এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  সমাজ

  • দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর - ৬

    এলেবেলে লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | সমাজ | ৩১ অক্টোবর ২০২০ | ৩৩৩৮ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • ষষ্ঠ অধ্যায়

     

    বিদ্যাসাগরের কর্মজগতের শুরুসাহেবসুবোর সুধাসঙ্গ

     

    তিনি একসময়ে আমাকে বলিয়াছিলেন ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটীজুতাশুদ্ধ পায়ে টক্করিয়া লাথি না মারিতে পারি

    শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী তৎকালীন বঙ্গসমাজ

     

     

    বালক ঈশ্বর পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি হন কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় আট বছর বয়স অবধি বীরসিংহের সেই পাঠশালায় পড়েন তিনি অতঃপর গুরুমশাই কালীকান্ত, ঠাকুরদাসকে কলকাতার কোনও ইংরেজি বিদ্যালয়ে ঈশ্বরকে ভর্তি করানোর প্রস্তাব দেন ঠাকুরদাস তখন কলকাতায় রামসুন্দর মল্লিকের দোকানে কাজ করেন, বেতন মাসে ১০ টাকা অথচ হিন্দু কলেজে তখন ছাত্রদের মাসিক বেতন টাকা। এই সময়ে ঠাকুরদাস, কুমারহট্ট-হালিশহরের পণ্ডিত সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের অধ্যাপক গঙ্গাধর তর্কবাগীশের সঙ্গে ঈশ্বরের পরবর্তী শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করেন। গঙ্গাধর ঈশ্বরকে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষাগ্রহণের সুপরামর্শ দেন সমসময়ে বিদ্যাসাগর-জননীর মাতুল পণ্ডিত রাধামোহন বিদ্যাভূষণের পিতৃব্যপুত্র মধুসূদন বাচস্পতি সংস্কৃত কলেজে পড়তেন তিনি ঠাকুরদাসকে আশ্বাস দেন, ঈশ্বর সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হলে আদালতের জজপণ্ডিতের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। মধুসূদন বাচস্পতির পরামর্শক্রমে, ঈশ্বর অবশেষে ১৮২৯ সালের জুন গোলদিঘির সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন একটানা বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পরে, ১৮৪১-এর ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজের পাঠ সম্পন্ন করেন তিনি যদিও পাঠ সমাপন করার অনেক আগেই তিনিবিদ্যাসাগরউপাধি লাভ করেন এবং তিনি ছাড়া কলেজের আরও অনেক পড়ুয়া এই উপাধি পান, তবুও আমবাঙালির কাছে ঈশ্বরচন্দ্রবিদ্যাসাগরনামেই পরিচিত সেই কারণে, আমরা গোটা লেখাটিতে তাঁকেবিদ্যাসাগরনামেই চিহ্নিত করব।

    এর আগে ছাত্রাবস্থায় ১৮৩৭ সালে, তিনি কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ত্রিপুরার জজপণ্ডিত পদের জন্য আবেদন করেন। তবে ওই পদে নির্বাচিত হলেও পিতার আপত্তিতে তিনি সেই চাকরি গ্রহণ করেননি। অবশেষে তাঁর অধ্যয়ন পর্ব শেষ হওয়ার মাত্র ২৪ দিন পরে, কর্মজগতে প্রবেশ করেন তিনি ১৮৪১-এর নভেম্বর মধুসূদন তর্কালঙ্কারের মৃত্যুর পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে সেরেস্তাদারের (১৮৩০ থেকে প্রধান পণ্ডিতদের সেরেস্তাদার বলা হত) পদ শূন্য হলে, বিদ্যাসাগর সেই পদের জন্য আবেদন করেন। তখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেক্রেটারি ছিলেন মার্শাল (G.T. Marshall) সাহেব তিনি ২৭ ডিসেম্বর বাংলা সরকারের সচিব বুশবি (G.A. Bushby) সাহেবের কাছে বিদ্যাসাগরের উচ্চ প্রশংসা করে এক সুপারিশপত্র পাঠান। ২৯ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর মাসিক ৫০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার পদে নিযুক্ত হন আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পাব, তাঁর চাকরি জীবনের বিভিন্ন পর্বে মার্শালের কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবেন না তিনি।

    ১৮২৭-এর মে মাসে সংস্কৃত কলেজে একটি ইংরেজি শ্রেণি শুরু হলে, ঈশ্বর সেখানে বছর ইংরেজি শিখেছিলেন। ১৮৩৫ সালে দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা শুরু হওয়ার পরে সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে, তাঁর ইংরেজি শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকে চাকরি পাওয়ার পরে মার্শালের পরামর্শ অনুযায়ী, তিনি মাসিক ১০ টাকা বেতন দিয়ে একজন হিন্দুস্তানি পণ্ডিতের কাছে হিন্দি এবং বন্ধু দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ইংরেজি শিখতে শুরু করেন কিছু দিন পরে, দুর্গাচরণের ছাত্র নীলমাধব মুখোপাধ্যায় তাঁর ইংরেজি শিক্ষার ভার নেন। শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন লিখেছেন

    অনন্তর তৎকালীন হিন্দু-কলেজের ছাত্র, বাবু রাজনারায়ণ গুপ্তকে মাসিক ১৫ টাকা বেতন দিয়া, অগ্রজ মহাশয় প্রত্যহ প্রাতঃকাল হইতে বেলা নয়টা পর্যন্ত ইংরাজী-ভাষা অধ্যয়ন করিতেন। এইরূপে কিছু দিন অতীত হইলে, সিবিলিয়ানগণের পরীক্ষার কাগজ দেখিতে যেরূপ ইংরাজী ভাষা অবগত হওয়া আবশ্যক, সেইরূপ শিক্ষা হইল

    ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে চাকরি করাকালীন নিছক হিন্দি-ইংরেজি শেখার চেয়েও বিদ্যাসাগরের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে যে বিষয়টি সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করে, তা হল কলেজের সাহেব কর্মকর্তা সিভিলিয়ানদের সঙ্গে তাঁর সৌহার্দ্যমুলক সম্পর্ক গড়ে ওঠা

    শম্ভুচন্দ্র জানিয়েছেন:

    ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে কর্ম করিবার সময় সীটিনকার, কষ্ট্‌, চ্যাপ্ম্যান, সিসিল বীডন, গ্রে, গ্রাণ্ড, হেলিডে, লর্ড ব্রাউন, ইডেন প্রভৃতি বহুসংখ্যক সম্ভ্রান্ত সিবিলিয়ানের সহিত অগ্রজের বিশেষরূপে ঘনিষ্ঠতা আত্মীয়তা ছিল সিবিলিয়ানগণ তাঁহাকে বিশেষ সম্মান করিতেন

    শুধু সিভিলিয়ানরাই নন,

    ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সংস্রবে এসে অনেক উচ্চশ্রেণীর ইংরেজ গণ্যমান্য দেশীয় বড়লোকের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের আলাপ-পরিচয় হয়। ক্যাপ্টেন মার্শাল কাউন্সিল-অব-এডুকেশন বা শিক্ষা-পরিষদের সম্পাদক . মোয়াটের সঙ্গে বিদ্যাসাগরকে পরিচিত করিয়ে দেন।

    বস্তুতপক্ষে কলেজে প্রথম দফায় মাত্র সাড়ে চার বছরেরও কম সময় (২৯ ডিসেম্বর ১৮৪১- এপ্রিল ১৮৪৬) কাজ করার সূত্রে বিদ্যাসাগর সাহেবদের এতটাই কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন যে, বিস্তর লোককে তিনি চাকরি করে দেন। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রথমে তিনি সহপাঠী পরম বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পণ্ডিতের শূন্য পদে নিযুক্ত করে দেন। এর কিছু দিন পরে, কলকাতা মাদ্রাসায় পণ্ডিতের শূন্য পদে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে নিযুক্ত করেন তাঁর আরেক সহপাঠী মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশকে

    ১৮৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে, সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের প্রথম শ্রেণির পণ্ডিত হরনাথ তর্কভূষণ স্বাস্থ্যভঙ্গের কারণে পদত্যাগ করেন। প্রায় একই সময়ে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণির পণ্ডিত গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মারা যান। ওই শূন্য পদ দুটিতে দুজন যোগ্য পণ্ডিত মনোনীত করে দেওয়ার জন্য, শিক্ষা সংসদ (১৮৪২ সালে General Committee of Public Instruction- পরিবর্তে, বিভাগটির নাম হয় Council of Education)-এর সেক্রেটারি মোয়াট সাহেব (F.J. Mouat) মার্শালকে অনুরোধ করেন। মার্শাল হরনাথ তর্কভূষণের শূন্য পদে বিদ্যাসাগরকে যোগ দিতে বলেন যদিও তিনি সেই প্রস্তাব গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করে মার্শালকে বলেন

    মহাশয়! আমি টাকার প্রত্যাশা করি না, আপনার অনুগ্রহ থাকিলেই আমি কৃতার্থ হইব আর আপনার নিকট থাকিলে, আমি অনেক নূতন নূতন উপদেশ পাইব আমি দুইটী উপযুক্ত শিক্ষক মনোনীত করিয়া আপনাকে দিব [নজরটান সংযোজিত]

    এই পদের যোগ্যতম প্রার্থী হিসেবে তিনি (তারানাথের সম্মতি ব্যতিরেকেই) তারানাথের নাম প্রস্তাব করেন অবশেষে বিদ্যাসাগরের পরিবর্তে, কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন তারানাথ তর্কবাচস্পতি। আপাতদৃষ্টিতে এই সমস্ত নিয়োগই বিদ্যাসাগরের মানসিক ঔদার্যের পরিচায়ক। কিন্তু আমরা ক্রমশ দেখতে থাকব, এর পরে দুটো বিষয় একই সঙ্গে ঘটবে। প্রথমত, শম্ভুচন্দ্র-কথিতকৌশল অনুরোধকরে যাঁদের বিভিন্ন চাকরিতে নিযুক্ত করবেন বিদ্যাসাগর, তাঁদের আজীবন অসীম আনুগত্য দাবি করবেন তিনি দ্বিতীয়ত, মার্শাল মোয়াটের অনুগ্রহ, তাঁকে তাঁর জীবনের অনেক কাজে অনাবশ্যক সহায়তা প্রদান করবে।

    যাই হোক, আমরা আপাতত বিদ্যাসাগরের চাকরির বিষয়ে আলোচনাকে স্থির রাখি ১৮৪৬- ২৬ মার্চ সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কারের মৃত্যু হলে, সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে চেয়ে বিদ্যাসাগর ২৮ মার্চ কলেজের সম্পাদক রসময় দত্তের কাছে আবেদন জানান তাঁর আবেদনপত্রের সঙ্গে ছিল, তাঁর সুখ্যাতি করে মার্শালের ওই দিনেরই একটি সার্টিফিকেট এই পদটির মাসিক বেতন ছিল ৫০ টাকা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেরেস্তাদারের পদেও বিদ্যাসাগর তখন সেই একই বেতন পেতেন সুতরাং তাঁর দরখাস্তে, তিনি বেতন বৃদ্ধির বিষয়টির উল্লেখ করেন রসময় দত্ত বিদ্যাসাগরের চাকরির বিষয়ে সম্মতি জানিয়ে ২৮ মার্চই শিক্ষা সংসদের সম্পাদক মোয়াটকে চিঠি লেখেন। অর্থাৎ একই দিনে বিদ্যাসাগরের দরখাস্ত পেশ, মার্শালের প্রশংসাপত্র প্রদান এবং রসময় দত্তের সম্মতিসূচক চিঠির ত্র্যহস্পর্শ যোগ! দরখাস্ত করার মাত্র চার দিন পরে, এপ্রিল সংসদ বিদ্যাসাগরের নিয়োগ মঞ্জুর করে যদিও মোয়াট ওই দিনই বিদ্যাসাগরকে জানিয়ে দেন, তাঁরা সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকরূপে বিদ্যাসাগরের নিয়োগ মঞ্জুর করেছেন, কিন্তু তাঁর বেতন বৃদ্ধি করা আপাতত সম্ভব না হলেও, পরে সে সম্ভাবনা আছে

                কিন্তু এখানেই তাঁর চাকরিজনিত নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটেনি! বিদ্যাসাগর মাসিক ৫০ টাকা বেতনে সহকারী সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন বটে, কিন্তু একই সঙ্গে মাসে আরও কিছু অতিরিক্ত টাকা আয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন। এখানেও তাঁর ত্রাতা মধুসূদন হন সেই মার্শাল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে তাঁর শূন্য পদে, বিদ্যাসাগর তাঁর ভাই দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে নিযুক্ত করার জন্য মার্শালকে অনুরোধ করেন। বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর অনুরোধ মঞ্জুর করে দীনবন্ধু ন্যায়রত্নকে এপ্রিল নিযুক্ত করে মার্শাল সরকারের সচিব হ্যালিডে (F.J. Halliday) সাহেবকে লেখেন:

    … the Council of Education has been pleased to appoint the Serishtadar of the Bengallee Department of this Institution, Iswar Chunder Bidyasagar to be the Assistant Secretary of the Government Sanscrit College. I have allowed him to join his new situation and have selected Dinobundhoo Nayaratna a person who was educated at the Sanscrit College, and obtained great distinction there, to officiate as Serishtadar of the Bengallee Department. I beg to request that this arrangement may be confirmed by the permanent appointment of the latter to fill the vacancy from this date.

    গোটা বিষয়টি সম্পন্ন হয় ঝড়ের গতিতে। অবশেষে ১৮৪৬ সালের এপ্রিল বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন          

    এই সময়ে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মারা গেলে, সম্পাদক রসময় দত্ত ওই শূন্য পদে বিদ্যাসাগরকে নিয়োগ করার কথা ভাবেন কিন্তু কোনও বিশেষ কারণে বিদ্যাসাগর সেই পদগ্রহণে অসম্মত হন এবং তাঁর পরিবর্তে মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করার অনুরোধ করেন স্বয়ং বিদ্যাসাগরের বয়ানেওবিশেষকারণটির উল্লেখ পাওয়া যায় না বিষয়ে তিনি লিখেছেন

    ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, পূজ্যপাদ জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয়ের লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয় সংস্কৃত কালেজের সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয় আমায় পদে নিযুক্ত করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন আমি, বিশিষ্ট হেতুবশতঃ, অধ্যাপকের পদগ্রহণে অসম্মত হইয়া, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ অনুরোধ করি তদনুসারে মদনমোহন তর্কালঙ্কার পদে নিযুক্ত হয়েন

    যদিও শেষ অবধি তাঁরঅধ্যাপকের পদগ্রহণে অসম্মতহওয়ার প্রকৃত কারণটি গোপন থাকবে না।

    মার্শালের সঙ্গে সংস্কৃত কলেজের পঠনপ্রণালীর উন্নয়ন সম্পর্কিত আলোচনা করে, সহকারী সম্পাদকরূপে বিদ্যাসাগর এক শিক্ষা পরিকল্পনা রচনা করেন। যদিও বিষয়ে মার্শাল তাঁকে কোনও পরামর্শ দিয়েছিলেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। তাঁর পরিকল্পনায় বিদ্যাসাগর যে মূল বিষয়গুলি আলোচনা করেন, সেগুলি সংক্ষেপে এই) ব্যাকরণের পাঠ্যক্রম পাঠ্যপ্রণালীর পরিবর্তন প্রয়োজন, ) বর্তমানে স্মৃতিশাস্ত্রের আগে ন্যায়শাস্ত্র পড়ানোর যে রীতি আছে, তার পরিবর্তে আগে স্মৃতি পড়ানো দরকার ) ইংরেজি বিভাগের পাঠ্যসূচী পাঠ্যপ্রণালীর আমূল সংস্কার জরুরি তবে পরিকল্পনাটির উপসংহারে বিদ্যাসাগর যা লেখেন, তাতে মার্শালের যে আনন্দিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কারণ, পরিকল্পনাটি শেষে তিনি লেখেন:

    .. such a training is likely to produce men who will be highly useful in the work of imbuing our Vernacular dialects with the science and civilization of the Western world.

    যেন একেবারে হুবহু মেকলের প্রতিধ্বনি

    To that class we may leave it to refine the vernacular dialects of the country, to enrich those dialects with terms of science borrowed from the Western nomenclature ….

    পরে অনেকবার তাঁর গলায় শোনা যাবে মেকলের স্বর, এমনকি সুরও।

    রসময় দত্তের কাছে বিদ্যাসাগর পরিকল্পনাটি পেশ করেন ১৮৪৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। যদিও তাঁর অনুরোধ সত্ত্বেও সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি না পাঠিয়ে, রসময় দত্ত তার সামান্য অংশ খণ্ডিত আকারে শিক্ষা সংসদে পাঠান পরিশেষে বিদ্যাসাগর ১৮৪৭- এপ্রিল, সরাসরি শিক্ষা সংসদের সম্পাদকের কাছে তাঁর ইস্তফাপত্র দাখিল করেন। তাঁর ইস্তফা গৃহীত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে কলেজের ১৩ জন অধ্যাপক, ১০ এপ্রিল রসময় দত্তের কাছে লিখিত আবেদন করেন তবে সেই আবেদনে লাভ হয়নি বরং কলেজের সম্পাদকের কাছে ইস্তফাপত্র জমা না দিয়ে সরাসরি শিক্ষা সংসদের সম্পাদককে দেওয়ার পদ্ধতিগত ত্রুটির উল্লেখ করে, ১৪ এপ্রিল শিক্ষা সংসদ জানায়,

    Ordered: that the assistant Secretary to the Sanscrit College be directed to forward his [Vidyasagar’s] application through the regular channel….

    অবশেষে ২০ এপ্রিল যথাবিহিত উপায়ে বিদ্যাসাগর ফের ইস্তফার আবেদন জানালে, তা ১৮৪৭-এর ১৬ জুলাই গৃহীত হয়

    বিদ্যাসাগরের শিক্ষা পরিকল্পনাটি মার্শাল শুধু যে দেখেছিলেন তাই নয়, এমনকি মন্তব্যও করেছিলেন

    The Assistant Secretary consulted me some time ago on a plan of study which he had prepared at a great sacrifice of time and labour. The suggestions therein contained appealed to me highly judicious, and the scheme altogether seemed well adopted to produce order, to save time, and to secure to each subject of study the degree of attention which it deserves: as such I would beg strongly to recommend the Council to give it a trial. If I am not much mistaken, the result would prove highly satisfactory.১০

    যদিও সংস্কৃত শিক্ষার পঠনপ্রণালী সম্পর্কে মার্শালের প্রশ্নাতীত জ্ঞান দক্ষতা ছিল, তা অবিশ্বাস্য কষ্টকল্পনা মাত্র! বিদ্যাসাগর তাঁর পরিকল্পনা পেশ করার প্রায় সাড়ে মাস পরে ইস্তফাপত্র দাখিল করেন। এই দীর্ঘ সময়ে মার্শাল কেন তাঁর পরিকল্পনাটি সম্পর্কে মোয়াটের সঙ্গে আলোচনা করেননি; সেগুলি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে কেন কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেননি; বিদ্যাসাগরই বা কেন সরাসরি মোয়াটকে বিষয়ে জানাননিসে সব প্রশ্নের উত্তর আজও অজানাতা সত্ত্বেও প্রত্যেক বিদ্যাসাগর-গবেষকই তাঁর পদত্যাগের জন্য, রসময় দত্তকে অকারণে অভিযুক্ত করেছেন ঊর্ধ্বতন ইংরেজ কর্তৃপক্ষের মতামত অগ্রাহ্য করে একজন সামান্য বেতনভুক ভারতীয় কর্মচারী এই কাজ আদৌ করতে পারেন কি না, সে বিষয়ে তাঁরা সম্যক বিবেচনা করার প্রয়োজনও বোধ করেননি। তাহলে যে বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের দায়ভার শাসকদের গ্রহণ করতে হয়!  

    তবে পদত্যাগ করলেও একেবারে বেকার ছিলেন না বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদক থাকাকালীনই বিকল্প উপার্জনের জন্য, তিনি বাল্যবন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশনার ব্যবসায় ব্যাপৃত হন। বিদ্যাসাগর নিজে লিখেছেন:

    যৎকালে আমি মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত ছিলাম; তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে, সংস্কৃতযন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা সংস্থাপিত হয় ছাপাখানায় তিনি আমি, উভয়ে সমাংশভাগী ছিলাম।১১

    সেই সময়ে তাঁদের দুজনেরই যথেষ্ট আর্থিক অসঙ্গতির কারণে, নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের থেকে ৬০০ টাকা ধার নিয়ে তাঁরা সেই প্রেস কেনেন পরে মার্শালের সহযোগিতায় তাঁদের সে ঋণ শোধ হয়। বিদ্যাসাগর-সহোদর শম্ভুচন্দ্র জানাচ্ছেন

    এই সময়ে অগ্রজ, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহিত পরামর্শ করিয়া, সংস্কৃত-যন্ত্র নাম দিয়া একটি মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করেন ৬০০ টাকায় একটি প্রেস্ক্রয় করিতে হইবে; টাকা না থাকাতে তাঁহার পরমবন্ধু বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নিকট টাকা ঋণ করিয়া, তর্কালঙ্কারের হস্তে দিলে, তর্কালঙ্কার প্রেস্ক্রয় করেন টাকা ত্বরায় নীলমাধব মুখোপাধ্যায়কে প্রত্যার্পন করিবার কথা ছিল এক দিবস কথাপ্রসঙ্গে অগ্রজ, মার্শেল সাহেবকে বলেন যে, “আমরা একটি ছাপাখানা করিয়াছি, যদি কিছু ছাপাইবার আবশ্যক হয়, বলিবেনইহা শুনিয়া সাহেব বলিলেন, “বিদ্যার্থী সিবিলিয়ান্গণকে যে ভারতচন্দ্রকৃত অন্নদামঙ্গল পড়াইতে হয়, তাহা অত্যন্ত জঘন্য কাগজে জঘন্য অক্ষরে মুদ্রিত; বিশেষতঃ অনেক বর্ণাশুদ্ধি আছে অতএব যদি কৃষ্ণনগরের রাজবাটী হইতে আদি অন্নদামঙ্গল পুস্তক আনাইয়া শুদ্ধ করিয়া ত্বরায় ছাপাইতে পার, তাহা হইলে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য আমি একশত পুস্তক লইব এবং এক শতের মূল্য ৬০০ টাকা দিব অবশিষ্ট যত পুস্তক বিক্রয় করিবে, তাহাতে তুমি যথেষ্ট লাভ করিতে পারিবে, তাহা হইলে যে টাকা ঋণ করিয়া ছাপাখানা করিয়াছ, তৎসমস্তই পরিশোধ হইবে।সুতরাং কৃষ্ণনগরের রাজবাটী হইতে অন্নদামঙ্গল পুস্তক আনাইয়া, মুদ্রিত প্রকাশিত করেন একশত পুস্তক ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে দিয়া ৬০০ টাকা প্রাপ্ত হন; টাকায় নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের ঋণ পরিশোধ হয় ইহার পর যে সকল সাহিত্য, ন্যায়, দর্শন পুস্তক মুদ্রিত ছিল না, তৎসমস্ত গ্রন্থ ক্রমশঃ মুদ্রিত করিতে লাগিলেন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সংস্কৃত-কলেজের লাইব্রেরীর জন্য যে পরিমাণে নূতন নূতন পুস্তক লইতে লাগিল, তদ্দ্বারা ছাপানর ব্যয় নির্বাহ হইয়াছিল অন্যান্য লোকে যাহা ক্রয় করিতে লাগিলেন, তাহা লাভ হইতে লাগিল টাকায় ক্রমশ ছাপাখানার ইষ্টেট বা কলেবর বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন১২

    ভারতচন্দ্রের আদি অন্নদামঙ্গল কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে আছে এবং প্রচলিত অন্নদামঙ্গল-অনেক বর্ণাশুদ্ধিআছেএতটা নির্ভুল তথ্য একজন ইংরেজ জানবেন, সেটা অবিশ্বাস্য। এই উদ্ধৃতাংশটিতে বাকি সব তথ্য যথাযথ বিবৃত করলেও, এই বিষয়টিতে শম্ভুচন্দ্র সামান্য বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন।

    বস্তুতপক্ষে ১৮৪৭ সালের জুন লিখিত চিঠিতে অন্নদামঙ্গল-এর বিষয়ে মার্শালকে অবহিত করেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তিনি মার্শালকে অনুরোধ করে লেখেন:

    Having fortunately obtained the author’s manuscript and thinking it very desirable that there should be a correct edition of such a valuable production, I have the honour to state, should you be pleased to subscribe for 100 copies of the same that I shall be most happy to undertake to print.১৩ [নজরটান মদনমোহনের]

    তবে মদনমোহনের এই চিঠি থেকে মনে হতে পারে, তিনিই যেন ১০০ কপি কেনার জন্য মার্শালকে প্রস্তাব দিচ্ছেন। কিন্তু সামান্য নোযো সহকারে চিঠিটি পড়লে বোঝা যায়, এই বিষয়ে প্রাথমিক কথাবার্তার সূত্র ধরেই চিঠিটি লেখা। সে কথাবার্তা বিদ্যাসাগরের সঙ্গেই হওয়া স্বাভাবিক। পরিহাসের কথা এই,

    বিদ্যাসাগর যখন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে সিবিলিয়ানদিগকে বাঙ্গালা পড়াইতেন, তখন তাঁহাকেবিদ্যাসুন্দরপড়াইতে হইতবিদ্যাসুন্দরে খেউড় অংশ পড়াইবার সময় তিনি অত্যন্ত লজ্জিত কুণ্ঠিতভাব প্রদর্শন করিতেন...১৪

    সেই একই বিদ্যাসাগরই অন্নদামঙ্গল ছেপে তাঁর প্রকাশনার ব্যবসা শুরু করেন! তবে মার্শালেরকৃপাদৃষ্টিথেকে বঞ্চিত হন না তিনি, বরং আরও ফুলেফেঁপে ওঠে তাঁর প্রকাশনার ব্যবসা; অচিরেই যোগদান করেন পুরনো কর্মক্ষেত্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে

    ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে চাকরি করাকালীন দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (বিদ্যাসাগরের বন্ধু ইংরেজি শিক্ষক এবং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা) অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে, মেডিক্যাল কলেজে লেকচার শুনতে যেতেন। অবশেষে তিনি ডাক্তারি করাই শ্রেয় স্থির করে ১৮৪৯-এর ১৬ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন। তাঁর শূন্য পদে মার্শালের সুপারিশে (২০ ফেব্রুয়ারি) হাজার টাকা জামিন রেখে, মাসিক ৮০ টাকা বেতনে বিদ্যাসাগর মার্চ পুনরায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার কোষাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন তাঁর আর্থিক অবস্থা তখন যথেষ্ট ভালো। মার্শালের অনুরোধে তিনি প্রথমে অনুবাদ করেছেন বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭) এবং পরে বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮); আর কিছু দিন পরে প্রকাশিত হবে জীবনচরিত (১৮৪৯) ছাড়া সংস্কৃত প্রেসের পাশাপাশি ১৮৪৭ সালে খুলেছেন বই বিপণিসংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি’, সেখানে সংস্কৃত প্রেসে ছাপা বই ছাড়াও অন্য প্রকাশকদের বই বিক্রি করে ভালো কমিশন পাওয়া যায় ফলে নতুন চাকরিতে যোগদান করার জন্য হাজার টাকা জামিন রাখার মতো অর্থ, তত দিনে উপার্জন করার মতো অবস্থায় চলে এসেছেন তিনি।

    বিদ্যাসাগরের এই নতুন পদটির সামান্য ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। তিনি যখন এর আগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদান করেন, তখনই প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার কেন্দ্র হিসেবে কলেজের পূর্ব গৌরব আর অবশিষ্ট নেই এর আগে ১৮৩০-এর জুন লর্ড বেন্টিঙ্ক ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সমস্ত অধ্যাপক পদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে এবং পরের বছরে কলেজ কাউন্সিল তুলে দিয়ে কলেজটিকে প্রায় সাইনবোর্ডে পরিণত করেন। বিদ্যাসাগরের আমলে ইংল্যান্ডের হেইলিবারি কলেজ থেকে পাশ করা সাহেব সিভিলিয়ানদের দেশে চাকরির নিয়োগপত্র পাওয়ার আগে, যে কোনও একটি ভারতীয় ভাষা শিখতে হত এঁদেরকে বলা হত কোম্পানিররাইটার’, যে বাড়িতে তাঁরা থাকতেন তার নাম ছিলরাইটার্স বিল্ডিং এখানেই ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সংলগ্ন অফিস ১৮৪৯- কলেজে তখন সাকুল্যে তিন জন লোকসম্পাদক পরীক্ষক মার্শাল, হেড রাইটার ক্যাশিয়ার বিদ্যাসাগর এবং মুহুরি কালিদাস গুপ্ত।১৫ সেভাবে বিচার করলে বিদ্যাসাগর অফিসেরবড়বাবুহিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। তবে এই পদে তিনি থাকবেন ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ মাত্র বছর মাস অচিরেই তাঁর সাহেবসঙ্গ তাঁকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত পদে বসার সুযোগ করে দেবে তত দিনে অবশ্য তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক অবহিত মার্শাল-মোয়াট জুটি, ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে চালু করার বিষয়ে তাঁদের প্রার্থিত ভারতীয় ব্যক্তিটিকে পেয়ে যাবেন!

    ১৮৫০-এর নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপক মদনমোহন তর্কালঙ্কার জজপণ্ডিতের চাকরি নিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যান শিক্ষা সংসদের সম্পাদক মোয়াট, এই শূন্য পদে বিদ্যাসাগরকে নিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নিছক অধ্যাপকের পদগ্রহণে অনিচ্ছুক বিদ্যাসাগর তাঁকে জানান, সংসদ তাঁকে অধ্যক্ষের ক্ষমতা দিলে তিনি ওই পদ গ্রহণ করতে রাজি আছেন। বিষয়ে মোয়াটকে লেখা তাঁর একটি চিঠির ভিত্তিতে ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর, বিদ্যাসাগর মাসিক ৯০ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপকের পদে যোগ দেন আর মার্শালকে অনুরোধ করে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে তাঁর শূন্য পদটিতে, বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাকরি করে দেন

    কলেজে বিদ্যাসাগরের অধ্যাপনার আয়ু ছিল সাকুল্যে ৪৮ দিন! ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে কলেজের সম্পাদক রসময় দত্ত ইস্তফা দেওয়ায়, সাহিত্যের অধ্যাপক ছাড়াও ১৮৫১- জানুয়ারি থেকে বিদ্যাসাগর প্রথমে কলেজের অস্থায়ী সম্পাদক হন ঠিক তার আগের দিন, বিদ্যাসাগরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিমাফিক মোয়াট বাংলা সরকারকে কলেজের সম্পাদক সহকারী সম্পাদকের পদ বিলুপ্ত করার এবং তার পরিবর্তে অধ্যক্ষের নতুন পদ সৃষ্টি করার প্রস্তাব জানিয়ে চিঠি লেখেন চিঠিতে, স্বাভাবিকভাবেই, এই পদের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে তিনি বিদ্যাসাগরের নামোল্লেখ করেন সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক সহকারী সম্পাদকের মাসিক বেতন ছিল যথাক্রমে ১০০ টাকা ৫০ টাকা মোয়াটের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার এই দুটি পদ বিলুপ্ত করে এবং ১৮৫১ সালের ২২ জানুয়ারি বিদ্যাসাগরকে মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদে নিয়োগ করে প্রথমে বিদ্যাসাগর যেমনভাবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেছিলেন, অবিকল তেমনভাবেই দ্বিতীয়বার গোটা বিষয়টি সম্পন্ন হয় ঝড়ের গতিতে।

    বিষয়ে বেতালপঞ্চবিংশতি দশম সংস্করণেরবিজ্ঞাপন’- বিদ্যাসাগর নিজে লিখেছেন

    আমি যে সূত্রে সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাপদে নিযুক্ত হই, তাহার প্রকৃত বৃত্তান্ত এই মদনমোহন তর্কালঙ্কার, জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, মু্রশিদাবাদ প্রস্থান করিলে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয় শিক্ষাসমাজের তৎকালীন সেক্রেটারি, শ্রীযুক্ত ডাক্তর মোয়েট সাহেব, আমায় পদে নিযুক্ত করিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন আমি, নানা কারণ দর্শাইয়া, প্রথমতঃ অস্বীকার করি। পরে, তিনি সবিশেষ যত্ন আগ্রহ প্রকাশ করাতে, আমি কহিয়াছিলাম, যদি শিক্ষাসমাজ আমাকে প্রিন্সিপালের ক্ষমতা দেন, তাহা হইলে আমি এই পদ স্বীকার করিতে পারি তিনি আমার নিকট হইতে মর্মে একখানি পত্র লেখাইয়া লয়েন। তৎপরে ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমি সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকপদে নিযুক্ত হই। আমার এই নিয়োগের কিছু দিন পরে, বাবু রসময় দত্ত মহাশয় সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাপদ পরিত্যাগ করেন। সংস্কৃত কালেজের বর্তমান অবস্থা, উত্তরকালে কিরূপ ব্যবস্থা করিলে, সংস্কৃত কালেজের উন্নতি হইতে পারে, এই দুই বিষয়ে রিপোর্ট করিবার নিমিত্ত, আমার প্রতি আদেশ প্রদত্ত হয়। তদনুসারে আমি রিপোর্ট সমর্পণ করিলে [১৮৫০-এর ১৬ ডিসেম্বর], রিপোর্ট দৃষ্টে সন্তুষ্ট হইয়া, শিক্ষাসমাজ আমাকে সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করেন সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাকার্য, সেক্রেটারি আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি, এই দুই ব্যক্তি দ্বারা নির্বাহিত হইয়া আসিতেছিল; এই দুই পদ রহিত হইয়া, প্রিন্সিপালের পদ নূতন সৃষ্ট হইল। ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে, আমি সংস্কৃত কালেজের প্রিন্সিপাল অর্থাৎ অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হইলাম১৬ [নজরটান সংযোজিত]

    এত দিনে বোঝা যায়, কোনবিশিষ্ট হেতুবশতঃতিনি ১৮৪৬ সালে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার পদগ্রহণে অস্বীকৃত হয়েছিলেন!

    যেমন বোঝা যায়,

    ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যক্ষ জি. টি. লেজার মার্শেল সাহেব, শিক্ষাসমাজের কর্মাধ্যক্ষ ডাক্তার ময়েট্সাহেব, শিক্ষাসমাজের প্রেসিডেন্ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেব, ইহাঁরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন এবং ইহাঁরা তিনজনেই তাঁহার উন্নতি, প্রতিপত্তি মানসম্ভ্রমের আদি কারণ; এই জন্য অগ্রজ, ইঁহাদের প্রতিমূর্তি অঙ্কিত করাইয়া, কলিকাতার বাদুড়বাগানের বাটীতে রাখিয়াছিলেন। তিনি প্রত্যহ উক্ত প্রতিমূর্তিগুলি একবার না দেখিয়া থাকিতে পারিতেন না।১৭

    শম্ভুচন্দ্রের এই উক্তির অমোঘ অর্থও!

    পরবর্তীকালেও মার্শাল-মোয়াট-বেথুন ত্রয়ী, তাঁর জীবনে হয়ে উঠবেন সাক্ষাৎ ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর! আর এঁদের আশীর্বাদপ্রাপ্ত বিদ্যাসাগর অধ্যক্ষরূপে শুরু করবেন সংস্কৃত কলেজেশিক্ষাসংস্কার’-এর কর্মযজ্ঞ

    ************************************************************

    উল্লেখপঞ্জী:

    . শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, কলকাতা, ১৩২১, পৃ. ৫৫

    . তদেব, পৃ. ৬৮

    . ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৩৩৮, পৃ.

    . শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, পৃ. ৬২

    . Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, 2nd Revised Edition, Kolkata, 2013, pp. 13-14

    . নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস;গোপাল হালদার (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৯৭২, পৃ. ৪৫১

    . বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর বাঙালী সমাজ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ১৫৬

    . H. Sharp (ed.), Selections from Educational Records, Part I, 1781-1839, Calcutta, 1920, p. 116

    . ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ১৩১

    ১০. General Report on Public Instruction in the Lower provinces of the Bengal Presidency, for 1846-47, p. 41; উদ্ধৃত ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১২৭

    ১১. নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস;গোপাল হালদার (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৩৯

    ১২. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, পৃ. ৮২-৮৩

    ১৩. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, p. 16

    ১৪. বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৯৫৯, পৃ. ৭১

    ১৫. Sisir Kumar Das, Sahibs and Munshis: An Account of the College of Fort William, New Delhi, 1960, p. 103

    ১৬. বেতালপঞ্চবিংশতি; গোপাল হালদার (সম্পাদিত), বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. -

    ১৭. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, পৃ. ১৪২


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ৩১ অক্টোবর ২০২০ | ৩৩৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • এলেবেলে | ৩১ অক্টোবর ২০২০ ০০:২২99448
  • আজ থেকে কোনও অচেনা নিক অবলম্বনকারী ব্যক্তি লগ ইন করে মন্তব্য না করলে, সেই মন্তব্যকে লেখকের তরফে ইগনোর করা হবে। যদিও চেনা নিকওয়ালা ব্যক্তিরা লগ ইন না করেই মন্তব্য করতে পারেন।

  • সমুদ্র | 2409:4061:2d9d:8b44::60c9:***:*** | ৩১ অক্টোবর ২০২০ ০৭:১০99450
  • শম্ভুচন্দ্র ও ইন্দ্রমিত্র এর বইদুটি প্রাইমারি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে লেখক যে মর্যাদা দিলেন আশা করি সেটি অক্ষুন্ন থাকবে অন্য পর্বের লেখার সময়। 

  • Ramit Chatterjee | ৩১ অক্টোবর ২০২০ ১২:০৪99456
  • খুব সুন্দর তথ্য বহুল লেখা। পড়ে সমৃদ্ধ হলাম।


    দু তিনটি প্রশ্ন আছে। তা তথ্য নিয়ে নয় বরং তার উপস্থাপনা নিয়ে। 


    ১ . বিদ্যাসাগর যদি ছাপার ব্যবসা করেন এবং পরিচিত বিশিষ্ট ব্যক্তি মার্শাল সায়েব এর থেকে অর্ডার পান, বা প্রত্যাশা করেন তাতে খারাপ কি আছে ? যেখানে ওনার থেকে সরকারি কাজের বরাত পাওয়ার সুবর্ন সুযোগ আছে। এটাকে ওনার এন্ত্রপর্নিয়রশিপ হিসেবে দেখা যেতেই পারে। এক বাাংআলীর ব্যবসা যদি ফুলেফেঁপে ওঠে তাতে ক্ষতি কি ? তখন কি কলেজেের টেন্ডারের ব্যবস্থা ছিল ? আমি সেটা সমন্ধে জানি না।


    ২. বিদ্যাসাগরের প্রিন্সিপাল হওয়াটা খারাপ কেন ? উনি হয়তো ভেবেছেন সম্পপদক উপ সম্পাদক নিয়ে কাজ চালানো মুুুশকিল হবে অধ্যক্ষ হয়ে সর্বময় ক্ষমতা পাবেন, মাইনে বেেশি। এই ব্যাপারে প্রবলেম টা কোোথায় ? আরেকটু বিস্ততৃত করলে সুবিিধা হবে বুঝতে।


    আগের পর্ব গুলোয় দারুন ভাবে কিছু ভ্যালিড ক্রিটিসিজম তুলে এনেছিলেন যা বিদ্যাসাগরের বিশ্লেষণে খুব উপযোগী ছিল। এটাতে মনে হল যে উনি এক দক্ষ কর্মী ছিলেন যাঁর ওপর উপরমহলের নেকনজর ছিল। ব্যাস এটুকুই। 


    পরের পর্ব গুলোতে বিদ্যাসাগর এই উপাধিটি আদৌ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, অন্যান্য বিদ্যাসাগরেরা ও রানী রাসমনির সাথে তাঁর সম্পর্ক ও কাজ সমন্ধে একটু আলোকপাত করলে বা ধি ত হব।

  • | ৩১ অক্টোবর ২০২০ ১৭:৩৭99464
  • এই যে মার্শম্যান-মোয়াট-্বেথুনের সাথে সম্পর্কের কথা বলছেন এইটেকে আমরা আজকাল 'নেটওয়ার্কিং' বলি। আমি নেটওয়ার্ক তৈরী করা ও সেটাকে মেন্টেইন করাটা ভাল গুণ হিসেবেই দেখি। আর ব্যবসা করার জন্য নিজস্ব নেটওয়ার্ক কাজে লাগানোও খারাপ কিছু নয়। উচ্চাশী (অ্যাম্বিশাস) হওয়াও বেশ ভাল। 


    মোটকথা এই সবকটাই বিদ্যাসাগরের গুণ হিসেবেই ধরলাম। 

  • aranya | 162.115.***.*** | ০১ নভেম্বর ২০২০ ০৬:৩১99480
  • নেটওয়ার্কিং আমার পছন্দের জিনিস নয়। করতে হয়, নয় পিছিয়ে পড়তে হয়, তাই দুঃখিত চিত্তে  লিঙ্কড ইনে বছর চারেক আগে নামকা ওয়াস্তে একটা প্রোফাইল বানিয়েছিলাম। 


    নেটওয়ার্কিং অপছন্দের কারণ হল চাকরি বা ব্যবসা-র কন্ট্রাক্ট দেওয়া ইঃ ক্ষেত্রে অন্য যোগ্য প্রার্থীদের কাটিয়ে দিয়ে নিজের পরিচিত বা বন্ধুজন-কে টেনে খেলানো বা অনেক সময় প্রার্থী নির্বাচনের স্বীকৃত পদ্ধতিটাকেই এড়িয়ে যাওয়া, যেটা বিদ্যাসাগরের বিবিধ পদে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছুটা হয়েছে , মনে হচ্ছে, এলেবেলের ভাষ্য অনুযায়ী - 'ঝড়ের গতিতে' কাউকে কোন ​​​​​​​পদে ​​​​​​​বসালে ​​​​​​​একটু ​​​​​​​সন্দেহ ​​​​​​​হয়, ​​​​​​​প্রপার প্রসিডিওর ​​​​​​​মানা ​​​​​​​হয়েছে ​​​​​​​কিনা। বিদ্যাসাগরের ​​​​​​​ভাই ​​​​​​​এবং ​​​​​​​বন্ধুদের ​​​​​​​যেভাবে ​​​​​​​বিভিন্ন ​​​​​​​পদে ​​​​​​​বসানো ​​​​​​​হয়েছে, ​​​​​​​নেটওয়ার্ক (মার্শম্যান-্মোয়াট ​​​​​​​ইঃ)- এর ​​​​​​​সুবাদে, ​​​​​​​সেখানে ​​​​​​​অন্য ​​​​​​​যোগ্য ​​​​​​​প্রাথী-দের ​​​​​​​বিবেচনা ​​​​​​​করা ​​​​​​​হয় ​​​​​​​নি, ​​​​​​​এ ​​​​​​​সম্ভাবনা থাকে। 


    এলেবেলে, ভাল লিখছেন । উপভোগ করছি, প্রতিটি পর্ব। 

  • শিবাশীষ বসু | 2409:4054:4:f39a::1731:***:*** | ০১ নভেম্বর ২০২০ ০৬:৪৬99482
  • বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাব্যবস্থাটা ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন তাই সর্বোচ্চ ক্ষমতা দরকার ছিল। ব্যাপারটা এজ সিম্পল এজ দ্যাট। অন্য কারুর আন্ডারে অধ্যাপক থাকলে আবার রসময় দত্ত টাইপের কেস হত। এটা তো না বোঝবার কোনো কারণ দেখছি না।


    তবে লেখার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে "যারে দেখতে নারি তার চলন বেঁকা" এই প্রবাদট‍া লেখক সত্যি প্রমাণ করেই ছাড়বেন।

  • শিবাশীষ বসু | 2409:4054:4:f39a::1731:***:*** | ০১ নভেম্বর ২০২০ ০৭:২৩99483
  • এলেবেলে মহাশয়কে আগের পর্বে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়েছিলাম, তিনি এড়িয়ে গেছেন। অবশ্য তাঁর ব্লগে তিনি তাঁর ন্যারেটিভের পক্ষে অস্বস্তিকর মনে হলে জবাব নাও দিতে পারেন। কাজেই এবার বাধ্য হয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করছি, উত্তর দেওয়া না দেওয়া তাঁর অভিরুচি।


    ১) অ্যাডাম সাহেব তাঁর তৃতীয় রিপোর্টে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম এবং বর্ধমান, এই তিনটি জেলায় ধর্ম ও জাতিগত ভেদে শিক্ষক ও ছাত্রদের সংখ্যার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দিয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, তিনটি জেল‍ার বাংলা পাঠশালায় শিক্ষকদের ৯৮.৩৯% হচ্ছেন হিন্দু, ১.২৫% মুসলমান এবং তথাকথিত নিচু জাতের শিক্ষকের শতাংশ ২.৯৫%। একইভাবে ছাত্রদের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ৯৪.৫৭% হিন্দু ছাত্র, ৫.২৪% মুসলমান ছাত্র এবং মাত্র  ১.৮২% তথাকথিত নিচু জাতের ছাত্র। এর পরেও কি মেনে নিতে হবে বঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা সার্বজনীন ছিল?


    ২) শিবনাথ শাস্ত্রীর বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্গজ পাঠশালার ছাত্রদের কি বিভৎসভাবে ট্রিটমেন্ট করা হত তার ফিরিস্তি দিয়েছিলাম। আপনি কি মনে করেন এটা একটা সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থা ছিল?


    ৩) টোল প্রদত্ত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা মধ্যযুগীয় রক্ষণশীল স্মার্ত পণ্ডিতদের রচনা তখনও ছাত্রদের পাঠ্য। রঘুনন্দন ও কুল্লুকভট্টের ন্যায়, সাংখ্যের গবেষণা যা স্রেফ ব্রাহ্মণ ও কিছু সীমিত শিক্ষার্থীর কাছে অধিগম্য ছিল, তার মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারার কোনও প্রতিফলন ছিল না, তাই-ই দিনের পর দিন পড়ানো হত। যে দেশে একসময় গণিতের ব্যাপক উন্নতি হয়েছিল, সেই দেশেই গণিত শিক্ষা সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আর্যা আর শুভঙ্করীতে। পড়ানো হত একাদশ শতকে ভাস্করাচার্যের রচিত বীজগণিত আর লীলাবতী ! আপনার কি এই সিলেবাস যুগোপযোগী লাগছে?

  • এলেবেলে | 202.142.***.*** | ০১ নভেম্বর ২০২০ ০৭:৩০99485
  • শিবাশীষ বসু, আপনাকে অনুরোধ করছি আপনার শেষ মন্তব্যটি পঞ্চম পর্বে রিপোস্ট করার জন্য। আপনাকে অনুরোধ করছি ইটন এবং ১৮৫১-তে ইংল্যান্ডের স্কুলব্যবস্থা নিয়ে রাখা আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এবং সেটাও পঞ্চম পর্বেই। আপনাকে অনুরোধ করছি 'যারে দেখতে নারি তার চলন ব্যঁকা' বা 'মানসিক বিদ্বেষ থেকে লিখছেন' জাতীয় শব্দ ব্যবহার না করার জন্য। একজন মানুষ অনেক দিন আগে মারা গেছেন, তাঁর প্রতি মানসিক বিদ্বেষ থাকার প্রশ্নটা অত্যন্ত হাস্যকর এবং অপ্রাসঙ্গিক। ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। তাই অন্ধকূপ হত্যা একটি হোক্স বলে প্রমাণিত হয়। আলোচনাকে নৈর্ব্যক্তিক স্তরে রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। 


    সব বিষয়েই আপনাকে অনুরোধ করছি। মানবেন কি না সেটা আপনার ব্যাপার। 

  • শিবাশীষ বসু | 2409:4054:4:f39a::1731:***:*** | ০১ নভেম্বর ২০২০ ১১:০৩99498
  • নিশ্চয়ই মানবো। আমার ঘ‍াড়ে কটা মাথা আছে মশাই ! তবে আমারও ছোট্ট একটা অনুরোধ রইলো, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একাডেমিক বিতর্কটা সুষ্ঠভাবে চালিয়ে যাওয়ার।

  • একলহমা | ০১ নভেম্বর ২০২০ ২২:৫৫99537
  • পড়ে চলেছি এবং আশা রাখছি একাডেমিক বিতর্কে এই সিরিজ-পাঠ আরও মনোগ্রাহী হয়ে উঠবে।

  • জয়র্ষি | ০২ নভেম্বর ২০২০ ০২:০১99544
  • এতদিন তরতর করে এগোচ্ছিলো। এই পর্বে আমার মনে হলো, একটু তাল কাটলো৷ ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর - এই আলোচনা তো হয় না৷ হওয়া তো দরকার। বাঙালি যে ব্যবসাকে কুনজরে দেখে সেটা বরং বন্ধ হলে ভালো। সফল ব্যবসায়ী হওয়া তো ভালো দিক বলবো।


    তবে তার জন্য বাংলা ভাষার কতটা কী সর্বনাশ হয়েছিলো, সেটা আলাদা করে আলোচনার দাবী রাখে। আশা করি লেখক এটা মাথায় রাখবেন।

  • Amit | 121.2.***.*** | ০২ নভেম্বর ২০২০ ০৪:০৮99548
  • এই পর্ব টা পড়ে ওভারঅল ভালো ই লাগলো। বিদ্যাসাগর এর সবকটা দিক নিয়ে আলোচনা হলে ভালোই।  ওনাকে সরগুনসম্পন্ন মহাপুরুষ হিসেবে দেখাটা যেমন অন্ধ ভক্তি র লক্ষণ যেটা অনেক খেত্রেই হয়েছে -যেমন মায়ের ডাকে দামোদর পেরোনো ইত্যাদি বানানো গল্পগাছা। তেমনই আবার চেরি পিক করে করে দোষগুলো হাইলাইট করাটাও বিদ্বেষের লক্ষণ -প্রথমটার  পুরো উল্টো রাস্তায় হাটা।  সমস্ত পয়েন্টস এক জায়গায় রেখে একটা ইনডিফারেন্ট ভিউপয়েন্ট রাখলে মনে হয় লেখাটা প্রকৃত ডকুমেন্ট্ররি হয়ে উঠবে। 


    আমি যদিও বিদ্যাসাগর এর নেটওয়ার্কিং টাকে ওনার সাফল্য হিসেবেই দেখবো। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ওনার যদি মনে হয় যেপথে উনি সমাজে বা এডুকেশন সিস্টেমে যা যা সংস্কার আনতে চান সেক্ষেত্রে ব্রিটিশ দের সহযোগিতা বেশি উপযোগী হবে তাহলে উনি সেই পথে হেঁটেছেন। মানুষ তো আর সুপারম্যান নয় যে একা উড়ে গিয়ে পাহাড় সরিয়ে ফেলবে। এটা পুরোটাই আর্ট অফ বার্গেন এন্ড নেগোশিয়েশন উইথ লটস ওফ ডিফারেন্ট পাওয়ারফুল স্টেকহোল্ডারস । ওনার স্কেল ওফ ওয়ার্কস ছেড়েই দিচ্ছি . এমনকি কলকাতার একটা ছোট্ট  পাড়ায়ও একটা বাস স্ট্যান্ড করতে গেলে  বা একটা মদের দোকান সরাতে গেলেও পাড়ার নেতাকে পাড়ার লোকের সাথে হাজার রকম ভাবে নেগোশিয়েট করতে হয়। কেও সেই নেগোশিয়েট পাড়ার লোকের সাথে করে বা কেউ পাড়ার গুন্ডাদের সাথে। সেক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ দের ওপর মহলের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে নিজের কাজ গুছিয়ে নিয়েছেন  সেই সঙ্গে নিজের টার্গেট সংস্কারের কাজও এগিয়ে নিয়েছেন -এটা তার সাফল্য বলেই মনে করছি। 


    আরো একটা জিনিস মনে হলো , নেপোটিজম বা স্বজনপোষণ বা ফেবারিটিজম - এগুলো ওভাবে সরাসরি প্রমান করা বা এভোয়েড করা মুশকিল। আর যোগ্য ক্যান্ডিডেট দের বাদ দিয়ে তিনি নিজের পছন্দের লোককে নিয়েছেন সেটাও কিন্তু সেভাবে অপরাধ বলে মনে হচ্ছেনা যদিনা সে একেবারে অপদার্থ হয় । প্রথম কথা -যোগ্য ক্যান্ডিডেট মানে কি ? কোনো পরীক্ষায় সে  একটু বেশি নম্বর পেয়েছে -এটাই তো ?  নিজে বহু প্রজেক্টে কাজের সুবাদে দেখেছি , হাই ফ্লায়ার ক্যান্ডিডেট মানেই সে টিমে আদৌ সুইটবলে নাও হতে পারে . ভালো স্টুডেন্ট মানেই ভালো টিচার বা ভালো পারফরমার বাই  ডিফল্ট একেবারেই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই টপ লেভেল স্টুডেন্ট দের দেখেছি বাকিদের সাথে ইগো ক্লাশে জড়াতে ওভার সিলি থিংস , যেখানে পুরো টিমের পারফরমেন্স খারাপ হয়েছে এসব উটকো ঝামেলায়। সেখানে অনেক অভারেজ পারফরমার কিন্তু দারুন টীম স্কিল দেখিয়ে অনেক বেটার রেজাল্ট দিয়েছে। এন্ড ওফ দা ডে টীম পারফরমেন্স ম্যাটার্স . ইন্ডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স নয় যদিনা কেউ একেবারে  নিউটন বা আইনস্টাইন লেভেলের হয়। 


    সেই জন্যেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখেছি টীম লিডার এমন কাউকে রাখতে চায় যারা ভালো নেগোশিয়েটর এন্ড হ্যাভিং গুড পিপল স্কিল। ব্রিলিয়ান্ট কিন্তু ইগোটিস্ট -এমন কাউকে এড়াতে চায়। তারাও যদি টীম সিলেকশন এর স্বাধীনতা পায় তখন তারাও এমন টিম মেম্বারই  চায় , যারা এভারেজ পারফরমার হলেও বেটার একোমোডেটিং এন্ড সাপোর্টিভ অফ টিম ওয়ার্ক । দিনের শেষে অলওয়েজ সেই টিমই  বেটার পারফর্ম করে. অবশ্যই কোথাওই 100-% যে সব ঠিক হয় তানয়। কিন্তু ওটাই অবজেক্টিভ। 


    সেক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর নিজের টিমে যদি সেই অবজেক্টিভ খোঁজেন তাহলে খুব একটা দোষ দিতে পারছিনা। যদি দু একটা ক্ষেত্রে কমপ্লিট অযোগ্য কাউকে বাছেন ভুল করে বা ইচ্ছে করেও  তাহলেও না কারণ এসব ছোটোখাটো ভুল ডিসিশন প্রতিটা প্রজেক্টে হয়ে থাকে। প্রতিটা মানুষ জেনে বা না জেনে বায়াসড ডিসিশন নেয় জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে । 

  • | ০২ নভেম্বর ২০২০ ১৬:৫৩99565
  • এহ অমিতের এই 'টিম প্লেয়ার' হ্যাজটা এখানে খাটে না। 


    ভাল শিক্ষক হবার জন্য ভাল টিম প্লেয়ার হবার দরকার নেই তো। দশকর্মা ভান্ডার টাইপের সব সাবজেক্টের কোচিং সেন্টার চালাবার জন্য টিম-্প্লেয়ার লাগতেও পারে। কিন্তু স্কুল কলেজে বরং দুই একজন এমন শিক্ষকশিক্ষিকা  বরাবর পেয়েছি যাঁদের অন্য কিছু সহ-শিক্ষকরা, ম্যানেজিং কমিটি ইত্যাদি ঘোর অপছন্দ করেন কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা খুব ভালোবাসে। এঁদের সম্পর্কে সাধারণত অভিযোগ থাকে অন্যের সাথে মানিয়ে কাজ করতে না পারার, সেটা খুঁড়লে অনেকসময় বেশ গোলমেলে জিনিষপত্তর বেরোয়। 


    কাজেই বিদ্যাসাগর যদি বেশী নম্বর ইত্যাদি তৎকালীন ঘোষিত বেঞ্চমার্ক (এটার বাংলা কী হবে?)উপেক্ষা করে কম যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নিয়েই থাকেন তো সেটা অন্যায়। 


    দেখা যাক পরের কোনও পর্বেএলেবেলে আরো বিস্তৃত করবেন নিশ্চয়। 

  • রমিত | 202.8.***.*** | ০২ নভেম্বর ২০২০ ১৭:২১99566
  • বেঞ্চমার্ক এর বাংলা মাপকাঠি

  • এলেবেলে | ০২ নভেম্বর ২০২০ ২০:২৩99571
  • লেখাটার ভূমিকাতে আমি একটা কথা বলেছিলামজটিল জ্যামিতিক বিন্যাস। এখন এই জ্যামিতিক বিন্যাসটা একটা অধ্যায়ের লেখা থেকে পুরোটা ধরতে পারা যাবে না (ধরতে দেব- না!) বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন বা যে সময়টুকুর জন্য তাঁর এত খ্যাতি প্রতিপত্তি, সেই সময়টা মোটামুটি ১৮৫১-১৮৫৮। মানে তিনি যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। এই সময়কালে এতগুলো বিষয় আলোচনা করার আছে যে তার সবগুলো প্রথম পর্বে নিয়ে আসা অসম্ভব। লেখকের পক্ষে তো বটেই, পাঠকও সব তালগোল পাকিয়ে ফেলতে পারেন। তাই পরবর্তী পর্বগুলোতে যা যা আলোচনা করা হবে, তার কিছু সূত্র এই পর্বে আলগোছে রেখে চলে যাওয়া। যাতে পরে পাঠক একটা যোগসূত্র খুঁজে নিতে পারেন। এই অধ্যায়ে প্রচুর সেই রকমের সূত্র রেখে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে, যার কিছুটা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করা হবে। কিছুটা পরবর্তী পর্বগুলোতে। সবাইকে এই বিষয়টা মাথায় রাখতে বলব বিনীতভাবে। এবারে উত্তর দেওয়ার পালা।

     

    সমুদ্র, //শম্ভুচন্দ্র ইন্দ্রমিত্র এর বইদুটি প্রাইমারি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে লেখক যে মর্যাদা দিলেন আশা করি সেটি অক্ষুন্ন থাকবে অন্য পর্বের লেখার সময়।//

    এটা তো লেখার একদম শুরুতেই বলে নেওয়া হয়েছে যে শম্ভুচন্দ্র-বিনয়-ইন্দ্রমিত্র গৃহীত, চণ্ডীচরণ-বিহারীলাল-সুবল বর্জিত। কিন্তু আপনি বিনয় ঘোষকে বাদ দিলেন কেন? ‘বিদ্যাসাগরের অসঙ্গতিপর্ব লেখারঅপরাধ’-? চিন্তা নেই, একটা গোটা অধ্যায় জুড়ে বিনয় ঘোষকে নিয়েও চরম খিল্লি করা হবে। তথ্যবিভ্রাট ঘটালে কাউকেই রেয়াত করা হবে না। ইন্দ্রমিত্রকেও না।

     

    রমিত, //বিদ্যাসাগর যদি ছাপার ব্যবসা করেন এবং পরিচিত বিশিষ্ট ব্যক্তি মার্শাল সায়েব এর থেকে অর্ডার পান, বা প্রত্যাশা করেন তাতে খারাপ কি আছে ? ... তখন কি কলেজে টেন্ডারের ব্যবস্থা ছিল ? অধ্যক্ষ হয়ে সর্বময় ক্ষমতা পাবেন ...//

    খারাপ কিছু ছিল কি না, সেটা তৃতীয় পর্বে বিশদে আলোচিত হবে। তবে দেখবেন, এখানেও লেখা হয়েছে যে বিদ্যাসাগর যখন দ্বিতীয়বার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে চাকরিতে ঢুকছেন, তখন কলেজের হাঁড়ির হাল। তাঁকে নিয়ে কলেজে সাকুল্যে তিন জন মানুষ মার্শাল, ক্লার্ক বিদ্যাসাগর আর মুহুরি কালিদাস গুপ্ত। সেখানে মার্শাল কাদের জন্য ১০০ কপি অন্নদামঙ্গল কিনছেন? কোন কম্মে লাগবে সেটা? পড়াবেন কে? কেন কিনছেন তাহলে মার্শাল? আসলে বিদ্যাসাগরের বই কিনছেন না, কিনছেন তাঁর আনুগত্য যেই আনুগত্যকে পরে কাজে লাগাবে ঔপনিবেশিক শাসকরা। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং বিধবাবিবাহ নামক আদ্যন্ত ঔপনিবেশিক অ্যাজেন্ডাটিতে। শিক্ষাক্ষেত্রটি এই পর্বে আলোচিত হবে, তখন দেখে নেবেন।

    একইভাবে বিদ্যাসাগরও আনুগত্য কিনবেন বিভিন্ন জনকে চাকরি করে দিয়ে। এই অনুগতদের নিয়ে তিনিসংস্কার’-এর ঢক্কানিনাদ বাজাবেন। তিনি যত জোরে না বাজাবেন, তার দ্বিগুণ জোরে বাজাবেন তাঁর একান্ত অনুগত ভক্তরা। তাঁর জীবদ্দশাতেও, তাঁর মৃত্যুর ১৩০ বছর পরেও। কেউ আনুগত্য প্রকাশে রাজি না হলে, তাঁকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করবেন প্রকাশ্যে। তার সেরা উদাহরণ তারানাথ তর্কবাচস্পতি। অথচ সংস্কৃত কলেজে চাকরি করার জন্য তারানাথ না করেছিলেন আবেদন, না করেছিলেন উমেদারি এবং বিদ্যাসাগর যত দিন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তত দিন সংস্কৃত কলেজের সেরা সম্পদ তারানাথ ছিলেন প্রায় নিষ্প্রভ। কারণ তাঁকে নিষ্প্রভ করে রাখা হয়েছিল। অথচ এই তারানাথের বাচস্পত্যাভিধান সারা পৃথিবীতে আজও সমাদৃত। বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর যে প্রান্তে সংস্কৃত পড়ানো হয়, সেখানে তারানাথের এই মহাগ্রন্থটি থাকবেই। সেটা দ্বিতীয় পর্বে আস্ত একটা অধ্যায় জুড়ে আসবে।

    //বিদ্যাসাগর এই উপাধিটি আদৌ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছি//

    একটা চমৎকার প্রশ্ন। এবং আমার কাছে পুরো ফুলটস! এইটা নিয়ে বাঙালির চরম আদিখ্যেতা, মিথের বন্যা, মিথ্যেরও। এটা কেবল একটা উপাধি। এর এক ফোঁটা কম- নয়, বেশিও নয়। এর সঙ্গে বিদ্যার কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর আগে কারা পেয়েছেন বলতে পারব না, কিন্তু পরে অনেকেই পেয়েছেন। আসলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন শিক্ষা সমাপ্তির শেষে একটা করে লেজ গজায় বিএসসি, পিএইচডি ইত্যাদি প্রভৃতি, ঠিক তেমনই সংস্কৃত পণ্ডিতদের শিক্ষা শেষে একটি উপাধি দেওয়া হত এবং তাঁরা পিতৃদত্ত পদবির বদলে ওই উপাধিটা ব্যবহার করতেন। যেমন তারানাথ তর্কবাচস্পতি বা মদনমোহন তর্কালঙ্কার, তেমনই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত কলেজের ইতিহাসে এই বিদ্যাসাগর উপাধির সেরা মর্যাদা দিয়েছিলেন তারানাথের পুত্র জীবানন্দ বিদ্যাসাগর। আরেক বিদ্যাসাগর অবশ্য জীবানন্দকেও যাচ্ছেতাই গালাগাল করেছেন! এবং ঈশ্বরচন্দ্র এই উপাধিটা পেয়েছিলেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তার ছবি এখানে চিপকে দেব।

    //রানী রাসমনি// আসবেন না, আসার প্রশ্নই নেই। আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।

     

    -দি, //ব্যবসা করার জন্য নিজস্ব নেটওয়ার্ক কাজে লাগানোও খারাপ কিছু নয়//

    ব্যবসা খারাপ তা কিন্তু বলিনি। কিন্তু একচেটিয়া ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতিকর। সেটা করতে গেলেই নেটওয়ার্ক দরকার হয়, মোদী-আদানির নেটওয়ার্ক। সেটা খারাপ না ভালো?

    আর এন্টারপ্রেনিওরশিপ? তারানাথ বিদ্যাসাগরের দশগুণ ব্যবসা করেছেন। চাকরি পাওয়ার আগে এবং পরে। কোনও নেটওয়ার্কের প্রয়োজন হয়নি। প্রচুর গরিব মানুষ কাজ পেয়েছেন, উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু তার জন্য তারানাথকে শাসকের সঙ্গে দহরম-মহরম করতে হয়নি। বই লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে কলেজে পাঠ্য করেননি।

     

    জয়র্ষি, //এই পর্বে আমার মনে হলো, একটু তাল কাটলো//

    আপনার উত্তর একদম প্রথমে দেওয়া আছে। যদি এবারে তাল কেটেছে বলে মনে হয়, তাহলে পরের পর্বে পুষিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর থাকলাম!

     

    অমিত, //ওনার যদি মনে হয় যেপথে উনি সমাজে বা এডুকেশন সিস্টেমে যা যা সংস্কার আনতে চান... নিজের টার্গেট সংস্কারের কাজও এগিয়ে নিয়েছেন//

    চৈতন্য জীবদ্দশায় কোনও দর্শন প্রচার করেননি, ওসব করেছিল তাঁর ভক্তবৃন্দ। বিদ্যাসাগরও নিজেকে কোনও দিন সংস্কারক বলেননি। সারা জীবনে দুটো কথা বলেছেন ভাই শম্ভুচন্দ্রকে চিঠিতে লিখেছেন যে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন তাঁর জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম আর আদালতে নিজের পরিচয় দিয়েছেন গ্রন্থব্যবসায়ী বলে। তাঁর গায়ে শিক্ষাসংস্কারক-সমাজসংস্কারক-সাহিত্যসংস্কারকের তকমা লাগিয়েছেন তাঁর জীবনীকাররা আর ভক্তরা। এই পর্বে তাঁর শিক্ষাসংস্কার নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করা হবে। তাতে অনেকের অরিনবাবু কথিতআজন্মলালিত কনফার্মেশন বায়াসভেঙে চুরমার হতে পারে।    

    //নেপোটিজম বা স্বজনপোষণ//

    প্রচুর এবং অজস্র। দীনবন্ধু বিদ্যারত্ন এই পর্বে, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন পরের পর্বে, কালিদাস মৈত্র শেষ পর্বে। 

     

    //ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে//

    সে কি মোয়ায়? তো দেখছি ভূতের মুখে রামনাম! এলেবেলে মানসিক বিদ্বেষ থেকে লিখছে, এলেবেলে বাঙ্গালার ইতিহাস যে মার্শম্যানের অনুবাদ সেটাই জানে না, এলেবেলে মূর্খ, এলেবেলে তুহিন মালাকার টুকছে, এলেবেলে সিজোফ্রেনিক এবং সর্বোপরি এলেবেলে হচ্ছে দেবোত্তম ইংরেজির ম্যাস্টর ইত্যাদি প্রভৃতি বলে-টলে পাল্টা তথ্যে ফর্দাফাঁই হয়ে, এখন অ্যাকাডেমিক আলুচানা! সে আলুচানার এমনই মাহাত্ম্য যে সৈকতকে শেষ পর্যন্ত ইন্টারভেন করতে হয়! ট্রোল করতে নিষেধ করা হয়!  

    আপনারা অ্যাকাডেমিক আলোচনা কাকে বলে জানেন? এখনও দেখলাম মুখস্থ উত্তর বমি করেছেনরসময় দত্ত টাইপের কেস হত আর কত দিন এই ভদ্রলোককে ভিলেন বানাবেন? তিনটে যৌক্তিক প্রশ্ন রেখেছি রসময় দত্তকে নিয়ে। তার উত্তর কোথায়? আরেক ভিলেন গর্ডন ইয়ং- তো স্রেফ হাওয়ায় উড়ে যাবেন! দশম অধ্যায়টা নজর রাখবেন, কেমন? ভগোমান আপনাদের মঙ্গল করুন।

  • শাশ্বতী দত্ত রায় | 2409:4060:2e86:211f::27ca:***:*** | ০৫ নভেম্বর ২০২০ ০১:৪১99642
  • এই পর্বটি এখন পর্যন্ত পড়া সবচেয়ে মনোজ্ঞ। চমৎকার খাপে খাপ এগোচ্ছে।

  • Malabika Roy | ০৪ জুলাই ২০২২ ১৩:৪৬509634
  • আমার একটা প্রশ্ন আছে ।যে সব পদে বিদ্যাসাগর নিজের পরিচিত লোক নিযুক্ত করেছিলেন সে পদে অন্য যোগ্য প্রার্থী ছিল কি? যে পদ গুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলি তো আজকের ভাষায় স্পেশালইজেড সে সব পদের জন্য কতজন যোগ্য প্রার্থী ছিলেন ? যদি না থাকেন তবে পরিচিত যোগ্য প্রাথী নেয়াটাই তো স্বাভাবিক .
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন