অষ্টম অধ্যায়
বিদ্যাসাগরের মডেল স্কুল – তোতাকাহিনী-র অনুপ্রেরণা
মালমসলা যাহা জড়ো হইতেছে তাহা প্রচুর তাহার আর সন্দেহ নাই; মানসিক অট্টালিকা নির্মাণের উপযুক্ত এত ইঁট পাটকেল পূর্বে আমাদের আয়ত্তের মধ্যে ছিল না। কিন্তু সংগ্রহ করিতে শিখিলেই যে নির্মাণ করিতে শেখা হইল ধরিয়া লওয়া হয়, সেইটেই একটা মস্ত ভুল। সংগ্রহ এবং নির্মাণ যখন একই সঙ্গে অল্পে অল্পে অগ্রসর হইতে থাকে তখনই কাজটা পাকা রকমের হয়।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষার হেরফের
বিদ্যাসাগর য্ত দিন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষপদে আসীন ছিলেন, তত দিন তিনি খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও সম্মানের শীর্ষবিন্দুতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর এই তুঙ্গ কর্মব্যস্ততার সময়েই বাংলার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পর্ব শুরু হয়। বাংলার অন্যতম শিক্ষাব্রতী হিসেবে তাঁর ওপর সরকারের তরফে অর্পিত হয়, তার সুষ্ঠু রূপায়ণের গুরুদায়িত্ব। সরাসরি সেই বিষয়ে আলোচনা শুরু করার আগে আমরা দেখে নিতে চাই, ঠিক কী কারণে তিনি এই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পরে আমরা দেখব, তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কতটা সফল হয়েছিলেন তিনি।
এ দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমশ অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে থাকে, সরকারি শিক্ষার আঙিনা থেকে সম্পূর্ণ ব্রাত্য হয়ে পাঠশালার পড়ুয়ারা ক্রমেই প্রান্তিক হতে শুরু করে। ইংরেজি শিক্ষা চালু হওয়ার পরে, প্রধানত চাকরি পাওয়ার সুবিধার্থে বিত্তবান মানুষেরা সেই শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরে। শিবনাথ শাস্ত্রী জানিয়েছেন –
একদিকে ফোর্ট উইলিয়ম কালেজের সাহায্যে পরোক্ষভাবে দেশে বাঙ্গালা ভাষার চর্চা চলিতে লাগিল এবং সেই সঙ্গে বাঙ্গালা শিক্ষার জন্য পাঠশালা স্থাপিত হইতে লাগিল, অপরদিকে কলিকাতা সহরের সম্ভ্রান্ত গৃহস্থদিগের মধ্যে নিজ সন্তানদিগকে ইংরাজী শিক্ষা দিবার প্রবৃত্তি প্রবল হইতে লাগিল।১
পাশাপাশি, একই সময়ে মাতৃভাষার চর্চা ক্রমশ অবহেলিত হতে থাকে। বিশেষত হিন্দু কলেজের ছাত্রদের বাংলা পড়ানোর পদ্ধতি, অভিভাবকদের শঙ্কিত করে তোলে।
হিন্দু কলেজের ছাত্র রাজনারায়ণ বসু পরবর্তীকালে এ বিষয়ে লিখেছেন,
আমরা যখন কালেজে পড়িতাম, তখন বাঙ্গালা পড়ার প্রতি কাহারো মনোযোগ ছিল না। যিনি আমাদের পণ্ডিত ছিলেন, তাঁহার সঙ্গে আমরা কেবল গল্প করে সময় কাটিয়ে দিতাম। সুতরাং যখন আমরা কালেজ থেকে বেরুলেম, তখন আমাদের বাঙ্গালা ভাষায় কিছু ব্যুৎপত্তি জন্মে নাই। সে সময়কার ছাত্রদিগের পক্ষে বাঙ্গালা ভাষা অতি ভীষণ পদার্থ ছিল।২
১৮৪৩-এ ইয়ং বেঙ্গলের মুখপত্র বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয় —
আমরা খেদপূর্বক প্রকাশ করিতেছি যে উক্ত বিদ্যালয়ের সিনিয়র ডিপার্টমেন্টের পণ্ডিত মহাশয়েরা এপর্যন্ত তত্রস্থ ছাত্রগণের বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষার বিষয়ে মনোযোগ করেন নাই, ঐ ডিপার্টমেন্টে নিম্ন চারি শ্রেণীতে কেবল গৌড়ীয় ব্যাকরণের পাঠ ও অনুবাদ করণ দ্বারা বাঙ্গালা শিক্ষা হয়; ...আমরা আরও জানিতে প্রার্থনা করি যে এতদ্দেশীয়ভাষার পুস্তক সংগ্রহার্থে যে সাবকমিটী নিযুক্ত হইয়াছিলেন তাঁহারা এতাবৎ কাল পর্যন্ত কি করিলেন? এবং এক্ষণে এতদ্দেশে কৌন্সেল আব এডুকেসনের অধীনে যে সকল পাঠশালা আছে তাহাতে গৌড়ীয় ভাষা শিক্ষাদানের বিষয়ে কৌন্সেলেরই বা মত কি?৩
মাতৃভাষার এই অবহেলার প্রতি ইংরেজি শিক্ষার প্রবল সমর্থক ইয়ং বেঙ্গলদের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়টি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের জন্য, বড়লাট হার্ডিঞ্জ (কার্যকাল: জুলাই ১৮৪৪-জানুয়ারি ১৮৪৮) ১৮৪৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নানা জায়গায় মাসিক ১৮৬৫ টাকা ব্যয়ে ১০১টি পাঠশালা স্থাপন করেন। তার আগে ওই বছরের ১০ অক্টোবর তিনি ঘোষণা করেন যে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। একদিকে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ইংরেজিকে অগ্রাধিকারের ঘোষণা, অন্যদিকে এই পাঠশালাগুলির জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক প্রভৃতির অভাব – এই যুগ্ম কারণে হার্ডিঞ্জের পাঠশালাগুলি মাত্র চার বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।
তারপরে সরকারি তরফে মাতৃভাষা শিক্ষায় আর কোনও উন্নতির চেষ্টা চোখে না পড়ায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা লেখে –
গবর্ণমেন্ট হইতে এ পর্যন্ত বাঙ্গলা ভাষা শিক্ষার কোন উপায় হইল না। সংবাদপত্র-সম্পাদকেরা যত চীৎকার করুন, আর অন্য ব্যক্তিই বা ইহার কর্তব্যতা পক্ষে যত যুক্তি প্রদান করুন, কিছুতেই তাঁহারা সচেতন হয়েন না। তাঁহারা বধির হইয়া রহিয়াছেন। এক্ষণে হিন্দুকালেজে বাঙ্গলা শিক্ষার নিয়ম আছে বটে কিন্তু সে নামমাত্র নিয়ম। তথায় পাঠ্যের শৃঙ্খলা নাই, উপযুক্ত শিক্ষক নাই, পাঠ্য গ্রন্থও নাই এবং কেহ তদ্বিষয়ে তত্ত্বাবধারণও করে না। বাঙ্গলা শিক্ষা করা আর না করা একপ্রকার ছাত্রদিগেরই স্বেচ্ছাধীন। তাহারা পণ্ডিতদিগকে গ্রাহ্যই করে না; সুতরাং এ বিষয়ে অবহেলা করিলে তাহারদিগকে শাসন করিবারও লোক নাই। ইহাতে তাহারদের যে প্রকার ব্যুৎপত্তির সম্ভাবনা, তাহা প্রত্যক্ষই হইতেছে। হিন্দু-কালেজ-সংক্রান্ত বাঙ্গলা পাঠশালাতে যে প্রকার অধ্যয়নের রীতি আছে, তাহাও অতি যৎসামান্য।৪
পরের বছরে একজন পত্রলেখক সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লেখেন —
এতদ্দেশস্থ মনুষ্যগণের স্বদেশীয় বিদ্যানুশীলনে অনাদর ও অমনোযোগ, অনুরাগ ও অশ্রদ্ধা সংপূর্ণরূপে জন্মিয়াছে, যেহেতু বঙ্গভাষাতে প্রচুর অর্থোপার্জন হয় না, কিন্তু ইংলণ্ডীয় ভাষাতে সুশিক্ষিত হইলেই অনায়াসে যথেষ্ট ধনার্জন করিবার ক্ষমতা হইতে পারে, তজ্জন্য এতদ্দেশীয় মনুষ্যেরা স্ব স্ব তনয়বৃন্দকে শৈশবকালাবধি অর্থলোভে লুব্ধ হইয়া অত্যন্তিক যত্নপূর্বক ইংরাজী পাঠশালাতে বিদ্যাভ্যাসার্থে প্রেরণ করেন, ইংলণ্ডীয় বিদ্যাতে সুপণ্ডিত হইলে এইক্ষণে যাবতীয় রাজকীয় কর্ম করিতে ক্ষমতাপন্ন হওয়া যায়, ও উচ্চপদ প্রাপ্ত দ্বারা সর্বসাধারণের সমীপে অত্যন্ত মর্যাদা ও সম্মান ও প্রশংসা লাভ করা যায়... অতএব তন্নিমিত্তে অস্মদ্দেশীয় মানব মণ্ডলী ইংরাজী বিদ্যোন্নতি করিতে আসক্ত হয়েন।৫
তদানীন্তন সময়ে মাতৃভাষার প্রতি অভিভাবকদের এহেন অবহেলার যথাযথ কারণ নির্দেশ করার বিষয়টি যথেষ্ট প্রশংসাজনক।
এর কয়েক বছর আগে, ১৮৪০-এর ২৯ এপ্রিল সরকারি আদেশক্রমে বেনারস, দিল্লি ও আগ্রার উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি সমেত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যসমূহের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, বাংলা সরকারের বদলে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরিত হয়। অ্যাডাম-প্রদর্শিত পথে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে, ১৮৪৬ সালের ১৮ নভেম্বর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গভর্নর টোমাসন (J. Thomason)-এর তরফে সচিব থর্নটন (J. Thornton) নতুন ধরনের স্কুল চালু করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন।৬ টোমাসন প্রস্তাবিত বিদ্যালয় ব্যবস্থাটি এই – প্রত্যেক তহশিলে একটি করে মডেল স্কুল স্থাপন করা হবে। চারিদিকে সব দেশি পাঠশালার আদর্শ হবে এই মডেল স্কুল। পাঠশালার শিক্ষকরা তার মাধ্যমে পড়ানোর উন্নত শিক্ষাপ্রণালী গ্রহণ করবেন। প্রত্যেক জেলায় এইসব স্কুল পরিদর্শনের জন্য একজন জেলা পরিদর্শক এবং দুটি তহশিল পিছু একজন পরগণা পরিদর্শক (Deputy Inspector) থাকবেন। তাঁদের কাজ হবে স্কুলের শিক্ষাপ্রণালী, পাঠ্যপুস্তক, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি তদারক করা। তাঁদের তত্ত্বাবধান করবেন একজন প্রধান পরিদর্শক। হিন্দি ও উর্দু হবে শিক্ষার বাহন।
এই নতুন ধরনের বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের বিষয়ে বলা হয়:
The course of instruction in this school will consist of reading and writing the vernacular languages, both Oordoo and Hindee, Accounts and the Mensuration of land according to the native system. To these will be added such instruction in Geography, History, Geometry, or other general subject, conveyed through the medium of the vernacular language, as the people may be willing to receive.৭
বিদ্যালয়গুলির খরচের বিষয়ে জানানো হয় — জেলা পিছু জেলা পরিদর্শকের জন্য ১৫০ টাকা, ৩ জন পরগণা পরিদর্শকের জন্য ৯০ টাকা ও ৬ জন শিক্ষকের জন্য ৯০ টাকা হিসেবে মোট মাসিক খরচ হবে মাত্র ৩৩০ টাকা এবং বার্ষিক পুরস্কারের জন্য ৫৪০ টাকা বরাদ্দ করে মোট বার্ষিক খরচ হবে ৪,৫০০ টাকা।৮ অতঃপর পরীক্ষামূলকভাবে ১৮৫২-৫৩ সালে বেরিলি, শাহজাহানপুর, আগ্রা, মথুরা, মৈনপুরী, আলিগড়, ফারুকাবাদ ও এটাওয়া – আটটি জেলায় এই শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। টোমাসন প্রবর্তিত এই নতুন ধরণের স্কুলগুলির নাম দেওয়া হয় ‘হলকাবন্দি বিদ্যালয়’।
টোমাসনের স্কুলগুলি পরিদর্শন করে, ১৮৫৩-র ৪ জুন শিক্ষা সংসদের সম্পাদক ড. মোয়াট রিপোর্ট জমা দেন। তত দিনে স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যা ৩১,৮৪৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৬,৮৮৪।৯ রুরকির নিকটবর্তী এক হলকাবন্দি বিদ্যালয় সম্পর্কে মোয়াট তাঁর রিপোর্টে লেখেন –
The pupils exhibited in examination a fair elementary knowledge of Arithmetic, and Geography; were able to trace the course of rivers on maps, and to indicate the most important towns situated on them. Some of them demonstrated with quickness and correctly, problems from the portions of Euclid read by them, and most of them read with ease simple prose compositions in Urdu and Hindee. They also write tolerably well and quickly. The attendance seemed on the whole to be good and the School to be popular as well as useful.১০
বাংলা ও বিহারে এই শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন করার সওয়াল করে প্রতিবেদনের উপসংহারে তিনি জানান:
I am convinced that the scheme above referred to is not only the best adopted to leaven the ignorance of the agricultural population of the North-Western Provinces, but is also the plan best suited for the Vernacular Education of the mass of the people of Bengal and Behar.১১ [নজরটান সংযোজিত]
যদিও আমরা দেখতে পাব বাংলার ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে।
এ দেশে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নতির বিষয়ে অ্যাডাম স্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করে লিখেছিলেন,
... I propose to qualify a body of vernacular teachers, to raise their character and provide for their support, and to give a gradual, a permanent, and a general establishment to a system of common schools.১২
কিন্তু তদানীন্তন কর্তৃপক্ষ অ্যাডামের পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেনি। এতদিন অ্যাডামের যে প্রতিবেদনগুলি বাংলায় অবহেলিত, অপাঙ্ক্তেয় অবস্থায় ছিল; সুদূর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাঁরই অনুসৃত পথে টোমাসনের পরিকল্পনার অপ্রত্যাশিত সাফল্যের কারণে, বাংলার শিক্ষামহল অবশেষে অ্যাডামকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
মোয়াটের রিপোর্ট পাওয়ার পরে, বড়লাট লর্ড ডালহৌসি (কার্যকাল: জানুয়ারি ১৮৪৮-ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬) ১৮৫৩ সালের ২৫ অক্টোবর কোর্ট অফ ডিরেক্টরদের জানান, বাংলা ও বিহারেও টোমাসনের শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তন করা উচিত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফে এ বিষয়ে কোনও আদেশ আসার আগেই, ৪ নভেম্বর তিনি বাংলা সরকারকে এই বিষয়ে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করার অনুরোধ জানান। বড়লাটের নির্দেশানুযায়ী বাংলা সরকার ১৯ নভেম্বর শিক্ষা সংসদকে মাতৃভাষা (vernacular) শিক্ষা সম্পর্কে ‘based on the information contained in Mr. Reid’s printed Reports, and in those of Mr. Adam’১৩ একটি পরিকল্পনা রচনা করার নির্দেশ দেয়। ১৮৫৪-র ৯ সেপ্টেম্বর, সংসদ সম্পাদক এই বিষয়ক সমস্ত সদস্যের প্রস্তাবগুলি সরকারকে পাঠিয়ে দেন। এর কিছু দিন আগে, ১৮৫৩ সালে কোম্পানির সনদ নবীকরণ হয়। ওই সনদ অনুযায়ী ঠিক হয়, বাংলা হবে ভারতের প্রদেশ ও তার শাসনভার থাকবে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর (চলতি কথায় ছোটলাট)-এর হাতে। সেই অনুযায়ী ১৮৫৪-র ১ মে বাংলার প্রথম ছোটলাট হন হ্যালিডে (F.J. Halliday)।
মূলত হ্যালিডের উৎসাহে, ১৮৫৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগর মাতৃভাষা শিক্ষা বিষয়ে ১৯টি অনুচ্ছেদ সংবলিত একটি শিক্ষা পরিকল্পনা রচনা করেন। ওই পরিকল্পনায় তিনি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন – মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে লিখন-পঠন-সরল অঙ্ক ছাড়াও ভূগোল, ইতিহাস, জীবনচরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞান।১৪ অ্যাডামসন ইটনের মতো নামকরা স্কুলের চিত্র জানিয়ে বলেছিলেন:
… teaching consisted of writing and arithmetic…; while those in the fifth form also learnt ancient Geography, or Algebra.
আর যারা সেখানে বেশ কিছুদিন পড়ার সুযোগ পেত, তারা এর বাইরে অতিরিক্ত শিখত ‘part of Euclid’। তবে ‘not till 1851 that Mathematics became a part of the regular school work’।১৫ সেখানে ১৮৫৪-তে বিদ্যাসাগর বাংলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে চান ভারতবর্ষ, গ্রিস, রোম ও ইংল্যান্ডের ইতিহাস!
না, এত অল্পতে তাঁর মনে ভরেনি! ওই পরিকল্পনার একাদশ অনুচ্ছেদে তিনি লেখেন, যাতায়াতের ব্যয়সমেত মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে দুজন বাঙালি পরিদর্শক – একজন মেদিনীপুর ও হুগলির জন্য এবং অন্যজন নদীয়া ও বর্ধমানের জন্য – রাখা প্রয়োজন। দ্বাদশ অনুচ্ছেদে তিনি জানান, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ এই মডেল স্কুলগুলির প্রধান তত্ত্বাবধায়ক (Ex-officio Head Superintendent) মনোনীত হবেন। তবে তার জন্য তাঁকে কোনও আলাদা পারিশ্রমিক দিতে হবে না, কেবল যাতায়াতের খরচ (বছরে ৩০০ টাকার বেশি হবে না) দিলেই চলে যাবে। আর ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদে বিদ্যাসাগর লেখেন – গ্রন্থরচনা, পুস্তক ও শিক্ষক নির্বাচনের ভার প্রধান তত্ত্বাবধায়কের ওপর থাকবে।১৬ [নজরটান সংযোজিত] ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বিদ্যাসাগরের ছাত্র হ্যালিডে ছোটলাট পদে নিযুক্ত হওয়ার আগে, শিক্ষা সংসদের অন্যতম সদস্য হিসেবে ১৮৫৪-র ২৪ মার্চ তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন। এবারে সামান্য সংসদ সদস্য থেকে এক লাফে ছোটলাট হয়ে, হ্যালিডে শুরু করেন তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শনের পালা।
আগেই উল্লিখিত হয়েছে, ১৮৫৪-র ৯ সেপ্টেম্বর সংসদ মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়ে সমস্ত সদস্যের যে প্রস্তাবগুলি সরকারকে পাঠিয়েছিল, সেখানে হ্যালিডের প্রস্তাবটিও ছিল। ছোটলাট হওয়ার পরে, হ্যালিডে বাকি সদস্যদের প্রস্তাব বাতিল করে নিজের প্রস্তাবটিকে সর্বোৎকৃষ্ট বিবেচনা করেন এবং কেবল সেই প্রস্তাবটিই ১৮৫৪ সালের ১৬ নভেম্বর বড়লাটের কাছে পাঠান। এই প্রস্তাবের পঞ্চম ও ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে তিনি লেখেন —
এই বিষয়ে সংস্কৃত কলেজের সুযোগ্য অধ্যক্ষ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অভিমত সংযুক্ত হল। সকলেই জানেন, বাংলা শিক্ষার প্রচারকার্যে বিদ্যাসাগর বহু দিন থেকেই বিশেষ উৎসাহী। সংস্কৃত কলেজে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং বিদ্যালয়ের পাঠোপযোগী অনেক প্রাথমিক পাঠ্যবই রচনা করে তিনি এক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ করেছেন।
অধ্যক্ষের মন্তব্যের অন্তর্গত শিক্ষাপ্রণালী আমি সাধারণভাবে অনুমোদন করি। আমার ইচ্ছা, তাঁর প্রস্তাবিত ব্যবস্থাকেই কাজে পরিণত করা হোক।১৭
বিদ্যাসাগর মডেল স্কুলগুলোর প্রধান তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হবেন, শিক্ষা সংসদের অনেক সদস্যই (রামগোপাল ঘোষ, স্যার জেমস কোলভিল প্রমুখ) এ প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। কিন্তু হ্যালিডে কারও কথায় কান না দিয়ে প্রস্তাবিত স্কুলগুলি স্থাপনের জন্য, বিদ্যাসাগরকেই স্থান নির্বাচনের ভার দেন। সেই অনুযায়ী সংস্কৃত কলেজের গ্রীষ্মাবকাশে বিদ্যাসাগর হুগলি জেলার কিছু গ্রাম পরিদর্শন করে ছোটলাটকে রিপোর্ট দেন ১৮৫৪-র ৩ জুলাই।
এই সময়ে, ১৮৫৪ সালের ১৯ জুলাই ‘বোর্ড অফ কন্ট্রোল’-এর সভাপতি স্যার চার্লস উড ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক সনদটি পাঠান, সেটি ‘উড ডেসপ্যাচ’ নামে পরিচিত। এই ডেসপ্যাচে প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে বলা হয় – ক) শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করতে হবে, খ) সকল ধরণের বিদ্যালয়ের জন্য উপযুক্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং গ) প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পাঠশালা ও অনুরূপ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির দিকে নজর দিতে হবে। উডের ডেসপ্যাচ অনুযায়ী সরকারি শিক্ষাবিভাগে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। কাউন্সিল অফ এডুকেশন উঠে যায়, বদলে নিযুক্ত হন প্রথম জনশিক্ষা অধিকর্তা (Director of Public Instruction) গর্ডন ইয়ং। এই কারণে আবার নতুন করে মডেল স্কুল নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। সরকারি নিয়মে বিদ্যাসাগরকে মাতৃভাষা শিক্ষার তত্ত্বাবধায়কের পদে নিযুক্ত করা সম্ভব নয়, কারণ জনশিক্ষা অধিকর্তা ও তাঁর অধীনস্থ পরিদর্শকদের সেই দায়িত্ব নেওয়ার কথা। তাই ১৮৫৫-র ২৩ মার্চ হ্যালিডের তরফ থেকে ইয়ংকে অন্তত কিছু দিনের জন্য বিদ্যাসাগরকে পরিদর্শনের কাজে নিযুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ জানানো হয়। প্রত্যুত্তরে ইয়ং জানান, স্থায়ী ইনস্পেক্টর প্র্যাট (H. Pratt) দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিদ্যাসাগর অস্থায়ীভাবে ইনস্পেক্টর অফ স্কুলস নিযুক্ত হতে পারেন।
বলা বাহুল্য, এই প্রস্তাব ছোটলাটের পছন্দ হয়নি। ১৮৫৫ সালের ১১ এপ্রিল তিনি লেখেন –
অস্থায়ীভাবে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রকে নিযুক্ত করে কোনও লাভ নেই। ... তিন মাস বা তিন সপ্তাহ পরে ইনস্পেক্টর মি. প্র্যাট যখন আসবেন তখন তাকে বিদায় নিতে হবে, এইরকম কোনও শর্তে তাঁকে নিযুক্ত করলে তিনি কোনও কাজ করতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না।১৮
এর পরে ২০ এপ্রিল সরকারের সচিব জনশিক্ষা অধিকর্তাকে চিঠিতে লেখেন —
... যে কোনও মুহূর্তে বিদায় করে দেওয়া যেতে পারে, ছোটলাট মনে করেন, পণ্ডিতের চরিত্র ও গুণ বিচার করে এমন শর্তে তাঁকে নিয়োগ করা হলে তাঁর প্রতি সরকারের অবিচার হবে।
ছোটলাটের মত এই, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র শর্মাকে এখনই অনুমোদিত ব্যবস্থা অনুসারে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হোক। ...তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে, কলকাতার নিকটবর্তী তিন-চারটি জেলা তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হোক। এতে, অন্তত এই সময়ে, কলেজের কাজে পণ্ডিতের বিশেষ অসুবিধা হবে না। ...সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে বেতন ছাড়া, পণ্ডিত এই কাজের জন্য (যাতায়াতের খরচ বাদে) মাসিক দুশো টাকা ভাতা পাবেন।১৯
হ্যালিডে যখন দক্ষিণবঙ্গে একজন সহকারী স্কুল পরিদর্শক নিয়োগ করার বিষয়ে বিদ্যাসাগরের হয়ে এত চিঠি চালাচালি করছেন, সেই সময়ে জেমস লং দেশজ শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতিকে ভিত্তি করেই এগোতে চেয়েছিলেন।
বড়লাটকে পাঠানো হ্যালিডের মিনিট থেকে জানা যায়, ১৮৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষা শিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে লং তাঁর পরিকল্পনা নোটের আকারে পেশ করেছিলেন। তিনি প্রধানত কম দামে ভালো পাঠ্যপুস্তকের প্রচলন এবং পাঠশালার গুরুমশাইদের স্থানীয়ভাবে নিজেদের উপযুক্ত হতে সাহায্য করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর পাঠ্যক্রমের প্রাথমিক ভিত্তি ছিল লেখা, পড়া, অঙ্ক, ভূগোল ও সাধারণ জ্ঞান। এমনকি বড়লাটের কাছে হ্যালিডে যেমন বিদ্যাসাগরের শিক্ষা পরিকল্পনাটি সংযুক্ত করে দিয়েছিলেন, তেমনই লঙের পরিকল্পনাটিও যুক্ত করে মন্তব্য করেছিলেন,
Mr. Long teaches, or proposes to teach, in his Schools, History, Biography and Geography, with especial reference to Bengal and India; Arithmetic, Writing by dictation, Natural History, Grammar and Etymology. He makes use of the indigenous Schools as a foundation to work upon, and he aims at their improvement. He asks for a Grant of Rupees 25 a month, and thinks that this would enable him to double the number of his Schools. He has at present three.২০
তবুও লং নন, মুরুব্বির জোরে এবং হ্যালিডের নির্দেশে বিদ্যাসাগরই ১৮৫৫ সালের ১ মে এই পদে নিযুক্ত হন। অথচ মাতৃভাষা শিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না। শুধু তাই নয়, তখনও অবধি খাস ইংল্যান্ডে অপ্রচলিত এবং এখনও পর্যন্ত স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রাথমিক স্তরে অপ্রচলিত বিষয়বস্তু ছিল তাঁর পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, এই বিষয়ে প্রচলন করতে চাওয়া এক বিশাল পাঠ্যপুস্তকের তালিকাও।
সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ৩০০ টাকা মাসিক বেতন ছাড়াও এই কাজের জন্য অতিরিক্ত মাসিক ২০০ টাকা বেতন পেতে শুরু করেন তিনি। উপরন্তু দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয়সমূহের সহকারী ইন্সপেক্টর হয়ে বিদ্যাসাগর যে চারজন সাব-ইন্সপেক্টর বেছে নেন, তার মধ্যে নির্বাচিত হন তাঁর আপন সহোদর দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন (বাকি তিনজন – হরিনাথ বন্দোপাধ্যায়, মাধবচন্দ্র গোস্বামী ও তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য)। এঁদের প্রত্যেককে পথখরচ ব্যতীত মাসিক ১০০ টাকা বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এহ বাহ্য, ১৮৫৪-র ৭ ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগর যে শিক্ষা পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন, সেখানে নিজের যাতায়াতের খরচ ছাড়া কোনও আলাদা পারিশ্রমিকের উল্লেখ করেননি। একই পরিকল্পনায় চারটি জেলার জন্য তিনি মাত্র দুজন পরিদর্শকের কথা বলেছিলেন। অথচ কার্যক্ষেত্রে তিনি অতিরিক্ত বেতন প্রত্যাখ্যান করেননি, উপরন্তু পরিদর্শক বাবদ অতিরিক্ত ১০০ টাকা ব্যয়বরাদ্দের বিষয়েও কোনও আপত্তি জানাননি। শুধু তাই নয়; সহকারী পরিদর্শক হিসেবে পাঠ্যপুস্তক রচনা, পুস্তক ও শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি পান অবাধ একচ্ছত্র ক্ষমতাও!
দায়িত্ব পেয়ে কাজ শুরু করেন বিদ্যাসাগর। প্রথমে মডেল স্কুল স্থাপনের উপযুক্ত অঞ্চল নির্বাচনের জন্য, তিনি সাব-ইন্সপেক্টরদের মফস্সলে পাঠান এবং স্কুলগুলিতে শিক্ষক নির্বাচনের জন্য মে মাসেই সংস্কৃত কলেজে একটি পরীক্ষা নেওয়ার নোটিশ দেন। ১৮৫৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালান্টাইনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে শিক্ষা সংসদের সম্পাদককে বিদ্যাসাগর রীতিমতো আশ্বাসের সুরে জানিয়েছিলেন –
পরিশেষে আমি সবিনয়ে জানাতে চাই, যদি আমাকে আমার নিজস্ব পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়, তবে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সংসদকে নিশ্চিত করতে পারি যে সংস্কৃত কলেজ যেমন বিশুদ্ধ ও অসামান্য সংস্কৃত শিক্ষার আদর্শ প্রতিষ্ঠান হবে, তেমনই একই সঙ্গে উন্নত দেশীয় সাহিত্যচর্চারও প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠবে। এখান থেকে এমন একদল ভবিষ্যতের শিক্ষক তৈরি হবে, যাঁরা দেশের জনসাধারণের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারের পথ সুগম করবেন।২১ [নজরটান সংযোজিত]
সেই অনুযায়ী তিনি কলেজে প্রচুর সরকারি অর্থব্যয়ে ইংরেজি বিভাগ চালু করেছিলেন। তা সত্ত্বেও, শিক্ষক নির্বাচনের পরীক্ষায় ২০০ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ৯২ জন উত্তীর্ণ হন। এমনকি যাঁরা উত্তীর্ণ হন, তাঁদের একজনও মডেল স্কুলে শিক্ষকতা করার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেননি।২২ সংস্কৃত কলেজের পরীক্ষার্থীরা যদি সামান্য প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করার যোগ্য না হতে পারেন, তাহলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বিদ্যাসাগরের ব্যর্থতা।
১৮৫৪-র ২৪ মার্চ শিক্ষা সংসদের অন্যতম সদস্য হিসেবে হ্যালিডে যে শিক্ষা পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন, সেখানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল স্থাপনের বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। বরং এ বিষয়ে পরিকল্পনাটির ২৮ সংখ্যক অনুচ্ছেদে তিনি জানিয়েছিলেন, সংস্কৃত কলেজের শিক্ষার ফলে এখন যথেষ্ট সংখ্যক ভালো শিক্ষক গড়ে উঠেছে এবং বর্তমান অধ্যক্ষের তত্ত্বাবধানে বাংলায় সংস্কৃত কলেজই নর্মাল স্কুলের স্থান অধিকার করেছে।২৩ বিদ্যাসাগরও তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনার ১৪ সংখ্যক অনুচ্ছেদে জানিয়েছিলেন, সংস্কৃত কলেজ সাধারণ উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হয়েও মাতৃভাষার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল হিসেবে কাজ করবে।২৪ অথচ এখন উপযুক্ত শিক্ষক গড়ে তোলার জন্য নর্মাল স্কুলের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ফলে বাড়ে এ বাবদ আরও এক দফা খরচ ।
১৮৫৫ সালের ২ জুলাই বিদ্যাসাগর অধিকর্তা গর্ডন ইয়ংকে নর্মাল স্কুল স্থাপনের ব্যাপারে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি জানান যে, সরকার মাসিক ৫০০ টাকা খরচ করতে রাজি হলে ৬ মাস অন্তর ৬০ জন উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যেতে পারে।২৫ মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে ইয়ং তাঁর প্রস্তাব অনুমোদন করেন। অবশেষে ১৭ জুলাই বিদ্যাসাগরের তত্ত্বাবধানে ৭১ জন ছাত্র নিয়ে প্রথম নর্মাল স্কুল খোলা হয়। অবশ্য নর্মাল স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগর তাঁর ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতা আরও একবার প্রকট করেন। নর্মাল স্কুল সংক্রান্ত রিপোর্টের ৫ সংখ্যক অনুচ্ছেদে তিনি ইয়ংকে জানান, ‘Those of the lower castes are excluded for the present’।২৬ বিদ্যাসাগরের প্রস্তাব অনুযায়ী নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন অক্ষয়কুমার দত্ত ও দ্বিতীয় শিক্ষক হন পণ্ডিত মধুসূদন বাচস্পতি। পরিশেষে সরকারি ব্যয়ে ১৮৫৫-র ২২ অগস্ট থেকে ১৮৫৬-র ১৪ জানুয়ারির মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় পাঁচটি করে মোট ২০টি মডেল স্কুল স্থাপিত হয়। বিদ্যালয় পিছু সরকারের খরচ হত মাসে ৫০ টাকা। বিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণের ব্যয় বহন করতেন গ্রামবাসীরাই।
এই কাজের জন্য সরকারি অনুদান হিসেবে লং মাত্র ৭৫ টাকা চেয়েছিলেন, তার অনেক গুণ বেশি খরচ করেও সরকারি ২০টি মডেল স্কুলে মোট ছাত্রসংখ্যা সাকুল্যে ৩ হাজারও হয়নি।২৭ টোমাসনের হলকাবন্দি বিদ্যালয়ে যেখানে এক বছরের মধ্যেই ছাত্রসংখ্যা ৩১,৮৪৩ থেকে বেড়ে হয় ৩৬,৮৮৪ জন, সেখানে বাংলার মডেল স্কুলগুলিতে তার এক-দশমাংশ ছাত্র ভর্তি হলেও বিদ্যাসাগরের ক্ষমতা বিন্দুমাত্র খর্ব হয়নি। কোনও সরকারি বিজ্ঞাপন না দিয়েই তিনি মডেল স্কুলের সাব-ইনস্পেক্টর, নর্মাল স্কুলের শিক্ষক এবং মডেল স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ করতে থাকেন। আর নিজেই মডেল স্কুল ও নর্মাল স্কুলের পাঠ্যক্রম তৈরি করে আরও পুষ্ট করতে থাকেন তাঁর গ্রন্থপ্রকাশের ব্যবসাকে।
১৮৫৬-৫৭ সালে বিদ্যাসাগরের একটি রিপোর্ট থেকে মডেল স্কুলের পাঠ্যসূচী সম্পর্কে জানা যায় যে, ওই স্কুলগুলিতে ছাত্রদের পড়তে হত বিদ্যাসাগরের নিজের লেখা ৭টি ও সংস্কৃত যন্ত্রে ছাপা ৬টি বই — বর্ণপরিচয়, ঋজুপাঠ, কথামালা, নীতিসার, বোধোদয়, পশ্বাবলী, চরিতাবলী, নীতিবোধ, ভূগোল বিবরণ, বাঙ্গালার ইতিহাস, পাটিগণিত, চারুপাঠ এবং জীবনচরিত।২৮ এখানেই শেষ নয়। ১৮৫৫ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর পেশ করা নর্মাল স্কুল সম্পর্কিত রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, নর্মাল স্কুলের পাঠ্যসূচিতে আছে — বোধোদয়, নীতিবোধ, শকুন্তলা, কাদম্বরী, চারুপাঠ এবং বাহ্যবস্তু। আর নর্মাল স্কুলে প্রবেশিকা পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের জন্য তিনি নির্দিষ্ট করেন — নীতিবোধ, শকুন্তলা, বেতালপঞ্চবিংশতি ও সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা।২৯ অর্থাৎ শুধু মডেল স্কুল চালু হওয়ার ফলে, বিদ্যাসাগর তাঁর সর্বমোট ১৮টি বইকে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করার পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করে ফেলেন!
মডেল স্কুল শুরু হওয়ার তিন বছর পরে, বিদ্যাসাগর স্কুলগুলি সম্পর্কে ১৮৫৭-৫৮ সালের একটি রিপোর্টে বলেন —
প্রায় তিন বছর মডেল স্কুলগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে স্কুলগুলির সন্তোষজনক উন্নতি হয়েছে। ছাত্ররা সমস্ত বাংলা পাঠ্যপুস্তক পাঠ করেছে। বাংলা ভাষায় তাদের যথেষ্ট দখল আছে, প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়েও তারা জ্ঞানলাভ করেছে।
আমরা এই কাজ আরম্ভ করার সময়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, মফস্সলের লোকেরা মডেল স্কুলের মর্ম বুঝতে পারবে না। কিন্তু বিদ্যালয়গুলির সাফল্য সেই সন্দেহ দূর করেছে। যে সব গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই সব গ্রামের ও তার আশপাশের গ্রামবাসীরা স্কুলগুলিকে আশীর্বাদ বলে মনে করেন এবং তার জন্য তাঁরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। স্কুলগুলির যে যথেষ্ট সমাদর হয়েছে, ছাত্রসংখ্যা দেখলে তা পরিষ্কার বোঝা যায়।৩০
যদিও পরবর্তীকালে মডেল স্কুল সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের এই দরাজ প্রশস্তিমূলক প্রতিবেদন প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বিদ্যালয়গুলির ব্যয়বাহুল্যের তুলনায় গুণমান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ১৮৬২-র ২৫ জুন ইনস্পেক্টর উড্রো অধিকর্তা ইয়ংকে চিঠিতে জানান,
The cost of Government of each pupil in aided English Schools is not quite 8 annas a head, and in aided Vernacular Schools 4 annas and 4 pies. The rate at the Hardinge Vernacular Schools is a trifle more than four annas. There is not such a difference between the Model Vernacular Schools established by Pundit Eshwar Chundra Vidyasagar, and the Hardinge and aided Vernacular Schools, as to warrant the remarkable fact that the former are 21/2 times more expensive than the latter.৩১
বহু ব্যয়ে এই ধরণের বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মানোন্নয়ন। বলা বাহুল্য, সেই বিষয়েও মডেল স্কুলগুলি ব্যর্থ হয়। শিক্ষাসম্পর্কীয় সরকারি প্রতিবেদনেই লেখা হয়:
The efforts to improve the indigenous Village Schools of the country had failed; and the few Schools established by Government as models, though affording a good vernacular education to a limited number of pupils of a higher social grade, seemed to have no effect whatever in raising the level of the indigenous Schools below them.৩২ [নজরটান সংযোজিত]
মডেল স্কুলের ক্ষেত্রে, বিদ্যাসাগর অ্যাডামের পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বিবেচনাও করেননি। এমনকি বড়লাটের তরফে নির্দিষ্টভাবে অ্যাডাম-নির্দেশিত পথে মাতৃভাষা শিক্ষার প্রচলনের কথা বলা হলেও বিদ্যাসাগর নিজের মতো গোটা পরিকল্পনাটিকে সাজান।
মডেল স্কুলগুলির বিষয়ে নিজের চাহিদা অনুযায়ী সরকারি তরফে সমস্ত কিছু পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। পেয়েছিলেন না চাইতেই মাসিক ২০০ টাকা অতিরিক্ত ভাতাও। বিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচন থেকে শিক্ষক নির্বাচন, পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে তাঁরই সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল। তবুও চার জন জেলা পরিদর্শকের এই বিষয়ক কাজকর্মের কোনও হদিশই পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র ভর্তির নিরিখে এবং দেশজ পাঠশালাগুলির উন্নয়নের বিষয়ে, এক বিরাট ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এই গোটা প্রকল্পটি।
************************************************************
উল্লেখপঞ্জী:
১. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, ২০১৯, পৃ. ৫০
২. রাজনারায়ণ বসু, সে কাল আর এ কাল, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৪৯
৩. ‘হিন্দুকালেজে বাঙ্গালা শিক্ষা’, বেঙ্গল স্পেক্টেটর, ২ খণ্ড ২৫ সংখ্যা, ১ আগষ্ট ১৮৪৩; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র ১৮৪০-১৯০৫, তৃতীয় খণ্ড, কলকাতা, ১৯৬০, পৃ. ২০৬-০৭
৪. ‘স্বদেশীয় ভাষায় বিদ্যাভ্যাস’, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বৈশাখ ১৭৭১ শক, ৬৯ সংখ্যা; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, পঞ্চম খণ্ড, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ২৬
৫. সংবাদ প্রভাকর, ৭ ভাদ্র ১২৫৭; বিনয় ঘোষ (সম্পাদিত), সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ৪২-৪৩
৬. J.A. Richey (ed.), Selections from Educational Records, Part II, 1840-1859, Calcutta, 1922, p. 241
৭. তদেব, পৃ. ২৫০
৮. তদেব, পৃ. ২৪৪
৯. Selections from the Records of the Bengal Government, No. XXII; Correspondence Relating to Vernacular Education in the Lower Provinces of Bengal, Calcutta, 1855, p. 3
১০. J.A. Richey (ed.), Selections from Educational Records, Part II, 1840-1859, p. 259
১১. তদেব, পৃ. ২৬২
১২. Anathnath Basu (ed.), Reports on the State of Education in Bengal (1835 & 1838) by William Adam, Calcutta, 1941, p. 401
১৩. Correspondence Relating to Vernacular Education in the Lower Provinces of Bengal, p. 32
১৪. তদেব, পৃ. ৭১
১৫. J.W. Adamson, A Short History of Education, Cambridge, 1919, p. 226; উদ্ধৃত Dharampal, The Beautiful Tree: Indigenous Indian Education in the Eighteenth Century, Goa, 2000, pp. 10-11
১৬. Correspondence Relating to Vernacular Education in the Lower Provinces of Bengal, p. 73
১৭. তদেব, পৃ. ৬৬
১৮. ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ১৭৪
১৯. তদেব, পৃ. ১৭৪-৭৫
২০. Correspondence Relating to Vernacular Education in the Lower Provinces of Bengal, p. 73
২১. In conclusion I beg most respectfully to state that if I may be so fortunate as to be permitted to carry out the system introduced, I can assure the Council with great confidence that the Sanscrit College will become a seat of pure and profound Sanscrit learning and at the same time a nursery of improved vernacular literature, and of teachers thoroughly qualified to disseminate that literature amongst the masses of their fellow countrymen.
বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, কলকাতা, ২০১১, পৃ. ৫৩০
২২. Selections from the Records of the Bengal Government, No. XXII; Report of the Director of Public Instruction in the Lower Provinces, for the 1st Quarter of 1855-56, p.196
২৩. Correspondence Relating to Vernacular Education in the Lower Provinces of Bengal, p. 71
২৪. তদেব, পৃ. ৭৩
২৫. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ২০৮
২৬. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, 2nd Revised Edition, Kolkata, 2013, p. 43
২৭. Report of the Director of Public Instruction in the Lower Provinces, p.192
২৮. Pundit Eshwur Chunder Surma’s Report for the Quarter ending January 1857; General Report on Public Instruction in the Lower Provinces of the Bengal Presidency, for 1856-57, pp. 71-72
২৯. Arabinda Guha (ed.), Unpublished Letters of Vidyasagar, pp. 43-44
৩০. It is now about three years since our operations commenced and the Model Vernacular Schools have been established. During this short period, the progress of these institutions has really been very satisfactory. The pupils have gone through all the vernacular books suited to such institutions and may be said to have acquired a thorough knowledge of the language and to have made respectable progress in several branches of useful studies.
At the commencement of our operations, doubts were entertained in several quarters as to whether the Model Schools could be duly appreciated by the people in the interior. These doubts, I am happy to state, have long since been fully removed by the almost complete success of those institutions. The people of the villages in which they are located, as well as those of contiguous places who are also benefited by them, look upon the schools as great blessings and feel grateful to Government for them. That the institutions are highly prized is evident from the number of pupils attending each of them. তদেব, পৃ. ৫২
৩১. তদেব, পৃ. ৮১
৩২. A.M. Monteath, Selections from Educational Records of the Government of India, Volume 1, Educational Reports, 1859 -71, Delhi, 1960, p. 125
বিদ্যাবণিক বিদ্যাসাগরের গ্রন্থব্যবসার প্রসঙ্গটি এই অধ্যায়ে সামান্য আলোচিত হয়েছে। এই বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা রমিত এবং দ-দি অধ্যায়টি পড়ে দেখতে পারেন।
বিদ্যাসাগর নিজের প্রস্তাবেই লিখেছেন দেখলাম, পরিদর্শকের রাহাখরচ বছরে ৩০০ টাকা হওয়া উচিৎ। পরে তিনি নিজেই মাসিক ২০০ টাকা (বছরে ২৪০০) রাহাখরচ নিচ্ছেন!!
জেমস লঙ এর প্রস্তাবিত মডেল মোটামুটি তিন ভাগের একভাগেরও কম খরচ (যা দেখা যাচ্ছে) তবুও তিনি একটা সুযোগও পেলেন না!
এতটা প্রতিপত্তি সত্যি ভাবা যাচ্ছে না
হ্যাঁ পড়ে ফেলব। আগের পর্বটাও মন দিয়ে পড়া হয় নি আমার। ওটা পড়ে এটায়।,এই ছুটিতে বসে সব ব্যাকলগ ক্লিয়ার করে ফেলব।
এই পর্বটা পড়ে ভালো লাগলো। অনেক তথ্য পড়ে সম্মৃদ্ধ হলুম। তবে শেষ পারায় মডেল স্কুল গুলোর প্রকল্প র ব্যর্থতা কে ঠিক সরাসরি ওনার ব্যর্থতা বলা যাবেকি ? অনেক এক্সপেরিমেন্ট ই তো শেষ অবধি ব্যর্থ হয়। কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট করাটাও জরুরি নাহলে এগোনোই যাবেনা। ইভেন এখনো বহু দেশ এ মিডিয়াম অফ এডুকেশন নিয়ে বিতর্ক চলছেই ।
রৌহিন, ভাতা মাসিক ২০০ টাকা। আর রাহাখরচ বছরে ৩০০ টাকার বেশি নয়। বিদ্যাসাগর প্রথমটা দাবি করেননি, কিন্তু দেওয়া হলে তা প্রত্যাখ্যানও করেননি। প্লাস স্বজনপোষণ করেছেন। মডেল স্কুলের ক্ষেত্রে তাঁর ভাই দীনবন্ধু সম্পর্কে একটি শব্দও কোথাও লিখিত হয়নি।
প্রতিপত্তি এমনি এমনি হয় না। দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে কেস থাকে। বিদ্যাসাগর প্রথমে ঔপনিবেশিক শিক্ষার উপযোগী একাধিক গ্রন্থ অনুবাদ করে সেগুলিকে শাসকের বদান্যতায় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তৃতীয় পর্বে তা বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে। সেখানে তাঁর মৌলিক গ্রন্থ বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগও আলোচিত হবে।
আর বিধবাবিবাহ নামক আদ্যন্ত ঔপনিবেশিক অ্যাজেন্ডাকে কীভাবে শাসকের নির্দেশ মেনে লিপিবদ্ধ করেন, সেটি দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হবে। প্রসঙ্গত এই বিষয়টি আজ অবধি কেউ আলোচনা করেননি।
অমিত, মডেল স্কুলের ব্যর্থতার পুরো দায়ভারটিই বিদ্যাসাগরের ওপর বর্তাবে। তিনি একা মডেল স্কুল ও নর্মাল স্কুলের পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করেছেন, কোথায় কোথায় স্কুল স্থাপন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, শিক্ষক নির্বাচন করেছেন, পাঠ্যপুস্তক প্রচলন করেছেন এবং পুরোদস্তুর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। এত কিছুর পরেও ২০টি মডেল স্কুলে ছাত্রসংখ্যা ৩ হাজার পার হয়নি। অথচ খরচ হয়েছে বিস্তর টাকা। সেসব সরকারি প্রতিবেদনেই আছে। তিনি যদি মডেল স্কুলের বিষয়ে সফল হতেন, সেক্ষেত্রেও তার যাবতীয় কৃতিত্ব তাঁর একার হত।