একাদশ অধ্যায়
জনশিক্ষা ও বিদ্যাসাগর – ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত
গোড়ায় যাঁরা এ দেশে তাঁদের রাজতক্তের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন করেছিলেন, দেখতে পাই, তাঁদেরও উত্তরাধিকারীরা বাইরের আসবাব এবং ইঁট-কাঠ-চুন-সুরকির প্যাটার্ন দেখিয়ে আমাদের এবং নিজেদেরকে ভোলাতে আনন্দ বোধ করে। ...আমাদের নালিশ এই যে, তলোয়ারটা যেখানে তালপাতার চেয়ে বেশি দামি করা অর্থাভাববশত অসম্ভব বলে সংবাদ পাই সেখানে তার খাপটাকে ইস্পাত দিয়ে বাঁধিয়ে দিলে আসল কাজ এগোয় না। তার চেয়ে ঐ ইস্পাতটাকে গলিয়ে একটা চলনসই গোছের ছুরি বানিয়ে দিলেও কতকটা সান্ত্বনার আশা থাকে।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ
বাংলায় বহু ব্যয়ে মডেল স্কুলগুলি প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মানোন্নয়ন। সেই বিষয়ে যে স্কুলগুলি ব্যর্থ হয়, তা শিক্ষাসম্পর্কীয় সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। এই পরিস্থিতিতে দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষাপদ্ধতির উন্নতির জন্য, পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্যালয় পরিদর্শক উড্রো বাংলায় টোমাসন প্রবর্তিত হলকাবন্দি ব্যবস্থা চালু করতে চান। তাঁর পরিকল্পনাকে সমর্থন করে ১৮৫৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির পরিচালকবর্গ জানান:
We approve Mr. Woodrow’s desire to make the utmost possible use of existing means of education, and to avoid as much as possible the supersession of the former teachers of indigenous schools, which seem, notwithstanding the small amount of instruction which they afford, to have naturally a considerable hold on the minds of the people. …we agree with you in thinking the scheme well deserving of a trial on an enlarged scale, and accordingly approve the sanction given to the recommendation of the Bengal Government.১
অ্যাডাম তাঁর তৃতীয় প্রতিবেদনের শেষে মডেল স্কুলের বিরোধিতা করে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন,
Government should do nothing to supersede the exertions of the people for their own benefit, but should rather endeavour to supply what is deficient in the native systems, to improve what is imperfect, and to extend to all what is at present confined to a few.২ [নজরটান সংযোজিত]
তাঁর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রায় কুড়ি বছর পরে, সরকার তাঁর অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করে!
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে চালু হওয়া হলকাবন্দি বিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে অপরিহার্য শর্ত ছিল – এই বিদ্যালয়গুলির খরচের অর্ধেক বহন করার জন্য স্থানীয় জমির মালিকরা তাঁদের প্রদত্ত রাজস্বের শতকরা এক ভাগ সরকারকে অতিরিক্ত দেবেন, বাকি অর্ধেক খরচ দেবে সরকার; তবে এ ব্যাপারে মালিকদের ওপর কোনও জোর খাটানো হবে না। উড্রোর পরিকল্পনা ছিল, স্থানীয় পাঠশালাগুলিকে হলকাবন্দি ব্যবস্থার কাজে লাগানো হবে। এই কাজ রূপায়নের জন্য চার-পাঁচটি মণ্ডলী (Circle) তৈরি করা হবে। প্রত্যেক মণ্ডলীতে থাকবেন সরকারি বেতনভুক যোগ্য শিক্ষক। তাঁরা এই পাঠশালাগুলির গুরুমশাইদের উন্নততর পাঠদানের বিষয়ে শেখাবেন, সঙ্গে এগিয়ে থাকা পড়ুয়াদের উচ্চতর বিষয়গুলি পড়াবেন। উড্রোর পরিকল্পনাকে সমর্থন করে ১৮৫৯ সালে ভারত সরকারের সচিব (ততদিনে শিক্ষাবিভাগ কোম্পানির আওতা থেকে মুক্ত হয়ে রানির প্রত্যক্ষ তদারকির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে) বেইলি (Mr. Bayley) জমির ওপর এক শতাংশ শিক্ষা কর (Education cess) বসানোর প্রস্তাব দিয়ে লেখেন —
[উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের] অনুরূপভাবে মাতৃভাষা শিক্ষার জন্য যদি বাংলার জমিদাররাও নিজেদের করের আওতায় নিয়ে আসেন, তাহলে বড়লাট খুশি হবেন। সেক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট শর্তে অঙ্গীকার না করে সরকারও সময়ে সময়ে স্বেচ্ছায় এই ধরনের আর্থিক সহায়তা দেবেন।
তবে [বাংলার জমিদারদের পক্ষে] যদি এ জাতীয় কোনও স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অসম্ভব হয়, তাহলে বড়লাটের মতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে স্থানীয় শুল্ক আরোপের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে আইন প্রয়োগ করা যেতে পারে।৩
বেইলির প্রস্তাবে বাংলার জমিদার শ্রেণির প্রতিভূদের চরম বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। সে প্রসঙ্গ আলোচনা করার আগে আমাদের দেখে নেওয়া প্রয়োজন, এই পরিকল্পনা সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মনোভাব কেমন ছিল।
জনসাধারণের জন্য অল্প খরচায় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করা এবং সাধারণভাবে মাতৃভাষা শিক্ষার বিস্তার ও উন্নতিসাধনের উপায় হিসেবে এই হলকাবন্দি প্রণালী বাংলায় কতদূর কার্যকর হতে পারে, সে বিষয়ে ভারত সরকার বাংলার ছোটলাট গ্র্যান্ট সাহেবের মতামত জানতে চায়। নিজের মত প্রকাশ করার আগে, ছোটলাট শিক্ষাবিভাগের কর্মচারীরা ছাড়াও এই ধরণের বিদ্যালয় সম্পর্কে যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, এমন কয়েকজন ইউরোপীয় ও ভারতীয় ব্যক্তির বক্তব্য জানতে চেয়ে বিজ্ঞপ্তি পত্র (circular letter) পাঠান। সরকারের তরফে ১৮৫৯-এর ১৭ জুন এই চিঠি পাওয়ার প্রায় তিন মাস পরে, ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলা সরকারের কনিষ্ঠ সচিব (Junior Secretary) টমসন (River Thomson)-কে বিদ্যাসাগর পাঁচটি অনুচ্ছেদ সংবলিত এক দীর্ঘ উত্তর দেন। চিঠির শুরুতেই এ বিষয়ে তাঁর মত জানিয়ে বলেন –
সরকার যে ভেবেছেন বিদ্যালয় পিছু মাসিক পাঁচ-সাত টাকা মাত্র ব্যয় করে কোনও শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন করবেন, আমার মতে দেশের বর্তমান অবস্থায় তা কার্যকর হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। লেখা-পড়া-অঙ্ক শেখানোর মতো যোগ্য লোক, যাঁদের নিজ নিজ গ্রামের প্রতি যত আকর্ষণই থাক, এমন যৎসামান্য বেতনে তাঁদেরকে পাওয়া যাবে না।৪
যদিও তিনি জানতেন না, এমনকি ১৮৫৪-তেও হলকাবন্দি বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের মাসিক বেতন আদৌ পাঁচ-সাত টাকা ছিল না, ছিল ১৫ টাকা।৫
হলকাবন্দি বিদ্যালয় সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা সত্ত্বেও চিঠিটির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে তিনি এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেন —
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হলকাবন্দি বিদ্যালয়গুলিতে যে প্রণালী অনুসৃত হয়েছে তার সঠিক খবর আমি জানি না। যদি ধরে নেওয়া হয় যে বিহারের বিদ্যালয়গুলিতে ওই একই প্রণালী গ্রহণ করা হয়েছে, তবে আমার মনে হয় অনেক দিক থেকেই তা বাংলার পাঠশালাগুলির মতো। যতটা বুঝেছি, বিহারের বিদ্যালয়গুলিতে চিঠি লেখা, জমিদারি হিসেব ও দোকানের খাতাপত্রের হিসেব রাখার মধ্যেই শেখানোর বিষয় সীমাবদ্ধ। তফাতের মধ্যে বিহারে উন্নত ধরনের কয়েকটি ছাপা বই নামমাত্র ব্যবহার করা হয়। বাংলায় এই শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে গুরুমশাইদের অল্প মাসমাইনের ব্যবস্থা, তাঁদের পাঠশালাগুলিতে খানকয়েক ছাপা বই চালু করা এবং সেগুলিকে সরকারি পরিদর্শনের আওতায় আনলে সহজেই সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।৬ [নজরটান সংযোজিত]
বিদ্যাসাগর নিজেই জানাচ্ছেন তিনি হলকাবন্দি বিদ্যালয় বিষয়ে জানেন না, অথচ ‘ধরে নেওয়া’-র ভিত্তিতে তিনি বিহারের পাঠ্যক্রম সম্পর্কে মত দিচ্ছেন! অথচ অষ্টম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, হলকাবন্দি বিদ্যালয়ে লেখা, পড়া ও অঙ্ক ছাড়াও পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল:
… Geography, History, Geometry, or other general subject, conveyed through the medium of the vernacular language, as the people may be willing to receive.৭
এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেন,
কিন্তু আমি বলতে বাধ্য, এই ধরণের শিক্ষা নিতান্ত তুচ্ছ (insignificant) হবে এবং তা কখনও জনসাধারণের কাছে – যদি জনসাধারণ বলতে শ্রমিক শ্রেণিকে বোঝানো হয় – পৌঁছবে না। কারণ এখনও পর্যন্ত বিহারে ও বাংলায় এই শ্রেণি থেকে পাঠশালায় খুবই কম ছাত্র আসে।৮
বিদ্যাসাগর নিজে পাঠশালার ছাত্র ছিলেন। তাছাড়া অ্যাডামের তৃতীয় প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর জানা ছিল যে, পাঠশালার অধিকাংশ ছাত্রই ছিল দরিদ্র নিম্নশ্রেণির পরিবারের সন্তানসন্ততি। যেখানে সরকার এই সন্তানদের শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসতে আগ্রহী, সেখানে তাঁর এই ধরণের মন্তব্য আমাদের অবাক করে।
তৃতীয় অনুচ্ছেদে পাঠশালায় কম ছাত্র আসার কারণ ব্যাখ্যা করে বিদ্যাসাগর বলেন —
শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা সাধারণত এতটাই নিচু স্তরে যে, সন্তানদের শিক্ষার জন্য খরচ করা তাঁদের সাধ্যে কুলায় না। তাঁদের ছেলেরা একটু বড় হলে যখন যে কোনও ধরণের কাজ করে যৎসামান্য উপার্জন করার উপযুক্ত হয়, তখন তাঁরা আর তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেন না। তাঁরা ভাবেন – সম্ভবত এ ভাবনা যথার্থ – যে ছেলেদের সামান্য কিছু লেখাপড়া শেখালেই তাঁদের অবস্থার উন্নতি হবে না, তাই ছেলেদের পাঠশালায় পাঠাতে তাঁদের প্রবৃত্তি থাকে না। এই অবস্থায় এমন প্রত্যাশা করা খুবই বেশি যে কেবল জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁরা তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবেন – যেখানে এমনকি উচ্চতর শ্রেণিগুলি এখনও পর্যন্ত শিক্ষার সুফল ঠিকমতো বোঝে না।৯
অথচ পঞ্চম অধ্যায়ে দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আলোচনায় আমরা দেখেছি, এই ধরণের পাঠশালাগুলিতে কৃষিজীবী, কারিগর, দোকানদার, জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারী ইত্যাদি সাধারণ শ্রেণির মানুষের সন্তানরাই শিক্ষা লাভ করত এবং পাঠশালার গুরুমশাইরা ছিলেন পুরোপুরি পড়ুয়াদের দেওয়া বেতন ও সিধের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ‘সন্তানদের শিক্ষার জন্য খরচ করা তাঁদের সাধ্যে কুলায় না’ জাতীয় যে কথা বিদ্যাসাগর চিঠিতে জানান, তা আদৌ প্রকৃত তথ্য ছিল না। সর্বোপরি ১৮৫১ সালে ইংল্যান্ডের পড়ুয়ারা সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বাধিক দু-বছর পড়লেও বাংলার পাঠশালাগুলিতে পড়ুয়াদের দু-তিন বছর পড়ার পরেই পাঠশালা পরিত্যাগ করার চল ছিল না। আসলে কোন শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য বিদ্যাসাগর এই অজুহাত দিচ্ছেন, তা আমরা পরবর্তী আলোচনাতে দেখতে পাব।
পাঠশালায় কম ছাত্র আসার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছন:
এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকশ্রেণিগুলির শিক্ষার চেষ্টা নিষ্প্রয়োজন। সরকার যদি জনশিক্ষা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখার কথা ভাবে, তাহলে সরকারকে অবৈতনিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কিছু লোক এই ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যদিও তার ফল সন্তোষজনক হয়নি।১০ [নজরটান সংযোজিত]
বিদ্যাসাগর তাঁর মডেল স্কুলে বেতন চালু করেছিলেন, তাঁর আমলে প্রতিষ্ঠিত একাধিক বালিকা বিদ্যালয়েও বেতন ব্যবস্থা চালু ছিল। অথচ কেবল এই শিক্ষাব্যবস্থায় অবৈতনিক প্রথার কথা বলেন তিনি, যদিও জমিদারদের ওপর শিক্ষা কর আরোপ করার প্রসঙ্গটি সুকৌশলে এড়িয়ে যান!
পরের অনুচ্ছেদে ইংল্যান্ডের সঙ্গে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনা করে তিনি জানান –
ইংল্যান্ডে ও আমাদের দেশে এমন একটি ধারণা জন্মেছে যে উচ্চশ্রেণির শিক্ষার জন্য যথেষ্ট করা হয়েছে, এখন জনসাধারণের শিক্ষার জন্য কিছু করা দরকার। স্পষ্ট বোঝা যায়, শিক্ষাসংক্রান্ত নানা প্রতিবেদন ও কার্যবিবরণে এই মতের অত্যন্ত অনুকূল চরিত্রের ফলেই এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে অনুসন্ধান করলে ভিন্ন অবস্থা দেখা যাবে।১১
যখন ইংল্যান্ডে ইটনের মতো স্কুলে প্রাথমিক স্তরে কেবল লেখা আর সামান্য হিসেবপত্র শেখানো হচ্ছে; ১৮৫১ সালের আগে যেখানে অঙ্ককে স্কুলের বাধ্যতামূলক পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না; সেখানে প্রায় একই সময়ে ইংল্যান্ডের প্রাথমিক স্কুলের কথা চিন্তা না করে বিদ্যাসাগর তাঁর মডেল স্কুলে পাঠ্য করছেন মাতৃভাষার মাধ্যমে লেখা-পড়া-অঙ্ক ছাড়াও ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞান। অথচ জনশিক্ষার প্রসঙ্গে হঠাৎই তাঁর ইংল্যান্ডের সঙ্গে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনা করার সাধ জাগে! তাই সরকার যাতে কোনও ভাবেই জনশিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রসর না হয়, সে বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করতেও তিনি চেষ্টার ত্রুটি রাখেন না!!
চিঠিটির শেষ অনুচ্ছেদে তিনি এ বিষয়ে তাঁর মনের গোপন বাসনাটি ব্যক্ত করে বলেন —
আমার বিনীত মতে, একমাত্র কার্যকর উপায় না হলেও বাংলায় শিক্ষাবিস্তারের শ্রেষ্ঠ উপায়, উচ্চশ্রেণির মধ্যে বিস্তৃত মাত্রায় শিক্ষা দেওয়ার মধ্যেই সরকারের নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। একশো জন ছেলেকে শুধু পড়তে, লিখতে ও কিছু অঙ্ক শেখানোর চেয়ে একটিমাত্র ছেলেকে যথাযথভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে, সরকার প্রকৃত জনশিক্ষার অভিমুখে অধিকতর সহায়তা করবেন। সমগ্র জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা নিশ্চয়ই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু কোনও সরকার সে কাজ গ্রহণ বা পূরণ করতে পারে কি না সন্দেহ। এও বলা যেতে পারে যে, ইংল্যান্ডে সভ্যতার উন্নত অবস্থা সত্ত্বেও শিক্ষা বিষয়ে সেখানকার জনসাধারণও তাদের এ দেশের ভাইদের চেয়ে কোনও অংশে ভালো নেই।১২ [নজরটান সংযোজিত]
সোজা কথায় – যেহেতু দেশের ‘সমগ্র জনগণকে’ শিক্ষিত করে তোলা ‘বাঞ্ছনীয়’ হলেও সে বাঞ্ছিত কাজটি কবে সম্পূর্ণ হতে পারে তার নিশ্চয়তা নেই, সেহেতু তত দিন পর্যন্ত সরকার উচ্চবর্ণ ও সম্পন্নশ্রেণির ছেলেদের জন্য শিক্ষাখাতে বরাদ্দ পুরো টাকাটাই ব্যয় করুক, তাহলেই কালক্রমে জনশিক্ষার কাজটি সম্পূর্ণ হবে!
বিদ্যাসাগরের এই মতকে তীব্র আক্রমণ করে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ লিখবেন,
শিক্ষার অভিসেচনক্রিয়া সমাজের উপরের স্তরকেই দুই-এক ইঞ্চি মাত্র ভিজিয়ে দেবে আর নীচের স্তরপরম্পরা নিত্যনীরস কাঠিন্যে সুদূরপ্রসারিত মরুময়তাকে ক্ষীণ আবরণে ঢাকা দিয়ে রাখবে, এমন চিত্তঘাতী সুগভীর মূর্খতাকে কোনো সভ্য সমাজ অলসভাবে মেনে নেয় নি। ভারতবর্ষকে মানতে বাধ্য করেছে আমাদের যে নির্মম ভাগ্য তাকে শতবার ধিক্কার দিই।১৩
মডেল স্কুল শুরু হওয়ার তিন বছর পরে, স্কুলগুলি সম্পর্কে ১৮৫৭-৫৮ সালের একটি রিপোর্টে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন:
আমরা এই কাজ আরম্ভ করার সময়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, মফস্সলের লোকেরা মডেল স্কুলের মর্ম বুঝতে পারবে না। কিন্তু স্কুলগুলির সাফল্য সেই সন্দেহ দূর করেছে। যে সব গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই সব গ্রামের ও তার আশপাশের গ্রামবাসীরা স্কুলগুলিকে আশীর্বাদ বলে মনে করেন এবং তার জন্য তাঁরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। স্কুলগুলির যে যথেষ্ট সমাদর হয়েছে, ছাত্রসংখ্যা দেখলে তা পরিষ্কার বোঝা যায়।১৪
বিদ্যাসাগরের নিজের রিপোর্ট থেকেই বোঝা যায়, বাংলায় জনশিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ একেবারে ব্যর্থ হওয়ার মতো বিষয় ছিল না। অথচ সরকার যখন নিম্নশ্রেণিভুক্ত জনগণের শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে প্রস্তুত, তখন তিনি সুস্পষ্টভাবে তার বিরোধিতা করেন।
শিক্ষার সাঙ্গীকরণ প্রবন্ধটি লেখার অনেক আগে ১৯০৫ সালে (১৩১২ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন —
...যে-চাষা তাহার ছেলেকে প্রাইমারি স্কুলে পাঠায়, তাহার একটিমাত্র উদ্দেশ্য এই যে, তাহার ছেলে নিতান্ত চাষা না থাকিয়া কিঞ্চিৎপরিমাণে ভদ্রসমাজ-ঘেঁষা হইবার যোগ্য হয়; চিঠিটা পত্রটা লিখিতে পারে, পড়িতেও পারে, জমিদারের কাছারিতে দাঁড়াইয়া কতকটা ভদ্রছাঁদে মোক্তারি করিতে পারে, গ্রামের মোড়লি করিবার যোগ্য হয়, ভদ্রলোকের মুখে শুনিতে পায় যে, “তাইতো রে, তোর ছেলেটা তো বলিতে-কহিতে বেশ”!
চাষা একটু সম্পন্ন অবস্থার হইলেই ভদ্রসমাজের সীমানার দিকে অগ্রসর হইয়া বসিতে তাহার স্বভাবতই ইচ্ছা হয়। এমন-কি, তাহার ছেলে একদিন হাল-লাঙল ছাড়িয়া দিয়া বাবুর চালে চলিবে এ সাধও তাহার মনে উদয় হইতে থাকে। এইজন্য সময় নষ্ট করিয়াও, নিজের ক্ষতি করিয়াও ছেলেকে সে পাঠশালায় পাঠায় অথবা নিজের আঙিনায় পাঠশালার পত্তন করে।
কিন্তু চাষাকে যদি বলা হয়, তোর ছেলেকে তুই চাষার পাঠশালায় পাঠাইবি, ভদ্রের পাঠশালায় নয়, তবে তাহার উৎসাহের কারণ কিছুই থাকিবে না। এরূপ স্থলে ছেলেকে পাঠশালায় পাঠাইবার উদ্দেশ্যই তাহার পক্ষে ব্যর্থ হইবে।
শুধু তাই নয়। পল্লীর মধ্যে চাষার পাঠশালাটা চাষার পক্ষে একটা লজ্জার বিষয় হইয়া দাঁড়াইবে। কালক্রমে ভাগ্যক্রমে যে-চাষাত্ব হইতে তাহারা উপরে উঠিবার আশা রাখে, সেইটাকে বিধিমতো উপায়ে স্থায়ী করিবার আয়োজনে, আর যেই হউক, চাষা খুশি হইবে না।১৫
বিদ্যাসাগর কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে এই বিভাজনের পক্ষেই সওয়াল করেন। ১৮৫৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাসংক্রান্ত প্রস্তাবের প্রথম অনুচ্ছেদেই তিনি লেখেন:
সুবিস্তৃত ও সুব্যবস্থিত মাতৃভাষা শিক্ষা একান্ত বাঞ্ছনীয়; কারণ কেবল তার সাহায্যেই জনসাধারণের উন্নতি সম্ভব।১৬ [নজরটান সংযোজিত]
অথচ তার মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে তিনি বলেন,
বাংলায় শিক্ষাবিস্তারের শ্রেষ্ঠ উপায়, উচ্চশ্রেণির মধ্যে বিস্তৃত মাত্রায় শিক্ষা দেওয়ার মধ্যেই সরকারের নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা।১৭
তবে বিদ্যাসাগরের পূর্বোদ্ধৃত প্রস্তাবে ‘জনসাধারণের উন্নতি’ কথাগুলি কী অর্থ বহন করে? আসলে তিনি কাদের হয়ে এই ওকালতি করেন, তা স্পষ্ট হয়ে যায় পরবর্তী বছরগুলিতেই।
সরকার জনশিক্ষার বিষয়ে বিদ্যাসাগরের পরামর্শকে অগ্রাহ্য করে। ওই বছরে অর্থাৎ ১৮৫৯ সালে, ভারত সরকারের সচিব স্ট্যালি (Staley) প্রাথমিক শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করার জন্য স্থানীয় স্তরে কর আদায় করার নির্দেশ জারি করেন। অবশেষে ১৮৬৪ থেকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে কর আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮৬৬-৬৭ নাগাদ দেখা যায়, ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের মধ্যে বাংলাতেই শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। এই বিষয়ে সরকারি প্রতিবেদনে লেখা হয় —
On the one hand we find a comparatively small number of students being instructed, mainly at Government expense, in the languages and the philosophy of the West and engaged in the pursuit of University distinctions; side by side are schools for the masses, receiving no aid from Government, where the pupils are taught to scratch letters in the dust….১৮
এই বৈষম্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির জন্য বাংলায় যেখানে খরচ হয় মাত্র ১.০৩ লক্ষ টাকা; সেখানে বোম্বে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশসমূহ ও পাঞ্জাবে খরচ হয় যথাক্রমে ৩.৯৩, ৩.৩৭ ও ১.৬৭ লক্ষ টাকা।
১৮৬৭-র ২৪ অগস্ট, রেভারেন্ড লং বড়লাট জন লরেন্স (কার্যকাল: জানুয়ারি ১৮৬৪-জানুয়ারি ১৮৬৯)-এর কাছে লেখা চিঠিতে শিক্ষাসংক্রান্ত নানা প্রস্তাব পাঠান। তিনি লেখেন, দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রসারের ব্যবস্থা না করা হলে বৃহৎ সংখ্যক কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ চিরদিনই অজ্ঞানের অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকবেন। বাংলার জমিদার ও শিক্ষিত ব্যক্তিরা যে কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে শিক্ষাপ্রসারের চিরবিরোধী, তা লক্ষ করে তিনি বলেন:
After a quarter of a century’s residence in Bengal, I have known but rare cases where either Zemindars or educated natives would do anything to raise the Bengal ryot to the status of a ‘man and a brother’.১৯
এই অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করার জন্য তিনি সরকারকে জনশিক্ষায় আরও অর্থ ব্যয় করার এবং জমিদারদের ওপর প্রয়োজনমতো শিক্ষা কর বসিয়ে অর্থসংগ্রহের অনুরোধ করেন।২০ যদিও উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাম্মানিক সম্পাদক যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ জমিদার ও শিক্ষিত ব্যক্তি লঙের প্রস্তাবের চূড়ান্ত বিরোধিতা করেন। প্রসঙ্গত জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বহুবিবাহপ্রথা সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য নিযুক্ত তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ডের অন্যতম ট্রাস্টি ছিলেন এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্র ছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র অন্যতম গ্রন্থাধ্যক্ষ। এই ব্যক্তিদের পরিচয় থেকে এ কথা স্পষ্ট বোঝা যায়, বিদ্যাসাগর আসলে কোন শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য জনশিক্ষার বিরোধিতা করেন।
১৮৬৮ সালের ২৮ এপ্রিল ভারত সরকারের সচিব বেইলি লেখেন, ১৮৬৬-৬৭-তে বাংলায় যেখানে জনসংখ্যা চার কোটির বেশি সেখানে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বুনিয়াদি স্তরের বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ৩৯,১০৪টি; অথচ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এই সংখ্যা ১,২৫,৯৩৪টি (জনসংখ্যা ৩ কোটির কম), বোম্বাইতে (জনসংখ্যা ১.৬ কোটি) ৭৯,১৮৯টি এবং পাঞ্জাবে (জনসংখ্যা ৮৫ লাখ) এই ধরণের স্কুলের সংখ্যা ২২,৬০০।২১ অবশেষে রোগের কারণ হিসেবে ধরা পড়ে –
In the North-Western Provinces, in the Punjab, and in Oude, the proprietors of land pay on this account a tax amounting to one per cent, on the Government demand. They pay the same in the permanently-settled districts of the Benares Division. In the Central Provinces they pay two per cent. In Madras the rate may be as much as 3 1/8 per cent. In Bombay, assuming that one-half of the cess lately imposed is devoted to roads, the proprietors of land pay at the rate of 3 1/8 per cent. In Bengal they pay nothing, although there is no part of India in which the means of the landholders are so large, in which the construction of roads and other works of local improvement is more urgently required, or in which such works have hitherto made so little progress.২২ [নজরটান সংযোজিত]
বাংলায় জনশিক্ষা প্রসারের বিষয়ে যুগপৎ বিদ্যাসাগর ও বাংলার জমিদারদের সংকীর্ণ শ্রেণিস্বার্থের দৃষ্টিভঙ্গি, এই তথ্যটি থেকে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে ১৮৬৮-র ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বেথুন সোসাইটির দ্বিতীয় অধিবেশনে, শিক্ষাক্ষেত্রে মেকলের ‘ডাউনওয়ার্ড ফিলট্রেশন’ নীতিকে সমর্থন করেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ, বিশেষত কিশোরীচাঁদ মিত্র। ওই সভায় উচ্চবর্ণের মানুষদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রথম আঙুল তোলেন লালবিহারি দে। তিনি মেকলীয় ‘ওপর থেকে চুঁইয়ে পড়া’ নীতির বিরোধিতা করেন এবং বাধ্যতামূলক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার দাবি জানান। এ বিষয়ে সোমপ্রকাশ পত্রিকায় লেখা হয় —
তিনি [লালবিহারি দে] অনুমান করেন, বাঙ্গলাদেশে ৪০০০০০০০ লোকের বসতি, প্রতি ১০০০ লোকের নিমিত্ত এক একটী বিদ্যালয় আবশ্যক। এ নিয়মে ৪০০০০ বিদ্যালয় করা কর্তব্য। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে মাসিক ব্যয় ১০ টাকার হিসাব ধরিলে ৪৮ লক্ষ টাকা হয়, তত্ত্বাবধানের ব্যয় ৩ লক্ষ, ৮০টি নর্মাল স্কুলে ৩ লক্ষ, ৮০টী প্রাইমারি হাই স্কুলে ৩ লক্ষ এবং গৃহ সংস্কারাদির নিমিত্ত ৩ লক্ষ সমুদায়ে ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়।২৩
অধিবেশনে লালবিহারি দে এই ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয়ের বিষয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানেরও প্রস্তাব রাখেন। তাঁর মতে, ছাত্রছাত্রীদের মাথা পিছু এক আনা বেতন ধরা হলে আয় হবে ১০ লক্ষ টাকা। এছাড়া লবণের ওপর কর বাবদ ২২ লক্ষ টাকা ও জমিদারদের ওপর শিক্ষা কর ধার্য করে ৭ লক্ষ টাকা আয় হতে পারে। বাকি ২১ লক্ষ টাকা সরকারি তহবিল থেকে দিতে হবে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবর্গ, বিশেষত বাংলার জমিদাররা এই শিক্ষা কর প্রবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করেন।
শিক্ষা কর চালু করে জনশিক্ষা প্রসারের পরিবর্তে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সরকারি টাকার সিংহভাগ কেবল ইংরেজি শিক্ষায় ব্যয় করার জন্য, ১৮৭০ সালের ২ জুলাই কলকাতার টাউন হলে এক বিশাল সভার আয়োজন করা হয়। ওই সভায় উপস্থিত রাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ বাহাদুর শিক্ষাক্ষেত্রকে উচ্চবিত্ত শ্রেণির কুক্ষিগত করার বাসনায় নিখাদ মেকলীয় সুরের অনুবৃত্তি করে বলেন:
...ইংরাজি শিক্ষাদানে দেশবাসী ও গবর্ণমেন্ট উভয়েরই মঙ্গল। এদেশীয়েরা সুশিক্ষিত হইলে শাসনকার্যে ব্যয় অনেক অল্প হইবে। যে টাকায় এদেশীয় কর্মচারীগণ কাজ করেন, সেই প্রকার গুণবিশিষ্ট ইউরোপীয় কর্মচারী আনিতে অনেক ব্যয় পড়িবে।২৪
তাঁকে সমর্থন করে ২৪ পরগণার জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ব্রডলি বলেন,
উচ্চতর শিক্ষা নিবন্ধন আমরা উপযুক্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও সদ্বক্তা উকিল পাইয়াছি, এ লাভ সামান্য নহে। বঙ্গদেশে যে মত ইংরাজীর আদর এমত কুত্রাপি নাই।২৫
এই মতকেই সমর্থন করেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র, কিশোরীচাঁদ মিত্র, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির লাগাতার বিরোধিতার কারণে, বাংলায় জনশিক্ষা বিস্তারের প্রসঙ্গটি ক্রমশ অবহেলিত থাকে।
এমনকি ১৮৭০-৭১-এও বাংলাতে যে এই পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তনই হয়নি, তার উল্লেখ করে শিক্ষাসংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয় —
In Bengal the amount spent on lower class boys’ schools represents a percentage of six on the educational fund, in the North-West the percentage is twenty-one, and in the Central Provinces forty-one. And yet the educational code is equally applicable to all provinces alike, as also are the orders of the Home Government of 1862 and 1864 and the more recent orders of 1870, which declare that the bulk of imperial expenditure should be mainly directed to the provision of an elementary education for the mass of the people.২৬
বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে এই ন্যক্কারজনক বৈষম্যের কারণ হিসেবে জানানো হয়:
In no province do the statistics of primary schools seem so inconsistent with the declaration “that Government expenditure should be mainly directed to the provision of elementary education for the mass of the people” as in Bengal.২৭
সরকার ইংরেজি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ অর্থ কাটছাঁট করে জনশিক্ষার বিস্তারে ব্যয় করতে উদগ্রীব – হিন্দু জমিদারশ্রেণির এই উচ্চগ্রামের প্রচার প্রকৃতপক্ষে কতটা অসার ছিল, তা অ্যাডামের প্রতিবেদনে চোখ বোলালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিবেদনের ভূমিকায় লং লেখেন –
In Bengal, at least, the Government cannot be charged with having done too little for the encouragement of the higher branches of education. The expenditure, in 1866-67, on Government and Aided Schools, mostly of a superior class, was nearly £250,000 of which more than £150,000 was contributed by the State.২৮
বোঝা যায়, কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির মানুষদের শিক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষা কর দেওয়ার বিষয়ে জোরালো আপত্তি থাকলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অর্থে পরিপুষ্ট এই খয়ের খাঁ ভদ্রলোক শ্রেণি নিজেদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থব্যয় করতে কোনও সময়েই ব্যয়কুণ্ঠ মনোভাব প্রদর্শন করেনি।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার ফলে অধিকাংশ মুসলিম জমিদার-জায়গিরদারদের প্রাধান্যের অবসান ঘটে। একই সঙ্গে বাংলার যে লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রজা ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হতে বাধ্য হন, তার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিলেন মুসলমানরাই। অন্যদিকে নতুন জমিদারদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু এবং এই হিন্দু জমিদার-মধ্যস্বত্বভোগীরাই সদ্য-প্রবর্তিত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অধিকতর চাকরি ও সুযোগসুবিধা দখল করে নেয়। ১৮৭১ সালে হান্টার (W.W. Hunter) সাহেব The Indian Musalmans গ্রন্থে দেখান – ১৮৭১-এ বাংলার সমস্ত বিভাগের ২,১১১ জন গেজেটেড অফিসারের মধ্যে ১,৩৩৮ জন ইউরোপীয়, ৬৮১ জন হিন্দু এবং মুসলমান মাত্র ৯২ জন।২৯ এই হিসেব দাখিল করে তিনি মন্তব্য করেন:
A hundred years ago, the Musalmans monopolized all the important offices of State … and, in fact, there is now scarcely a Government office in Calcutta in which a Muhammadan can hope for any post above the rank of porter, messenger, filler of ink-pots and mender of pens. … the Muhammadans are now shut out equally from Government employ and from the higher occupations of non-official life.৩০
পাশাপাশি ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার দেখান – ১৮৫৮ থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১,৭২০ জন গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে মাত্র ৩৮ জন মুসলমান; এমনকি ১৯০৬ সালেও পূর্ববঙ্গের ১৪টি জেলার বাংলার মোট জনসংখ্যার ৬৫.৮৫ শতাংশ এবং শিক্ষিতদের ৪১.১৩ শতাংশ মুসলমান মাত্র ১৫.৫ শতাংশ সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত হন।৩১ ফলে একদিকে সরকারি চাকরি ও অন্যদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে বিপুল বৈষম্যের সৃষ্টি হয়।
এই ভয়ানক বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য, ১৮৭১-এর ৭ অগস্ট লর্ড মেয়ো (কার্যকাল: জানুয়ারি ১৮৬৯-ফেব্রুয়ারি ১৮৭২) সমস্ত প্রাদেশিক সরকারকে ভারতীয় মুসলমান সমাজের শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। তদন্তের পরে বাংলার ছোটলাট মন্তব্য করেন —
আমার ভয় হয়, আমরা মুসলমানদের প্রতি শিক্ষার দিক দিয়ে সুবিচার করিনি। আমি বার্নাডের ‘নোট’ থেকে যেটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, তাতে দেখছি, শিক্ষাবিভাগের ইন্সপেক্টিং এজেন্সিতে একজনও মুসলমান কর্মচারী নেই। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে একজনও মুসলমান আছেন কি না সন্দেহ। বাংলার সরকারি শিক্ষাবিভাগ হিন্দুদের বিভাগ বললেও ভুল হয় না। ওপর স্তর থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত সমস্ত চাকরিগুলি হিন্দুদের একচেটিয়া দখলে।৩২
শিক্ষাক্ষেত্রের সমস্ত সরকারি অর্থবরাদ্দ যথাসম্ভব পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নিংড়ে নিয়ে সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য, ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দু জমিদার শ্রেণির প্রতিভূদের প্রবল শ্রেণিস্বার্থ প্রকট থেকে প্রকটতর হতে থাকে।
এই মনোভাবের তীব্র বিরোধিতা করে অ্যাডাম বলেছিলেন:
To make the superstructure lofty and firm, the foundation should be broad and deep; and, thus building from the foundation, all classes of institutions and every grade of instruction may be combined with harmonious and salutary effect.৩৩
তবুও ভারতবর্ষের বড়লাট কিংবা ভাইসরয়রা শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের পূর্বসূরীদের গৃহীত নীতিসমূহের কোনও পরিবর্তন করেননি। এই প্রথম লর্ড মেয়ো প্রচলিত শিক্ষানীতির পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হন। তাঁর আমলেই প্রথম মেকলের ফিলট্রেশন নীতি থেকে সরে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে মেয়ো স্পষ্ট বলেন –
আমি এই ‘ফিলট্রেশন’ নীতি অপছন্দ করি। বাংলায় আমরা বিপুল সরকারি খরচে অল্পসংখ্যক বাবুকে ইংরেজি শিক্ষা দিচ্ছি। এদের অনেকেই নিজের খরচে এই শিক্ষা নিতে পারে। এরা সরকারি চাকরির যোগ্য হওয়ার জন্য বিবেচিত হওয়া ছাড়া আর অন্য কিছুর জন্য এই শিক্ষা নিচ্ছে না। ইতিমধ্যে অগণিত জনগণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য আমরা কিছুই করিনি। বাবুরা কখনই এটা করবে না। যতই এদের শিক্ষা দাও, এরা ততই তা নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ রাখবে এবং অতিরিক্ত শিক্ষাকে এরা অত্যাচারের কাজে লাগাবে। বাবুরা যেভাবে খুশি ইংরেজি শিখুক। আমরা গ্রামবাংলায় লেখা, পড়া আর অঙ্ক শেখার কিছু ব্যবস্থাই না হয় করি।৩৪
বাংলার ছোটলাট হিসেবে ক্যাম্পবেল (George Campbell) দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে, বাংলার সরকারি শিক্ষানীতিতে বিপুল পরিবর্তন শুরু হয়।
জনশিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি কম খরচে বহু সংখ্যক প্রাথমিক স্কুল খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সরকারি টাকা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করার নীতি সাব্যস্ত করেন। তাঁর অনুসৃত নীতিতে বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে মাত্র চার বছরের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা যায়। হান্টার জানাচ্ছেন:
In 1870-71 the Department of Public Instruction was educating 163,854 children in Lower Bengal at a cost of £186,598 to the State. In 1874, when Sir George Campbell laid down the Lieutenant-Governorship, he left 400,721 children being educated at a cost to Government of £228,151. He had, in the interval, covered Bengal with primary schools; pieced together and resuscitated the old indigenous mechanism of rural instruction, and, without in any essential feature curtailing high-class education, created a bona fide system of public instruction for the people of the country.৩৫
যদিও ক্যাম্পবেলের এই কাজকর্মে বাংলার ‘বাবু’ সমাজে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। তাঁরা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শহরে শহরে সভা করে ক্যাম্পবেলের শিক্ষানীতির বিরোধিতা করা শুরু করেন। উচ্চবর্ণের প্রবল আন্দোলনের ফলে ক্যাম্পবেল বাংলা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। তার আগে আন্দামানে নিহত হন মেয়ো। ফলে আবারও শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ সরকারি অর্থের অধিকাংশ, উচ্চবর্ণের জন্য নির্দিষ্ট উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যেতে থাকে।
বাংলায় সরকারি শিক্ষানীতি দিয়ে নিয়ে তুমুল বিতর্ক ও উত্তেজনা চলাকালীন বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন —
...ইহা স্মরণ করিতে হইবে যে, সকল মনুষ্যেরই শিক্ষায় সমান অধিকার। শিক্ষায় ধনীর পুত্রের যে অধিকার, কৃষকপুত্রের সেই অধিকার। রাজকোষ হইতে ধনীদিগের শিক্ষার জন্য অধিক অর্থব্যয় হউক, নির্ধনদিগের শিক্ষায় অল্প ব্যয় হউক, ইহা ন্যায়বিগর্হিত কথা। বরং নির্ধনদিগের শিক্ষার্থ অধিক ব্যয়, এবং ধনীদিগের শিক্ষার্থ অল্প ব্যয়ই ন্যায়সঙ্গত; কেন না ধনীগণ আপন ব্যয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইতে পারে, কিন্তু নির্ধনগণ, সংখ্যায় অধিক, এবং রাজকোষ ভিন্ন অনন্যগতি। কিন্তু ভারতবর্ষীয় ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট পূর্বাপর শিক্ষার্থে যে প্রণালীতে ব্যয় করিয়া আসিয়াছেন, তাহা ন্যায়ানুমোদিত নহে। ধনীর শিক্ষার্থই সে ব্যয় হইয়া আসিতেছে; দরিদ্রের শিক্ষার্থ প্রায় নহে। যখন ইন্ডিয়ান গবর্ণমেণ্ট হইতে এ প্রথা পরিবর্তন করিয়া, ধনীর শিক্ষার ব্যয়ের লাঘব করিয়া, দরিদ্র শিক্ষার ব্যয় বাড়াইবার প্রস্তাব হইয়াছিল, তখন সর্ উইলিয়ম গ্রে “উচ্চশিক্ষা! উচ্চশিক্ষা!” করিয়া সে প্রস্তাবের প্রতিবাদ করিয়া, দেশের লোকের প্রিয় হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু দেশের মঙ্গল করেন নাই। যদি উচ্চশিক্ষার ব্যয় হইতে কিছু টাকা লইয়া তাহা দরিদ্রশিক্ষায় ব্যয় করিবার জন্য সর্ জর্জ কাম্বেল উচ্চশিক্ষার ব্যয় কমাইয়া থাকেন, তবে আমরা তাঁহার নিন্দা করিতে পারি না।৩৬
১৮৫৯-এর ২৯ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে রিভার টমসনকে তাঁর চিঠি লেখার পর থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে এত কিছু ঘটে। কিন্তু এই ষোলো বছরে দরিদ্র নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানদের জনশিক্ষার প্রসঙ্গে এত বিতর্কের মধ্যে ‘শিক্ষাসংস্কারক’ বিদ্যাসাগরের কণ্ঠ নীরব থাকে।
এই প্রসঙ্গে দরিদ্র অন্ত্যজ হিন্দুদের শিক্ষাবিস্তার সম্পর্কে ‘মতুয়া’ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৭)-এর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরের উল্লেখ করা অত্যন্ত জরুরি। গুরুচাঁদ ঠাকুর ১৮৪৭ সালে ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার ওড়াকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। কেবল নমঃশূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণের ‘অপরাধে’ তিনি উচ্চবর্ণের জন্য নির্দিষ্ট বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। ফলে তিনি ওড়াকান্দির এক মক্তবে ভর্তি হন এবং আরবি ও ফারসি অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। নমঃশূদ্র জাতি সম্পর্কে ১৮৭২-এর জনগণনায় জানা যায়:
Chandals or Charals aggregate upwards of a million and a half. This was the great sweeper caste to which were doubtless consigned the great bulk of the aboriginal tribes who embraced Hinduism in Bengal. They are most numerous in the Eastern districts of Jessore, Furreedpore, Backergunge, Dacca, Mymensingh, and Sylhet.৩৭
এই বিপুল সংখ্যক ‘চণ্ডাল’দের অধিকাংশই ছিলেন দরিদ্র ভূমিহীন কৃষিজীবী। উচ্চবর্ণের জমিদার ও মহাজনরা এই নিরক্ষর কৃষকদের খাজনা, ঋণ এবং দৈনন্দিন ব্যবসার বিষয়ে প্রতারণা করতেন। গুরুচাঁদ উপলব্ধি করেন, এই নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নমঃশূদ্র সমাজের আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য শিক্ষাবিস্তারই একমাত্র উপায়।
অবশেষে যাবতীয় বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে ১৮৮০ সালে গুরুচাঁদ নিজের বাড়িতে প্রথম পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার পণ্ডিত রঘুনাথ সরকার ছিলেন এই ওড়াকান্দি পাঠশালার প্রথম শিক্ষক। পরের বছরে গুরুচাঁদের সভাপতিত্বে খুলনার দত্তডাঙায় নিখিল বঙ্গ নমঃশূদ্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে বহুসংখ্যক নমঃশূদ্রের উপস্থিতিতে শিক্ষা সংক্রান্ত কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় মূলত দরিদ্র নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের জন্য একের পর এক পাঠশালা, প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নিম্ন ও উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। মহানন্দ হালদার শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত-এ লিখছেন –
শিক্ষা আন্দোলন যবে প্রভু করে দেশে।
ভকত সুজন যত তার কাছে আসে।।
নমঃশূদ্র তেলী মালী আর কুম্ভকার।
কপালী মাহিষ্য দাস চামার কামার।।
পোদ আসে তাঁতী আসে আসে মালাকার।
কতই মুসলমান ঠিক নাহি তার।।৩৮
‘দ্বাদশ রুদ্র’ নামে পরিচিত গুরুচাঁদের ১২ জন সহচর – দেবীচাঁদ, গোপাল সাধু, যাদব ঢালী, রাধা খ্যাপা, যাদব বিশ্বাস, অশ্বিনী গোঁসাই, হরিবর সরকার, হরি পাল, রমণী গোঁসাই, নকুল গোঁসাই, বিপিন গোঁসাই ও বিচরণ পাগল – গুরুচাঁদের নির্দেশ মতো মতুয়া ভক্তদের বাড়িতে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্ত নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে শিক্ষার উপযোগিতা ব্যাখ্যা করা শুরু করেন।
পরবর্তীকালে গুরুচাঁদ ঠাকুরের পথ ধরে বাংলার বিভিন্ন জেলার অনুন্নত সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের কাজে যাঁরা নিজেদের নিঃস্বার্থ সমর্পণ করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন — খুলনার সীতারাম মণ্ডল, রাইচরণ বিশ্বাস, মুকুন্দবিহারী মল্লিক, নীরদ মল্লিক ও পুলিন মল্লিক; বরিশালের ভেগাই হালদার, মাধব বিশ্বাস, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ও জিতেন্দ্রনাথ তালুকদার; ফরিদপুরের যজ্ঞেশ্বর মণ্ডল, বিরাটচন্দ্র মণ্ডল, কামিনী মজুমদার, মনোহর ঢালী ও দ্বারিকানাথ বারুরী; যশোহর জেলার রসিকলাল বিশ্বাস, উপেন্দ্রনাথ মল্লিক ও সন্তোষকুমার মল্লিক; ঢাকার মাধবচন্দ্র সরকার, রমেশচন্দ্র মণ্ডল এবং ময়মনসিংহের গয়ানাথ বিশ্বাস প্রমুখ।৩৯
১৯০২ সালে ঢাকায় গঠিত ‘নমঃশূদ্র হিতৈষিণী সমিতি’-র বহুমুখী কর্মধারার অন্যতম উল্লেখযোগ্য কর্মসূচী ছিল ‘মুষ্টিভিক্ষা তণ্ডুল’।৪০ সমিতির সদস্যরা গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের কাছে প্রতিদিন দু-বেলা রান্নার আগে নির্দিষ্ট চাল থেকে এক মুঠো চাল আলাদা করে রেখে দেওয়ার জন্য প্রচার করতেন। মাসান্তে সমিতির সদস্যরা সেই চাল একত্রিত করে বিক্রি করতেন। বিক্রিলব্ধ অর্থ শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ – স্কুলবাড়ি তৈরি, স্কুলের আসবাবপত্র, স্কুলের শিক্ষকদের বেতন, দরিদ্র ছাত্রদের খাতা কেনার জন্য অর্থ দান – ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হত। এই সময়ে ১৯০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট মিশনারি মিড (Dr C. S. Mead) সাহেবের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ওড়াকান্দির পাঠশালাটি মিডল ইংলিশ স্কুলে পরিণত হয়। গবেষক অতুল চন্দ্র প্রধান বলেছেন, ১৯৩১ সাল পর্যন্ত গুরুচাঁদ তাঁর অনুগামীদের সহায়তায় অন্ত্যজ শ্রেণির সন্তানদের জন্য প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে ৫৬৯টি, বর্ধমান ডিভিশনে আদিবাসীদের জন্য ২৪৬টি এবং ঢাকা ডিভিশনে ১০৬৭টি পাঠশালা, নিম্ন প্রাইমারি, উচ্চ প্রাইমারি, মিডল স্কুল এবং হাইস্কুল মিলিয়ে মোট ১৮৮২টি স্কুল স্থাপন করেন।৪১
জনশিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের এই বিপুল উদ্যোগের সামান্য আগে-পরের সময়কালে, সমস্ত শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিদ্যাসাগর নিজস্ব ‘কেরানি গড়ার কল’ মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন তৈরিতে ব্যস্ত! ১৮৫৯ সালে উত্তর কলকাতার শঙ্কর ঘোষ লেনে ঠাকুরদাস চক্রবর্তী, মাধবচন্দ্র ধাড়া, পতিতপাবন সেন, গঙ্গাচরণ সেন, যাদবচন্দ্র পালিত ও বৈষ্ণবচরণ আঢ্যর উদ্যমে ও আর্থিক সহায়তায় ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি বিদ্যালয় গড়ে তোলা, যেখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের হিন্দু ছেলেরা অপেক্ষাকৃত অল্প খরচে ইংরেজি শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেতে পারে। প্রথমে প্রতিষ্ঠাতারাই স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন। কিছু দিন পরে তাঁরা বিদ্যাসাগর ও তাঁর বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সে বিষয়ে তাঁদের সাহায্য করার অনুরোধ করলে বিদ্যাসাগর সেই প্রস্তাবে সম্মত হন। তাঁদের দুজনকে নতুন পরিচালন সমিতির অন্তর্ভুক্ত করে ১৮৬১-র মার্চ পর্যন্ত স্কুলটি পরিচালিত হতে থাকে।
এই সময়ে পরিচালন সমিতির সঙ্গে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ঠাকুরদাস চক্রবতী ও মাধবচন্দ্র ধাড়ার মতবিরোধ হয় এবং সমিতির সদস্যপদ ত্যাগ করে তাঁরা ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি’ নামে একটি নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই পরিস্থিতিতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা বিদ্যাসাগরের ওপর স্কুল পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পরে, বিদ্যাসাগর রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রমানাথ ঠাকুর, হীরালাল শীল, রামগোপাল ঘোষ ও হরচন্দ্র ঘোষকে নিয়ে এক নতুন পরিচালন সমিতি গঠন করেন। সমিতির সভাপতি হন রাজা প্রতাপচন্দ্র, সম্পাদক হন বিদ্যাসাগর। ১৮৬৪ সালে স্কুলটির নতুন নাম হয় ‘হিন্দু মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন’।
ওই বছরেই বি. এ পর্যন্ত পড়ানোর অনুমোদনের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করা হলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৮৬৬-তে প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ১৮৬৮-তে হরচন্দ্র ঘোষের মৃত্যুর পরে এবং বাকি তিনজন সদস্য পদত্যাগ করার ফলে, স্কুলটির সমস্ত দায়িত্ব বিদ্যাসাগরের একার ওপর পড়ে। এমতাবস্থায় ১৮৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি কৃষ্ণদাস পাল ও দ্বারকানাথ মিত্রকে নিয়ে বিদ্যাসাগর নতুন একটি কমিটি গঠন করেন এবং স্কুলটিতে এফ. এ পর্যন্ত পড়ানোর অনুমোদন চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করেন। আবেদন ফের নামঞ্জুর হতে পারে ভেবে তিনি ওই দিনই সিন্ডিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য বেলি (E.C. Bayley) সাহেবকে সমস্ত বিষয় জানিয়ে তাঁর সমর্থন লাভের আশায় লেখেন –
The high rate of schooling charged at the Presidency College is prohibitory to many middle class youths, while their parents being opposed to their boys being sent to Missionary Colleges, they are obliged to give up academic education after matriculation. This Institution would be a great boon to them.৪২
১৮৭২ সালেও ‘সমাজসংস্কারক’ বিদ্যাসাগর অভিভাবকদের মিশনারি কলেজে ছেলেদের ভর্তি না করার বিষয়ে কোনও প্রতিবাদ তো করছেনই না, বরং ওই কলেজগুলোর থেকে বেতনহার সামান্য কমিয়ে একটি বেসরকারি কলেজ খুলতে চাইছেন কেবল ‘হিন্দু’ ছেলেদের জন্য! যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদন চাওয়ার সময়ে সুকৌশলে কলেজটির নাম থেকে ‘হিন্দু’ শব্দটি বাদ দেন তিনি!! ওই বছরে বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রোপলিটনকে এফ. এ পড়ানোর অনুমতি দেয়। ১৮৮১ সালে বি. এ পরীক্ষার জন্য সর্বপ্রথম ছাত্র পাঠানো হয়, পরের বছরে কলেজে ‘ল’ ক্লাস খোলা হয় এবং ১৮৮৩, ১৮৮৫ ও ১৮৮৬ সালের পরীক্ষায় মেট্রোপলিটনের ছাত্ররাই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। কলেজের ছাত্রদের পরীক্ষার ফল দেখে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সাটক্লিফ সাহেব মন্তব্য করেন: ‘The Pundit has done wonders’।
সাটক্লিফের এই আপাত প্রশংসাবাক্য আদতে গভীর দ্যোতনাবাহী। এই একটি ঘটনাতেই ধূর্ত ইংরেজরা বুঝে যায় যে, তাদের অবর্তমানেও দেশীয় লোকদের উদ্যম ও উৎসাহে এ দেশে ইংরেজি শিক্ষা পুরোদমে প্রচলিত থাকবে; ঔপনিবেশিক পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচিই বিদ্যমান থাকবে; শিক্ষাক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের একচেটিয়া প্রাধান্য বজায় থাকবে এবং ‘বাংলাদেশে গোপালের মতো সুবোধ ছেলেগুলি পাস করিয়া ভালো চাকরি-বাকরি ও বিবাহকালে প্রচুর পণ লাভ’ করার উদ্দেশ্যে সেই শিক্ষাকেই ‘প্রকৃত’ শিক্ষারূপে বিবেচনা করবে চিরকাল। এই অন্তঃসারশূন্য ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় সচেতন হয়ে বিদ্যাসাগর স্বয়ং বলেছিলেন —
তাই বলি পূর্ণচন্দ্র, আমাদের যে-সব ছেলে আছে, তাদের কাছ থেকে আমরা মাহিনা নিই, পাঙ্খা ফি নিই, একজামিনেশন ফি নিই, নিয়ে কলের দোর খুলি, – দেখাইয়া দিই এইখানে মাষ্টার আছে, এইখানে পণ্ডিত আছে, এইখানে বই আছে, এইখানে বেঞ্চি আছে, এইখানে চেয়ার আছে, এইখানে কালি কলম দোয়াত পেন্সিল সিলেট সবই আছে। বলিয়া তাহাদের কলের ভেতর ফেলিয়া দিয়া চাবি ঘুরাইয়া দিই। কিছুকাল পরে কলে তৈয়ারী হইয়া তাহারা কেহ সেকেন ক্লাস দিয়া, কেহ এন্ট্রেন্স হইয়া, কেহ এল্.এ হইয়া, কেহ বি.এ হইয়া, কেহ বা এম্.এ হইয়া বেরোয়। কিন্তু সবাই লেখে I has; একপাকের তৈরি কি না!৪৩
অথচ তিনিই উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার এই অসারতাকে মেনে নিয়ে, তারই শ্রীবৃদ্ধিসাধনে আত্মনিয়োগ করেন।
ইংরেজি শিক্ষার অন্তঃসারশূন্যতা উপলব্ধি করে হিন্দু কলেজের ছাত্র রাজনারায়ণ বসু লিখেছিলেন,
এখনকার ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল উপাধী পায়, আমি তাহা পাণ্ডবদিগের স্বর্গারোহণের সহিত তুলনা করিয়া থাকি। পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই ও দ্রৌপদী স্বর্গের পথে যাইতে যাইতে প্রথম দ্রৌপদী, পরে সহদেব, পরে নকুল, পরে অর্জুন, পরে ভীম একজনের পর একজন পড়িয়া গেলেন। সর্বশেষে কেবল একা যুধিষ্ঠির স্বর্গারোহণ করিলেন। তেমনি যে সকল ছাত্র প্রথমতঃ এণ্ট্রেন্স কোর্স পড়ে, তাহার মধ্যে কতকগুলি এণ্ট্রেন্স পরীক্ষা না দিতে দিতে পড়িয়া যায়। ফার্ষ্ট আর্টস্ পরীক্ষা না দিতে দিতে আর কতকগুলি পড়িয়া যায়। বি, এ, পরীক্ষা না দিতে দিতে আর কতকগুলি পড়িয়া যায়। এম, এ, উপাধী প্রাপ্তি অর্থাৎ স্বর্গারোহণ অতি অল্প লোকেরই ভাগ্যে ঘটে। এক হিসাবে বর্তমান ইংরাজী শিক্ষার প্রণালী মানুষ মারিবার কল বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।৪৪
এই শিক্ষাব্যবস্থা যে আসলে কতটা অসার, কতটা ফোঁপরা – তা স্পষ্ট হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের এই মন্তব্যে:
Nothing could more clearly show that it was not education at large, but English education, and especially English education preparatory to the university course, which aroused the enthusiasm of Bengal.৪৫
এই শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা যে ব্রিটিশ রাজশক্তির দালাল ছাড়া অন্য কিছু হবে না, তা বোঝা যায় দামোদর কোসাম্বির এই তীক্ষ্ণ মন্তব্যেও –
The new class that rose in the second half of the 19th century — after the last upsurge of feudalism in the 1857 Mutiny had been suppressed — developed out of the go-between dalal, who were ultimately based on machine production, but production mostly in England, supplied by India with raw materials and a market.৪৬
কিন্তু হায়, সারাটা জীবন এই অর্থহীন ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার হয়েই সওয়াল করেন বিদ্যাসাগর। আর জনশিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, প্রান্তজনের শিক্ষা, প্রকৃত শিক্ষা ক্রমে দূরে, আরও দূরে সরে সরে যেতে থাকে।
ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্রে এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতি উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ লিখবেন —
এ দেশে শিক্ষা-ইমারতে সিঁড়ির সঙ্কল্প গোড়া থেকেই আমাদের রাজমিস্ত্রির প্ল্যানে ওঠে নি। নীচের তলাটা উপরের তলাকে নিঃস্বার্থ ধৈর্যে শিরোধার্য করে নিয়েছে : তার ভার বহন করেছে, কিন্তু সুযোগ গ্রহণ করে নি; দাম জুগিয়েছে, মাল আদায় করে নি। ... সমাজের উপরের থাকের লোক খেয়ে-প’রে পরিপুষ্ট থাকবে আর নীচের থাকের লোক অর্ধাশনে বা অনশনে বাঁচে কি মরে সে সম্বন্ধে সমাজ থাকবে অচেতন, এটাকে বলা যায় অর্ধাঙ্গের পক্ষাঘাত। এই অসাড়তার ব্যামোটা বর্বরতার ব্যামো।৪৭
কিন্তু তার পরেও তাঁর ‘সংস্কৃতকলেজের কর্ম ছাড়িয়া দিবার পর বিদ্যাসাগরের প্রধানকীর্তি মেট্রোপলিটান ইনস্টিস্ট্যুশন্’৪৮ বাক্যটি আমাদের মগজে, মননে ও মজ্জায় গেঁথে নিয়ে, আমরা যাপন করতে চাইব নিশ্ছিদ্র নিরাপদ তরঙ্গহীন জীবন। ফলে শিক্ষা আর বাহন হবে না আমাদের, তাকে বহন করে চলেই খুঁজে বেড়াব জীবনের সার্থকতা। একই সঙ্গে একরাশ হতাশার বিপজ্জনক চোরাবালিতে আমরা নিমজ্জিত হতে থাকব ক্রমশ, যেখান থেকে পরিত্রাণের উপায় আমাদের ইহজীবনে জুটবে না।
উপসংহার
দীর্ঘ এগারোটি পর্বে বিন্যস্ত এই পর্বটির শেষে যে শিক্ষাসংস্কারক বিদ্যাসাগরের মুখোমুখি হই আমরা, তাঁর জীবনব্যাপী শিক্ষাদর্শনে অন্ত্যজ হিন্দুরা যেমন অনুপস্থিত, ঠিক তেমনই অনুপস্থিত মুসলমানরাও। যে বীরসিংহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি, তার নিকটবর্তী খড়ার ছিল কাঁসা-পেতল শিল্পের অন্যতম বৃহৎ উৎপাদন কেন্দ্র; অদূরবর্তী রাধানগরে ছিল তিনটি রেশমের কারখানা; ক্ষীরপাই ও চন্দ্রকোণায় ছিল রেশম ও সুতিবস্ত্রের উৎপাদন কেন্দ্র। তাঁর জীবদ্দশাতেই এই শিল্পগুলির মুমূর্ষু অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন তিনি। তবু ব্রিটিশদের আর্থিক শোষণের কারণে হিন্দু কিংবা মুসলমান কারিগর-তাঁতির ভূমিহীন চাষিতে পরিণত হওয়ার ঘটনাতে তিনি বিচলিতও হন না, তাঁর প্রচলিত শিক্ষার অঙ্গনে এই শ্রেণির মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার সামান্যতম পরিকল্পনাও গ্রহণ করেন না।
তাঁর যাবতীয় শিক্ষাচিন্তা কেবলই আবর্তিত হয় সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে, বেন্টিক-মেকলের আমলের মতোই সমাজের সংখ্যাগুরু দরিদ্র মানুষরা অবহেলিত ও অপাঙ্ক্তেয় থেকে যান। এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীদেরও তাঁর প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় ঠাঁই হয় না। যে সামান্য সংখ্যক নারী সে সুযোগ পান, তাদেরও শিক্ষা কেবল ভবিষ্যতের আদর্শ জায়া ও জননী হয়ে ওঠার পাঠ্যক্রমের ঘেরাটোপে সীমাবদ্ধ থাকে। যেহেতু তিনি সমাজের এগিয়ে থাকা অংশের প্রতিভূ, যেহেতু সেই অংশের বেশিরভাগ মানুষের মতো তাঁর উপার্জন ও জীবনযাপনের প্রশ্নটিও ইংরেজ প্রভুদের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকে, সেহেতু নিজের শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ও সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে তিনি প্রকাশ্য প্রতিবাদটুকুও করেন না। জীবনের উপান্তে এসে যে সাঁওতালদের মধ্যে মানসিক শান্তির সন্ধান করেন তিনি, সেই সাঁওতাল পরগণার মাটি প্রায় ২৫ হাজার সাঁওতালের রক্তস্নাত হলেও সে বিষয়ে জীবনভর থেকে যান আশ্চর্য রকমের উদাসীন ও নির্লিপ্ত।
তাই স্বাভাবিকভাবেই যে শ্রেণির মানুষজন তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর তথাকথিত ‘শিক্ষাসংস্কার’ নামক কাল্পনিক মহীরূহের চারাগাছটি রোপণ করেন, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁদেরই পরবর্তী প্রজন্ম সযত্ন জলসিঞ্চন করে পুষ্পে-পল্লবে ভরিয়ে তোলেন তাঁদের একান্ত প্রিয় মহীরূহটিকে। সৃষ্টি হয় নানাবিধ গল্পগাথার, মিথ্যা মিথের – যাকে তাঁর জন্মের দুশো বছর পরেও প্রশ্ন করা ক্রমেই দুরূহতর থেকে দুরূহতম হয়ে ওঠে। আর এই কারণেই অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে মহম্মদ মহসীন, মধ্যভাগে জ্যোতিবা ও সাবিত্রী ফুলে এবং অন্তভাগে গুরুচাঁদ ঠাকুরদের মতো প্রান্তিক মানুষজন শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচুর সদর্থক অবদান রাখা সত্ত্বেও আরও বেশি করে প্রান্তিক হতে থাকেন; ঠাঁই নিতে বাধ্য হন ইতিহাসের অকিঞ্চিৎকর পাদটীকারূপে। অযুত সম্ভাবনাময় মানবসম্পদের এহেন অবাঞ্ছিত অপচয় আজ আর দেখতে পান না বিদ্যাসাগর। ধূপের ধোঁয়ায় আর মিথ্যা প্রশস্তির আড়ালে তাঁর দৃষ্টিশক্তিকে ঢেকে দিয়ে সুকৌশলে নির্মিত হতে থাকে ‘ঈশ্বর’-এর নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি।
****************************************************************
উল্লেখপঞ্জী:
১. Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, Calcutta, 1941, p. 492
২. তদেব, পৃ. ৩৫৬
৩. তদেব, পৃ. ৪৯৮
৪. ...it seems almost impracticable, in the present circumstances of the country, to introduce any system of education with such limited expenditure as is contemplated by Government, viz. Rupees 5 to 7 a month for each School. Men, who are qualified to teach mere reading, writing and a little of Arithmetic with any degree of success, however great their attachment to their Native villages may be, cannot be induced to accept service on such low remuneration.
Proceedings of the Lieutenant-Governor of Bengal, Education Department, October 1860, No. 53; ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ৬৮৬
৫. J.A. Richey (ed.), Selections from Educational Records, Part II, 1840-1859, Calcutta, 1922, p. 244
৬. I have no precise information about the systems pursued in the Hulkabandee Schools in the North-Western Provinces. But presuming that, that system has been adopted in the Behar Schools, I would beg to observe that in many respects it is similar to that prevailing in the indigenous Schools of Bengal. The course of instruction in the Behar Schools is, I understand, limited to letter writing, and Zemindar and Shopkeeper’s accounts, and the only difference between them and the Bengal Schools is, that a few printed books of an improved character are nominally used in the former. If the object of Government be to promote such a system of education in Bengal, a small monthly pay to the Goroomohashoys, the introduction of a few printed books in their Schools, and placing those Schools under Government inspection would easily secure that object.
ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ৬৮৬
৭. J.A. Richey (ed.), Selections from Educational Records, Part II, 1840-1859, p. 250
৮. But I must remark that such education, insignificant as it would be, will not extend the masses, if by that word is meant the labouring classes; for even now, both in Behar and in Bengal, few, if any, from these classes are to be found among the pupils of those schools.
ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ৬৮৬
৯. This state of things is to be ascribed to the condition of the labouring classes. It is generally so low that they cannot afford to incur any charge on account of the education of their children. Neither can they continue their boys in School, after the latter have attained that age when they become fit for any sort of work, which would secure some kind of remuneration however trifling it may be. They think, and perhaps rightly, that if this children learnt a little of reading and writing, it will not better their condition, and therefore they feel no inducement whatever in sending them to School. It is too much to expect that they would educate their children merely for the sake of knowledge, when even the higher classes do not yet properly appreciate the benefits of education. তদেব, পৃ. ৬৮৬-৮৭
১০. Under such circumstances it is needless to attempt the education of the labouring classes. But should it be in the contemplation of Government to try the experiment it must be prepared for giving education free of all charges. It may be mentioned here, that experiments have been made by private individuals, the results of which have not however been satisfactory. তদেব, পৃ. ৬৮৭
১১. An impression appears to have gained ground, both here and in England, that enough has been done for the education of the higher classes and that attention should now be directed towards the education of the masses. This impression has evidently been caused by the too favorable character of the Reports and Minutes on education. An enquiry into the matter will however show a very different state of things. তদেব, পৃ. ৬৮৭
১২. As the best, if not the only practicable means of promoting education in Bengal, the Government should, in my humble opinion, confine itself to the education of the higher classes on a comprehensive scale. By educating one boy in a proper style the Government does more towards the real education of the people, than by teaching a hundred children mere reading, writing and a little of Arithmetic. To educate a whole people is certainly very desirable, but this is a task which, it is doubtful, whether any Government can undertake or fulfil. It may be remarked that, notwithstanding the high state of civilization in England, the masses there are no better than their brethren in this country on the point of education. তদেব, পৃ. ৬৮৭
১৩. ‘শিক্ষার স্বাঙ্গীকরণ’; রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খণ্ড, কলকাতা, ১৩৬৮, পৃ. ৭০১
১৪. At the commencement of our operations, doubts were entertained in several quarters as to whether the Model Schools could be duly appreciated by the people in the interior. These doubts, I am happy to state, have long since been fully removed by the almost complete success of those institutions. The people of the villages in which they are located, as well as those of contiguous places who are also benefited by them, look upon the schools as great blessings and feel grateful to Government for them. That the institutions are highly prized is evident from the number of pupils attending each of them.
Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, 2nd Revised Edition, Kolkata, 2013, p. 52
১৫. ‘প্রাইমারি শিক্ষা’; রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, কলকাতা, ১৩৬৭, পৃ. ৫১৩
১৬. Vernacular Education on an extensive scale, and on an efficient footing, is highly desirable, for it is by this means alone that the condition of the mass of the people can be ameliorated.
Selections from the Records of the Bengal Government, No. XXII, Correspondence Relating to Vernacular Education in the Lower Provinces of Bengal, p. 71
১৭. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ৩৮৭
১৮. A.P. Howell, Note on the State of Education in India during 1866-67 (Selections from the Records of the Government of India, Home Department, no. LXVII), Calcutta, 1868, p. 60; উদ্ধৃত Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones, New Delhi, 2016, p. 37
১৯. Long’s Introduction; Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, p. 506
২০. তদেব, পৃ. ৫০৬
২১. তদেব, পৃ. ৪৯৯
২২. তদেব, পৃ. ৫০১
২৩. ‘বঙ্গদেশের শ্রমজীবী ও কৃষক প্রভৃতির বিদ্যাশিক্ষা’, সোমপ্রকাশ, ১২ ফাল্গুন ১২৭৫, ১৫ সংখ্যা; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১৮৪০-১৯০৫, চতুর্থ খণ্ড, কলকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৫২৮
২৪. ‘ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেন্টের শিক্ষাসংক্রান্ত রাজনীতির প্রতিবাদকারিণী সভা’, সোমপ্রকাশ, ২৮ আষাঢ় ১২৭৭; তদেব, পৃ. ৫৪২
২৫. তদেব, পৃ. ৫৪৩
২৬. A.M. Monteath, Selections from Educational Records of the Government of India, Volume 1, Educational Reports, 1859-71, Delhi, 1960, p. 364
২৭. তদেব, পৃ. ৩৬৭
২৮. Long’s Introduction; Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, p. 499
২৯. W.W. Hunter, The Indian Musalmans, Third Edition, London, 1876, p. 169
৩০. তদেব, পৃ. ১৭০
৩১. Sumit Sarkar, The Swadeshi Movement in Bengal 1903-1908, New Delhi, 1973, p. 410
৩২. বিনয় ঘোষ, বাংলার বিদ্বৎসমাজ, কলকাতা, ১৯৬৩, পৃ. ২৫
৩৩. Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, p. 358
৩৪. W.W. Hunter, A Life of the Earl of Mayo: Fourth Viceroy of India, Volume II, London, 1876, p. 303
৩৫. তদেব, পৃ. ৩০৫
৩৬. ‘সর্ উইলিয়ম গ্রে ও সর্ জর্জ কাম্বেল’; যোগেশচন্দ্র বাগল (সম্পাদিত), বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৩৯৭, পৃ. ৮৯৩
৩৭. H. Beverley, Report on the Census of Bengal 1872, Calcutta, 1872, p. 182
৩৮. মহানন্দ হালদার, শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত, তৃতীয় সংস্করণ, ওড়াকান্দি, ১৯৯৮, পৃ. ১৪৪
৩৯. বিপিনচন্দ্র পাল, আমার জীবন ও সমকাল প্রথম পর্ব, অনু. শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৮৫, পৃ. ২২-২৩
৪০. কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর (সম্পাদিত), গুরুচাঁদ ঠাকুর ও অন্ত্যজ বাংলার নবজাগরণ, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ৭৬
৪১. Atul Chandra Pradhan, The Emergence of Depressed Classes, Bhubaneswar, 1986, p. 33
৪২. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯০৯, Appendix C, p. xvi
৪৩. ‘কর্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগর’, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখিত ভূমিকা; ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৩৩৮, পৃ. ১৬-১৭
৪৪. রাজনারায়ণ বসু, সে কাল আর এ কাল, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৪৪
৪৫. Calcutta University Commission (1919), Report, Vol. I, Calcutta, 1919, p. 54; উদ্ধৃত Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones, p. 43
৪৬. D. D. Koshambi, An Introduction to the Study of Indian History, New Delhi, 2016, p. 403
৪৭. ‘শিক্ষার সাঙ্গীকরণ’, রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খণ্ড, পৃ. ৭০০-০১
৪৮. ‘বিদ্যাসাগরচরিত’; রবীন্দ্র রচনাবলী, একাদশ খণ্ড, পৃ. ৩৪২
অনবদ্য লেখা। সব জায়গায় আপনার বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হই নি। আমার মনে হয় বিদ্যাসাগর ও দোষে গুণে মানুষ, কাজেই যেটুকু করে গেলেন সেটাই অনেক। যা করলেন না তা করার দায়িত্ব নিন অন্যেরা। তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্যের কাজে বাধা না দিলেই হল। এবং তিনিও সময়ের সন্তান। কাজেই সমসাময়িক ভাবনা তার মাথায় একেবারে থাকবে না এমন কোন চাহিদা আমার নেই। তাই আপনার কিছু কিছু মতের সঙ্গে সহমত হতে পারি নি। আবার কিছু কিছু মতের সঙ্গে পূর্ণ সহমত।
তবু আপনি যে অসম্ভব পরিশ্রম করে এবং যুক্তি সহকারে বিষয়টা সাজিয়েছেন তার তারিফ না করলেই নয়।
গুরুর শুরু থেকে এতাবৎকাল অবধি বেরোন যাবতীয় ধারাবাহিকের মধ্যে এইটা ওয়ান অব দ্য বেস্ট সিরিজ। পর্বগুলো আরো অনেকবার পড়িতে রেফার করতে হবে এই বিষয়ে আগ্রহীদের।
মতুয়াদের শিক্ষাবিষয়ক পুরো ব্যপারটাই আমার অজানা ছিল। সবকটা ইন্টারপ্রিটেশানের সাথে আমি ঠিক একমত নই, তবে উপসংহারটির সাথে মোটের উপর একমত।
এই অতি পরিশ্রমসাধ্য ধারাবাহিকের জন্য এলেবেলেকে কৃতজ্ঞতা।
পুরোটা শেষ হলো। কোনো রকম আলোচনায় অংশ না নিয়ে সবটা পড়ে গেলাম। লেখককে একটা বড়সড় ধন্যবাদ। ভালো লাগলো।
দময়ন্তী ঠিক বলেছেন। ওয়ান অফ দ্য বেস্ট সিরিজ।
কিছুই জানতাম না। সবগুলো কিস্তি কপিপেস্ট করে ওয়ার্ড ফাইল বানিয়েছি। আবার পড়ব, যখনই দরকার হবে রেফারেন্সের জন্যে এর পাতা ওল্টাবো।
ইন্টারপ্রিটেশনের ব্যাপারে আমার বক্তব্য প্রায় স্বাতী রায়ের মত। অনেক জায়গায় যেন লেখক দু'শো বছর আগের এক ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মানো এবং ওই সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষটির থেকে আজকের ভিশন আশা করছেন।
আবারও বলি, অসাধারণ তথ্যনিষ্ঠা , পরিশ্রম ও যুক্তিসাজানো। টুপি খুললাম। আর বহুদিন ধরে স্থাপিত আইকনের নির্মোহ কাটাছেঁড়া করতে ধক লাগে। অনেকে গোড়াতেই ভুল বোঝে।
যদি এই ইন্টারপ্রিটেশনের পালটা বক্তব্য সাপোর্টিং তথ্য সমেত কেউ পেশ করেন তো মজা আ জায়েগা! কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণে অরণিমন্থন হোক ।
সত্যি অসাধারণ এবং অনবদ্য এই সিরিজ, লেখক অসম্ভব ধৈর্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্যবহুল এই কাজ কে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। সহমত পোষণ করুক বা না করুক এটা সবার পড়া উচিৎ। যেভাবে যুক্তিদ্বারা লেখক এই মহীরুহের বিনির্মাণ করেছেন তা প্রশংসনীয়।
পড়লাম, একটু অন্য কাজে মনোযোগ দিতে হচ্ছে। আপনার সব তথ্য আমার কাছে অজানা। নূতন। বইয়ের অপেক্ষায় রইলাম। এটা দ্বিতীয় বার লিখেছি।
উত্তর দিতে দেরি হল। যাঁরা ধারাবাহিকটি পড়লেন, মন্তব্য করলেন, শেয়ার করলেন, বিতর্ক করলেন, অনাবশ্যক ব্যক্তি আক্রমণ করলেন - তাঁদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাই। সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ থাকলাম গুরুর টেক টিমের কাছে যাঁরা লেখাটি ঠিক যেভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছি, সেভাবেই প্রকাশ করার প্রযুক্তিগত সুবিধাটা দিলেন বলেন। আর সত্যিই স্বস্তি বোধ করছি গোটা লেখাটার কথাও রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চারু-সরোজ এবং তুহিন মালাকারের উল্লেখ করিনি বলে।
সব্বাইকে ধন্যবাদ।