেন—
হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুইপক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,— সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।
মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কি না, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসংগত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।
মুসলমানদের সন্দেহের কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি কালান্তর গ্রন্থের ‘সংযোজন’ অংশে জানান:
ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়।
সোজা কথায়, ‘ছাদ-রক্ষা’ করতে চাইলে ‘পাঁচটা কড়ি’-র ‘তিনটে কড়ি’-কে উপেক্ষা করলে চলবে না, বরং তিনটে কড়ি না থাকলে যে গোটা ছাদটাই ধসে পারতে পারে যে কোনও দিন– সেই বাস্তব সত্যটি উপলব্ধি করাই বাঞ্ছনীয়।
৭. ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৮৫, ইতিহাস)
এখানে কোন সময়ের ভারতবর্ষের কথা বলছেন রবীন্দ্রনাথ? বলছেন সেই সময়ের কথা যখন—
শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত; এবং বৌদ্ধধর্ম বিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতোহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। তখন ধর্মে সমাজে শাস্ত্রে কোনো বিষয়ে নবীনতা ছিল না, গতি ছিল না, বৃদ্ধি ছিল না, সকল বিষয়েই যেন পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, নূতন আশা করিবার বিষয় নাই। সে সময়ে নূতনসৃষ্ট মুসলমানজাতির বিশ্ববিজয়োদীপ্ত নবীন বল সম্বরণ করিবার উপযোগী কোনো একটা উদ্দীপনা ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল না।
সেই ‘নূতনসৃষ্ট’ মুসলমান জাতিকে কীভাবে তদানীন্তন ভারতবর্ষ নিজের আত্মিক বন্ধনে অঙ্গীভূত করে নিয়েছিল, তার বিশদ উল্লেখ তিনি করেছেন শান্তিনিকেতন প্রবন্ধেই।
৮. প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না। (হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)
কিন্তু এই ‘নিম্নশ্রেণী’-র হিন্দুরা তো আর বিনা কারণে ‘মুসলমান এবং খৃস্টান’ ধর্মকে বরণ করে নিচ্ছেন না। বরং হিন্দুসমাজের ‘মজ্জাগত অনৈক্যজনিত দুর্ব্বলতা’ এবং তাঁদের ওপর ‘উচ্চশ্রেণী’-র হিন্দুদের ‘সহস্রবিধ বিধিনিষেধের বোঝা’ চাপিয়ে দেওয়ার ফলে ‘সামাজিক অসম্মান থেকে বাঁচবার জন্যে’ তাঁরা সেই ধর্মের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন মাত্র। কাজেই মুসলমানদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে দাবিয়ে রাখা এবং একই ভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ওপর একাধিপত্য বজায় রাখার যে প্রবল আত্মঘাতী ও আত্মক্ষয়ী বাসনা, তার এক ও একমাত্র দায় উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরই।
পরিশেষে -- (সোমনাথ?)-কে অসংখ্য ধন্যবাদ। তিনি ত্রুটির দিকটি ধরিয়ে না দিলে লেখাটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিতই হত না। অবশ্য এত কিছুর পরেও কেউ যদি চোথাটিতে কেবল রবীন্দ্রবাণীর উপস্থিতিকেই একমাত্র ধ্রুবসত্য মনে করেন, তবে আমি নাচার!
[উদ্ধৃতিতে ব্যবহৃত সমস্ত নজরটান আমার]
একজন মহান কবি যিনি বহু দিন আগে এই কথা গুলো বলে আমাদের চেতনা কে জাগ্রত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন , তার পরিনাম আর প্রতিফলন হলো বিজেপি 'র রবীন্দ্র চর্চা ,নাগরিক জনের বাৎসরিক রবীন্দ্র প্রণাম , আর ওনার কিছু পানপানানো গান দিয়ে নিজেদের আত্মতুষ্ট করা !!!আসল রবীন্দ্রনাথ কোথায় হারিয়ে গেলেন !!বা হারিয়ে দেয়া হলো !!
১. পল্লীসঞ্জীবন,৷ বলতে কি দাদু ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন? শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ ব্যবস্থাকে আরও দৃঢ় করতে চাইছিলেন, না ঐ ব্যবস্থার উৎখাত চাইছিলেন?
২. রবীন্দ্রনাথ কি কোরান মজিদ পাঠ করেছিলেন? করে থাকলে ঐ ঐশী পুস্তক নিয়ে কি, কিছু লিখেছেন?
৩. হিন্দুর এই হীন স্বার্থবুদ্ধির কারণ কি? কেন উচ্চবর্গের হিন্দুরা মুসলমানদের জন্য নিখাদ ভালোবাসা ব্যক্ত করে নি। নিম্নবর্গের হিন্দুরা যে এরকম ভাবেন নি, সেটা যোগেন মন্ডল দেখিয়ে গিয়েছেন।
আসলে আমি, স্পেসিফিক্যালি যৌনকেশ যুক্ত বনি কুরাইজা গণহত্যা (আজকের দৃষ্টিভঙ্গিতে, এলেবেলের চোখেও মনে হয়) নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত জানতে চাই।
তখনকার যুগে এসব কিচ্ছু গুরুতর ছিল না।
কিন্তু সমস্যা হল, আজকেও কোন মুসলমান, বনি কুরাইজা গণহত্যাকে ডিনাউন্স করতে পারবেন না। করলে উনি, মুরতাদ বা কতল-এ-আজিম বলে ঘোষিত হবেন। ইসলাম আধাখ্যাঁচড়া ধর্ম নয়, যে এটা মানব, ওটা মানব না। সুফি, বাউল দর্শন দিয়ে ব্যখ্যা করার দরকার নেই। প্রকৃত মুসলমান, এদের বিধর্মীদের থেকেও বেশি ঘৃণা করে।
এলেবেলে, নিশ্চিত, একটা ধোঁয়া ধোঁয়া তত্ত্ব দিয়ে আমার থোঁতামুখ ভোঁতা করে দেবেন।
এলেবেলেকে অজস্র ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ দেবেন না। আমি কিছুই করতে পারিনি। কোনও মানুষের চিন্তা সামান্যতম বদলায়নি। আপনার করা মন্তব্যের ঠিক আগের মন্তব্য দুটো দেখলে সেটা পরিষ্কার হবে।
@ ফেক টেবিলের*****,
"বনি কুরাইজা গণহত্যা" কারে কয়? জানিতে চাই। রবীন্দ্রনাথ ইহা লইয়া কিছু বলিয়াছেন কি?
যদি বলিয়াছেন তো এখানে জানাইয়া ঋদ্ধ করুন। আর যদি না বলিয়াছেন তো দুইটি প্রশ্ন।
1.. রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছু নিয়েই বলে যান নাই, ধরেন ছুন্নত করা , তাহাতে কী খাড়াইল? লেখাটি ত কী বলিয়াছেন তাাহা লইয়া।
অথবা তাঁহার কথিত মুসলিম বিরোধী উক্তি বলিয়া যে চোথা চলিতেছে সেই উক্তির সত্যতা বা তাহার কন্টেক্সট লইয়া।
2. উক্ত সন্দর্ভে এলেবেলের লিখনটি একটি পরিশ্রমসাধ্য আয়াস। ইহাকে আপনি সঠিক বা বেঠিক দুইই মনে করিতে পারেন। যদি সঠিক মনে করেন ত কোন কথা হইবে না। যদি বেঠিক মনে করেন ত দুইটি প্রশ্ন ছিল।
2.1 এলেবেলে বেঠিক হইলে আপনি পাল্টা তথ্য ও যুক্তি দিয়া খন্ডন করেন নাই কেন? তাহাতে বিতর্ক বাড়িত, আমাদের মত ইতরজন যুগপৎ ঋদ্ধ ও আমাদের হইত।
2.2 তবে কি আপনি একজন-- যাহাদের নাম করিতে মানা-- ট্রল?
৮. নং নিয়ে একটু বলার। যুক্তিতে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চাওয়ার মূল কারণ ‘উচ্চশ্রেণী’-র হিন্দুদের চাপিয়ে দেওয়া ‘সহস্রবিধ বিধিনিষেধের বোঝা’-জনিত 'সামাজিক অসম্মান থেকে বাঁচবার' তাগিদ।
কিন্তু "একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে" এখান থেকে এই সাজেশনটাও আসছে যে, মুসলমানেরা জোর করেও ধর্মান্তরণ করে বা ভবিষ্যতে করবে। এটা সমস্যার। এটার ক্লারিফিকেশন দরকার। তাছাড়া "প্রপৌত্রী" পড়লে প্রধানত মেয়েদের কথা বলা হয়েছে বলেই মনে হয়, সেহেতু লাভ জিহাদের সাজেশন আসে। ব্যাকরণগত সন্ধি/সমাস/বিভক্তি বা নিয়মটার ব্যাখ্যা দরকার।
১. নং, খুব স্পষ্টতই "মুষল ধরবে" কথাটা ইংরেজদের বিরুদ্ধে, হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়। ব্যাখায় সেটা কোথাও বলা আছে চোখে পড়ল না।
৩. খুবই গোলমেলে। মুসলমান সমাজ মেরেছে, হিন্দুরা পড়ে পড়ে মার খেয়েছে - এটা তিনি এসট্যাবলিশ করেছেন। মূল সমস্যা হিসেবে আইডেন্টিফাই করেছেন খন্ডিত থাকাকে। "আমাদের মধ্যে কত ছোটো ছোটো সম্প্রদায়, কত গণ্ডী, কত প্রাদেশিকতা– এ উত্তীর্ণ হয়ে কে আসবে"? "বাহির থেকে যখন প্রথম আঘাত নিয়ে এল মহম্মদ ঘোরী তখন হিন্দুরা সে আসন্ন বিপদের দিনেতেও তো একত্র হয় নি। তার পর যখন মন্দিরের পর মন্দির ভাঙতে লাগল, দেবমূর্তি চূর্ণ হতে লাগল, ... তখনও একত্র হতে পারল না। খণ্ডিত ছিলেম বলেই মেরেছে, যুগে যুগে এই প্রমাণ আমরা দিয়েছি।" - এই খন্ডিত থাকার দুর্বলতার অ্যান্টিডোট হিসেবে হিন্দুত্বের কনসলিডেশন, হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের ছক ভ্যালিডেট হয়ে যায়।
"যে দুর্বল সেই প্রবলকে প্রলুব্ধ করে পাপের পথে টেনে আনে। পাপের প্রধান আশ্রয় দুর্বলের মধ্যে।" - এও এক সাংঘাতিক স্টেটমেন্ট। ভিকটিম ব্লেমিং যাকে বলে। রেপ থেকে শুরু করে খুন ডাকাতি চুরি রাহাজানি সমস্ত অন্যায়ের জন্য ভিকটিমের দুর্বলতাই দোষী সাব্যস্ত হয়। "দুর্বলতা পুষে রেখে দিলে সেখানে অত্যাচার আপনিই আসে– কেউ বাধা দিতে পারে না।" এই দর্শনের মর্ম বোঝার জায়গায় সামাজিকভাবে এখনও আমরা আসিনি।
দুর্বলতা দূরীকরণের দাওয়াই হিসেবে শুধু "মনে ও আচরণে ভেদবুদ্ধি, খণ্ড খণ্ড স্বার্থবুদ্ধি" "অন্তরের মধ্যে বহুকালের অভ্যস্ত ভেদবুদ্ধি" - এই পাপ-এর বিলুপ্তিকরণের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের আভ্যন্তরীণ সংস্কার আর অখন্ড সংহত হয়ে ওঠার দাবিই শুধু তিনি জানিয়েছেন, তা নয়। এক নিঃশ্বাসে বলেছেন "বাইরেও বহুদিনের গড়া অতি কঠিন ভেদের প্রাচীর" সরানোর কথা, বলেছেন "ঐ জাজিম-তোলা আসনে বহুদিনের মস্ত ফাঁকটা" যা আসলে "অকূল অতল কালাপানি" সেটা দূর করার কথাও। "প্রতিবেশীদের প্রতি অবিচার করে তাদের মধ্যে হিংসা জাগিয়ে" তোলাকে যখন তিনি অভিযুক্ত করছেন - এটা স্পষ্ট হয়, শুধু হিন্দু সংহতি নয়, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা ও তিনি এক নিঃশ্বাসেই বলছেন। শুধু হিন্দু সমাজের ভেদ-বিভেদ দূর করাই নয়, মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের প্রভেদমূলক আচরণ -এর প্রায়শ্চিত্তের কথাও বলছেন। মুসলমানকে পৃথক সত্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে হিন্দুদের সামাজিক প্রথাগুলোকেই দায়ী করছেন, সেগুলোরই বিলুপ্তি চেয়েছেন। প্রতিপক্ষ নয় এক জাতি এক প্রাণ হিসেবেই হিন্দু-মুসলমানকে দেখতে চাইছেন।
দুটো নিদানই বিজেপি / আর এস এস-এর অ্যাজেন্ডার বিপ্রতীপ। একদিকে দেখি দলিত-ঠাকুর শূদ্র-বর্ণহিন্দু বিভাজনের বাড়বাড়ন্ত যা এই খন্ডিতকরণের দিকেই নিয়ে যায়। আর মুসলমানদের 'অপর' করে তোলা 'প্রতিদ্বন্দ্বী' করে তোলা - বাইরের ভেদের প্রাচীর সরানোর বদলে আরো উঁচু করেই তুলছে।
ডাবল ড্যাশ,
আপনার যুক্তিগুলো প্রণিধানযোগ্য, আমার সঠিক মনে হয়েছে।
ধ্যার মশাই রঞ্জনবাবু, আপনার সাহস তো মন্দ নয়। যে সাইটে খিস্তিট্যান লেখকদের রেটিং করে সেখানে এক আইটেম তথা বামনদেব চক্রবর্তীর 'চ্যবনপ্রাশ'-কে আপনি 'পরিশ্রমসাধ্য আয়াস' বলেন কোন আক্কেলে? যার রেঞ্জ বনি কুরাইজা থেকে যোগেন মণ্ডল, তার সঙ্গেই বা আপনি পাঙ্গা নিতে যান কোন সাহসে? আপনার সময় কি অফুরন্ত?
-- 'প্রপৌত্রী' নয়, প্রপৌত্রমণ্ডলীই। প্রপৌত্রীটা আঁটি সেলের। মূল চিঠি দেখুন।
'জোর করে কলেমা পড়াবে'-টা নিছকই একটা অ্যাপ্রিহেনশন। কারণ রবীন্দ্রনাথ জানেন 'মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়'। যদি বাংলার দিকে তাকাই তাহলেও দেখব এখানকার অধিকাংশই মুসলমানই আসলে হিন্দু বা বৌদ্ধ ছিলেন। তাই একজন ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল ও মুসলমান পাশাপাশি দাঁড়ালে তাঁদের চেহারগত দিক থেকে পার্থক্য খুঁজে বের করা মুশকিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন পাঁচটা ও তিনটে কড়ির কথা। তিনি তো জানেন বাংলায় সুলতানি শাসন কতদিন ধরে চলেছিল। তারপরেও ওই পাঁচ ও তিনের ফারাক রয়ে গেছে, উল্টে যায়নি।
আরেকটা ব্যাপার এখানে খেয়াল করা দরকার। তিনি চিঠিটি লিখেছেন ১৯৩৩-এর অক্টোবরে। তার আগের বছরে ২৫ সেপ্টেম্বর পুনা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। তার ফলে 'রাষ্ট্রিক অধিকারের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা চল্চে আজকাল— যেন লঙ্কাভাগ করতে বসেচি অথচ সমস্ত লঙ্কাই যাচ্চে তলিয়ে।'
আপনি পরে যে মন্তব্যটা করেছেন, সত্যি কথা বলতে আমি সেটা খুব একটা ভালো বুঝতে পারিনি। আরেকবার আপনার বক্তব্যটা পরিষ্কার করে বলবেন? মানে কোনখানে আপনি দ্বিমত পোষণ করছেন এবং কোনখানে সহমত হয়ে সংযোজন করছেন। সেখানে চোথাটার নম্বরগুলো উল্লেখ করলে আমার পক্ষে বোঝা সুবিধা হবে।
The Banu Qurayza, a Jewish tribe, were besieged for 25 days until they surrendered. Sa,d gave his verdict that 'the men should be killed, the property divided, and the women and children taken as slaves. ' Muhammad approved of the ruling after which nearly all male members of the tribe who had reached puberty were beheaded.: https://on.wikipedia.org/wiki/Invasion_of_Banu_QQQUrayza.