দশম অধ্যায়
বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ – দশচক্রে ভগবান ভূত
…আমরা বিচারের চেয়ে প্রচারের অত্যন্ত বশীভূত, ফলে কোনোমতে একটা দাগ এঁটে বা মেরে দিলে বা কিছুদিন রটালে সাদা মিথ্যাও আমাদের কাছে জোর পেয়ে যায়, এর পেছনে উপরন্তু সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ও অন্তঃশীল প্রচার থাকলে তার ভিত এত পাকা হয় যে, খুব খাঁটি সত্যকেও অনেক সময় মাথা কুটতে হয় অসহায়ভাবে।
— কার্তিক লাহিড়ী, কলকাতার গ্রাম্যতা ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী
বিদ্যাসাগর সহসা সংস্কৃত কলেজ থেকে কেন পদত্যাগ করেছিলেন, তার কারণ হিসেবে একাধিক বিদ্যাসাগর জীবনীকার ও গবেষক জনশিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ংকে দায়ী করে থাকেন। তাঁদের মুল বক্তব্য – সংস্কৃত কলেজে ও বাংলায় শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে সব নিয়ে ইয়ঙের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ চরমে ওঠায় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। যেমন বিনয় ঘোষ এ বিষয়ে ইয়ংকে অভিযুক্ত করে সরাসরি লিখেছেন —
১৮৫৭ সালে সিপাহীবিদ্রোহের সময় থেকে দেখা যায়, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সরকারী শিক্ষাবিভাগের মতবিরোধের আবার সূত্রপাত হতে থাকে। এবারে বিরোধ ডি.পি.আই গর্ডন ইয়ঙের সঙ্গে। বিরোধ দিন-দিন বাড়তে থাকে এবং ক্রমে তা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে বিদ্যাসাগর শেষ পর্যন্ত তাঁর অধ্যক্ষতার সরকারী চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।১
তাঁর অনেক আগে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের আসল কারণটি বলার পরেও, বিনয় ঘোষ একাধিক ছেঁদো অজুহাত দেখিয়ে তাঁর মতটিতেই অটল থাকার চেষ্টা করেছেন। আমরা এই অধ্যায়ে গোটা বিষয়টিকে নানা তথ্যের সাহায্যে সম্যক পর্যালোচনার চেষ্টা করে দেখব, ঠিক কী কারণে বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেছিলেন।
১৮৫৪-র নভেম্বরে গর্ডন ইয়ঙের আমলে, বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে মুগ্ধবোধ-এর বদলে সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা এবং ঋজুপাঠ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ চালু করেন। পরে তার সঙ্গে যোগ হয় আরও একটি গ্রন্থ ব্যাকরণ কৌমুদী। পরের বছরে যথাক্রমে তত্ত্বাবধায়ক, সহকারী পরিদর্শক ও বিশেষ পরিদর্শক হিসেবে তিনি মডেল স্কুল ও নর্মাল স্কুল স্থাপন করলেও অধিকর্তা ইয়ং তাঁকে বাধা দেননি। বরং ১৮৫৫-র ২ জুলাই বিদ্যাসাগর নর্মাল স্কুল স্থাপনের ব্যাপারে ইয়ংকে চিঠি লিখলে, তিনি মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। ১৮৫৬-এ তাঁরই অনুরোধে বিদ্যাসাগর প্রকাশ করেন চরিতাবলী। বিদ্যাসাগর-জীবনীকার বিহারীলাল সরকার কিংবা সুবল চন্দ্র মিত্র কোনও তথ্যসূত্রের উল্লেখ না করে ধারণা করেছেন, ইয়ংকে উপেক্ষা করে স্বয়ং ছোটলাটের ভরসায় বিদ্যাসাগর যে একাধিক বালিকা বিদ্যালয় খোলেন, সেখান থেকেই তাঁর সঙ্গে ইয়ঙের বিরোধের সূত্রপাত – যার ফলে বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বলা বাহুল্য, এই ধারণার কোনও প্রামাণ্য ভিত্তি নেই। কারণ এই অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব, ১৮৫৮ সালে বালিকা বিদ্যালয়গুলির শিক্ষকদের বকেয়া বেতন পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে বিদ্যাসাগর যখন সরকারের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করবেন, তখনও বিদ্যাসাগরের পক্ষেই কথা বলবেন জনশিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ং।
আমরা আগের অধ্যায়েই দেখেছি, ১৮৫৮-র ৭ মে ভারত সরকার বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে অনুমোদন না দেওয়ার কারণে, বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারীরা বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। ওই বছরের জুন পর্যন্ত সরকারের কাছে তাঁদের মোট বকেয়া বেতন পাওনা হয় ৩৪৩৯ টাকা ৩ আনা ৩ পয়সা। এই শিক্ষক ও কর্মচারীদের নিয়োগ করেছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। এই পরিস্থিতিতে ২৪ জুন বিদ্যাসাগর ইয়ংকে জানান –
The establishments, having been appointed by me, naturally look up to me for payment, and it will certainly be a great hardship if I am made responsible for it ….২
ইয়ং এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আদৌ অসহযোগিতা করেননি, বরং বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন এবং তাঁর চিঠির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের চিঠিটিও বাংলা সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে লেখেন:
I would venture to recommend to the generous consideration of Government the Pandit’s petition to be shielded from personal and pecuniary liability on account of the female schools which, in anticipation of the sanction and approbation of Government, he was the means of establishing.৩ [নজরটান সংযোজিত]
২২ জুলাই ছোটলাট সরকারের ৭ মে জারি করা আদেশনামা পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানিয়ে সম্পূর্ণ বিষয়টি ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেন।
কিন্তু নতুন করে সরকারি আদেশনামা জারি করার আগে, কোন পরিস্থিতিতে আর্থিক অনুমোদনের প্রত্যাশা করে বালিকা বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিদ্যাসাগর এত অর্থ ব্যয় করেছেন; বিদ্যাসাগরের দাবি অনুযায়ী কোন ব্যক্তি তাঁকে এই কাজে উৎসাহিত করেছেন; বিশেষত ১৮৫৮ সালের ১৩ই এপ্রিল বাংলা সরকার লিখিত চিঠির আগেই প্রায় অর্ধেক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা ছোটলাটের জানা ছিল কি না এবং থাকলে সে কথা চিঠিতে কেন উল্লেখ করা হয়নি — এই সমস্ত ব্যাপারে ভারত সরকার হ্যালিডের কাছে পূর্ণ ব্যাখ্যা দাবি করেন।৪ ভারত সরকারের প্রশ্নের উত্তরে ৩০ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগর অধিকর্তাকে লেখেন –
...যেহেতু সরকারি অনুমোদনের ভিত্তিতে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, তার ফলে আমার ধারণা হয়েছিল যে এ বিষয়ে সরকারের সার্বিক অনুমোদন আছে। প্রত্যেক নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরের মাসেই আপনাকে তা জানিয়েছি। কোনও আদেশনামা প্রকাশিত না হলেও আপনি সর্বদা বিদ্যালয়গুলির ব্যয়সংক্রান্ত আমার সমস্ত আবেদনপত্র গ্রহণ করেছেন। এতদিন এই কাজে আমাকে নিরুৎসাহিত না করার কারণে স্বভাবতই আমার ধারণা হয়েছিল যে, এ বিষয়ে সরকারের সম্মতি আছে।৫
বিদ্যাসাগরের চিঠি থেকে এ কথা স্পষ্ট, ইয়ং কোনও সময়েই তাঁকে এ কাজে নিরুৎসাহিত করেননি, বরং তাঁর আবেদনপত্র গ্রহণ করে সরকারের বিবেচনার জন্য যথাসময়ে পাঠান।
এই কথার সমর্থন মেলে স্বয়ং ইয়ঙের লেখা চিঠিতেও। ৪ অক্টোবর তিনি বাংলা সরকারের কাছে বিদ্যাসাগরের চিঠিটি পাঠিয়ে মন্তব্য করেন —
আমি জানি, আমার অবর্তমানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ছোটলাটের সঙ্গে পণ্ডিতের ব্যক্তিগত মত বিনিময় হয়েছে। সরকার তাঁর প্রচেষ্টায় সর্বাত্মক সাহায্য করতে প্রস্তুত, সেটা আপনার ২১ অক্টোবরের চিঠি (No. 503) থেকে অনুমান করে আমি বিনা দ্বিধায় পণ্ডিতের প্রতিবেদনগুলি কোনও নিরুৎসাহ প্রদর্শন বা মন্তব্য ছাড়া সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে পাঠিয়েছি। আমার অনুপস্থিতিতে মি. উড্রোও তাই করেছেন।৬
অবশেষে ২৭ নভেম্বর ছোটলাট নিজের ত্রুটি স্বীকার করে ভারত সরকারকে লেখেন,
ছোটলাটের ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, তিনি তাঁর ক্ষমতাবলে বিদ্যালয়গুলির আর্থিক অনুমোদন দিতে পারেন। ...কিন্তু এক্ষেত্রে যে ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের মতো ছোটলাট নিজেও সমান দায়ী।৭
কাজেই যে ভুলের জন্য স্বয়ং ছোটলাট নিজে দায়স্বীকার করছেন, সেখানে ইয়ঙের মতো নেহাতই এক সরকারি আমলাকে এ বিষয়ে জড়ানোর কোনও অর্থই থাকতে পারে না।
এই ক্ষেত্রেও যখন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে জনশিক্ষা অধিকর্তার কোনও বিরোধিতা হয়নি, তাহলে তিনি আকস্মিকভাবে ১৮৫৭ সালের ২৯ অগস্ট পদত্যাগপত্র পেশ করলেন কেন? এই বিষয়ে বিনয় ঘোষ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন! বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ গ্রন্থের ‘শিক্ষাচিন্তা’ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন –
সরকারী শিক্ষাবিভাগের সঙ্গে এই ধরনের নানাবিষয় নিয়ে বিদ্যাসাগরের যখন বিরোধ চলছিল, তখন সিপাহীবিদ্রোহের আগুন দাবানলের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্রিটিশ শাসকরা রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। কলকাতা শহরের বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের অট্টালিকা তাঁরা তখন সৈন্যসামন্ত মজুত করার জন্য দখল করছেন। সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজের বৃহৎ অট্টালিকাও তাঁরা দখল করার সিদ্ধান্ত করেন। এই সিদ্ধান্তও বিদ্যাসাগর সহজে মেনে নেননি।৮ [নজরটান সংযোজিত]
এখানেই না থেমে তিনি দৃঢ় সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে জানিয়েছেন,
বরং ঘটনাগতি ও এই সময়কার চিঠিপত্রের বিষয়বস্তু থেকে মনে হয় যে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজ সরকারী সেনাবিভাগের কুক্ষিগত করার বিরোধী ছিলেন।৯
বিনয় ঘোষের ভাষাপ্রয়োগ দেখে এ কথা মনে করা অসঙ্গত নয় যে, বিদ্যাসাগর সিপাহি বিদ্রোহের চরম সমর্থক ছিলেন বলেই তাঁর কলেজটিকে সেনাবিভাগের কুক্ষিগত করার বিরোধিতা করেছিলেন। এ বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে, সিপাহি বিদ্রোহের প্রকৃতি ও বিদ্রোহ সম্পর্কে সমকালীন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মনোভাব সংক্ষেপে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
বিদ্রোহের যথাযথ কারণ হিসেবে ‘destruction, through free trade, [of] the domestic handicraft industry in India’-কে চিহ্নিত করে, ১৮৫৭ সালের ৩০ জুন নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে মার্ক্স যে বিদ্রোহকে ‘national revolt’ এবং ‘the only social revolution ever heard of in Asia’১০ বলে আখ্যায়িত করেন, সেই বিদ্রোহকে তৎকালীন তাবৎ অগ্রগণ্য হিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবী ‘সামন্ত বিদ্রোহ’ বলতে দ্বিধা করেননি। যদিও সিপাহি বিদ্রোহকে সামন্ত বিদ্রোহ বলার কোনও কারণই থাকতে পারে না। কারণ এই বিদ্রোহে সামন্তব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ রাজন্যবর্গের একজনও যোগ দেননি। শুধু তাই নয়, অযোধ্যা বাদে জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রিটিশের পক্ষে। বরং উত্তর ভারতের অযোধ্যা, রোহিলখণ্ড, বুন্দেলখণ্ড ও নর্মদা – চারটি অঞ্চলের জনসাধারণ এই বিদ্রোহে যোগ দেন।
বিদ্রোহের প্রাথমিক সাফল্যের পর পরই সংগ্রাম পরিচালনার জন্য, বিভিন্ন সামরিক বিভাগের নির্বাচিত সিপাহি প্রতিনিধি নিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় সভা (Court of Administration) গঠিত হয়। এই সভা ১৮৫৭-র ১১ মে বাহাদুর শাহকে ভারত সম্রাট ঘোষণা করে ঠিকই, কিন্তু এর অব্যবহিত পরেই ‘আজমগড় ইস্তাহার’-এর ভিত্তিতে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয় এই রাষ্ট্রীয় সভা। ২৫ অগস্ট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের নামে ঘোষিত আজমগড় ইস্তাহারে কোম্পানির অপশাসনের প্রকৃত ছবি তুলে ধরা হয়। সেখানে মূল অভিযোগগুলি ছিল — জমিদারদের অবর্ণনীয় শোষণ; নীল, কাপড় ও রপ্তানিযোগ্য পণ্যের একচেটিয়া কারবারের ফলে দেশীয় কারিগরদের নাভিশ্বাস; ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর চাপানো করের গুরুহার এবং কোম্পানির সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সেনাদের পদোন্নতির সুযোগের অভাব ও দুর্ব্যব্যহার।১১ ইস্তাহারে সিপাহিদের অভাব-অভিযোগ ছাড়াও চাষি, কারিগর ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করার কারণে বিহারের পশ্চিমভাগে, পাটনা বিভাগের বহু জেলায়, আগ্রা এবং মিরাটে সিপাহিদের সঙ্গে একই সময়ে অভ্যুত্থানে যোগ দেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ, সাধারণ চাষি ও মুসলমান কারিগররা। এই ব্যাপক অভ্যুত্থানের ফলে শুধু অযোধ্যাতে মারা যান দেড় লাখ মানুষ, যার মধ্যে সিপাহি ছিলেন মাত্র ৩৫ হাজার জন। লখনউ ও কানপুরের মধ্যবর্তী মিয়াগঞ্জে যে যুদ্ধ হয়, সেখানে আট হাজার বিদ্রোহীর মধ্যে সিপাহি ছিলেন মাত্র এক হাজার জন। একই সময়ে সুলতানপুরের বিদ্রোহে পঁচিশ হাজার বিদ্রোহীর মধ্যে ছিলেন মাত্র পাঁচ হাজার জন সিপাহি।
আসলে এই বিদ্রোহকে ‘সামন্ত বিদ্রোহ’ বলার অন্য কারণ বর্তমান। তৎকালীন ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ইংরেজি-শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তদের জমিদারি এবং ‘ঘটিরাম ডেপুটি’গিরির পুরোটাই ছিল ইংরেজ শাসকদের কৃপার ওপর নির্ভরশীল। ফলে একাধিক ছোট-বড় আঞ্চলিক কৃষক বিদ্রোহের পরে দেশ জুড়ে যখন বৃহত্তম বিদ্রোহটি সংগঠিত ও সশস্ত্র রূপ ধারণ করে, তখন ব্রিটিশ শোষণের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করেও তাঁদের কাছে তা অসহ্য মনে হয়নি। একাধিক সমকালীন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও সমসাময়িক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া, এ কথাকে সমর্থন করে। ১২৭৮ বঙ্গাব্দের এডুকেশন গেজেট-এ ছাপা হয় এই মন্তব্য –
ইংলণ্ডের কোন সুপ্রসিদ্ধ সংবাদপত্রে লিখিত হইয়াছে যে, ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেন্ট উচ্চ ইংরাজী শিক্ষার প্রতিকূলতাচরণ করিয়া অবিবেচনার কার্য করিতেছেন। কোন ইংরাজী ভাষাভিজ্ঞ ভারতবর্ষীয় লোক সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দেন নাই। ইহাতেই সপ্রমাণ হয় যে ইংরাজী শিখিলে ইংরাজ গবর্ণমেন্টের প্রতি দৃঢ়ভক্ত জন্মিয়া থাকে।১২
বিদ্রোহ চলাকালীন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লেখা হয় —
...বঙ্গদেশস্থ সমস্ত বাঙ্গালি প্রজা নিতান্ত প্রভুভক্ত, ইহারা নিরন্তর কেবল শ্রীশ্রীমতী রাজ্যেশ্বরীর প্রতুল প্রত্যাশা করে, যাহাতে রাজপুরুষদিগের রাজলক্ষ্মী ভারতবর্ষে চিরস্থায়িনী হয়েন, একাগ্র চিত্তে তাহারি অভিলাষ করে, স্বপ্নেও কখনো অমঙ্গল চিন্তা করে না, কারণ ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের অধীনতায় অধুনা দুর্বল ভীরু বাঙ্গালি ব্যূহ যেরূপ সুখ সচ্ছন্দতা সম্ভোগ পূর্বক সানন্দে বাস করিতেছে, কস্মিন্কালে তদ্রূপ হয় নাই, রামরাজ্য আর কাহাকে বলে? এই রাজ্যইতো রাম রাজ্যের ন্যায় সুখের রাজ্য হইয়াছে, আমরা যথার্থরূপ স্বাধীনতা সহযোগে পদ, মান, বিদ্যা, এবং ধর্ম, কর্মাদি সকল প্রকার সাংসারিক সুখে সুখি হইয়াছি; কোন বিষয়েই ক্লেশের লেশমাত্র জানিতে পারি না, জননীর নিকট পুত্রেরা লালিত ও পালিত হইয়া যদ্রূপ উৎসাহে ও সাহসে অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া অন্তঃকরণকে কৃতার্থ করেন, আমরাও অবিকল সেইরূপে পৃথিবীশ্বরী ইংলণ্ডেশ্বরী জননীর নিকটে পুত্রের ন্যায় প্রতিপালিত হইয়া সর্বমতে চরিতার্থ হইতেছি।১৩
অন্যদিকে নীল বিদ্রোহের আগুনখেকো সম্পাদক হরিশ মুখোপাধ্যায়ের ভূয়সী প্রশংসা করে শিবনাথ শাস্ত্রী পরোক্ষে বুঝিয়ে দেন, অন্তত এই বিষয়ে ঈশ্বর গুপ্ত এবং হরিশ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে কোনও ফারাক নেই! তিনি লেখেন:
বিদ্রোহজনিত উত্তেজনাকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত হিন্দু পেট্রিয়ট নামক সাপ্তাহিক ইংরাজী কাগজ এক মহোপকার সাধন করিল। পেট্রিয়ট সারগর্ভ সুযুক্তিপূর্ণ তেজস্বিনী ভাষাতে কর্তৃপক্ষের মনে এই সংস্কার দৃঢ়রূপে মুদ্রিত করিবার প্রয়াস পাইলেন যে, সিপাহী-বিদ্রোহ কেবল কুসংস্কারাপন্ন সিপাহিগণের কার্য মাত্র, দেশের প্রজাবর্গের তাহার সহিত যোগ নাই। প্রজাকুল ইংরাজ গবর্ণমেণ্টের প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুরক্ত এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচলিত রহিয়াছে। পেট্রিয়টের চেষ্টাতে লর্ড ক্যানিং-এর মনেও এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল; সেজন্য এদেশীয়দিগের প্রতি কঠিন শাসন বিস্তার করিবার জন্য ইংরাজগণ যে কিছু পরামর্শ দিতে লাগিলেন ক্যানিং তাহার প্রতি কর্ণপাত করিলেন না। পূর্বেই বলিয়াছি সেই কারণে তাঁহার স্বদেশীয়গণ তাঁহার Clemency Canning বা ‘দয়াময়ী ক্যানিং’ নাম দিল। এমনকি তাঁহাকে ফিরাইয়া লইবার জন্য ইংলণ্ডের প্রভুদিগকে অনেকে পরামর্শ দিতে লাগিলেন। পার্লিয়ামেন্টেও সে কথা উঠিয়াছিল; কিন্তু ক্যানিং-এর বন্ধুগণ পেট্রিয়টের উক্তিসকল উদ্ধৃত করিয়া দেখাইলেন যে এদেশবাসিগণ ক্যানিং-এর প্রতি কিরূপ অনুরক্ত এবং ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টের প্রতি কিরূপ কৃতজ্ঞ।১৪
সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়গুলিতে বিদ্রোহের প্রতি এহেন মনোভাবে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে যায়।
একই কারণে ১৮৫৭-র ভারত কাঁপানো মহাবিদ্রোহের পরে, ব্রিটেনের রানি স্বহস্তে এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করায় উচ্ছ্বসিত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ-এর ভূমিকায় লেখেন –
প্রজাবৃন্দের সুখ-সূর্যোদয়ের সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে। দাসীদ্বারা সন্তানকে স্তনদুগ্ধ দেওয়া অবৈধ বিবেচনায় দয়াশীলা প্রজা-জননী মহারাণী ভিক্টোরিয়া প্রজাদিগকে স্বক্রোড়ে লইয়া স্তন পান করাইতেছেন। সুধীর সুবিজ্ঞ সাহসী উদারচরিত্র ক্যানিং মহোদয় গভরনর্ জেনরল্ হইয়াছেন।১৫
ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর মহানুভবতার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি লিখতে পারেন:
প্রজার দুঃখে দুঃখী, প্রজার সুখে সুখী, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, ন্যায়পর গ্র্যান্ট মহামতি লেফ্টেনেন্ট গভরনর্ হইয়াছেন এবং ক্রমশ সত্যপরায়ণ, বিচক্ষণ, নিরপেক্ষ ইডেন, হার্সেল্ প্রভৃতি রাজকার্য-পরিচালকগণ শতদলস্বরূপে সিবিল্ সর্ভিস সরোবরে বিকশিত হইতেছেন। অতএব ইহাদ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে নীলকর দুষ্টরাহুগ্রস্ত প্রজাবৃন্দের অসহ্য কষ্ট নিবারণার্থ উক্ত মহানুভবগণ যে অচিরাৎ সদ্বিচাররূপ সুদর্শনচক্র হস্তে গ্রহণ করিবেন, তাহার সূচনা হইয়াছে।১৬
আরেক ‘ঈশ্বর’ বিদ্যাসাগর ১৮৭১ সালে বহুবিবাহ নিবারণ বিষয়ক প্রথম পুস্তকের বিজ্ঞাপনে অক্লেশে লিখতে পারেন –
ব্যবস্থাপক সমাজ বহুবিবাহনিবারণী ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করিবেন, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ আশ্বাস জন্মিয়াছিল। কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশের দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই সময়ে রাজবিদ্রোহ উপস্থিত হইল। রাজপুরুষেরা বিদ্রোহনিবারণবিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যাপৃত হইলেন; বহুবিবাহনিবারণবিষয়ে আর তাঁহাদের মনোযোগ দিবার অবকাশ রহিল না।১৯
অর্থাৎ অঙ্গুলিমেয় কুলীন ব্রাহ্মণের বহুবিবাহ তাঁর প্রধান মাথাব্যথার বিষয়। তাই তাঁর কাছে ‘রাজবিদ্রোহ’ ঘোরতর অন্যায়, নেহাত দেশে ‘দুর্ভাগ্য’ উপস্থিত না হলে এমনটা হতেই পারে না! হাজার হাজার সাধারণ মানুষের প্রাণবিসর্জনে তিনি বিচলিত হন না, বরং ‘রাজপুরুষেরা’ যে সেই বিষয়ে ভিন দেশ থেকে সেনা এনে বিদ্রোহ সামাল দিতে ‘সম্পূর্ণ ব্যাপৃত’ হয়ে পড়ে, এতে তাঁর আফশোসের সীমা-পরিসীমা থাকে না!! আর এ বিষয়ে তাঁর হয়ে সাফাই দিতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েন মাননীয় বিদ্যাসাগর-গবেষক বিনয় ঘোষ!!!
অথচ তদানীন্তন সরকারি নথিপত্রে দেখা যায়, ১৮৫৭ সালে বিদ্যাসাগর শুধু সিপাহি বিদ্রোহ উপলক্ষেই সংস্কৃত কলেজটি ছাড়েননি, বরং ওই বছরেই প্রথমে ‘বকরি ইদ’ ও পরে ‘মহরম’-এর জন্য তিনি কলেজ ভবনটি ছেড়ে দেন। ১ অগস্ট তিনি গর্ডন ইয়ংকে জানান:
I have the honour to report that, in compliance with the request contained in the accompanying copy of a letter to my address from the Principal of the Presidency College of yesterday’s date, I have closed the Sanscrit College for five days commencing from today.
It will be seen from Mr. Sutcliffe‘s letter that the Colleges and Schools have been closed at the desire of Colonel Strachey, Commandant of the Volunteer Corps, a body of whom are to be located in the College premises during the festival of the Buckreed.২০
এর পরে ইয়ঙের অনুমোদন পাওয়ার আগেই ২৪ অগস্ট মহরম উপলক্ষে ৮ দিন কলেজ বন্ধ রেখে তাঁকে লেখেন —
Two squads of the Volunteer Corps having occupied the Sanscrit College premises from Saturday evening when it is understood that they will be on duty for the day and night during the Mohurrum, I have the honour to report for your information that in anticipation of your sanction I have this day closed the Institution for 8 Days.২১
এই চিঠিগুলি থেকে এই সামান্য কথাটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না – বিদ্যাসাগর যেমন সিপাহি বিদ্রোহের আগেও তাঁর কলেজটিকে সেনা ও পুলিশের সাময়িক আস্তানা হিসেবে ছেড়ে দেন, তেমনই তার জন্য সর্বদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও নেননি। বিনয় ঘোষের মতো খ্যাতিমান বিদ্যাসাগর-গবেষকের এ চিঠিপত্রগুলি না দেখার কথা নয়, তবুও তিনি এ বিষয়ে তাঁকে আড়াল করার হাস্যকর চেষ্টা করেছেন।
মহরমের ছুটি শেষে কলেজ ফের খোলে ১ সেপ্টেম্বর। ওই দিন দুপুর দুটো নাগাদ বিদ্যাসাগর প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ সাটক্লিফ (J. Sutcliffe)-এর পাঠানো চিঠিতে জানতে পারেন যে, গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার সংস্কৃত কলেজটি অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। ২ সেপ্টেম্বর তিনি সে কথা জানিয়ে ইয়ংকে লেখেন:
Measures have accordingly been taken to remove the College furniture to the Normal School premises, one of the houses which I had reported upon as available, having since been let out by its proprietor to another party without intimation being given to me.
As no other houses can immediately be had for transferring the College and as there are only 12 days to the Dusserah vacation, I have in anticipation of your sanction closed the College for that period from this day. In the mean time I hope to be able to engage suitable houses for the accomodation of the College after the Dusserah vacation.২২ [নজরটান সংযোজিত]
গোটা ঘটনার গতিপথ বুঝতে এই চিঠিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিঠি থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার, ব্রিটিশ সরকারের আদেশ অনুযায়ী বিদ্যাসাগর জেনেবুঝে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতিরেকে, কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংস্কৃত কলেজকে সেনাবাহিনীর ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করতে দেন। সরকারি বেতনভুক কর্মচারী বিদ্যাসাগরের সরকারি নির্দেশ অমান্য করার উপায়ও ছিল না।
কিন্তু খটকা লাগে চিঠিটির ‘one of the houses which I had reported upon as available’ জায়গাটিতে। বোঝা যায়, এই আদেশ পাওয়ার আগেই বিদ্যাসাগর অস্থায়ীভাবে বাড়ি ভাড়া করে কলেজ চালানোর প্রস্তুতি নেন এবং সেই বাড়িতে কলেজের আসবাবপত্র সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করেন। যদিও কবে তিনি এই আগাম ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, তা এই চিঠি থেকে জানা সম্ভব নয়। তবে জনশিক্ষা অধিকর্তার অনুমোদন পাওয়ার আগেই তিনি যে নিজের উদ্যোগে কলেজ সংলগ্ন দুটি বাড়ি যথাক্রমে মাসিক ৩০ টাকা ও ৫০ টাকায় ভাড়া নেওয়ার সুলুকসন্ধানের কাজ সম্পন্ন করেন, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয় বিদ্যাসাগরের অন্য একটি চিঠি থেকে। এখানে উল্লেখ্য, কলেজটিকে সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া এবং বাড়ি ভাড়ার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া – কোনও ক্ষেত্রেই তিনি গর্ডন ইয়ঙের অনুমোদনের তোয়াক্কা করেননি।
নিজের মতো করে সমস্ত বিষয়টি সেরে ফেলার পরে, এ বিষয়ে সরকারের আর্থিক অনুমতির জন্য মহরম উপলক্ষে কলেজ বন্ধ করার দিনে অর্থাৎ ২৪ অগস্ট বিদ্যাসাগর ইয়ংকে জানান –
As other houses are not available in that suitable quarter and as the rent appears to me to be cheap, I would beg your permission to enter into written agreements at once with the proprietors of the houses in question, otherwise I am told they would dispose them to other parties.২৩
ইয়ং তাঁর প্রস্তাবে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি। চিঠি পাওয়ার পরের দিনই তিনি বাংলা সরকারের সচিব বাকল্যান্ড (C.T. Buckland)-কে গোটা বিষয়টি অবহিত করে লেখেন:
In anticipation of the approval of Government, I have permitted the Principal to rent the two houses in question, should he find it absolutely necessary to do so.২৪
ইতিমধ্যে একটি বাড়ি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার জন্য, বিদ্যাসাগর অন্য একটি বাড়ি মাসিক ৭৫ টাকা ভাড়ায় জোগাড় করেন এবং দুটি বাড়ির জন্য মোট মাসিক ১০৫ টাকা ভাড়ার আর্থিক অনুমোদন চেয়ে ৯ সেপ্টেম্বর ইয়ংকে চিঠি লেখেন। ইয়ঙের অনুপস্থিতিতে, কার্যনির্বাহী জনশিক্ষা অধিকর্তা উড্রো সেদিনই বিষয়টি অনুমোদনের জন্য বাকল্যান্ডের কাছে পাঠিয়ে দেন।২৫ ২৮ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার এই ব্যয় মঞ্জুর করার পরে, মাসিক ১০৫ টাকা ভাড়ায় বিদ্যাসাগর দুটি বাড়ি ভাড়া করে সংস্কৃত কলেজের কাজ চালানোর ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ তাঁর কলেজটিকে সেনানিবাসে পরিণত করার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর কোনও আপত্তি জানাননি, এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ইয়ঙের কোনও মতান্তর হয়নি এবং সর্বোপরি এই ঘটনার প্রায় এক বছর পরে, ১৮৫৮-র ৫ অগস্ট জনশিক্ষা অধিকর্তার কাছে বিদ্যাসাগর পদত্যাগপত্র পেশ করেন। তাহলে ঠিক কোন কারণে বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেছিলেন?
এই বিষয়ে সুবল চন্দ্র মিত্র Isvar Chandra Vidyasagar:Story of His Life and Work গ্রন্থে (১৯০২) একাধিক চিঠি উদ্ধৃত করেন। গোটা বইটিতে তিনি তথ্যপ্রমাণ ছাড়া প্রচুর মন্তব্য করলেও অন্তত এই কারণে তিনি প্রত্যেক অনুসন্ধানী পাঠকের কাছে ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকবেন। পরে ১৯৩১ সালে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ-তে সুবল চন্দ্র মিত্রের চিঠিগুলির ভিত্তিতে চাঁচাছোলা ভাষায় বলেন –
অনেকে বলিয়া থাকেন, বালিকা-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত ব্যাপারে ডিরেক্টরের সহিত বিরোধের ফলেই বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেন। কিন্তু হ্যালিডেকে লিখিত বিদ্যাসাগরের একখানি আধা-সরকারী পত্রে প্রকৃত কারণগুলি প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে।২৬
আমরা ব্রজেন্দ্রনাথ-কথিত ‘হ্যালিডেকে লিখিত বিদ্যাসাগরের একখানি আধা-সরকারী’ পত্রটি দেখার আগে, পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ বিষয়ক গোটা ঘটনাক্রমটি সংক্ষেপে দেখে নেব।
দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয় পরিদর্শক প্র্যাট সাহেব ছুটি নিয়ে ইংল্যান্ডে গেলে বিদ্যাসাগরের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ওই শূন্য পদে তিনিই নিযুক্ত হবেন। ১৮৫৭-এর মে মাসে এ বিষয়ে তিনি হ্যালিডেকে লেখেন —
গত শনিবার আপনার সঙ্গে দেখা করে দক্ষিণবঙ্গের ইন্সপেক্টর নিয়োগ সম্পর্কিত দু-একটা কথা বলার অনুমতি চাইলে, আপনি আমাকে এ বিষয়ে একটি লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করার আদেশ দেন। সেই অনুযায়ী আমি বিনীতভাবে প্রস্তাব করছি, যদি আপনি আমাকে ওই পদে নিয়োগ করতে ইচ্ছুক হন, তাহলে সংস্কৃত কলেজে আমার পদে যিনি নিযুক্ত হবেন, তাঁর নিয়োগ সম্পর্কে যেন আমার সঙ্গে পরামর্শ করা হয়। কারণ যাঁদের মধ্যে থেকে বাছাই করা হবে, তাঁদের সম্পর্কে ব্যক্তিগত ধারণা থাকার জন্য আমার মনে হয়, কে ওই পদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত সে বিষয়ে আমিই সুপারিশ করতে পারব। যদি সরকারি ইংরেজি কলেজ ও স্কুল থাকার জন্য [দক্ষিণবঙ্গ] বিভাগটি আমার অধীনে রাখা উপযুক্ত বলে বিবেচিত না হয়, তবে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, অন্তত যে জেলাগুলিতে মডেল স্কুল আছে যেমন – হুগলি, মেদিনীপুর, বর্ধমান ও নদীয়া – সেই জেলাগুলি যেন আমার অধীনে রাখা হয়। যিনি বিভাগীয় পরিদর্শক হিসেবে নিযুক্ত হবেন, তাঁর অধীন কলেজ ও স্কুলগুলি থাকলে কোনও অসুবিধা হবে না।২৭
অর্থাৎ বিদ্যাসাগর নিজেই বলছেন, তিনি দক্ষিণবঙ্গের ইন্সপেক্টর পদের জন্য বিবেচিত হলে তাঁর শূন্য পদে তাঁর নির্বাচিত ব্যক্তিকে নিয়োগ করবেন এবং তিনি নিজে চারটি জেলায় ‘বিশেষ’ পরিদর্শকের পরিবর্তে ‘বিভাগীয়’ পরিদর্শক হবেন। মনে রাখতে হবে, এই সময়ে তাঁর সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন সংস্কৃত কলেজে সহকারী অধ্যক্ষ ছিলেন। একই সঙ্গে প্রথম দিন থেকেই দীনবন্ধু মডেল স্কুলের সহকারী পরিদর্শকও ছিলেন। যদিও এ ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর তাঁর দুটি শূন্য পদে দীনবন্ধুকেই নির্বাচিত করতেন কি না তা জানা যায় না; কিন্তু সে সম্ভাবনা যে ছিল, তা বিদ্যাসাগরের এই চিঠি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।
বিদ্যাসাগরের চিঠির প্রত্যুত্তরে ২৭ মে হ্যালিডে তাঁকে জানান যে, তিনি এপ্রিল মাসে লজ (Mr. Lodge) সাহেবকে ওই পদে নিযুক্ত করেছেন। পদোন্নতির আশা নেই বুঝতে পেরে হতাশ বিদ্যাসাগর ২৯ অগস্ট গর্ডন ইয়ংকে পদত্যাগ করার কথা জানিয়ে লেখেন –
অল্প দিনের মধ্যে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার বিষয়ে আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনি তিন মাসের জন্য শহর ছাড়তে চলেছেন জেনে আমি মনে করি, সে বিষয়ে আপনাকে জানানোর এটাই উপযুক্ত সময়। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পেছনে যে সব কারণ আছে তা প্রকাশ্যে জানানোর চেয়েও বেশি ব্যক্তিগত প্রকৃতির, সুতরাং সেগুলি উল্লেখ করা থেকে বিরত হলাম।২৮
একই চিঠিতে তিনি ইয়ংকে জানান, সংস্কৃত কলেজের কিছু বকেয়া কাজ শেষ করার জন্য আগামী ডিসেম্বর অবধি অধ্যক্ষ পদে থাকার পরে, তিনি যথাযথ ইস্তফাপত্র দাখিল করবেন। এই সময়ের মধ্যে ইয়ং যেন তাঁর পরিবর্তে অন্য কোনও উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে নেন। ৩১ অগস্ট এ বিষয়ে তিনি হ্যালিডেকেও গোটা বিষয়টি জানিয়ে লেখেন:
I may here be permitted to state that I have made up my mind to retire from the public service from January next and that I have intimated my intention to Mr. Young in a demi-official note of which I venture to enclose a copy for your information also.২৯
যদিও হ্যালিডে তাঁকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। ফলে তিনি পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৮৫৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁর পদত্যাগপত্র পেশ না করে, ওই বছরের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮-র মে পর্যন্ত ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
অবশেষে ১৮৫৮-র ৫ অগস্ট তিনি ইয়ংকে জানান,
সরকারি চাকরিজনিত কারণে অবিরত মানসিক পরিশ্রমের ফলে আমার এমন ভগ্নস্বাস্থ্য হয়েছে যে, বাংলার ছোটলাটের কাছে আমার পদত্যাগপত্র দাখিল করতে বাধ্য হলাম।৩০
পদত্যাগের কারণ হিসেবে এবারে তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্য ও অন্যান্য কারণ ছাড়াও তিনি ‘the absence of all further prospects of advancement’ ও ‘the want of that immediate personal sympathy with the present system of education’৩১-এর উল্লেখ করেন। ১৮ অগস্ট ইয়ং বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ পত্রটির প্রতিলিপি বাংলা সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেন এবং সংস্কৃত কলেজ ও নর্মাল স্কুলের দায়িত্ব সহকারী অধ্যক্ষ দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে দেওয়ার অনুরোধ করেন। পাশাপাশি তিনি বিশেষ পরিদর্শকের দায়িত্ব পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গের পরিদর্শকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
সংস্কৃত কলেজ থেকে পদত্যাগের জন্য সরকারিভাবে ইস্তফাপত্র পেশ করার ৪০ দিন পরে, ১৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগর হ্যালিডেকে ব্রজেন্দ্রনাথ উল্লিখিত ‘আধা-সরকারী’ চিঠিটি লেখেন। এই চিঠিতেই লুকিয়ে আছে তাঁর পদত্যাগের আসল রহস্য। ওই চিঠিতে বিদ্যাসাগর জানান —
এ কথা ঠিক, ভগ্নস্বাস্থ্য আমার পদত্যাগের অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু বিবেকবুদ্ধিসম্পন্নভাবে একে একমাত্র কারণ বলতে পারি না। তাই যদি হত, তাহলে আমি লম্বা ছুটির আবেদন করে স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারতাম। ...এছাড়া, দেখেছি পদোন্নতির আর কোনও আশা নেই এবং একাধিকবার আমার ন্যায্য দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। অতএব আশা করি, আপনি স্বীকার করবেন যে আমার অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।৩২ [নজরটান সংযোজিত]
অস্যার্থ বিদ্যাসাগর গর্ডন ইয়ঙের সঙ্গে মতবিরোধের জন্য আদৌ পদত্যাগ করেননি, করেছিলেন নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ না হওয়ার কারণেই। যদিও হ্যালিডে ২৫ সেপ্টেম্বর মন্তব্য করেন –
দুঃখের বিষয় এই যে পণ্ডিত কিঞ্চিৎ অশিষ্টভাবে (ungraciously) অবসর গ্রহণ করা সঙ্গত বিবেচনা করলেন, বিশেষত তাঁর যখন অসন্তোষের কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।৩৩
ওই দিনই সরকারিভাবে বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ মঞ্জুর হয়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ সংক্রান্ত নাটকের এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেনি!
যেহেতু তখনও পর্যন্ত বালিকা বিদ্যালয়গুলির শিক্ষকদের বকেয়া বেতনের বিষয়ে সরকারের অনুমোদন মেলেনি, পদত্যাগপত্র পেশ করার ও তা গৃহীত হওয়ার পরে বিদ্যাসাগর ৫ অক্টোবর ইয়ংকে আবারও লেখেন:
...if you see no particular objection, till the decision of Government on my application for the payment of the bill of the Female Schools is ascertained.৩৪
তত দিনে সরকারিভাবে সংস্কৃত কলেজ, নর্মাল স্কুল ও মডেল স্কুলের দায়িত্ব অন্য ব্যক্তিদের দেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। তাছাড়া কবে সরকারের তরফে বকেয়া আর্থিক অনুমোদন পাওয়া যাবে তারও নিশ্চয়তা নেই, সে কথা জানিয়ে ইয়ং তাঁকে প্রত্যুত্তরে জানান —
As various arrangements have been made and orders issued in regard to the charge of the College, Normal School, Vernacular Schools &c., which it would be very inconvenient now to cancel, and especially as it is uncertain within what time the Supreme Government may issue final orders in the matter of Female Schools, I do not think it will be expedient on public grounds to defer carrying out the new arrangements any longer. Had your note of the 5th been written a week or two ago I dare say your request could have been complied with, but now I think it is too late.
I trust the matter of the Female Schools will be dealt with justly and generously by the Supreme Government and that before long you will be relieved from your present awkward position in regard to these schools.৩৫ [নজরটান সংযোজিত]
ইয়ঙের চিঠিতে স্পষ্ট, বিদ্যাসাগরের আর্থিক দায়ভারের বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন এবং বিদ্যাসাগর তাঁর পদত্যাগপত্র সরকারিভাবে মঞ্জুর হওয়ার আগে এই অনুরোধ করলে, তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে অনুমোদিত হওয়ার পরে, একজন আধিকারিক হিসেবে তাঁর আর কিছু করার ছিল না। এ বিষয়ে প্রথমে সুবল চন্দ্র মিত্র ও পরে শেষোক্ত দুটি চিঠি ছাড়া ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি নথিপত্রগুলি উদ্ধৃত করেছেন। যদিও বিনয় ঘোষ সে সবের উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। হয়তো এই কারণেই বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ গ্রন্থে তিনি এই গ্রন্থদুটির মাত্র একবার উল্লেখ করেছেন!
অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে, বিদ্যাসাগর ১৮৫৮ সালের ৩ নভেম্বর সংস্কৃত কলেজ থেকে পাকাপাকিভাবে পদত্যাগ করেন এবং ৪ নভেম্বর ই. বি. কাওয়েল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগর যখন মাসিক ৫০০ টাকা বেতনের চাকরি ছাড়ছেন, তখন বই বিক্রি থেকে তাঁর আয় মাসে ৫০০ টাকার থেকে ঢের বেশি। বাকল্যান্ড জানিয়েছেন,
Vidyasagar’s monthly benefactions amounted to about Rs. 1,500 and his income from his publications for several years ranged from Rs. 3,000 to Rs. 4,500 a month.৩৬
তত দিনে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে তাঁর লিখিত ও প্রকাশিত একাধিক গ্রন্থকে, সংস্কৃত কলেজ, নর্মাল স্কুল এবং বাংলার একাধিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে ফেলার কাজ সেরে ফেলেছেন তিনি। এমনকি চাকরির একদম শেষ দিকে ১৮৫৮ সালের ৩০ মার্চ, আগামী দু-বছরের জন্য ৮টি নির্বাচিত পাঠ্যপুস্তক বাবদ তাঁকে সরকারি তরফে অগ্রিম ৭,১৫৬ টাকা ৮ আনা বরাদ্দ করাও হয়ে গেছে। তৃতীয় পর্বে আমরা দেখতে পাব বিদ্যাসাগর যখন আর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নন, তখনও তাঁর গ্রন্থব্যবসাতে এই অবাধ ও মসৃণ সরকারি পোষণ অব্যাহত থাকবে।
************************************************************
উল্লেখপঞ্জী:
১. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ১৮৪
২. Brajendranath Banerji, ‘Ishwarchandra Vidyasagar as a Promoter of Female Education in Bengal’ (Based on unpublished State Records), Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. XXIII, 1927, Calcutta, p. 386
৩. তদেব, পৃ. ৩৮৭
৪. তদেব, পৃ. ৩৮৭
৫. I have the honour to state that as some female schools on this footing had already been established with the sanction of the Government, I believed that the plan was generally approved. I invariably reported to your office the establishment of every new school, and usually in the month succeeding that in which it was opened. My several applications for the establishments required in these schools were always entertained by you though no orders were ever passed, and during a period of several months I was not in any way discouraged in the course I was taking, which I believed to be in accordance with the wishes of the Government. তদেব, পৃ. ৩৮৭-৮৮
৬. তদেব, পৃ. ৩৮৮
৭. তদেব, পৃ. ৩৮৯
৮. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ১৮৬
৯. তদেব, পৃ. ১৮৭
১০. Karl Marx, ‘The Revolt in the Indian Army’; The First Indian War of Independence, 1857-1859, Moscow, 1959, p. 40
১১. Ainslie Embree, 1857 in India: Mutiny or War of Independence, Boston, 1963, p. 2
১২. ‘ইংরাজী শিক্ষা’, এডুকেশন গেজেট, ১৪.১. ১২৭৮; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ১৯৯
১৩. ‘সম্পাদকীয়’, সংবাদ প্রভাকর, ৭.৩. ১২৬৪; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, প্রথম খণ্ড, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ২১৭
১৪. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ১৪৪
১৫. ‘ভূমিকা’, নীলদর্পণ; ক্ষেত্র গুপ্ত (সম্পাদিত), দীনবন্ধু রচনাবলী, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃ. ১
১৬. তদেব, পৃ. ১
১৭. ‘ভারত-কলঙ্ক’; যোগেশচন্দ্র বাগল (সম্পাদিত), বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৩৯৭, পৃ. ২৩৯
১৮. তদেব, পৃ. ২৪০-৪১
১৯. ‘বিজ্ঞাপন’, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, প্রথম পুস্তক; গোপাল হালদার (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৭৪, পৃ. ১৫৭
২০. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, 2nd Revised Edition, Kolkata, 2013, p. 239
২১. তদেব, পৃ. ২৪০
২২. তদেব, পৃ. ২৪৩
২৩. তদেব, পৃ. ২৪০-৪১
২৪. তদেব, পৃ. ৩২৭
২৫. তদেব, পৃ. ৩২৮
২৬. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৩৩৮, পৃ. ৭৪
২৭. When I had the honour to wait on you on Saturday last and solicited your permission to make a few suggestions regarding the appointment of an Inspector for South Bengal, you were pleased to direct me to submit a written memorandum upon the subject. I have accordingly availed myself of the permission and beg respectfully to suggest that if you should feel inclined to transfer me to that post, the appointment of my successor in the Sanskrit College may be made in consultation with me, as from an intimate personal knowledge of the several parties from whom the selection may be made, I think I will be best able to recommend the most proper person for the place. If, however, it should be thought inexpedient to place the division under my charge on account of the Government English Colleges and schools in it, I would earnestly solicit that at least the districts in which there are model schools, viz, Hooghly, Midnapur, Burdwan and Nuddea may be placed under me, the colleges and schools being without inconvenience in charge of the person who may be appointed Inspector of the Division.
Subal Chandra Mitra, Isvar Chandra Vidyasagar: Story of His Life and Work, Second Edition, Calcutta, 2013, pp. 215-16
২৮. তদেব, পৃ. ২১৬
২৯. As you are about to leave town for 3 months, I consider this a fitting occasion to intimate to you that I have made up my mind to retire from the public service in a short time. The reasons which have induced me to come to this determination are more of a private than of a public nature, and I, therefore, refrain from mentioning them. তদেব, পৃ. ২১৭
৩০. The unceasing mental exertion required by the discharge of my public duties has now so seriously affected my general health, as to compel me to tender my resignation of the Education service to the Hon’ble the Lieutenant- Governor of Bengal. তদেব, পৃ. ২১৯
৩১. তদেব, পৃ. ২২০
৩২. It is true that ill-health is one of the principal causes which have induced me to resign. But I cannot conscientiously say that that is the sole cause. If it were so, I could have applied for a long leave and renovated my health. …I saw besides no prospects of advancement and more than once I felt my just claims passed over. Thus I hope you will be pleased to admit that I had reasonable grounds of complaint. তদেব, পৃ. ২২১-২২
৩৩. It is to be regretted that the Pundit should have thought fit to make his retirement somewhat ungraciously, especially as he can have no fair reason for dissatisfaction. তদেব, পৃ. ২২৫
৩৪. তদেব, পৃ. ২২৬
৩৫. তদেব, পৃ. ২২৬
৩৬. C. E. Buckland, Bengal under the Lieutenant-Governors, Vol. II, p. 1035; উদ্ধৃত ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ২১১
এখন পর্যন্ত পড়া সেরা পর্ব। অনবদ্য যুক্তি বিন্যাস।
দারুন লাগলো। সমস্ত মিথ আর মিথ্যা কে কেটে খান খান করা হচ্ছে। প্রত্যেকের পড়া উচিৎ এটা।
তবে কি সরল ন্যারেটিভ এই যে বিদ্যাসাগর মেয়েদের ইস্কুলগুলো খুল্লেন উনার বৈ বেচার জন্যে ?
তথ্যসন্ধান অতি চমত্কার - e তো বলার অপেক্ষা রাখে না!
যতই পড়ছি ততই মনে হচ্ছে বাঙ্গালির ঐতিহাসিক ভুল হচ্ছে সমাজসঙ্গস্কারক বলে বিদ্যাসাগরপুজো। ব্যব্সায়ী ঈশ্বর্চন্দ্রের ভজনা করলে সমাজটার একটু তাড়াতাড়ি উন্নতি হতে পারত। যেভাবেই দেখুন, অসামান্য লোক ছিলেন কোন সন্দেহই নেই।
আমার দুটো প্রশ্ন ।
এক, চাকরি করলে প্রমোশনের আশা করা কি অনৈতিক?
দুই, তখন বাংলা ভাষায় সবে দোমাটির কাজ শুরু হয়েছে। বিদ্যাসাগর রচিত প্রাইমারগুলো ছাড়া অন্য কী কী বই উপলব্ধ ছিল? কোন তথ্য।?
শাশ্বতী ও রমিত, অধ্যায়টি আপনাদের ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল।
রঞ্জনবাবু, আপনাকে বলি।
এক, চাকরি করলে প্রোমোশনের আশা করা একদমই অনৈতিক নয়। কিন্তু বিদ্যাসাগর তো নিছক প্রোমোশনে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি তাঁর শূন্য পদে কাকে নির্বাচিত করা হবে সে বিষয়ে ছড়ি ঘোরাতে চান যে! তাও একটি পদে নয়, দু-দুটি পদে অর্থাৎ সংস্কৃত কলেজের পরবর্তী অধ্যক্ষ কে হবেন এবং পূর্ববঙ্গের বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদ কে পাবেন। এটা কি আদৌ নৈতিক? তাছাড়া সিনিয়ার অধ্যাপকদের টপকে নিজের ভাই দীনবন্ধুকে সহকারী অধ্যক্ষের পদে বসানোটা কতটা নৈতিক? এর আগে তিনি সাহিত্যের অধ্যাপকের পদে বসিয়েছিলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে। সেটা কতটা নৈতিক ছিল? তার চেয়েও বেশি বিরক্তিকর তাঁর পদত্যাগের জন্য ইয়ং গর্ডনকে 'ভিলেন' বানানো। বিনয় ঘোষ তো ছড়িয়ে ছত্তিরিশ করেছেন। এত আত্মমর্যাদাবোধ অথচ পদত্যাগ সরকারিভাবে মঞ্জুর হওয়ার পরেও তিনি অধ্যক্ষের পদ আঁকড়ে থাকতে চাইছেন, এটাই বা কতদূর নৈতিক?
দুই, বিদ্যাসাগর শুধু প্রাইমার রচনা করেননি। যদিও তাঁর আগে বাংলা ভাষায় প্রচুর প্রাইমার রচিত হয়েছে, পরেও। আশিস খাস্তগীরকে আমি এক্ষেত্রে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছি। প্রাইমার বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ বাদে যে একাধিক গ্রন্থকে তিনি সরকারি পদের অপব্যবহার করে বিদ্যালয়গুলিতে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে প্রচলন করেন, সেগুলি হল বেতালপঞ্চবিংশতি, বাঙ্গালার ইতিহাস, বোধোদয়, চরিতাবলী, কথামালা এবং জীবনচরিত। এই প্রত্যেকটি গ্রন্থ বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ। সেখানে ঔপনিবেশিক সুর ও স্বর চরম প্রকট। এবং এগুলি ছাড়াও আরও অনেক পাঠ্যপুস্তক ছিল। সরকারের থেকে আগাম দু-বছরের টাকা নিয়ে তিনি বই ছেপেছেন। যে সম্ভাব্য বিক্রির হিসেব তিনি সরকারকে দিয়েছেন, বাস্তবে বিক্রি হয়েছে তার ঢের বেশি। এটা চলেছে ১৮৭২ পর্যন্ত। ভাবা যায়?
মেয়েদের ইস্কুলগুলো,
না, বিদ্যাসাগর একটি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেননি। বেসরকারি উদ্যোগে সেগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শিক্ষকরা বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। বিদ্যাসাগর তাঁদের বেতনের টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন, এমন সরকারি নথি নেই। তিনি কেবল পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যালয়গুলি সম্পর্কে সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছেন। এর এক ইঞ্চি বেশিও করেননি, কমও করেননি। আর মোটে ৩৫ টা বিদ্যালয়ে তাঁর বই বিক্রি করার তেমন গরজ তাঁর ছিল না। আয়ুই তো ছিল সাকুল্যে এক বছর!
ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর? হ্যাঁ, সেও এক ঘটনা বটে! মদনমোহনের শিশুশিক্ষা-র দ্বিতীয় ভাগ ছাপা হয়েছিল ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি থেকে, সংস্কৃত যন্ত্র থেকে নয়। অথচ মদনমোহনের মৃত্যুর পরে সেই বইটিরও কপিরাইট বিদ্যাসাগরের কাছে চলে আসে!! দারুণ না?
না, এখানেই তাঁর ব্যবসা শেষ হয়নি! ১৮৬৯ সালের ৯ অগস্ট বিদ্যাসাগর সংস্কৃত প্রেসের ১/৩ অংশ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও ১/৩ অংশ কালীচরণ ঘোষকে বিক্রি করেন। মানে সেই সময় থেকে সংস্কৃত প্রেসে তাঁর মাত্র ১/৩ অংশ মালিকানা বিদ্যমান থাকে। অথচ শিশুশিক্ষা-র তিনটি ভাগই তাঁর কব্জায় থেকে যায়। কোনও দিন এমন আজব মালিকানার কথা শুনেছেন? তাতে বিদ্যাসাগরের কেমন লাভ হয়েছিল? আজ্ঞে ১৮৮০ সালে শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ-এর শততম সংস্করণ হয়, বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের তখন ৯৪তম সংস্করণ চলছে। ব্যবসা একেই বলে!!!
মানছি, বিদ্যাসাগর কোন মৌলিক রচনা করেননি। কিন্ত বাংলা গদ্যের সেই হাঁটি হাঁটি পা পা যুগে সার্থক মৌলিক রচনা ক'টি? বেশিরভাগই হয় চরিতাবলী নয় অনুবাদ। এটাই স্বাভাবিক। তাই জানতে চাইছি সেইসময়ে আরও কেউ পাঠ্যবই লিখেছিলেন কিনা ?
ধরুন, আপনি যদি সেই সময়ে দায়িত্ব পেতেন তো কার কার বা কী কী বই রাখতে চাইতেন ?
আমার ব্যক্তিগত অভিমত -- বিদ্যাসাগরের বাংলা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের তুলনায় 'অধিক প্রসাদগুণসম্পন্ন'।
বিদ্যাসাগরের ব্যবসায়িক দিকটি বা নেপোটিজম এর দিকটা একটু নতুন ভাবে জানতে পারছি। কিন্তু সেটাকে খারাপ বলতে পারছিনা যতক্ষণ না সেটা সেই সময়ের আইন ভাঙছে। তিনি যদি মোনোপলিস্টিক হয়েও থাকেন , সেটাও কিছু দোষের নয়। মনোপোলি আটকানো সরকারের বা আদালতের কাজ। আমেরিকায় রকফেলার ১৯থ সেঞ্চুরিতে পুরো তেলের ব্যবসা মনোপলি করে নিয়েছিলেন নানা রকম ম্যানিপুলেট করে । শেষ অবধি সরকার আন্টি মনোপলি আইন এনে তার কোম্পানিকে চার ভাগে ভেঙে দেয়। কিন্তু তাকে কোনো ক্রিমিনাল চার্জ লাগাতে পারেনি কারণ তখনকার আইনে তার আগে আন্টি মনোপলি প্রভিশন ছিলই না। তো তাকে আজকে কি বলবেন ?
তাই বিদ্যাসাগর যদি বইয়ের কপিরাইট নিজের কাছে রেখে ও দ্যান , তিনি অর্থলোভী হতে পারেন , ম্যানিপুলেটিভ হতে পারেন । কিন্তু তখনকার কোনো কপিরাইট বা অন্য আইন ভেঙে ছিলেন কি ? নেপোটিজম এর অভিযোগ সত্যি হলেও হতে পারে . কিন্তু এগেন : ওনাকে সর্ব কাম -ক্রোধ -লোভ জয়ী মহাপুরুষ হিসেবে দেখার একদমই কোনো দায় নেই। একজন মানুষ হিসেবে তিনি যেটুকু কাজ করে গ্যাছেন শুধুমাত্তর তার বেসিস এ ওনার মূল্যায়ন করতে চাই । আমি ওনাকে নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে ভাবা এবং কাজের মানুষ হিসেবে ই দেখছি এখনো।
যারাই যেকোনো জিনিস বিক্রি করে - বই হার্ট সক্কলে কিছুটা মনোপলিস্টিক। সে বই হোক সিনেমা হোক , গান হোক , মিষ্টি হোক - সকলেই চায় তাদের জিনিস টা সবাই কিনুক। আর পাশের দোকানের টা যেন কেও না কেনে। এবার পাড়ার মিষ্টির দোকান হলে রটাবে পাশের দোকানের মিষ্টি খারাপ , ওই সিনেমাটা এক্কেরে খাজা , ওই গায়ক মাতাল এইসব। আর আম্বানি আদানি লেভেলের হলে সোজা প্রধানমন্ত্রীদেরকে কিনে নিয়ে মনোপোলি চালাবে। অল্প বিস্তর লোভী তো সবাই। এবার যার যতদূর যাওয়ার বা ম্যানিপুলেট করার ক্ষমতা বা সাহস সে তদ্দুর যায় । আইন ভাঙলে অপরাধী . নাহলে সে জাস্ট লোভী আর মোনোপলিস্টিক , কিন্তু ক্রিমিন্যাল নয়।
আর ব্যবসা র আইন কানুন ও ফিক্সড কিছু নয়। সময়ের সাথে সাথে সব দেশে সমানে ইভল্ভ করছে গত কয়েকশো বছর ধরে। এটা একটা ট্রায়াল & এরর প্রসেস এবং অনেক কিছুই রিলেটিভ। ১৮থ সেঞ্চুরি র ব্যবসার আইন কানুন দিয়ে কি আজকের সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি বা টেক কোম্পানি গুলোকে চালানো যাবে ? পাল্টাতে হবে।
আর সিপাহী বিদ্রোহে একা বিদ্যাসাগর কেন ? পুরো বাঙালি জমিদার ক্লাস বা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্রলোক এর ক্লাস টাই পুরোপুরি ব্রিটিশদের সাপোর্ট করেছিল। সেটাও তখনকার হিসেবে ভালো না খারাপ - এর কোনো সোজাসুজি উত্তর হয়না -এটাও একটা রিলেটিভ স্ট্যান্ড। সিপাহী বিদ্রোহ সফল হলে আজকের ইন্ডিয়া কিরকম হতো কোথায় দাঁড়াতো সে সবই হয় লার্নড বা আবেগের স্পেকুলেশন। কোনো টাই ফাক্টস নয় . তাই ওটা নিয়ে আলাদা করে বিদ্যাসাগর কে ধরার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। আর তিনি কোনোকালেই বিপ্লবী ছিলেননা। সবার হওয়ার দরকারও নেই।
রঞ্জনবাবু, //তাই জানতে চাইছি সেইসময়ে আরও কেউ পাঠ্যবই লিখেছিলেন কিনা ?//
কেন লিখবেন না? গাদা গাদা ইস্কুল হচ্ছে অথচ আর কেউ পাঠ্যবই লিখবে না? হ্যাঁ, লেখা হয়েছে। ইতিহাস নিয়ে লিখিত হয়েছে নীলমণি বসাকের ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৫৮), কেদারনাথ দত্তের ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৫৯), শ্যামধন মুখার্জির মুর্শিদাবাদের ইতিহাস (১৮৬৪), রাজকৃষ্ণ মুখার্জির প্রথম শিক্ষা বাংলার ইতিহাস (১৮৭৪) ইত্যাদি। বিদ্যাসাগর-সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন চরিতমালা।
সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের সহপাঠী ছিলেন মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ। এহেন মুক্তারাম ১৮৫২ সালে চার্লস ল্যামের টেলস ফ্রম শেক্সপীয়ার অবলম্বনে অপূর্বোপাখ্যান রচনা করেন। পরের বছরে প্রকাশ করেন আরবীয়োপাখ্যান-এর প্রথম খণ্ড। তিনি এই দুটি বইকেই স্কুলপাঠ্য করতে চাইলে বইদুটি বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাঠের উপযোগী কি না, সে বিষয়ে সরকার বিদ্যাসাগরের মত জানতে চায়। বিদ্যাসাগর দুটি বইকেই ছাত্রপাঠ্য হিসেবে অনুপযোগী বলে ঘোষণা করেন।
১৮৫৭ সালের গোড়ার দিকে শ্রীরামপুরের তমোহর প্রেসের মালিক শ্রীনাথ দে কালিদাস মৈত্রের লেখা বাষ্পীয় কল ও ভারতবর্ষীয় রেলওয়ে, ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ এবং ভূগোল-বিজ্ঞাপক – এই তিনটি বই পাঠ্যতালিকাভুক্ত করার জন্য সরকারের কাছে পাঠান। সরকার বইগুলি সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মতামত জানতে চাইলে বিদ্যাসাগর জানান যে, তিনটি বই-ই যথেষ্ট অশুদ্ধ ও জড়তাগ্রস্ত ভাষায় লেখা। ফলে বই তিনটিকে কোনও মতেই স্কুলপাঠ্য করা যায় না। যদিও কালিদাস মৈত্রের ভূগোল বইটিকে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ছাড়পত্র দিলে সংস্কৃত প্রেস প্রকাশিত বাজার সংকুচিত হয়ে পড়বে – বিদ্যাসাগরের মনে এই আশঙ্কা কাজ করেছিল কি না, তা জানা সম্ভব নয়। তবে প্রথমে ১৮৫৮ সালের ৩০ মার্চ ও পরে ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর, বিদ্যাসাগর যে তাঁর ভূগোল বিবরণ-এর জন্য সরকারের থেকে আগাম বাবদ যথাক্রমে ১০৩১ টাকা ৪ আনা (১৫০০ কপি) ও ২৫৭৮ টাকা ২ আনা (৫ হাজার কপি) পেয়েছিলেন, সেই বিষয়টি বিবেচনা করলে বিদ্যাসাগরের আশঙ্কাকে অমূলক মনে করা যায় না।
পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিদ্যাসাগরের পেশাগত রেষারেষির উল্লেখ করেছেন কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যও। তিনি বলেছেন —শ্যামাচরণ [সরকার] বাবু খাঁটি বিশুদ্ধ বাঙ্গালা ভাষায় একখানা ব্যাকরণ লিখিয়াছিলেন। এখন মনে হয় যে, বইখানি বাস্তবিকই খুব ভাল হইয়াছিল, কিন্তু যেমন পুস্তকখানি প্রকাশিত হইল, অমনই বিদ্যাসাগর সে বইখানাকে pooh pooh করিলেন, আমরাও সকলে বিদ্যাসাগরের সহিত যোগ দিলাম। শ্যামাচরণ বাবু মাথা তুলিতে পারিলেন না।
//আমার ব্যক্তিগত অভিমত -- বিদ্যাসাগরের বাংলা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের তুলনায় 'অধিক প্রসাদগুণসম্পন্ন'।//
এটা আলোচনা করতে গেলে মৃত্যুঞ্জয় ও বিদ্যাসাগরের গদ্যকে পাশাপাশি রেখে বিচার করতে হবে। পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রাজাবলি-তে (১৮০৮)-এ লেখেন,
যে সিংহাসনে কোটি ২ [কোটি] লক্ষ স্বর্ণদাতারা বসিতেন সে সিংহাসনে মুষ্টিমাত্র ভিক্ষার্থী অনায়াসে বসিল। যে সিংহাসনে বিবিধপ্রকার রত্নালঙ্কারধারিরা বসিতেন সে সিংহাসনে ভস্মবিভূষিত সর্বাঙ্গ কুযোগী বসিল। যে সিংহাসনে অমূল্য রত্নময় কিরীটধারি রাজারা বসিতেন সেই সিংহাসনে জটাধারী বসিল। যে সিংহাসনস্থ রাজারদের নিকটে অনাবৃত অঙ্গে কেহ যাইতে পারিত না সেই সিংহাসনে স্বয়ং দিগম্বর রাজা হইল। যে সিংহাসনস্থ রাজারদের সম্মুখে অঞ্জলীকৃত হস্তদ্বয় মস্তকে ধারণ করিয়া লোকেরা দাঁড়াইয়া থাকিত সেই সিংহাসনের রাজা স্বয়ং ঊর্ধ্ববাহু হইল।
এমনকি রাজাবলি-র অনেক আগে প্রকাশিত বত্রিশ সিংহাসন-এ (১৮০২) তিনি ‘সাধু’ গদ্যের ব্যবহার করেন এই ভাষায় —
এই বৃত্তান্ত লোক পরম্পরাতে ধারাপুরীর রাজা ভোজ শুনিলেন। অনন্তর রাজা কৌতুকাবিষ্ট হইয়া মন্ত্রী সামন্ত সৈন্য সেনাপতির সহিত মঞ্চের নিকটে গিয়া কৃষকের ব্যবহার প্রত্যক্ষ দেখিয়া আপনার অত্যন্ত বিশ্বাসপাত্র এক মন্ত্রীকে মঞ্চের উপরে বসাইলেন। সেই মন্ত্রী যাবত মঞ্চের উপর থাকে তাব্ত রাজাধিরাজের প্রায় প্রতাপ ও শাসন ও মন্ত্রণ করে। ইহা দেখিয়া রাজা চমৎকৃত হইয়া বিচার করিলেন যে এ শক্তি মঞ্চের নয় এবং কৃষকেরও নয় এবং মন্ত্রীরও নয় কিন্তু এ স্থানের মধ্যে চমৎকার কোনহ বস্তু আছেন তাহারি শক্তিতে কৃষক রাজাধিরাজ প্রায় হয়। ইহা নিশ্চয় করিয়া দ্রব্যে উদ্ধার কারণ সেই স্থান খনন করিতে মহারাজ আজ্ঞা দিলেন। আজ্ঞা পাইয়া ভৃত্যবর্গেরা খনন করিল তৎপরে সেই স্থান হইতে প্রবাল মুক্তা মাণিক্য হীরক সুর্যন্ত চন্দ্রকান্ত নীলকান্ত পদ্মরাগ মণিগণেতে জড়িত বত্রিশ পুত্তলিকাতে শোভিত তেজোময় এক দিব্য রত্নসিংহাসন উঠিলেন।
…যে স্থানে ত্রেতাবতার ভগবান রামচন্দ্র, দুর্বৃত্ত দশাননের বংশধ্বংসবিধানবাসনায়, মহাকায় মহাবল কপিবল সাহায্যে, শতযোজনবিস্তীর্ণ অর্ণবের উপর, লোকাতীত কীর্তিহেতু সেতুসঙ্ঘটন করিয়াছিলেন, তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, কল্লোলিনীবল্লভের প্রবাহমধ্য হইতে, অকস্মাৎ এক স্বর্ণময় ভূরুহ বিনির্গত হইল; তদুপরি এক পরম সুন্দরী রমণী, বীণাবাদনপূর্বক, মধুর স্বরে সঙ্গীত করিতেছে। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সেই বৃক্ষ কন্যা সহিত জলে মগ্ন হইয়া গেল। এই অদ্ভুত ব্যাপার দর্শনে বিস্ময়সাগরে মগ্ন হইয়া, তীর্থপর্যটন পরিত্যাগপূর্বক, আমি আপনকার নিকট ঐ বিষয়ের সংবাদ দিতে আসিয়াছি।
নিউটন সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের অনুবাদের সামান্য নমুনা এইরকম –
পাঠশালার সকল বালকই, বিরামের অবসর পাইলে, খেলায় আসক্ত হইত; কিন্তু তিনি সেই সময়ে নিবিষ্টমনা হইয়া, ঘরট্ট প্রভৃতি যন্ত্রের প্রতিরূপ নির্মাণ করিতেন। একদা, তিনি একটা পুরাণ বাক্স লইয়া জলের ঘড়ী নির্মাণ করিয়াছিলেন। ঐ ঘড়ীর শঙ্কু, বাক্সমধ্য হইতে অনবরতবিনির্গতজলবিন্দুপাত দ্বারা নিমগ্নকাষ্ঠখণ্ডপ্রতিঘাতে, পরিচালিত হইত; বেলাববোধনার্থ তাহাতে একটি প্রকৃত শঙ্কুপট্ট ব্যবস্থাপিত ছিল।
এবারে নিজে বিচার করুন প্রায় ৫০ বছরের ব্যবধানে বিদ্যাসাগরীয় গদ্য মৃত্যুঞ্জয়ের থেকে কতটা আলাদা।
বিদ্যাসাগরীয় গদ্যের তীব্র সমালোচনা করে শিবনাথ শাস্ত্রী জানান —
একদিকে পণ্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অপরদিকে খ্যাতনাম অক্ষয়কুমার দত্ত, এই উভয় যুগপ্রবর্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত-বহুল হইয়া দাঁড়াইল। বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয়বাবু উভয়ে সংস্কৃত-ভাষাভিজ্ঞ ও সংস্কৃত-ভাষানুরাগী লোক ছিলেন; সুতরাং তাঁহারা বাঙ্গালাকে যে পরিচ্ছদ পরাইলেন তাহা সংস্কৃতের অলঙ্কারে পরিপূর্ণ হইল। অনেকে এরূপ ভাষাতে প্রীতিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ লোকের নিকট, বিশেষতঃ সংস্কৃতানভিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের নিকট, ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন ও দুর্বোধ্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
১২৮৮ বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শন-এর শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লেখেন,
কথাটি এই যে, যাঁহারা এ পর্যন্ত বাংলাভাষায় লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাঁহার কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই। হয় ইংরেজি পড়িয়াছেন, না-হয় সংস্কৃত পড়িয়াছেন, পড়িয়াই অনুবাদ করিয়াছেন। কতকগুলি অপ্রচলিত সংস্কৃত ও নূতন গড়া চোয়ালভাঙা কথা চলিত করিয়া দিয়াছেন। নিজে ভাবিয়া কেহ বই লেখেন নাই, সুতরাং নিজের ভাষায় কী আছে না আছে তাহাতে তাঁহাদের নজরও পড়ে নাই।
মনে রাখতে হবে শিবনাথ এবং হরপ্রসাদ দুজনেই বিদ্যাসাগরের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন।
অমিত, //সেটাকে খারাপ বলতে পারছিনা যতক্ষণ না সেটা সেই সময়ের আইন ভাঙছে।//
আমার জ্ঞানমতে ভারতীয় কপিরাইট আইন চালু হয় ১৯১৪ সালে। বিদ্যাসাগরের আমলে সেই আইন ছিল কি না আগে জানান, তারপরে সেই নিয়ে আলোচনা করা যাবে।
//সিপাহী বিদ্রোহে একা বিদ্যাসাগর কেন ? পুরো বাঙালি জমিদার ক্লাস বা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্রলোক এর ক্লাস টাই পুরোপুরি ব্রিটিশদের সাপোর্ট করেছিল।//
আমি একা বিদ্যাসাগরের কথা বলিনি তো। একাধিক সমকালীন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের উল্লেখ করেছি। সঙ্গে দিয়েছি দীনবন্ধু ও বঙ্কিমের বক্তব্য। সেটা ভুল হলে অবশ্যই বলবেন।
এলেবেলে এটা আপনি ঠিক বলেছেন, ওই সময় অনেক বাঙালি ই সিপাহি বিদ্রোহের বিিিওরর ধী তা করেছিলেন কিিনতু তার মানে এটা নয় যে তা করা টা ঠিক ছিল। অনেকেই ইতালি তে মুসোলিনি কে সাাপোর্ট করে ছিলেন বা রাশিয়ায় স্তালিিন কে। তার মানে এটা নয় তারাা ঠিক ছিলেন
এসব ব্যাপারে ঠিক ভুল বলে কিচ্ছু হয়না। ইতিহাসে যত ইভেন্ট ঘটেছে, সবকটাই অনেকগুলো পসিবল পার্মুটেশন এর মধ্যে জাস্ট একটা ঘটে গেছে কোনো কারণে। অন্য অনেকগুলোই ঘটতে পারতো , কিন্তু সেই সময় ক্লিক করেনি এক বা অনেক ফ্যাক্টরের জন্যে । ফিক্সড আউটকাম বলে কিছু হয়না। ১০০-১৫০ বছর পরে জাস্ট পেছনে ফিরে দেখা যায় কি ঘটেছে আর পার্মুটেশন করে হিসেব করা যায় আর কি কি ঘটতে পারতো সেই ফ্যাক্টর গুলো না থাকলে।
তখন সিপাহী বিদ্রোহ সফল হলে আজকের ইন্ডিয়া কিরকম হতো , কটা দেশ হতো , কে রাজ্যত্ব করতো বা বাঙালিদের অবস্থাই বা কিরকম হতো সবই জাস্ট সেইরকম সব স্পেকুলেশন। এর আর কোনো সিগ্নিফিক্যান্স নেই। যারা এর ফর বা এগেনস্ট এ ছিলেন , তারাও কেও ঠিক ভুল কিছু নন , জাস্ট নিজের রোল প্লে করেছিলেন।
এলেবেলেদা-
আমার কাছে কোনো রেফারেন্স নেই কপিরাইট আইন এর। কিন্তু আপনি রঞ্জন দা কে লিখলেন যে :"এখানেই তাঁর ব্যবসা শেষ হয়নি! ১৮৬৯ সালের ৯ অগস্ট বিদ্যাসাগর সংস্কৃত প্রেসের ১/৩ অংশ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও ১/৩ অংশ কালীচরণ ঘোষকে বিক্রি করেন। মানে সেই সময় থেকে সংস্কৃত প্রেসে তাঁর মাত্র ১/৩ অংশ মালিকানা বিদ্যমান থাকে। অথচ শিশুশিক্ষা-র তিনটি ভাগই তাঁর কব্জায় থেকে যায়। কোনও দিন এমন আজব মালিকানার কথা শুনেছেন? "
আমার প্রশ্ন হলো: - এই প্রেস বিক্রি র চুক্তি টা আজব শোনাতে পারে আপনার আমার কাছে, কিন্তু বেআইনি কি ? তাহলে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা ১/৩ অংশ কালীচরণ ঘোষ এনারা আদালতে এর এগেনস্টে মামলা করলেন না কেন ? তারা তো আরো বেশি লাভের অংশ পেতেন তাহলে। কিসের ভয়ে তারা বসে ছিলেন ?
আপনার তথ্য নিয়ে প্রশ্নটা নয়। আমি ধরেই নিচ্ছি তথ্যগুলো সঠিক । আমি নিজে এবিষয়ে অত পড়াশোনা করিনি আর সম্ভবও নয়। প্রশ্ন এসবের ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে। আমাদের কাছে কিছু আজব লাগলেই সেটা বেআইনি হতে পারেনা।
অমিত, আমি লেখাটা শুরু করেছি পলাশি থেকে, শেষ হবে বঙ্গভঙ্গে। প্রায় ১৫০ বছরের দীর্ঘ জটিল ইতিহাস। সেখানে সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে আমি কোনও স্পেকুলেশন করিনি ঠিকই, কিন্তু এটাও ঠিক বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি তার বিরোধিতা করেছিল। যদিও এর পরেই শুরু হবে হিন্দু মেলা। একদা বাপের এক গেলাসের ইয়ার রাজনারায়ণ বসু তার সলতে পাকাবেন। কিছু পরে ১৮৭২ নাগাদ এই হিন্দু মেলার রিট্যালিয়েশন আসবে দুটো তরফ থেকে - বাংলার মুসলমান ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়। তাঁদের সঙ্গে এই রাজনারায়ণ অ্যান্ড কোং কী আচরণ করেছিলেন, সেটা পরের অধ্যায়ে বিস্তারিত আসবে। দেখা যাবে বঙ্গভঙ্গের সময়ে এই দুটি সম্প্রদায়কে হাজার চেষ্টা করেও রবীন্দ্রনাথরা 'এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন' গাওয়াতে পারছেন না। তারপরে কী হল জানে শ্যামলাল!
আরে বাবা যদি আইনই না থাকে তাহলে মামলা করে কী ঘন্টার লাভ হবে? তাই মামলা হয়নি। যেমন মদনমোহনের সঙ্গে টাকাপয়সার সালিশি হয়েছিল তিনজনের সামনে। সেখানে শিশুশিক্ষা-র প্রসঙ্গই ওঠেনি। যেমন দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন সংস্কৃত প্রেসের মালিকানা দাবি করেছিলেন পারিবারিক সম্পত্তির অংশ হিসেবে। সেখানেও সালিশি। আর স্বয়ং বিদ্যাসাগরের করা উইলের কী পরিণতি তাঁর সুপুত্তুর করেছিলেন, সেটা সবাই জানেন।
কথা হয়েছিল নৈতিকতার প্রসঙ্গে। বিদ্যাসাগর তাঁর একাধিক পাঠ্যপুস্তকে নীরস নীতিকথা গুঁজতে গুঁজতে গেছেন ঠিকই, কিন্তু নিজে সে সবের ধারপাশ দিয়েও যাননি। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, প্রথম বিধবাবিবাহটি আসলে ছিল একই সঙ্গে বহুবিবাহ (শ্রীশচন্দ্র দোজবরে ছিলেন)-বাল্যবিবাহ (১৮৫০ সালে বিদ্যাসাগর যার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন)-বিধবাবিবাহের আশ্চর্য ত্রিবেণীসঙ্গম, যেখানে বিদ্যাসাগর নিজের পকেট থেকে খরচ করেছিলেন তৎকালীন আমলে দশ হাজার টাকা। অবিশ্যি তার আগে নারাজ শ্রীশচন্দ্রকে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন পাত্রীর মা আর ওই বিবাহের মাত্র এক সপ্তাহ আগে শ্রীশচন্দ্রকে রাতারাতি জজপণ্ডিতের পদ ভেট দিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁকে রাজি করান। গুণধর শ্রীশচন্দ্র কালীমতি মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই একটি 'অপাপবিদ্ধা কুমারীকে বিয়ে করেন! কিছু বলবেন?
বিধবাবিবাহ বাস্তবায়িত করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর চূড়ান্ত আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেছেন। পরে আক্ষেপ করেছেন সমাজের লোক অসার ও অপদার্থ জানলে উনি আইন পাস করিয়েই থেমে যেতেন। বড্ড আদর্শবাদী লোক।
বিধবাবিবাহ তারপরেও বাস্তবায়িত হয়েছিল? বরং যাঁদের মধ্যে চালু ছিল তাঁদের ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাসাগর ইহজীবনে তাঁদের চিন্তাভাবনার আওতাতেও রাখেননি। আর বাল্যবিবাহ চালু থাকবে, বহুবিবাহ চালু থাকবে অথচ বিধবাবিবাহ সফল হবে - এটা হচ্ছে ফুটো কলসিতে জল ঢালার কঠোর বিকল্প। কেন আইনটা পাশ হয়েছিল এবং সেখানে মেয়েদের ক ইঞ্চি অধিকার দেওয়া হয়েছিল, সে ব্যাপারে পৃথিবীর তাবৎ কবি নীরব থাকতে ভালোবাসেন!
আচ্ছা, বহুবিবাহ আছে বলেই কি মুসলমান সমাজে বিধবাবিবাহ হয় না?
মুসলমান সমাজে বিধবা বিবাহ হয় না?
এই সেরেছে! মুসলমান সমাজে তো বিধবাবিবাহ কোনও ঘটনাই নয়। খাদিজা নিজেই তো বিধবা ছিলেন। তার সঙ্গে বহুবিবাহের কী সম্পর্ক? তাছাড়া উনিশ শতকে হিন্দু কুলীন বাউনরা তো গাদাগুচ্ছের বিয়ে করতেন। তাই জন্য তাঁরা বিধবাবিবাহ করেননি, তা-ও তো নয়।
ইয়ে সব মুসলমান বহুবিবাহ করতেন নাকি? সেরকম তথ্য থাকলে দেবেন তো, বড়ই কৃতজ্ঞ থাকব।
এলেবেলে দা, হেইডা কি কইলেন। এটা কোনো লজিক হলো আদৌ -? নিতান্ত চোর ছ্যাঁচোড় মানুষ ও তো নিজের ছেলে মেয়েদের ছোটবেলায় ভালো হতেই উপদেশ দেয়। বিদ্যাসাগর নিজে অর্থ লোভী ব্যবসায়ী হতেও পারেন হয়তো , কিন্তু স্কুলের বাচ্চাদের নীতিকথার বইতে তিনি আর কি লিখবেন ? বা লিখলেও সেটা টু দা পয়েন্ট ফলো করতে হবে সেটা র দিব্যি কে দিয়েছে ? নাকি ওনার বইতে বাচ্চাদের ব্যবসা শেখানো উচিত ছিল ? আজব লজিক। ওনাকে আদর্শ মানুষ বা মহাপুরুষ হিসেবে তো আপনি নিজেই দেখতে চাইছেন মনে হচ্ছে নামলে এসব চেরি পিকিং এর দরকারই নেই ।
শ্রীশচন্দ্র একটি আস্ত দুনম্বরি লোক হলে তার দায় বিদ্যাসাগর এর ঘাড়ে চাপে কেন ?আর বিধবা বিবাহ , বাল্য বিবাহ , বহু বিবাহ সবকটা সংস্কারের দায় ওনাকে একা নিতে হবে কেন ? সমাজের বাকি যাবতীয় মান্যিগণ্যি লোকেরা কি ওনার একার ঘাড়ে সব ফেলে নিজেরা নাকে তেল মেরে ঘুমোবেন আর কিছু ভুল হলে সমালোচনা করবেন ? তখন এসব বার্নিং ইস্যু নিয়ে আর কে কে এগিযে এসেছিলেন ?
বাঙালি সমাজে হিন্দু মুসলিম ডিভাইড ও সিপাহী বিদ্রোহে আর ঢুকছিনা কারণ ওগুলো মূল লেখা থেকে ডিগ্রেস করে যাবে। কিন্তু বিদ্যাসাগর কি কোনোভাবে হিন্দু মুসলিম ডিভাইডকে ডাইরেক্টলি উসকে ছিলেন ? নাহলে এর মধ্যে ওনাকে টানার কি দরকার বুঝছিনা।
আর বিধবা বিবাহ র ইনিশিয়েটিভ সফল কি ব্যর্থ -তাই নিয়ে বিদ্যাসাগর কে গাল দিয়ে আদৌ লাভ আছে ? আমার স্কুলের এক বন্ধু একজনকে বিয়ে করায় তার বাবা মা তার সাথে দুবছর যোগাযোগ রাখেনি, বিয়েতে আসা তো দূরে থাক। আমার নিজের ক্ষেত্রে হলে আমার ঘরে কিছু আলাদা হতো বলে তো ভরসা হয়না। হয়নি , তাই জানিনা।
এই ২১স্ট সেঞ্চুরিতে এইরকম ডাইনোসর মেন্টালিটির লোকজন নিজের ঘরে ঘরে, আশেপাশে হাজারে হাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের মেন্টালিটি পাল্টানোর ক্ষমতা আছে কারোর ? অনেকে আবার তার মধ্যে হিপোক্রিটের চূড়ান্ত , মুখে পণপ্রথা , ডিভোর্স , বিধবা বিবাহ এসব নিয়ে লম্বা লম্বা লেকচার মারে , কিন্তু নিজের ঘরে একটা হলেই তখন পুরো সুর পাল্টে যায়।
আজকের এই সময়ে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত সভ্য বাঙালির এই হাল। তাহলে সেই সময় সাহস করে একটা প্রথম স্টেপ নিতে গিয়ে ওনার হাল কি হয়েছিল সেটা আন্দাজ করতে কি কষ্ট হয় ? সেই স্টেপ গুলো সফল নাহলেও কিছু আসে যায়না , কারণ যদি কুসংস্কারে ডুবে থাকা একটা জগদ্দল সমাজের (শুধু বাঙালি বলছিনা পুরো দেশটাকেই ধরেছি ) এক -% ও চেন্জ হয়ে থাকে তার পেছনে সেই এক দুটো ইনিশিয়াল স্টেপস জরুরি ছিল। বরং এটাই লজ্জার যে ওনার প্রথম স্টেপ নেওয়ার পরে বাঙালিদের মধ্যে আর কেও সাহস করে এগিয়ে আসতে পারেনি বাকি রাস্তা টা হাঁটার জন্যে.
বক্তব্য ১ঃ "বাল্যবিবাহ চালু থাকবে, বহুবিবাহ চালু থাকবে অথচ বিধবাবিবাহ সফল হবে - এটা হচ্ছে ফুটো কলসিতে জল ঢালার কঠোর বিকল্প।"
বক্তব্য ২ঃ "মুসলমান সমাজে তো বিধবাবিবাহ কোনও ঘটনাই নয়। খাদিজা নিজেই তো বিধবা ছিলেন। তার সঙ্গে বহুবিবাহের কী সম্পর্ক?"
বুঝ লোক যে জান সন্ধান।
Hmm, আপাতত এটা হজম করে নিন ---
১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হওয়ার পর উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত কয়েকটি মাত্র বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তার অধিকাংশই বিদ্যাসাগরের নিজের উদ্যম ও অর্থব্যয়ে অথবা তাঁর একান্ত ভক্তদের প্রচেষ্টায়। তাও দেখা গেছে বিধবাবিবাহ যাঁরা করতে অগ্রণী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে সাময়িক অর্থলোভে শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন, কোনও আদর্শপ্রীতির জন্য বিবাহ করেননি। বিধবাবিবাহ হিন্দুসমাজ গ্রহণ তো করেই নি,শিক্ষিত উচ্চসমাজে যাঁরা আদর্শের দিক থেকে একদা তা সমর্থন করেছিলেন,তাঁরাও কার্যক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করতে পারেননি। বিধবাবিবাহের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সামাজিক প্রথা, যেমন নারীর অর্থনৈতিক পরাধীনতা, যৌথ পরিবার, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি - যেমন ছিল ঠিক তেমনি রেখে শুধু প্রথা হিসেবে বিধবাবিবাহ সমাজে প্রচলিত হতে পারে না। ... তাই বিধবাবিবাহ ব্যর্থ হয়েছে,নারীর পরাধীনতা,যৌথ পরিবার সবই বজায় থেকেছে,এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিবারণের জন্য শেষ পর্যন্ত ইংরেজরাই কোনো আইন পাশ করতে চাননি।
বিনয় ঘোষ – বাংলার নবজাগৃতি
অমিত, দুঃখিত আপনার মন্তব্যের উত্তর দিতে দেরি হল। আপনি একাধিক প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এর প্রত্যকেটিই বাঙালির প্রিয় প্রশ্ন কিন্তু উত্তর অজানা। হয় তাঁরা উত্তর খোঁজার পরিশ্রম করেন না কিংবা তাঁদের উত্তরগুলো পছন্দসই হয় না। আপনি সেই গোত্রের নন। তাই আমার তরফ থেকে আপনাকে উত্তর দেওয়ার সামান্য প্রচেষ্টা।
১. //কিন্তু স্কুলের বাচ্চাদের নীতিকথার বইতে তিনি আর কি লিখবেন ?//
সোজা বাংলায় স্কুলের বাচ্চাদের জন্য নীতিকথা লিখিতই হবে না কারণ ওতে বিন্দুমাত্র কাজ হয় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাধিক প্রবন্ধে এই প্রবণতার চরম সমালোচনা করেছেন। আমি একটা সামান্য নমুনা দিচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাসমস্যা প্রবন্ধে লিখছেন, “সংসারে কৃত্রিম জীবনযাত্রায় হাজার রকমের অসত্য ও বিকৃতি যেখানে প্রতি মুহূর্তে রুচি নষ্ট করিয়া দিতেছে সেখানে ইস্কুলে দশটা-চারটের মধ্যে গোটাকতক পুঁথির বচনে সমস্ত সংশোধন করিয়া দিবে ইহা আশাই করা যায় না। ইহাতে কেবল ভূরি ভূরি ভানের সৃষ্টি হয় এবং নৈতিক জ্যাঠামি, যাহা সকল জ্যাঠামির অধম, তাহা সুবুদ্ধির স্বাভাবিকতা ও সৌকুমার্য নষ্ট করিয়া দেয়।” চাইলে এইরকম উদাহরণ আরও দেওয়া যায়।
২. //শ্রীশচন্দ্র একটি আস্ত দুনম্বরি লোক হলে তার দায় বিদ্যাসাগর এর ঘাড়ে চাপে কেন ? আর বিধবা বিবাহ , বাল্য বিবাহ , বহু বিবাহ সবকটা সংস্কারের দায় ওনাকে একা নিতে হবে কেন ? ...তখন এসব বার্নিং ইস্যু নিয়ে আর কে কে এগিযে এসেছিলেন ? ... বরং এটাই লজ্জার যে ওনার প্রথম স্টেপ নেওয়ার পরে বাঙালিদের মধ্যে আর কেও সাহস করে এগিয়ে আসতে পারেনি বাকি রাস্তা টা হাঁটার জন্যে//
শ্রীশচন্দ্রকে বিধবাবিবাহের আইডল বয় হিসেবে এন্ডোর্স করলে তার দায় বিদ্যাসাগরের ঘাড়ে চাপে বইকি। বিশেষত যেখানে বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যাঁকে জজপণ্ডিতের ভেট দিয়ে বিয়েতে রাজি করাতে হয়, সেখানে আরও চাপে।
হ্যাঁ, বাল্যবিবাহ নিয়ে সারা জীবনে বিদ্যাসাগর একটি প্রবন্ধ লিখলেও সেই আন্দোলন ওখানেই থেমে যায়নি। ১৮৫২-তে সংবাদ প্রভাকর, ১৮৫৪-তে বিবিধার্থ সংগ্রহ এবং ১৮৫৭-তে বঙ্গবিদ্যাপ্রকাশিকা-য় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একাধিক লেখা প্রকাশিত হয়। ১৮৫৯-এ শ্রীপতি মুখোপাধ্যায় ও ১৮৬০-এ শ্যামাচরণ শ্রীমানি রচনা করেন যথাক্রমে বাল্যবিবাহ ও বাল্যোদ্বাহ নাটক শীর্ষক দুটি নাটক। পরবর্তীকালে ১৮৭০-এ সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বাল্যবিবাহের কুফল দেখিয়ে লেখেন বাল্যবিবাহ। রামচন্দ্র দত্তের বাল্যবিবাহ নাটক প্রকাশিত হয় ১৮৭৪-এ। ১৮৭৫ সালের ২ জুলাই ভারত সংস্কারক পত্রিকায় ভুবনেশ্বর মিত্র ‘হিন্দুবিবাহ সমালোচনা’-য় বাল্যবিবাহের তীব্র নিন্দা করেন।
১৮৬২ সালে বিধবাবিবাহ করেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের পিতামহ গুরুচরণ মহলানবিশ। বিদ্যাসাগর সেই বিবাহ হিন্দুমতে না হওয়ায় আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও যাননি। ১৮৭২-এ কেশব সেনের উদ্যোগে তিন আইন পাশ হয়। সেখানে বিধবাবিবাহ ছাড়াও মেয়েদের ডিভোর্সের অনুমতি প্রদান, অসবর্ণ বিবাহ, বাল্যবিবাহের বিরোধিতা ইত্যাদি গুচ্ছ প্রগতিশীল ধারণা গৃহীত হয়। বিদ্যাসাগর এর ত্রিসীমানায় ছিলেন না। আর বহুবিবাহ নিয়ে দুটি বই লেখা ছাড়া বিদ্যাসাগর আর কিছু করেননি। বরং এই সুযোগে মনুকে এন্ডোর্স করেছেন।
৩. //বিদ্যাসাগর কি কোনোভাবে হিন্দু মুসলিম ডিভাইডকে ডাইরেক্টলি উসকে ছিলেন ? নাহলে এর মধ্যে ওনাকে টানার কি দরকার বুঝছিনা।//
প্রত্যক্ষভাবে করেননি কিন্তু পরোক্ষভাবে যথেষ্ট করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক মোহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, “প্রথমে চাই মুসলমান বালক বালিকাদিগের পাঠ্যপুস্তক। কি পরিতাপের বিষয়, আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভাল ছেলে। কাসেম বা আবদুল্লা কেমন ছেলে, সে তাহা পড়িতে পায় না। এখান হইতেই তাহার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে পাঠ্যপুস্তকে রামলক্ষ্মণের কথা, কৃষ্ণার্জুনের কথা, সীতাসাবিত্রীর কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদিগেরই আখ্যান পড়িতে থাকে। স্বভাবতঃ তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের মধ্যে বড় লোক নাই। এই সকল পুস্তক দ্বারা তাহাকে জাতীয়ত্ব বিহীন করা হয়। হিন্দু বালকগণ ঐ সকল পুস্তক পড়িয়া মনে করে, আমাদের অপেক্ষা বড় কেহ নয়। মোসলমানরা নিতান্ত ছোট জাত। তাহাদের মধ্যে ভাল লোক জন্মিতে পারে না। এই প্রকারে রাষ্ট্রীয় একতার মূলোচ্ছেদন করা হয়।”
থ্যাংকু উত্তর দেওয়ার জন্যে। আপনি যে পয়েন্ট ধরে ধরে উত্তর দিচ্ছেন এটাই বেশ ভালো লাগছে। আপনি অনেক তথ্য জোগাড় করে পড়াশোনা করে লিখছেন। আমি সেখানে জাস্ট নিজের একটু আধটু এক্সপি থেকে কোরিলেট করে করে প্রশ্ন করছি।
৩ ) প্রথমে ৩ নম্বর উত্তরে আসি। দ্যাখেন আমি আমার চারদিকে যেটুকু দেখি তাতে মনে হয় আমাদের মধ্যে মোটামুটি তিন ধরণের লোকজন আছে ইন জেনারেল। একটা ছোট অংশ এক্টিভলি কম্যুনাল, সরাসরি অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ দেখান। আর বাকি একটা বড়ো অংশ (এরাই মেজরিটি) অনেকেই প্যাসিভলি কম্যুনাল , হয়তো নিজের অজান্তেই। এনারা সরাসরি বিদ্বেষ পোষণ করেন না জাস্ট অভ্যাসের বশে নিজের প্রথাগুলো ফলো করতে থাকেন। এটা তারা অতটা তলিয়ে ভাবেন না যে কিছু কিছু জিনিস অন্য ধর্মের লোকজনের কাছে আপত্তিজনক হতে পারে, কিন্তু আদতে তারা খারাপ লোক নন। জাস্ট মেজোরিটিকে ফলো করে যান।
আর একটা ছোট অংশ এক্টিভলি সেক্যুলার বা এথেয়িস্ট , কোনো ধর্মই মানেন না। এদের সংখ্যা কমই কারণ কতজন সারাক্ষন সমাজের সব রকম অনুঠান থেকে দূরে সরে থাকতে পছন্দ করেন ? সামাজিক প্রেসার ও থাকেই।
বিদ্যাসাগর যে তার বইতে মেনলি হিন্দু ক্যারেক্টার ব্যবহার করেছেন সেটা হয়তো জাস্ট এই দ্বিতীয় শ্রেণীর মাজরিটারিয়ান মানসিকতা থেকেই সেটা সরাসরি মুসলিমদের এলিয়েনেট করার জন্যে নাও হতে পারে। এই সেন্স টা আসতেই অনেক সময় লেগে যায়। আমরা যেদেশে থাকি সেদেশের স্কুলের বইতেও কিন্তু আগে সমস্ত ওয়েস্টার্ন ক্যারেক্টার ই ছিল। গত ১৫ বছর ধরে আস্তে আস্তে সচেতনতা বাড়ছে এখানকার এবোরিজিনালসদের প্রতি। এখন আস্তে আস্তে বইতে ওদের কোথাও ঢোকানো হচ্ছে, যেকোনো প্রোগ্রামে শুরুতে অরিজিনাল ইনহ্যাবিট্যান্টস দের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তারপর শুরু হয় । এখনো সেভাবে এশিয়ান মিগ্র্যান্ট দের কথা ভাবা হয়নি , হয়তো নেক্সট ১০-১৫ বছরে সেটাও পাল্টাবে আস্তে আস্তে। এসব কোনোটাই রাপিড চেঞ্জ নয়।
এবার যারা এদেশে আগের বইগুলো লিখেছেন তাদেরকে কি সরাসরি রেসিস্ট বলা যাবে ? হয়তো অনেকে হতেও পারেন. কিন্তু এটাও হতে পারে যে অনেকেই হয়তো জাস্ট ওয়েস্টার্ন বইগুলো কপি পেস্ট করেছেন। সেগুলোতে যে এবোরিজিনাল বা এশিয়ান দের কভার করা নেই হয়তো এই সচেতনতা টাই ছিলনা।
তাই অন্তত এটার প্রেক্ষিতে আমি ঠিক নিশ্চিত নয় বিদ্যাসাগরকে সরাসরি আন্টি মুসলিম বলতে পারছিনা। আরো ডাইরেক্ট প্রমান দরকার যে তিনি মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন।
1.) স্কুলের বাচ্চাদের বই লেখা তখন জাস্ট শুরু হয়েছে , ব্রিটিশ শিক্ষার মডেলে নতুন ভাবে একটা ইন্ডিয়ান এডুকেশন সিস্টেম গড়ে তোলা হচ্ছে। বিদ্যাসাগরের মত কয়েকজনই সেটা শুরু করেছেন। তার আগে কোনো গাইড লাইন ছিলই না, তারা নিশ্চয় সংস্কৃত টোলের থেকে গাইড লাইন নেবেননা , বৰং নিজের মতো করে একটা নতুন বানানোর চেষ্টা করবেন ? এগুলো একেবারে ফার্স্ট লেভেল এক্সপেরিমেন্ট। রবীন্দ্রনাথ এর ৫০-৬০ বছর পরে সেটার এনালাইসিস করে অন্য সিদ্ধান্তে আসতেই পারেন। তার বেসিসে ওনার লেখা নীতিকথার বই ভুল বলা যায়না।
সেটা বলতে গেলে এখনো তো বাচ্চাদের বইতে কি পড়ানো উচিত সেটা নিয়ে সারাক্ষন রিসার্চ চলছে। আপনি আরো ভালো জানবেন যে ১৯৪৭ এর পরে ইন্ডিয়াতে বায়োলজি র বই সব নতুন করে লেখা হয় কারণ তার আগে বয়লজিতে বেশির ভাগ ইউরোপিয়ান গাছ পালা ফুল শেখানো হতো যেগুলো ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টরা আশেপাশে দেখতে পেতোনা আর বুঝতে পারতোনা। তার মানে আগের বইগুলো নিশ্চয় ভুল নয় ? এগুলো একটা অনগোয়িং প্রোসেস .
২ ) হ্যা কেশব সেনের কথা ভুলে গেসলাম। তবে ব্রাহ্ম দের সাথে সেকালে মনুবাদীদের একটা পাওয়ার স্ট্রাগগল চলছিল সেটা আপনি ভালোই জানেন। বিদ্যাসাগর কেশব সেনের সঙ্গে না যেতে চাওয়ার সেটা একটা কারণ হতে পারে। তবে শ্রীশচন্দ্রর দোষের ভাগী ওনাকে করা যায়না। তার দোষ যেটা হলো তিনি ওকে বিশ্বাস করেছিলেন। এটুকুই।
আমার নিজের সাথেই হয়েছে বহুবার - কাউকে চাকরির ইন্টারভিউ করলাম। সে ইন্টারভিউতে অনেক ভালো ব্যবহার করলো . এবার চাকরিতে ঢুকে দেখি সে সবার সাথে ঝামেলা বাধাচ্ছে। এবার বাধ্য হয়ে তাকে ছাড়াতে হলো। এবার এটা মানছি যে তাকে সিলেক্ট করাটা আমার দোষ হতে পারে, কিন্তু তার বাজে ব্যবহারের দোষটা কি আমার ?
ভাগ্যিস মুসলিম সমাজ বিনয় ঘোষের কোটেশন পড়েনি। নইলে আর বিধবাবিবাহ চালু রাখতে হত না।
অমিত, এমন করলে খেলব না মাইরি! শুধু এক্সপি থেকে কোরিলেট করলে হয় না। নীতিকথা কি বিদ্যাসাগরের নিজের না ঔপনিবেশিক প্রভুদের? আগে অন্তত বোধোদয় আর নীতিবোধ গ্রন্থদুটো পড়ুন। বাঙ্গালার ইতিহাস কি বাংলার ইতিহাস না ব্রিটিশদের বিজয়গাথা? বর্ণপরিচয়-এর সুবোধ বালক কাদের শাসনকর্মে সুবিধা করে দেয়? লেখাপড়া করলেই গাড়িঘোড়া চড়া যায় না যেত? তাহলে বর্ণপরিচয় জুড়ে 'পড়া' ক্রিয়াপদটির এত বাড়বাড়ন্ত কেন?
প্রত্যেকটি পাঠ্যপুস্তকে তিনি অসংখ্যবার সংশোধন করেছেন (বোধোদয়-তে সবচেয়ে বেশি), সেখানে একটা বইতে একটা নামও মুসলমানের হতে পারে না? আপনি গুগল না করে বলতে পারবেন হার্শেল, গ্রোশ্যস, লিনিয়াস, ড্যুবাল, রস্কো, জিরম স্টোন, উইলিয়াম হটন কিংবা উইলিয়াম গিফোর্ড কারা? এগুলো বাচ্চারা কেন পড়ছে তাহলে? কারণ প্রভুর ইচ্ছাপূরণ। এর থেকে ঢের ভালো ইতিহাস, জীবনী এবং গল্প বাংলায় ছিল। কিন্তু প্রভুদের ইচ্ছাপূরণ না হওয়ায় সেসব পাত্তা পায়নি।
বিদ্যাসাগর ইসলামোফোব নন, কিন্তু পরোক্ষে তিনি হিন্দু মানসে ইসলামোফোবিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটান। রবীন্দ্রনাথও বিদ্যাসাগরের বইতে মুসলিমদের অনুপস্থিতিতে অপ্রসন্ন হয়েছিলেন। তাঁর সামনে সহজ পাঠ-এর মডেল ছিল? ওই কারণেই কেউ কপি-পেস্ট, কেউ উদ্ভাবক। মুড়ি-মিছরির এক দর হয় না। বিদ্যাসাগর যে শ্রেণিটাকে রিপ্রেজেন্ট করেন তাঁদের ৯৯% ইসলামোফোবিয়ায় ভুগেছেন। প্লাস ছোটলোকফোবিয়া তো ছিলই। বঙ্গভঙ্গে সেটা টের পাওয়া যায়। নমঃশূদ্র শিক্ষিত যুবক প্রথম সরকারি চাকরি পাচ্ছেন ১৯০৭ সালে। ভাবা যায়?
বিদ্যাসাগর কেশব সেনের সঙ্গে যাওয়া তো দূরের কথা, তাঁর সহযোগী ইয়ং বেঙ্গলদের সঙ্গেই বিধবাবিবাহের পদ্ধতি নিয়ে একমত হতে পারেননি। আর বিবাহ হলেই বা মেয়েদের কোন স্বর্গলাভ হয়েছিল? কতটুকু সম্মান বা অধিকার পেয়েছিলেন তাঁরা? আমি অবাক হয়ে ভাবি যে এই প্রশ্নটা আপনাদের কখনও হন্ট করে না --- বিধবাবিবাহের দ্বিতীয় পুস্তক লিখলেন অক্টোবরে, আবেদন করলেন ডিসেম্বরে আর ঝড়ের গতিতে পরের বছরেই আইন পাশ হয়ে গেল অথচ বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহে আইন নট নড়নচড়ন থাকল কেন?
ভাবুন, ভাবা প্র্যাক্টিস করুন।
আরে বইপত্তর কিছু নেই হাতের কাছে, পোস্টে আনাতে গেলে অনেক খরচ । কি আর করবো ? এখানে লোকজনকে জ্বালিয়ে যতটা জানা যায়. আর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছি বা মতামত দিচ্ছি বলে পার্সোনাল আনিমসিটি কিছু নেই এখানে , জাস্ট মায়াপাতায় ভাট।
হ্যা , বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ দের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এতে তো সন্দেহ নেই। তখনকার সিলেবাসে ব্রিটিশ ইন্ফ্লুএন্স থাকবেই এটা তো গিভেন। এটা শাসকের চাল সবদেশেই , নিজেদের কালচার কে নেটিভদের থেকে সেরা প্রমান করা আর নেটিভ কালচার কে আন্ডার মাইন করা . ঠিক যেরকম আরিয়ান ইনভেশন এর পর বেশির ভাগ আদিবাসী দেরকে শূদ্র হিসেবে সমাজের একদম নিচে রাখা হয়েছিল বা আজকের মোদির ইন্ডিয়ায় নতুন করে ইতিহাস লেখা হয় রানা প্রতাপ আকবরকে মেবার এর যুদ্ধে হারিয়েছিলেন। একই ভাবে ইন্ডিয়ার ইতিহাস বইতে আকবরকে মহান আর আওরঙ্গজেব কে অত্যাচারী দেখানো হয়। আর পাকিস্তানের ইতিহাস বইতে এক্কেবারে উল্টো , আওরঙ্গজেব সেখানে নিষ্ঠাবান মুসলমান। (আমার অনেক পাকিস্তানী বন্ধু আছে। তাদের থেকেই জানা)।
তাহলে সিলেবাস নিয়ে আপনার মেন্ অভিযোগ টা কি তাহলে এটাই যে বিদ্যাসাগর যথেষ্ট পরিমানে সেখানে ইন্ডিয়ানিজশন করেন নি ? বরং সেগুলো ব্রিটিশ দের কপি পেস্ট হয়েছে ? সেটাতে একমত। কিন্তু তার কারণটাও বলেছি। একটা কারণ ব্রিটিশদের প্রভাব আর একটা হলো এটা একটা ফার্স্ট এক্সপেরিমেন্ট। সিলেবাস মানেই একটা কন্টিনাসলি অন গোয়িং , ট্রায়াল এন্ড এরর লার্নিং প্রসেস। আর তিনি তো বিপ্লবী ছিলেন না. তাহলে ওনার থেকে সেটা আশাই বা করছি কেন যে তিঁনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলন করবেন এটা নিয়ে ?
বাল্যবিবাহ নিয়ে আমি অনেক আগে একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম কলকাতায় থাকতে (রেফারেন্স মনে নেই)। সেখানে লেখা ছিল বিদ্যাসাগর এটার এগেনস্ট এ লেখালেখি করেচিলেন , কিন্তু বিধবা বিবহের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর তিনি আবার এটা নিয়ে লড়ার উৎসাহ দেখান নি আর । প্রবন্ধের সত্যি মিথ্যে জানিনা , কিন্তু সব লড়াই একজনকেই কেন লড়তে হবে ?
ব্রাহ্ম সমাজ এর অনেকেই হয়তো ই প্যারালাল চেষ্টা করছিলেন , অনেকেই বেশ ইনফ্লুয়েনশিয়াল ফিগার ও ছিলেন তাদের মধ্যে। কিন্তু তখন ব্রাহ্ম সমাজ অনেকটা অভিজাত, ওয়েস্টার্ণ এডুকেটেড লোকজনের সোশ্যাল ক্লাব ধরণের হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাধারণ লোকের সাথে বা হিন্দু সমাজের মূল স্রোতে তাদের কতটা যোগাযোগ ছিল , সেটা তদন্তসাপেক্ষ। আর হিন্দু মুসলিম কোহেশন কোনোকালেই সেভাবে ছিলোনা , ব্রিটীশ নিজেদের স্বার্থে আরো বেশি করে সেটাকে প্রোমোট করেছিল। যেটার ফাইনাল রেজাল্ট দেশভাগ। কিন্তু আজকেও তো একই জিনিস ঘটে , গোর্খাল্যান্ড ঠেকাতে দিদি নেপালি, লেপ্চা ভূটিয়া দের মধ্যে ডিভাইড করেন। মোদি বাউ বলেন পোশাক দেখেই দাঙ্গাকারী চেনা যায়। জম্মু কাস্মীর লাডাখ কে আলাদা করা হয় জোর করে। তাহলে ব্রিটিশরা আলাদা করে কি দোষ করলো ? এতো রাবণ আর লঙ্কার কেস।
বিধবাবিবাহের আইনের পেছনে ব্রিটিশদের নিজেদের স্বার্থও থাকতেই পারে , স্বার্থ না থাকলেও নিজেদের সুপেরিয়র দেখানো অবজেক্টিভ হতেই পারে। সেটা একটা কারণ হতে পারে অত তাড়াতাড়ি আইন পাস্ হওয়ার। এবার সেটার রিঅ্যাকশন দেখার পরে ব্রিটিশরা হয়তো আর ঝামেলা বাড়াতে চায়নি বহুবিবাহ বা বাল্যবিবাহের পেছনে। হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকেই যে আরো বেশি লোক এসবের প্রতিবাদ করেন নি , এটাই লজ্জার। শুধু ব্রিটিশ বা বিদ্যাসাগর কে আঙ্গুল তুলে কি হবে ?
আর বিধবা দের অধিকারের কথাই যখন আনলেন, হাতের কাছেই দ্যাখেন। এই মোদী বাবু গত বছর তিন তালাক বন্ধের আইন করলেন , সেটা কতটা মুসলিম মহিলাদের ভালো করার জন্যে ? আর কতটা মুসলিম দের চাপে রাখার জন্যে আরএসএস এজেন্ডা -? সেই আইন আসার পর কি মুসলিম মহিলাদের সব সমস্যা মিটে গেছে ? কিন্তু তেনার অবজেক্টিভ যাই হোক , তিন তালাকের মতো একটা জঘন্য প্রথা যেটা বহু মুসলিম দেশে উঠে গেছে অলরেডি , সেটা যে এতদিন পরে তোলা হলো , তাতে আমি অন্তত এটাকে খারাপ বলবোনা। বিধবা বিবাহ আইনটাও আমার কাছে তাই। যে অবজেক্টিভ নিয়েই করা হোক , তাতে সব সমস্যা মিটুক না মিটুক , সেটা একটা কল্যাটারাল বেনিফিট এন্ড এ গুড ফার্স্ট স্টেপ।
অমিত, আর উত্তর দিলাম না। মানে এমনিতেই আজ রাতে নতুন কিস্তি পোস্ট করব। আর আপনি যা লিখেছেন তার সম্যক আলোচনা মুখোমুখি বসে জমে ভালো। কত আর টাইপ করা যায়! হবে, খোদার রহমতে মুখোমুখি একদিন দেখা হবে আমাদের। ততদিন এসব তোলা থাক।
ইনশাল্লাহ। নিশ্চয় দেখা হবে কখনো। তখন জমিয়ে তর্ক হবে। তবে এই পুরো সিরিজ টা দারুন লেখা হয়েছে , সবটাতে একমত হই বা না হই। কুডোস