দ্বিতীয় অধ্যায়
হেস্টিংস থেকে কর্নওয়ালিস – সাহেব আর মোসাহেবদের লুঠ কিসসা
If security was wanting against extensive popular tumult or revolution, I should say that the Permanent Settlement … has this great advantage, at least, of having created a vast body of rich landed proprietors deeply interested in the continuance of the British Dominion and having complete command over the mass of the people.
— Lord William Bentinck, Speech on November 8, 1829
কোম্পানি কর্তৃপক্ষ লর্ড কর্নওয়ালিসকে (কার্যকাল: সেপ্টেম্বর ১৭৮৬-অক্টোবর ১৭৯৩) স্থায়ী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দেন। সেই মোতাবেক দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে, অবশেষে তিনি ১৭৮৯-এর ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথমে বাংলা ও বিহারে এবং পরের বছর উড়িষ্যায় দশসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। পাঁচসালা-একসালা-দশসালা ইত্যাদি নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার শেষে, কোম্পানির পরিচালক সভার অনুমোদনক্রমে ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ, এই বন্দোবস্ত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামে আইনগত স্বীকৃতি পায় এবং পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় চালু হয়।
কর্নওয়ালিসের আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলেও, অনেক আগে থেকেই কোম্পানির পরিচালক সভার সদস্যরা, মূলত আর্থিক কারণে এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা করছিলেন। যে সময়ে ভারতবর্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়, ঠিক সেই সময়ে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে, সেখানকার উপনিবেশগুলি ব্রিটিশের হাতছাড়া হয়ে যায়। অন্যদিকে নেপোলিয়ন ইউরোপীয় মহাদেশ থেকে ইংরেজ বণিকদের প্রায় বিতাড়িত করেন। এই দুঃসময়ে ব্রিটিশ শিল্প পুঁজিপতিদের দৃষ্টি পড়ে ভারতবর্ষের দিকে এবং কোম্পানির সনদ (Charter)-এর পুনর্নবীকরণ করে, কোম্পানির হাত থেকে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বিনয় ঘোষের মতে,
তা না হলে ইংল্যান্ডে শ্রমশিল্পের বিকাশ হয় না, শিল্পজাত পণ্যদ্রব্যের বাজার মেলে না, নতুন বুর্জোয়াশ্রেণির মূলধন নিয়োগ এবং মুনাফা বৃদ্ধিরও সুবিধা হয় না।১
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বছরের শেষে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যমে, কোম্পানির আর্থিক ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। যদিও রাজস্বের নতুন হার নির্ধারণের আগে, কোম্পানির তরফে জমির পরিমাপ বা উৎপাদন-শক্তি হিসেব করার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি।
সুবে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করার সময়, কোম্পানির প্রাপ্য ভূমিরাজস্ব নির্ধারিত হয় ২৬ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ড। মীরজাফরের রাজত্বকাল থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হওয়ার মধ্যবর্তী প্রায় ৩০ বছরে, রাজস্বের হার কী অবিশ্বাস্য পরিমাণে বেড়েছিল, তা স্পষ্ট হবে এই হিসেবটি দেখলে:
The last Mahomedan ruler of Bengal, in the last year of his administration (1764), realised a land revenue of £817,553; within thirty years the British rulers realised a land revenue of £2,680,000 in the same Province.২
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৭৬৪-৬৫ সালে মহারাজা নন্দকুমারের আদায়ীকৃত রাজস্বের (৮ লক্ষ ১৮ হাজার পাউন্ড) তিন গুণের সামান্য বেশি এবং ১৭৬৫-৬৬-তে অর্থাৎ কোম্পানির দেওয়ানি প্রাপ্তির প্রথম বছরে, রেজা খাঁ-র আদায় করা রাজস্বের (১৪ লক্ষ ৭০ হাজার পাউন্ড) প্রায় দ্বিগুণ।৩
মুঘল আমলে ভূমিব্যবস্থার সাধারণ কাঠামোর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও, জমির ওপর আইনত রাষ্ট্র অথবা জমিদারজাতীয় শ্রেণির কোনও দখলি স্বত্ব ছিল না। তখন জমির সত্যিকারের মালিক ছিলেন তাঁরাই, যাঁরা নিজেরা গ্রামে কৃষিকাজের মাধ্যমে জমিতে ফসল উৎপাদন করতেন। তবে জমির সর্বস্বত্ব নীতিগতভাবে না হলেও, কার্যত রাজার অর্থাৎ রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত ছিল। এই ব্যবস্থায় সমগ্র গ্রামের ওপর রাজস্ব ধার্য হত এবং গ্রামসমাজগুলি রাজস্ব (ভূমিকর) আদায়কারী ‘জমিদার’-এর মারফত সমবেতভাবে রাজস্ব প্রদান করত। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জমিদার নির্দিষ্ট দিনে গ্রামে উপস্থিত হয়ে, রাজস্ব হিসেবে সমগ্র ফসলের এক-তৃতীয়াংশ আদায় করত এবং এই আদায়ীকৃত ফসলের এক-দশমাংশ নিজের পারিশ্রমিক হিসেবে রেখে, বাকি ফসল রাষ্ট্রকে দিতে বাধ্য থাকত। ফলে পূর্ববর্তী ভূমিব্যবস্থায় জমিদাররা ছিল নিছকই সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রতিনিধি, ভূস্বামী অথবা জমির মালিক নয়। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুযায়ী স্থির হয় যে, জমিদাররা আদায়ীকৃত রাজস্বের নয়-দশমাংশ কোম্পানির কাছে হস্তান্তরিত করবে। বছরের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই নির্দিষ্ট রাজস্ব কোম্পানির ঘরে জমা দিলে, জমিদাররা বংশানুক্রমে জমির স্বত্বাধিকারী থাকবে। ভবিষ্যতে জমির মূল্য যাই হোক না কেন, তাতে তাদের সঙ্গে কোম্পানির রাজস্ব বন্দোবস্তের কোনও পরিবর্তন হবে না।
দেশের ভূমিব্যবস্থায় এই আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত সামাজিক বিন্যাসও পাল্টাতে শুরু করে। পরবর্তীকালে জমিদারির মুনাফা বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও, প্রথম দিকে অর্থাৎ লর্ড কর্নওয়ালিসের সময়কালে, জমিদারদের ওপর দেয় রাজস্বের যে ভার চাপানো হয়, তৎকালীন অবস্থায় তা যে যথেষ্ট বেশি ছিল – সে প্রসঙ্গ আগেই আলোচিত হয়েছে। বিশেষত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরে অনেক দিন পর্যন্ত, কৃষকদের খাজনা দেওয়ার ক্ষমতা আগের থেকে কমে আসে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে, জমিদারদের পক্ষে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও এই রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হত না। এই অবস্থায় জমিদারি রক্ষার জন্য, অনেক জমিদার মহাজন ও বেনিয়ানদের শরণাপন্ন হত, কিন্তু এত সব করেও শেষ পর্যন্ত জমিদারি রক্ষা করতে পারত না। বন্দোবস্তের শর্ত অনুসারে, সরকারের হাতে দেয় রাজস্ব নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দিতে না পারার জন্য, তাদের জমিদারি আংশিক অথবা পুরোপুরিভাবে নিলাম হয়ে যেত। আর সেই জমি কিনে নিত, কোম্পানির আর্থিক শোষণের একনিষ্ঠ সহযোগী কিছু ভুঁইফোঁড় দেওয়ান, বেনিয়ান, সরকার, মুনশি অথবা খাজাঞ্চিরা।
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে, কোম্পানির বাণিজ্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই মুৎসুদ্দি শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। এই বাঙালি দেওয়ান ও বেনিয়ানরা ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ‘interpreter, head book-keeper, head secretary, head broker, supplier of cash and cash-keeper, and in general secret-keeper’৪। সেকালের ধনী ও সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারের অধিকাংশই এই দেওয়ান, বেনিয়ান, সরকার, মুনশি ও খাজাঞ্চির বংশ। যেমন — শোভাবাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ দেব ছিলেন লর্ড ক্লাইভের দেওয়ান। আন্দুল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামচরণ রায় গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট ও জেনারেল স্মিথ-এর দেওয়ান ছিলেন। খিদিরপুরের ভূকৈলাস রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোকুলচন্দ্র ঘোষাল ছিলেন ভেরেলস্ট-এর দেওয়ান ও বেনিয়ান। পাইকপাড়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ হেস্টিংসের আমলে কাউন্সিল ও বোর্ড অফ রেভিনিউ-এর দেওয়ান ছিলেন। হেস্টিংসের দেওয়ান ছিলেন কৃষ্ণকান্ত নন্দী। পাথুরিয়াঘাটার ঘোষ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা রামলোচন ঘোষ ছিলেন হেস্টিংসের সরকার। ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা দর্পনারায়ণ ঠাকুর হুইলার সাহেবের দেওয়ান ছিলেন।
মুঘল যুগের বণিকরা, ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় ধীরে ধীরে বাংলার অর্থনৈতিক মানচিত্র থেকে ক্রমশ সরে যেতে থাকে। তার আগেই বাংলার মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থা অপসারিত হওয়ার ফলে, মুঘল প্রশাসনের কর্মীরাও অন্তর্হিত হয়ে যায়। তাদের স্থান দখল করে নেয়, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় সৃষ্ট বাঙালি দেওয়ান, বেনিয়ান, গোমস্তা, দালালরা। এদের প্রত্যেকে দেওয়ানি ও বেনিয়ানি করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন –
তখন নিমক মহলের দেওয়ানী লইলেই লোকে দুইদিনে ধনী হইয়া উঠিত।৫
এই নতুন অভিজাত শ্রেণির প্রতিনিধি দেওয়ান ও বেনিয়ানদের বংশধররা, সকলেই জমিদারি কিনে নতুন জমিদার হয়।
তবে জমি ক্রয় এবং জমির মালিকানায় তারা যতটা আগ্রহী ছিল, কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার তিলমাত্র আগ্রহও তাদের ছিল না। খাজনার মাধ্যমে কৃষি-উৎপাদন থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ করাই ছিল, তাদের অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি। এই নতুন জমিদারদের অধিকাংশই ছিল শহরবাসী মানুষ, জমিদারি সংক্রান্ত কোনও কিছুই তারা বুঝত না। তাদের মেজাজ ও চরিত্রও ছিল, আগের জমিদারদের থেকে অনেক আলাদা। শহরে বসবাস করার ফলে, গ্রামাঞ্চলে গিয়ে নিয়মিতভাবে রাজস্ব আদায় করার দক্ষতাও তাদের ছিল না। যদিও জমিদারির বিনা পরিশ্রমে লব্ধ বিপুল আয়ের দিকে, তাদের ছিল লুব্ধ ও তীক্ষ্ণ নজর।
এই জমিদাররা কৃষকদের অমানবিক শোষণ করে কীভাবে অমিত ধনসম্পদের মালিক হয়ে ওঠে, তা এই দুটি উদাহরণেই স্পষ্ট হবে। বাংলায় সমস্ত জমিদারির এক-তৃতীয়াংশ ৯টি বিখ্যাত জমিদার পরিবারের দখলে ছিল, যথা – বর্ধমানের মহারাজা, কাশিমবাজারের মহারাজা, প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর, ব্রজেন্দ্র কিশোর, নাটোরের জমিদার, ময়মনসিংহের মহারাজা, নসিপুর, দীঘাপাতিয়া ও পুঠিয়ার জমিদার। এই ন’টি পরিবার সরকারকে রাজস্ব বাবদ দিত বছরে ১ কোটি টাকা, অথচ বাংলার একজন চাষির গড়পড়তা বাৎসরিক আয় ছিল মাত্র ৪৩ টাকা।৬ আর একটি সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলার জমিদাররা প্রতি একরে সরকারকে খাজনা দিত ১০ আনা ৮ পয়সা, অথচ বেআইনি আদায় বাদ দিয়ে তারা কৃষকদের থেকে আদায় করত, একর প্রতি ৩ টাকা অর্থাৎ সরকারকে দেয় রাজস্বের প্রায় পাঁচগুণ।৭
এই অলস অকর্মণ্য বিলাসপ্রিয় নব্য জমিদারশ্রেণি, জমিদারির রক্ষণাবেক্ষণ ও যথাসময়ে খাজনা আদায়ের প্রয়োজনে, এক নতুন মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সৃষ্টি করে। বিনয় ঘোষ লিখেছেন:
১৮৭২-৭৩ সালের প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে মধ্যস্বত্বের বিস্তারের ফলে জমিদারীর সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লক্ষের বেশি হয়েছে, বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারীর সংখ্যা পাঁচশ’র কিছু বেশি, বিশ হাজার থেকে পাঁচশ একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারী প্রায় ষোল হাজার, এবং পাঁচশ একর ও তার কম ছোট জমিদারীর সংখ্যা দেড় লক্ষের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার-পত্তনিদার-জোতদারদের গোমস্তা নায়েব তহশীলদার পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যদের সংখ্যা যোগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে উনিশ শতকের শেষ পর্বে ব্রিটিশ ভূমিরাজস্বনীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রাম্যসমাজে কমপক্ষে সাত-আট লক্ষ লোকের এমন একটি ‘শ্রেণী’ (সামাজিক ‘স্তরায়ন’) তৈরি হয়েছে, যে শ্রেণী ব্রিটিশ শাসকদের সুদৃঢ় স্তম্ভস্বরূপ।৮
নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে, কোম্পানি এই নতুন বংশানুক্রমিক মধ্যস্বত্বভোগীদের আইনসংগত বলে স্বীকার করে নেয়। এর পরিণতিস্বরূপ, তারা জমিদারদের মোট প্রাপ্যের ওপর নিজেদের অতিরিক্ত প্রাপ্য কৃষকদের থেকে আদায় করতে শুরু করে। জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের যৌথ শোষণের ফলে, কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।
কোম্পানি যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে নতুন জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির সৃষ্টি করে, তেমনই তাদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য অসংখ্য কৃষক সংগ্রামের সৃষ্টি হয়। যখন হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধনের গরিমায় মত্ত ‘এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার এসরাজ বীণ প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাপ আকড়াই, পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া, রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া’৯ দিনাতিপাত করতে ব্যস্ত; তখন এই জমিদার-মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির হাত থেকে ভূমিস্বত্বের পুনরুদ্ধার এবং সমস্ত শোষণ-উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, এই সময়ে বাংলার বুকে একের পর এক কৃষক বিদ্রোহ ঘটতে থাকে। এসব বিদ্রোহের মধ্যে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-৭৮), মেদিনীপুরের বিদ্রোহ (১৭৬৬-৮৩), ত্রিপুরায় সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯), কৃষক-তন্তুবায়দের লড়াই (১৭৭০-৮০), পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭) এবং রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল ঠিকই, তবুও এই বিদ্রোহগুলি সম্পর্কহীন ছিল না। সুপ্রকাশ রায়ের মতে,
প্রত্যেকটি বিদ্রোহই পূর্ববর্তী বিদ্রোহ হইতে অধিকতর সংগঠিত রূপ গ্রহণ করিয়াছিল এবং বিদ্রোহের অঞ্চলের অধিকতর বিস্তার ঘটিয়াছিল। প্রত্যেকটি বিদ্রোহই যেন উহার বহুমুখী অভিজ্ঞতা পরবর্তী বিদ্রোহের সংগ্রামী কৃষকের নিকট হস্তান্তরিত করিয়া দিয়াছে।১০
বস্তুতপক্ষে পলাশির যুদ্ধ ও মহাবিদ্রোহের মধ্যবর্তী দীর্ঘ একশো বছরে, এমন কোনও সময় যায়নি যখন ভারতবর্ষের কোনও না কোনও প্রান্তে, ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি।
আর্থিক প্রয়োজনে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাকে একটা নিশ্চিত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও, এই বন্দোবস্তের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে, ভারতবর্ষের সমস্ত ইংরেজ শাসনাধীন অঞ্চলে যে ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহের ঝড় বইছিল, তার প্রচণ্ড অভিঘাত থেকে আত্মরক্ষা করা একক ইংরেজ-শক্তির পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠছিল। ব্রিটিশের প্রধান লক্ষ্য ছিল, নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত শাসন ও শোষণের উদ্দেশ্যে, এ দেশের আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক স্থিতি যে কোনও উপায়ে বজায় রাখা। কর্নওয়ালিস-সহ ব্রিটিশ শাসকরা খুব ভালো করেই জানতেন যে, নবলব্ধ পুঁজি বিনিয়োগের অন্য কোনও বিকল্প পথ না থাকায়, এই জমিদাররা তাদের পুঁজি জমিতে লগ্নি করতে বাধ্য হবে। সেই সূত্রে তাদের স্বার্থের গাঁটছড়া বাঁধা থাকবে, ইংরেজ শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সঙ্গেই। এ কথা আঁচ করতে পেরে কর্নওয়ালিস এই নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে, ১৭৯৩ সালের ৬ মার্চ কোম্পানির পরিচালকবর্গকে একটি চিঠিতে লেখেন,
ভূমিস্বত্বকে নিরাপদ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই এদেশীয়দের হাতে যে বিরাট বিত্ত আছে, তা তারা অন্য কোনও ভাবে নিয়োগ করার উপায় না পেয়ে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করবে।১১
ফলে তারা সমাজের শ্রেণিবিন্যাসটিকে এমনভাবে ঢেলে সাজায়, যাতে তার অতীতের সামন্ততান্ত্রিক বনেদটি অক্ষুন্ন থাকে। এই জন্যই ক্রমবর্ধমান গণবিদ্রোহ থেকে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ শাসনকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে তারা একদল কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন সমর্থকশ্রেণি সৃষ্টি করে। তারা নিশ্চিত ছিল, এই সমর্থকশ্রেণি এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের সুদৃঢ় স্তম্ভ হিসেবে বিরাজ করে, বিদ্রোহী কৃষকদের বিদ্রোহের যাবতীয় ঝড়ঝাপটা থেকে শাসকদের রক্ষা করতে পারবে।
এই সমর্থকদের শ্রেণিবিন্যাস করে বিনয় ঘোষ লিখেছেন –
গ্রাম্যসমাজে নতুন জমিদারশ্রেণী, বৃহৎ একটি জমিদারি-নির্ভর মধ্যস্বত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্যশ্রেণী, এবং নাগরিক সমাজে নতুন অর্বাচীন অভিজাত-ধনিকশ্রেণী, খুদে-ব্যবসায়ী দোকানদার চাকরিজীবী প্রভৃতিদের নিয়ে বড় একটি নাগরিক মধ্যশ্রেণী এবং তার মধ্যে সোনার চাঁদের মতো একদল ইংরেজিশিক্ষিত ‘elite’।১২
অন্যদিকে এই নতুন সমর্থকশ্রেণির ভূমিকা সম্পর্কে লর্ড কর্নওয়ালিস বলেন:
আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই [এ দেশের] ভূস্বামীগণকে আমাদের সহযোগী করিয়া লইতে হইবে। যে ভূস্বামী একটি লাভজনক ভূসম্পত্তি নিশ্চিতমনে ও সুখে-শান্তিতে ভোগ করিতে পারে, তাহার মনে উহার কোনও রূপ পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগিতেই পারে না।১৩
এভাবে কর্নওয়ালিস এক ঢিলে দু-পাখি মারেন। একদিকে ইংরেজদের অনুগত ও আশ্রিত একটি শ্রেণিকে, কলকাতা ও বাংলার গ্রামেগঞ্জে ব্রিটিশদের বন্ধু ও সমর্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অন্যদিকে দেশীয় ব্যবসায়ীদের পুঁজিকে জমিতে বিনিয়োজিত করে, ইংল্যান্ডের উঠতি ধনতন্ত্রের এক সম্ভাব্য প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী পথের কাঁটাকে সরিয়ে দেন। তাই এই ঘটনার প্রায় ৪০ বছর পরে ১৮২৯ সালের ৮ নভেম্বর লর্ড বেন্টিঙ্ক মন্তব্য করেন –
আমি মানতে বাধ্য যে, ব্যাপক গণবিক্ষোভ বা বিপ্লব থেকে নিরাপত্তার প্রশ্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটা বিরাট সুবিধে আছে। …অন্ততপক্ষে এর বদান্যতায় এমন এক বিপুলসংখ্যক ধনী জমিদারশ্রেণি উদ্ভূত হয়েছে, যারা ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে প্রচণ্ড আগ্রহী, জনসাধারণের ওপরও তাদের সম্পূর্ণ আধিপত্য আছে।১৪
বলা বাহুল্য, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-সৃষ্ট জমিদারশ্রেণি নিষ্ঠার সঙ্গে এ দেশের ইতিহাসে সেই ভূমিকাই পালন করেছিল।
উনিশ শতকের প্রথম থেকে এ দেশে যে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়, তার সুযোগ প্রধানত গ্রহণ করে এই জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির প্রতিনিধিরাই। ভূমিরাজস্ব থেকে প্রাপ্ত বিপুল আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, পরবর্তীকালে তারা শিক্ষাদীক্ষা, সরকারি চাকরি এবং ডাক্তারি-ওকালতি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত থেকে, এক নতুন বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সৃষ্টি করে। চাকরি-নির্ভর এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ও স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ অনুরাগী হিসেবে গড়ে ওঠে। তারা এমন একটি সামাজিক শ্রেণির রূপ গ্রহণ করে, যাদের শ্রেণিস্বার্থ বাঁধা থাকে ভূমিব্যবস্থার স্রস্টা, পালক ও রক্ষক ব্রিটিশদের সঙ্গে।
যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে এত বাক্যব্যয়; সেই ব্যবস্থাকে কী চোখে দেখেছিলেন তৎকালীন ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় – তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন হিসেবে, এখানে মাত্র তিনটি উদ্ধৃতাংশের উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে। জমিদারি প্রথাকে এক প্রকার বৈধতা দিতে, বঙ্গদেশের কৃষক প্রবন্ধটির গোড়াতেই বঙ্কিম এই সাফাই দিয়ে নেন –
আমরা জমীদারের দ্বেষক নহি। কোন জমীদার কর্তৃক কখন আমাদিগের অনিষ্ট হয় নাই। বরং অনেক জমীদারকে আমরা বিশেষ প্রশংসাভাজন বিবেচনা করি। যে সুহৃদগণের প্রীতি আমরা এ সংসারের প্রধান সুখের মধ্যে গণনা করি, তাঁহাদিগের মধ্যে অনেকে জমীদার। জমীদারেরা বাঙ্গালী জাতির চূড়া, কে না তাঁহাদিগের প্রীতিভাজন হইবার বাসনা করে? ...আমাদিগের বিশেষ বক্তব্য এই, আমরা যাহা বলিতেছি, তাহা ‘জমীদার সম্প্রদায়’ সম্বন্ধে বলিতেছি না। যদি কেহ বলেন, জমীদার মাত্রেই দুরাত্মা বা অত্যাচারী, তিনি নিতান্ত মিথ্যাবাদী। অনেক জমীদার সদাশয়, প্রজাবৎসল এবং সত্যনিষ্ঠ। সুতরাং তাঁহাদিগের সম্বন্ধে এই প্রবন্ধপ্রকাশিত কথাগুলি বর্তে না। কতকগুলি জমীদার অত্যাচারী; তাঁহারা এই প্রবন্ধের লক্ষ্য। যেখানে জমীদার বলিয়াছি বা বলিব, সেইখানে ঐ অত্যাচারী জমীদারগুলিই বুঝাইবে। পাঠক মহাশয় ‘জমীদার সম্প্রদায়’ বুঝিবেন না।১৫
অর্থাৎ তিনি ‘সদাশয়’ ও ‘অত্যাচারী’ জমিদারদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য খুঁজে বের করে, প্রথমেই প্রতিবাদের সুরটিকে মোলায়েম করে নেন!
আর সারা প্রবন্ধ জুড়ে হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত-পরাণ মণ্ডলদের জন্য বিস্তর কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন শেষে, মোক্ষমতম খানকতক বাক্য লেখেন ‘ঋষি’ বঙ্কিমচন্দ্র —
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গসমাজে ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরাজেরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাঁহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন, এমত কুপরামর্শ আমরা ইংরাজদিগকে দিই না। যে দিন ইংরাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সেই দিন সে পরামর্শ দিব। এবং ইংরাজেরাও এমন নির্বোধ নহেন যে, এমত গর্হিত এবং অনিষ্টজনক কার্যে প্রবৃত্ত হয়েন। আমরা কেবল ইহাই চাহি যে, সেই বন্দোবস্তের ফলে যে সকল অনিষ্ট ঘটিতেছে, এখন সুনিয়ম করিলে তাহার যত দূর প্রতীকার হইতে পারে, তাহাই হউক।১৬
অস্যার্থ, যারা এই ‘অনিষ্টজনক কার্যে প্রবৃত্ত’ হয়েছিল, তাদের দরবারেই সেই অনিষ্টজনক কাজ নিবারণের উদ্দেশ্যে ‘সুনিয়ম’ প্রবর্তন করার সুপারিশ!
আর ‘মানবতাবাদী’ বিদ্যাসাগর? তিনি সমস্ত ইতিহাস জেনেও নির্দ্বিধায় লিখতে পারেন,
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে, বাঙ্গালা দেশের যে সবিশেষ উপকার দর্শিয়াছে, ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই। এরূপ না হইয়া, যদি, পূর্বের ন্যায়, রাজস্ব বিষয়ে নিত্য নূতন পরিবর্তের প্রথা প্রচলিত থাকিত, তাহা হইলে, এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না।১৭
শুধু তাই নয়, কর্নওয়ালিসের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি লেখেন:
লার্ড কর্ণওয়ালিস রাজ্যশাসন দৃঢ়ীভূত করিয়াছেন, এবং, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা, দেশীয় লোকদিগের মঙ্গল করিয়াছেন। দেশীয় লোকেরা, তাঁহার দয়ালুতা ও বিজ্ঞতার নিমিত্ত, যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহা অপাত্রে বিন্যস্ত হয় নাই।১৮
বুঝ লোক যে জান সন্ধান!
************************************************************
উল্লেখপঞ্জী:
১. বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, কলকাতা, ১৪২৩, পৃ. ৩৯
২. Romesh Dutt, The Economic History of India under Early British Rule, London, 1906, p. ix
৩. তদেব, পৃ. ৮৫, ৯২-৯৩
৪. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৭
৫. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ৪৪
৬. ভবানী সেন, মুক্তির পথে বাংলা, কলকাতা, ১৯৪৬, পৃ. ১১-১২; উদ্ধৃত অমলেন্দু দে, বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ , কলকাতা, ২০১২, পৃ. ১৭৩
৭. Memorandum on the Permanent Settlement presented by the Bengal Provincial Kisan Sava to the Land Revenue Commission, p. 51; উদ্ধৃত বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক, কলকাতা, ২০১২, পৃ. ৩৬
৮. বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, পৃ. ১৫২-৫৩
৯. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, পৃ. ৩৭
১০. সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, কলকাতা, ২০১৮, পৃ. একুশ
১১. বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, পৃ. ১৭৬
১২. তদেব, পৃ. ১৫৭
১৩. Radha Kamal Mukherjee, Land Problems in India, p. 35; উদ্ধৃত সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃ. ১৩৪
১৪. R. Palme Dutt, India To-Day, Bombay, 1947, pp. 192-93
১৫. ‘বঙ্গদেশের কৃষক’; যোগেশ্চন্দ্র বাগল (সম্পাদিত), বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৩৯৭, পৃ. ২৯২
১৬. তদেব, পৃ. ৩০৯-১০
১৭. বাঙ্গালার ইতিহাস; গোপাল হালদার (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ২৭৫
১৮. তদেব, পৃ. ২৭৬
দেখুন, সোজাসুজি বলাই ভাল। প্রচন্ড মেজাজ খিঁচ্ড়ে গ্যাছে লেখাটা পড়ে। এতো এতো তথ্য দিয়ে প্রফেসনালি (বোধায় অ্যাকাডেমিকালি ঠিক শব্দ ) একটা চমত্কার ব্যাপার নামিয়ে এনে শেষ তিন লাইনে আদ্যপান্ত ছড়িয়ে দেওয়াটা জাস্ট নেওয়া গ্যালো না!
তাপ্পর ডিডি পড়ে মেজাজ সামলাতে হল।
আরে মহাই খিস্তি মারারও এক্টা প্রসেস আছে না কি? আপনার লেখা আপনি বিদ্যেসাগরকে হাড়হারামি বলবেন কি গুখেগোর বেটা বলবেন সে আপনার ব্যাপার! তাই বলে পুউউরো লেখাটায় কোথাও বিদ্যেসাগর নেই আর ধাঁ করে শেষ তিন লাইনে একটা বিদ্যেসাগর ছুঁড়ে দেবেন! পাঠকের মানসিক প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে তো, না কি? এ অতি অখাদ্য হইল!
আনলেস, আনলেস, এসব আপনি টিজার হিসেবে ব্যবহার করছেন পরের পর্বের জন্য! আর সেখানে বিদ্যাসাগরের নির্মান হবে! কারণ এখন পর্যন্ত আপনার টোন খুবই অ্যান্টি বিদ্যাসাগর হয়ে আছে। এই টোন লেখায় থাকলে তো নিজের পক্ষের লোক ছাড়া কেউই পড়্তে চাইবে না এরকম লেখা।
এত কথা বলা এজন্য যে এটা একটা লেখার টেকনিকাল প্রবলেম আর শোধরান সহজ। আপনি এত খাটাখাটি করেন, এটুকু সামালাতে পারবেন বলে মনে হয়! এখন তই করতে চান না আগুনখেকো ডোনাল্ড ট্রাম্প হতে চান আপনার ব্যাপার!
ইংরাজদের ভারত লুণ্ঠনের প্রচুর তথ্য দিয়েছেন, ঠিক আছে । ইংরাজরা ব্যবসা করতে এসেছে ভারতকে ভালবাসতে নয়। তাদের কাছে মানবতা আশা করছেন বলে তো আমারও বোধ হচ্ছে না। তবু ভাগ্য ভালো স্প্যানিয়ারড বা পর্তুগীজ ছিল না ,এরা তবু মন্দের ভালো।
“মানবতাবাদী’ বিদ্যাসাগর?”...............
বলে আপনি একটি কটাক্ষ করেছেন, কিন্তু একটা জিনিস ভাবুন যে বিদ্যাসাগরের আশু লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ ছিল ? ‘ইংরাজ-খেদাও’ নামক একটি আজগুবি বুনোহাঁসের পিছনে ধাওয়া করা, না নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে শিখে তার মধ্যেই যতটুকু পারা যায় আদায় করে নেওয়া। বিদ্যাসাগর মশাই তো আর কোন প্রাশিয়ান মিলিটারি ফ্যামিলির থেকে আসেন নি যে যুদ্ধ করতে নেমে পড়বেন, কাজেই জেনে বুঝেও যে ওনার বিশেষ কিছু করবার ছিল তেমন কিন্তু নয়। বাস্তববাদী হয়ে ভাবলে দেখা যাবে যে ইংরাজ চটিয়ে ওনার বা তৎকালীন সমাজের কারুরই বিশেষ কোনো উপকার সাধিত হত না । করলে ভালো হত কিন্তু হয়নি কি আর করা যাবে ?
[এলেবেলের সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া বা সমঝোতা হয়েছে। তাহল এই লেখাপত্তরের ব্যাপারে আমরা দু'জন একে অপরকে এক ইঞ্চি ছাড় দেব না। ফল্র পালটা বক্তব্য ব্যঙ্গ চিমটি সব চলবে। তাতে দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কে কোন চিড় ধরবে না ।]
বঙ্কিম 'ভাল জমিদার মন্দ জমিদার' বর্গবিভাজন করে এলেবেলের শ্লেষের শিকার হয়েছেন।অবশ্যই কলোনিয়াল ইংরেজি শিক্ষা প্রাপ্ত হওয়ার ফলে বঙ্কিম/বিদ্যাসাগর সেই পরিবেশে অ্যাডভান্টেজ পেয়েছিলেন। এ'ব্যাপারে আপনার বক্তব্য সঠিক।
কিন্তু আমরা সবাই তো (বঙ্কিম/বিদ্যাসাগর সমেত) আমাদের সময়ের ফসল।
আমার প্রশ্ন সেই যুগে ভারতের কৃষি সমাজে জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব বিকাশ এবং পরিবর্তন বা ধ্বংস নিয়ে অন্তর্দৃষ্টি আদৌ বঙ্কিম/বিদ্যাসাগরের পক্ষে কতটুকু সম্ভব ছিল । যদি হত তবে তাঁরা ব্যতিক্রমী যুগপুরুষ হতেন। হন নি তা নিয়ে আক্ষেপ করব? নাকি যা হয়েছেন তার মূল্যায়ন করব?
এ যেন সেই ময়মনসিঙ্ঘের বিয়ের গান শাশুড়ি গাইছেনঃ
অ জামাই জামাই রে!
তুই ক্যান রে ভাতার হইলি না?
শেষ দুটি প্যারা পড়েই স্পষ্ট হতে চলেছে এলেবেলে ওরফে দেবোত্তম বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা নয়, বরং এক মানসিক বিদ্বেষ থেকেই প্রবন্ধটি লিখতে চলেছেন।
ভাল লেখা, দারুণ বিশ্লেষণ! পরবর্তী অধ্যায়ের অপেক্ষায় |
এলেবেলে বাবুর লেখার তথ্যের আমি খুব ই ফ্যান . কিন্তু ওনার অ্যানালিসিস / কনক্লুসন নিয়ে আমি খুব মাথা বেথা করি না । তাতে তথ্য গুলোর ওপোর থেকে ফোকাস চলে যায়
একটা ছোট্ট কথা না বলে পারছি না । আমার কম্পানির আইটি আমি দেখি . তাতে যদি ভুল কিছু করে থাকি , লোকে সমালোচনা করতেই পারে । কিন্তু আমি কেনো ডাক্তারী ও কেনো করি না , এটা নিয়ে সিয়িও আমাকে রেটিং খারাপ দিলে সেটা কি ভালো হবে ? ডাক্তারী ও করতে পারলে ভালৈ হতো সন্দেহ নেই . কিন্তু করাটা এক্স্পেক্টেড নয় কেআরএ তেও নেই :(
সোজাসুজি বলতে গিয়েও ট্যারাব্যাঁকা হয়ে যায়। লেখাটি "বিদ্যাসাগর" প্রসঙ্গে নয়।ঈশ্বরচন্দ্র মূল কেন্দ্র।বাঙালি “বিদ্যাসাগর” শব্দটির সাথে একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্রের নামটিই মনে করতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে। সকালে আরো অনেকেই বিদ্যাসাগর ছিলেন ঃ-জীবানন্দ,নীলকমল,প্রাণকৃষ্ণ,রাজীবলোচন,শশিশেখর কাব্য ব্যাকরণ পুরাণতীর্থ,হরিহর, হরানন(যেগুলি মনে এল), সেকথা বাঙালি মনে রাখেনি । তবে লেখক যদি ঈশ্বরচন্দ্র নিয়ে লিখতে গিয়ে "বিদ্যাসাগর" প্রসঙ্গ না আনেন তাহলে সেটা লেখকের অযোগ্যতাই প্রমাণ করবে ভবিষতে। ইস! মাত্তর ১৫ বছর বয়সে "বিদ্যাসাগর " হয়ে গেলেন। কী পোতিভা!!!!
এলেবেলে কোট করেছেন,
"চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে, বাঙ্গালা দেশের যে বিশেষ উপকার দর্শিয়াছে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।এরূপ না হইয়া যদি, পূর্ব্বের ন্যায় রাজস্ব বিষয়ে নিত্য নূতন পরিবর্ত্তের প্রথা চলিত থাকিত, তাহা হইলে এদেশের কখনই মঙ্গল হইত না।"
বিদ্যাসাগরের 'বাঙ্গালার ইতিহাস' বইতে এর পরের লাইনটা হল,
"কিন্তু ইহাতে দুই অমঙ্গল ঘটিয়াছে। প্রথম এই যে, ভূমি ও ভূমির মুল্য সঠিক না জানিয়া বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। তাহাতে কোন কোন ভূমিতে অত্যন্ত অধিক ও কোন কোন ভূমিতে যৎসামান্য কর নির্দ্ধারিত হইয়াছে। দ্বিতীয় এই যে, সমুদয় ভূমি যখন বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া গেল, তখন যে সকল প্রজারা আবাদ করিয়া চিরকাল ভূমির উপসত্ত্ব ভোগ করিয়া আসিতেছিল, নুতন ভূম্যধিকারীদিগের স্বেচ্ছাচার হইতে তাহাদের পরিত্রাণের কোনো বিশিষ্ট উপায় নির্দ্দিষ্ট করা হয় নাই।"
বুঝ লোক যে জান সন্ধান!
তুহিন মালাকারের চটি বইটা দিয়ে কতদিন টানা যাবে?
এটা কিন্তু যাকে বলে ডিসেপসান! খারাপ খবর লোকে খিস্তি করলেও শেষে মেনে নেয় ও সংবাদদাতাকে শেষ পর্যন্ত ধন্যবাদ দেয়! ডিসেপসান কিন্তু লোকে ক্ষমা করে না! এবং এটা রিপিটেড অফেন্স।
এর কাউন্টার না এলে ডিসেপসান থিওরিটাই ধরে রাখব।
এলেবেলের দুটো কোট পড়ে ঈশ্বরচন্দ্রের চিন্তার ডাযনামিজম মনে এল।
একজাযগায থেমে যান নি। প্রথম একটা নতুন ববস্থার পজিটিভ দিকটি দেখেছেন। সময় পেরোতে নেগেটিভ দিকগুলো চোখে পড়েছে।
সময় পেরোতে নয় পরের লাইনে একই লেখায়।
মনোজ্ঞ লেখা। তবে আমার নিজের প্রযুক্তি-পঙ্গুত্ব বড়োই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পটভূমিটি চমৎকার ফাঁদা হয়েছে।
ধন্যবাদ, মোবাইলে পড়তে গিয়ে ভুল দেখেছিলাম।
এটা তো আরও ভাল । প্রথম দর্শনেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঘোষিত আপাত-সুফল সত্ত্বেও এর গভীরে সর্বনাশের দিকটি বিদ্যাসাগর তুলে ধরেছেন।
যেমন আজকের কৃষি রিফর্ম বিল।
সোজাসুজি, //এতো এতো তথ্য দিয়ে প্রফেসনালি (বোধায় অ্যাকাডেমিকালি ঠিক শব্দ ) একটা চমত্কার ব্যাপার নামিয়ে এনে শেষ তিন লাইনে আদ্যপান্ত ছড়িয়ে দেওয়াটা জাস্ট নেওয়া গ্যালো না!
তাই বলে পুউউরো লেখাটায় কোথাও বিদ্যেসাগর নেই আর ধাঁ করে শেষ তিন লাইনে একটা বিদ্যেসাগর ছুঁড়ে দেবেন! পাঠকের মানসিক প্রস্তুতির একটা ব্যাপার আছে তো, না কি?
কারণ এখন পর্যন্ত আপনার টোন খুবই অ্যান্টি বিদ্যাসাগর হয়ে আছে। এই টোন লেখায় থাকলে তো নিজের পক্ষের লোক ছাড়া কেউই পড়্তে চাইবে না এরকম লেখা।
এত কথা বলা এজন্য যে এটা একটা লেখার টেকনিকাল প্রবলেম আর শোধরান সহজ।//
পাঠক একটা লেখার টেকনিক্যাল প্রবলেম শোধরানোর কথা বলছেন লেখককে – বিষয়টা বেশ অভিনব বটে। লেখক আগেভাগেই তার লেখার গোপন রহস্য ফাঁস করবেন তার পাঠকের কাছে বা তার লেখার টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি নিয়ে নিজেই বিস্তর ব্যাখ্যা হাজির করবেন – সেই বিষয়টাও যথেষ্ট দৃষ্টিকটু। তবে আমি যেহেতু এক আপাদমস্তক না-লেখক এবং আপনার এই প্রসঙ্গটার উত্থাপন লেখাটির দ্বিতীয় পর্বেই, তাই আমি আপনাকে ও প্রত্যেক পাঠককে এই লেখাটি সম্পর্কে সামান্য ধরতাই দেওয়ার চেষ্টা করছি মাত্র।
খেয়াল করলে দেখবেন লেখাটার যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে একেবারে প্রথমেই, সেখানে খুব নিচু সুরে কয়েকটা কথা বলা আছে। গোটা ৯০ শব্দের মধ্যে ইঙ্গিত দেওয়া আছে দুই শ্রেণির – ভদ্রলোক ও ছোটলোক। সেখানে ছোটলোকরা ভদ্রলোকদের দাসত্বের দোসর হবে না বলা আছে। সেখানে ‘নির্মাণ’ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার আশঙ্কার কথা বলা আছে। এবং ছোটলোকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিদ্যাসাগরকে বিশ্লেষণ করার ইঙ্গিতও দেওয়া আছে। মোদ্দা কথায় একটা প্যারাডাইম শিফট যে ঘটলেও ঘটতে পারে, সে কথাটা বলা আছে ঠারেঠোরে। কিন্তু উচ্চকিত স্বরে নয়।
অধ্যায়ের শিরোনাম থেকে তার সূচনামূলক উদ্ধৃতি – সবই লেখাটিরই অংশ। এর একটা শব্দও বাহুল্য নয়, চটকদারি নয়, দেখনদারি তো নয়ই। এখানেও খুব সূক্ষ্মভাবে পাঠককে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, সেই অধ্যায়ের মূল সুর কী হতে চলেছে। এবং এগুলোর প্রত্যেকটাই লেখকের চিন্তিত চয়ন। আলটপকা কিছু নয়। এখানেও উচ্চকিত সুরে কিচ্ছুটি বলা হচ্ছে না। কারণ পাঠককে এই স্পেসটুকু দিয়ে রাখা একজন লেখকের কর্তব্য, সে যতই তিনি না-লেখক হন না কেন।
একই কারণে এই অধ্যায়টির শুরু থেকেই বিদ্যাসাগর জুড়ে আছেন প্রবলভাবেই। মুৎসুদ্দি শ্রেণির উল্লেখের সময়ে যেমন ইচ্ছে করেই ‘কম্প্রাদর বুর্জোয়া’ শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়নি, তেমনই সেই শ্রেণির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের প্রসঙ্গেও অকারণে বিদ্যাসাগর উল্লিখিত হননি। হয়েছেন ঠিক সেই জায়গাতে এসে, যেখানে তাঁকে সেই শ্রেণির মনোভঙ্গি প্রকাশে কাজে লাগানো হবে। এমনকি এই শ্রেণিটির শাসকের সঙ্গে শ্রেণিস্বার্থের প্রশ্নটি কোন গাঁটছড়ায় বাঁধা ছিল, তা বলার জন্য অকারণে মার্ক্সের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজনই হয়নি।
লেখক কখনও তার পাঠককে ‘নির্বোধ অশিক্ষিত’ ভাবতে রাজি নয়। নয় বলেই এখানে বাপু খানিক পোস্ট-কলোনিয়াল ছিটিয়ে রেকিচি, বা এখানে এক খাবলা সাব-অল্টার্ন – জাতীয় ছেলেমানুষির আশ্রয় এই গোটা লেখাটিতে একবারের জন্যও নেওয়া হবে না। যে পাঠকের পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে আস্ত একটি সহায়িকা লাগবে, তিনি এই লেখা এড়িয়ে যাবেন। কারণ ওটি সাপ্লাই করাই হবে না।
বাকি রইল অ্যান্টি বিদ্যাসাগর টোন। ক্রিকেটের একটা উপমা দিয়ে ব্যাখ্যা করি বিষয়টা। বিশ্বত্রাস অস্ট্রেলিয়া টিম ইডেনে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে। এখন ভারত নেমেছে আন্ডারডগ হয়ে। আমি সেই টিমের রাহুল দ্রাবিঢ়। আমার সহবাগের আপার কাট নেই, শচীনের ধুঁয়াধার বল্লেবাজি নেই, সৌরভের ফ্ল্যামবয়্যান্স নেই। কিন্তু মনস্থির করে মাঠে নেমেছি, আজ প্যারাডাইম শিফট ঘটাতে হবে ভারতীয় টিমের। উল্টোদিকে আমার মতোই আনসাং হিরো লক্ষ্মণ। মানে ক্রিজের একদিকে অন্ত্যজ হিন্দু ও দরিদ্র মুসলমান আর অন্যদিকে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ‘অবলা’ নারীরা। যেহেতু সারা দিন ব্যাট করে নট আঊট থাকতে হবে এবং অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে হবে, কাজেই প্রথম দিকে যাবতীয় স্ট্রোক ভি বরাবর। এক ফোঁটা হাঁকুপাকু নেই, খোঁচা দিয়ে বেঁচে যাওয়া নেই, স্লেজিং-এ পাত্তা দেওয়া নেই। সারাটা দিন পড়ে আছে। কাজেই প্রথম থেকেই মারমার কাটকাট করতে গেলে তো আউট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। আগে সেট হয়ে নিই, তারপরে ৬ বলে ৬ ছক্কার রেকর্ড তো ভাঙবেই, ৮ বলে ৮ ছক্কার নতুন রেকর্ড হবে। তবে দ্বিতীয় পর্বে!
সর্বোপরি বলি, আপনার মন্তব্যটি আমার যথেষ্ট ভালো লেগেছে। বিশেষত আপনার সরস উপস্থাপন ভঙ্গিটি অনবদ্য।
এস, //‘ইংরাজ-খেদাও’ নামক একটি আজগুবি বুনোহাঁসের পিছনে ধাওয়া করা, না নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে শিখে তার মধ্যেই যতটুকু পারা যায় আদায় করে নেওয়া।//
ধাওয়া কি আদৌ করেছিলেন? নাকি তাদের সহযোগী হয়ে কলাটা-মুলোটা বাগিয়েছিলেন মাত্র? আমি এখনও সংশয়াচ্ছন্ন। আপনি?
রঞ্জনবাবু, //এলেবেলের সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া বা সমঝোতা হয়েছে। তাহল এই লেখাপত্তরের ব্যাপারে আমরা দু'জন একে অপরকে এক ইঞ্চি ছাড় দেব না।
আমার প্রশ্ন সেই যুগে ভারতের কৃষি সমাজে জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব বিকাশ এবং পরিবর্তন বা ধ্বংস নিয়ে অন্তর্দৃষ্টি আদৌ বঙ্কিম/বিদ্যাসাগরের পক্ষে কতটুকু সম্ভব ছিল । যদি হত তবে তাঁরা ব্যতিক্রমী যুগপুরুষ হতেন। হন নি তা নিয়ে আক্ষেপ করব? নাকি যা হয়েছেন তার মূল্যায়ন করব?//
এলেবেলে স্পষ্ট বলে দিচ্ছে প্রয়োজনে আপনাকে এক ইঞ্চি কেন, এক মিটার ছাড়তে আপত্তি থাকবে না। যদি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেন, তাহলে ঘাড় বাঁকা করে রাখার কোনও প্রশ্নই নেই! তবে আমি চাইব আপনি আমাকে এক ইঞ্চি কেন, এক সেন্টিমিটার অবধি ছাড় দেবেন না। তাতে বরং আমারই লাভ।
বঙ্কিম-বিদ্যাসাগরের যদি ‘অন্তর্দৃষ্টি’ সম্ভব না হয়, তাহলে সমসাময়িক অক্ষয় দত্ত বা কাঙাল হরিনাথের ‘অন্তর্দৃষ্টি’ সম্ভব হল কোন যাদুমন্ত্রে? কোন যাদুমন্ত্রে সোমপ্রকাশ পত্রিকায় একের পর এক ‘অন্তর্দৃষ্টি’ সম্পন্ন লেখা প্রকাশিত হল? বিদ্যাসাগর ওই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না? আজ অবধি গবেষকবৃন্দ সেসব লেখার একটাকেও তাঁর লেখা বলে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন? আমি জানি না। আপনার জানা থাকলে অবশ্যই জানাবেন। আপনি আশা করেন যে বিদ্যাসাগর ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের জন্য বরাদ্দ করেন সাকুল্যে তিনটে বাক্য, তিনি তাঁর অন্নদাতাদের বিষদৃষ্টিতে পড়বেন? ধন্য আশা কুহকিনী!
পারিজাত এম, //এলেবেলে বাবুর লেখার তথ্যের আমি খুব ই ফ্যান . কিন্তু ওনার অ্যানালিসিস / কনক্লুসন নিয়ে আমি খুব মাথা বেথা করি না ।//
এ তো খুবই দুঃখের কথা মশাই! আমার পাখাতে বিস্তর নাট-বল্টু-মোটর-ক্যাপাসিটর-ব্লেড আছে। সব মিলিয়ে সেটা একটা পাখার আকার নিয়েছে। এখন যদি সেখান থেকে আপনার পছন্দমাফিক একটা বা দুটো ব্লেড খুলে নেন, তাহলে গোটা পাখাটাই তো অকেজো হয়ে পড়বে! তথ্যগুলোকে ডিডাকটিভ ডিসকাশনের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে, পুরো অধ্যায়টিকে পূর্ণাঙ্গরূপ দেওয়ার জন্য। অ্যানালিসিস বলুন বা কনক্লুসন – সব ওগুলোর ওপর নির্ভরশীল। কাজেই আমার তথ্য নিলে, অ্যানালিসিস নিয়ে মাথা ‘বেথা’ করতেই হবে মিস্টার মিত্তির!
সপ্তর্ষি রায়, //তবে লেখক যদি ঈশ্বরচন্দ্র নিয়ে লিখতে গিয়ে "বিদ্যাসাগর" প্রসঙ্গ না আনেন তাহলে সেটা লেখকের অযোগ্যতাই প্রমাণ করবে ভবিষতে।//
কথা দিতে পারি, দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হলে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাসাগর আসবেন। শুধু আসবেনই না, প্রবল প্রতাপেই আসবেন। তাতে লেখকের যোগ্যতা বা অযোগ্যতা নিয়ে আপাতত ভাবিত নই।
০৪ অক্টোবর ২০২০ ০৭:০৫
যত খুশি স্লেজিং করুন, কুচ্ছো গান – কোনও আপত্তি নেই। শুধু দয়া করে যদি নিকটা বদলে নেন তো খুব ভালো হয় আর কি।
এর আগে একজনকে আতস কাচ নিয়ে রামকেষ্ট ভটচাজ খুঁজতে বলা আছে। অন্যজনকে ছিপে ফেভিকুইক লাগিয়ে সরোজ-চারু তুলতে বলা আছে। তুহিন মালাকারের জন্য আপনি কোনটা বেছে নেবেন – আতস কাচ না ছিপ? আপনি বরং দুটোই ট্রাই করতে পারেন।
শুধু বিদ্যাসাগরের একটি ‘কিন্তু’ জাতীয় সংশয়াত্মক অব্যয় নিয়ে অত ভাব দেখাবেন না। কারণ আপনি বাঙ্গালার ইতিহাসের পৃ. ২৭৫ তুলেছেন। কিন্তু এই কাণ্ডটি করতে গিয়ে ঠিক তার পরের পাতাটি (টীকাংখ্যা ১৮) দেখে উঠতে পারেননি। পারলে দেখতে পেতেন, শেষাবধি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যাবতীয় সংশয় বিলকুল উধাও হয়ে গেছে! ওই কারণেই একটা উদ্ধৃতির কতটা রাখতে হয় এবং কতটা ফেলে দিতে হয়, সেই পরিমিতিবোধ থাকা খুব জরুরি।
ফালতু আপনার চুনী গোস্বামীয় চুক্কিতে সোজাসুজি এবং রঞ্জনবাবু টাল সামলাতে পারলেন না। স্যাড, ভেরি স্যাড! পরের বার সামান্য প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন, কেমন?
এই সুযোগে সমস্ত পাঠককে লেখা নিয়ে দুটো কথা বলার –
১. যেহেতু লেখা এখনও পুরোদমে চলছে, তাই উত্তর না পেলে রাগ করবেন না। আমি চেষ্টা করব পাঠকদের সোমবার বা মঙ্গলবার উত্তর দেওয়ার (স্লেজিং বাদে)।
২. ভদ্রলোকদের উইক এন্ড রঙীন করে তোলার পবিত্র দায়িত্ব যেহেতু ছোটলোকদের, সেই কারণে ছোটলোক এলেবেলে তার লেখাটির প্রত্যেকটি নতুন কিস্তি শুক্রবার রাতে প্রকাশিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।
এলেবেলে মহাশয় উপদেশ দিয়েছেন, "আপনি বাঙ্গালার ইতিহাসের পৃ. ২৭৫ তুলেছেন। কিন্তু এই কাণ্ডটি করতে গিয়ে ঠিক তার পরের পাতাটি (টীকাংখ্যা ১৮) দেখে উঠতে পারেননি।পারলে দেখতে পেতেন, শেষাবধি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যাবতীয় সংশয় বিলকুল উধাও হয়ে গেছে!"
তো দেখা যাক, সেই টীকা সংখ্যা ১৮ অর্থাৎ ২৭৬ পৃষ্ঠায় কি লেখা আছে?
"লার্ড কর্ণওয়ালিস রাজ্যশাসন দৃঢ়ীভূত করিয়াছেন, এবং, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা, দেশীয় লোকদিগের মঙ্গল করিয়াছেন। দেশীয় লোকেরা, তাঁহার দয়ালুতা ও বিজ্ঞতার নিমিত্ত, যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছিলেন, তাহা অপাত্রে বিন্যস্ত হয় নাই।"
এলেবেলের সুচিন্তিত মন্তব্য হল বিদ্যাসাগর এক্ষেত্রে "কর্নওয়ালিসের ভূয়সী প্রশংসা" করেছেন।
মুশকিলটা হল কি জানেন মহায়, এলেবেলে ভাবছেন যে 'বাঙ্গালার ইতিহাস' বইটা বিদ্যাসাগরের নিজস্ব রচনা নয় বরং জন মার্শম্যানের 'আউটলাইন অফ দ্য হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল' বইয়ের স্রেফ অনুবাদ - এই তথ্যটি বোধহয় তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না! এবার দেখা যাক তো মার্শম্যান সাহেব তাঁর বইয়ের ২৩৮ পাতায় কি লিখেছেন,
"Yet the arrangements made by Lord Cornwallis are justly popular throughout the country. He is considered as the individual who gave the Government a fixed character, and who gave the Natives a great boon of a permanent settlement, and his benevolence and wisdom justly entitled him to that gratitude which he had received from the people."
ও এলেবেলে মহায়, বিদ্যাসাগর অনুবাদটি ঠিকঠাক করেছিলেন তো? না, আপনি ইনজিরির ম্যাস্টর কিনা, তাই জানতি চাইনু এজ্ঞে।
আপনার এই লেভেলের লোকঠকানো ট্রিকস এখন গাঁঘরে বিয়ের বরের সঙ্গে শ্যালিকারাও করে না, পরের শুক্রবার বরং একটু তৈরি হয়ে আসবেন, কেমন?
ও, একটা কথা। আপনার জ্ঞানগর্ভ বাণী হল, "ওই কারণেই একটা উদ্ধৃতির কতটা রাখতে হয় এবং কতটা ফেলে দিতে হয়, সেই পরিমিতিবোধ থাকা খুব জরুরি।"
নিশ্চয়ই, চেরি পিকিং করে নিজের ন্যারেটিভ চালাতে গেলে তা তো জরুরি বৈকি।
বাঙ্গালার ইতিহাস বিদ্যাসাগর-ভক্তদের চিরকালীন অ্যাকিলিস হিল বা ডেকান আলসার। তাই কখনও তারা বিদ্যাসাগর তার অনুবাদে কোথায় কোথায় পরিবর্তন করেছিলেন, তা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করেন! ঠেলায় পড়লেই তিনি অনুবাদের ক্ষেত্রে কতটা নিষ্ঠ ছিলেন, তা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন!
কিন্তু কিছু করার নেই। পরবর্তী অধ্যায় থেকে ওই অ্যাকিলিস হিল থেকে অংশবিশেষ গুঁজতে গুঁজতে যাওয়া হবে! কোন কারণে তিনি এই অনুবাদের কাজে হাত দেন, কী উদ্দেশ্যে সেটাকে আপামর বাংলার স্কুলগুলোতে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে চালিয়ে দেন - সেসব তো আর এই পর্বে আসবে না, আসবে তৃতীয় পর্বে। ততদিন আপনি ব্যক্তি আক্রমণ অব্যাহত রাখতে পারেন।
এলেবেলে এটা জেনেই মাঠে নেমেছে, অধ্যায়ের সংখ্যা যত বাড়তে থাকবে - স্লেজিং-এর সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে তার চার গুণ বাড়তে পারে। ভবিষ্যতে পাত্তা দেব না। মিটে গেল।
এলেবেলে ওরফে দেবোত্তম দেখছি চালাকি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তাই বোধহয় পয়েন্টে কথা না বলে কথা ঘোরাচ্ছেন।
ম্যাচ পুরো জমে ক্ষীর। আমরা ক্রিকেটের দর্শকরা কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে উপভোগ করছি।
এলেবেলের বক্তব্য কিছুটা বুঝতে পেরেছি মনে হয়!
কেবল একটা কথা বলে যেতে চাই - লেখাটার টোন নিয়ে এক্স্পেক্টেশান বিল্ড করেছি নামকরন থেকেঃ
জমে ক্ষীর।
শুক্রবারের প্রতীক্ষায়।
পড়ছি, আর তথ্যবহুলতায় চমকে যাচ্ছি। ইতিহাসপাঠ তেমন নিবিড় বা গভীর ছিল না। কিন্তু সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে এমন বিশ্লেষণী লেখা পড়ে চমৎকৃত হচ্ছি। লেখকের অনুসন্ধানী পরিশ্রম শেষপর্যন্ত আমাদের একটা দৃষ্টি-উন্মীলনী বই উপহার দিতে সক্ষম হবে, এ আশা রাখছি।