নবম অধ্যায়
বিদ্যাসাগর ও নারীশিক্ষা – তোতাকাহিনী-র পুনরাবৃত্তি
…এই ভারতবর্ষে ইংলণ্ডাধিপতি হস্তে পতিত হওয়াবধিই ইহাতে কিয়ৎ পরিমাণে স্ত্রীবিদ্যার অনুশীলন হইতে আরম্ভ হয়। কিন্তু তখন এক্ষণকার মত ইহার প্রাদুর্ভাব হয় নাই কেবল বিষয় সম্পত্তি রক্ষা করিবার জন্য দুই একজন ভূস্বামিপত্নী যৎকিঞ্চিৎ মাত্র শিক্ষা করিতেন। তৎপর এতদ্দেশে যখন খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী মহোদয়গণ স্থানে স্থানে ভজনালয় সংস্থাপন ও বিদ্যামন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন, আর সেই ধর্মের সুন্দর জ্যোতি দর্শনে মোহিত হইয়া যখন হিন্দু যুবকগণ সস্ত্রীক ঝম্প প্রদানে প্রবৃত্ত হন এবং উল্কধারিণী কৃষ্ণাঙ্গী অবলাগণকে বিবী করণ মানসে বিদ্যা চর্চায় প্রয়োগ করেন, তৎকাল হইতেই এই ভারত সুতাগণের বিদ্যানুশীলনের পথ আবিষ্কৃত হয়।
— কৈলাসবাসিনী দেবী, হিন্দু অবলাকুলের বিদ্যাভ্যাস ও তাহার সমুন্নতি
অনেকেই মনে করেন, বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে ও উৎসাহেই বাংলায় নারীশিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে নারীশিক্ষার এক দীর্ঘ ইতিহাস বর্তমান। এই পর্বে সেই ইতিহাস উল্লেখের সূত্রে আমরা ক্রমশ বিদ্যাসাগরের জন্মের আগে থেকে যে সময়ে নারীশিক্ষা বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ নীরব, সেই সময় অবধি আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। একই সঙ্গে তদানীন্তন আমলে বিদ্যাসাগর ঠিক কোন মেয়েদের জন্য কী ধরণের শিক্ষাকে সমর্থন করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গটি সবিস্তারে আলোচিত হবে।
উনিশ শতকে বাঙালি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। ১৮১৯ সালে কলকাতার ব্যাপটিস্ট মিশনারির উদ্যোগে ও কতিপয় সহৃদয় ইংরেজ মহিলার সহযোগিতায় স্থাপিত হয় ‘The Female Juvenile Society for the Establishment and Support of Bengali Female Schools’ বা ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’। ওই বছরের প্রথম দিকে, সোসাইটির অর্থানুকূল্যে কলকাতার গৌরীবাড়িতে প্রথম অবৈতনিক বালিকা বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। কিছু দিনের মধ্যে সোসাইটি নন্দনবাগান, জানবাজার ও চিৎপুর অঞ্চলে আরও তিনটি বিদ্যালয় খোলে।
১৮২১-এর নভেম্বর মাসে, ইংল্যান্ডের ‘ব্রিটিশ অ্যান্ড ফরেন স্কুল সোসাইটি’ মিস মেরি অ্যান কুক (Mary Anne Cooke)-কে নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য এ দেশে পাঠান। সোসাইটির উদ্যোগ, কুকের আন্তরিক পরিশ্রম ও স্থানীয় অধিবাসীদের উৎসাহে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে – ঠনঠনিয়া, মির্জাপুর, শোভাবাজার, কৃষ্ণবাজার, শ্যামবাজার, মল্লিকবাজার ও কুমারটলি – নতুন আটটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৮২৩ সালে কুকের (ওই বছরে বিবাহসূত্রে তিনি মিসেস উইলসন নামে পরিচিত হন) পরিচালনাধীন স্কুলের সংখ্যা হয় ২৩, ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়ায় ৫০০। ১৮২৪-এ ‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি’-র উদ্যোগে ‘Ladies’ Society for Native Female Education in Calcutta and its vicinity’ বা ‘লেডিস সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। চার্চ মিশনের পক্ষে নারীশিক্ষার সমস্ত দায়িত্ব মিসেস উইলসন গ্রহণ করেন। ওই বছরেই সোসাইটির ২৪টি স্কুলে ৪০০ জন মেয়ে ভর্তি হয়। অল্প দিনের মধ্যে সোসাইটির স্কুলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৩০, ছাত্রীসংখ্যা ৬০০-র কাছাকাছি।
১৮২৫-এর ১৪ জানুয়ারি ‘লেডিস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে আরেকটি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমিতিরও প্রেসিডেন্ট হন মিসেস উইলসন। প্রধানত মুসলমানপ্রধান এন্টালি ও জানবাজার অঞ্চলে, সমিতির উদ্যোগে এবং স্থানীয় মুসলমানদের উৎসাহে কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে কুকের স্কুলগুলি শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকার কারণে চার্চ মিশন একটি ‘সেন্ট্রাল ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয় এবং মিসেস উইলসনকে ‘লেডিস সোসাইটি’ ও কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় গঠনের সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে। ১৮২৮-এর ১ এপ্রিল, ৮৫ জন ছাত্রী নিয়ে কেন্দ্রীয় বালিকা বিদ্যালয় শুরু হয়। মি. ও মিসেস উইলসনের তত্ত্বাবধানে ১৮২৯-৩০ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রীসংখ্যা হয় প্রায় ২০০ জন। এই বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রী ছিল মূলত নিম্নবিত্ত হিন্দু ও মুসলমান পরিবারের মেয়েরা; পড়ানো হত মাতৃভাষা, ভূগোল, অল্প গণিত, সেলাই এবং খ্রিস্টীয় নীতিকথা।
কুকের প্রচেষ্টায় নারীশিক্ষার উপকারিতা সম্পর্কে রক্ষণশীল হিন্দুরাও ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু কুকের আন্তরিকতা এবং পাদরিদের উৎসাহ সত্ত্বেও মূলত মিশনারি ও নিম্নজাতি সংস্পর্শ বর্জন করার কারণে, মধ্যবিত্ত হিন্দু ভদ্রলোকেরা এই সব স্কুলে তাঁদের কন্যাদের ভর্তি করেননি। তবু এরই মধ্যে মিশনারিদের প্রচেষ্টার সঙ্গে হিন্দু ভদ্রলোকদের সদিচ্ছা দু-একবার মিলিত হয়। সেন্ট্রাল ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য রাজা বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় ২০ হাজার টাকা দান করেন। ১৮২২ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক গ্রন্থটিকে ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ এবং ‘লেডিস সোসাইটি’ পরিচালিত স্কুলগুলিতে পাঠ্য করা হয়।
যদিও রাজা রাধাকান্ত দেব গৌরমোহনকে এই বই লিখতে উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং বইটি লেখার প্রয়োজনীয় বেশ কিছু মালমশলা তাঁকে যোগান দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি ‘সম্ভ্রান্ত’ হিন্দু পরিবারের মেয়েদের এই সব স্কুলে পাঠানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। এ বিষয়ে ১৮২১-এর ১০ ডিসেম্বর কলকাতা স্কুল সোসাইটির সম্পাদক পিয়ার্স (W.H. Pearce)-কে তিনি লেখেন:
I beg leave to observe, that the British and Foreign School Society, bearing in the mind the usages and customs of the Hindoos, have sent out Miss Cooke to educate Hindoo females, and that I fear none of the good and respectable Hindoo Families will give her access to the women’s Apartment, nor send their females to her school if organized. They may be all convinced of the utility of getting their female children taught at home in Bengalee, by their domestic school masters, as some families do, before such female children are married, or arrived to the age of 9 or 10 years at farthest.১
সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের অভিভাবকদের পাশাপাশি তৎকালীন সরকারি শিক্ষা দফতর যেমন নারীশিক্ষা সম্পর্কে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, তেমনই এ বিষয়ে দেশীয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলিকে সাহায্য করতেও এগিয়ে আসেনি। ফলত ১৮৩০ নাগাদ এই সব বিদ্যালয়ের অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যায়।
স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক -এর দ্বিতীয় ভাগ ‘স্ত্রীলোকের বিদ্যাভ্যাসের প্রমাণ’-এ গৌরমোহন লিখেছিলেন —
যদি বল স্ত্রীলোকের বুদ্ধি অল্প, একারণ তাহাদের বিদ্যা হয় না, অতএব পিতা মাতাও তাহাদের বিদ্যার জন্য উদ্যোগ করেন না, এ কথা অতি অনুপযুক্ত; যে হেতুক নীতিশাস্ত্রে পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীর বুদ্ধি চতুর্গুণ ও ব্যবসায় ছয়গুণ কহিয়াছেন। এবং এদেশের স্ত্রীলোকদের পড়াশুনার বিষয়ে বুদ্ধি পরীক্ষা সংপ্রতি কেহই করেণ নাই। এবং শাস্ত্রবিদ্যা ও জ্ঞান ও শিল্পবিদ্যা শিক্ষা করাইলে যদি তাঁহারা বুঝিতে ও গ্রহণ করিতে না পারেন, তবে তাঁহারদিগকে নির্বোধ কহা উচিত হয়। এ দেশের লোকেরা বিদ্যা শিক্ষা ও জ্ঞানের উপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন না বরং তাঁহাদের মধ্যে যদি কেহ বিদ্যা শিখিতে আরম্ভ করে তবে তাঁহাকে মিথ্যা জনরব মাত্র সিদ্ধ নানা অশাস্ত্রীয় প্রতিবন্ধক দেখাইয়া ও ব্যবহার দুষ্ট বলিয়া মানা করাণ।২
দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের পরে, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে। নারীশিক্ষার বিষয়ে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একদল তরুণ নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা পার্থেনন, এনকোয়্যারার, জ্ঞানান্বেষণ ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় নারীশিক্ষার সমর্থনে লেখালেখি শুরু করেন। ১৮৪৫-এ উত্তরপাড়ার জমিদার ভ্রাতৃদ্বয় জয়কৃষ্ণ ও রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় উত্তরপাড়ায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে শিক্ষা সংসদের কাছে সরকারি সাহায্যের আবেদন করেন, যদিও তাঁরা সরকারি তরফে কোনও সাড়া পাননি। এর বছর দুয়েক পরে, নবীনকৃষ্ণ মিত্র, কালীকৃষ্ণ মিত্র, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৪৭ সালে বারাসতে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত, এটিই ‘সম্ভ্রান্ত’ বাঙালিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম প্রকাশ্য বালিকা বিদ্যালয়।
১৮৪৮-এর এপ্রিল মাসে বড়লাটের আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে ভারতবর্ষে আসেন জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (J. Bethune)। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি শিক্ষা সংসদের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। বেথুন এ দেশে পৌঁছনোর অল্প কিছু দিন পরে, ১৮৪৯-এ জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় আবারও সরকারের সহযোগিতায় উত্তরপাড়ায় মেয়েদের একটি অবৈতনিক স্কুল খোলার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান। সরকার থেকে এবারও কোনও ইতিবাচক সাড়া তিনি পাননি। ইতিমধ্যে ১৮৪৯ সালের ৭ মে, বেথুন রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারের (ডালহৌসিকে লেখা চিঠিতে বেথুন স্বয়ং এই তিন জনের নামোল্লেখ করেছিলেন) সক্রিয় সহযোগিতায় চালু করেন ‘ক্যালক্যাটা ফিমেল স্কুল’।
বেথুন নিয়ম করেন, তাঁর স্কুলে কেবল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের চার থেকে দশ বছর বয়সী মেয়েদের ভর্তি করা হবে। এই শিক্ষা হবে অবৈতনিক এবং দূরবর্তী মেয়েদের স্কুলে যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা থাকবে। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে বেথুন তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বলেন –
এই বিদ্যালয়ের মেয়েদের প্রথমে বাংলার ভিত গড়া হবে, পরে অল্পস্বল্প ইংরেজিও শেখানো হবে। তবে অভিভাবকের অনুমতি না নিয়ে, কোনও মেয়েকে ইংরেজি পড়ানো হবে না। পাশাপাশি মেয়েদের যে অজস্র শিক্ষণীয় বিষয় – সূঁচ শিল্প, এমব্রয়ডারি ও অন্যান শৌখিন কর্ম, অঙ্কন – আছে সে বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হবে।৩ [নজরটান সংযোজিত]
বেথুনের ভাষণ থেকে স্পষ্ট, মেয়েদের সাধারণ বুদ্ধিতে কিছুটা শান দিয়ে ভাবীকালের উপযুক্ত গৃহিণী করে তোলাই ছিল তাঁর নারীশিক্ষা প্রচলনের মূল উদ্দেশ্য। বিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচ বহন করতেন বেথুন নিজে, এই বাবদ তাঁর খরচ হত মাসিক ৮০০ টাকা। অবশেষে ২১ জন মেয়েকে নিয়ে ক্যালক্যাটা ফিমেল স্কুল শুরু হয়। পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার, তাঁর দুই কন্যা ভুবনবালা ও কুন্দমালাকে প্রথম দিনেই এই স্কুলে ভর্তি করে দেন।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে বেথুন তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে আরও দুটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে নারীশিক্ষার মূল সুরটি বেঁধে দেন। তিনি বাংলার ইংরেজি-শিক্ষিত যুবকদের উদ্দেশে বলেন —
I believed that you, having felt in your own person that elevating influence of a good education, would before long begin to feel the want of companions, the cultivation of whose taste and intellect might correspond in some degree to your own; that you would gradually begin to understand how infinitely the happiness of domestic life may be enhanced by the charm which can be thrown over it by the graceful virtues and elegant accomplishments of well educated women….৪ [নজরটান সংযোজিত]
অর্থাৎ ‘happiness of domestic life’ বহু গুণ বৃদ্ধি করার জন্য এই যুবকরা তাঁদের ভাবী জীবনসঙ্গিনীদের শিক্ষার ভার নেবেন। যদিও ‘in some degree’ শব্দবন্ধে বেথুন তাঁদের আশ্বস্ত করেন যে, তার ফলে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোটির সামান্যতম ক্ষতিও হবে না! তাঁর ভাষণের দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি আরও মারাত্মক। ভারতবর্ষের ইতিহাসের নিজস্ব সাম্রাজ্যবাদী ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন:
Further, it was a hopeful reflection that the seclusion and the ignorance to which your females have been so long condemned do not belong to the oldest customs of your nation, that they are themselves innovations, brought in, as I believe, by a courtly imitation of your Mohammedan invaders.৫
বেথুনের ভাষণে উল্লিখিত এই দুটি প্রসঙ্গেরই অবিকল প্রতিধ্বনি করে বেথুন-অনুরক্ত মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্ত্রীশিক্ষা নামক এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন।
এই প্রবন্ধের প্রথমাংশে তিনি বলে নেন,
আমরা তো ভূয়োভূয় দর্শন করিতেছি শিক্ষা কার্যের উপযোগিনী যে যে শক্তিমত্তার আবশ্যক, স্ত্রী জাতির সে সমুদায়ই আছে কোন অংশে ন্যূনতা নাই; বরং পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রী লোকের কোন কোন বুদ্ধিবৃত্তির আধিক্যই দেখা যায়। ...অতএব বালকেরা যেরূপ শিখিতে পারে, বালিকারা সেরূপ কেন না পারিবেক?৬
যদিও ওই একই প্রবন্ধে তিনি নারীশিক্ষার আসল উদ্দেশ্যটি ব্যক্ত করে লিখে ফেলেন:
যাহার সহিত চিরকাল এক শরীরের ন্যায় হইয়া বাস করিতে হয়, ও যাহার সুখে সুখী দুঃখে দুঃখী হইতে হয়, এবং শাস্ত্রানুসারে যে ব্যক্তি শরীরের অর্ধ বলিয়া পরিগণিত; সেই সহধর্মিনী পশুর মত ঘোরতর মূর্খ, ইহা অপেক্ষা আর কি অধিকতর কষ্ট ঘটিতে পারে?৭
একই সঙ্গে নারীশিক্ষার পরিসীমাটিকে নির্ধারিত করে দিয়ে তিনি লেখেন –
তাহারা অন্তঃপুরে বসিয়া নানাবিধ শিল্পকার্য ও কারুকর্ম নির্মাণ করিবে তদ্দ্বারা অনায়াসে অভিলষিত অর্থেরও অধিগম হইতে পারিবে। পুরুষেরা গৃহে বসিয়া যে সকল লেখাপড়া করেন স্ত্রীজাতিরা তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ সাহায্য দান করিতে পারিবে। গৃহস্থালী ব্যাপারে আয় ব্যয় বিষয়ক লিখন পঠন নির্বাহার্থে যে সমুদয় লোক নিযুক্ত করিতে হয় গৃহের গৃহিণীরা ও নন্দিনীরা অনায়াসে তৎসমুদায় সম্পাদন করিতে যে সমর্থা হইবে তদ্বিষয়ে সন্দেহ কি?৮ [নজরটান সংযোজিত]
নারীশিক্ষা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মদনমোহন আত্রেয়ী, গার্গী, মৈত্রেয়ী, রুক্মিণী, লীলাবতী, কর্ণাট রাজমহিষী, কালিদাসপত্নী, খনা, হটি বিদ্যালঙ্কার প্রভৃতি বিদূষী রমণীর উল্লেখ করলেও রাজিয়া সুলতানা, চাঁদ বিবি, নুরজাহান, জাহানারা, জেবউন্নিসা প্রমুখ কোনও শিক্ষিত মুসলমান নারীর উল্লেখ করেননি। বরং নারীশিক্ষার অভাবের কারণ হিসেবে একমাত্র মুসলমানদের দায়ী করে তিনি প্রবন্ধটিতে অবলীলায় লিখতে পেরেছেন —
কিছুকাল হইল এদেশে স্ত্রীজাতির বিদ্যাভ্যাসের প্রথা কিঞ্চিৎ স্থগিত হইয়াছে তাদৃশ প্রচরদ্রূপ নাই, ইহা আমরাও অস্বীকার করি না। ইহার কারণ কি? অন্বেষণ করিলে অতি স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হইবেক। এই দেশ যখন দুরন্ত যবনজাতি দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিল তৎকালে ঐ দুর্বৃত্তজাতির দৌরাত্ম্যে আমাদিগের সুখসম্পত্তির একেবারেই লোপাপত্তি হইয়াছিল। কেহ ইচ্ছানুসারে নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করিতে পারিত না। ...দুশ্চরিত্র যবনজাতির ভয়ে স্ত্রীলোকদিগের প্রকাশ্য স্থানে গমনাগমন ও বিদ্যানুশীলন সম্পূর্ণরূপে স্থগিত হইয়া গেল। সকলেই আপনাপন জাতি প্রাণ কুলশীল লইয়া শশব্যস্ত, স্ত্রীজাতিকে বিদ্যা দান করিবেক কি পুরুষদিগেরও শাস্ত্রালোচনা মাথায় উঠিল। তদবধি স্ত্রীদিগের অন্তঃপুরনিবাস ও বিদ্যাভ্যাস নিরাশ হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে জগদীশ্বরের কৃপায় আমাদিগের আর সে দুরবস্থা নাই, অত্যাচারী রাজা নাই। শুভদিন পাইয়া সকল শুভকর্মেরও অনুষ্ঠান করিতেছি। আমাদিগের লুপ্তপ্রায় অন্যান্য সদ্ব্যবহার সকল পুনরুদ্ধার করিতেছি। অতএব এমত সুখের সময়ে সংসার সুখের নিদানভূত আপন আপন পুত্র কলত্র কন্যাদিগকে কি বিদ্যারসে বঞ্চিত রাখা উচিত?৯ [নজরটান সংযোজিত]
‘সম্ভ্রান্ত’ হিন্দুদের যুগপৎ নির্ভেজাল ব্রিটিশবন্দনা ও তীব্র মুসলমান বিদ্বেষের চরম নিদর্শন প্রদর্শন করে, প্রবন্ধটির একেবারে শেষে তিনি সিদ্ধান্ত নেন:
এক্ষণে আমরা এক প্রকার স্থির করিয়াছি, এদেশের মৃত্তিকায় যথার্থ উৎসাহী ও যথার্থ হিতকারী মনুষ্য জন্মিতে পারে না। অতএব এ দেশ মধ্যে স্ত্রী শিক্ষা অথবা বিধবাবিবাহ প্রভৃতি যে কিছু মহৎকার্য যখন ঘটিবে, তাহা বিদেশীয় লোকের অর্থাৎ ইউরোপীয় জাতির হস্ত দ্বারাই সম্পাদিত হইবে, দেশের লোক কেবল হা করিয়া চাহিয়া রহিবেন।১০
পরবর্তীকালে এই একই মনোভাব আমরা একাধিক শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের মধ্যেও দেখতে পাব।
যাই হোক, আমরা আবার নারীশিক্ষার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বেথুনের স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে, ভারত সরকার নারীশিক্ষা বিষয়ে তাদের উদাসীন নীতি খানিকটা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। স্কুল প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পরে, ১৮৫০ সালের ২৯ মার্চ বড়লাট ডালহৌসিকে বেথুন লেখেন,
আমি প্রস্তাব করছি যে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আপনি শিক্ষা সংসদকে এই নির্দেশ দিন, আমরা যেন এখন থেকে নারীশিক্ষা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং বিভিন্ন স্থানের উৎসাহী ব্যক্তিদের বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যথাযথ সাহায্য করি।১১
বেথুনের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বড়লাট ডালহৌসি ১ এপ্রিল তাঁর ‘মিনিট’-এ লেখেন:
নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তিনি আমাকে তাঁর পত্রে যে অনুরোধ জানিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ মঞ্জুর করতে আমি সম্মত আছি এবং আশা করি আমার সহযোগীরাও তাতে আপত্তি করবেন না।১২
ওই বছরের ১১ এপ্রিল ভারত সরকারের তদানীন্তন সচিব হ্যালিডে বাংলা সরকারকে জানান –
ভারত সরকার শিক্ষা সংসদকে অনুরোধ করছে, এখন থেকে তাঁরা যেন নারীশিক্ষার তত্ত্বাবধানকেও তাঁদের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করেন এবং এদেশীয় লোকের চেষ্টায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, সেই বিদ্যালয়কে যথাসাধ্য সাহায্য করতে কুণ্ঠিত না হন।১৩
দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় বেথুন স্কুলের নিজস্ব ভবনের জন্য মির্জাপুরে ১০ হাজার টাকা মূল্যের ৫ বিঘা জমি দান করেন। এই জমির পাশেই আরও কিছুটা জমি ১০ হাজার টাকায় কিনে নেন বেথুন। মেয়েদের যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে, অবশেষে তিনি হেদুয়ার কাছে সরকারি জমির সঙ্গে ওই দুটি জমি বদল করেন। ১৮৫০ সালে স্কুলের নিজস্ব ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
এই সময়ে বেথুন বিদ্যাসাগরকে অবৈতনিক সম্পাদকরূপে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করলে বিদ্যাসাগর ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশ্য ১৮৫১-র সেপ্টেম্বরে স্কুলের নিজস্ব ভবন তৈরি হওয়ার আগেই ১২ অগস্ট মারা যান বেথুন। মৃত্যুর আগে উইল করে বিদ্যালয়ের জন্য তিনি রেখে যান প্রায় ৩০ হাজার টাকার সম্পত্তি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে, স্কুলের হাল ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। ছাত্রীসংখ্যা ও তাদের উপস্থিতির হার দিন দিন কমতে থাকে। ১৮৫১-তে স্কুলটিতে ভর্তি হয় মাত্র একজন ছাত্রী, অথচ ওই বছরে ২৭ জন মেয়ে স্কুল পরিত্যাগ করে।১৪
এমতাবস্থায় ১৮৫১ সালের অক্টোবর থেকে তাঁর স্কুলটির সমস্ত খরচ চালাতে থাকেন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি। এই সময়ে বেথুনের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘ক্যালক্যাটা ফিমেল স্কুল’-এর নতুন নাম হয় ‘বেথুন স্কুল’। ১৮৫৬-র ৬ মার্চ ডালহৌসির বিদায়ের পরে, স্কুলটি সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত সরকারি স্কুলে পরিণত হয়। সরকারের অন্যতম সচিব সেসিল বিডন (Cecil Beadon)-এর তত্ত্বাবধানে স্কুলটি আসার পরে, ওই বছরের ১২ অগস্ট সরকারকে স্কুলটির তত্ত্বাবধানের জন্য তিনি একটি পরিচালন সমিতি (Managing Committee) গঠন করার ও বিদ্যাসাগরকে সেই সমিতির সম্পাদক করার প্রস্তাব দেন। বিডনের প্রস্তাব অনুযায়ী ২০ সেপ্টেম্বর সরকারি তরফে একটি সমিতি গঠিত হয়। নবগঠিত সমিতির সভাপতি হন সেসিল বিডন এবং বিদ্যাসাগর হন সেই সমিতির সম্পাদক।
১৮৫০ সালে বিদ্যাসাগর নামেই স্কুলটির অবৈতনিক সম্পাদক হয়েছিলেন, কারণ দীর্ঘ ছ’বছরে স্কুলটির সম্পাদক হিসেবে তাঁর কার্যকলাপের কোনও হদিশ পাওয়া যায় না। এমনকি ১৮৫৬-তেও সম্পাদক হিসেবে বিদ্যাসাগর স্কুলটিতে বেথুন প্রবর্তিত মূল নিয়মাবলি পরিবর্তন করার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন অনুভব করেননি। নারীশিক্ষাকে কেবল ‘সম্ভ্রান্ত’ হিন্দু পরিবারের মেয়েদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং তাদের নিছকই সেলাই-ফোঁড়াই জাতীয় গৃহস্থালির কাজে পারঙ্গম করে তোলার বিষয়ে বেথুনের সঙ্গে তাঁর যে কোনও মতবিরোধ ছিল না, ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর কলকাতার বিশিষ্ট হিন্দু পরিবারবর্গের কাছে পাঠানো বিদ্যাসাগর-স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘কলিকাতা ও তৎসান্নিধ্যবাসী হিন্দুবর্গের প্রতি বিজ্ঞাপন’-এ বলা হয় —
ভদ্র জাতি ও ভদ্র বংশের বালিকারা এই বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইতে পারে, তদ্ব্যতীত আর কেহই পারে না, যাবৎ কমিটির অধ্যক্ষদের প্রতীতি না জন্মে অমুক বালিকা সদ্বংশজাতা এবং যাবৎ তাঁহারা নিযুক্ত করিবার অনুমতি না দেন তাবৎ কোন বালিকাই ছাত্ররূপে পরিগৃহীত হয় না।১৫ [নজরটান সংযোজিত]
বেথুন তাঁর স্কুলে ‘ধর্মীয়’ শিক্ষা দেওয়ার বিরোধী ছিলেন অথচ প্রথমাবধি তাঁর স্কুলে কেবল ‘সদ্বংশজাতা’ হিন্দু মেয়েদের ভর্তি করার যে নিয়ম চালু করেছিলেন, তা অক্ষুণ্ণ রাখতে বিদ্যাসাগর কোনও অস্বস্তি বোধ করেননি! যে বিদ্যাসাগর তাঁর মডেল স্কুলে চালু করতে চান ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞান; সেই একই সময়ে বেথুন স্কুলের পাঠ্যসূচী হল:
পুস্তক পাঠ, হাতের লেখা, পাটীগণিত, পদার্থবিজ্ঞান, ভূগোল ও সূচীকর্ম, এই সকল বিষয়ে বালিকারা শিক্ষা পাইয়া থাকে, সকল বালিকাই বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা করে আর যাহাদের কর্তৃপক্ষীয়েরা ইংরেজী শিখাইতে ইচ্ছা করেন তাহারা ইংরেজীও শিখে।১৬
শুধু তাই নয়, হুবহু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের প্রবন্ধটির সুরেই এই বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয় –
হিন্দু জাতীয় স্ত্রীলোকদিগের যথোপযুক্ত বিদ্যা শিক্ষা হইলে হিন্দু সমাজের ও এতদ্দেশের যে কত উপকার হইবে তদ্বিষয়ে অধিক উল্লেখ করা অনাবশ্যক, যাঁহাদের অন্তঃকরণ জ্ঞানালোক দ্বারা প্রদীপ্ত হইয়াছে তাঁহারা অবশ্যই বুঝিতে পারেন ইহা কত প্রার্থনীয় যে যাঁহার সহিত যাবজ্জীবন সহবাস করিতে হয় তাঁহারা সুশিক্ষিত ও জ্ঞানাপন্ন হন এবং শিশুসন্তানদিগকে শিক্ষা দিতে পারেন, আর স্ত্রী ও কন্যাগণের মনোবৃত্তি প্রকৃতরূপে মার্জিত হইয়া অকিঞ্চিৎকর কার্যের অনুষ্ঠানে পরাঙ্মুখ থাকে এবং যে সকল কার্যের অনুষ্ঠানে বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতি ও পরিশুদ্ধি হইতে পারে তাতে প্রবৃত্ত হয়।১৭ [নজরটান সংযোজিত]
বাংলায় নারীশিক্ষা প্রচলনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের প্রকৃত মনোভাব বোঝার ক্ষেত্রে এই বিজ্ঞপ্তিটি অনেক দিক থেকেই সাহায্য করে। এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় – ক) ইংরেজি শিক্ষার মতো নারীশিক্ষার আঙিনা থেকেও নিম্নবর্ণের হিন্দু ও দরিদ্র মুসলমানদের অপাঙ্ক্তেয় করে রাখা হবে, খ) এই শিক্ষা সংরক্ষিত থাকবে কেবল ‘সম্ভ্রান্ত’ হিন্দু পরিবারের মেয়েদের জন্য, গ) মেয়েরা বিবাহযোগ্যা গণ্য হওয়া মাত্র তাদের শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং ঘ) এই মেয়েদের আদর্শ স্ত্রী ও জননী হিসেবে গড়ে তোলার কারণে, কোনও অবস্থাতেই তাদের পাঠ্যক্রম ছেলেদের মতো হবে না। এই বিদ্যাসাগর নাকি আমাদের নারীশিক্ষার কাণ্ডারি!
স্ত্রীশিক্ষার ‘সুধাময় ফল’ বৃহত্তর জনসমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, ১৮৫৭ সালে দ্বারকানাথ রায় স্ত্রীশিক্ষা-বিধান নামে একটি বই প্রকাশ করেন। গ্রন্থটির প্রথম ভাগ ‘স্ত্রীশিক্ষা প্রতিপক্ষগণের আপত্তি খণ্ডন’-এ তিনি লেখেন,
মাতার যেরূপ কষ্টে পুত্র সন্তানকে গর্ভে ধারণ করিতে হয়, কন্যা সন্তানকেও সেই রূপে গর্ভে স্থান দিতে হয়; তবে হতভাগ্য কন্যা সন্তানেরা কেন অত অপদার্থ হইয়া পড়ে! পুত্র ও কন্যাতে কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। অতএব, মাতা পিতার কর্তব্য, যে তাঁহারা যেরূপ যত্নে পুত্রদিগকে বিদ্যাভ্যাসার্থ গুরুসদনে নিযুক্ত করেন, কন্যা সন্তানদিগকেও সেই রূপে বিদ্যা দানে যত্নবান হয়েন।১৮
কিন্তু দ্বারকনাথ যতই লিখুন না কেন ‘পুত্র ও কন্যাতে কিছুমাত্র প্রভেদ নাই’; তা যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল, সে কথা একই বছরে সম্বাদ ভাস্কর-এ প্রকাশিত বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞাপনটিতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সরকারি বেথুন স্কুলের আলোচনা সাময়িক স্থগিত রেখে, আমরা বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা একাধিক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে মনোনিবেশ করি। ১৮৫৪ সালে উডের নির্দেশনামায় নারীশিক্ষার পক্ষে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নেওয়ার পরে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একের পর এক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বরিশাল, কুমিল্লা, পাবনা, যশোহর, রংপুর এবং দক্ষিণবঙ্গের কুমারখালি, কোন্নগর, খড়দহ, পলতা, বরানগর, রানাঘাট, নৈহাটি, শান্তিপুর, সালকিয়া, বেহালা, মজিলপুর প্রভৃতি অঞ্চলে একাধিক বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। শুধু মফস্সলের বিভিন্ন প্রান্তে নয়, কলকাতার রামবাগান, জানবাজার, চোরবাগান প্রভৃতি স্থানেও স্থাপিত হতে থাকে একাধিক বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়গুলির প্রতিটিই যে দীর্ঘদিন চলেছিল তা নয়, কিন্তু মেয়েদেরও লেখাপড়া শেখার অধিকার আছে এবং লেখাপড়া করলে মেয়েদের কোনও ক্ষতি হয় না – অন্তত এই ধারণাটি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গে বিদ্যালয়গুলি এক সদর্থক ভূমিকা পালন করে। মাথুরের তথ্য উদ্ধৃত করে ফোর্বস (Geraldine Forbes) তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন:
In 1854 there were approximately 626 girls’ schools (Bengal 288, Madras 256, Bombay 65 and NWFP and Oudh 17) with a total of 21,755 students.১৯
এই তথ্য থেকে অন্তত এ কথা প্রমাণ হয়, দেশ জুড়ে এই বিশাল সংখ্যক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের কোনও ভূমিকাই ছিল না।
আমরা আগেই দেখেছি, বড়লাট লর্ড ডালহৌসির আমলে ১৮৫০ সালে বাংলায় দেশীয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে সরকারি সাহায্য দেওয়ার জন্য, ভারত সরকারের সচিব হ্যালিডে শিক্ষা সংসদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৮৫৪-তে হ্যালিডে বাংলার ছোটলাট হওয়ার পরে, মূলত তাঁরই উৎসাহে দক্ষিণবঙ্গের সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক বিদ্যাসাগর মাতৃভাষা শিক্ষার প্রসারকল্পে গ্রামে গ্রামে মডেল স্কুল স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এবারে ১৮৫৭-র গোড়ার দিকে, হ্যালিডের উদ্যোগে তিনি নারীশিক্ষা প্রসারের কাজে উদ্যমী হন। যদিও আমরা দেখতে পাব, কেবল হ্যালিডের বরাভয়ে আশ্বাস রাখার ফলে এবং বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম পরিকল্পনার অভাবে, বিদ্যাসাগরের এই প্রয়াসটিও মাঝপথেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
বিদ্যাসাগর যখন প্রথম এই কাজে অগ্রসর হন, তার কয়েক মাস আগে দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয় পরিদর্শক প্র্যাট জনশিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ংকে হুগলির হরিপাল থানার দ্বারহাটা ও বৈদ্যবাটি থানার গোপালনগর এবং বর্ধমানের নাড়ুগ্রামের তিনটি বালিকা বিদ্যালয়ের আর্থিক অনুদান (Grants-in-aid) সংক্রান্ত আবেদন পাঠান। ১৮৫৭ সালের ১৮ মার্চ ইয়ং আবেদনগুলি সরকারের কাছে পেশ করলে ছোটলাট তিনটি আবেদনই মঞ্জুর করেন। শুধু তাই নয়, বিভাগীয় পরিদর্শকদের কাছে এই ধরণের আরও আবেদন এলে, সেই বিষয়ে ছোটলাটকে জানানোর অনুরোধও করেন।২০ ওই বছরের ১৫ এপ্রিল, বর্ধমানের জৌগ্রামের মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পরামর্শক্রমে জৌগ্রামের স্থানীয় বাসিন্দারা একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়টি পরিদর্শনের পরে ওই বিদ্যালয়টিতে প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, পরিচারিকা ও আনুষঙ্গিক খরচ (যথাক্রমে ২৫, ১৫, ২ ও ৫ টাকা) বাবদ ৪৭ টাকা মাসিক সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ৩০ মে বিদ্যাসাগর ইয়ংকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি জানান,
বিদ্যালয়টিতে ২৮ জন বালিকার বয়স ৪ থেকে ১১-র মধ্যে এবং তাদের অধিকাংশই স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবারের কন্যা।২১
প্রথম অবস্থায় দুজন শিক্ষক বাহুল্য মনে করে ইয়ং একজন শিক্ষকের বেতন বাদ দেন এবং বিদ্যালয়টিতে মাসিক ৩২ টাকা সরকারি সাহায্য মঞ্জুর করার পক্ষে মত প্রকাশ করে আবেদনটি সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেন।
এই ঘটনায় বিদ্যাসাগর মনে করেন, তিনি নিজে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে সেগুলিও সরকারি অনুদান পাবে। কেবল এই ধারণার বশবর্তী হয়ে এবং কোনও সরকারি অনুমতির তোয়াক্কা না করে, ‘বিশেষ’ পরিদর্শক হিসেবে ১৮৫৭-র নভেম্বর থেকে ১৮৫৮-র মে অর্থাৎ মাত্র ৭ মাসের মধ্যে, তিনি হুগলির বিভিন্ন গ্রামে ২০টি, বর্ধমানে ১১টি, মেদিনীপুরে ৩টি ও নদীয়ায় একটি মিলিয়ে মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই বিদ্যালয়গুলির জন্য মাসে খরচ হত ৮৪৫ টাকা, ছাত্রীসংখ্যা ছিল প্রায় ১,৩০০।২২ যদিও তখনও অবধি তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি বালিকা বিদ্যালয়ও সরকারি আর্থিক অনুমোদন পায়নি, তবুও প্রত্যেকটি বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর কুলকৌলীন্য রক্ষা করার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৮৫৮-র ১৮ সেপ্টেম্বর উড্রো অধিকর্তা ইয়ংকে জানাচ্ছেন,
…Pundit Ishwar Chunder Bidyasagar opened forty Female Schools, secured an attendance of more than 1300 girls of good caste, and soon found himself liable for between three and four thousand Rupees.২৩ [নজরটান সংযোজিত]
এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট, এক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগর সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাবের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
বিদ্যাসাগরের বালিকা বিদ্যালয়গুলি আর্থিক অনুদান না পাওয়ার কারণে, স্বয়ং ছোটলাট উদ্যোগী হন। ১৮৫৮ সালের ১৩ এপ্রিল তিনি ভারত সরকারকে জানান, পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে যতগুলি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব এসেছে, তার মধ্যে জনশিক্ষা অধিকর্তা তাঁর কাছে ২৬টি বিদ্যালয়ের (তত দিনে বিদ্যাসাগর স্থাপন করে ফেলেছেন ২৪টি বিদ্যালয়) আর্থিক সাহায্যের আবেদনপত্র পাঠিয়েছেন। কিন্তু সরকারি আর্থিক অনুমোদনের শর্তগুলি আরও কিছুটা শিথিল না হলে, তাঁর পক্ষে এই আবেদনগুলি মঞ্জুর করা সম্ভব নয়।২৪ যদিও ৭ মে ভারত সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, বালিকা বিদ্যালয় সম্পর্কে সরকারি সাহায্যের শর্তাবলী পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। জনগণের নিজস্ব ব্যয় এবং সহযোগিতা ছাড়া চালাতে না পারলে সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হোক।২৫
বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়ে স্বয়ং ছোটলাট তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। ফলে বিদ্যাসাগরের দৃঢ় ধারণা ছিল, অন্তত তাঁর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির ক্ষেত্রে সরকারের তরফে আর্থিক অনুমোদনের বিষয়টিতে কোনও অসুবিধাই হবে না। তাই আর্থিক অনুদানের ব্যাপারে কোনও নিয়মনীতি না মেনে তিনি একাধিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং বিদ্যালয়গুলির প্রত্যেক কর্মচারীকে তিনি নিজেই নিযুক্ত করেন। কিন্তু ভারত সরকারের এই আদেশে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আর্থিক অনুমোদন ছাড়াই বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে, প্রথম থেকেই শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারীরা বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। ১৮৫৮-র জুন পর্যন্ত, সরকারের কাছে তাঁদের মোট পাওনা হয় ৩৪৩৯ টাকা ৩ আনা ৩ পয়সা। এই বকেয়া বেতনের জন্য ছোটলাট হ্যালিডে, জনশিক্ষা অধিকর্তা ইয়ং এবং বিদ্যাসাগরের তরফে ভারত সরকারের সঙ্গে বিস্তর চিঠি চালাচালির পরে, বিদ্যালয়গুলির যাবতীয় আর্থিক দায়ভার গ্রহণ করে ২২ ডিসেম্বর ভারত সরকার জানিয়ে দেয়,
এই বিদ্যালয়গুলিকে কোনও অবস্থাতেই অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এটা পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বা সরকারি বিদ্যালয় – উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।২৬
ফলে মাত্র এক বছরের মধ্যেই বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত একাধিক বালিকা বিদ্যালয় বন্ধ হতে শুরু করে। ১৮৫৯ সালের ২৫ জানুয়ারি জৌগ্রামের বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করে পরিদর্শক জানান, বিদ্যালয়টি তখনও মাসিক ৩২ টাকা অনুদান পেলেও ‘not a girl, boy or pundit was in attendance’।২৭
বালিকা বিদ্যালয়গুলির এহেন অকালমৃত্যুর পরে, বেথুন স্কুলের সম্পাদকরূপে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বাংলার নারীশিক্ষার ক্ষীণ যোগসূত্রটি অবশিষ্ট থাকে। যদিও নারীশিক্ষার বিষয়ে যে তাঁর ব্রাহ্মণ্যবাদী মনোভাবের কণামাত্র পরিবর্তন হয়নি, বিদ্যালয়ের সম্পাদক হিসেবে ১৮৬২-র ১৫ ডিসেম্বর বাংলা সরকারের কার্যকরী সচিব ইডেন (A. Eden)-এর কাছে তাঁর পেশ করা বেথুন স্কুলের নিয়মাবলি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৫ বছর পরেও স্কুলের প্রথম নিয়মটিই ছিল:
The School is established for the instruction of the female children of Hindus of respectable family.২৮
একই দিনে এ বিষয়ে জনশিক্ষা বিভাগে তিনি যে প্রতিবেদন পাঠান, তাতে জানা যায় স্কুলটিতে মেয়েদের পাঠ্যক্রম ও বয়ঃক্রমেরও কোনও পরিবর্তন হয়নি। তিনি লেখেন –
Reading, writing, arithmetic, biography, geography, and history of Bengal, with gallery, lessons on objects form the course of study. Needle-work and sewing are likewise taught.২৯
এমনকি ১৮৬৫ সালের ২৯ জুলাই বিদ্যাসাগর এ সম্পর্কে সরকারের কাছে জানান,
The course of study consisted of Reading, Writing, Arithmetic, Geography, and the Histories of Bengal and India. Lessons were also given on common objects and things, besides Needle Work and Sewing.৩০
অর্থাৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেয়েদের শিক্ষা সেই রুমাল তৈরি আর আসন বুননের পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকে!
যেখানে বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে আর্থিক অনুদানের ক্ষেত্রে সরকার অর্থাভাবের অজুহাত দেখালে বিদ্যাসাগর তা নতমস্তকে মেনে নেন, সেখানে ১৮৫৭ ও ১৮৫৮-তে বেথুন স্কুলের মাত্র ৫০ জন মেয়ের জন্য সরকার ব্যয় করে যথাক্রমে ৮,৩৬০ ও ৭,৬৯৩ টাকা। ১৮৪৯ সালের শেষে ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়ায় ২৫, তার ১৩ বছর পরেও সংখ্যাটি সাকুল্যে ১০০ ছাড়ায়নি। সঙ্গে প্রতি বছরেই অসংখ্য ছাত্রী ভর্তি হয়েও বিদ্যালয় ছেড়ে দিতে থাকে।৩১ বিপুল সরকারি অর্থব্যয় সত্ত্বেও বেথুন স্কুলে নারীশিক্ষার বিন্দুমাত্র অগ্রগতি না হওয়ায় ১৮৬৩-৬৪ সালে পরিদর্শক উড্রো জানান:
The little girls when first admitted are excessively irregular, they absent themselves for every trifling reason and often without any reason at all. ...All the girls in the school learn worsted work, and several needle works, and seem to use their fingers with facility. ...Only 21 girls out of 64 in attendance were accustomed to attach meaning to what they read. ...The ‘bhadra lok’ (the respectable), not the ‘dhani lok’ (the rich), send their children to the Bethune School....The average cost to Government of each child in attendance to the Bethune School is about Rs. 10/- a month.৩২ [নজরটান উড্রোর]
বেথুন স্কুলের দুরবস্থা দেখে ১৮৬৭ সালে বামাবোধিনী পত্রিকা-র সম্পাদকীয়তে লেখা হয় –
আমরা শুনিয়া দুঃখিত হইলাম যে এদেশের সর্বপ্রধান বেথুন বালিকাবিদ্যালয়ে এক্ষণে ৩০টী মাত্র ছাত্রী অধ্যয়ন করিতেছে। “ফ্রেণ্ড অভ ইণ্ডিয়া” সংবাদপত্র লিখিয়াছে, যে এই বিদ্যালয় উনিশ বৎসর স্থাপিত হইয়াছে, এই সময়ের মধ্যে গবর্ণমেন্ট ইহার শিক্ষার কার্যে (১,৪২,৭,৭৬) এক লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার সাতশত ছিয়াত্তর টাকা ব্যয় হইয়াছে। এতদ্ভিন্ন ইহার সংস্থাপক এককালে ৬০,০০০ ষাটি হাজার টাকা দান করেন এবং প্রতি তিন বৎসর অন্তর বাটীর সংস্কার কার্যেও যথেষ্ট অর্থ ব্যয় হয়। এরূপ প্রচুর অর্থ ব্যয় হইয়া যখন শুদ্ধ ৩০টী মাত্র সাত-আট বৎসর বালিকার সামান্য শিক্ষা লাভ হইতেছে, তখন ইহাতে অর্থের কেবল অপব্যয় হইতেছে বলিতে হইবে।৩৩
এই পরিস্থিতিতে, ১৮৬৬-র ২০ নভেম্বর মিস মেরি কার্পেন্টার (Mary Carpenter) নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য কলকাতা আসেন।
তত দিনে জনশিক্ষা দফতরের আওতাধীন বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০, ছাত্রীসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার।৩৪ এই বিপুল সংখ্যক বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে মিস কার্পেন্টার উপলব্ধি করেন, বাংলায় দেশীয় শিক্ষিকার অভাবের কারণে নারীশিক্ষা প্রসারের বিষয়টি ব্যাহত ও অবহেলিত হচ্ছে। ফলে দেশীয় মহিলাদের শিক্ষিকা হওয়ার উপযোগী শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বেথুন স্কুলেই একটি নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৮৬৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলার ছোটলাট উইলিয়াম গ্রে (William Grey) এ বিষয়ে স্কুলের সম্পাদক বিদ্যাসাগরের মত জানতে চেয়ে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। প্রত্যুত্তরে ১ অক্টোবর বিদ্যাসাগর তাঁকে জানান —
আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের পরে আমি এ বিষয়ে অনেক ভেবে দেখেছি এবং অনুসন্ধানও করেছি। কিন্তু আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এ সম্পর্কে আমার পূর্বের মত পরিবর্তনের কোনও কারণ আমি খুঁজে পাইনি। মিস কার্পেন্টারের শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণের এই পরিকল্পনাটি – সে বেথুন স্কুলেই হোক বা অন্য কোথাও হোক – হিন্দুসমাজের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে না। এ সম্পর্কে আমি যত ভেবেছি, তত এই ধারণাই আমার দৃঢ় হয়েছে। যে কাজ বা পরিকল্পনা বাস্তবে সফল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, তা আমি কোনও মতেই সরকারকে গ্রহণ করার পরামর্শ দিতে পারি না। যে সমাজে সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা তাঁদের দশ-এগারো বছরের বিবাহিত মেয়েদের বাড়ির বাইরে যেতে দেন না, তখন তাঁরা তাঁদের বাড়ির বয়স্কা মহিলাদের শিক্ষিকার কাজ গ্রহণে সম্মতি দেবেন, এ আশা অলীক কল্পনা মাত্র। একমাত্র সহায়সম্বলহীন বিধবা মহিলারা হয়তো এই পেশায় আসতে পারেন। যদিও শিক্ষকতার কাজে তাঁরা কতদূর উপযুক্ত হবেন আপাতত সে প্রশ্ন বাদ দিয়েও আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, অন্তঃপুর ছেড়ে তাঁরা যদি শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন, তাহলে তাঁরাও সমাজের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সম্মুখীন হবেন এবং এই পরিকল্পনার কার্যকরী দিকটি ব্যর্থ হবে।
মেয়েদের শিক্ষার জন্য শিক্ষিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও অভিপ্রেত তা আমি বিশেষভাবে জানি এবং সে কথা আপনাকে নতুন করে জানানো বাহুল্য মনে করি। কিন্তু দেশবাসীর সামাজিক কুসংস্কার যদি অনতিক্রম্য বাধা হয়ে না দাঁড়াত, তাহলে আমি প্রথম এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করে এর বাস্তবায়নে আন্তরিক সহযোগিতা করতাম। কিন্তু যখন দেখছি এই কাজে সরকারের সাফল্যের কোনও সম্ভাবনা নেই এবং তার ফলে সরকার অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হবে, তখন আমি এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করতে পারি না।৩৫
প্রথমে বিধবাবিবাহ ও পরে বহুবিবাহ নিয়ে শাস্ত্রীয় তর্কযুক্তির সময়ে, বিদ্যাসাগর ‘হিন্দুসমাজের পক্ষে গ্রহণযোগ্য’ বা ‘সমাজের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সম্মুখীন’ হওয়া অথবা ‘দেশবাসীর সামাজিক কুসংস্কার’ নিয়ে তিলমাত্র মাথা ঘামাননি। তিনি নিজে যখন বিধবাবিবাহের পক্ষে ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, তখন সমাজের অবস্থা ও দেশবাসীর মনোভাব নারীশিক্ষার পক্ষে অনুকূল ছিল – তা-ও নয়। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে, বিধবাবিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত আশাব্যঞ্জক পরিণাম না দেখতে পেয়ে ‘হতাশ’ বিদ্যাসাগর নর্মাল স্কুলের বিষয়ে সাফল্যের আশা করেননি, তবে তা যুক্তির ধোপে টেকে না। কারণ এই ঘটনার অব্যবহিত পরে ১৮৭১ ও ১৮৭৩ সালে, তিনি বহুবিবাহ নিবারণের জন্য গ্রন্থ রচনা করে আন্দোলন শুরু করেন। যিনি বিধবাবিবাহ প্রচলন কিংবা বহুবিবাহ নিবারণের ক্ষেত্রে দেশাচারের দাসত্ব করা অপছন্দ করেন; যিনি মাত্র ২০টি মডেল স্কুলের জন্য নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন; সেই তিনিই হঠাৎ দেশাচারের অজুহাত খাড়া করে ৩০০টি বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য মেয়েদের নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন!
তবে তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতি যে আদৌ ততটা প্রতিকূল ছিল না, এই বিষয়ে সমকালীন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি থেকে তা জানা যায়। ফিমেল নর্মাল স্কুল সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মনোভাবকে কটাক্ষ করে বামাবোধিনী লেখে —
বয়ঃস্থা ভদ্রকুল রমণী পাইবার এই সকল প্রমাণ সত্ত্বেও যাঁহারা কৃতনিশ্চয় হইয়া বলিতেছেন যে এরূপে বিদ্যালয়ের ছাত্রী পাওয়া যাইবার সময় এখনও বঙ্গদেশে উপস্থিত হয় নাই। তজ্জন্য বিদ্যালয় সংস্থাপনের চেষ্টা নিরর্থক, এ প্রস্তাব এককালে পরিত্যাগ করা শ্রেয়ঃ এবং এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া গবর্ণমেন্টকে যখন বিদ্যালয় সংস্থাপনের চেষ্টা হইতেও এককালে নিরস্ত করিলেন তখন তাঁহাদিগকে ঐ মহোপকারী প্রস্তাবটী সংসাধন পথের বিঘ্নকারী না বলিয়া আর কি বলা যাইতে পারে।৩৬
পরের বছরে সোমপ্রকাশ পত্রিকার সম্পাদকীয়তেও এ প্রসঙ্গে লেখা হয়:
কলিকাতা, বোম্বাই ও মান্দ্রাজে এক একটি নর্মাল বিদ্যালয় করিবার নিমিত্ত প্রত্যেক স্থানে মাসিক ১০০০ টাকা দিবার আজ্ঞা হইল। নানা জনের নানা আপত্তিনিবন্ধন আপাততঃ পাঁচবৎসর কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিবার নিমিত্ত এই বিদ্যালয় হইতেছে। কলিকাতার বেথুন বিদ্যালয়ে এই কার্য আরম্ভ করিবার আজ্ঞা হইয়াছে। এই বিষয় লইয়া যে মতভেদ হইবে তাহা আশ্চর্যের বিষয় নহে, কিন্তু আমাদিগের স্ত্রীলোকদিগকে যে উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া উচিত সে বিষয়ে মতভেদ নাই। তবে প্রশ্ন এই হইতেছে, হিন্দু শিক্ষয়িত্রী প্রস্তুত করার সময় আসিয়াছে কি না? আমরা ইহার আন্দোলন প্রারম্ভকালেই কহিয়াছি সে সময় উপনীত হইয়াছে। অন্ততঃ ইহার পরীক্ষা করা উচিত।৩৭
যদিও বিদ্যাসাগরের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, বাংলা সরকার মিস কার্পেন্টারের পরিকল্পনাকে দ্রুত বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৬৮-র ৩ মার্চ সরকার বেথুন স্কুলের পরিচালন সমিতিকে লেখে –
ছোটলাট মনে করেন যে স্কুলটিকে ফিমেল নর্মাল স্কুলের সঙ্গে যুক্ত করলে নারীশিক্ষার প্রভূত উন্নতি হবে। ...একজন ইংরেজ সভাপতির অধীনে কমিটির দেশীয় সদস্যরা যেমন বেথুন স্কুল পরিচালনা করেন, তেমন একজন বিভাগীয় বিদ্যালয় পরিদর্শকের অধীনে তাঁরা পরামর্শদাতা কমিটির ভূমিকায় কাজ করতে ইচ্ছুক কি না, তা ছোটলাট জানতে আগ্রহী।৩৮
এর প্রত্যুত্তরে প্রায় তিন মাস পরে ১৩ জুন, বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে তাঁদের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেন।
অবশেষে ১৮৬৯ সালের ২৭ জানুয়ারি তিন বছরের চুক্তিতে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে শিক্ষিকা ব্রিটশে (Mrs. Brietzche) বেথুন স্কুল ও নর্মাল স্কুলের যুগ্ম পরিদর্শকরূপে যোগদান করার পরে, বেথুন স্কুলের পুরনো পরিচালন সমিতির অবসান ঘটে। এর তিন বছর পরে ছোটলাট ক্যাম্পবেল (George Campbell) বেথুন স্কুল সংশ্লিষ্ট নর্মাল স্কুলটি তুলে দেওয়ার আদেশ দিলে ১৮৭২-এর ৩১ জানুয়ারি নর্মাল স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। নর্মাল স্কুল সফল হয়নি প্রচার করে বিদ্যাসাগরের যুক্তিকে যথার্থ হিসেবে প্রতিপন্ন করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন তাঁর অসংখ্য জীবনীকার। যদিও ওই একই সময়ে (১ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭১) কেশবচন্দ্র সেনের নর্মাল স্কুল (Native Female Normal and Adult School) বেশ সাফল্যের সঙ্গেই চলেছিল। এর পাঠ্যক্রমও ছিল উন্নত ধরনের। এই নর্মাল স্কুল থেকে পাশ করে রাধারাণী লাহিড়ী বেথুন স্কুলের শিক্ষিকা ও পরে প্রধান শিক্ষিকা হন। কালক্রমে সরকারও এই নর্মাল স্কুলকে অর্থসাহায্য করে।
তবে বেথুন স্কুল সংলগ্ন নর্মাল স্কুলটি বন্ধ হলেও কার্পেন্টার হাল ছাড়েননি। ওই বছরেই তিনি কেশবচন্দ্র সেন ও একজন ইংরেজ মহিলা মিস অ্যানেট (Annette Akroyd)-এর সহযোগিতায় আরেকটি নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু মেয়েরা যাতে ‘সুগৃহিনী’ ও ‘সুমাতা’ হয়ে ওঠে এমন শিক্ষাই তাদের দেওয়া উচিত – কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামী প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, উমেশচন্দ্র দত্ত, অঘোরনাথ গুপ্ত প্রমুখ এই মত পোষণ করার ফলে, মিস অ্যানেট দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস, আনন্দমোহন বসু, অন্নদাচরণ খাস্তগীর, ভগবানচন্দ্র বসু প্রমুখের সহায়তায় ১৮৭৩-এর ১৮ নভেম্বর স্থাপন করেন ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’। ১৮৭৬ সালে বিদ্যালয়টির নাম হয় ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’। ১৮৭৩-এ বেথুন স্কুলের নতুন পরিচালন সমিতির সম্পাদক হন মনোমোহন ঘোষ। তিনি বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৭৮-এর ১ অগস্ট বেথুন স্কুলের সঙ্গে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়কে যুক্ত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলে বেথুন স্কুলের সমূহ পরিবর্তন ঘটে, সামান্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে স্কুলটি রাতারাতি উচ্চ বিদ্যালয়ের রূপ ধারণ করে। ১৮৭৮-এর ২৭ এপ্রিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন ‘That the female candidates be admitted to the University examination, subject to certain rules’।৩৯
১৮৭৯ সালে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ছাত্রী কাদম্বিনী বসু বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। ওই বছরেই কাদম্বিনীর উচ্চশিক্ষার জন্য বেথুন স্কুলে ফার্স্ট আর্টস বিভাগের ক্লাস শুরু হয়, যদিও ধর্মে খ্রিস্টান হওয়ার ‘অপরাধ’-এ দেরাদুন থেকে আগত চন্দ্রমুখী বসু বেথুন স্কুলে এফ. এ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। ১৮৮১-তে কাদম্বিনী ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ওই বছরেই ফ্রি চার্চ নর্মাল স্কুল থেকে এফ.এ পাস করেন চন্দ্রমুখী বসুও। ১৮৮৩ সালে এই দুই তরুণী বি. এ পাস করেন। পরবর্তীকালে কাদম্বিনী বসু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪-তে চন্দ্রমুখী ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। নারীশিক্ষার উত্তরণের এই গোটা পর্বটিতে বেথুন স্কুলের একদা সম্পাদক বিদ্যাসাগর ছিলেন আশ্চর্য রকমের উদাসীন, নীরব ও নির্লিপ্ত। কে জানে, তাঁরই প্রবর্তিত নিয়মের ফলে চন্দ্রমুখী বসু বেথুন স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি – এই অপরাধজনিত অনুশোচনা থেকে চন্দ্রমুখীর এম. এ পাশের সংবাদ পেয়ে বিদ্যাসাগর তাঁকে শেক্সপিয়ার রচনাবলি পাঠিয়েছিলেন কি না!
************************************************************
উল্লেখপঞ্জী:
১. স্বপন বসু (সম্পাদিত), উনিশ শতকে স্ত্রীশিক্ষা, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ১১
২. তদেব, পৃ. ৭৬-৭৭
৩. Jogesh C. Bagal, ‘History of the Bethune School and College’; Dr. Kalidas Nag (ed.), Bethune School & College Centenary Volume 1849-1949, Calcutta, 1951, p. 13
৪. তদেব, পৃ. ১০৭
৫. তদেব, পৃ. ১০৮
৬. ‘স্ত্রীশিক্ষা’, সর্বশুভকরী পত্রিকা, আশ্বিন ১৭৭২ শক, ২ সংখ্যা; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ১০৩
৭. তদেব, পৃ. ১১০
৮. তদেব, পৃ. ১০৮
৯. তদেব, পৃ. ১০৪-০৫
১০. তদেব, পৃ. ১১৩
১১. J.A. Richey, Selections from Educational Records, Part II (1840-59), Calcutta, 1922, p. 55
১২. তদেব, পৃ. ৫৬
১৩. তদেব, পৃ. ৫৯
১৪. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, 2nd Revised Edition, Kolkata, 2013, p. 65
১৫. ‘বীটন বালিকা বিদ্যালয়’, ১৩ জানুয়ারি ১৮৫৭, সম্বাদ ভাস্কর, ১১৬ সংখ্যা; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১৮৪০-১৯০৫, তৃতীয় খণ্ড, ১৯৬০, পৃ. ৪৫১
১৬. তদেব, পৃ. ৪৫১
১৭. তদেব, পৃ. ৪৫১
১৮. স্বপন বসু (সম্পাদিত), উনিশ শতকে স্ত্রীশিক্ষা, পৃ. ১২৯
১৯. Y.B. Mathur, Women’s Education in India, 1813-1966, Bombay, 1973, p. 25; Quoted in Geraldine Forbes, ‘Education for Women’; Sumit Sarkar & Tanika Sarkar (ed.), Women and Social Reform in Modern India, Volume I, New Delhi, 2017, p. 89
২০. Brajendranath Banerji, ‘Ishwarchandra Vidyasagar as a Promoter of Female Education in Bengal’ (Based on unpublished State Records); Journal and Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, New Series, Vol. XXIII, 1927, Calcutta, p. 384
২১. It was opened on the 15th of April last and now musters on its rolls 28 girls of different ages, ranging from 4 to 11 years, the majority of whom are daughters of respectable Brahmans and Kyasthas of the place. তদেব, পৃ. ৩৮৩
২২. তদেব, পৃ. ৩৮৪
২৩. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, p. 59
২৪. Brajendranath Banerji, Ishwarchandra Vidyasagar as a Promoter of Female Education in Bengal, p. 385
২৫. তদেব, পৃ. ৩৮৬
২৬. তদেব, পৃ. ৩৯০
২৭. Sumit Sarkar, Writing Social History, Delhi, 1997, p. 260
২৮. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, p. 63
২৯. Jogesh C. Bagal, History of the Bethune School and College, p. 24
৩০. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ৬৯১
৩১. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, p. 65
৩২. Jogesh C. Bagal, History of the Bethune School and College, p. 26
৩৩. ‘বেথুন বালিকা বিদ্যালয়’, বামাবোধিনী পত্রিকা, ১২৭৪ পৌষ; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ১৫৩-৫৪
৩৪. Jogesh C. Bagal, History of the Bethune School and College, pp. 26-27
৩৫. Since we met last, I have made careful enquiries and have thought over the subject, but I regret to say that I see no reason to alter my opinion as regards the difficulty of practically carrying out Miss Carpenter’s scheme of rearing a body of Native Female Teachers either in connection with the Bethune School or independently such as may be acceptable to the bulk of the Hindu community and worthy of their confidence. Indeed, the more I think about it the more am I convinced that I cannot conscientiously advise the Government to take the direct responsibility of setting in motion a project which, in the present state of the native society and native feeling, I feel satisfied, will be attended with failure. You can easily conceive whether respectable Hindus will allow their grown up female relatives to follow the profession of tuition and necessarily break through the present seclusion, when they do not permit the young girls of ten or eleven years to quit the zenana after they are married. The only persons, whose services may be available, are unprotected and helpless widows, and apart from the consideration whether morally they will be fit agents for educational purposes, I have no hesitation in saying that the very fact of their dispensing with the Zenana seclusion and offering themselves as public teachers will lay them open to suspicion and distrust and thus neutralize the beneficial action aimed at.
I need hardly assure you that I fully appreciate the importance and desirableness of having female teachers for female learners; but if the social prejudice of my countrymen did not offer an insuperable bar, I would have been the first to second the proposition and lend my hearty co-operation towards its furtherance. But when I see that success is by no means certain and that the Government is likely to place itself in a false and disagreeable position, I cannot persuade myself to support the experiment.
Subal Chandra Mitra, Isvar Chandra Vidyasagar: Story of His Life and Work, Second Edition, Calcutta, 2013, pp. 305-06
৩৬. বামাবোধিনী, কার্তিক ১২৭৪; স্বপন বসু, সমকালে বিদ্যাসাগর, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ১৭
৩৭. ‘স্ত্রীনর্মাল বিদ্যালয়’, সোমপ্রকাশ, ৫ ফাল্গুন ১২৭৫; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত),সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১৮৪০-১৯০৫, চতুর্থ খণ্ড, কলকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৫২৬
৩৮. Brajendranath Banerji, Ishwarchandra Vidyasagar as a Promoter of Female Education in Bengal, p. 395
৩৯. Jogesh C. Bagal, History of the Bethune School and College, p. 37
কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। আগের পর্বটা তাড়াহুড়ো করে পড়লাম। এবার এটাও পড়ব। বিদ্যাসাগরের পুস্তক বিক্রয়ের ভেতরের ব্যাপারটা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।
পড়লাম। খুবই বিস্তৃত তথ্যাবলী।
মেয়েদের পাঠ্য বিষয় - বিদ্যাসাগর মদনমোহন ইত্যাদিরা মনে করতেন মেয়েদের ঘর সংসার করা আর ... আর ( হয়ত) ইন্টারেস্টিং ফোরপ্লে করার মত শিক্ষা পেলেই চলবে। এবার এঁদের সময় শুধু নয় এই ২০২০ তেও অনেক হোমড়া চোমড়া লোক ঐরকম বা তার সামান্য উনিশ বিশ মানসিকতাই বহন করে চলে। এটা দেখে আমার যতই রাগ হোক, আগের মানে ঐ অত আগের সময় তো গিয়ে প্রতিবাদ করে আসতে পারব না। তাঁদের কালের ফ্রেমে তাঁরা ঠিকই ছিলেন।
ধরুন ১৮৬৮ তে প্রকাশিত হয় কামিনীসুন্দরী দেবী রচিত "বামাবোধিকা" প্রথম ভাগ। এতে গোপাল ও রাখালের তূল্য দুই চরিত্র বরদা ও সারদা। বরদা "স্বাভাবিক ধীরা, সর্বদা সভয়া"। সারদা ঠিক তার উলটো, ব্যঙ্গে, কটুভাষে সে পারদর্শিনী। "সকল বালিকারই বরদার মত হওয়া উচিত, সারদার মত হওয়া উচিত নয়"। একেবারে বর্ণপরিচয়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ এইপর্যন্ত তাইই মনে হচ্ছে বটে; কিন্তু বরদা-সারদা কে ঠিক গোপাল-রাখালের স্ত্রীলিঙ্গানুবাদ বলা গেল না। কারণ বাড়ুজ্যেদের রাজলক্ষ্মীর মা মুখুয্যেদের মেয়েদের বোঝান -- স্বামী ভিন্ন মেয়েমানুষের গতি নেই; আজকালকার ছেলেরা লেখাপড়ায় ভারী পন্ডিত, ইংরেজী পড়ে ভারী সুসভ্য হয়েছে, অতএব তাদের মনোমত হতে গেলে ভালো করে লেখাপড়া করতেই হবে। তখনও পর্যন্ত মেয়েদের লেখাপড়া ব্যাপারটি স্রেফ বিবাহের পূর্বশর্ত, চাকরি বাকরি উচ্চাশা বা ব্যক্তিগত কোন বাসনা পূরণের জন্য নয়।
কিম্বা ধরুন অরো বহু বহু বছর পরে লীলা মজুমদারের মণিমালার কথা। সেখানে ঠাকুমা মণিকে যে সব উপদেশ দেন (প্রশ্নোত্তরের ছলে দেওয়া ) সেসবও একটি বিবাহযোগ্যা এবং পরবর্তীতে 'সুগৃহিণী' নির্মাণ প্রকল্পের অন্তর্গতই। এই প্রকল্প এখনো রীতিমত ঘটমান বর্তমান। কাজেই রাগ হলে রাগটা একহনকার লোকের দিকে চালনা করা বেশী যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি। এঁরা অন্তত উদ্যোগটুকু শুরু করেছিলেন বলেই পরে সেটা ফুলে ফলে বেড়ে ওঠে।
এই ফুলে বলতেই সাবিত্রীবাঈ ফুলের কথা মনে হল। ফুলে দম্পতি মটামুটি অঙ্ক, বিজ্ঞান, সোশ্যাল সায়েন্স ইত্যাদি পড়াতেন তাঁদের স্কুলে। তো এখানে আমার যে প্রশ্নটা মনে আসছে সেটা হল এঁরা কি কোনওভাবে ফার্স্ট ওয়েভ অব ফেমিনিজমের সংস্পর্শে এসেছিলেন? জানি না মানে ওঁদের সম্বন্ধে খুব ডিটেলে পড়া হয়ে ওঠে নি। কিন্তু মদন- ঈশ্বর জুটি বা বঙ্গের অন্যরা সম্ভবতঃ আসেন নি। এমনিতেও বঙ্গে নতুন কিছু চট করে নিতে সময় লাগে
সর্বত্র উচ্চবর্ণের জন্য সংরক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে তখনও 'ব্রাহ্মণ খতরেঁ মেঁ হ্যায়'্টাইপ ন্যারেটিভ চালু ছিল যদ্দুর মনে হয়। আর সিপাহী বিদ্রোহের সময়ও কলকতার ভদ্রলোক শ্রেণী ইংরেজদের পক্ষেই ছিল মোটামুটি। সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে ইংরেজরা মুসলমানদের সিস্টেমেটিকালি ডেমোনাইজ করতে শুরু করে। কলকাতা কেন্দ্রীক ভদ্রশ্রেণী এই ন্যারেটিভটা লুফে নেয় তাদের স্বার্থানুকুল হওয়ায়।
আরো একটু আছে, লম্বা হ্যাজ দিচ্ছি সঙ্গে থাকুন :-))
মেয়েদের শিক্ষাদানের বয়স - যা দেখছি এই চার, আট দশ থেকে বারো অবধি মেয়েদের পড়াশোনার কাল। তো এইটে দেখে যে প্রশ্নটা আসছে সেটা হল তখন মেয়েদের স্কুলে বাথরুমের ব্যবস্থা কিরকম ছিল? এই নিয়ে কোথাও উল্লেখ দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমার ধারণা মেয়েদের মেন্স্ট্রুয়েশান শুরু হলেই পড়া বন্ধ হোত। তার জন্য আবার ঐ ঠিকঠাক বাথরুম না থাকা একটা কারণ হলে অন্যটা সম্ভবতঃ সেই সময় ন্যাপকিন দূরে থাক কাপড়ের ব্যবহারও সম্ভবতঃ খুবই সীমিত ছিল, হ্যাঁ এমনকি উচ্চকূলজাত মহিলাদের মধ্যেও। অন্তত অহনা বিশ্বাসদের সম্পাদিত 'এগারোয় পা' পড়ে আমার সেরকমই ধারণা হয়েছে। ওঁরা তিন প্রজন্মের মেয়েদের মধ্যে মেন্স্ট্রুয়েশান সম্পর্কিত স্বাস্থ্য ও ব্যবহারবিধি সম্পর্কে সমীক্ষা করে লিখেছেন।
তো কথা হল পড়া বন্ধের একটা ক্রাইটেরিয়া যেমন বিয়ে হয়ে যাওয়া, আরেকটা ক্রাইটেরিয়া সম্ভবত মেন্স্ট্রুয়েশান। আর সেটা যে খোলাখুলি কেউ কোত্থাও লিখবে না সেটা আন্দাজ করাই যায়। এখনও তো কত শিক্ষিকা মুখে উচ্চারণ করতে পারেন না। আমাদের সময়ও (সত্তরের শেষ আশির শুরু ) শিক্ষিকারা ঐ সময় স্কুলে যেতে নিরুৎসাহিত করতেন।
(আরো কি যেন বলার ছিল, বলছি পরে)
দ-দি, আমি কিন্তু আপনার কথা উৎকীর্ণ হয়ে শুনছি। বিশেষত নারীশিক্ষার বিষয়টিকে একজন নারী কীভাবে দেখছেন, সেটা জানা খুবই জরুরি। কাজেই আরও যা যা আপনার বলার আছে বলেছেন, সেগুলো দ্রুত বলতে থাকুন। যদিও আপনাকে কেবলই একজন নারী হিসেবে বিবেচনা করছি, এমনটা আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আমি নিজেকে নারীবাদী হিসেবে আইডেন্টিফাই করি, নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান বোঝার চেষ্টা করছি। নারী, পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ যে কেউ নারীবাদী হতে পারে। :-)
কোন্নগর হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় ১৮৬০ এ স্থাপিত, এখনও রমরম করে চলছে। ( আমার মা ১৯৫২ এ ময়মনসিং থেকে এসে এখানেই ভর্তি হয়েছিল।) তো, যাই হোক এই ৫২ সালে মা যখন স্কুলে যেত তখন আশে পাশের বাড়িগুলো থেকে যথেষ্ট কটুক্তি শুনেছে। কটুক্তির মূল বক্তব্য ছিল বাঙাল মেয়েগুলোর আচা বিচার কিছু নেই, 'বেওয়া' হবার ভয়ও নেই। অন্যত্র লিখেছি এইটা। তো দেখুন ১৯৫২ তেও কোন্নগরে ক্লাস নাইনে পড়তে যাওয়াকে এতটা নীচু চোখে দেখা হচ্ছে। তো, সেখানে সেই ১৮৬০-১৯০০ সময়কালে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে পাঠ্যসূচী বানানো খুব অস্বাভাবিক নয়। বরং এটা সম্ভবতঃ স্ট্র্যাটেজিকালি ঠিক ছিল। পিতৃতান্ত্রিক (এই 'পিতৃতান্ত্রিক' ব্যপারটাও আমরা আজ সহজে আইডেন্টিফাই করতে পারছি) কাঠামো অক্ষুন্ন থাকার ভরসা যুগিয়ে কিছু মেয়েকে অন্তত পড়া লেখার রাস্তা দেখানো গেছিল। এর একটা স্নোবলিং এফেক্ট হয়েইছে। বিদ্যাসাগরের প্রচলিত স্কুল উঠে যাওয়া প্রসঙ্গে আমার এই এখনকার স্টার্টাপগুলোর কথা মনে হচ্ছিল। অজস্র তৈরী হয়েছে ২০১৬ পরবর্তী বছরগুলোতে, তার অর্ধেকের বেশী উঠে গেছে। কিন্তু অনেকগুলো টিকেও গেছে। আর এগুলো বেশ কিছু চাকরি তৈরী করেছে। বলতে চাইছি উঠে গেলেও তার একটা সুফল থেকে গেছে।
এইটে লিখতে লিখতেই মনে পড়ল বেগম রোকেয়া বোরখা পরে সম্ভ্রান্ত মুসলমানবাড়িগুলিতে গিয়ে গিয়ে মুসলমান মেয়েদের পড়ালেখা শেখানোর আবেদন করতেন। বোরখা সেই কমফর্ট ফিলিংটা দিত যে হ্যাঁ পর্দানসীন নারীর পর্দা হানি হবে না। এবার পড়াশোনা করার পর একজন সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে কী করবে ভবিষ্যতে। এইখানেই আসে সিলেবাসের প্রয়োজনীয়তা। সেইটে যথেষ্ট ডাইভার্স আর আধুনিক হলে ভাল হত। কিন্তু তাহলে আবার হয়ত শুরুতেই ছাড়িয়ে নিয়ে যেত অভিভাবকেরা। ফলে সেইখানে সুগৃহিণী নির্মাণ প্রকল্প চালু। এদের কি পাঠাগারের ধারণা ছিল? নানারকম বাইরের বই পড়তে উৎসাহ দেওয়া ও বই যোগানো হত?
এই ফাঁকটাই আমার মনে হচ্ছে বিদ্যাসাগরের বড় ব্যর্থতা। এই যে সুগৃহিণী নির্মাণ প্রকল্প অনুযায়ী সিলেবাস বানানো এবং অন্য কোনও জানলা না খোলা এইজন্যই সম্ভবতঃ ওঁর চেষ্টা তেমন সফল নয় কিন্তু কেশবচন্দ্রের চেষ্টা সফল।
এইসাথে সহযোগী প্রশ্ন বাংলায় সেরকম বড়সড় সামাজিক আন্দোলন কিছু হয়েছে বিধবা বিবাহ প্রচলন ছাড়া? এর পরেও সেইভাবে কিছু হয় নি বলেই সম্ভবতঃ এখনও আমাদের জগদ্দল ঠেলতে হচ্ছে। :-(
ব্যাস ব্যাসস। আর কিছু বলার নেই আপাতত।
মূল লেখাটা আর দ-দির কমেন্টস গুলো পড়ে খুব ভালো লাগলো। খুব দরকারি পয়েন্টস সব কটাই। এখনো বেশির ভাগ গ্রামের দিকের স্কুলে শৌচাগারের অবস্থা হয়তো খুবই বাজে. শহরে বেড়ে ওঠার সুবাদে নিজে ডাইরেক্ট বেশি দেখার সুযোগ হয়নি , কিন্তু কলেজে পড়ার সময় একবার সুন্দরবনের দিকে দল বেঁধে বেড়াতে গিয়ে শৌচাগারের দরকার পড়ায় একটা গ্রামের স্কুলে ঢুকে যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল না বলাই ভালো। গ্রামের দিকে মেয়েদের বড়ো হলে স্কুল ড্রপ আউট এর পেছনে এর একটা মেজর রোল থাকতেই পারে .
বিদ্যাসাগরকে সুধু মহাপুরুষ হিসেবে না দেখে দোষে গুনে মেলানো একজন মানুষ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যেটা খুব দরকারি।ওনার বই বিক্রির প্রসঙ্গ বা অল্পবিস্তর নেপোটিজম নিয়ে ইনফরমেশন গুলো নতুন জানতে পারছি। এর আগে কোথাও পড়েছিলাম উনার মায়ের দাপটে তিনি নিজের স্ত্রীকে লেখাপড়া শিখিয়ে উঠতে পারেননি। প্রদীপের নিচে খানিকটা অন্ধকার রয়েই যায়. যেটা হয়তো সব গ্রেট মানুষের ক্ষেত্রেই হয় , অতিভক্তির জোরে সেগুলো চাপা পড়ে যায়। কেওই ১০০-% পারফেক্ট নয়।আর দোষ গুন্ মাপার স্কেলও হয়তো সময়ের প্রেক্ষিতে পাল্টে যায়। যেমন হয়তো নারীশিক্ষার পিছনে ওনাদের একটু আধটু লেখাপড়া জানা ভালো স্ত্রী বানানোর তাগিদটাই বেশি ছিল। এযুগের প্রেক্ষিতে সেটা নিশ্চয় প্যাট্রিয়ার্কি। কিন্তু সেযুগের প্রেক্ষিতে সেটা কতটা ? ওনারা যদি মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করতেন তাহলে হয়তো একটা মেয়ের বাবামা ও তাদের স্কুলে পাঠতোনা। প্রথম স্টেপটা নেওয়া জরুরি ছিল যত ছোট স্টেপই হোকনা কেন.
একই ভাবে যদি বিদ্যাসাগর সবার জন্যে তখন ন্যায়শাস্ত্র চালু করতেন হয়তো ব্রাক্ষণদের রেসিস্টেন্স অনেক বেশি হতো। উনি বা ব্রিটিশরা হয়তো মিনিমাম রেসিস্টেন্স র রাস্তা বেছে বেছে এগিয়েছেন। সব আন্দোলন কিআর নভেম্বর রেভোলুশন বা ফ্রেঞ্চ রেভোলুশন এর মতো একটা গ্র্যান্ড রেজিমে চেঞ্জার হয় ? 99-% ই তো সাইলেন্ট রেভোলুশন আস্তে আস্তে আমাদের চারদিকে ঘটে যাচ্ছে . একটু আধটু রিপলস ছাড়া সেরকম হইচই নেই। অনেক পরে নজরে আসে।
এই কলকাতায় দূর্বারের করা দুর্গাপুজো টাই যেমন ধরেন -প্রথম বছর মনে আছে বিশাল হইচই মেডিয়ায় , লোকে আপত্তি করছে । পুলিশ পারমিশন দিচ্ছে না কিছুতেই. এখন কবছর পর কেউ ইভেন চিন্তা করেন ওটা নিয়ে ? ওটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সমাজে যৌনকর্মীদের যা চোখে দেখা হয় সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এরকম একটা ইনিটিয়াটিভ সাস্টেইন করা কিন্তু কোনো ছোট খাটো রেভোলুশন এর কম নয়। আর যারা সেই সাহসটা প্রথমবার দেখিয়েছেন, তারা গেম চেঞ্জার নিঃসন্দেহে.
যাকগে ভাটাতে গিয়ে টোয়ি বেপথে করতে চাইনা। তবে শুরুতে কয়েকটা পর্ব আমার যেমন মনে হচ্ছিলো একটা প্রিডিটারমিন্ড নেগেটিভ ভিউপয়েন্ট করেই লেখা ,শেষ চারটে পর্বে অনেক বেশি ভালো লাগছে পড়ে। অনেক বেশি ব্যালান্সড ভিউ পয়েন্ট আর রেফারেন্স গুলোও রেলেভান্ট। সমস্ত পাবলিক ফিগার কেই দোষে গুনে মানুষ হিসেবে দেখতে আমার অন্তত কোনো আপত্তি নেই,
এনারা ও মানুষই কিন্তু সমকালীন সমাজের থেকে একদু পা এগিয়ে ভাবার সাহস দেখিয়েছেন। সেটা ইটসেলফ অনেক কৃতিত্বের মনে করি। ব্যালান্সড এসেসমেন্টস ই হওয়া দরকার , অতিভক্তি নয়।তাহলে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস র অবস্থা হবে।
এইটাই দরকার। খালি গলায় মালা চড়িয়ে মহাপুরুষ হিসেবে সাজিয়ে না রেখে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে ও তার দোষ গুন দুটোই যত্নের সাথে বিচার করতে হবে। আসলে মহাপুরুষ করে দিতে পারলে বেশ সুবিধা, একটা আইকন ও পাওয়া যায় আর তার আদর্শ, কাজ এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করতেও হয়না, খালি নমস্কারেই মিটে যায়।
আবার সাধারণ মানুষ হিসেবে ট্রিট করার নেগেটিভ সাইড ও আছে। লোকে তাকে বেমালুম ভুলেই মেরে দেবে তখন। কালী সিঙ্গি, প্যারিচাঁদ মিত্র ওই তো বাংলা সিলেবাসের ব্যাপার। রাসবিহারী বসু, ২ নম্বরের প্রশ্ন আসবে মুখস্ত করিস। অক্ষয়কুমার দত্ত, কে রে ওটা ? সিলেেবসে আছে ? বাইরের জিিনিিিসে সময় নষ্ট নয় বরং চারটে ক্যালকুলাস কর বসে।
@অমিত, প্যাট্রিয়ার্কির আর এখন তখন কি? তাখনো এটা প্যাট্রিয়ার্কিই ছিল এখনো তাই। :-) তফাৎ যেটা সেটা হল এটাকে আইডেন্টিফাই করা, প্যাত্রিয়ার্কাল প্র্যাকটিসগুলো থেকে বেরিয়ে আসা, আনলার্ন করা ইত্যাদি। তো এই ব্যপারটা ঠিকঠাকভাবে শুরু হয়েছে মধ্য ষাতের দশকে।
আর বাথরুম ইত্যাদি নিয়ে মনে পড়ল গুরুতেই বছরআট দশ আগে রিমি লিখেছিল যে পরেরদিন কলকাতায় যেতে হলে আগের দিন বিকেল থেকে কম করে জল খেয়ে থাকতে হত। আমরা মেয়েরা যারা মফস্বল থেকে চাকরি বা পড়াশোনার জন্য কলকাতায় যাতায়াত করতে বাধ্য হয়েছি তারা জানি এটা কি ভীষণ সত্যি। যে সব মেয়েরা ডোর ট্যু ডোর সেলসে কাজ করেন তাঁদের কতজনের (এবং অন্যান্যদেরও ) এই করে ইউটিএফ বা অন্য গুরুতর অসুখ হয়ে যায়।
@এলেবেলে, সেইসময়কার তৈরী করা মেয়েদের স্কুলগুলোতে বাথরুমের কোনও ব্যবস্থা ছিল কিনা এইটে যদি একটু খোঁজ করতে পারেন তো বড় ভাল হয়।
আর একটা জিনিষ মনে পড়ল সম্ভবতঃ চাণক্য সেনের 'পিতা পুত্রকে' বইতে ছিল যে উনবিংশ শতকে বাড়ির মেয়েরা পিরিয়ড হলে একবস্ত্রা থাকতেন এবং প্রায় অন্তরীণ থাকতেন (দ্যুতসভায় দ্রৌপদী যেভাবে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন)। এইটা কি নীরোদ সি'ও লিখেছিলেন? ঠিক মনে পড়ছে না। হাতের কাছে কোনও বইই নেই। (চাণক্য সেন অবিশ্যি বাড়িত্তে রাখার মত নয়ও ) লাইব্রেরীও নেই হাতের কাছে, ফলে কনফার্ম করতে পারছি না।
দ-দি, //বিদ্যাসাগর মদনমোহন ইত্যাদিরা মনে করতেন মেয়েদের ঘর সংসার করা আর ... আর ( হয়ত) ইন্টারেস্টিং ফোরপ্লে করার মত শিক্ষা পেলেই চলবে।
তাঁদের কালের ফ্রেমে তাঁরা ঠিকই ছিলেন।//
না, ছিলেন না। নারীশিক্ষা মানেই মদন-ঈশ্বর জুটি নন। তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। আসলে মদন-ঈশ্বর ঔপনিবেশিক শিক্ষার ধাঁচাটিকে আত্মস্থ করেছিলেন এবং বেথুন-নির্দেশিত পথে নারীশিক্ষার গতিপথকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। বেথুন স্কুল একটি ব্যর্থ প্রয়াস। বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠা করা বালিকা বিদ্যালয়গুলিও তাই। শিল্প পুঁজির অবাধ দৌরাত্ম্যের কারণে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ‘সাহেব’ যুবকেরা ইংল্যান্ডে তৈরি মালপত্র কিনবেন আর বৈঠকখানা থেকে ঘর-গৃহস্থালী সাজাবেন তাদের ‘মেম’ বিবিরা। এই ছিল নারীশিক্ষা প্রচলনের পেছনের মূল প্রতিপাদ্য। সঙ্গে ফাউ হিসেবে ছিল তীব্র মুসলমানবিদ্বেষ ও প্রকট বর্ণবাদ। কারণ এই অভিজাত উচ্চবর্ণের হিন্দু শ্রেণিই ব্রিটিশের সম্ভাব্য ক্রেতা। সেই আমলেই কৈলাসবাসিনী দেবী একে চিহ্নিত করেছেন ‘হিন্দু যুবকগণ সস্ত্রীক ঝম্প প্রদানে প্রবৃত্ত হন এবং উল্কধারিণী কৃষ্ণাঙ্গী অবলাগণকে বিবী করণ মানসে বিদ্যা চর্চায় প্রয়োগ করেন’ বলে। কিন্তু তার জন্য বাংলার নারীশিক্ষা থমকে যায়নি। মেরি কার্পেন্টার যখন ভারতবর্ষে আসছেন, তখন বাংলা বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০০টি। ছাত্রীসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। এবং দক্ষিণবঙ্গ নয়, নারীশিক্ষার প্রকৃত প্রসার হয় পূর্ববঙ্গে। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় হাল না ধরলে বাংলায় নারীশিক্ষার বিকাশ হতে আরও দেরি হত। তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ এবং নারীশিক্ষার মেনস্ট্রিম ডিসকোর্সে চির-অবহেলিত। যেমন সাবিত্রী ফুলে। তাঁর স্কুলের জনপ্রিয়তায় সরকারি স্কুলের ছাত্ররা পর্যন্ত আশঙ্কিত হচ্ছে। অথচ আলোচনা হয় বিদ্যাসাগর-বেথুনকে ঘিরে!
//১৮৬৮ তে প্রকাশিত হয় কামিনীসুন্দরী দেবী রচিত “বামাবোধিকা” প্রথম ভাগ।//
ঠিক। এই জিনিস আপনি সরলার উপাখ্যান-এও পাবেন। শিবাজী বন্দ্যো অতুলনীয় আলোচনা করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছিল। পূর্ববঙ্গেই। কাদম্বিনী দেবী ও আরও কিছু সমসাময়িক ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েরা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
//তখন মেয়েদের স্কুলে বাথরুমের ব্যবস্থা কিরকম ছিল?//
আমি নবদ্বীপ থেকে ৬ কিমি দূরের একটি অঞ্চলে গত ৩০ বছর শিক্ষকতা করছি। গঙ্গার ওপারে। আমাদের স্কুলের পাশে একটি জুনিয়ার হাই গার্লস স্কুলের মেয়েরা ক্লাস নাইনে আমার স্কুলে ভর্তি হত। ১৯৯০ সালেও তাদের জন্য কোনও বাথরুমের বন্দোবস্ত ছিল না। তাহলে তখনকার অবস্থা আপনি নিজেই ভেবে নিন।
মেনস্ট্রুয়েশনের সময় স্কুল কামাই করা এখনও ঘটে। আমার একাদশ-দ্বাদশের ছাত্রীরা স্কুল কামাই করতে বাধ্য হয়। কারণ অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার। ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন বসানোর ক্ষেত্রে হেডুর তীব্র রক্ষণশীল মনোভাব। তবে উনিশ শতকে বিদ্যাসাগর নিজে যেখানে কন্যা ঋতুমতী হওয়ার আগেই তাকে পাত্রস্থ করার পক্ষে সওয়াল করছেন বারংবার, সেখানে বাকি অভিভাবকদের এতে উৎসাহিত হওয়ার কথা। কিন্তু সে বিঘ্ন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কাদম্বিনী-চন্দ্রমুখী ১৮৭৯তে সেই জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হন।
অমিত, //বাংলায় সেরকম বড়সড় সামাজিক আন্দোলন কিছু হয়েছে বিধবা বিবাহ প্রচলন ছাড়া?//
বিধবাবিবাহ কোনও সামাজিক আন্দোলন নয়। ওটি একটি ঔপনিবেশিক অ্যাজেন্ডা। বিদ্যাসাগর তার বিশ্বস্ততম সহযোগী। তার প্রতিস্পর্ধী ন্যারেটিভ লেখা হয়ে গেছে। আমিই লিখেছি। যথাসময়ে যথাস্থানে তা প্রকাশিত হবে।
//একই ভাবে যদি বিদ্যাসাগর সবার জন্যে তখন ন্যায়শাস্ত্র চালু করতেন হয়তো ব্রাক্ষণদের রেসিস্টেন্স অনেক বেশি হতো।//
ব্রাহ্মণদের ঘাড়ে বন্দুক রাখার প্রয়োজন নেই। বিদ্যাসাগর নিজেই চাননি। আজীবন তাঁর ব্রাহ্মণত্য জাহির করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র ‘শর্মা’ নামে সই করে। কোদালকে কোদাল বলতে শিখুন।
ব্রাহ্মণত্য ব্রাহ্মণত্ব
দুঃখিত। বিধবাবিবাহকে সামাজিক আন্দোলন বলেছেন দ-দি, অমিত নন। অমিত বলেছেন প্যাট্রিয়ার্কির কথা। আমি এর বাংলা হিসেবে 'পিতৃতান্ত্রিক'-এর পরিবর্তে 'পুরুষতান্ত্রিক' শব্দটি ব্যবহার করি। হ্যাঁ, প্যাট্রিয়ার্কিও কলোনিয়াল প্রভুদের 'দান'। রানি ভবানী বাংলার দাপুটে জমিদার ছিলেন, সেটা দয়া করে ভুলে যাবেন না।
আমার এটা পড়তে অনেক দেরী হয়ে গেল। জানতে চাইছি যে প্যারিচরণের স্কুল নিয়ে যে এলেবেলে বলেছেন "প্রসঙ্গত, এটিই ‘সম্ভ্রান্ত’ বাঙালিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম প্রকাশ্য বালিকা বিদ্যালয়।" অসম্ভ্রান্ত বাঙ্গালিদের তৈরি বাঙ্গালি বিদ্যালয় কি ছিল এর আগে? সেন্ট্রাল ফিমেল স্কুলেরও মূল কারিগর তো মিশনারিরাই ছিলেন। আর প্যারিচরণের স্কুলে ( শুধু তো বারাসাত নয় পরে চোরবাগানেও তিনি স্কুল করেছিলেন তো ) পাঠ্যক্রম কি ছিল তা নিয়ে আলোচনা করবেন বলেছিলেন,তা কি পরে করবেন?
আর একটা কথা পড়েছিলাম যে মিশনারিদের নারী শিক্ষা নিয়ে উৎসাহ উঠে যাওয়ার কারণ সরকার এবং নাগরিক উভয় তরফেই ধর্মশিক্ষা নিয়ে অনীহা,অথচ মিশনারিদের শিক্ষা বিস্তারের এক মাত্র উদ্দেশ্যই ছিল ধর্ম প্রচার। দুয়ের মধ্যে সংযোগ না করতে পেরেই মিশনারিরা হাল ছেড়ে দেন।
নারীশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যে ভাল মা,ভাল বৌ তৈরি করা এটার থেকে সে আমলে কোন মানুষটা বেরোতে পেরেছেন?দ্বারকানাথ কাদম্বিনীর সন্তানেরাও তো মা'র স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি অত ব্যস্ত ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও কত ভাল সুগৃহিনী ছিলেন সেটা বলেন। অথচ স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে দ্বারকানাথ কিভাবে সন্তানদের দেখাশোনা করলেন, তাঁদের খাওয়া পড়ার কিভাবে ব্যবস্থাদি করলেন সে বিষয়ে আমি অন্তত কিছু পড়ি নি। আছে নাকি কিছু? তবু যে কোন উদ্দেশ্যেই হোক , এঁরা নারীশিক্ষা শুরু করলেন বলেই না কিছু মেয়ে বেরোতে পারল। ...তবে আনন্দীবাই যোশি কে নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে মনে হয়েছিল,বাংলা নারী-স্বাধীনতার বাবদে সে আমলে অন্তত মহারাষ্ট্রের থেকে বেশ কয়েক কদম পিছিয়েই ছিল। আনন্দীবাই বার বার বাংলার নারী-পুরুষকে এই বাবদে অসভ্যতার জন্য দুষেছেন। সেই মনোভাবই ছাপ ফেলেছে সমাজজীবনে।
বরং আমার কৌতূহল জাগল অন্যত্র - এলেবেল লিখেছেন " মিস অ্যানেট দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাস, আনন্দমোহন বসু, অন্নদাচরণ খাস্তগীর, ভগবানচন্দ্র বসু প্রমুখের সহায়তায় ১৮৭৩- এর ১৮ নভেম্বর স্থাপন করেন ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’। ১৮৭৬ সালে বিদ্যালয়টির নাম হয় ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’।" তিনবছরের মধ্যে হিন্দু থেকে বঙ্গে ট্রানজিশনের কি কোন প্রত্যক্ষ কারণ ছিল?
বর্ণপরিচয়ের একমাত্র নারী চরিত্র ভুবনের মাসি। বিদ্যাসাগর নারীদের কি চোখে দেখতেন এ থেকেই বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের "বড় বৌ মেজ বৌ মিলে ঘুঁটে দেয় ঘরের পাঁচিলে" পড়লে বোঝা যায় উনি বহুবিবাহের পক্ষে এবং মেয়েদের ঘুঁটে দেওয়ার কাজেই বহাল রাখতে চান।
স্বাতীদি, আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আজ নতুন কিস্তি পোস্ট করা নিয়ে সামান্য ব্যস্ততা আছে। কাল আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
ভ্যাট বড়ছেলের বৌকে বড়বৌ আর মেজছেলের বৌকে মেজবৌ বলে। এর মধ্যে বহুবিবাহ নাই। @অসীম সাহা।
@এলেবেলে, পুরুষতান্ত্রিক ভুল। ওটা পিতৃতান্ত্রিক। ম্যাসকুলিনিটি অর্থ পৌরুষ। toxic masculinity বোঝাতে বিষাক্ত পৌরুষ বলা যেতে পারে।
"কর্তব্যসাধনের পক্ষে স্ত্রীলোকের একপতিনিষ্ঠ হওয়ার যত আবশ্যক পুরুষের পক্ষে একপত্নীনিষ্ঠ হইবার তেমন আবশ্যক নাই। কারণ, বহুপতি থাকিলে সন্তানপালন ও লোকযাত্রার বিশেষ ব্যাঘাত ঘটে, কিন্তু বহুপত্নীতে সে-ব্যাঘাত না ঘটিতেও পারে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে দ্বিতীয়বার বিবাহ সংসারযাত্রার সুবিধাজনক হইতে পারে, কিন্তু বিধবার দ্বিতীয়বার বিবাহ অধিকাংশস্থলে সংসারে বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে।"
"অনেক সময়ে সংসারযাত্রানির্বাহের সহায়তা-জন্যই পুরুষ দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করিতে বাধ্য। কারণ, অপত্য উৎপাদন যখন বিবাহের প্রধান উদ্দেশ্য তখন বন্ধ্যা স্ত্রী সত্ত্বে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ শাস্ত্রমতে অন্যায় হইতে পারে না।"
স্বাতীদি, মাফ করবেন। কিছু ব্যস্ততাজনিত কারণে আপনাকে উত্তর দিতে দেরি হল। আপনার প্রশ্নগুলোর যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।
১. //অসম্ভ্রান্ত বাঙ্গালিদের তৈরি বাঙ্গালি বিদ্যালয় কি ছিল এর আগে?//
না, ছিল না। প্রথমে ‘সম্ভ্রান্ত’ পরিবারের কন্যাদের জন্যই যাবতীয় আয়োজন হয়েছিল। পরে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা ছাড়াও অন্য বর্ণের মেয়েরা পড়াশোনা করার সুযোগ পান।
২. //প্যারিচরণের স্কুলে ( শুধু তো বারাসাত নয় পরে চোরবাগানেও তিনি স্কুল করেছিলেন তো ) পাঠ্যক্রম কি ছিল//
বেথুন স্কুলের থেকে আলাদা কিছু ছিল না।
৩. //আর একটা কথা পড়েছিলাম যে মিশনারিদের নারী শিক্ষা নিয়ে উৎসাহ উঠে যাওয়ার কারণ সরকার এবং নাগরিক উভয় তরফেই ধর্মশিক্ষা নিয়ে অনীহা, অথচ মিশনারিদের শিক্ষা বিস্তারের এক মাত্র উদ্দেশ্যই ছিল ধর্ম প্রচার। দুয়ের মধ্যে সংযোগ না করতে পেরেই মিশনারিরা হাল ছেড়ে দেন।//
ধর্মশিক্ষা নিয়ে অনীহা ছিল। তার থেকেও বেশি ছিল জাত খোয়ানোর ভয়। মিশনারি কলেজে ধর্মশিক্ষা দেওয়া হলেও বাঙালি কিন্তু সেখানে শিক্ষাগ্রহণে আপত্তি জানায়নি। হেয়ার কলেজ স্মর্তব্য। মিশনারিদের স্কুলগুলোতে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রীরা পড়ত। তাদের সঙ্গে একাসনে বসে শিক্ষা নেওয়ার কথা তদানীন্তন সমাজের মুরুব্বিরা মেনে নেননি। এখানে রাধাকান্তের উক্তি উদ্ধৃত করেছি। ওতেই যা বলার, বলে দেওয়া আছে। তাছাড়া সরকারি তরফে এই স্কুলগুলোকে কোনও সাহায্য করা হয়নি। অথচ মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই বেথুনের স্কুলে সরকারি টাকার বৃষ্টি হয়েছিল। তখন ছেলেদের স্কুল নিয়েই সরকারের মাথাব্যথা কম, ফলে মেয়েদের স্কুল নিয়ে তাদের আগ্রহ ছিল না।
৪. //বাংলা নারী-স্বাধীনতার বাবদে সে আমলে অন্তত মহারাষ্ট্রের থেকে বেশ কয়েক কদম পিছিয়েই ছিল। আনন্দীবাই বার বার বাংলার নারী-পুরুষকে এই বাবদে অসভ্যতার জন্য দুষেছেন। সেই মনোভাবই ছাপ ফেলেছে সমাজজীবনে।//
একদমই তাই। উনিশ শতকের মধ্যভাগে যেমন বোম্বে বাংলার থেকে এগিয়ে ছিল নারীশিক্ষার বিষয়ে, অন্তভাগে তেমনই সহবাস সম্মতির বয়স নিয়ে জোরালো আন্দোলনটি হয়েছিল মালাবারির নেতৃত্বে। বাংলায় তখন শশধর তর্কচূড়ামণি এবং বিদ্যাসাগরের মধ্যে এই বিষয়ে কোনও মতভেদ ছিল না।
৫. //তিনবছরের মধ্যে হিন্দু থেকে বঙ্গে ট্রানজিশনের কি কোন প্রত্যক্ষ কারণ ছিল?//
নিশ্চিত নই। তবে যেহেতু ১৮৭২ সালে কেশব সেনের উদ্যোগে তিন আইন পাশ হয়েছিল এবং কেশবপন্থীরা ‘ব্রাহ্মরা হিন্দু নন’ এমন ঘোষণা করেছিলেন, সেহেতু বিদ্যালয়ের নামটি পরিবর্তিত হতে পারে।